আবদু গুবেইর এর গল্প: তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশনটাকে দেখেছ?

অন্যভাষার গল্প

অনুবাদ - এমদাদ রহমান


[আবদু গুবেইর সম্পর্কে ‘Under the Naked Sky, Short Stories from the Arab World’- বইটিতে, ডেনইস জনসন-ডেভিস আমাদের যে তথ্য দেন তা থেকে জানা গেল, মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে হঠাৎ করেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন লেখক হবেন আর বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যাবেন কায়রো। সেখানে জীবিকার জন্য যখন যে কাজ পাবেন তা-ই করবেন। কিন্তু মসজিদের মুয়াজ্জিন হবেন না। গুবেইরের পারিবারিক ইতিহাস ধর্ম প্রচারকের। তার পূর্বপুরুষরা ধর্মের প্রচারে কাজ করতেন, মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন। তিনি এই ধারা ভাঙতে চাইলেন।
চলে গেলেন কায়রো। পালিয়ে। ‘রিদওয়ানের ছুটি’ উপন্যাসে এই বিষয়টাকেই আখ্যানভাগে তুলে এনেছেন তিনি। তারপর তিনি চলে যান কুয়েতে, সেখানে দৈনিক পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত নেন মিশরেই ফিরবেন আর সৃজনশীল লেখালেখিতেই নিজেকে উৎসর্গ করবেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার তিন খণ্ডের ছোটোগল্পের সংকলন আর চারটি উপন্যাস। আবদু গুবেইর সেইসব মিশরীয়দের নিয়ে গল্প আর উপন্যাস লিখেছেন, যারা কাজের সন্ধানে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলিতে চলে গেছে। ‘তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশনটাকে দেখেছ?’ গল্পটিতেও মাটি ছেড়ে যাবার বেদনাটুকু আছে। মানুষ কোথাও থাকে না। জীবন তাকে কোথাও যেন থিতু হতে দেয় না! মানুষ মাটি ছেড়ে চলে যাবার কালে শুধু শেষবারের মত চারপাশটাকে চোখ ভরে দেখে নেয়।
তাঁর জন্ম মিশরের নীল-তীরবর্তী এক ছোট্ট শহরে, ১৯৫০ সালে।]


প্ল্যাটফর্মের কাঠের তৈরি ছাউনির নিচে বসে থেকেই সে তাকে বলল- তুমি কি জান, আর সে ছিল নীরব—কয়েকবছর আগে ‘তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশনটাকে দেখেছ?’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম।

হাসি দিয়ে সে তার ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তরে বলল, সত্যি?

সে বলল, হ্যাঁ।

তারপর সে দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে যাত্রীদের বিশৃঙ্খল ঠেলাঠেলি, ট্রেন থেকে নামবার আর উঠবার দৃশ্য। কিন্তু মেয়েটি— কারণ সে তাকে ভালবাসে, এবং সেও তাকে। খুব তীব্রভাবেই, কারণ কখনোই তার সামনে দিয়ে তার হেঁটে যাবার দৃশ্যটাকে ভুলতে পারবে না। কারণ, তার এই হেঁটে যাওয়াটা ছিল স্নানের পোশাক পরে, আর সেই পোশাকে সমুদ্রসৈকতে আর তখন তার পেছন থেকে সে তাকে যেভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত, তখন তার দেখা থেকে বাদ পড়ত না তার হেঁটে যাওয়ার পথ আলো করে রাখা শহরের বাতিগুলি; আর, যেভাবে সে প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে থাকত আর যেভাবে সে তার সামনে এসে দাঁড়াত আর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরত— ঠিক এইসব অদ্ভুত কারণেই, সে বলল- গল্পটি আসলে কী নিয়ে?

আর, আসল কথাটা হচ্ছে, আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশন নিয়ে এরকম কোনও গল্পই সে লেখেনি। তবু, সে তার জানতে চাওয়ায় বলে- গল্পটি দু’জন মানুষকে নিয়ে, যারা দাঁড়িয়ে ছিল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আর তারা জীবনের যন্ত্রণাগুলো নিয়ে কথা বলছিল, কারণ তারা আলেকজান্দ্রিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছিল আর হয়ত তারা আরও কিছুদিন এখানে থাকতে চাচ্ছিল। তাদের সমুদ্রের প্রতি গভীর প্রেম ছিল। ও সাঁতার কাটতে পছন্দ করত, যদিও সে যে খুব ভালভাবে কাটতে পারত তা না, কারণ একদিন সে একেবারে তীরের কাছেই ডুবতে বসেছিল। তবে সে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল সেই পথটাকে দেখায়, যে-পথ দিয়ে তারা পরস্পর সমুদ্রতীরে চলে আসত কিংবা সেইসব ব্যাপার— রাতের ক্ষীণ আলোর নিচে তাদের একসঙ্গে বসে পড়া আর গল্প বলা যেন তারা শুধু ঢেউগুলিকেই দেখছে।

-আর স্টেশনের ব্যাপারটা? সে জানতে চাইল। গল্পে কি কোনও স্টেশনের উল্লেখ ছিল?

- হ্যাঁ, অবশ্যই সেখানে একটি স্টেশন ছিল। সে বলল- কেননা তারা তো প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে ছিল আর কথা বলছিল সমুদ্র নিয়ে, শহরের সড়কগুলো নিয়ে আর এখানকার বিস্ময়কর আবহ নিয়ে, পরিবেশ নিয়ে, তারা যে আলেকজান্দ্রিয়া নিয়ে, যেখানে তারা বাস করত আর এখন আলেকজান্দ্রিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে— এই বিষাদটুকু নিয়ে, কারণ তারা একজন আরেকজনকে ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিল।

সেও কি সত্যিকার অর্থেই আলেকজান্দ্রিয়াকে ভালবাসত? সে জানতে চাইল।

-এটা নিশ্চিত যে সে ভালবাসত— আর হ্যাঁ, কে এই নগরীকে ভালবাসে না বল? সে তাকে বলল।

সে সমুদ্রতীর ভালবাসত। কিন্তু নগরীর প্রতি তার কোনও আগ্রহ ছিল না। তার কারণ, কোনও শীতকাল সে এখানে কাটায়নি। যদি শীতকালটা থাকত, তাহলে অবশ্যই এই নগরীকে সে ভালবাসবেই, তবে যখন সে এখানে আবার ফিরে আসবে।

-সম্ভবত, সে বলল, তবে আমার ধারণা এখানে অন্যকোনও কারণ লুকান আছে। শুধুমাত্র শহরে যাওয়ার কারণেই কেউ কোনও শহরকে ভালবাসবে না। অবশ্যই অন্যকোনও কারণ আছে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই, সে জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল যে এটা কি আসলেই একটা প্রেমকাহিনী? কিন্তু রহস্যটা লুকিয়ে ছিল দুই লাইনের ভিতর আর খুঁজে বের করাটাও অত সহজ ছিল না, কারণ ব্যাপারটা দুর্বোধ্য।

কিন্তু ব্যাপারটাকে এত জটিল লাগছে কেন? সে জানতে চাইল। সে বলল, কারণ মেয়েটিকে সে ভালবাসত— যাত্রীদের ভিড়, ঠেলাঠেলির দৃশ্যের ওপর চোখ রেখেই সে বলল, মেয়েটি ছিল তার স্ত্রীর বোন। তাকে সে আগে কখনোই দেখে নি কিন্তু যেদিন দেখল, পড়ে গেল তার প্রেমে আর ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই খুব জটিল।

-আমি বুঝতে পারছি না যে কেন তুমি এমন এক নায়কের জন্ম দিচ্ছ, এমন একটা চরিত্র, যাকে মনে হচ্ছে সে খুব তীব্রভাবে জীবনকে ভালবাসে। সে সমুদ্র ভালবাসে। তাহলে কেন তাকে এই ধরণের অনুভূতি দিয়ে সৃষ্টি করছ?

- সে আসলেই এমন কিছু হোক চায়নি আর এজন্য সে খুব চিন্তিতও কিন্তু তা হলে কী হবে, ব্যাপারটা যে ঘটে গেছে। আর এই ঘটনার পেছনে আর কোনও কারণও ছিল না কিন্তু ব্যাপারটা এভাবেই লিপিবদ্ধ হয়েছে, ঠিক যা সে করেছে।

-ওহ। সে অস্ফুট শব্দ করল।

তারপর, সে আবার যাত্রীদের দেখতে শুরু করল আর সে তাকে খুব গভীরভাবে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরব থাকল তারা, যতক্ষণ না সে খুব অস্থিরভাবে নড়ে উঠল। তার স্ত্রী তার জন্য কিছু সিগারেট কিনে আনল, আর সে ছিল ক্লান্ত, কিছুটা অসুস্থ, তাই সে সিগারেট কিনতে যেতে পারছিল না।

-তোমাকে যা করতে হবে, তা হল গল্পটা পুরোটা তোমাকে পড়তে হবে, তাহলেই দেখবে যে তুমি এটাকে পছন্দ করে ফেলেছ... সে তাকে বলতে লাগল।

-কোন গল্পটা? তার কথা ভাল করে শেষ হবার আগেই সে কথাটা বলল।

- সে গল্পের নাম ‘তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশনটাকে দেখেছ?

-তুমি কি গল্পটা এই নামেই লিখেছিলে?

-হ্যাঁ, অনেকদিন আগে।

আমি মনে করতাম যে আমি তোমার সব গল্পই জানি, সে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, তার মানে হল তোমার এমন কিছু গল্পও আছে, যা আমি জানি না। তুমি কি লুকিয়ে লুকিয়ে লেখেছ?

সে বলল -হ্যাঁ, মাঝে মাঝে। কিন্তু, অই যে দেখছ ট্রেন চলে এসেছে। আসো, যাই।

যদিও সে ক্লান্ত ছিল আর কিছুটা অসুস্থও তবু, সে তাকে তার পিঠে তুলে নেয়, ঠিক যেমনভাবে তাদেরকেও একদিন ট্রেনের কামরার দরজা দিয়ে উঠতে দেখেছিল। তারপর,- বিষাদে, গভীর বেদনায়, প্ল্যাটফর্মের যতটুকু দেখা যায়, শেষবারের মত সে দেখে নেয় স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম, মানুষ আর প্ল্যাটফর্মের সেই ঘণ্টাটিকে!

লেখক পরিচিতি 
এমদাদ রহমান 

গল্পকার
অনুবাদক।
জন্ম সিলেট, বাংলাদেশ।
বর্তমানে ইংলন্ডে থাকেন। 

প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পাতালভূমি ও অন্যান্য গল্প।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ