এই কাহিনী আপনাকে নিয়ে। এই কাহিনী তোমাকে নিয়ে। আসলে আপনাকে নিয়ে বলার আগে সেই লোকটির কথা বলে নেই। তাকে আমরা খুঁজছি অনেকদিন ধরে। সে হয় সীমান্ত পার হয়ে এদেশে ঢুকে পড়েছে, অথবা ঢুকতে যাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে সে এদিকে আসছে না। অন্য কোথাও রয়ে গিয়েছে অনেক দিন ধরে। কিন্তু সে কোথায় আছে তা আমাদেরও জানা নেই। তার সমস্ত গতিবিধিই আমাদেরও অজানা, অথচ এটি সে যে-কোনও মুহূর্তে এই শহরেও ঢুকে পড়ে জনারণ্যে মিশে যাবে। তারপর হয় এই শহরে অথবা পৃথিবীর অন্য কোনও শহরে বড়সড় এক বিস্ফোরণ হয়ে যাবে। একই সময় এক শহরের নানা জায়গায় বিস্ফোরণ নতুন নানা শহরে একই সময় বারবার বিস্ফোরণ--কেঁপে উঠবে গোটা রাষ্ট্রই। আতঙ্ক ছড়িয়ে যাবে।
আমরা তাকে খুঁজছি যে লন্ডন শহরের বিস্ফোরণের সময় হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছিল স্পেনের সমুদ্রতীরে। চোখে ছিল দূরবিন। দেখছিল সমুদ্র পাখিদের উড়াল। অথবা কায়রো বিস্ফোরণের সময় অপেক্ষা করছিল লিসবন শহরে কোনও অভিজাত হোটেলে। একের পর এক ফোন ধরছিল নিজের মোবইল-এ।
কিন্তু আমাদের এই সমস্ত অনুমান যে সত্য, তা নাও হতে পারে। এমন হতে পারে যখন বাগদাদে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ হল, সে ছিল আমেরিকাতে বসে। টেলিভিশনে দেখছিল বিস্ফোরণের প্রকৃতি। আমদের অনুমান নানা সূত্র ধরে আকার পায়। কেউ কেউ আন্দাজ করেছে ওই সময় সে ছিল আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত গ্রামে, পাহাড়ের গুহায়। সবটাই অনুমান। আমরা ঠিক জানিনা সে কখন কোথায় থাকে, বিস্ফোরণের সময় ছিল কোথায় থাকে? আগামী বিস্ফোরণেই বা থাকবে কোথায়? আরবের মরু অঞ্চলে, উটের ক্যারাভানে, নাকি বাংলাদেশের কোন উপাসনালয়ে, পদ্মানদীতে ভাসা ইলিশের নৌকায়?
আমরা যে লোকটাকে খুঁজছি সে পাতালরেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, লন্ডন শহরে। তারপর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে কায়রোর হোটেলে, তারপর জাকার্তার এক নাইট ক্লাবে।পরপর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বাগদাদের মার্কেট প্লেসে, কুয়েতের বিমান বন্দরে এইরকম অসংখ্য জায়গায়। আমরা এও জানি সেই লোকটি আবার বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছে পৃথিবীর বড় কোন শহরে। যেখানে যারা বেশি সতর্ক, সেখানেই তারা ঢুকে পড়ে আচম্বিতে। তার সম্ভাব্য টার্গেট হিসাবে আছে বিমানবন্দর, রেলষ্টেশন, সমুদ্রবন্দর, পার্লামেন্ট হাউস, অ্যাসেমব্লি হাউস, নাইটক্লাব, হোটেল, রিসোর্ট, ম্যাসাজ ক্লিনিক-- ইত্যাদি। আমরা জানি, দেশে দেশে যত সীমান্ত তা পার হয়ে হয়ে সে এদেশে থেকে ওদেশে চলে যায় অনায়াশে। সুদীর্ঘ সীমান্তে রক্ষীদের পাহারা, কাটাতারের বেড়া সব তার কাছে তুচ্ছ। হয়ত সে জানে সীমান্ত কখন অরক্ষিত হয়ে যায়, কখন সীমান্ত রক্ষীর মনে পড়ে যায় নিজ গ্রামের কথা, কখন সীমান্ত রক্ষী ব্যস্ত হয়ে পড়ে পারাপার নিয়েই। আর জানে বলেই পারাপার তার কাছে কোন সমস্যা নয়। অথবা এমন হতে পারে সে কোন সীমান্তকেই সীমান্ত বলে জানে না, যেমন জানে যা, যাযাবর জাতি, আরব বেদুইন, সাপুড়ে, বেদের দল, পরিযায়ী পাখির দল। অথচ এও সত্য যে আনন্দময় পরিযায়ী পাখির দল, বেদুইন, যাযাবর জাতির সংগে তার কোন তুলনাই টানা যায় না, তারা থাকে দলে দলে, দৃশ্যমান হয়ে। আর সেই লেকটি একা, গোপনে ধ্বংসের মৃত্যুর ছক কষে এদেশে থেকে ওদেশে যায়। তার জাল বিছানো আছে সমস্ত দেশেই, কিন্তু জালের উৎসটি কোথায় তাকে কেউ জানে না। তার হয়ে যারা আজ মাদ্রিদে, কাল লন্ডনে, পরশু বুয়েনস আয়ার্স-এ বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে, তারা কেউ তাকে চেনে না। আর সেই লোকটি যে লন্ডন, মাদ্রিদে বা লিসবনে বিস্ফোরণের সময় উপস্থিত থাকছে কিনা তাও অজানা। কিন্তু লোকটা কোন না কোনও সময়ে বিস্ফোরণের আগে ওইসব শহরে যে যায়নি, সমুদ্রতীরে বা কাফেতে গিয়ে ছক কষেনি বিষ্ফোরণের তা স্পষ্ট করে বলা যায়না।
আমরা তাকে নিয়ে ভেবেছি অনেক। সে কিভাবে দেশ থেকে দেশান্তরে গিয়ে মানুষকে ক্রমাগত আতঙ্কিত করে তোলে। পাসপোর্ট, ভিসা, সীমান্তরক্ষী, অভিবাসন আইন কোন কিছুই তার কাছে কিছু নয়। সে যে-কোন মুহুর্তে যে-কোন দেশে ঢুকে পড়ছে। পরামর্শ করছে, ধ্বংস করে দিচ্ছে বিমানবন্দর, হোটেল, রেস্তোরাঁ, টিউব-ষ্টেশন, যা যা বহুমানুষ বহুদিন ধরে নির্মাণ করে তাদের শহরকে সাজিয়ে তুলেছিল। এসবের পর তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না। তখন সে হয়ত বহুদূরের কোন সমূদ্র তীরে বা হিল স্টেশনে বসে দূরবিনে লক্ষ্য করছে কিভাবে, কোথায় আবার আতংকের ধোয়া উড়িয়ে দেবে। কীভাবে ঢুকে পড়বে হেড কোয়ার্টারে, যাত্রীভরা বোয়িং বিমানে। কীভাবে কমপক্ষে সাজিয়ে রাখবে ল্যান্ড মাইন, ধ্বংস করে দেবে মিলিটারি কনভয়। কীভাবে উড়িয়ে দেবে ভালবাসায় ভরা, ঘুমে ভরা যাত্রীবাহী রাতের রেলগাড়ি। আমরা সেই লোকটিকে খুঁজি সে সবার অলক্ষে ঢুকে পড়েছিল জাকার্তায় নাইট ক্লাবে। কিন্তু সে সন্ধ্যায় ঢুকেছিল, না মধ্যরাতে তা জানা যায়নি, নাইট ক্লাব মধ্যরাতেও জেগে ওঠে। উন্মাদ হয় বিবসনা প্রায় নারী আর সুরাতে। ধ্বংস কান্ডের পর সেখানে পৌঁছে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তে জানা গিয়েছে লোকটি এসেছিল। শক্তিশালী টাইম বোমা রেখে হয় অপেক্ষা করছিল, নতুবা বেরিয়ে গিয়েছিল নিরাপদ সময়। এমন হতে পারে ঐ বিস্ফোরণের সংগে জড়িত কেউ, যে তার নির্দেশে এসেছিল টাইম বোমা নিয়ে, সেও মারা গিয়েছে বিস্ফোরণে। কিন্তু কোন মৃত্যুদেহটি তার তা ধরা যায়নি। কোন দেহকেই চেনা যাচ্ছিল না। দলাদলা মাংসপিন্ড এখানে ওখানে ছড়িয়ে গিয়েছিল। মৃতদেহের ভিতর বিদেশি ছিল অনেক। তার ভিতরে ইউরোপিয়ান যেমন ছিল, তেমনি ছিল নানা এশীয় দেশের টুরিস্ট। আমারা তাকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে পারিনে। কিন্তু আন্দাজ করেছি ক্লোজড সার্কিট টিভির ছবি মিলিয়ে মিলিয়ে। যত মানুষ ঢুকেছে আর যত মানুষ বেরিয়েছে বিস্ফোরণের আগে পরে, তাদের পরিচয় খুঁজতে খুঁজতে আমারা পেয়ে গিয়েছি অনেকরকম মুখ। অনেকরকম গায়ের রং। অনেক রকম গায়ের রং তাদের চুলের । কারো চুল ছিলনা। কারোর চুলে ছিল আফ্রিকার মানুষের ধরণ। অনেক রকম ছিল তাদের বয়স। যুবকেরা ছিল, মধ্যবয়সীরা ছিল, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ছিল। আমরা জানিনা সে যুবক না বৃদ্ধ না মধ্যবয়সি। সেইসব মানুষের মুখে ছিল নানারকম ভাব, চোখে ছিল নানারকম দৃষ্টি। কারো দৃষ্টিতে ছিল কামুকতা, কারোর ছিল শুধুই বিস্ময়। কিউ কেউ ছিল ভাবলেশহীন, কারোর মুখে আতঙ্কের চিহ্ন। এত মুখ, এত মানুষের ভিতর থেকে তাকে শনাক্ত করতে হবে যে কিনা বহন করে এনেছিল বিস্ফোরক।
এ কাহিনী আপনাকে নিয়ে। তোমাকে নিয়ে। কিন্তু তার আগে সেই লোকটির কথা বলা শেষ হোক।
আমারা সেই লোকটিকে চিনে নিতে চাইছি যে কিনা লন্ডন টিউব-স্টেশনে রুকস্যাকে কাঁধে নিয়ে কয়েকটি যুবককে নামিয়ে দিয়েছিল বিস্ফোরক সমেত। তারা হয়ত জানতোনা তাদের সংগে কি ছিল। সে যদি এসে থাকে তাদের সংগে, দূর থেকে অনুসরণ করে ফিরে গিয়ে থোকে বিস্ফোরণের পূর্ব মূহুর্তে তার চেহারা রয়ে গিয়েছে ক্লোজড সার্কিট টিভিতে। আমরা দেখছি কতরকম মানুষ সেদিন প্রবেশ করেছিল টিউব স্টেশনে। কতরকম তাদের মুখ, কত ধরণের হাটা চলা। কত রকম হাসি ছিল মুখে। এর ভিতর থেকেই আমরা খুঁজে বের করবো।
এভাবে রোমে, মাদ্রিদে, লিসবনে, পারিতে, ঢাকায়--সর্বত্র তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমরা। তার ছড়িয়ে দেওয়া লিফলেটগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে সতর্ক হয়ে উঠছি আরো। কিন্তু সে রয়ে গিয়েছে অধরা।
এখন সেই লোকটি হয়তো সীমান্ত পেরিয়ে অথবা বিমান বন্দর দিয়ে ঢুকে পড়েছে আমাদের এই শহরে। এই শহরে বিস্ফোরণ হলে বহু মানুষ একসঙ্গে মারা যাবে সত্য। এত মানুষ আর কোন শহরে আছে। এই শহরে সমস্ত দিন ট্রেনে, বাসে রেলস্টেশনে, শপিং মলে, ফ্লাইওভারে, পার্কে, সিনেমায়, থিয়েটারে ম্যাজিক শো-এ ভীড় করে থাকে এত মানুষ যে বিস্ফোরণ হলে বহুজন হতাহত হবে। এই শহরে পাতালে, আকাশে, মাটিতে এত মানুষ সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকে যে দেখলে ভয় হয়, কতজন মারা যাবে বিস্ফোরণ হলে। বিস্ফোরণ আটকাতে আমরা তাকে খুঁজে বের করছি। সমস্ত শহরেই আমরা নেমে পড়েছি সন্দেহভাজনের খোঁজে-- লন্ডনে, মাদ্রিদে, বাগদাদে, নিউইয়র্কে, ঢাকায়, কলকাতায়। আমরা জানি সে কোনও না কোনও শহরে আছে। থাকতেই হবে। ক্লোজড সার্কিট টিভি তো অসংখ্য ছবি দিয়েছে আমাদের।
কাহিনী তোমাকে নিয়ে। আপনাকে নিয়ে। আপনি সে হতে পারেন কেন না আমরা যত এশিয়ান, আফ্রিকান, লাতিন আমেরিকান মানুষের ছবি পেয়েছি অকুস্থলের টেলিভিশন থেকে, তাদের কারও না কারোর সঙ্গে আপনার মুখের মিল আছে, কাহিনী আপনাকে নিয়ে তাই আমরা আপনাকে অনুসরণ করছি। আপনি দ্রুত হাঁটছেন। বাসে উঠবেন হয়তো। অথবা টের পেয়ে গিয়েছেন আপনার নিয়তি। তাই দ্রুত পার হয়ে যেতে চাইছেন এই পথটুকু। আপনি জানেন না নিজের অজান্তে আপনি হয়ে গিয়েছেন সন্দেহভাজন। কেননা আমরা আমরা সন্দেহ করতে ভালবাসি। আমাদের কাজ একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা। আমরা পেয়েছি।
সন্দেহ করা জেরা করে করে সন্দেহটিকে সত্য করে তোলায় আমরা যথেষ্ট দক্ষ যে তার প্রমাণ বহুবার দিয়েছি। বিভিন্ন নগরে, গ্রামে-গঞ্জে বহুবার আমরা আমাদের দক্ষতা প্রমা্ণ করছি। সন্দেহকে সত্য করে তুরতে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছি নগরে, নগরে। ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দখল করে ফেলেছি অন্যদেশ। সেই কাজ সফল করতে ধ্বংস করে ফেলেছি হাসপাতাল, ইস্কুল, কলেজ, শিশুদের খেলার জায়গা। তাদের নামতা পড়া কষ্ট বুজিয়ে দিয়েছি আতঙ্কে। বড় কাজ করতে গেলে হয়।
ওয়ান্টেড পার্সনকে আমাদের ধরতেই হবে। সেই করণে যে-কোনও পথেই আমরা যেতে পারি। তাকে খুঁজতে গাঁ উজাড় করতে পারি। বনপথে কেউ ল্যান্ড মাইন বসিয়ে গেলে, সেই লোকটার খোঁজে সন্দেহের বশে যে কোনও মানুষকে ঢুকিয়ে দিতে পারি জেলখানায়। জেলখানায় এখনও কতো বুড়োবুড়ি। তারা জেলখানায় থেকেই থেকেই এমন হয়ে গেল। জেলখানায় কত যুবক-যুবতী। তারা অশক্ত না হয়ে পড়লে বার্ধক্যে না পৌঁছলে সন্দেহ থেকে মুক্তি নেই।
কহিনীটা তোমার। আমরা তোমাকে সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখে দিয়েছি। তোমার চোখ বলছে তুমিই সেই। তোমার গায়ের রং, মাথার চুল, চুলের রং, চোখের মনির রং, তোমার উচ্চতা, তোমার স্বাস্থ্য, বলছে তুমিই সেই। ক্লোজড সার্কিড টিভিতে যত মানুষ ধরা পড়েছিল সেদিন তাদের ভিতরে তোমার মত কেউ ছিল। লন্ডনে, কায়রোয়, মাদ্রিদে। তোমার নাক-মুখ, চোখের তলার আবছা হয়ে আসা ক্ষতচিহ্ন আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে তুমিই সেই। তুমিই বনপথে ল্যান্ডমাইন বসাও, নগরে নগরে বিস্ফোরণ ঘটাও, আতঙ্ক তৈরি করে দাও মানুষের ভিতর।
তুমিই সেই। সেই সন্দেহভাজন যাকে আমরা খুঁজে যাচ্ছিলাম এখানে। তুমিই সেই ব্যক্তি কেননা আমরা তো জানি না সেই আত্মগোপনকারীর চেহারা কেমন। তার উচ্চতা, গায়ের রং, মাথার চুল, চোখের মণি-- কোনওটাই আমাদের চেনা নয়। চেনা নয় বলেই সন্দেহভাজনকে শনাক্ত করতে সুবিধেই হয় আমাদের। আমরা জানি না সে এশিয়ার মানুষ না আফ্রিকার, আবর দেশ না আফগানিস্তান থেকে ঢুকে পড়েছিল আমাদের শহরে। সুতরাং তুমিই সেই। তোমাকে দেখে তার সম্পর্কে একটা ধারনা করতে পারি আমরা। সে তোমার মত উচ্চতার, তোমার মত তার গায়ের রং, তোমার মত তার চোখদুটি, চোখের মণি। জাকার্তার নাইট ক্লাবে সে ঢুকেছিল, বেরিয়ে এসেছিল বিস্ফোরণের আগে। আমরা ভেবে নিতে পারি তুমি ওই সময় জাকার্তায় ছিলে। আর এক সময় ছিলে স্পেনের সমুদ্রতীরে, লিসবনের হোটেলে।
তুমিই সে কেননা তোমার সঙ্গে তার মিল আছে। এই কাহিনী তোমার। তুমি তো জান সন্দেহই আমাদের মূল উপজীব্য। সন্দেহের বশে একটা গোটা দেশ আমরা ধ্বংস করে দিতে পারি। মুছে দিতে পারি প্রচীন সভ্যতার নানান চিহ্ন। বহুদিন ধরে গড়ে তোলা একটি নগরকে ধুলো করে দিতে পারি। অসংখ্য মানুষের জীবন শেষ করে দিতে পারি। করেছিও তা। জাদুনগরী বাগদাদের কথা ভাবো। সবটাই তো ছিল সন্দেহ।
কাহিনী তোমারই। কেননা তুমি বোধহয় টের পেয়েছ তোমাকে কেউ কেউ অনুসরণ করছে। তাতে তোমার পায়ের গতি বেড়েছে। দিনের আলোয় এখন সমস্ত শহর ঝলমল করছে। ক’দিন ধরে কারফিউ ছিল, সঙ্গে ছিল মেঘ আর বৃষ্টি। মানুষ ছিল ঘরবন্দি। এখন সবাই বাইরে। এই ক’দিন ধরে তোমার বাড়িতে চোখ রেখেছিলাম আমরা। অনুসরণ করছি।
তুমিই সেই। সন্দেহটা দৃঢ় হয়েছে তোমার আচরণে। ঘর থেকে বেরোলে তুমি কয়েক পা দ্রুত হেঁটে হঠাৎই ফিরলে। মিনিট কয়েক বাদে আবার বের হলে, কিন্তু বেরিয়েই আবার ফিরে গেলে বাড়ি। আমাদের সন্দেহ তুমি টের পেয়েছিলে। আমাদের একজন সাদা পোশাকে দাঁড়িয়েছিল রোইনট্রির নিচে। তাকে তুমি চিনতে পেরেছিলে মনে হয়। দূরে প্রচীন শিরিষ গাছটির ছায়ায় অপেক্ষা করছিল পুলিশের জিপ। তুমি তা দেখতে পেয়েছিলে। তুমি ভয় পেয়েছিলে নিশ্চয়ই।
পরে জানা গেল তুমি প্রথমবার ফিরেছিলে দেরি হবে ফিরতে সেই কথাটি বলতে। পরের বার ফিরেছিলে কবিতার বইটি ফেলে গিয়েছ, তাই। এতে আমাদেরও সন্দেহ সত্য হয়। মন চঞ্চল হলে, উদ্বেগ বেড়ে গেলে বরাবর এমন ভুল হতে থাকে।
তুমি হাঁটছ। আমরা তোমাকে অনুসরণ করছি। তোমার রুকস্যাকটি দেখে আমার সন্দেহ সত্য হয়ে উঠেছিল যেন। প্রয়োজনে তুমি আবার বিস্ফোরণ ঘটাবে। রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাবে। অথচ এখন টের পাচ্ছি, তোমার হাঁটার ভিতরে কোনও উদ্বেগ ছিল না। খুব স্বাভাবিক যেন কোন অপেরায় চলছে বান্ধবী অপেক্ষা করছে এখানে। যেন কোন মেজিক শো দেখতে চলেছে, সেখানে বান্ধবীর হাতে গোলাপটি দেবে। পথের ধার থেকে গোলাপ কিনেছিলে একগুচ্ছ। এতে আমার সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছিল। মনে হচ্ছিল তুমি আমাদের ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছ।
কহিনীটা এখন তোমার। তুমিই সেই লোক যাকে আমরা হয়তো দেখেছি ক্লোজড সার্কিড টিভিতে। অস্পট দেখেছি। বহুদূরে যেন দাঁড়িয়েছিলে তুমি। পিঠে রুকস্যাক। তোমাকে সন্দেহ করতে করতে আমরা মেট্রো স্টেশনে পৌঁছলাম। তুমি দ্রুত এগিয়ে গেলে খোলা কামরার দিকে। তোমার পিছনে পিছনে আমরা। তুমি রুকস্যাকটি নামালে পিঠ থেকে। আমাদের একজন এগিয়ে গিয়ে তোমার জামার কলার ধরল, হেঁকে, উঠে আয় বাসটার্ড।
আপনি জানেন এই কাহিনী অনেক পুরানো। এই ঘটনা কত ঘটেছে। সাতটি গুলিতে ব্রাজিলীয় যুবক হত হওয়ার পরও এই কাহিনীতে নতুন কোনও মাত্রা জোড়া যায় না। এই রকমাই তো ঘটে থাকে। ঘটেনি কী? মধ্যরাতে কত ঘুমন্ত দম্পতির ঘুম ভেঙ্গেছে আতঙ্কে। স্ত্রীর পাশ থেকে স্বামীকে তুলে নিয়ে গিয়েছে যে, পরের দিন আর স্বীকারই করেনি। অথবা সমস্ত রাত জেরার পর আতঙ্কিত স্বামী বাড়ি ফিরে আবার বেরিয়েছে। উন্মাদ হয়ে গলা দিয়েছে রেললাইনে।
এই কাহিনী আগেও বলা হয়েছে আনেকবার। স্পেনে, মিশরে, কলম্বিয়া, আমেরিকায়, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে, ভারতবর্ষে, চিনে, ইতালি, জার্মানিতে। এশিয়া, ইউরোপ। সব দেশ, মহাদেশে দেখা গিয়েছে একই পরস্পরা।
এই কাহিনীতে রং লেগে যেত যদি সেই যুবক হত এশিয়ার কেউ। আর পরিচয় হত কুয়াশায় ঢাকা। কিন্তু ছিল নিতান্তই সাধারণ কেউ। বেঁচেবর্তে থাকা মানুষ। হয়তো প্রেমিকার সঙ্গে সমস্তদিন ঘুরত পার্কে পার্কে, নতুবা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলত অদ্ভুত সব। তার শার্টটিতে মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে এসেছিল তা ছিল সমুদ্র নীলরঙে ভরা। সেই নীলের ভিতরে রক্তাক্ত সমুদ্র পাখিটি আছড়ে পড়েছিল হয়তো। অথবা অন্যরকম হতে পারে। রক্তাক্ত পাখিটিকে সে তুলে এনেছিল বেলাভূমি থেকে, বুকে চেপে। তাকে বাঁচিয়ে তুলবে। আর মনে পড়ে গিয়েছিল স্পেনের সমুদ্রতীরের কথা। মরণের সময়ও মরণের কথা ভাবে না মানুষ।
আমরাই তো ছিলাম সেই শিকারিদের একজন যে কিনা পাখি শিকারে সমুদ্রতীরে পৌঁছে গিয়েছিল একদিন। সেই গুলিবিদ্ধ উড়ন্ত পাখির রক্ত এসে আবার ঝাপটা মারল যেন টিউব-রেলের কামরা থেকে টেনে বের করা যুবকটির শার্টে। সমুদ্র নীল ভেসে যেতে লাগল রক্তে। রক্তের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। আমাদের সন্দেহ অমূলক ছিল না। ব্রাজিলীয় যুবকটি হলেই তো হতে পারত বিস্ফোরকবাহী কেউ। সেই তো একদিন মৃত পাখিটিকে তুলে এনেছিল বুকের ভিতর থেকে। গভীর সমুদ্র থেকে উড়ে এসেছিল যে নীল হাওয়া, তার কারনেই তো সমুদ্র নীল হয়ে গিয়েছিল তার জমা জুতো প্যাণ্ট, শার্ট মাথার চুল আর চোখের মণি।
ব্রাজিলীয় যুবকের কাছে হেরে গিয়েও আমরা বলিনি হেরেছি। এইরকম হার তো প্রতিনিয়ত হারতে হয়। সন্দেহের বসে যে যুবকটি জেলখানায় থেকে থেকে বুড়ো হয়ে গেল, তার কাছেও তো হেরে যাই বার বার। বারবার সাজাতে হয় নতুন নতুন কথা। নতুন মোকদ্দমা। তবু আমাদের খুঁজে বের করতে হবে নতুন নতুন সন্দেহভাজন মানুষ। হয়তো আপনিই সে।
কাহিনীটি আপনার। আপনি জানেন না আপনাকে আমরা নিঃশব্দে আনুসরণ করছি। দু’একটি সবুদ ব্রাজিলীয় যুবকের নোটবুকে আপনার নাম, বা অন্য কোনও সন্দেহভাজনের ডায়েরিতে আপনার টেলিফোন নম্বর-- এই-ই যথেষ্ট। এরপর কোনওদিন মধ্যরাতে আপনার ফ্ল্যাটের দরজায় বুটের লাথি-- দরজা খুলুন। না হলে টিউব স্টেশনে পরপর সাতটা গুলি, তুলে নিয়ে গিয়ে না ফিরিয়ে দেওয়া সন্দেহটা তখন সত্য হবে।
আপনার পিছনে আমরা আছি। সন্দেহ দৃঢ় হচ্ছে। আপনিই সে। সেই চোখ সেই মুখ যা আমরা নিজেরা কখনও দেখিনি। অনুমান করে নিয়েছি সন্দেহের বসে।
আশ্চর্য! আমরা তো জানি যার প্রতি সন্দেহে আপনাকে অনুসরণ, সেই ব্যক্তি, সেই অচেনা মুখ বিস্ফোরক নিয়ে আমাদের অনুসরণ করে যাচ্ছে ক্রমাগত। রাস্তায় ল্যান্ডমাইন, টাইম বোমা-রিমোর্ট কন্ট্রোল তার হাতে। সমস্তটাই ডাইনি। ঘাড় ঘুরিয়ে মুখখানি যে দেখব উপায় নেই। এখন আমাদের চোখ আপনার দিকে। উধাও না হয়ে যান। দরকারে সাতটি গুলি। আপনিই সে, কাহিনীটি আপনারই।
লেখক পরিচিতি
অমর মিত্রজন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাছে ধুলিহর গ্রামে | বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে | তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্রউপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।]
প্রকাশিত বই : পাহাড়ের মত মানুষ, অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, ধুলোগ্রাম, অশ্বচরিত, আগুনের গাড়ী,ধ্রুবপুত্র, নদীবসত, কৃষ্ণগহ্বর, আসনবনি, নিস্তব্দ নগর, প্রান্তরের অন্ধকার, ভি আই পি রোড, শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, সমাবেশ, সারিঘর, সুবর্ণরেখা, সোনাই ছিলো নদীর নাম, হাঁসপাহাড়ি।
পুরস্কার : সাহিত্য একাডেমী।
2 মন্তব্যসমূহ
নিশ্বাস রুদ্ধ করে শেষ করলাম। মনে হচ্ছে কেউ তর্জনী তুলে আছে এখনও - 'কাহিনিটি আপনার'।
উত্তরমুছুনসে কি ভয়? সে কি আতঙ্ক? সন্দেহ? অবিশ্বাস? এই অহোরাত্র তাড়া করে চলেছে... পালানোর পথ নেই।
স্যালুট লেখককে...
শ্রাবণী দাশগুপ্ত।
অসম্ভব ভালোলাগল এই গল্পটি, অমরদা। :)
উত্তরমুছুন