ছুটির লেখা
স্বকৃত নোমান
সার্ত্র পৃথিবীতে যে আদর্শ খুঁজছিলেন বা যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তার বিপরীত আদর্শের সঙ্গে তাকে লড়াই করতে হয়েছে আজীবন। তাই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের ওপরই ছিল তার অত্যাচার। নোবেল পুরস্কার বা ফরাসি সরকারের রাষ্ট্রীয় শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘লিজিয়ন অফ অনার’ প্রত্যাখ্যান হয়ত এই অত্যাচারেরই অংশ। নোবেল প্রত্যাখ্যান বিষয়ে তার বিবৃতির অর্থ এই দাঁড়ায়, এমন একটা প্রকট পাশ্চত্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক সংগ্রামে তিনি কোনো পক্ষ অবলম্বন করতে চান না। বস্তুত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির মূল্য সার্ত্রের কাছে ছিল না। তার মতে, ‘আমি কোনো প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে চাই না।’ তার সব কাজই আসলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তার মতে, প্রতিষ্ঠান আছে বলেই পৃথিবীতে মানুষ তার পূর্ণ বিকাশ পায় না। মানুষের সদর্থক কাজ আর নঞর্থক চেতনার স্পর্ধা পূর্ণ রূপ পায় না। তাই মানুষ কোনোদিনই পূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে না। সার্ত্রের কাছে প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড। সার্ত্রের আজীবনের প্রার্থনা ছিল, সামাজিক কল্যাণের জন্যই ব্যক্তির যাবতীয় কাজ, কিন্তু ব্যক্তিই গ্রহণ করবে তার নিজের শেষ সিদ্ধান্ত। সামাজিক সত্তা কোনোভাবে ব্যক্তিসত্তাকে নিষ্পেষণ করবে না।
প্যারিসীয় সার্ত্রের সঙ্গে পাকিস্তানি ইকবালের দর্শনের অনেকটা মিল খুঁজে পাই। ব্যক্তিত্বের এই বিকাশের কথা পাকিস্তানের ইকবালও ঠিক এভাবেই বলেছেন। ইকবাল কিন্তু সার্ত্রের অগ্রজ। তার মানে আমি এটা বলতে চাচ্ছি না ইকবাল কর্তৃক সার্ত্র প্রভাবিত। তা মোটেই না। কিন্তু উভয়ের দর্শনে ঐক্য রয়েছে। ইকবাল তার ‘আসরার-ই-খুদী’ কাব্যে ‘খুদী’ বা ‘অহং’ বা ‘আমিত্ব’র প্রতিষ্ঠার কথা খুব জোর দিয়ে বলেছেন। ‘দর দাস্তে জুনান মান জিবরিল জবুন সায়েদী/ ইয়াজদান বা কামান্দ আওয়ার আই হিম্মতি মর্দানা।’ অর্থাৎ ‘আমার পাগলামির মরুভূমিতে জিবরাইল তো সামান্য শিকার মাত্র। হে আমার সাহস ও শক্তি, স্বয়ং সর্বশক্তিমানকে বেঁধে ফেল।’ এই পাগলামি আমিত্বের, অহংয়ের, ব্যক্তির প্রচণ্ড শক্তির পাগলামি। ‘খুদী’ বা ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা দর্শনের সঙ্গে যার পরিচয় ঘটে নি, ইকবাল বলেছেন, তার জীবন অর্থহীন।
ইকবালের কাব্য ‘আসরার-ই-খুদী’তে দেখতে পাই তিনি ব্যক্তিগত জীবন বিকাশের পরামর্শ দিচ্ছেন এবং ‘রামুয-ই-বেখুদী’তে সমষ্ঠিগত জীবন বা সামাজিক জীবনের বিকাশের পরামর্শ দিচ্ছেন। ইকবালের কাছে মানুষই একমাত্র সত্য, ব্যক্তিই একমাত্র সত্য, অন্যসব প্রহেলিকা। অদৃষ্টবাদীদের যুক্তি খণ্ডন করে ইকবাল বলেছেন, ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তিতে মানুষ সম্পূর্ণই স্বাধীন। ‘আসরার-ই-খুদী’ গ্রন্থে তিনি প্লেটোনিক দর্শনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। ইকবালের মতে, প্লেটোর শিক্ষা মানুষের উদ্যমশীল জীবনকে চিন্তাশ্রয়ী, অসৃজনশীল নিয়তিবাদের দিকে ঠেলে দিয়ে সৃজনশীল দর্শনের পথ থেকে বিচ্যুত করে। ইকবাল পরামর্শ দিয়েছেন মানুষকে সর্বপ্রকারের দূর্বলতা পরিত্যাগ করে সৃজনশীল হওয়ার জন্য। তার মতে, দুর্বলতাই মানব-জীবনের সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠন করে জীবনকে অহেতুক ভয় ও আত্মপ্রবঞ্চনায় ভরে তোলে। সুতরাং ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাও। অর্থাৎ সার্ত্র বলেছেন ‘সুপারম্যান’-এর কথা, আর ইকবাল বলেছেন ‘ইনসানে কামেল’-এর কথা।
ইউরোপে পড়ালেখা করা ইকবাল, ‘আসরার-ই-খুদী’র জন্য বৃটিশ সরকার কর্তৃক ‘নাইট’ উপাধি পাওয়া ইকবাল, নাস্তিকতার প্রধান তোরণে পা রাখা ইকবাল শেষ পর্যন্ত কিনা হয়ে গেলেন তথাকথিত ইসলামি পুনর্জাগরণবাদী! হয়ে গেলেন বিশিষ্ট ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিক বা আল্লামা। হয়ে গেলেন আবুল আলা মওদুদির তাত্ত্বিক গুরু। ‘আসরার-ই-খুদী’তে ইকবাল যে তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন, তাতে তার এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। তা অন্য প্রসঙ্গ। আমি শুধু সার্ত্রের ‘আমি’র সঙ্গে ইকবালের ‘খুদী’কে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম মাত্র।
জাঁ পল সার্ত্র পাঠ ও বুঝে ওঠার প্রচেষ্টা
২২.১২.২০১৪
1 মন্তব্যসমূহ
অনেক ভালো হয়েছে। ইকবাল আমার প্রিয় লেখক।
উত্তরমুছুন