... তবু সিংহের ফোলা কেশরের উদ্দাম আনন্দ অনুভব করছ রক্তে! এবার ফিরবার পালা, ওই শোন হুইটম্যানের ডাক। তুমি কি পৃথিবীর সব কবির মত রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে অনুভব করতে ব্যর্থ হয়েছ অসীম শুন্যতা? এখনও দরিয়ায় বাঁধা পড়ে আছ তুমি? হাসি পায়। আমাদের হাসি পায়। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অন্ধকার রঙমহলে ছবি দেখছি। যুদ্ধের ছবি আমাদের বড় ক্লান্ত করে। হত্যা, ধর্ষণ, হত্যা, ধর্ষণ, হত্যা, ধর্ষণ... আমাদের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে।
না, জানালা বন্ধ করো না। বন্ধ জানালাগুলি খুলে দাও। সব, সমস্ত জানালা, পৃথিবীর সমস্ত বন্ধ জানালা টান মেরে খুলে ফেল। দেখি নিউক্লিয়ার শীতের গোধূলি নামার আর কত বাকি।
না, জানালা বন্ধ রেখ না। খুলে দাও। খোলা জানালার হু হু হাওয়া শীতল করে দিক আমাদের যন্ত্রণা। দম আটকে আসছে। মেট্রো রেলে টাওয়ার হিল থেকে মনুমেন্ট যাচ্ছি। হাতে সকালে মেট্রো। বড় বড় অক্ষরে লেখা স্টপ দিজ ম্যাডনেস! ম্যাডনেসের এদিক সেদিক শিশুদের লাশের স্তূপ। কীসের উন্মাদনা? আমাদের বুকের ঠিক মাঝ বরাবর তাক করা আছে অদৃশ্য বন্দুকের নল। হাত দিয়ে দেখ, মনে হবে মরা সাপের শরীরের মত শীতল এই নল। খুব শান্ত। শুধু শক্ত হাতে একবার শুধু একবার ট্রিগার দিপে দাও কিংবা আরও কোথাও আরেকবার হিরোশিমা-নাগাসাকি। বাহ! আহা, দেখ, আমরা একটুতেই খুশি। একটুতেই আনন্দ। একটা মাত্র গুলি চাই আমাদের। আর কিছু না, অথবা, যদি পার আমাদের পৃথিবীর নিচে একটা মাত্র বাউন্সিং মাইন বসিয়ে দাও হে সমর প্রযুক্তিবিদ... আবার, আবার সেই চাপা গোঙানিঃ হরিদাশ, হরিদাশরে...
এভাবে আর কতদিন। এখনও সব ঘাতকের বিচার হয় নি।
এখনও সব বধ্যভূমি খুঁড়ে করোটির হাড় বের করা হয় নি।
খুলে দাও। জানালাগুলি কখনোই বন্ধ কর না। খোলা জানালার আলো, হে আলো, আমাদের অন্ধ করে দাও। তুমি আসো। মনুমেন্ট পার হয়ে হু হু ঢুকে পড় আমাদের বন্ধ ঘরগুলোয়। তোমার সান্তিয়াগো বুড় হয়ে গেছে হেমিংওয়ে। মানুষের চেয়েও মহৎ এক শয়তান চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসছে। শয়তানটার দুই হাতে পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা। তার হাতের ক্ষমতা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে রক্ত। আমরা তো শান্তিতে ঘুমাতে চেয়েছিলাম। আমরা তো একটু শান্তিতে মরতে চেয়েছিলাম। কারা জানি ফিসফিস করে বলছে। এক বৃদ্ধা শয়তানটার পায়ের কাছে বসে তাকে গান শোনাচ্ছেঃ ওয়ার ইজ ম্যাডনেস, ওয়ার ইজ ম্যাডনেস, ও মাই লর্ড... আলো আসুক। আলোকে আসতে দাও। লেট দেয়ার বি লাইট। লেট দেয়ার বি লাইট। তাতে কী আর আসে যায়? জীবিতরা সব মূক ও বধির।
আজ ভাবলাম মনুমেন্ট হোক কিংবা হ্যাম্পশায়ার হোক, আজ যেখানেই থাকি ওয়াটারলু গিয়ে ট্রেন ধরব। সোজা স্ট্রবেরি হিল। সেখানে এক অদ্ভুত জায়গা আছে। ওয়াটার মিল পার্ক। পার্কের পাশেই লেক। লেকের জলে আকাশের ছায়া। চারপাশে বন। বনের পাশ দিয়ে মোটরওয়ে। লেকের পাশে বসলে মোটরওয়ের গাড়ির শব্দকে মনে হবে জলের শব্দ; কিংবা চলে যাব গ্রিন পার্ক। লন্ডনের পিকাদ্যালি সার্কাসের কাছে। লোকজন সেখানে প্যালেস দেখতে যায়। বাকিংহ্যাম। আমি সেখানে যাব না। আমি যাব থেচারস-এ। গ্রিন পার্ক আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে নেমে একা একটি অপরূপ মেয়ের অপেরা শুনতে শুনতে হেঁটে যেতে সাত থেকে আট মিনিট। থেচারস। একটি বই কিনতে যাব। সেখানে গিয়ে ভুলে যাব বইয়ের নাম, ভুলে যাব লেখকের নাম। আইজাক বাশেভিস সিঙ্গার না গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ না ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা না হোর্হে লুইস বোর্হেস না আমা আতা আইদু? মনে করতে কষ্ট হবে; তবু যাব। দোতলা’য় কামু আর কাফকা আর মুরাকামির ফিকশনগুলোর সামনে দাঁড়ালেই নাম টা মনে পড়বে— দ্য ম্যাজিশিয়ান অভ লুবলিন। আর তখনই বুকটা খচ করে উঠবে। কবে দেখা হবে আমাদের, মৌ? পরিচয়ের ও প্রেমের দুই বছর হয়ে গেছে। একসঙ্গে আমরা অনেকবার কেঁদেছি। একসঙ্গে হেসেও উঠেছি। একবারও দেখা হয় নি! আশ্চর্য না? দুই বছর আগে, সেদিন তোমাকে প্রথম ফোন করেছিলাম, আসলে দিন নয়, রাত দু’টো কি তিনটে বাজে। বাংলাদেশে তখন সকাল নয় টা ছিল?
হ্যাম্পশায়ারে সেদিন তুষার পড়ছিল। সম্ভবত বৃহস্পতিবার। হ্যাঁ। তারপর? বিষাদ, অবসাদ, নিঃসঙ্গতা, শত বছর, হাজার বছরের নিঃসঙ্গতা ঝাপটে ধরছে মানুষকে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পালাবার সবগুলো পথ। ঘর জুড়ে অন্ধকার। অন্ধকার বিপুলা। বিপুল বিষাদ। সলিচিউড। একাকীত্ব, নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা... খোলো, খুলে দাও। বাজুক নির্জন এককের গান। এই গানে ভর করে ভায়োলেট এভিনিউয়ের দিকে, মনুমেন্টের দিকে, বন্ড স্ট্রিটের দিকে ধেয়ে আসুক মত্ত হাওয়া। জানালা খুলে দাও মৌ। তুমি যেদিন মৌলভী বাজার থেকে শমশের নগর আসলে, সেদিন কি দয়ালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল? আমাদের শহরে এই একমাত্র লোক, দয়াল। উচ্চতায় আকাশের সমান। কালো কুচকুচে শরীর। এই লোকটাই আমাদের ছেলেবেলাটাকে গল্প দিয়ে ভরে রেখেছিল। আমাজন বনের বিশাল ডানাওয়ালা প্রজাপতিটার গল্প আমাদেরকে দয়ালই বলেছিল। দয়াল ছাড়াও তার আরও কয়েকটি নাম আছে। একটা নাম যমুনা। যমুনা আমাকে এক রাতে, দুর্গাপূজার সময়, যাত্রা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তার আরেকটি নাম হরেকরাম। হরেকরাম আমাকে একদিন গান শুনিয়েছিল— দমকলেতে বাজে বাঁশি কদম্বতলায়, আনন্দে ময়ূরী হইয়া নাচইন রাধিকায় গো...
ভ্যান গগের পটেটো ইটারস ছবিটা দেখেছ? আমরা একসঙ্গে দেখব মৌ। মৌরে, আমরা দেখব কালিঝুলিমাখা কিছু মানুষ-- পটেটো ইটারস! এইত সেদিন একটা সিনেমা দেখলাম। নাম টা মনে করতে পারছি না। একটা বন্দি মেয়ের শুধু কয়েকটি সংলাপ মনে আছে। মেয়েটা বলছেঃ মুক্তি দেবে না আমায়? বাঁচতে না দাও, অন্তত মুক্তিটুকু দাও। প্রথমে চাই মুক্তি, তারপর শুধু একটা গুলি। একটা তীব্র ঠাস... রাতভর ধর্ষণ করেছ। এবার এক ঝলক আলো দেখতে দাও। আলো ছাড়া আমার এই চোখ দুটি কিছুই যে দেখবে না!
ওই চেরি গাছগুলি ছুঁয়ে মত্ত বাতাস ঢুকে পড়ুক কুঠুরিতে। আমরা ঠিক কীরকম জীবন চাইরে মৌ? তুই জানিস? এই মহাপৃথিবীতে আমরা কী আসলেই কোনও জীবন চাই বল? টাওয়ার হিল থেকে মনুমেন্ট যেতে যেতে আমি ফের সেই সিনেমাটার ভিতর ঢুকে পড়ি। মেয়েটা বলছেঃ ধন্যবাদ বন্ধু, জানালাটা খুলে দিলে, কিন্তু... কিন্তু... এ কী হল, কীসের গন্ধ বাতাসে?
যুদ্ধমাতাল অফিসারের বাজখাই উত্তরঃ এই গন্ধ বসনিয়া ক্যাম্পে আটক যুবকদের পোড়া মাংশের। জ্যান্ত বন্দীদের সামনেই আমরা অন্য বন্দীদের গুলি করে হত্যা করি। তারপর লাশের স্তূপে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিই। মেয়েদের ধর্ষণ করি প্রাণ ভরে। মেয়েরা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তাদের বুকের ওপর বুট চেপে ধরে পেচ্ছাব করে দিই। তাদের বলি, এই পেচ্ছাব গিলে ফেলতে হবে। যুদ্ধ আসলে এমনই। যুদ্ধের অর্থ শুধুই যুদ্ধ। মেগা ডেথ। ম্যাডনেস। কখনই তাই জানালা খুলতে বল না। যুদ্ধের অন্যতম শর্ত বন্ধ জানালা।
তাই, জানালা বন্ধ থাকুক। খোলা জানালার বাতাসে চিৎকার মিশে থাকে। আলোয় মিশে থাকে রক্ত। রক্ত আর চিৎকার যুদ্ধবাজের প্রিয় শব্দ। তালিয়া বাজাও।
কী করা যায়? মনে মনে খেলা দেখা যায়? কে সেই খেলার পুতুল? ভ্লাদিমির পুতিন, নাকি বারাক ওবামা, নাকি নেতানিয়াহু? নাকি শচীন, সেরেনা, উসাইন? খেলা বড় আশ্চর্য হয় এখানে। চার। ছক্কা। হৈ হৈ। সেঞ্চুরি। ডাবল সেঞ্চুরি। উল্লাস। গ্যালারিতে আজ বড় উল্লাস। ব্যাটসম্যানের ব্যাটে আজ ঝড়। শচীনে-সেরেনায়-উসাইনে আজ ঝড়। তীব্র উল্লাসে ফেটে যাচ্ছি আমরা। খেলা। জয়। পরাজয়।
খেলার উল্লাসে চাপা পড়ে যাচ্ছে গণহত্যার কান্না। পৃথিবীর ঘাতকরাও অবাক আমাদের উল্লাসে। এক ভূখণ্ডে মানুষের ব্যাট-বলের কারবারে উল্লাস, অন্য খণ্ডে বিমান থেকে মানুষের জন্য প্লাস্টিকের পা নামছে। তালিয়া বাজাও। তালিয়া বাজাও। তালি... চমৎকার। যুদ্ধে পেতে রাখা মাইনে যাদের পা উড়ে গেছে, শুভ্র আকাশযান তাদের জন্য নকল পা নিয়ে এসেছে। এবার শুরু করো। দৌড়। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে যে আগে যেতে পারবে, সে-ই আজ মালিক বনে যাবে একখানি নকল পায়ের। একশজনের ভিতর মাত্র কয়েকজন শুধু পাবে। নকল পা-ও বেশি নেই। এই দৃশ্য সরাসরি দেখা যাবে বিবিসি, সিএনেনে। চমৎকার। মখমলবাফ তার কান্দাহারে এরকমই দেখিয়েছিলেন। বহু বছর পর, আমাদের যখন দেখা হবে কিংবা যেদিন আমরা আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশনের হলদে আলোর স্রোতে মানুষের ভিড়ে মিশে যাব, সেদিন তোকে বলব এসব।
উত্তেজনা আর সহ্য হচ্ছে না। অবসর চাই। বিজ্ঞাপন বিরতির অবসর। নায়িকার শৈল্পিক শরীর... শরীর। যুদ্ধেও শরীর। নাচেও শরীর। জন্মে, মৃত্যুতে, খেলায়, হত্যায় শুধু শরীর। শরীর এক ভিয়েন। প্রিয় আবুল বাশার লিখেছিলেনঃ কথার ভিয়েনে সাহিত্য, মাটির ভিয়েনে মৃৎপাত্র। এই এক লেখক আমার! আবুল বাশার। বলেছিলেন, আমার ব্যক্তিগত অনিশ্চয়তার জীবনে কী কাজে লাগে ওই ইমরানের শত রান? লিখেছিলেন তার স্মৃতিকথায়, আমি মুখে ক্ষুদার গন্ধ নিয়ে বড় হওয়া লেখক। লিখেছিলেন, জল মাটি আর আগুনের উপাখ্যান!
শরীর কি ভাষার ভিয়েন? শরীর কি মানচিত্র? তোমাকে কী বলব মৌ, তুমি যেদিন শমশেরনগর এলে, সেদিন কি বৃহস্পতিবার ছিল? আমার মনে নেই। শুধু জানি খুব বৃষ্টি পড়ছিল হ্যাম্পশায়ারে। এত বৃষ্টি বহুদিন দেখি নি। দেশ থেকে আসার পর তো মনেই হয় নি বিদেশেও বাংলাদেশের মত বৃষ্টি নামবে। শমশেরনগরে সেদিন রোদ ঝলমল করছিল? স্টেশনে গিয়েছিলে? আমার সবচেয়ে প্রিয় রেলওয়ে স্টেশন এই শমশেরনগর।
দীর্ঘ দিনের চলতে থাকা যুদ্ধও একদিন শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে যারা বেঁচে থাকে আর যারা জন্ম নেয়, তারা শুধুই বেঁচে থাকে আর তারা চেয়ে থাকে চারপাশের ভাঙা কাচের দিকে। ভাঙাকাচ মানে মানুষের ভাঙা বুক। যুদ্ধের ময়দানে তখন ধর্ষিতার মত কাঁদতে থাকে নিকষ অন্ধকার। অন্ধকার আর বিষণ্ণতা, অন্ধকার আর বিষাদ, অন্ধকার আর নৈশব্দ, অন্ধকার আর ভাঙা কাচ।
নিঃসঙ্গতার কামড়ে ক্ষতবিক্ষত জীবন জন্মের যন্ত্রণায় কাৎরাতে কাৎরাতে নো ম্যান্স ল্যান্ডে এসে দাঁড়ায়।
নো ম্যান্স ল্যান্ডে, জীবন ... তার পাশে কিছু শামুক, তার পাশে কিছু পাতা, গন্ধ আর ঘ্রাণ, স্মৃতি আর জীবন; বৃদ্ধা ইভলিন আর তার কুকুর,-- হ্যাম্পশায়ার-- গন্ধ আর ঘ্রাণ, স্মৃতি আর জীবনের। শমসের নগরের সঙ্গে হ্যাম্পশায়ার আজ একাকার।
এই ছিল দশ ঘণ্টা আগের খুব স্বাভাবিক এক জীবন, ঠিক যেন স্টিল লাইফ। এর মাঝে রয়েল মেইল পৌঁছে দিয়েছে বেকেটের জার্মান ডাইরি'জ ১৯৩৬-১৯৩৭। ধূসর মলাটের ওপর সবুজরঙে লেখা স্যামুয়েল বেকেট!
জীবনের তখন কী হয়? দেখো জীবন, কতকিছু শিখিয়েছ তুমি... বেকেটের ডাইরি! আশ্চর্য অনুভূতি হয়। মনে হয় কী যেন... কোথায়, কোন দেশে এই এখন, হত্যাকাণ্ড ঘটছে! তারপর, মনে হয়, পিটসবুরগের কনসার্টে গান গাইছে 'পোয়েটিক জাস্টিস', আর কবি জয় হার্জো স্যাক্সোফোন বাজাতে বাজাতে গাইতে শুরু করেছেন দ্য বার্ডস... এখনই জেগে উঠবে উইনচেষ্টার স্ট্রিট। একটা বই হাতে নিলে কতকিছু হয়। কত ভাঙচুর। এই যে একটি ভয়ানক অভিনয় দৃশ্যঃ
শুয়োরের বাচ্চারা, সাবধান হবি, সা আ আ আ আ ব ধা আ আ আ আ আ ন...
ধুপধাপ আওয়াজ হয়। বাতাসে গোঙানি। চাপা। গন্ধ আসে। গন্ধ যায়। ভেঙে যাওয়া থেঁতলে যাওয়া এক কণ্ঠস্বরঃ হরিদাস, হরিদাস... সাবধান হবি...
রাজা সাবধান করে দিয়েছেন। কেউ কারো মুখের দিকে তাকাবি না।
কেউ কারো মুখের ভাষা পড়বি না।
ঘেউ ঘেউ। দূরে। থেমে থেমে। ঘেউ ঘেউ।
বাতিগুলো নিভে যায়। আসলে, নিভে যেতে চায়।
এখন, উইনচেষ্টার স্ট্রিট জেগে উঠবে।
পাশের জানালা দিয়ে হ্যাম্পশায়ারের রাতের আকাশ দেখি। মেঘ করেছে। রাস্তায় যুবক-যুবতীরা, চুম্বনরত। আগস্টের শেষ দিকে হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা নেমেছে। হাসান আজিজুল হককে মনে পড়ে, মানে তাঁর গল্পকে। এখন নির্দয় শীতকাল। ঠাণ্ডা নামছে হিম... এইসব। খোলা জানালার কারণে ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ ব্যাপারটা ভয়ানকরকম টের পাওয়া গেল। বাইরের যুবকরা হাততালি দিচ্ছে, মেয়েরা চিৎকার করে গাইছে- ওলমৌস্ট হ্যাভেন... লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার... কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ... ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া...
বুকটা হু হু করে উঠে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া! ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ আর ‘ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া’ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়? ছোট বোন’টির কাছে? মায়ের কাছে? শমসের নগরে? জানালা খোলাই থাকে। কোরাস ঢুকে পড়ে ১০ নম্বর উইনচেষ্টার স্ট্রিটের চূড়ায়। এক কুঠুরিতে।
আত্মজা ও একটি করবী গাছের ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে আর খোলা জানালায় হ্যাম্পশায়ারের আকাশ! বাইরের রাস্তায় যুবক-যুবতীদের কোরাস- কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ... ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া; আমি যেন শমসের নগর থেকে আমাদের গ্রামের পথে হাঁটছি!
সারারাত তারা এই গানটি গাইবে। তাদের কোরাসে উইনচেষ্টার স্ট্রিট আজ ঘুমাবে না!
ছাদের ওপর বসে থাকবে একজন। ফিডলার। হ্যাম্পশায়ারে রাতের শেষ হওয়া দেখে দেখে ভায়োলিন বাজাবে সে। ছাদের ওপর ফিডলার। নিঃসঙ্গতা! আহা, নিঃসঙ্গতা! গন্ধ ও ঘ্রাণ; স্মৃতি ও জীবন! বাবার খুব প্রিয় ছিল সূর্যমুখী ফুল। তার মৃত্যুর পর, ফুলগুলি কোথায় ফুটে? ভোরে, মা যখন বাবার কবরের দিকে তাকান, আমার স্থির বিশ্বাস সূর্যমুখী ফুলগুলি তখন তার বুকের ভিতর ফুটে।
ওলমৌস্ট হ্যাভেন... লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার... কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ... ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া...
শুয়োরের বাচ্চারা, সাবধান হবি, সা আ আ আ আ ব ধা আ আ আ আ আ ন... নতুন দিনের খবরের কাগজের শিরোনাম-- স্টপ দিজ ম্যাডনেস! ... আর, শিশুদের লাশ। বাবার সূর্যমুখী ফুল মায়ের বুকে ফুটছে! ভোর হচ্ছে হ্যাম্পশায়ারে, শমসের নগরে। ছাদের ওপর ফিডলার। ভায়োলিন বাজাচ্ছে। তখন, আলবেয়ার কামু তাঁর ডাইরিতে লিখছেনঃ আমি অস্তিত্বের অভিঘাতের দিকে অগ্রসর হতে অস্বীকার করি না, কিন্তু আমি এমন কোনও যাত্রাপথও আকাঙ্ক্ষা করি না, যা মানুষ থেকে দূরে সরে গেছে। আমরা কি আমাদের তীব্রতম অনুভূতিগুলোর শেষে ঈশ্বরকে খুঁজে পাব?
খুঁজে পাওয়া? পাওয়ার অপেক্ষা? আর কত? সত্যি আর সহ্য করতে পারছি না। কিছু একটা ঘটুক। হঠাৎ লেলিহান আগুন জ্বলে উঠুক কিংবা হাত থেকে পড়ে যাক ওয়াইনের গ্লাস। এখনই একটা মানুষ চিৎকার করে উঠুক। কুকুরটা ঘৃণাভরে পা তুলে প্রশ্রাব করুক আমাদের দিকে কিংবা ভেঙে পড়ুক সমস্ত নিরাপত্তার কাচ। অবারিত শান্তি ঝনঝন শব্দে ভেঙে যাক। দুন্দুভি বেজে উঠুক দ্রিম দ্রিম নাদে। কান ফাটিয়ে বিস্ফোরিত হয়ে যাক সমস্ত করাতকল। দাউদাউ দাবানল ছড়িয়ে পড়ুক। একটা চাপা গোঙানি। বুক-ভেঙে-আসা নীরব কান্নাঃ হরিদাশ... হরিদাশরে... মুই তরে খুঁজি পাই না বাপ, কে তরে মারল! হরিদাশরে...
... অপেক্ষা? আর কতকাল অপেক্ষা করে যাব? একটি শিশু হাসবে না মৌ তোর উঠোন জুড়ে রোদের ভিতর?
লেখক পরিচিতি
এমদাদ রহমান
গল্পকার
অনুবাদক।
জন্ম সিলেট, বাংলাদেশ।
বর্তমানে ইংলন্ডে থাকেন।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পাতালভূমি ও অন্যান্য গল্প।
না, জানালা বন্ধ করো না। বন্ধ জানালাগুলি খুলে দাও। সব, সমস্ত জানালা, পৃথিবীর সমস্ত বন্ধ জানালা টান মেরে খুলে ফেল। দেখি নিউক্লিয়ার শীতের গোধূলি নামার আর কত বাকি।
না, জানালা বন্ধ রেখ না। খুলে দাও। খোলা জানালার হু হু হাওয়া শীতল করে দিক আমাদের যন্ত্রণা। দম আটকে আসছে। মেট্রো রেলে টাওয়ার হিল থেকে মনুমেন্ট যাচ্ছি। হাতে সকালে মেট্রো। বড় বড় অক্ষরে লেখা স্টপ দিজ ম্যাডনেস! ম্যাডনেসের এদিক সেদিক শিশুদের লাশের স্তূপ। কীসের উন্মাদনা? আমাদের বুকের ঠিক মাঝ বরাবর তাক করা আছে অদৃশ্য বন্দুকের নল। হাত দিয়ে দেখ, মনে হবে মরা সাপের শরীরের মত শীতল এই নল। খুব শান্ত। শুধু শক্ত হাতে একবার শুধু একবার ট্রিগার দিপে দাও কিংবা আরও কোথাও আরেকবার হিরোশিমা-নাগাসাকি। বাহ! আহা, দেখ, আমরা একটুতেই খুশি। একটুতেই আনন্দ। একটা মাত্র গুলি চাই আমাদের। আর কিছু না, অথবা, যদি পার আমাদের পৃথিবীর নিচে একটা মাত্র বাউন্সিং মাইন বসিয়ে দাও হে সমর প্রযুক্তিবিদ... আবার, আবার সেই চাপা গোঙানিঃ হরিদাশ, হরিদাশরে...
এভাবে আর কতদিন। এখনও সব ঘাতকের বিচার হয় নি।
এখনও সব বধ্যভূমি খুঁড়ে করোটির হাড় বের করা হয় নি।
খুলে দাও। জানালাগুলি কখনোই বন্ধ কর না। খোলা জানালার আলো, হে আলো, আমাদের অন্ধ করে দাও। তুমি আসো। মনুমেন্ট পার হয়ে হু হু ঢুকে পড় আমাদের বন্ধ ঘরগুলোয়। তোমার সান্তিয়াগো বুড় হয়ে গেছে হেমিংওয়ে। মানুষের চেয়েও মহৎ এক শয়তান চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসছে। শয়তানটার দুই হাতে পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা। তার হাতের ক্ষমতা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে রক্ত। আমরা তো শান্তিতে ঘুমাতে চেয়েছিলাম। আমরা তো একটু শান্তিতে মরতে চেয়েছিলাম। কারা জানি ফিসফিস করে বলছে। এক বৃদ্ধা শয়তানটার পায়ের কাছে বসে তাকে গান শোনাচ্ছেঃ ওয়ার ইজ ম্যাডনেস, ওয়ার ইজ ম্যাডনেস, ও মাই লর্ড... আলো আসুক। আলোকে আসতে দাও। লেট দেয়ার বি লাইট। লেট দেয়ার বি লাইট। তাতে কী আর আসে যায়? জীবিতরা সব মূক ও বধির।
আজ ভাবলাম মনুমেন্ট হোক কিংবা হ্যাম্পশায়ার হোক, আজ যেখানেই থাকি ওয়াটারলু গিয়ে ট্রেন ধরব। সোজা স্ট্রবেরি হিল। সেখানে এক অদ্ভুত জায়গা আছে। ওয়াটার মিল পার্ক। পার্কের পাশেই লেক। লেকের জলে আকাশের ছায়া। চারপাশে বন। বনের পাশ দিয়ে মোটরওয়ে। লেকের পাশে বসলে মোটরওয়ের গাড়ির শব্দকে মনে হবে জলের শব্দ; কিংবা চলে যাব গ্রিন পার্ক। লন্ডনের পিকাদ্যালি সার্কাসের কাছে। লোকজন সেখানে প্যালেস দেখতে যায়। বাকিংহ্যাম। আমি সেখানে যাব না। আমি যাব থেচারস-এ। গ্রিন পার্ক আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে নেমে একা একটি অপরূপ মেয়ের অপেরা শুনতে শুনতে হেঁটে যেতে সাত থেকে আট মিনিট। থেচারস। একটি বই কিনতে যাব। সেখানে গিয়ে ভুলে যাব বইয়ের নাম, ভুলে যাব লেখকের নাম। আইজাক বাশেভিস সিঙ্গার না গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ না ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা না হোর্হে লুইস বোর্হেস না আমা আতা আইদু? মনে করতে কষ্ট হবে; তবু যাব। দোতলা’য় কামু আর কাফকা আর মুরাকামির ফিকশনগুলোর সামনে দাঁড়ালেই নাম টা মনে পড়বে— দ্য ম্যাজিশিয়ান অভ লুবলিন। আর তখনই বুকটা খচ করে উঠবে। কবে দেখা হবে আমাদের, মৌ? পরিচয়ের ও প্রেমের দুই বছর হয়ে গেছে। একসঙ্গে আমরা অনেকবার কেঁদেছি। একসঙ্গে হেসেও উঠেছি। একবারও দেখা হয় নি! আশ্চর্য না? দুই বছর আগে, সেদিন তোমাকে প্রথম ফোন করেছিলাম, আসলে দিন নয়, রাত দু’টো কি তিনটে বাজে। বাংলাদেশে তখন সকাল নয় টা ছিল?
হ্যাম্পশায়ারে সেদিন তুষার পড়ছিল। সম্ভবত বৃহস্পতিবার। হ্যাঁ। তারপর? বিষাদ, অবসাদ, নিঃসঙ্গতা, শত বছর, হাজার বছরের নিঃসঙ্গতা ঝাপটে ধরছে মানুষকে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পালাবার সবগুলো পথ। ঘর জুড়ে অন্ধকার। অন্ধকার বিপুলা। বিপুল বিষাদ। সলিচিউড। একাকীত্ব, নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা... খোলো, খুলে দাও। বাজুক নির্জন এককের গান। এই গানে ভর করে ভায়োলেট এভিনিউয়ের দিকে, মনুমেন্টের দিকে, বন্ড স্ট্রিটের দিকে ধেয়ে আসুক মত্ত হাওয়া। জানালা খুলে দাও মৌ। তুমি যেদিন মৌলভী বাজার থেকে শমশের নগর আসলে, সেদিন কি দয়ালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল? আমাদের শহরে এই একমাত্র লোক, দয়াল। উচ্চতায় আকাশের সমান। কালো কুচকুচে শরীর। এই লোকটাই আমাদের ছেলেবেলাটাকে গল্প দিয়ে ভরে রেখেছিল। আমাজন বনের বিশাল ডানাওয়ালা প্রজাপতিটার গল্প আমাদেরকে দয়ালই বলেছিল। দয়াল ছাড়াও তার আরও কয়েকটি নাম আছে। একটা নাম যমুনা। যমুনা আমাকে এক রাতে, দুর্গাপূজার সময়, যাত্রা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তার আরেকটি নাম হরেকরাম। হরেকরাম আমাকে একদিন গান শুনিয়েছিল— দমকলেতে বাজে বাঁশি কদম্বতলায়, আনন্দে ময়ূরী হইয়া নাচইন রাধিকায় গো...
ভ্যান গগের পটেটো ইটারস ছবিটা দেখেছ? আমরা একসঙ্গে দেখব মৌ। মৌরে, আমরা দেখব কালিঝুলিমাখা কিছু মানুষ-- পটেটো ইটারস! এইত সেদিন একটা সিনেমা দেখলাম। নাম টা মনে করতে পারছি না। একটা বন্দি মেয়ের শুধু কয়েকটি সংলাপ মনে আছে। মেয়েটা বলছেঃ মুক্তি দেবে না আমায়? বাঁচতে না দাও, অন্তত মুক্তিটুকু দাও। প্রথমে চাই মুক্তি, তারপর শুধু একটা গুলি। একটা তীব্র ঠাস... রাতভর ধর্ষণ করেছ। এবার এক ঝলক আলো দেখতে দাও। আলো ছাড়া আমার এই চোখ দুটি কিছুই যে দেখবে না!
ওই চেরি গাছগুলি ছুঁয়ে মত্ত বাতাস ঢুকে পড়ুক কুঠুরিতে। আমরা ঠিক কীরকম জীবন চাইরে মৌ? তুই জানিস? এই মহাপৃথিবীতে আমরা কী আসলেই কোনও জীবন চাই বল? টাওয়ার হিল থেকে মনুমেন্ট যেতে যেতে আমি ফের সেই সিনেমাটার ভিতর ঢুকে পড়ি। মেয়েটা বলছেঃ ধন্যবাদ বন্ধু, জানালাটা খুলে দিলে, কিন্তু... কিন্তু... এ কী হল, কীসের গন্ধ বাতাসে?
যুদ্ধমাতাল অফিসারের বাজখাই উত্তরঃ এই গন্ধ বসনিয়া ক্যাম্পে আটক যুবকদের পোড়া মাংশের। জ্যান্ত বন্দীদের সামনেই আমরা অন্য বন্দীদের গুলি করে হত্যা করি। তারপর লাশের স্তূপে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিই। মেয়েদের ধর্ষণ করি প্রাণ ভরে। মেয়েরা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তাদের বুকের ওপর বুট চেপে ধরে পেচ্ছাব করে দিই। তাদের বলি, এই পেচ্ছাব গিলে ফেলতে হবে। যুদ্ধ আসলে এমনই। যুদ্ধের অর্থ শুধুই যুদ্ধ। মেগা ডেথ। ম্যাডনেস। কখনই তাই জানালা খুলতে বল না। যুদ্ধের অন্যতম শর্ত বন্ধ জানালা।
তাই, জানালা বন্ধ থাকুক। খোলা জানালার বাতাসে চিৎকার মিশে থাকে। আলোয় মিশে থাকে রক্ত। রক্ত আর চিৎকার যুদ্ধবাজের প্রিয় শব্দ। তালিয়া বাজাও।
কী করা যায়? মনে মনে খেলা দেখা যায়? কে সেই খেলার পুতুল? ভ্লাদিমির পুতিন, নাকি বারাক ওবামা, নাকি নেতানিয়াহু? নাকি শচীন, সেরেনা, উসাইন? খেলা বড় আশ্চর্য হয় এখানে। চার। ছক্কা। হৈ হৈ। সেঞ্চুরি। ডাবল সেঞ্চুরি। উল্লাস। গ্যালারিতে আজ বড় উল্লাস। ব্যাটসম্যানের ব্যাটে আজ ঝড়। শচীনে-সেরেনায়-উসাইনে আজ ঝড়। তীব্র উল্লাসে ফেটে যাচ্ছি আমরা। খেলা। জয়। পরাজয়।
খেলার উল্লাসে চাপা পড়ে যাচ্ছে গণহত্যার কান্না। পৃথিবীর ঘাতকরাও অবাক আমাদের উল্লাসে। এক ভূখণ্ডে মানুষের ব্যাট-বলের কারবারে উল্লাস, অন্য খণ্ডে বিমান থেকে মানুষের জন্য প্লাস্টিকের পা নামছে। তালিয়া বাজাও। তালিয়া বাজাও। তালি... চমৎকার। যুদ্ধে পেতে রাখা মাইনে যাদের পা উড়ে গেছে, শুভ্র আকাশযান তাদের জন্য নকল পা নিয়ে এসেছে। এবার শুরু করো। দৌড়। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে যে আগে যেতে পারবে, সে-ই আজ মালিক বনে যাবে একখানি নকল পায়ের। একশজনের ভিতর মাত্র কয়েকজন শুধু পাবে। নকল পা-ও বেশি নেই। এই দৃশ্য সরাসরি দেখা যাবে বিবিসি, সিএনেনে। চমৎকার। মখমলবাফ তার কান্দাহারে এরকমই দেখিয়েছিলেন। বহু বছর পর, আমাদের যখন দেখা হবে কিংবা যেদিন আমরা আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশনের হলদে আলোর স্রোতে মানুষের ভিড়ে মিশে যাব, সেদিন তোকে বলব এসব।
উত্তেজনা আর সহ্য হচ্ছে না। অবসর চাই। বিজ্ঞাপন বিরতির অবসর। নায়িকার শৈল্পিক শরীর... শরীর। যুদ্ধেও শরীর। নাচেও শরীর। জন্মে, মৃত্যুতে, খেলায়, হত্যায় শুধু শরীর। শরীর এক ভিয়েন। প্রিয় আবুল বাশার লিখেছিলেনঃ কথার ভিয়েনে সাহিত্য, মাটির ভিয়েনে মৃৎপাত্র। এই এক লেখক আমার! আবুল বাশার। বলেছিলেন, আমার ব্যক্তিগত অনিশ্চয়তার জীবনে কী কাজে লাগে ওই ইমরানের শত রান? লিখেছিলেন তার স্মৃতিকথায়, আমি মুখে ক্ষুদার গন্ধ নিয়ে বড় হওয়া লেখক। লিখেছিলেন, জল মাটি আর আগুনের উপাখ্যান!
শরীর কি ভাষার ভিয়েন? শরীর কি মানচিত্র? তোমাকে কী বলব মৌ, তুমি যেদিন শমশেরনগর এলে, সেদিন কি বৃহস্পতিবার ছিল? আমার মনে নেই। শুধু জানি খুব বৃষ্টি পড়ছিল হ্যাম্পশায়ারে। এত বৃষ্টি বহুদিন দেখি নি। দেশ থেকে আসার পর তো মনেই হয় নি বিদেশেও বাংলাদেশের মত বৃষ্টি নামবে। শমশেরনগরে সেদিন রোদ ঝলমল করছিল? স্টেশনে গিয়েছিলে? আমার সবচেয়ে প্রিয় রেলওয়ে স্টেশন এই শমশেরনগর।
দীর্ঘ দিনের চলতে থাকা যুদ্ধও একদিন শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে যারা বেঁচে থাকে আর যারা জন্ম নেয়, তারা শুধুই বেঁচে থাকে আর তারা চেয়ে থাকে চারপাশের ভাঙা কাচের দিকে। ভাঙাকাচ মানে মানুষের ভাঙা বুক। যুদ্ধের ময়দানে তখন ধর্ষিতার মত কাঁদতে থাকে নিকষ অন্ধকার। অন্ধকার আর বিষণ্ণতা, অন্ধকার আর বিষাদ, অন্ধকার আর নৈশব্দ, অন্ধকার আর ভাঙা কাচ।
নিঃসঙ্গতার কামড়ে ক্ষতবিক্ষত জীবন জন্মের যন্ত্রণায় কাৎরাতে কাৎরাতে নো ম্যান্স ল্যান্ডে এসে দাঁড়ায়।
নো ম্যান্স ল্যান্ডে, জীবন ... তার পাশে কিছু শামুক, তার পাশে কিছু পাতা, গন্ধ আর ঘ্রাণ, স্মৃতি আর জীবন; বৃদ্ধা ইভলিন আর তার কুকুর,-- হ্যাম্পশায়ার-- গন্ধ আর ঘ্রাণ, স্মৃতি আর জীবনের। শমসের নগরের সঙ্গে হ্যাম্পশায়ার আজ একাকার।
এই ছিল দশ ঘণ্টা আগের খুব স্বাভাবিক এক জীবন, ঠিক যেন স্টিল লাইফ। এর মাঝে রয়েল মেইল পৌঁছে দিয়েছে বেকেটের জার্মান ডাইরি'জ ১৯৩৬-১৯৩৭। ধূসর মলাটের ওপর সবুজরঙে লেখা স্যামুয়েল বেকেট!
জীবনের তখন কী হয়? দেখো জীবন, কতকিছু শিখিয়েছ তুমি... বেকেটের ডাইরি! আশ্চর্য অনুভূতি হয়। মনে হয় কী যেন... কোথায়, কোন দেশে এই এখন, হত্যাকাণ্ড ঘটছে! তারপর, মনে হয়, পিটসবুরগের কনসার্টে গান গাইছে 'পোয়েটিক জাস্টিস', আর কবি জয় হার্জো স্যাক্সোফোন বাজাতে বাজাতে গাইতে শুরু করেছেন দ্য বার্ডস... এখনই জেগে উঠবে উইনচেষ্টার স্ট্রিট। একটা বই হাতে নিলে কতকিছু হয়। কত ভাঙচুর। এই যে একটি ভয়ানক অভিনয় দৃশ্যঃ
শুয়োরের বাচ্চারা, সাবধান হবি, সা আ আ আ আ ব ধা আ আ আ আ আ ন...
ধুপধাপ আওয়াজ হয়। বাতাসে গোঙানি। চাপা। গন্ধ আসে। গন্ধ যায়। ভেঙে যাওয়া থেঁতলে যাওয়া এক কণ্ঠস্বরঃ হরিদাস, হরিদাস... সাবধান হবি...
রাজা সাবধান করে দিয়েছেন। কেউ কারো মুখের দিকে তাকাবি না।
কেউ কারো মুখের ভাষা পড়বি না।
ঘেউ ঘেউ। দূরে। থেমে থেমে। ঘেউ ঘেউ।
বাতিগুলো নিভে যায়। আসলে, নিভে যেতে চায়।
এখন, উইনচেষ্টার স্ট্রিট জেগে উঠবে।
পাশের জানালা দিয়ে হ্যাম্পশায়ারের রাতের আকাশ দেখি। মেঘ করেছে। রাস্তায় যুবক-যুবতীরা, চুম্বনরত। আগস্টের শেষ দিকে হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা নেমেছে। হাসান আজিজুল হককে মনে পড়ে, মানে তাঁর গল্পকে। এখন নির্দয় শীতকাল। ঠাণ্ডা নামছে হিম... এইসব। খোলা জানালার কারণে ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ ব্যাপারটা ভয়ানকরকম টের পাওয়া গেল। বাইরের যুবকরা হাততালি দিচ্ছে, মেয়েরা চিৎকার করে গাইছে- ওলমৌস্ট হ্যাভেন... লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার... কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ... ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া...
বুকটা হু হু করে উঠে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া! ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ আর ‘ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া’ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়? ছোট বোন’টির কাছে? মায়ের কাছে? শমসের নগরে? জানালা খোলাই থাকে। কোরাস ঢুকে পড়ে ১০ নম্বর উইনচেষ্টার স্ট্রিটের চূড়ায়। এক কুঠুরিতে।
আত্মজা ও একটি করবী গাছের ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে আর খোলা জানালায় হ্যাম্পশায়ারের আকাশ! বাইরের রাস্তায় যুবক-যুবতীদের কোরাস- কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ... ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া; আমি যেন শমসের নগর থেকে আমাদের গ্রামের পথে হাঁটছি!
সারারাত তারা এই গানটি গাইবে। তাদের কোরাসে উইনচেষ্টার স্ট্রিট আজ ঘুমাবে না!
ছাদের ওপর বসে থাকবে একজন। ফিডলার। হ্যাম্পশায়ারে রাতের শেষ হওয়া দেখে দেখে ভায়োলিন বাজাবে সে। ছাদের ওপর ফিডলার। নিঃসঙ্গতা! আহা, নিঃসঙ্গতা! গন্ধ ও ঘ্রাণ; স্মৃতি ও জীবন! বাবার খুব প্রিয় ছিল সূর্যমুখী ফুল। তার মৃত্যুর পর, ফুলগুলি কোথায় ফুটে? ভোরে, মা যখন বাবার কবরের দিকে তাকান, আমার স্থির বিশ্বাস সূর্যমুখী ফুলগুলি তখন তার বুকের ভিতর ফুটে।
ওলমৌস্ট হ্যাভেন... লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার... কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ... ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া...
শুয়োরের বাচ্চারা, সাবধান হবি, সা আ আ আ আ ব ধা আ আ আ আ আ ন... নতুন দিনের খবরের কাগজের শিরোনাম-- স্টপ দিজ ম্যাডনেস! ... আর, শিশুদের লাশ। বাবার সূর্যমুখী ফুল মায়ের বুকে ফুটছে! ভোর হচ্ছে হ্যাম্পশায়ারে, শমসের নগরে। ছাদের ওপর ফিডলার। ভায়োলিন বাজাচ্ছে। তখন, আলবেয়ার কামু তাঁর ডাইরিতে লিখছেনঃ আমি অস্তিত্বের অভিঘাতের দিকে অগ্রসর হতে অস্বীকার করি না, কিন্তু আমি এমন কোনও যাত্রাপথও আকাঙ্ক্ষা করি না, যা মানুষ থেকে দূরে সরে গেছে। আমরা কি আমাদের তীব্রতম অনুভূতিগুলোর শেষে ঈশ্বরকে খুঁজে পাব?
খুঁজে পাওয়া? পাওয়ার অপেক্ষা? আর কত? সত্যি আর সহ্য করতে পারছি না। কিছু একটা ঘটুক। হঠাৎ লেলিহান আগুন জ্বলে উঠুক কিংবা হাত থেকে পড়ে যাক ওয়াইনের গ্লাস। এখনই একটা মানুষ চিৎকার করে উঠুক। কুকুরটা ঘৃণাভরে পা তুলে প্রশ্রাব করুক আমাদের দিকে কিংবা ভেঙে পড়ুক সমস্ত নিরাপত্তার কাচ। অবারিত শান্তি ঝনঝন শব্দে ভেঙে যাক। দুন্দুভি বেজে উঠুক দ্রিম দ্রিম নাদে। কান ফাটিয়ে বিস্ফোরিত হয়ে যাক সমস্ত করাতকল। দাউদাউ দাবানল ছড়িয়ে পড়ুক। একটা চাপা গোঙানি। বুক-ভেঙে-আসা নীরব কান্নাঃ হরিদাশ... হরিদাশরে... মুই তরে খুঁজি পাই না বাপ, কে তরে মারল! হরিদাশরে...
... অপেক্ষা? আর কতকাল অপেক্ষা করে যাব? একটি শিশু হাসবে না মৌ তোর উঠোন জুড়ে রোদের ভিতর?
লেখক পরিচিতি
এমদাদ রহমান
গল্পকার
অনুবাদক।
জন্ম সিলেট, বাংলাদেশ।
বর্তমানে ইংলন্ডে থাকেন।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পাতালভূমি ও অন্যান্য গল্প।
0 মন্তব্যসমূহ