শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প : ঝুমকোলতার স্নানের দৃশ্য ও লম্বোদরের ঘাটখরচ



ভূষণ একটু দূর থেকে তার বউ ঝুমকোলতাকে দেখছিল। ঝুমকো কুয়ো থেকে জল তুলছে। মাত্র পাঁচ দিনের পুরনো বউ। কত কী দেখার আছে নতুন-নতুন। ভূষণ কি কালও জানত যে, তার বউয়ের মাথার গড়নটা অনেকটা মাদ্রাজী নারকেলের মতো? এরকমের গড়নের মাথা ভাল না মন্দ তা ভুষণ জানে না। সে ঝুমকোলতার যা দেখছে তাতেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই একটা মেয়েমানুষের মধ্যে যে নিত্যি নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করছে, পেয়ে যাচ্ছে গুপ্তধন, লাভ করছে কত না জ্ঞান। মাত্র পাঁচ দিনে।

ঝুমকো এই যে সাতসকালে বালতি-বালতি জল তুলে চান করবে বলে, এ ভূষণের ভালো লাগছে না। তার ইচ্ছে করছে হাত থেকে বালতি কেড়ে নিয়ে নিজেই জল তুলে দেয়। কিন্তু তা হওয়ার নয়। বাড়িভরতি গুরুজন, আত্মীয়কুটুম, হাজার জোড়া চোখ নজর রাখছে তাদের দিকে। রাখবেই। নতুন বিয়ের বর-বউ। তো নজর দেওয়ারই জিনিস। তবু তার মধ্যেই ভূষণ নানা কায়দা কৌশল করে লুকিয়ে চুরিয়ে ঝুমকোলতাকে একটু আধটু দেখে নেয়। এই যে এখন উত্তর দিককার ঘরে ভূষণের কোনও কাজ নেই, তবু সে এসে ঢুকে পড়েছে। এ-ঘর তুলসীজ্যাঠার। বুড়োমানুষ। দেশের কাছে গান্ধীবাবার অনুগত হয়ে জীবন উৎসর্গ করবেন বলে নাছোড়বান্ধা হয়ে লেগে গিয়েছিলেন, তাই আর সংসারধর্ম করেননি। উড়ণচণ্ডী হয়ে গাঁ-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন, তকলি চরকা কাটতেন। বুড়ো বয়সে এসে আবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু ততদিনে গুষ্টি বেড়েছে, ভালো-ভালো ঘরগুলো বেহাত হয়েছে। উত্তরের এই ঘরে থাকে জ্বালানি কাঠ, খোলভুসির বস্তা, বীজধান, তারই একধার দিয়ে কোনওরকমে বুড়ো মানুষটার জন্য একটা চৌকি পাতা হয়েছে। আগে গুটিকয় ছাগলও থাকত। আজকাল থাকে না, তবু ঘরটায় কেমন ছাগল-ছাগল গন্ধ। কস্মিনকালেও ভূষণ এই ঘরে আসে না। কিন্তু ঝুমকোলতা চান করতে যাচ্ছে আঁচ পেয়েই ভূষণ হঠাৎ এ ঘরে এসে সেঁধিয়েছে। কারণ, এ ঘরের জানালার ফোকর দিয়ে কুয়োতলাটা ভারী পরিষ্কার দেখা যায়। একটা লেবুগাছের আবডালও আছে, তাকে কেউ দেখতে পাবে না।

কিন্তু ঘরে ঢুকেই তো আর জানালায় হামলে পড়া যায় না। জ্যাঠা কী বা মনে করবে। যদিও গান্ধীবাবার শিষ্য, চিরকুমার এবং বুড়ো, তবু সাবধানের মার নেই। ভূষণ ঘরে ঢুকেই চৌকির একধারটায় চেপে বসে বলল, জ্যাঠামশাই, শরীর-গতিক কেমন?

তুলসীজ্যাঠা বুড়ো হলেও মজবুত গড়নের লোক। মাঠে ঘাটে ঘুরে-ঘুরে শরীর পোক্তই হয়েছে। তার ওপর খাওয়া-দাওয়ায় খুব সংযমী। নেশা ভাঙ নেই। এখনও নিজের কাপড় নিজে কাচেন, নিজের ঘর নিজে সাফ করেন, স্নানের জলও নিজেও তোলেন। কারও তোয়াক্কা রাখেন না।

বসে একখানা বই পড়ছিলেন। হিন্দি বই। মুখ তুলে বললেন, খারাপ থাকব কেন রে? ভালোই আছি। তোর খবর-টবর কী?

মাথা চুলকে ভূষণ বলে, এই আর কী, ঘাড়ে আবার বোঝা চাপল, বুঝতেই পারেন।

বোঝা বলে বোঝা? এ একেবারে গন্ধমাদন। বলে তুলসীজ্যাঠা একটু হাসলেন। তারপর বললেন, বউ তো আনলি, তা মেয়েটা লেখাপড়া জানে তো?

ভূষণের নজর কুয়োতলায়। বলল, ওই আর কী। গাঁয়ের স্কুলে অজ আম পড়েছে।

এঃ, স্ত্রী শিক্ষাটাই আমাদের দেশে হল না। তা একখানা বই দেবোখন ভারতীয় নারীর ঐতিহ্য। বইখানা বউমাকে পড়াস।

ও বাবা, ওসব খটোমটো বই কি আর পড়বে।

পড়বে। জোর করে পড়াস। পড়াটা অভ্যাসের ব্যাপার। প্রথম-প্রথম পড়তে চাইবে না। তারপর রস পেলে হামলে পড়বে।

বুড়োমানুষরা এমনিতেই একটু ভ্যাজর ভ্যাজর করে, তার ওপর এ মানুষ আবার আদর্শবাদী, ভূষণ জানালাটার দিকে একটু চেপে বসে বাইরের দিকে চেয়ে উদ্বেগের সঙ্গে বলল, এঃ, লেবুগাছটায় দেখি পোকা লেগেছে।

তুলসীজ্যাঠা তাঁর হিন্দি বইখানা সাবধানে মুড়ে রাখলেন। তারপর বললেন, যাই, হোমিওপ্যাথির বাক্সটা নিয়ে একটু মাঠেঘাটে পাক দিয়ে আসি।

সেই ভালো। বলে ভূষণ এ ঘরে থাকার ছুতো খুঁজতে হিন্দিবইখানাই খুলে বসল। বলল, ইঃ, বাবা এ যে দেখছি তুলসীদাসের রামচরিতমানস। অ্য্যাঁ! কতকাল ধরে বইখানা পড়ার ইচ্ছে।

তা পড় না, বসে-বসে পড়।

তুলসীজ্যাঠা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভূষণ অপলক নয়নে ঝুমকোলতাকে দেখছে। হাতে রামচরিতমানস এলিয়ে আছে।

আচ্ছা, এই যে ভূষণ ঝুমকোলতাকে দেখছে, ঝুমকো কি তা টের পাচ্ছে? মোটেই না। ভূষণের তো মনে হয় এই পাঁচ দিনে একটা অচেনা মেয়েকে সে যেমন অষ্টেপৃষ্টে ভালোবেসে ফেলেছে, তার সিকির সিকি ভাগও ঝুমকোলতা পারেনি। ভূষণের যেমন আনচান অবস্থা, চোখে হারাই হারাই ভাব, তেমনটা ঝুমকোলতার কই? দিব্যি ঘুমোচ্ছে, শ্বশুরবাড়ির নতুন সব চেনাদের সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারছে, ভূষণ বলে যে কেউ আছে তাই বোধহয় সারাদিন মনে পড়ে না। এসব কথা নিয়ে কাল রাতেও হয়ে গেছে একচোট। কিন্তু যা কথায়-কথায় কাঁদতে পারে মেয়েটা। ভূষণ শেষে পা অবধি ধরেছে।

কে একজন ছোকরা মতো ঝুমকোর খুব কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল? অ্যাঁ! সাহস তো কম নয়। পিছন থেকে মুখটা দেখা যাচ্ছে না বটে। কে ও? ভূষণ একটু খর চোখেই তাকিয়ে রইল। নাঃ, পল্টু। ভূষণের ভাইপো। কাকিমার জল তুলতে কষ্ট হচ্ছে দেখে এগিয়ে এসেছে। ছেলেটা বড় ভালো। খুব হেসে-হেসে গল্প করছে কাকিমার সঙ্গে।

ভূষণ মুখটা একটু আড়াল করল। পল্টুটা না আবার তাকে দেখে ফেলে। আবার সন্তর্পণে মুখ বার করে দেখতে পেল, আরও দুচারজন এসে জুটেছে কুয়োতলাআয়। পল্টু জল তুলছে। ঝুমকো গুলতানি মারছে। মুখটা আড়াল করতেই হয়। নইলে দেখে ফেলবে।

রামচরিতমানসখানা খুলে দু-চার লাইন পড়ার চেষ্টা করল ভূষণ। হিন্দিটা তার ভালো আসে না। তা ছাড়া রামচরিত পড়ার মতো মনের অবস্থাও নয়। মন এখন উটাচন। বই রেখে বালিশের পাশে ডাঁই করে রাখা বইপত্র একটা খাতামতো জিনিস তুলে নেয়, খুলে দেখে মুক্তোর মতো পরিষ্কার অক্ষরে ঝরঝরে বাংলা লেখা।

‘তিনি চলিয়াছেন, গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে, দেশ হইতে দেশান্তরে। পরণে সেই দরিদ্র ভারতবাসীর লজ্জা নিবারণের পক্ষে যৎসামান্য দুটি বস্ত্রখণ্ড। ভুলিলে চলিবে না। তাঁহার এই পোশাকও বড় উপযুক্ত, বড় দেশজ, বড় প্রতীকী। হাতে দীর্ঘ শীর্ণ যষ্টি। তাঁহার সহিত আকারে প্রকারে ওই যষ্টিটারও যেন সুদূর মিল রহিয়াছে। রস মরিয়া ওই যষ্টি যেমন ঋজু ও কঠিন হইয়াছে, জীবনের সমস্ত উপভোগ, আমোদ, আনন্দ ইত্যাদিকে ত্যাগ ও তপস্যার অনলে শুকাইয়া তিনিও ঋজু, রিক্ত, কঠিন। সেই কাঠিন্য কাহাকেও আঘাত করে না, কিন্তু সব আঘাতকেই অনমনীয়ভাবে প্রতিরোধ করে।’

‘বাবুরা, ধনিকেরা, গৃহীরা তাঁহাকে চিনে না। তাহারা শুধু মহাত্মা গান্ধীর জয় জোকার দিয়া ক্ষণিক আবেগ অনুভব করে মাত্র। মহাত্মাজি দেশের কাজ করিতেছেন, তিনিই দেশোদ্ধার করিবেন, আমাদের কিছু করিবার নাই, এইরূপ ধারণা লইয়া তাহারা বেশ নিশ্চিন্তে ইংরেজের গোলামি করিতেছে বা কালোবাজারিতে মুনাফা লুটিতেছে, ঘুস লইতেছে বা অন্যবিধ অপকর্ম করিয়া যাইতেছে। গান্ধীবাবা আছেন, ভালো কাজ তিনিই করিবেন।’

‘মাঝে-মাঝে ভাবি, তিনি এই দেশে জন্মগ্রহণ করিলেন, তবু কই দেশের তো কলঙ্ক ঘুচিল না। ইহাও কি সম্ভব যে তিনি এই দেশের বাতাসে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করিলেন, তবু এই দেশের বায়ু পবিত্র হইল না? তাঁহার চরণরেণু মাখিয়াও এই দেশের মাটি ধন্য হই;ল না।‘

ঝুমকোলতা বেড়া দিয়ে ঘেরা চানের জায়গাটায় ঢুকে আড়াল হল, কিন্তু তাতে কি?

ঝুমকোর টুকটুকে লাল শাড়ি, রাঙা গামছা আর ধপধপে শায়া যে বেড়ার ওপর। তারও কি শোভা কম? তাতেই নেশা লেগে যায় যে।

উঁকি মেরে মুখটা আবার চট করে সরিয়ে নেয় ভূষণ। তার মেজ কাকিমা চাল ধুতে এসে এদিকপানে চেয়ে কী যেন দেখছে।

দেওয়ালের দিকে সরে বসল ভূষণ, এ বাড়িটা একেবারে হাট। এত লোক যে কেন যেখানে সেখানে হুটহাট আনাগোনা করে তা বোঝা মুশকিল। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ভূষণ ঘরখানা দেখছিল। লকড়ির মাচানের নিচে কুঁইকুঁই শব্দ শুনে ভূষণ উঁকি মেরে দেখল, গোটাচারেক কুকুরছানা দলা পাকিয়ে আছে। বাড়িতে কুকুরের অভাব নেই, তারই একটা এসে এ-ঘরে বাচ্চা দিয়েছে। বাস্তবিক গান্ধীবাবার শিষ্য ছাড়া বোধহয় কারও পক্ষেই এ-ঘরে বাস করা সম্ভব নয়। বস্তা-বস্তা বীজধান, ভূসি, খোল আর রাজ্যের লকড়িতে ঘর পনেরোয়ানা বোঝাই। একটা বিটকেল গন্ধও থানা গেড়ে আছে। মাটির ভিতে নানা মাপের অজস্র ফুটো। লেপাপোঁছার বালাই নেই। এমন বুকচাপা দম আটকানো ঘরে তুলসীজ্যাঠাই থাকতে পারে, যার জন্য লড়ার কেউ নেই।

একটু কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিল ভুষণ, সেই ফাঁকে কখন চানটি সেরে বেরিয়ে পড়েছে ঝুমকোলতা। বেরিয়ে সোজা সেজোকাকির ঘরের ভিতর দিয়ে অন্দরমহল। তবে ভূষণ একেবারে বঞ্চিত হল না। উঠোনের তারে ভেজা শাড়ি মেলার জন্য মিনিটদুই দাঁড়িয়ে ছিল, তখন ভালো করে দেখে নিল।

এ-বাড়ির অন্দরমহল হল রাক্ষসপুরী। একবার যাকে গ্রাস করে নেয় তাকে আর সহজে ছাড়ে না। এই যে ঝুমকোলতা অন্দরে ঢুকল এর মানে হল, সে সংসারে সামগ্রী হয়ে গেল। আর ভূষণের জিনিস রইল না। ফের সেই রাত দশটার পর ঝুমকোলতা আবার ভূষণের হবে। রাক্ষসপুরীর কথা কি আর সাধে মনে হয় ভূষণের।

আর তুলসীজ্যাঠার ঘরে বসে লাভ নেই। ভূষণ বেরিয়ে এসে দরজার শিকল তুলে দিল।

বিয়ের মধ্যে যে আনন্দ আর রোমহর্ষ ছিল, তা বিয়ের আগে জানত কোন আহাম্মক? ভূষণ ভাবত, বিয়েটা একটা ব্যাপারই হবে বটে, কিন্তু তা যে এ-রকম ভালো, তা তার কল্পনাতেও ছিল না। যারা বিয়ে না করে থাকে, তাদের জীবনটাই বৃথা। এই যে তুলসীজ্যাঠা, কী নিয়ে যে বেঁচে আছে ভগবান জানে। মাঠেঘাটে ঘুরছে, হোমিওপ্যাথি করে বেড়াচ্ছে, আর দিনান্তে রামচরিতমানস বা গান্ধীর বই খুলে মুখ গুঁজে বসে আছে। অসুখ-বিসুখ হলে জলটুকু এগিয়ে দেওয়ারও লোক নেই।

অসুখের কথায় ভুষণ হঠাৎ নিজেই চমকায়, তাই তো। কথাটা তো জব্বর মনে পড়েছে। অ্যাঁ! এখন যদি তার অসুখ হয়, তাহলে ঝুমকোসুন্দরী কী করে? অ্যাঁ! ধরো জ্বর উঠে গেল পাঁচ-সাত ডিগ্রী, ভুষণ চোখ উলটে গোঁ-গোঁ করছে, ডাক্তার নাড়ি ধরে গম্ভীর মুখে বসে আছে আর ঘড়ি দেখছে, অ্যাঁ। তখন কী করবে ঝুমকো? বুকের অপর পড়ে, ‘ওগো, পায়ে পড়...’ এই সব বলবে না? অ্যাঁ! কাণ্ডটা কী হবে তখন!

বেজায় শীত পড়েছে এবার। সকালে রোদটাও বড্ড ঢিমে। একটা মোটা খদ্দরের চাদর জড়িয়ে ভুষণ বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। বন্ধুবান্ধবেরা আজকাল তাকে দেখলেই মুখ বেজার করছে। সেদিন ফণী তো বলেই ফেলল, উরে বাব্বা, তোর ঝুমকোলতার গল্প শুনতে-শুনতে যে আঁত শুকিয়ে গেল বাপ।

তা ভুষণই বা করে কী? ঝুমকোলতার কথা ছাড়া তার যে আর কথা আসছে না গত তিন-চার দিন। এখনও মেলা কথা বলার বাকি।

ছোলাখেত বাঁয়ে রেখে হনহন করে হাঁটছে ভুষণ। পাশের গাঁ হল মুনসির চক। গোকুল থাকে। এমনিতে গোকলেটা যাকে বলে গর্ভাস্রাব। ধান বলতে কান বোঝে। কিন্তু তার কাছে কথা বলে সুখ আছে। যাই বল না কেন, হাসি-হাসি মুখ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনবে, ফোড়ন কাটবে না, বিরক্ত হবে না, উঠি-উঠি করবে না, কাজ দেখবে না। আজ গোকলেকে পাকড়াও করতে হবে। পেটে ঝুমকোলতকার গপ্প ভুড়ভুড়ি কাটছে। না বললেই নয়। এ গাঁয়ের বন্ধুগুলো বড্ড সেয়ানা হয়ে গেছে।



মনসাতলায় অশ্বত্থ গাছে নীচে বাঁধানো জায়গাটায় কয়েকজন বসে আছে গোমড়া মুখে। একজঅন তুলসীজ্যাঠা। তিনি ওষুধের বাক্স খুলে শিশি তুলে-তুলে নাম দেখছেন ওষুধের। ওরে ও ভুষণ, কোথা যাস?

ভূষণ জ্যাঠার ডাক শুনে একটু থমকায়। তারপর বলে, এই যাচ্ছিলাম একটু, কাজেই।

এদিকে যে লম্বোদর প্রামানিকের হয়ে গেল। ঘাটখরচের যোগাড় নেই। একটু দেখবি বাবা?

ভূষণ একটু নরম হল। লম্বোদরের কী হল, বৃকোদরের কী হবে, দামোদরের কী হচ্ছে, এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারটাই বা কী আছে, তাই সে বোঝে না। যে যার মতো বেঁচে থাকছে, মরে যাচ্ছে, খাবি খাচ্ছে, দুনিয়ার তাই নিয়ম। থাক, যাক, খাক, তাতে তার কী?

তবু ভূষণ দাঁড়িয়ে গেল। যত যাই হোক, এই পাগোল লোকটার তো কেউ নেই, জীবনের স্বাদই পায়নি, মায়া হল ভূষণের।

--কী করতে হবে জ্যাঠা?

করার অনেক আছে। চারটে ছেলেপুলে, একটা মুখ্যু বউ, ঘরে দানাপানির জোগাড় নেই। তা সে না হয় পরে ভাবা যাবে। আগে ঘাটখরচা তো তোলা লাগে। এই এরা সব বসে আছে ওষুধের জন্যে, আমি নড়তে পারছি না। একটু গাইয়ের ঘরে-ঘরে ঘুরে খরচটা তুলে দিবি বাবা?

সে কী কথা? ঘুরব কেন? ঘাটখরচ নয় পকেট থেকেই দিয়ে দিচ্ছি!

তুলসীজ্যাঠা একগাল হাসলেন, দূর পাগল। ও বাহাদুরী ক’দিন? আজ লম্বোদর গেছে, কাল বিধু নস্কর যাবে, পরশু বিনোদ হাতি মরবে, কারোর ঘরে মামলোত নেই। ক’জনেরটা দিতে পারবি? তার চেয়ে ঘরে-ঘরে ঘোরা ভালো। পাঁচজনকে সমাজ-সচেতনও করা যায়, দশের কাজে নামানো যায়। যাবি বাবা?

ভূষণ তত্ত্বটা বুঝল না। তবে একটু আঁচ করল। কথাটা মন্দ নয়। একটু মাথা চুলকোল সে। তারপর বলল, আচ্ছা দেখছি।

যা বাবা, তুই পারবি।

দোনামোনা করে ভূষণ গাঁয়ের দিকে ফিরল। কাজটা খুব শক্ত নয়। সবাই তাকে চেনে। চাইলে দেবে।

দিলও। বেলা দশটা নাগাদ শুরু করেছিল ভূষণ। সাড়ে এগারোটার মধ্যে শ’আড়াই টাকা উঠে গেল। পাঁচ টাকা কম ছিল, সেটা নিজে পুরণ করে দিল। লম্বোদর যখন মাচানে চেপে শ্মশানে রওনা করল, তখন পড়ন্ত বেলা। চারটে ছেলেমেয়ে আর বউ—কিছুটা শোকে, কিছুটা খিদেয় আর কিছুটা ভবিষ্যতের ভয়ে কাঁদছে লুটোপুটি খেয়ে।

দৃশ্যটা বেশিক্ষণ দেখতে পারল না ভূষণ। ঘরদোরের যা চেহারা, তাতে বোঝা যায়, এদের নুন আনতে পান্তা জুটলে সেদিন ভোজ।

ফেরার সময় তুলসীজ্যাঠা ছাতাটা মেলে ধরে বলল, আয়, ছাতার নিচে আয়। মুখটা রাঙা হয়ে গেছে তোর।

জ্যাঠার এত কাছাকাছি কখনও হয়নি ভূষণ। আজ তার বড় জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, কীসের আনন্দে বেঁচে আছেন আপনি? কী সুখ পেয়েছেন জীবনে?

কিন্তু কথাটা সরল না মুখে।

আনন্দেরও তো কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। কে যে কী থেকে আনন্দ পায়! কখনও ঝুমকোলতার স্নানের দৃষ্যে, কখনও লম্বোদরের ঘাটখরচ জোগাড়ে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. পঠিত এবং অন্যতম প্রিয়। অসামান্য দক্ষতায় সাধারণ সূত্র অসাধারণ সমাপ্তিতে অর্থবহ হয়ে ওঠে। শীর্ষেন্দুর লেখা এমনই - বাহুল্যবর্জিত, আন্তরিক উত্তরণ।
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

    উত্তরমুছুন