কিছু কিছু খুব চেনা ইংরেজি শব্দের ঠিক ঠিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন৷ ডিকশনারিতে একটা মানে দেওয়া থাকে ঠিকই, কিন্তু সেটা একটা গালভরা কঠিন সংস্কৃত ঘেঁষা শব্দ৷ মোটেও কেউ ওরকম ভাবে মনে মনে কথার মানে করে না৷
ইরিটেশন এমনিই একটা অদ্ভুত শব্দ৷ লোকে সাধারণত চলতি কথায় ওটাই বলে, আর যে বলছে এবং যাকে বা যাদের বলা হচ্ছে দু পক্ষই একদম ঠিকঠাক বুঝে যায় কী বলতে চাওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু বাংলা করে বোঝাতে গেলেই বিপদ৷
এ টি দেবের ডিকশনারিতে অনেকগুলো মানের মধ্যে কয়েকটা হল উত্তেজিত করা, বিরক্ত করা, জ্বালাতন করা৷ কিন্তু সত্যি করে ইরিটেশন বলতে এগুলোর একটাও বোঝায় না৷ ইরিটেশন মানে একটা অন্য কিছু, অন্য রকম কিছু৷ বেখাপ্পা জায়গায় লাগাতার চুলকুনির মতন৷
ও তখন বোঝে নি, কিন্তু সেই বাসর রাত থেকেই আদিত্য ওর ওপর বিরক্ত হতে শুরু করেছিল৷ ঠিক বিরক্ত নয়, ওই যাকে বলা যায় ইরিটেশন৷ কারণটা আপাততুচ্ছ হলেও প্রভাবটা ছিল সুদূরপ্রসারী৷ আসলে ওর তুতো ভাইবোনেদের সংখ্যা প্রচুর৷ নতুন জামাইবাবুর সঙ্গে আনলিমিটেড ফাজলামির ধান্দায় তারা সকলেই বাসরঘরে ভিড় জমিয়েছিল৷ হিহি হাহায় নরক একেবারে গুলজার৷ এ বাড়ির সবারই এমনিতেই একটু জোর গলায় কখা বলার অভ্যেস৷ বিয়ে বাড়িতে স্বভাবতই সেটা আরও একটু উঁচুতে চড়েছিল৷ কিছুক্ষণ পরেই আদিত্য চাপা গলায় ওকে বলে, ‘তোমরা কি কেউ আস্তে কথা বলতে জানো না? সারা পাড়াকে শুনিয়ে বাসর জাগানো হচ্ছে মনে হচ্ছে৷ ইরিটেটিং৷’
যথেষ্ট হ্যাণ্ডসাম এবং ‘বিদেশি সংস্থায় উচ্চ পদে কর্মরত সুউপায়ী’ নতুন বরের বিরক্তিতে ও খুবই অপ্রতিভ বোধ করতে থাকে৷ ভাইবোনেদের ওপরেও ওর অত্যন্ত রাগ হয়৷ কী দরকার ছিল ওদের অমন ছেলেমানুষি করার? আদিত্য কী না জানি ভাবল ওর বাপের বাড়ি সম্বন্ধে৷
সেই যে ওকে নিয়ে আদিত্যর ইরিটেশন শুরু হযেছিল, আজ এত বছর পার করেও তার কমার নামটি নেই৷
ফুলশয্যার রাতে পিঠের তলায় ওর লম্বা বেণী আটকে যাওয়ায় আদিত্যর কাছ থেকে মধ্যবিত্ত (আদিত্য অবশ্য ‘মিডল ক্লাস’ শব্দটা ব্যবহার করেছিল) বাঙালি পরিবারের মেয়েদের লম্বা চুল রাখার গ্রাম্যতা তথা প্র্যাকটিক্যাল অসুবিধা নিয়ে মিনিট চল্লিশের একটা ভাষণ শুনতে হয়েছিল৷ বরকে খুশি রাখতে ও তক্ষুণি চুল কাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি দু পক্ষই তাদের আপত্তি সজোরে ব্যক্ত করায় সেটা দুর্ভাগ্যক্রমে সঙ্গে সঙ্গে ফলপ্রসূ করা হয়ে ওঠে নি৷
‘এক বছরের মধ্যে চুল কাটার কথা মনেও আনবে না’-শাশুড়ি ফতোয়া জারি করেছিলেন৷-‘অত সুন্দর চুল তোমার, কাটে কখনও? রাজুর কথা ছাড়ো তো৷’
শুধু কি চুল? শাঁখা পলা যে কী ভীষণ গাঁইয়া ব্যাপার আদিত্য না বললে ও কখনও জানতেও পারত না৷ হ্যাণ্ডলুমের শাড়িও৷
-‘এই ন্যাতনেতে শাড়িগুলো তোমার এত কেন ভালো লাগে বুঝি না৷ শিফন-টিফন পরতে পারো না? আর সব সময় ওই লম্বা লম্বা হাতাওলা জামাগুলো যে কেন পরে থাকো৷ এত আনস্মার্ট দেখায়৷ মোস্ট ইরিটেটিং৷’
সুতরাং বিয়ের বছর ঘুরতেই ও হাঁটু পর্যন্ত চুল কেটে পিক্সি কাট করে ফেলে৷ শাশুড়ির ভয়ে সিঁদুর পুরোপুরি মোছে না, তবে চুলের আড়ালে একেবারে অল্প করে ছুঁইয়ে রাখে. যাতে আদিত্যের চোখে না পড়ে৷ শাঁখা পলা খুলে ফেলে, যদিও নোয়াটা খুলতে সাহস পায় না৷ স্লিভলেস ব্লাউজ পরা অভ্যেস করতে চেষ্টা করে এবং বারে বারে গায়ে সি-থ্রু শিফনের আঁচল টানতে থাকে৷
এত বড় সাহসিক প্রচেষ্টাতেও অবশ্য আদিত্যকে বিশেষ খুশি করা যায় নি৷ বরং ওর শব্দভাণ্ডারে আরও অনেকগুলো –ইং যোগ হয়েছে৷ যেমন ডিসগাস্টিং, এমব্যারাসিং, বোরিং ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ৷ তবুও ওরই মধ্যে স্বাভাবিক জৈব নিয়মে প্রথমে তুতুন ও পরে বুবুন এই পৃথিবীতে আসে৷ প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় আদিত্যর ইরিটেশন প্রায় মাপার বাইরে চলে যাচ্ছিল, সৌভাগ্যক্রমে দু বছর পরে বুবুন জন্মে সেটাকে অনেকটা সামলে দেয়৷
দিন যায়৷ বয়স বাড়ে সকলেরই৷ শাশুড়ি গত হন৷ বর্ধমানের বাড়ি বিক্রি হয়ে যায় ও সেখানকার পাট পাকাপাকিভাবে উঠে যায়৷ আদিত্যর কেরিয়ার গ্রাফও আস্তে আস্তে আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে৷ পদমর্যাদা উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়৷ ক্লাব টাবের মেম্বারশিপ নিতে হয়৷ পার্টি–শার্টিতে যেতে হয় বউ নিয়ে৷ ফলে আরও, আরও ইরিটেশন৷ শত চেষ্টা ও প্রাণপণ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ও কিছুতেই নাক না কুঁচকে মিসেস গিদওয়ানির মত জিন অ্যাণ্ড লাইম, কিংবা মিসেস চট্টরাজের মত ব্লাডি মেরি খেতে পারে না৷ যদি বা উপরোধে ঢেঁকি গেলার প্রবাদবাক্যটি স্মরণ করে এক আধ বার বাধ্য হয়ে হাতে গ্লাস নেয়ও, সেটা হাত থেকে মুখে বড় একটা ওঠে না৷ বরং সেই একটা ঘেমে ওঠা গরম হয়ে যাওয়া বিস্বাদ তরলে ভরতি গ্লাস ধরেই ও সারা সন্ধ্যে কাটিয়ে দেয়৷
‘উফ্, সো ইরিটেটিং৷’ প্রতি বারই পার্টি থেকে ফেরার সময় গাড়িতে ওকে ঈষৎ টলটলায়মান আদিত্যর কাছ থেকে এই মন্তব্যটা শুনতে হয়৷
রোজ ঘুম থেকে উঠে আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ও মনপ্রাণ দিয়ে ঠাকুরকে ডাকে শুধু একটাই প্রার্থনা নিয়ে৷-‘ভগবান আমাকে আমার স্বামীর মনের মত হতে সাহায্য করো৷ বেচারা আমার সব কিছুতেই এত ইরিটেটেড হয়, আমার বড্ড খারাপ লাগে৷ আমাকে নিয়ে ও খুশি না হয় না-ই বা হল, অন্তত উঠতে বসতে এমন বিরক্ত যেন না হয় ঠাকুর৷’
চুপি চুপিই ডাকে অবশ্য৷ ওদের মার্বেল মোড়া আলিশান ফ্ল্যাটে বার কাউণ্টার আছে৷ ঠাকুরঘর নেই৷ বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজো টিপিক্যাল লোয়ার মিডল ক্লাস ব্যাপার৷ দরজায় দাঁড়িয়ে দুর্গা দুর্গা বলতে নেই, বলতে হয় বাই হানি৷ সী য়ু সুন৷ ও জানত না৷
নিজের দিক থেকে অবশ্য ও চেষ্টার কোনো ত্রুটি করে না৷ এমন কি, আদিত্য পছন্দ করে না বলে নিজের কলেজের বন্ধুদের সঙ্গেও সম্পর্ক ছেদ করে দেয়৷ আদিত্যর বন্ধুদের বউরাই এখন ওর বন্ধু৷ বন্ধু মানে ওই আর কী৷ মিসেস অমুক, মিসেস তমুক৷ দেঁতো হাসি ছেঁদো কথা৷ কী আর করা যাবে৷
তবু ভগবানকে প্রাণপণে ডাকে ও, যদি কোনওমতে ওর এই ইরিটেটিং স্বভাবটা পালটানো যায়৷
সকলেই জানে যে ভগবান নামক অস্তিত্বটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান৷ না হলে এত দায়িত্বপূর্ণ পদের ভার এতদিন ধরে সামলাতে পারতেন না৷ এই বুদ্ধিবলেই ভগবান অনেকদিন আগেই পরিষ্কার বুঝে গেছেন যে পৃথিবীর সাতশো নব্বই কোটি (এখনও পর্যন্ত) মানুষের ননস্টপ প্রার্থনা শুনতে হলে তাঁর ঈশ্বরীয় মস্তিষ্ক অতি দ্রুত তালগোল পাকিয়ে যাবে৷ সুতরাং তিনি নিজের সুস্থতার খাতিরেই যুগযুগান্ত ধরে কানে ছিপি এঁটে রেখেছেন৷ মর্ত্যলোকের বাসিন্দারা ঘুণাক্ষরেও তা জানতে না পেরে জন্ম জন্মান্তর ধরে এটা দাও ওটা দাও করেই চলেছে৷ মাঝেমধ্যে ছিপির ফাঁক দিয়ে দু চারটে প্রার্থনা যে ঢুকে পড়ে না তা নয়৷ এবার সেই সব সিঁধেল প্রার্থনাদের ফলাফল নির্ভর করে শ্রীভগবানের সেই সময়কার মুডের ওপর৷ মুড ভালো তো তথাস্তু, না হলে পুরোপুরি উপেক্ষা৷ ওর এতদিনের টানা প্রার্থনাও এইভাবে ভগবানের কর্ণকূহরের বাইরেই থেকে যাচ্ছিল, যদিও অন্য অনেক কিছুর মতই ও সেটাও আদৌ জানত না৷
অতএব ও মন দিয়ে সংসার করে৷ ছেলেমেয়ে মানুষ করে৷ মানে করার চেষ্টা করে, তবে খুব একটা সফল হয় না৷ কারণ মোটামুটি খুঁটে খেতে শেখার সঙ্গে সঙ্গেই বুবুন তুতুন দুজনেই ক্রমবর্ধমান হারে ওর ওপর বিরক্ত হতে থাকে৷
ওরই দোষে, নিঃসন্দেহে৷
ও চেয়েছিল ছেলেমেয়েরা বাংলা গান শুনে, বাংলা সাহিত্য পড়ে বড় হোক৷ বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়ার কথাটা যদিও সাহস করে বলে উঠতে পারে নি৷
আদিত্য বিশ্বাস করতে পারে নি যে ওর মধ্যে এখনও এতটা মধ্যবিত্ত মানসিকতা থাকতে পারে৷
ওকে আর ভরসা করা চলছিল না৷ অতএব বাচ্চাদের জামাকাপড় পছন্দ করা থেকে আরম্ভ করে স্কুল নির্বাচন, লেখাপড়া, এন্টারটেনমেণ্ট সব কিছুরই দায়িত্ব আদিত্য নিজের হাতে নিয়ে নেয়৷
এখন অবশ্য ভাইবোন দুজনেই বড় হয়ে গেছে৷ নিজেদের জীবন তারা নিজেরাই বেশ সামলাতে পারে৷
তুতুন আর বুবুন ৷ রিয়া আর রেহান৷ ঝকঝকে স্মার্ট আধুনিক নাম৷ আদিত্য রেখেছে৷
ওর পছন্দ ছিল যশোধরা আর ঋতুপর্ণ৷ শুনে আদিত্যর মন্তব্য যথাক্রমে ‘স্টুপিড’ ও ‘রাবিশ’ হওয়ায় সে নাম আর রাখা হয় নি৷
তুতুনের পোশাক দেখলে আজকাল ওর যেন কেমন শরীর খারাপ লাগে৷ আদিত্য বলেছে ওটাই নাকি আজকালকার টপ স্টাইল৷ হাই সোসাইটির মেয়েরা এই ধরনেরই ড্রেস পরে৷ ও চুপ করে থাকে৷ কিছু বলতে গেলে বাবা মেয়ে দুজনেই ইরিটেটেড হয়৷
বুবুন সারাদিন কী যে সব ইংরেজি গান শোনে তার কথাগুলো কানে এলে ওর গা গোলায়৷ ওর অপছন্দগুলো মুখ ফুটে না বললেও ওরা ঠিকই বুঝতে পারে৷ ভুরু তোলে, ঠোঁট বাঁকায়৷ তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দেয়৷–‘ওহ্ মম, তুমি সেই ব্যাকডেটেডই রয়ে গেলে৷’
আদিত্যও ছেলেমেয়ের সঙ্গে যোগ দেয়৷ কাঁধ ঝাঁকায়৷–‘ভালো মিউজিক কি কোনোদিন শুনেছ যে অ্যাপ্রিসিয়েট করবে? তোমাদের তো গান বলতে ওই এক ন্যাকা ন্যাকা প্যানপেনে রবীন্দ্রসঙ্গীত৷ ডিসগাস্টিং৷’
গুরুজি বলতেন, ‘মায়ের আমার কণ্ঠে স্বয়ং সরস্বতীর অধিষ্ঠান৷ গান কখনো ছাড়িস না রে মা৷’ সে আজ কবেকার কথা৷ ক্ল্যাসিক্যাল গান আদিত্যর বেড়ালের কান্না মনে হয়৷ তানপুরাটা কোথায় যে হারাল৷ বোধহয় ও বাড়ি থেকে আনাই হয় নি৷
২
নিজের চারদিকে একটা অদৃশ্য বুদবুদ তৈরি করে নিলে যে কী শান্তিতে থাকা যায় সেটা ও অনেক দিন পর্যন্ত জানত না৷ যেদিন থেকে আবিষ্কার করেছে সেদিন থেকে চব্বিশ ঘণ্টা ও ওই বুদবুদটার মধ্যেই থাকে৷ এমনিতেই তো দরকার ছাড়া কেউ ওকে দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না৷ সে আদিত্যই বলো, আর বুবুন তুতুনই বলো৷ এখন বরং ওরই মজা৷ বুদবুদের ভেতর থেকে কারোর ইরিটেশন, ছুঁড়ে দেওয়া মন্তব্য কিচ্ছু ও শুনতে পায় না৷ কী শান্তি, কী শান্তি৷
আদিত্যর সঙ্গে পার্টিতে যেতে আগে যে ওর কী কান্না পেত৷ এখনও পায়, তবে বুদবুদটা থাকায় অতটা কষ্ট হয় না আজকাল৷ বুদবুদের বাইরে ধেড়ে ধেড়ে লোকগুলোর কাণ্ডকারখানা দেখে মাঝে মাঝে হাসিও পায়৷
আজও বুদবুদের মধ্যে চুপ করে বসেই ছিল ও৷ আদিত্য তো ঢুকেই বারের দিকে চলে যায়৷ ও পেছনে পেছনে আসছে না মাঝরাস্তায় হারিয়েই গেছে একবার ফিরেও দেখে না৷ কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার তো প্রশ্নই নেই৷
আজ কিন্তু বসে থাকতে থাকতে অবাক হয়ে ও দেখল আদিত্য এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে ওর সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে৷ মুখটা হাসি হাসি, কী যেন বলছে৷ ও তাড়াতাড়ি বুদবুদ থেকে বেরিয়ে আসে৷ উঠে দাঁড়ায়৷
“মিট মাই ওয়াইফ স্যর৷” আদিত্যর মুখে বিগলিত হাসি৷“শী ক্যান টেল য়ু অল অ্যাবাউট বেঙ্গলি লিটারেচার৷ আমি আবার ও ব্যাপারে একেবারেই, বুঝলেন তো৷হাঃ হাঃ৷”
ও কিছুই বোঝে না৷ আদিত্যর দিকে একবার তাকায়৷
“আরে আমাদের নতুন এম ডি, মিস্টার বাসু৷ এগারো বছর স্টেটসে কাটিয়ে এই জাস্ট দেশে ফিরেছেন৷ বলেছিলাম না তোমাকে, খুব বইটই পড়তে ভালোবাসেন৷”
কবে বলেছিল ওর মনে পড়ে না যদিও, তাও মুখে ভদ্রতার হাসি টেনে দাঁড়িয়ে থাকে৷
“আপনারা কথা বলুন স্যর, আমি একটু আসছি৷” যেতে যেতে আদিত্য চোখের ইশারা করে কিছু একটা বোঝাতে চায় ওকে৷ ও বোকা হয়ে তাকিয়ে থাকে৷
“আদিত্য বলছিল আপনি নাকি খুব বাংলা সাহিত্যের ভক্ত, একেবারে এক্সপার্ট যাকে বলে?”- মিস্টার বাসুর কথায় ওর চেতনা ফেরে৷
“না মানে ওই আরকি৷” উফ্ এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেজুরে আলাপ চালাতে হবে কে জানে কতক্ষণ ধরে৷
“আসলে কী জানেন, বাইরে বাইরে বড় হয়েছি তো, কারেণ্ট বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সেভাবে পরিচয়টা হয়ে ওঠে নি৷ এবারে ভাবছি অপরিচয়টা ঘুচিয়ে নেব৷ আপনি কী বলেন?”
“ভালোই তো৷” কী জ্বালায় পড়া গেল রে বাবা৷
“আদিত্য যখন আপনাকে এত বড় সার্টিফিকেট দিয়ে গেল তখন আপনাকেই জিজ্ঞাসা করি তাহলে৷ আচ্ছা মিসেস ভট্টাচারিয়া, ওহ্ নো, আই কাণ্ট কল য়ু বাই সাচ আ বিগ মাউথফুল৷ হোয়াটস য়োর ফার্সট নেম বাই দ্য ওয়ে? হোপ য়ু ডোণ্ট মাইণ্ড মাই আস্কিং৷ অ্যাকচুয়্যালি সবাইকে নাম ধরে ডাকতেই আমার সুবিধে হয়৷ এতদিন অ্যামেরিকায় থাকার কুফল আর কি৷” আদিত্যর এমডি অট্টহাসি হেসে ওঠেন৷
মিস্টার বাসুর প্রশ্নটা অবশ্য খুবই সাধারণ ছিল কিন্তু ওর প্রতিক্রিয়াটা হল মারাত্মক৷ ভদ্রলোক হাসি থামিয়ে খুবই অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর সামনে দাঁড়ানো যথেষ্ট সুন্দরী ও এলিগ্যাণ্ট মহিলাটি হঠাৎ যেন কেমন বেভুল হয়ে পড়লেন৷ চোখের দৃষ্টিটাও কী রকম যেন ফ্যালফেলে হয়ে গেল৷
আসলে প্রশ্নটার উত্তর যে ওর নিজেরই আদৌ জানা নেই৷ মা ডাকত খুকু, বাবা ডাকত মামণি, এটা মনে আছে৷ বাবা মা কেউই তো আজ আর নেই৷
এ বাড়িতে আসার পর নাম হয়েছিল বউমা৷ কিন্তু আসল নামটা কী যে ছিল ছাই৷ মিসেস ভট্টাচার্য, ভটচায্যি বাড়ির বড় বউ, তুতুন-বুবুনের মা, বউদি, আণ্টি, এরকম আরও অনেকগুলো সম্পর্ক আর সম্বোধন ওর মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু ওর নিজের নামটা যে কী সেটা কিছুতেই মনে পড়ছিল না৷ স্কুলের দিদিরা কী বলে যে ডাকতেন এত বছর পরে সে কি আর মনে থাকে৷
গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেটে হয়তো নামটা ছিল, কিন্তু সে তো কোনকালে হারিয়ে গেছে৷ একবার খুব তোড়জোড় করে চাকরির ইণ্টারভিউ দেবে বলে সব ঝেড়েপুঁছে বার করেছিল, আদিত্যর ইরিটেশনের চোটে সেগুলোকে যে কোথায় বিসর্জন দিয়েছে আজ আর মনেও নেই৷ আদিত্য ভটচায্যির বউ চাকরি করার কথা ভাবছে এটা কল্পনা করেই আদিত্য এত ইরিটেটেড হয়েছিল যে সত্যি চাকরি করলে যে কী হত ও ভাবতেও পারে না৷
মিস্টার বাসু সত্যিই ভদ্রলোক, তাই ওর এই রকম অদ্ভুত ব্যবহারের পরেও অসন্তুষ্ট হন নি৷ বরং খুবই নরম গলায় জানতে চান-‘আপনার কি শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছে মিসেস ভট্টাচারিয়া? জল খাবেন একটু? বরং ওই সোফাটায় বসে একটু রেস্ট নিন৷ য়ু আর লুকিং কোয়াইট পেল, য়ু নো৷ আদিত্যকে ডাকব কি?’
এই কথায় ওর সংবিৎ ফিরে আসে৷ নিজের এহেন অভদ্র আচরণে খুবই লজ্জা পায় বেচারা৷ কোনোক্রমে তুতলে টুতলে “না না ঠিক আছে, সো সরি” ইত্যাদি বাঁধা বুলি আউড়ে সামাল দিতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা৷ ওর স্পষ্ট অস্বস্তি দেখে মিস্টার বাসুও আর বিশেষ ঘাঁটান না৷ -“এক্সকিউজ় মি আ মোমেণ্ট” বলে কায়দা করে অকুস্থল থেকে কেটে পড়েন৷ ও লক্ষ্যও করে না৷
আসলে ওর সমস্যাটা ও কী করে যে কাউকে বোঝায়? কে-ই বা বিশ্বাস করবে ওর কথা? নিজের বলতে ওই একটাই তো জিনিস ছিল ওর৷ একেবারে নিজস্ব৷ একান্ত আপন৷ এই সবথেকে দামী সম্পত্তিটা বেমালুম ওর অজান্তে ওরই জীবন থেকে কবে কখন লোপাট হয়ে গেল আর ও কিনা তা টেরই পেল না? হায় রে হায়, এতবড় চুরিটা কখন কী ভাবে ঘটে গেল? হলভরতি লোকজনের মধ্যে এক কোনে একা একা সোফায় বসে ও গালে হাত দিয়ে শুধু ভাবতেই থাকে আর ভাবতেই থাকে৷ যদি মনে পড়ে, যদি ফিরে পাওয়া যায়৷ কী যেন ছিল, আহা, কী যে ছিল ওর নামটা৷
লেখক পরিচিতি
অদিতি সরকার
কলকাতা
অনুবাদক। গল্পকার।
দেশ, সানন্দা, উনিশ কুড়ি এবং আরো কিছু প্রচলিত পত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন।
ইরিটেশন এমনিই একটা অদ্ভুত শব্দ৷ লোকে সাধারণত চলতি কথায় ওটাই বলে, আর যে বলছে এবং যাকে বা যাদের বলা হচ্ছে দু পক্ষই একদম ঠিকঠাক বুঝে যায় কী বলতে চাওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু বাংলা করে বোঝাতে গেলেই বিপদ৷
এ টি দেবের ডিকশনারিতে অনেকগুলো মানের মধ্যে কয়েকটা হল উত্তেজিত করা, বিরক্ত করা, জ্বালাতন করা৷ কিন্তু সত্যি করে ইরিটেশন বলতে এগুলোর একটাও বোঝায় না৷ ইরিটেশন মানে একটা অন্য কিছু, অন্য রকম কিছু৷ বেখাপ্পা জায়গায় লাগাতার চুলকুনির মতন৷
ও তখন বোঝে নি, কিন্তু সেই বাসর রাত থেকেই আদিত্য ওর ওপর বিরক্ত হতে শুরু করেছিল৷ ঠিক বিরক্ত নয়, ওই যাকে বলা যায় ইরিটেশন৷ কারণটা আপাততুচ্ছ হলেও প্রভাবটা ছিল সুদূরপ্রসারী৷ আসলে ওর তুতো ভাইবোনেদের সংখ্যা প্রচুর৷ নতুন জামাইবাবুর সঙ্গে আনলিমিটেড ফাজলামির ধান্দায় তারা সকলেই বাসরঘরে ভিড় জমিয়েছিল৷ হিহি হাহায় নরক একেবারে গুলজার৷ এ বাড়ির সবারই এমনিতেই একটু জোর গলায় কখা বলার অভ্যেস৷ বিয়ে বাড়িতে স্বভাবতই সেটা আরও একটু উঁচুতে চড়েছিল৷ কিছুক্ষণ পরেই আদিত্য চাপা গলায় ওকে বলে, ‘তোমরা কি কেউ আস্তে কথা বলতে জানো না? সারা পাড়াকে শুনিয়ে বাসর জাগানো হচ্ছে মনে হচ্ছে৷ ইরিটেটিং৷’
যথেষ্ট হ্যাণ্ডসাম এবং ‘বিদেশি সংস্থায় উচ্চ পদে কর্মরত সুউপায়ী’ নতুন বরের বিরক্তিতে ও খুবই অপ্রতিভ বোধ করতে থাকে৷ ভাইবোনেদের ওপরেও ওর অত্যন্ত রাগ হয়৷ কী দরকার ছিল ওদের অমন ছেলেমানুষি করার? আদিত্য কী না জানি ভাবল ওর বাপের বাড়ি সম্বন্ধে৷
সেই যে ওকে নিয়ে আদিত্যর ইরিটেশন শুরু হযেছিল, আজ এত বছর পার করেও তার কমার নামটি নেই৷
ফুলশয্যার রাতে পিঠের তলায় ওর লম্বা বেণী আটকে যাওয়ায় আদিত্যর কাছ থেকে মধ্যবিত্ত (আদিত্য অবশ্য ‘মিডল ক্লাস’ শব্দটা ব্যবহার করেছিল) বাঙালি পরিবারের মেয়েদের লম্বা চুল রাখার গ্রাম্যতা তথা প্র্যাকটিক্যাল অসুবিধা নিয়ে মিনিট চল্লিশের একটা ভাষণ শুনতে হয়েছিল৷ বরকে খুশি রাখতে ও তক্ষুণি চুল কাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি দু পক্ষই তাদের আপত্তি সজোরে ব্যক্ত করায় সেটা দুর্ভাগ্যক্রমে সঙ্গে সঙ্গে ফলপ্রসূ করা হয়ে ওঠে নি৷
‘এক বছরের মধ্যে চুল কাটার কথা মনেও আনবে না’-শাশুড়ি ফতোয়া জারি করেছিলেন৷-‘অত সুন্দর চুল তোমার, কাটে কখনও? রাজুর কথা ছাড়ো তো৷’
শুধু কি চুল? শাঁখা পলা যে কী ভীষণ গাঁইয়া ব্যাপার আদিত্য না বললে ও কখনও জানতেও পারত না৷ হ্যাণ্ডলুমের শাড়িও৷
-‘এই ন্যাতনেতে শাড়িগুলো তোমার এত কেন ভালো লাগে বুঝি না৷ শিফন-টিফন পরতে পারো না? আর সব সময় ওই লম্বা লম্বা হাতাওলা জামাগুলো যে কেন পরে থাকো৷ এত আনস্মার্ট দেখায়৷ মোস্ট ইরিটেটিং৷’
সুতরাং বিয়ের বছর ঘুরতেই ও হাঁটু পর্যন্ত চুল কেটে পিক্সি কাট করে ফেলে৷ শাশুড়ির ভয়ে সিঁদুর পুরোপুরি মোছে না, তবে চুলের আড়ালে একেবারে অল্প করে ছুঁইয়ে রাখে. যাতে আদিত্যের চোখে না পড়ে৷ শাঁখা পলা খুলে ফেলে, যদিও নোয়াটা খুলতে সাহস পায় না৷ স্লিভলেস ব্লাউজ পরা অভ্যেস করতে চেষ্টা করে এবং বারে বারে গায়ে সি-থ্রু শিফনের আঁচল টানতে থাকে৷
এত বড় সাহসিক প্রচেষ্টাতেও অবশ্য আদিত্যকে বিশেষ খুশি করা যায় নি৷ বরং ওর শব্দভাণ্ডারে আরও অনেকগুলো –ইং যোগ হয়েছে৷ যেমন ডিসগাস্টিং, এমব্যারাসিং, বোরিং ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ৷ তবুও ওরই মধ্যে স্বাভাবিক জৈব নিয়মে প্রথমে তুতুন ও পরে বুবুন এই পৃথিবীতে আসে৷ প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় আদিত্যর ইরিটেশন প্রায় মাপার বাইরে চলে যাচ্ছিল, সৌভাগ্যক্রমে দু বছর পরে বুবুন জন্মে সেটাকে অনেকটা সামলে দেয়৷
দিন যায়৷ বয়স বাড়ে সকলেরই৷ শাশুড়ি গত হন৷ বর্ধমানের বাড়ি বিক্রি হয়ে যায় ও সেখানকার পাট পাকাপাকিভাবে উঠে যায়৷ আদিত্যর কেরিয়ার গ্রাফও আস্তে আস্তে আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে৷ পদমর্যাদা উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়৷ ক্লাব টাবের মেম্বারশিপ নিতে হয়৷ পার্টি–শার্টিতে যেতে হয় বউ নিয়ে৷ ফলে আরও, আরও ইরিটেশন৷ শত চেষ্টা ও প্রাণপণ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ও কিছুতেই নাক না কুঁচকে মিসেস গিদওয়ানির মত জিন অ্যাণ্ড লাইম, কিংবা মিসেস চট্টরাজের মত ব্লাডি মেরি খেতে পারে না৷ যদি বা উপরোধে ঢেঁকি গেলার প্রবাদবাক্যটি স্মরণ করে এক আধ বার বাধ্য হয়ে হাতে গ্লাস নেয়ও, সেটা হাত থেকে মুখে বড় একটা ওঠে না৷ বরং সেই একটা ঘেমে ওঠা গরম হয়ে যাওয়া বিস্বাদ তরলে ভরতি গ্লাস ধরেই ও সারা সন্ধ্যে কাটিয়ে দেয়৷
‘উফ্, সো ইরিটেটিং৷’ প্রতি বারই পার্টি থেকে ফেরার সময় গাড়িতে ওকে ঈষৎ টলটলায়মান আদিত্যর কাছ থেকে এই মন্তব্যটা শুনতে হয়৷
রোজ ঘুম থেকে উঠে আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ও মনপ্রাণ দিয়ে ঠাকুরকে ডাকে শুধু একটাই প্রার্থনা নিয়ে৷-‘ভগবান আমাকে আমার স্বামীর মনের মত হতে সাহায্য করো৷ বেচারা আমার সব কিছুতেই এত ইরিটেটেড হয়, আমার বড্ড খারাপ লাগে৷ আমাকে নিয়ে ও খুশি না হয় না-ই বা হল, অন্তত উঠতে বসতে এমন বিরক্ত যেন না হয় ঠাকুর৷’
চুপি চুপিই ডাকে অবশ্য৷ ওদের মার্বেল মোড়া আলিশান ফ্ল্যাটে বার কাউণ্টার আছে৷ ঠাকুরঘর নেই৷ বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজো টিপিক্যাল লোয়ার মিডল ক্লাস ব্যাপার৷ দরজায় দাঁড়িয়ে দুর্গা দুর্গা বলতে নেই, বলতে হয় বাই হানি৷ সী য়ু সুন৷ ও জানত না৷
নিজের দিক থেকে অবশ্য ও চেষ্টার কোনো ত্রুটি করে না৷ এমন কি, আদিত্য পছন্দ করে না বলে নিজের কলেজের বন্ধুদের সঙ্গেও সম্পর্ক ছেদ করে দেয়৷ আদিত্যর বন্ধুদের বউরাই এখন ওর বন্ধু৷ বন্ধু মানে ওই আর কী৷ মিসেস অমুক, মিসেস তমুক৷ দেঁতো হাসি ছেঁদো কথা৷ কী আর করা যাবে৷
তবু ভগবানকে প্রাণপণে ডাকে ও, যদি কোনওমতে ওর এই ইরিটেটিং স্বভাবটা পালটানো যায়৷
সকলেই জানে যে ভগবান নামক অস্তিত্বটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান৷ না হলে এত দায়িত্বপূর্ণ পদের ভার এতদিন ধরে সামলাতে পারতেন না৷ এই বুদ্ধিবলেই ভগবান অনেকদিন আগেই পরিষ্কার বুঝে গেছেন যে পৃথিবীর সাতশো নব্বই কোটি (এখনও পর্যন্ত) মানুষের ননস্টপ প্রার্থনা শুনতে হলে তাঁর ঈশ্বরীয় মস্তিষ্ক অতি দ্রুত তালগোল পাকিয়ে যাবে৷ সুতরাং তিনি নিজের সুস্থতার খাতিরেই যুগযুগান্ত ধরে কানে ছিপি এঁটে রেখেছেন৷ মর্ত্যলোকের বাসিন্দারা ঘুণাক্ষরেও তা জানতে না পেরে জন্ম জন্মান্তর ধরে এটা দাও ওটা দাও করেই চলেছে৷ মাঝেমধ্যে ছিপির ফাঁক দিয়ে দু চারটে প্রার্থনা যে ঢুকে পড়ে না তা নয়৷ এবার সেই সব সিঁধেল প্রার্থনাদের ফলাফল নির্ভর করে শ্রীভগবানের সেই সময়কার মুডের ওপর৷ মুড ভালো তো তথাস্তু, না হলে পুরোপুরি উপেক্ষা৷ ওর এতদিনের টানা প্রার্থনাও এইভাবে ভগবানের কর্ণকূহরের বাইরেই থেকে যাচ্ছিল, যদিও অন্য অনেক কিছুর মতই ও সেটাও আদৌ জানত না৷
অতএব ও মন দিয়ে সংসার করে৷ ছেলেমেয়ে মানুষ করে৷ মানে করার চেষ্টা করে, তবে খুব একটা সফল হয় না৷ কারণ মোটামুটি খুঁটে খেতে শেখার সঙ্গে সঙ্গেই বুবুন তুতুন দুজনেই ক্রমবর্ধমান হারে ওর ওপর বিরক্ত হতে থাকে৷
ওরই দোষে, নিঃসন্দেহে৷
ও চেয়েছিল ছেলেমেয়েরা বাংলা গান শুনে, বাংলা সাহিত্য পড়ে বড় হোক৷ বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়ার কথাটা যদিও সাহস করে বলে উঠতে পারে নি৷
আদিত্য বিশ্বাস করতে পারে নি যে ওর মধ্যে এখনও এতটা মধ্যবিত্ত মানসিকতা থাকতে পারে৷
ওকে আর ভরসা করা চলছিল না৷ অতএব বাচ্চাদের জামাকাপড় পছন্দ করা থেকে আরম্ভ করে স্কুল নির্বাচন, লেখাপড়া, এন্টারটেনমেণ্ট সব কিছুরই দায়িত্ব আদিত্য নিজের হাতে নিয়ে নেয়৷
এখন অবশ্য ভাইবোন দুজনেই বড় হয়ে গেছে৷ নিজেদের জীবন তারা নিজেরাই বেশ সামলাতে পারে৷
তুতুন আর বুবুন ৷ রিয়া আর রেহান৷ ঝকঝকে স্মার্ট আধুনিক নাম৷ আদিত্য রেখেছে৷
ওর পছন্দ ছিল যশোধরা আর ঋতুপর্ণ৷ শুনে আদিত্যর মন্তব্য যথাক্রমে ‘স্টুপিড’ ও ‘রাবিশ’ হওয়ায় সে নাম আর রাখা হয় নি৷
তুতুনের পোশাক দেখলে আজকাল ওর যেন কেমন শরীর খারাপ লাগে৷ আদিত্য বলেছে ওটাই নাকি আজকালকার টপ স্টাইল৷ হাই সোসাইটির মেয়েরা এই ধরনেরই ড্রেস পরে৷ ও চুপ করে থাকে৷ কিছু বলতে গেলে বাবা মেয়ে দুজনেই ইরিটেটেড হয়৷
বুবুন সারাদিন কী যে সব ইংরেজি গান শোনে তার কথাগুলো কানে এলে ওর গা গোলায়৷ ওর অপছন্দগুলো মুখ ফুটে না বললেও ওরা ঠিকই বুঝতে পারে৷ ভুরু তোলে, ঠোঁট বাঁকায়৷ তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দেয়৷–‘ওহ্ মম, তুমি সেই ব্যাকডেটেডই রয়ে গেলে৷’
আদিত্যও ছেলেমেয়ের সঙ্গে যোগ দেয়৷ কাঁধ ঝাঁকায়৷–‘ভালো মিউজিক কি কোনোদিন শুনেছ যে অ্যাপ্রিসিয়েট করবে? তোমাদের তো গান বলতে ওই এক ন্যাকা ন্যাকা প্যানপেনে রবীন্দ্রসঙ্গীত৷ ডিসগাস্টিং৷’
গুরুজি বলতেন, ‘মায়ের আমার কণ্ঠে স্বয়ং সরস্বতীর অধিষ্ঠান৷ গান কখনো ছাড়িস না রে মা৷’ সে আজ কবেকার কথা৷ ক্ল্যাসিক্যাল গান আদিত্যর বেড়ালের কান্না মনে হয়৷ তানপুরাটা কোথায় যে হারাল৷ বোধহয় ও বাড়ি থেকে আনাই হয় নি৷
২
নিজের চারদিকে একটা অদৃশ্য বুদবুদ তৈরি করে নিলে যে কী শান্তিতে থাকা যায় সেটা ও অনেক দিন পর্যন্ত জানত না৷ যেদিন থেকে আবিষ্কার করেছে সেদিন থেকে চব্বিশ ঘণ্টা ও ওই বুদবুদটার মধ্যেই থাকে৷ এমনিতেই তো দরকার ছাড়া কেউ ওকে দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না৷ সে আদিত্যই বলো, আর বুবুন তুতুনই বলো৷ এখন বরং ওরই মজা৷ বুদবুদের ভেতর থেকে কারোর ইরিটেশন, ছুঁড়ে দেওয়া মন্তব্য কিচ্ছু ও শুনতে পায় না৷ কী শান্তি, কী শান্তি৷
আদিত্যর সঙ্গে পার্টিতে যেতে আগে যে ওর কী কান্না পেত৷ এখনও পায়, তবে বুদবুদটা থাকায় অতটা কষ্ট হয় না আজকাল৷ বুদবুদের বাইরে ধেড়ে ধেড়ে লোকগুলোর কাণ্ডকারখানা দেখে মাঝে মাঝে হাসিও পায়৷
আজও বুদবুদের মধ্যে চুপ করে বসেই ছিল ও৷ আদিত্য তো ঢুকেই বারের দিকে চলে যায়৷ ও পেছনে পেছনে আসছে না মাঝরাস্তায় হারিয়েই গেছে একবার ফিরেও দেখে না৷ কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার তো প্রশ্নই নেই৷
আজ কিন্তু বসে থাকতে থাকতে অবাক হয়ে ও দেখল আদিত্য এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে ওর সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে৷ মুখটা হাসি হাসি, কী যেন বলছে৷ ও তাড়াতাড়ি বুদবুদ থেকে বেরিয়ে আসে৷ উঠে দাঁড়ায়৷
“মিট মাই ওয়াইফ স্যর৷” আদিত্যর মুখে বিগলিত হাসি৷“শী ক্যান টেল য়ু অল অ্যাবাউট বেঙ্গলি লিটারেচার৷ আমি আবার ও ব্যাপারে একেবারেই, বুঝলেন তো৷হাঃ হাঃ৷”
ও কিছুই বোঝে না৷ আদিত্যর দিকে একবার তাকায়৷
“আরে আমাদের নতুন এম ডি, মিস্টার বাসু৷ এগারো বছর স্টেটসে কাটিয়ে এই জাস্ট দেশে ফিরেছেন৷ বলেছিলাম না তোমাকে, খুব বইটই পড়তে ভালোবাসেন৷”
কবে বলেছিল ওর মনে পড়ে না যদিও, তাও মুখে ভদ্রতার হাসি টেনে দাঁড়িয়ে থাকে৷
“আপনারা কথা বলুন স্যর, আমি একটু আসছি৷” যেতে যেতে আদিত্য চোখের ইশারা করে কিছু একটা বোঝাতে চায় ওকে৷ ও বোকা হয়ে তাকিয়ে থাকে৷
“আদিত্য বলছিল আপনি নাকি খুব বাংলা সাহিত্যের ভক্ত, একেবারে এক্সপার্ট যাকে বলে?”- মিস্টার বাসুর কথায় ওর চেতনা ফেরে৷
“না মানে ওই আরকি৷” উফ্ এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেজুরে আলাপ চালাতে হবে কে জানে কতক্ষণ ধরে৷
“আসলে কী জানেন, বাইরে বাইরে বড় হয়েছি তো, কারেণ্ট বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সেভাবে পরিচয়টা হয়ে ওঠে নি৷ এবারে ভাবছি অপরিচয়টা ঘুচিয়ে নেব৷ আপনি কী বলেন?”
“ভালোই তো৷” কী জ্বালায় পড়া গেল রে বাবা৷
“আদিত্য যখন আপনাকে এত বড় সার্টিফিকেট দিয়ে গেল তখন আপনাকেই জিজ্ঞাসা করি তাহলে৷ আচ্ছা মিসেস ভট্টাচারিয়া, ওহ্ নো, আই কাণ্ট কল য়ু বাই সাচ আ বিগ মাউথফুল৷ হোয়াটস য়োর ফার্সট নেম বাই দ্য ওয়ে? হোপ য়ু ডোণ্ট মাইণ্ড মাই আস্কিং৷ অ্যাকচুয়্যালি সবাইকে নাম ধরে ডাকতেই আমার সুবিধে হয়৷ এতদিন অ্যামেরিকায় থাকার কুফল আর কি৷” আদিত্যর এমডি অট্টহাসি হেসে ওঠেন৷
মিস্টার বাসুর প্রশ্নটা অবশ্য খুবই সাধারণ ছিল কিন্তু ওর প্রতিক্রিয়াটা হল মারাত্মক৷ ভদ্রলোক হাসি থামিয়ে খুবই অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর সামনে দাঁড়ানো যথেষ্ট সুন্দরী ও এলিগ্যাণ্ট মহিলাটি হঠাৎ যেন কেমন বেভুল হয়ে পড়লেন৷ চোখের দৃষ্টিটাও কী রকম যেন ফ্যালফেলে হয়ে গেল৷
আসলে প্রশ্নটার উত্তর যে ওর নিজেরই আদৌ জানা নেই৷ মা ডাকত খুকু, বাবা ডাকত মামণি, এটা মনে আছে৷ বাবা মা কেউই তো আজ আর নেই৷
এ বাড়িতে আসার পর নাম হয়েছিল বউমা৷ কিন্তু আসল নামটা কী যে ছিল ছাই৷ মিসেস ভট্টাচার্য, ভটচায্যি বাড়ির বড় বউ, তুতুন-বুবুনের মা, বউদি, আণ্টি, এরকম আরও অনেকগুলো সম্পর্ক আর সম্বোধন ওর মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু ওর নিজের নামটা যে কী সেটা কিছুতেই মনে পড়ছিল না৷ স্কুলের দিদিরা কী বলে যে ডাকতেন এত বছর পরে সে কি আর মনে থাকে৷
গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেটে হয়তো নামটা ছিল, কিন্তু সে তো কোনকালে হারিয়ে গেছে৷ একবার খুব তোড়জোড় করে চাকরির ইণ্টারভিউ দেবে বলে সব ঝেড়েপুঁছে বার করেছিল, আদিত্যর ইরিটেশনের চোটে সেগুলোকে যে কোথায় বিসর্জন দিয়েছে আজ আর মনেও নেই৷ আদিত্য ভটচায্যির বউ চাকরি করার কথা ভাবছে এটা কল্পনা করেই আদিত্য এত ইরিটেটেড হয়েছিল যে সত্যি চাকরি করলে যে কী হত ও ভাবতেও পারে না৷
মিস্টার বাসু সত্যিই ভদ্রলোক, তাই ওর এই রকম অদ্ভুত ব্যবহারের পরেও অসন্তুষ্ট হন নি৷ বরং খুবই নরম গলায় জানতে চান-‘আপনার কি শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছে মিসেস ভট্টাচারিয়া? জল খাবেন একটু? বরং ওই সোফাটায় বসে একটু রেস্ট নিন৷ য়ু আর লুকিং কোয়াইট পেল, য়ু নো৷ আদিত্যকে ডাকব কি?’
এই কথায় ওর সংবিৎ ফিরে আসে৷ নিজের এহেন অভদ্র আচরণে খুবই লজ্জা পায় বেচারা৷ কোনোক্রমে তুতলে টুতলে “না না ঠিক আছে, সো সরি” ইত্যাদি বাঁধা বুলি আউড়ে সামাল দিতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা৷ ওর স্পষ্ট অস্বস্তি দেখে মিস্টার বাসুও আর বিশেষ ঘাঁটান না৷ -“এক্সকিউজ় মি আ মোমেণ্ট” বলে কায়দা করে অকুস্থল থেকে কেটে পড়েন৷ ও লক্ষ্যও করে না৷
আসলে ওর সমস্যাটা ও কী করে যে কাউকে বোঝায়? কে-ই বা বিশ্বাস করবে ওর কথা? নিজের বলতে ওই একটাই তো জিনিস ছিল ওর৷ একেবারে নিজস্ব৷ একান্ত আপন৷ এই সবথেকে দামী সম্পত্তিটা বেমালুম ওর অজান্তে ওরই জীবন থেকে কবে কখন লোপাট হয়ে গেল আর ও কিনা তা টেরই পেল না? হায় রে হায়, এতবড় চুরিটা কখন কী ভাবে ঘটে গেল? হলভরতি লোকজনের মধ্যে এক কোনে একা একা সোফায় বসে ও গালে হাত দিয়ে শুধু ভাবতেই থাকে আর ভাবতেই থাকে৷ যদি মনে পড়ে, যদি ফিরে পাওয়া যায়৷ কী যেন ছিল, আহা, কী যে ছিল ওর নামটা৷
লেখক পরিচিতি
অদিতি সরকার
কলকাতা
অনুবাদক। গল্পকার।
দেশ, সানন্দা, উনিশ কুড়ি এবং আরো কিছু প্রচলিত পত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
অনেক সুন্দর গল্পটি এক বসায় পড়ে নিলাম দিদি। অনেক সুন্দর লেখেন আপনি। আরো লিখুন।
উত্তরমুছুন