দীপেন ভট্টাচার্যের গল্প : কোরিওলি বল

ঘুরন্ত নির্দেশতন্ত্রে অপকেন্দ্র বলের মতো আর একটি অলীক বল দেখা যায়। উহা কোরিওলি বল।


১.
বর্ষার জলে টলমল করে নদী দুলারী। দক্ষিণ থেকে কার্তিকের বাতাস তার তরল তল ছুঁয়ে চলে যায় উত্তরের হিমদেশে। আর সেই তলের ওপর এক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ভেসে চলে এক নৌকো, তার কালো রঙ মিশে যায় জলের কালো প্রতিফলনে। হঠাৎ হঠাৎ একটা কেন্দ্রীভূত আলো আঁধার চিরে নদীটাকে দুভাগ করে দিয়ে যায় আর তখনই নৌকোয় বসা দুজন মানুষ মিশে যায় পাটাতনের সাথে। দুলতে থাকে নৌকো, ছলকাতে থাকে জল।


আবারও ঘুরে আসে সার্চলাইট, তার শ্বাপদ দৃষ্টি নির্দোষ ঢেউয়ে প্রতিবিম্বিত হয়ে দুলারীকে করে তোলে বিচিত্র। কথা বলে না যাত্রী দুজন, দুটি সার্চলাইটের মাঝে তারা দাঁড় বায় নিঃশব্দে। দাঁড়ের চারদিকে জল ঘূর্ণি দিয়ে ওঠে, তারপর হালকা স্বরে ভেঙে পড়ে গলুইয়ের ধারে। হঠাৎ এক রাতের গাঙচিল উড়ে যায় নৌকোর গা ঘেঁষে। চমকে উঠে একজন বলে, "আহ, সাবধান!" চাপা স্বরে বলে তার সঙ্গী, "গলা চড়িও না।"

রাতের নদী বিস্তৃত থাকে অমাবস্যার আকাশের নিচে। তার গভীর জলে সেই কালো নৌকোর গতিতে কোন উৎসাহ না দেখিয়েই বিচরণ করে শেষ-বর্ষার মাছেরা। নদীর ঐ পারে সান্ধ্য আইনে নির্বাসিত শহরের সব আলো শ্বাসরোধ করে বসে থাকে সকালের অপেক্ষায়। সকাল হতেও হয়তো বেশি দেরি নেই। আরোহীদের একজন সন্ত্রস্ত চোখে তাকায় হাতঘড়ির দিকে, ভোর চারটা। পাশ থেকে হাত দিয়ে জল তুলে সে ঘুমন্ত মুখে ঝাপটা দেয়।

তির্যক রেখায় কার্তিকের মৃদু স্রোত পার হয়ে যায় নৌকো, এ'পাশের চরায় ঠেকলে দু'জন লাফিয়ে নেমে নৌকোটাকে ঠেলে দেয় স্রোতের মাঝে, ভরাট ভাটির আঁধারে ধীরে মিলিয়ে যায় সেটি। তীরের বালি পেরিয়ে অভিযাত্রীদল গিয়ে দাঁড়ায় একটা ছোট গাছের নিচে। কোথায় যেন রাতের পাখি ডেকে ওঠে তাদের চমকে দিয়ে।

কোন কথা না বলে তারা দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষায়। মিনিট পাঁচেক বাদেই দূরে একটা টর্চের আলো দেখা যায়। টর্চধারী কাছে এসে সরাসরি মুখ আলো ফেলে, তারপর সরিয়ে নেয়। "আপনাদের নাম?" জিজ্ঞেস করে এক যুবক কন্ঠ। "আরাত্রিক," উত্তর দেয় একজন। "তিষান," বলে অন্যজন। "আমি ক্রান্তিক, আপনাদের যোগাযোগ, আমার সঙ্গে আসুন।"

অনেক দিন পরে এই শহরে ঢোকে আরাত্রিক ও তিষান। অমানিশায় ভূতুড়ে ছায়া নিয়ে শহর দাঁড়িয়ে থাকে তাদের জন্য এক অজানা আশঙ্কায় । ক্রান্তিক তাদের নিয়ে যায় সরু গলির ঘুমন্ত পৃথিবীর মাঝে। তিষান কান পেতে শুনতে চায় দেয়ালের ঐ পাশে নিঃশ্বাসের শব্দ, কোথাও থেকে কি ভেসে আসছে মরাকান্নার ধ্বনি? সে জানে ঐ পাশে রয়েছে না-বলা অনেক কাহিনী, যে কাহিনীরা অপেক্ষা করছে ইতিহাসের ভারে হারিয়ে যাবার জন্য। হেঁটে চলে যায় তারা পুড়ে-যাওয়া কালো বাড়ির পাশ দিয়ে, দরজা জানালা ভাঙ্গা শূন্য অট্টালিকার সামনে দিয়ে। গত বছর পর্যন্ত মনে হয় এই শহর ছিল আধুনিক, আজ তা মধ্যযুগে নির্বাসিত। মড়কের ছোঁয়াচ লেগেছে তার আবরণে, তবে এবার প্রকৃতি নয়, মানুষ নিয়ে এসেছে মহামারী।

তিষান সামনে তাকায় আলো আঁধারে সঞ্চারমান ক্রান্তিকের অবয়বের দিকে। সতর্ক ক্রান্তিক প্রতিটি গলির মোড়ে কান ফেলে শুনতে চায় অনাকাঙ্ক্ষিত পদশব্দ।

পুবের আকাশে আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই বহু ছোট গলি ঘুরে তিনজন পৌঁছয় একটি পরিত্যক্ত দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়ির সামনে ছোট মাঠটি আগাছায় ভরে আছে। মাঠটি পেরিয়ে দরজা-ছাড়া বাড়িটিতে ঢোকে তারা। প্রায় ভাঙ্গা একটি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে একটি ঘরে গিয়ে বসে, তিনজন তিনটি চেয়ারে।

তারপর ক্রান্তিক জিজ্ঞেস করে, "এবার বলুন আপনারা কেন এসেছেন?"

আরাত্রিক অবাক হয়, "আপনি জানেন না?" মাথা নাড়ে ক্রান্তিক। কয়েক মুহূর্ত সবাই নিশ্চুপ থাকে।

তারপর আরাত্রিক বলে, "আপনি প্রফেসর বৈকালকে চেনেন?"

চমকে ওঠে ক্রান্তিক। "চিনি", উত্তর দেয় সে, "তবে ব্যক্তিগত্ভাবে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রকৌশলের ছাত্র ছিলাম। উনি পড়াতেন ভৌত বিজ্ঞান।"

আরাত্রিকের ভুরু কোঁচকায়। কেন্দ্র তাকে ঠিকমত সব খবর দেয় নি। "আপনার তাহলে কোন ধারণাই নেই আমরা কেন এসেছি?" আবারও জিজ্ঞেস করে আরাত্রিক, অনেকটা অভ্যাসবশত, অনেকটা কৌতূহলে যেন ক্রান্তিক দুবার না বললে তার অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। অথচ সে জানে ক্রান্তিকের কিছু জানার কথা নয়। কিন্তু এবার ক্রান্তিক না বলে না। দুটো হাতের পাতা একসাথে করে আঙুলগুলো একে অপরের পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে শক্ত মুঠি করে সে, তারপর সমতল কন্ঠে প্রশ্ন করে, "আপনারা কি প্রফেসরকে মারতে এসেছেন?"

বদ্ধ ঘরের মাঝে "মারতে এসেছেন" কথাদুটি আবাস্তব শোনায় না। যুদ্ধের সময় এটাই তো স্বাভাবিক। অধৈর্য হয়ে মাথা নাড়ায় আরাত্রিক, সে এই প্রশ্ন শুনতে প্রস্তুত ছিল না। "আমরা আততায়ী নই, আপাতত পরিস্থিতির মূল্যায়ণ করতে এসেছি। আপনি প্রফেসর সম্পর্কে কী জানেন?"

বাইরে ভোর হতে শুরু করে। ঘরের একটি জানালা ময়লা সাদা পর্দায় ঢাকা। তিষান জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে রাস্তা দেখে। এখনও নির্জন। পছন্দ করে না তিষান এই শহরের সকাল। তার মনে পড়ে তুরা শহরের সকাল নতুন দিনের অনিশ্চয়তায় তাকে সব সময় অস্থির করে রাখত। সারা শহর যখন আলোয় উচ্ছ্বসিত, প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত সে। কিন্তু আজ যুদ্ধের উন্মাদনা সমস্ত অনিশ্চয়তা দূরে ঠেলে দিয়েছে। অচঞ্চল চোখে রাস্তায় চিতার খোঁজে তাকিয়ে তাকে সে। ভেতরে আরাত্রিক ও ক্রান্তিক নিচু স্বরে কথা বলে।

মুঠি খোলে ক্রান্তিক। বলে, খুব শান্ত স্বরে, "প্রফেসর সম্বন্ধে যা খবর আমার জানা তা অনেক মুখ ঘোরা। যুদ্ধ শুরুর দ্বিতীয় দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে চিতারা হত্যা করে। তাদের কাছে কোন একটা তালিকা ছিল। আমাদের আজও ধারণা নেই সেই তালিকা কে তৈরি করতে পারে। কিছু শিক্ষককে তারা ধরে নিয়ে যায়। আমাদের প্রফেসর তাদের মধ্যে ছিলেন। তাদের বেশির ভাগের ভাগ্যে কি হয়েছে জানি না। কিন্তু প্রফেসরকে ছ'মাস পরে ছেড়ে দেয়া হয়।"

তিষান জানালার কাছে দাঁরিয়ে ক্রান্তিকের কথা শুনছিল, প্রফেসরকে ছেড়ে দেয়ার কথা শুনে কাছে এসে বসে।

ক্রান্তিক বলে, "কেন তাকে ছেড়ে দেয়া হল তা আমরা কেউ জানি না। অনেকের ধারণা উনি চিতাদের সাথে একটা রফা করেছেন। আপনাদেরও বোধহয় তাই মত। কী ধরনের রফা হয়েছে সেটা সবারই প্রশ্ন। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার, প্রফেসরকে পড়ানো শুরু করতে বাধ্য করা হয়েছে।"

তিষান খুব আশ্চর্য হয়, বলে, "আপনি বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা, তাতে ক্লাস হচ্ছে আর ছাত্ররা পড়ছে?"

"নিশ্চয়।" ক্রান্তিক অবাক হয় কেন্দ্রীয় একজনের অজ্ঞতা দেখে। সে জানে না তিষান কেন্দ্র থেকে আসে নি। এই অভিযানের আগে তাকে ডাকা হয়েছে আরাত্রিককে সাহায্য করার জন্য।

"কিন্তু আপনারা শুধু প্রফেসরকে নিয়েই এত চিন্তিত কেন? আরো তো অনেকেই আছে যারা চিতাদের সাথে সরাসরি সহযোগিতা করছে, তাদের পথ দেখিয়ে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে, মানুষ খুন করছে, প্রকাশ্যে বিবৃতি দিচ্ছে, তাদের নিয়ে আপনাদের কোন ইন্টারেস্ট নেই?" জিজ্ঞেস করে ক্রান্তিক।

প্রশ্নটি আশা করছিল আরাত্রিক। কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন করে সে, "আপনার নেই?"

এবারও ক্রান্তিক এমন উত্তর দেয় যা আরাত্রিককে অবাক করে। "আছে," বলে পাশের ঘর থেকে একটা খাতা নিয়ে আসে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই ক্রান্তিক বলতে থাকে, "যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই আমি কিছু জিনিস লিখে রাখি। আমার জানা মতে কোথায় কোথায় হত্যাকাণ্ড হয়েছে, কোন কোন বুদ্ধিজীবীকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এইসব তথ্য তারিখসহ এখানে লেখা আছে। যারা সহযোগিতা করছে তাদের নামও আছে।"

মানুষকে কাছে থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে আরাত্রিক লক্ষ করতে শিখেছে। সে লালিত হয়েছে এমন এক বিরুদ্ধ পরিবেশে যেখানে বেঁচে থাকার জন্য তাকে এই বিশেষত্বটি অর্জন করতে হয়েছে। মানুষের চরিত্রকে সে বুঝতে পারে তাকে কিছুক্ষণের জন্য দেখেই : তাদের উচ্চারণ, চাহনি, হাতের গতি, বসার ভঙ্গি দেখে সে বলে দিতে পারে তাদের গভীরতা, ঝোঁক, মানসিকতা। এতক্ষণ পরে সে বুঝতে পারে কেন ক্রান্তিক এই শহরের যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু সে কি জানে তাদের উদ্দেশ্য? ক্রান্তিক বুদ্ধিমান যুবক, সে কি আন্দাজ করতে পারে নি প্রফেসরের গুরুত্ব? আরাত্রিক ক্রান্তিকের লেখা চিতাদের সহযোগীদের তালিকাটা দেখে। অনেক নামের সম্মেলন, তার মাঝে পরিচিত কয়েকটি নাম চোখে পড়ে তার। ভুরু কুঁচকে যায়, রাগে, বিরিক্তিতে। সুযোগ থাকলে এদের বিচারের ব্যবস্থা করত সে।

"আমরা প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করতে চাই," বলে আরাত্রিক, "আপনি কি সেই ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?"

"আপনারা আজ বিশ্রাম করুন। পাশের ঘরে খাবার আর বিছানা আছে। আমি রাতে আসব।" ক্রান্তিক আরাত্রিকের প্রশ্নের উত্তর দেয় না। আরাত্রিক বোঝে ক্রান্তিকের ওপর নির্ভর করা চলে।

সারাদিন বিশাল একঘেয়েমিতে কেটে যায় সময়। আরাত্রিক ও তিষান পালা করে ঘুমায়। দুপুরে বোয়াল মাছের মত বিশাল সামরিক বিমান ভেসে যায় বাড়ির ওপর দেয়াল কাঁপিয়ে দিয়ে।


২.
অনেক দিন আগে, প্রায় দশ হাজার বছর আগে এক নিওলিথ মানুষ বেরিয়ে এসেছিল তার পাহাড়ী গুহা থেকে শিশির ভেজা সকালে। তার সামনে – কিছু ছোট সবুজ গাছ পেরিয়ে – বহু নিচে একটা উপত্যকা নিজেকে বিছিয়ে রেখেছিল লাল, হলুদ আর বাদামী গাছের আবরণে। উপত্যকার মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছিল এক স্বচ্ছ নদী। তারপর নদী পেরিয়ে জংলী সবুজ ঘাসের মাঠ, তাতে ফুটে ছিল নীল-বেগুনি ফুল। অবশেষে মাঠের প্রান্তরে দিগন্তের ধারে কুয়াশার মাঝে জেগে ছিল স্তরে স্তরে নীল পাহাড়।

সূর্য উঠছে এই পাহাড়ের পেছন দিয়ে। ওপরে নীল নীল আকাশ, চোখ তুলে তাকায় নিওলিথ মানুষ সেই দিকে। আদিম চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে আকাশ চিরে চলে যাওয়া দুটি শুভ্র সরলরেখা। ধীরে, খুব ধীরে অসীম নীলে তুলোর মত ধোঁয়া ছড়িয়ে চলে, সেই রেখার মাথায় সূর্যের আলোকে প্রতিবিম্বিত করে, কোন ধাতব বস্তু। ভেসে যায় খুব ধীরে মাটির অনেক ওপর, বাতাসের তরলে উড়ে যায় এক বিমান বোয়াল মাছের মত।

এ কোন প্রাণী, ভাবে সেই নিওলিথ জীব, যে আকাশের গা ঘেঁষে চলে? একটা চাপা শব্দ আস্তে আস্তে উপত্যকার ওপর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ধাতব পাখি নিচু স্বরের তীক্ষ্ণতায় ভরিয়ে দেয় জনশূন্য আদিম প্রান্তর, তার ইঞ্জিন থেকে নির্গত ধোঁয়া অতি-উচ্চতার স্ফটিক ঠাণ্ডায় ঘনীভূত হয়ে যায়।

তার পাহাড় ও নিচের উপত্যকাটি ছাড়া নিওলিথ মানুষ জানে না এই পৃথিবীতে আর কি আছে। তার গোষ্ঠী থেকে সে হারিয়ে গেছে বহুকাল। আজ সে চিন্তা করে পাহাড়ের ঐ পারে বন পেরিয়ে কি রহস্য সঞ্চিত আছে তার জন্য। সেখানে বাস করে কি আকাশের গায় ঝলসে ওঠা পাখিরা? নাকি সেই পাখি এসেছে রাতের আকাশের গায়ে জ্বলে থাকা আলোর বিন্দুগুলো থেকে? ঐ পাখি কি দেখতে পাচ্ছে এই নিচে, বহু নিচে ক্ষুদ্র মানবকে? জানছে তার অস্তিত্ব?

অতি উচ্চতার বাতাস ধীরে ধীরে ধোঁয়ার সরলরেখাকে সাপের মত বাঁকিয়ে দেয়, দিগন্তে মিলিয়ে যেতে থাকে ধাতব পাখি। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে নিওলিথ মানুষ। এক অসীম নিসঙ্গতায় ভরে যায় মন। এই পাখি কি দেখেছে তাকে? জেনেছে তার অস্তিত্ব? সে কি জানে তার স্বপ্নের কথা? সে কি বলবে কাউকে আদিম বুনো পাহাড়ে দেখেছে সে এক সঙ্গহীন মানুষ? বিশাল আকাশের নিচে হৃতমান নিওলিথ প্রাণী প্রার্থনা করে ঐশ্বরিক পাখির কৃপা।


প্রফেসর বৈকালের প্রথম ক্লাসটির কথা মনে করে তিষান। উনি বলেছিলেন চেতনার কথা, যোগাযোগের কথা, স্পৃহার কথা। নিওলিথ মানুষটির কথা তিনিই বলেছিলেন। সেই নিওলিথ সময়ের প্রাচীন মানুষটির কাছে সব ছিল রহস্যে ঢাকা, পৃথিবীর পুরোটাই তার কাছে ছিল অজানা। রাতের আঁধারে তার চারদিকে বিচরণ করত কিংবদন্তীর অস্তিত্বরা, দিনের আলোয় সে ভাবত পাহাড়ের ঐ পাশে কী আছে? তার স্বপ্ন ছিল আবার মানুষের সঙ্গ পাবার, সে কল্পনা করত তার অস্তিত্বের কথা আবার জানবে আরও পাঁচটি মানুষ। প্রফেসর এটাকে বলতেন নিওলিথ স্বপ্ন। মানুষ বাঁচতে চায়, কিন্তু একা বাঁচতে চায় না, তার বাঁচার অর্থ নিহিত থাকে অন্য লোকের স্মৃতির মাঝে। তাই আকাশের বিমান তাকে দেখতে পেয়েছে কিনা, তার অস্তিত্ব জানতে পেরেছে কি না এটা সেই নিওলিথ মানুষের কাছে বড় ছিল।


৩.
রাতে ফিরে আসে ক্রান্তিক। অন্ধকার ঘরে অভিযাত্রীদের সে বলে প্রফেসর ক্যাম্পাসের ভেতর থাকেন। কিন্তু চিতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে পাহারা বসিয়েছে। পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে তারা। তবে কাল সকালের মধ্যে সে হয়তো একটি পরিচয়পত্র জোগাড় করতে পারবে, সকালে প্রফেসরের ক্লাস আছে।

আরাত্রিক তাকায় তিষানের দিকে। একজনের যেতে হবে। অন্ধকারে আরাত্রিককে দেখতে না পেলেও তিষান তার দৃষ্টি টের পায়, সে বোঝে। যুদ্ধের আগে তিষান প্রফেসরের ছাত্র ছিল, সেই সূত্রেই সে আজ এই অভিযানের শরিক, তার চেয়ে ভাল মূল্যায়ণ আর কে করতে পারবে?

ক্রান্তিক দুজনের মৌনতা লক্ষ করে। তারপর সন্ধিগ্ধ স্বরে বলে, "আপনারা এখনো বলেন নি আপনাদের পরিকল্পনা, প্রফেসরকে নিয়ে আপনারা কী করতে চান। তুরার যোগাযোগ হিসেবে এটা জানা আমার কর্তব্য, আর এই বিষয়ে আমার মতামত নেয়া উচিত আপনাদের।"

আরাত্রিক বোঝে ক্রান্তিককে কিছু বলা দরকার, কিন্তু সে নিজেই নিশ্চিত নয় তাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে। আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরাত্রিক বলে, "আমাদের ধারণা প্রফেসর চিতাদের জন্য কোন বিশেষ অস্ত্র তৈরি করছেন। সেটা কি এবং তাতে কতদূর অগ্রগতি হয়েছে তাই জানতে আমরা এসেছি।"

ক্রান্তিক বিশ্বাস করতে পারে না আরাত্রিক সিরিয়াস। "কী বলছেন আপনি? চিতারা মানুষ মারতে ব্যস্ত, যা অস্ত্র দরকার সব আসছে রাজধানী থেকে। এই মাথা-খারাপ সময়ে কে চিন্তা করবে গবেষণার কথা? কোথায় তাদের গবেষণাগার, কোথায় তাদের বিজ্ঞানী প্রকৌশলী?" সে গলা চড়িয়ে বলে।

"সেই সম্বন্ধেই আমরা নিশ্চিত হতে এসেছি," উত্তর দেয় আরাত্রিক,"স্বাভাবিক বুদ্ধি আপনি যা বলেছেন তাই বলে। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত চিতারা কোন বিশেষ অস্ত্রের সন্ধান করছে না যে অস্ত্রের সাহায্যে এই যুদ্ধ জেতা খুব সহজ হয়ে যাবে?"

ক্রান্তিক তবুও অবিশ্বাসে মাথা নাড়ায়। সে ধারণাই করতে পারে না যুদ্ধের এই কঠিন সময়ে দুজন যোগ্য সৈনিককে তুরায় পাঠানো হয়েছে একটা নিতান্ত কাল্পনিক ও তাত্ত্বিক সমস্যা সমাধানে। তিষানের বিশ্বাস চিতাদের ধ্যান-ধারণায় ধৈর্য সহকারে সময় নিয়ে সৃজনের দর্শন নেই। তার মনে হয় কেন্দ্রের কারুর প্রফেসরের ওপর ব্যক্তিগত আক্রোশ রয়েছে।

অন্ধকার গাঢ় হয়ে ওঠে। তিষান উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। বাইরে সান্ধ্য-আইন, রাস্তার বাতি নিভে থাকে। তবু আকাশের আবছা আলো ঘরে ঢোকে, আরাত্রিক ও তিষানের অবয়ব দেখা যায়। বাইরে চিতারা গাড়িতে টহল দেয়।

আরাত্রিক ক্রান্তিকের দ্বন্দ্বের আভাস পায়। কিন্তু এতদূর এসে সে ক্রান্তিকের জন্য এই অভিযানকে ভেস্তে দিতে পারবে না। সে বলে, "ক্রান্তিক, আপনার উদ্বেগ আমি বুঝতে পারছি। আমি আগেই বলেছি আমাদের কাজ পরিস্থিতি মূল্যায়ণের, সংবাদ সংগ্রহের। কাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিষান যাবে প্রফেসরকে দেখতে, যদি সম্ভব হয় কথা বলবে তার সঙ্গে। আমি বিশ্বাস করি প্রফেসর সৎ মানুষ, বাধ্য হয়ে চিতাদের সাথে সহযোগিতা করলে উনি আমাদের তা বলবেন। যদি সম্ভব হয় আমরা তাকে শহরের বাইরে নিয়ে যাব।"

আবেগ দিয়ে কথাগুলো বলে আরাত্রিক। ক্রান্তিক চুপ করে থাকে, তারপর বলে, "কাল সকালে ন'টায় প্রফেসরের ক্লাস।"

পাশের ঘরে ক্রান্তিক ক্যামেরায় ছবি তোলে তিষানের, তারপর দুজনকে বলে রাতে তার জন্য অপেক্ষা না করতে, সকালে সে ফিরবে পরিচয়পত্র নিয়ে।

নিওলিথ মানুষ ফিরে আসে গুহাতে। গুহার কোণায় জ্বলে আগুন। গুহার একপাশে একটা বড় পাথর, পাথরের ওপর ছোট একটা অবতল জায়গা। সেখানে রাখা আছে রং। লাল-বাদামি মাটি, সবুজ পাথরের গুঁড়ো আর গাছের বাকল তেলের সাথে মিশিয়ে আগুনের উত্তাপে নিওলিথ মানুষ তৈরি করেছে রং। একটা ছোট ডাল নিয়ে তরল রং তুলে আধো অন্ধকারে সে আঁকে ছবি, গুহার দেয়ালে। আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির ছবি। সেই পাখি ঝলকায় সূর্যের আলোতে। পাখির পেছনে সে আঁকে দুটি রঙ্গিন মেঘের রেখা। আকাশের বিমান উড়ে যায় নিওলিথ গুহায়।


৪.
চিতাদের বেষ্টনি পার হয়ে যায় তিষান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত চত্বর নির্জন। শরতের শুভ্র সকাল কোন অশুভ ইঙ্গিত বহন করে না। শুধু তার প্রিয় চেস্ট্নাট গাছগুলো কেটে ফেলেছে চিতারা। প্রফেসরের ক্লাসে দশ-বারোজন ছাত্র-ছাত্রী বসে আছে। তিষানকে ঢুকতে দেখে তারা একটু চমকায়, এদের মধ্যে দু'একজন হয়তো চিনল তাকে। সে সবচেয়ে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসে। যুদ্ধের মাঝে এত জ্ঞানসঞ্চয়ের আগ্রহ দেখে তিষান আশ্চর্য হয়। কিন্তু ভৌত বিজ্ঞান কোন যান্ত্রিক সূত্র মুখস্থ করে শেখা যায় না, যে শিক্ষার্থীরা ইতিহাসের সাথে যুক্ত নয় তাদের জ্ঞানার্জনের চেষ্টা বৃথা, প্রফেসর নিজে এই কথা বলতেন। ছাত্র-ছাত্রীরা অস্বস্তিতে তিষানের সামনে বসে থাকে। তাদের কাউকে কি সে চেনে? বাঁ হাত দিয়ে কোটের পকেটে ধাতব পিস্তলটা অনুভব করে নেয় সে।

মিনিট কয়েক পরেই ঢুকলেন তিনি। তাঁকে যেমন মনে করে রেখেছিল তিষান, সেই মানুষটি কিন্তু ঢুকল না। চুপসে-যাওয়া মানুষটি তাঁর অতীত ঔজ্জ্বল্যের স্মৃতি মাত্র। শুধু চোখদুটি ছাড়া। সেই অভ্রভেদী চোখ সবার মাথা পেরিয়ে তিষানকে চিনে নিল এই মুহূর্তেই, কিন্তু বিস্মিত হল না। প্রফেসর যেন তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এই মানুষটির পক্ষে কি চিতাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া সম্ভব? এক হাতে একটা লাঠি আর একটা পায়ে ভর দিয়ে হাঁটছিলেন তিনি।

তিষান তার খাতা খোলে। প্রফেসর পকেট থেকে চশমা বের করে পরেন। মনে পড়ে প্রতিটি লেকচারের আগে প্রফেসর সেই বিষয়ের ঐতিহাসিক পটভূমি দিতেন, সেই বিজ্ঞানের উদ্ভব ও দর্শনের কথা বলতেন। তিনি কি এখনও সেই অভ্যাস বজায় রেখেছেন? যুদ্ধের দামামা তিষানের মন থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায়। সে কোন সৈনিক, গুপ্তচর বা ন্যায়যোদ্ধা নয়, সে আজ আবার জ্ঞানের ছাত্র। সে ভুলে যায় প্রফেসর চিতাদের সহযোগী হতে পারেন।

বৈকাল বলেন, "আজ আমাদের আলোচনার বিষয় হল অজড়ত্বীয় নির্দেশ-ফ্রেম। কোন কণার অবস্থান বোঝাতে গেলে নির্দেশ-ফ্রেমের দরকার হয়। নির্দেশ-ফ্রেম হতে পারে জড়ত্বীয় বা অজড়ত্বীয়। যে সমস্ত নির্দেশ-ফ্রেম তার অধীনস্থ কণাসমূহের তুলনায় ত্বরণে ভ্রমণ করে না সেই সমস্ত নির্দেশ-ফ্রেমকে জড়ত্বীয় বা ইনারশিয়াল নির্দেশ-ফ্রেম বলা হয়।"

অধীনস্থ!? পদার্থবিদ্যায় প্রফেসর নতুন সংজ্ঞা ব্যবহার করছেন, প্রফেসর এইভাবে পড়াতেন না, ভাবে তিষান।

"অন্যদিকে অজড়ত্বীয় ফ্রেমেরা তাদের অধীনস্থ কণাদের অবস্থানের তুলনায় ত্বরণে ভ্রমণ করে।"

আবার? প্রফেসর নিজের কথাকেই cliche পরিণত করছেন। তিষানের বাঁ-হাত কোটের পকেটে ঠাণ্ডা ধাতব পিস্তলের গা স্পর্শ করে।

"মহাবিশ্বে সঠিক জড়ত্বীয় ফ্রেম বলে কিছু নেই, কারণ যে কোন ফ্রেমই রৈখিক বা আবর্তীয় এই দুই ধরণের ত্বরণে বন্দী। আমাদের আপাতদৃষ্টির জড়ত্বীয় ফ্রেম হচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠ। কিন্তু পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে ঘুরছে, কাজেই পৃথিবীপৃষ্ঠ অজড়ত্বীয়। আবার পৃথিবীর অক্ষকেও জড়ত্বীয় বলা যাবে না, কারণ সে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে বাধ্য। আবার সূর্য আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরছে, আমাদের গ্যালাক্সি অন্য একটি গ্যালাক্সিপুঞ্জের দিকে দ্রুতগতিতে পলায়ন করছে।"

বন্দী, বাধ্য, পলায়ন! প্রফেসর কি একটু বেশি করে ফেলেছেন না? তিষান বিরক্ত হয়, বিরক্তিতে বাঁ-হাতটা পকেটের পিস্তল আঁকড়ে ধরে।

"ঘুরন্ত নির্দেশ-ফ্রেম অজড়ত্বীয়। এই এই ঘূর্ণনের ফলে কিছু ছদ্ম-বল দেখা যায় যেমন অপকেন্দ্র বল ও কোরিওলি বল। এই বলগুলোকে অলীক বলা হয়, কারণ জড়ত্বীয় ফ্রেমে এদের কোন অস্তিত্ব নেই।"

তিষানের বাঁ-হাত উঠে আসে, কিন্তু তাতে পিস্তল থাকে না। প্রফেসর তার দিকে তাকালে সে বলে, "আপনি কেন তাদের অলীক বলছেন? আমরা যখন চলন্ত গাড়িতে বসে থাকি এবং সেই গাড়ি যদি ডানদিকে মোড় ঘোরে তাহলে আমরা বাঁয়ে হেলে পড়ি। আমাদের ওপর তখন অপকেন্দ্র বল কাজ করে। আমার তো মনে হয় সেটা একেবারেই অলীক নয়।" কথাগুলো বলে তিষান প্রায় হেসে ফেলে।

সবাই পেছনে ফিরে তিষানের দিকে তাকায়। প্রফেসর কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তিষানের কৌতুক তাঁর অলক্ষিত থাকে না। তারপর চার বছর আগে তিষানের প্রশ্নের উত্তর যেভাবে দিয়েছিলেন ঠিক সেই উৎসাহ নিয়েই বলেন, "হ্যাঁ, আপনার নির্দেশ-ফ্রেম যদি গাড়ি হয়, তবে আপনি অপকেন্দ্র বল অনুভব করবেন। কিন্তু মনে রাখতে হনে মোড় ঘোরার সময় গাড়ি সমবেগে যাচ্ছে না, ত্বরাণ্বিত হচ্ছে। কাজেই গাড়িটা হচ্ছে অজড়ত্বীয় ফ্রেম। আমি যদি বাইরে থেকে আপনাকে দেখি আমি বলব আপনার শরীর ইনারশিয়া বা জাড্যর কারণে মোড় ঘোরার সময় আগের সরল পথে ভ্রমণ করতে চাইছে, গাড়ির নতুন পথে যেতে চাইছে না। সেইখানে অপকেন্দ্র বল বলে কিছু নেই।"

মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় তিষান। নিজেকে এই পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে অ্যাবসার্ড লাগে তার।

প্রফেসর বলে চলেন, "এইরকম আর একটি জনপ্রিয় ছদ্ম-বল হচ্ছে কোরিওলি বল। ঘূর্ণীয়মান পৃথিবীর বুকে কোন কণা ভ্রমণ করলে তার ওপর কোরিওলি বল কাজ করে। পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত নদী এই বলের ফলে ডানদিকে সরে ও প্রবাহের ডান পার ভাঙতে থাকে।"

প্রফেসর আবার একটা নিরস ভঙ্গীতে লেকচার দিতে থাকেন। তিষানের সামনে বসা ছাত্র-ছাত্রীরা ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলে, তার এই ক্লাসের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তিষান ভাবে যুদ্ধের সময় কে মাথা ঠিক রেখে অজড়ত্বীয় নির্দেশ-ফ্রেম বুঝতে চাইবে? কিন্তু তা'হলে ক্লাসে আসা কেন? দেশ জুড়ে হত্যাকাণ্ডের সময় এই অভিনয়ের অর্থ কি? মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ সব, একটা সামান্য ডিগ্রীর লোভে বসে আছে আতঙ্কিত মৃত শহরে। হঠাৎ সীমাহীন রাগে তিষান কাঁপতে থাকে। বাঁ-হাতটা আবার পকেটের পিস্তল চেপে ধরে। বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে জ্ঞানের সাথে।

চেয়ার ঠেলার শব্দে তিষানের সম্মোহন ভেঙ্গে যায়। আজ প্রফেসর আগে ক্লাস ভেঙ্গে দিয়েছেন। বাঁ-হাত পিস্তলটা ছেড়ে পকেট থেকে বের হয়ে আসে। দুহাত মুঠিবদ্ধ করে তিষান বসে থাকে। তার গণনা ভুল হয় না। প্রফেসর ধীরে এগিয়ে আসেন, "তিষান?" হাঁটতে অসুবিধা হয় তাঁর, ক্লান্তি ছড়িয়ে থাকে সমস্ত মুখে। তিষান মুঠিবদ্ধ হাতদুটি থুতনির নিচে রাখে, উত্তর দেয় না। উত্তর দেবার সময় এখনও আসে নি। যুদ্ধক্ষেত্রে না-দেখা শত্রুর দিকে গুলি করা সম্ভব, কিন্তু অতিপরিচিত মানুষটি আজ যতই অপরিচিত হোক সে অচেনা বা না-দেখা নয়, বোঝা যায় না তার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করা উচিত। তার প্রতারণাকে না বোঝা পর্যন্ত পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না। তিষান ভাবে যদি সে প্রফেসরকে চিনে থাকে, তিনি নিজেই সব বলবেন, তিনি যদি দরকার মনে করেন।

"তিষান, নিচে ল্যাবরাটরিতে এসো, ওখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায়।"


৫.
দশ হাজার বছর পর সেই নিওলিথ গুহা ঢাকা ছিল লতাগুল্মে। সেই প্রাচীন মানুষটির বসবাসের কোন চিহ্ন ছিল না পাথরের মেঝেতে, কিন্তু দেয়ালের গায়ে ছিল তার আঁকা চিত্রকর্ম। একটি ছোট গ্রাম ছড়িয়ে থেকে নিচের উপত্যকায়। একদিন গ্রামের ছেলেমেয়েরা পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে খুঁজে পেল সেই গুহা। তারপর সেই নিওলিথ মানুষের ছবি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে এল মানুষেরা। একদিন এক পর্যটকদলের সাথে আসে এক বৈমানিক। সে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে দেয়ালের গায়ে আঁকা সেই ধাতব পাখির দিকে। সেই পাখির পেটে আঁকা আছে কয়েকটি দাগ দিয়ে একটি চিহ্ন। চিহ্নটি তার চেনা। তার বিমানের নিচে আঁকা আছে একই চিহ্ন।

গুহা থেকে বের হয়ে আসে বৈমানিক।


নিচে যন্ত্রপাতির মাঝে তিষানকে বসান প্রফেসর। এই কয়মাসের ক্লান্তি তার কন্ঠে বাজে, "তুমি ক্লাসের ছাত্রদের নিয়ে চিন্তা করো না, তোমার খবর চিতাদের কাছে পৌঁছানোর সাহস তাদের হবে না। ঐ ধরনের লোক্জন বর্তমানে বাঁচে বটে, ইতিহাস বাঁচে না।" তিষান মৃদু হাসে।

"গত বছর পর্যন্ত আমি ভাবতাম তুরা বোধহয় সভ্যতার শেষ প্রান্তে বাস করছে," প্রফেসর বলতে থাকেন, "আমি ভাবতাম এখান থেকে উত্তরের পাহাড়ে ও নদী পেরিয়ে দক্ষিণের বনে হারিয়ে যাওয়া খুব সহজ। আর এখন দেখ এর থেকে বড় কারাগার আর নেই।" চশমা খুলে জানালা পেরিয়ে রাস্তার দিকে তাকান, তারপর জিজ্ঞেস করেন, "তুমি কেন এসেছ?"

"আপনি চিতাদের সাথে সহযোগিতা করছেন কিনা জানতে," তিষান উত্তর দেয় বৈকালের চোখের দিকে তাকিয়ে, সহজ উত্তর।

"সহযোগিতা? করছি। যখন মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য বনে জঙ্গলে ঘুরছে তখন আমি পড়াচ্ছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো নিশ্চয় চিতাদের নৈতিক শক্তি যোগাচ্ছে। কাজেই সহযোগিতার দায় আমি অস্বীকার করছি না।"

"প্রফেসর, অনেকেই পড়াচ্ছেন। আপনার নাম যুক্ত হলে চিতাদের শাসন হয়তো আর একটু বৈধ হবে, কিন্তু তাতে তাদের ক্ষমতার বিরাট পরিবর্তন হবে না। আমি এসেছি অন্য কারণে। আমি জানতে চাই আপনি চিতাদের জন্য কোন অস্ত্র তৈরি করছেন কিনা?" প্রশ্নটা করে ফেলে তিষান, প্রফেসর কি হেসে উঠবেন?

"আমার কথা শুনতে হলে তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে, তিষান। আমি জানি না তোমার হাতে কত সময় আছে। আমাকে সরিয়ে দেবার কোন পরিকল্পনা কি তোমার ছিল?" কথাগুলো বলে প্রফেসর হাসেন, দুঃখের হাসি। তিষান কিছু বলে না।

প্রফেসের জানালার কাছে যেয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলেন, "যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে ওরা আমাদের ধরে নিয়ে যায় রাতের আঁধারে। আমাকে একটা ঘরে আটকে রেখেছিল আর একজনের সঙ্গে, তিনি ছিলেন একজন দর্শনের অধ্যাপক। দু'দিন তারা আমাদের না-খাইয়ে রাখল। তৃতীয় দিন রাতে চিতাদের এক ক্যাপ্টেন আমাকে নিয়ে যায়, চোখ বেঁধে দিয়ে ঝুলায়। ওরা এমন কিছু করল যাতে পায়ের আঙুলগুলো ভেঙ্গে যায়, হাঁটতে এখনো কষ্ট হয়।

"সেই ক্যাপ্টেন ছিল তরুণ, কতই বা বয়েস হবে, সাতাশ-আঠাশ। সে আমাকে বলত, 'আপনার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, আমি ডাক্তার পাঠিয়ে দেব।" যেদিন সে ডাক্তারের কথা বলতো সে'দিনই আমাত ওপর খুব অত্যাচার হত।

"পাশের কামরা থেকে প্রতিদিনই অমানুষিক চিৎকার শুনতাম। ক্যাপ্টেন নাকি একটা অত্যাচার যন্ত্র জোগাড় করেছে। একদিন সে আমাকে ডেকে চা খাওয়াল, দেখা গেল সে চা-বিশারদ। তারপর প্রতি সপ্তাহে একবার করে তার ওখানে আমার ডাক পড়ত। সে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করতো, শিল্প সাহিত্যের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে সে আমার সাথে কথা বলতে চাইত। মোলায়েম ছিল তার ব্যবহার।

"তুমি ভাবছ সে আমাকে কিনতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু এই সমস্ত সময়ে অত্যাচারের মাত্রা কিছুমাত্র কমে নি।" বৈকাল জানালার কাছ থেকে ফিরে এসে চেয়ারে বসেন। বলতে থাকেন, "এর মাঝে আমার দর্শনের অধ্যাপককে অন্ধ করে দেয়া হলো। সেই অধ্যাপক আমাকে বলতেন, 'মানুষের ভেতরের দানব শুধু হত্যা বা অত্যাচারের মধ্যেই বহিঃপ্রকাশ করবে এমন নয়, সাধারণ জীবনে দৈনন্দিন ব্যবহারেই তা ফুটে উঠবে।' সেই অধ্যাপককে ক্যাপ্টেন আর বাঁচতে দেয় নি।"

দর্শনের অধ্যাপককে যে ক্যাম্পে মেরে ফেলা হয়েছিল সেই খবর তিষান কেন্দ্রে শুনেছে। তারা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে।

প্রফেসর বলেন, "তারপর তারা আমাকে ছেড়ে দিল।"

"ছেড়ে দিল?" তিষান যেন আশাহত, এই ফলাফল মেনে নিতে তার অসুবিধা হল। সে বলল, "কোন শর্ত ছাড়াই ছেড়ে দিল?"

"শর্ত ছিল," তিষানকে অনেকটা চমকে দিয়েই প্রফেসর বললেন, "ক্যাপ্টেন আমাকে সেই অত্যাচার যন্ত্রের ওপর কাজ করতে দিয়েছে।"

"কি বলছেন আপনি?" তিষানের বিস্ময়ের বাধ মানে না।

"ক্যাপ্টেন একজন প্রকৌশলী। তার অত্যাচার যন্ত্রের জন্য উচ্চ-ক্ষমতার তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দরকার, কোন কারণে ক্যাম্পে সেটি কাজ করছিল না। সে আমাকে জিজ্ঞেস করে এই ল্যাবরাটরিতে সেটা মেরামত করা যাবে কিনা। আমি তাকে হ্যাঁ বলি। তোমার পেছনে যন্ত্রটি কাপড় দিয়ে ঢাকা আছে।"

চমকে লাফিয়ে ওঠে তিষান। পেছনে তাকিয়ে দেখে শুভ্র চাদরে ঢাকা একটা একটা বিশাল বাক্স। সে ভেবেছিল লাল রঙ্গে রঞ্জিত থাকবে সেটা।

"আমি যন্ত্রটা এখানে নিয়ে এসেছি, আপাতত এটার হাত থেকে ক্যাম্প মুক্ত।"

"প্রফেসর, আপনি কি আসলেই এটার ওপর কাজ করবেন?" কেন্দ্রের কাছে তাহলে এই সংবাদই পৌঁছেছে, ভাবে তিষান।

"করব, ক্যাপ্টেন আমাকে তিন মাস সময় দিয়েছিল, আগামী সপ্তাহে মেয়াদ শেষ হচ্ছে।"

"আপনি ওটাকে ঠিক করবেন। তারপর কী হবে?" এক অশুভ অনিবার্য ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কাঁপতে থাকে তিষান, নিজের অজান্তে কোটের পকেটে হাত চলে যায়।

"শান্ত হও, তিষান। এই যন্ত্র চিতাদের হাতে পড়বে না।"

বৈকালকে অবিশ্বাস করে না তিষান। সে বলে, "আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম, প্রফেসর। কেন্দ্রে আপনাকে খুব দরকার।"

মৌন থাকেন বৈকাল। তাঁর কপালে ভেসে ওঠে চিন্তার রেখা। তাঁর এককালের প্রিয় ছাত্র আজ তরুণ সৈনিক, নিজের জীবন বিপন্ন করে এই মৃত শহরে এসেছে তাঁকে উদ্ধার করতে। গভীর কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন, উঠে যেয়ে তিষানের কাঁধে হাত রাখেন। তার মাঝে নির্ভরতার স্পর্শ থাকে। বলেন, "আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারব না তিষান, আমার এখানে অনেক কাজ। ক্যাপ্টেনের সাথে আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার একটা ব্যাপার আছে। সেই দ্বন্দ্বে তোমার ভূমিকা নেই। তোমার অভিযান এখানে শেষ হয়েছে, আমার জন্য চিন্তা কোর না।"

তিষান বোধ করে প্রফেসরের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক। সে বলে, "আপনি আমাকে সব খুলে বলুন সব, এই যুদ্ধের শেষে আমরা নাও থাকতে পারি।"

প্রফেসর আবার জানালার কাছে ফিরে যান। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলেন, "তুমি যখন দুলারী পার হয়ে ফিরে যাবে তখন দিগন্তের দিকে তাকিও। যদি বৃষ্টি নামে আকাশের পারে বিদ্যুতের খোঁজ করো। নদীর পারে কোরিওলি বলের প্রভাব দেখ। আর আকাশে সূর্যকে দেখ। সময়ের সাথে সূর্য অস্থিত হচ্ছে, তিষান। তার পিঠে কম্পন বাড়ছে দ্রুত, ভেতরের পারমাণবিক কেন্দ্রকীয় সংযোজন অপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সূর্যের ভেতরের অংশ তার পৃষ্ঠের তুলনায় ঘুরছে, তার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। আরা আগামী সপ্তাহে, বিষুবায়নের সময় পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহাকর্ষ তরঙ্গ। পৃথিবীর কেউ তার জন্য প্রস্তুত নয়।"

প্রফেসর ফিরে আসেন জানালা কাছে থেকে, নাটকীয় ভঙ্গীতে ডান হাত সাদা কাপড়ে ঢাকা অত্যাচার যন্ত্রের দিকে তোলেন, তারপর বলেন, "শুধু আমি ছাড়া।"

"এই অত্যাচার-যন্ত্র আজ আমার মহাকর্ষ তরঙ্গ নির্দেশক। সে শুধু মহাকর্ষ তরঙ্গই মাপে না, সে এই তরঙ্গের শক্তিকে অর্বুদ অর্বুদ গুণ বর্ধিত করে। আর দু'সপ্তাহ বাদে এই ল্যাবরাটরিতে ডেকেছি সেই ক্যাপ্টেনকে। তাকে বলেছি তার সাথে তুরা শহরের চিতা অধিনায়ককে নিয়ে আসতে। তারা দেখতে আসছে অত্যাচার যন্ত্রের কি রূপান্তর আমি করেছি।"

"কি বলছেন আপনি? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করে তিষান, "আপনি মহাকর্ষ শক্তির মাত্রা বাড়াতে পারবেন?"

"বোধহয়। ক্যাপ্টেন আর অধিনায়ক এই ঘরে আসলে আমি যন্ত্র চালু করব। এর পরিণতি কি হতে পারে আমার জানা নেই, হতে পারে এই ঘরের মাঝে সময়ের গতি বদলে যাবে।"

"আপনি বলছেন এই বিবর্ধিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গশক্তি সময় বদলে দিতে পারে এই ঘরের মাঝে? আর তুরার? তুরা শহরের কিছু হবে না?"

"আমার মনে হয় না। শোন, তিষান, তোমাকে এখন যেতে হবে। প্রতিদিন দুপুরে ক্যাম্প থেকে কেউ না কেউ আমার খবর করতে আসে।"

চলে যেতে চায় না তিষান, এই ঘরে তার অনেক কিছু জানার আছে। রাস্তার ও'পাশে চিতাদের গাড়ি দেখা যায়, তবুও যুদ্ধ তার কাছে মনে হয় অনেক দূরে। প্রকৃতির রহস্যের মাঝে কি কোন ন্যায়-অন্যায় বোধ আছে? মহাবিশ্বের গঠন প্রক্রিয়ায় মানবিক নীতি বলে কিছু নেই? তিষান প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করতে চায় মহকর্ষ তরঙ্গ বর্ধন করার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে, কিন্তু তার বদলে বলে, "এই যুদ্ধের কি কোন অর্থ আছে, প্রফেসর?"

প্রফেসর চাইলেন তিষানের দিকে, পরিচিত প্রশ্ন যেন। তিনি কী বলতে পারেন? জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, "যতক্ষণ আমরা সময়ের বন্দী ততক্ষণ বোধহয় আমাদের যুদ্ধ করেই যেতে হবে।"

বৈকাল তার প্রশ্নের উত্তর দিল কিনা বুঝল না তিষান। "আমাদের আর দেখা নাও হতে পারে, প্রফেসর। আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে শান্তির সময়ে এই গবেষণার কথা সবাই যেন জানতে পারে। আজ আমি যাই।"

দরজার দিকে এগোয় তিষান। প্রফেসর বলেন, "একটু দাঁড়াও, তিষান।" কাঁপা হাতে তার কোটের পকেট থেকে একটা ছবি বের করলেন, তিষানের দিকে এগিয়ে দিলেন। সবুজ ঘাসের ওপর দোলনায় দুলছে লাল পোষাক পরা একটি তরুণী। হাসছে, অথচ একটা বিষাদ ঘিরে আছে তার চোখদুটিতে। "আমার মেয়ে, বহনা। তুমি কেন্দ্র থেকে আসছ। দেখেছ কোথাও তাকে?"

প্রশ্নটির আকুতি প্রফেসরের এতক্ষণের আত্মপ্রত্যয়কে ভেঙ্গে দেয়। শীতের বাতাসের ঝাপটায় ঝরে পড়ে হলুদ পাতা, নিয়ে আসে অতিপরিচিত হারিয়ে যাবার বেদনা, চোখের কোণায় টলমল করে জলের ফোঁটা।

বহনাকে চেনে না তিষান। সে জানে না সেই অশান্ত মেয়ের উচ্ছাস। সে কোনদিন দেখে নি দুটি বাড়ির মাঝে ঝোলানো দড়ির ওপর সার্কাসের মেয়ের মতো তার হেঁটে যাওয়া, প্রচণ্ড বাতাসের মাঝে তার ছাতাকে প্যারাসুটের মত ছেড়ে দেয়া। বহন তার কাছে শুধুই এক দ্বিমাত্রিক রঙ্গীন তল, হয়তো কিছুটা মিষ্টি, হয়তো কিছুটা বিষাদপূর্ণ। তবু তিষানের মনে হয় বহনার চুলকে উড়িয়ে দিচ্ছে যে বাতাস তার ছোঁয়াচ পাওয়া যায় এই বদ্ধ ঘরের মাঝে। বাতাস কেটে উড়ে যায় যে দোলনা তার গতিকে কানের পাশে সে অনুভব করে।

মাথে নেড়ে ছবিটা ফিরিয়ে দেয় তিষান, "আমি দুঃখিত, প্রফেসর।"

প্রফেসর ছবিটা নিলেন না। বললেন, "ওটা তুমি রাখ, তিষান। ওকে খোঁজ কোরো কেন্দ্রে, শরনার্থী শিবিরে, আমার কথা বোল। আর শোনো, সূর্যের কথা বললাম তোমাকে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে স্থানকালের কন্টিনিয়াম বদলাবে। যুদ্ধের পর তোমার যদি সময় থাকে আমার খাতা-পত্র খুঁজে দেখো, কোন সমাধান পেলে কাজে লাগিও। জানবে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর তখন থাকবে না।"

সেই রাতে দুলারী নদী পার হয়ে যায় তিষান ও আরাত্রিক। আকাশের নক্ষত্রদের দিকে তাকিয়ে তিষান ভাবে। সে বিশ্বাস করতে পারে না প্রফেসর সূর্য থেকে নির্গত মহাকর্ষ বল অবলোকন করতে পারবেন, আর পারলেও তার শক্তি বর্ধন করার কোন উপায় নেই, সূর্যের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ খুব দুর্বল। এই সাধারণ ব্যাপারটা যে তিষান বুঝতে পারবে সেটা বৈকাল জানেন, তবু কেন তিনি তিষানকে স্বপ্ন দেখালেন? এটাও এক নিওলিথ স্বপ্ন, ভাবে তিষান, পৃথিবীর অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার মাঝে ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

তিষান দেখে দুলারীর ডান পাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে। কোরিওলি বল কি বাড়ছে? পৃথিবী ঘুরছে, ঘুরছে তার অক্ষের চারদিকে, সূর্যের চারদিকে। চিতাদের সার্চলাইট কি অনুভব করছে সূর্যের সেই দুরন্ত ঘূর্ণন? এই যুদ্ধের মাঝে জাড্য রেখায় ভ্রমণ করে তিষান, বন্দী হয়ে থাকে অজস্র অলীক বলের মাঝে।

৬.

সেই ছিল প্রফেসরের সঙ্গে শেষ দেখা। দু'সপ্তাহ বাদে, যুদ্ধের শেষ দিনগুলোয় পরাজিত হবার আগে, চিতারা ক্যাম্পের আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপককে হত্যা করে। সাবার ধারণা প্রফেসর বৈকাল নিহতদের মাঝে ছিলেন। তিষান জানত বৈকালের সেই নিহতদের মধ্যে থাকার কথা নেই। কিন্তু প্রফেসর বৈকালের দেহ আর পাওয়া যায় নি, অনেক খুঁজেছে তিষান। সেই ক্যাপ্টেন আর অধিনায়কেরও খোঁজ মেলে নি। সে ভেবেছে প্রফেসরের নিওলিথ স্বপ্ন হয়তো সত্যি হয়েছে।

আর সেই বৈমানিক?

সেই বৈমানিক দেখেছিল কি নিওলিথ মানুষটিকে? অনেক নিচে, পৃথিবীর কোণায় আদিম মানুষটি যখন প্রার্থনা করছিল ধাতব পাখির ঐশ্বরিক কৃপা? দশ হাজার বছর পর গুহার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে বৈমানিক যেখানে একদিন দাঁড়িয়ে ছিল নিওলিথ মানুষ। সামনে ছড়ানো থাকে ছোট্ট সাজানো গ্রামটি। আকাশের দিকে তাকায় বৈমানিক। সে আজ নিওলিথ মানব, তার জন্য কি আকাশের গায়ে উড়ে যাবে কোন ধাতব পাখি? আকাশের দিকে তাকিয়ে নিওলিথ স্বপ্ন দেখে বৈমানিক।




লেখক পরিচিতি
ড. দীপেন (দেবদর্শী) ভট্টাচার্য

জন্ম ১৯৫৯ সালে। আদি নিবাস টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায়।

ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসার (NASA) গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইনস্টিটিউটে গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিআর) গামা-রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। মহাশুন্য থেকে আসা গামা-রশ্মি পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বায়ুমণ্ডলের ওপরে বেলুনবাহিত দূরবীন ওঠানোর অভিযানসমূহে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় রিভারসাইড কলেজে অধ্যাপক।

দীপেন ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ্ভাবে যুক্ত। ১৯৭৫ সাথে বন্ধুদের সহযোগিতায় 'অনুসন্ধিৎসু চক্র' নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ছাড়াও তাঁর নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো ও দিতার ঘড়ি নামে বিজ্ঞান-কল্পকাহিনিভিত্তিক ভিন্ন স্বাদের তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ