পাঠ-প্রতিক্রিয়া : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রীর পত্র পড়ে

দীপেন ভট্টাচার্য

রবীন্দ্রনাথকে হয়তো আমরা ভালভাবে পড়ি না। ওনার গানশুনে ভুলে থাকি, ভাবি এই মানুষটা এত ভাব এরকম ভাষায় এমন অসামান্যভাবে কেমন করে ফুটিয়ে তুললেন। য্খন যেমন পরিস্থিতি তার জন্য তিনি প্রস্তুত, তিনি আমাদের ঘুমভাঙানিয়া, তিনিই আমাদের দুখজাগানিয়া। কিন্তু আজ বহুদিন পরে তাঁর মৃণালীনির চিঠি আবার পড়তে গিয়ে ভেবেছি এত সহজে কয়েকটি পাতার মধ্যে এই মানুষটি মৃণাল হয়ে এমন এক ক্ষয়িষ্ণু বিবেকহীন সমাজের ছবি আঁকলেন যা কিনা কোন সহ্জ করুণাময়ী নাটক নয়, বরং কুয়োর আঁধারে আবদ্ধ পরিবেশকে বহু উঁচুর আলো থেকে বর্ণনা করার প্রয়াস। তাই এই লেখাটি পড়তে গিয়ে করুণ রসে হোঁচট না খেয়েএকটি বুদ্ধিমান মানুষের (মৃনালের) হাত ধরে আমাদের সমাজকে চিনে নেওয়া যাবে।

স্ত্রীর পত্র লেখার পরে একটি শত বর্ষ কেটে গেছে, সাইঁত্রিশটি হাজার দিন, কিংবা আরো বেশী, আমাদের সমাজ সেই সাথে কিছুটা হয়তো বদলেছে, কিন্তু সেই বদলানো বাঙ্গালী নারী, বিশেষতঃ বাঙ্গালী হিন্দু নারীর মুক্তি এনেছে কিনা তা নিয়ে আমরা দ্বিধাগ্রস্থ।

কিন্তু মৃণালের চিঠি কোন নিগৃহীতা নারীর আক্ষেপ নয়, বরং এক শক্তিশালী নারীর মুক্তির বাণী। মৃণাল পুরী থেকে চিঠি লিখছেন তাঁর স্বামীকে, সেই চিঠি এক আত্মজীবনী, ছাইয়ের নিচে যে অঙ্গার - সেই অঙ্গারের উন্মুক্ত আলোর কাহিনী। এই চিঠিতে স্বামীর নাম অনুল্লেখিত, এই চিঠি যেন লেখা সমস্ত পুরুষ সমাজের প্রতি।

ছোটবেলায় মৃণালের ভাই জ্বরে মারা যায়, মৃণালেরও জ্বর হয়েছিল, কিন্তু সে বেঁচে যায়। রবি ঠাকুর মৃণাল হয়ে লিখছেন,

পাড়ার সব মেয়েরাই বলতে লাগল, "মৃণাল মেয়ে কিনা, তাই ও বাঁচল, বেটাছেলে হলে কি আর রক্ষা পেত?" চুরিবিদ্যায় যম পাকা, দামি জিনিসের পরেই তার লোভ।

মৃণালকে মেজোবৌ করে কলকাতার যে বাড়ীতে নিয়ে আসা হল সেটি বাইরেরে চাকচিক্য বজায় রাখত, কিন্তু বাইরের জৌলুশ বাড়ীর ভেতর পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে আবার্জনায় আটকে যেত, অন্ধকার অন্তঃপুরটি ছিল যেন গোয়ালঘরের মত। মৃণালের রূপ ছিল, সেজন্যই তাঁকে এক অজ পাড়াগাঁ থেকে বৌ করে নিয়ে আসা হয়েছিল, কিন্তু তাঁর শুধু রূপই ছিল না, তিনি ছিলেন বুদ্ধিমতী, কবি ছিলেন। কিন্তু অন্তঃপুরে বুদ্ধিমত্তার বিচার হয় না। ইতিমধ্যে আবার তাঁর একটি বাচ্চা মেয়ে জন্মেই মারা গেল। মৃণাল লিখলেন

মা হবার দুঃখটুকু পেলুম কিন্তু মা হবার মুক্তিটুকু পেলুম না।

পৃথিবীর প্রতি মৃণালের মায়া, নিজে না খেয়ে বাড়ীর গরু আর বাছুরদের খাওয়াতেন। এর মধ্যে মৃণালের বড় জায়ের ছোট বোন বিন্দু আত্মীয়দের অত্যাচার না সহ্য করতে পেরে কলকাতার বাড়ীতে ঠাঁই নিল। বড় জায়ের এই নিয়ে খুব কুন্ঠা, তাই বিন্দুকে বাড়ীতে দাসীর মত কাজ দিলেন। এই জা হয়তো রূপসী ছিলেন না, মৃণাল তাঁর সম্বন্ধে লিখছেন,

তিনি নিজের বিবাহটাকে এ বংশের প্রতি এক বিষম অপরাধ বলে জেনেছেন।

বিন্দুর প্রতি মৃণালের অপত্য মায়া। বিন্দু তাঁকে ভালবাসল। মৃণাল লিখলেন,

তার এই ভালবাসার ভিতর দিয়ে আমি আপনার একটি স্বরূপ দেখলুম যা আমি জীবনে আর কোনদিন দেখি নি। সেই আমার মুক্ত স্বরূপ।

অবশেষে বাড়ীর লোকেরা জোর করে বিন্দুকে এক লোকের সঙ্গে বিয়ে দিল, দেখা গেল মানুষটি পাগল। বিন্দু পালিয়ে এল একবার, তার দিদি বললেন

তা পাগল হোক ছাগল হোক স্বামী তো বটে।

বিন্দুকে ফিরিয়ে দেয়া হল। বালিকা নিজেকে পুড়িয়ে মারল, বাঁচল। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন মৃণালের কলমে,

দেশশুদ্ধ লোক চটে উঠল। বলতে লাগল, "মেয়েদের কাপড়ে আগুন লাগিয়ে মরা একটা ফ্যাশন হয়েছে।"

মৃণালেরো মুক্তি হল। সে সাতাশ নম্বর মাখ্ন বড়াল গলির গণ্ডি পেরিয়ে জগৎ দেখতে বের হল। স্বামীর কাছে তাঁর চিঠি তিনি মীরা বাঈয়ের কথা দিয়ে শেষ করেছেন। প্রত্যাক্ষিতা মীরা তীর্থ থেকে তীর্থে ঘুরেছেন, উপহাসের পাত্র হয়েছেন, কিন্তু তাঁর ভক্তি তাঁকে মরতে দেয় নি। মৃণাল লিখলেন

তার শিকলও তো কম ভারী ছিল না। তাকে মরবার জন্য তো মরতে হয় নি।

মৃণাল লিখলেন তিনি আর স্বামীর কাছে ফিরে যাবেন না।

রবি ঠাকুরের এই লেখার মূল্যায়ণ সুহৃদ পাঠক হয়তো আমার থেকে ভাল করবেন। কিন্তু একটি মাত্র নাতিদীর্ঘ চিঠির মাধ্যমে তিনি যেভাবে একটা অন্তঃসারশূন্য সমাজের ঘূণে ধরা কঙ্কালকে উন্মোচিত করেছেন সেটির ভয়াবহ রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। হিন্দু পুরুষ সমাজের বিবেকহীনতা রবীন্দ্রনাথকে যে ভাবে নাড়া দিয়েছিল সেই ভাবটিই মৃণালের পত্র মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। আমার যেটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে সেটা হল মৃণালকে রবীন্দ্রনাথ অসহায়ত্বের আধার বানিয়ে ছোট করেন নি, বরং মাখ্ন বড়াল গলির অন্ধকার থেকে বঙ্গোপসাগরের রক্তিম সূর্যোদয়ের নিচে উত্তাল ঊর্মিতে তাঁর পা ভিজিয়ে বাস্তবায়িত করেছেন এক সাহ্সী নারী চরিত্রের। এই সাহ্স যেন সমস্ত নারীর মাঝে সঞ্চার হোক - আমি ভাবতে চাই - এই ছিল রবি ঠাকুরের কামনা, সব নারীই যেন মৃণালের মত বলতে পারে--

তোমাদের গলিকে আর আমি ভয় করিনে। আমার সন্মুখে আজ নীল সমুদ্র, আমার মাথার উপরে আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ।

শুধু তাই নয় মৃণাল চিঠিটির সমাপনীতে নাম লিখেছেন

তোমাদেরচরণতলাশ্রয়ছিন্ন-
মৃণাল।

তাদের চরণতলের আশ্রয় ছিন্ন করার যে সাহস মৃণাল দেখিয়েছে তা যেন আগামী দিনের নারীর প্রতি এক অভয়বার্তা।

রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য লেখায় নারী স্বাধীনতা প্রসঙ্গ কতখানি এসেছে তা নিয়ে আমার এই লেখাটি নয়, আমি এ সম্বন্ধে খুবই কম জানি। কিন্তু স্ত্রীর পত্র আবার পড়ে আমার দুটি কথা মনে হয়েছে। প্রথম কথাটি রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা নিয়ে। পুরুষ হয়ে একটি নারীর চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মধ্যে এক ধরণের বিশেষ গুণ চাই। স্ত্রীর পত্র পড়বার সময় আমাদের কখনই মনে হবে না এটি একটি পুরুষের লেখা (অবশ্য আমি পুরুষ হিসেবে এটা বলছি)। নিজেকে নারীর আসনে বসিয়ে তার জীবনের যে ঘাত-প্রতিঘাত সেসব অনুধাবনের ক্ষমতা সবার থাকে না। এখানেও রবি ঠাকুরের সৃষ্টিশীলতা।


কিন্তু দ্বিতীয়া কথাটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। আজ একশো বছর পরে হিন্দু নারীদের কি পরিত্রাণ হয়েছে? আমার ব্যক্তিগত মতামত - হয় নি। বিশেষতঃ বাংলাদেশে। ১৯৪৭য়ের দেশ ভাগের পরে ভারতে হিন্দু আইনের পরিবর্তন হয়েছে, বাংলাদেশে হয় নি। এখানে এখনো হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নেই, বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি নেই। তদুপরি বৃহত্তর সমাজে হিন্দু মেয়েদের নিরাপত্তা নেই ভেবে অনেক মেয়েকেই বাবা-মা ভারতে বা পশ্চিমের কোন দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ওদিকে দেশের মধ্যে অনেক স্বামী-পরিত্যক্তা নারী নিজের সম্পত্তির অধিকারী না হয়ে আত্মীয়দের বাড়িতে সেই হতভাগা বিন্দুর মত থাকছেন, যথাযথ আইনের অভাবে স্বামীকে বিচ্ছেদও করতে পারছেন না। আমার মতে এই আইন পরিবর্তনে উৎসাহ না দেখিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তর হিন্দু সমাজ মৃণালের শ্বশুরকুলের মতই আচরণ করছে। স্ত্রীর পত্র থেকে চলে এলাম বর্তমানের সমাজে। কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের গুণই এরকম, তা সময়কে ছাপিয়ে যায়।




লেখক পরিচিতি
ড. দীপেন (দেবদর্শী) ভট্টাচার্য

জন্ম ১৯৫৯ সালে। আদি নিবাস টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায়।

ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসার (NASA) গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইনস্টিটিউটে গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিআর) গামা-রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। মহাশুন্য থেকে আসা গামা-রশ্মি পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বায়ুমণ্ডলের ওপরে বেলুনবাহিত দূরবীন ওঠানোর অভিযানসমূহে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় রিভারসাইড কলেজে অধ্যাপক।

দীপেন ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ্ভাবে যুক্ত। ১৯৭৫ সাথে বন্ধুদের সহযোগিতায় 'অনুসন্ধিৎসু চক্র' নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ছাড়াও তাঁর নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো ও দিতার ঘড়ি নামে বিজ্ঞান-কল্পকাহিনিভিত্তিক ভিন্ন স্বাদের তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ