“শকুন্তলা ধীরে ধীরে তার আভরণ খুলে রাখলেন। কেয়ূর, কুণ্ডল, নথ। নুপুর জোড়া শুধু রয়ে গেল। দুষ্মন্তের কঠিন বাহুতে ভীত সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো নিজেকে সঁপে দিলেন। অনাঘ্রাতা শকুন্তলা তার উন্মুক্ত বক্ষে দুষ্মন্তকে পেষণ করে বললেন, আমাকে ভুলে যেও না রাজা।’’
এইটুকু বলে থামলেন মদনলাল পণ্ডিত। নেহাত ছেলেদের কলেজ, তাই এই ভাবে শকুন্তলা-উপাখ্যান ব্যাখ্যা করতে পারছেন। এই অংশটুকু বললেই পণ্ডিত মশাইয়ের চোখমুখ আরক্ত হয়। শরীর থেকে দুরন্ত আগুনের প্রবাহ বয়ে যায়। ভাগ্যিস তার ক্লাসে কোনও রমণী নেই। থাকলে কি আর তিনি স্বাধীনভাবে পড়াতে পারতেন! দিন কয়েক হল, একটি বিষয় খুব ভাবাচ্ছে পণ্ডিতকে। সরকার নাকি নিয়ম করেছে, শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগে কোনও লিঙ্গ-বৈষম্য করা যাবে না। ‘ন লিঙ্গং ধর্ম্মকারণম্’—তারাকুমার কবিরত্নের হিতোপদেশ মনে পড়ল তার। কাব্যচর্চা করে দিন কাটে, আর এর মধ্যে রমণী ঢুকে পড়লে মহা সর্বনাশ হবে। যৌবনকালে এক সৈরন্ধ্রী তাকে বলেছিল, “বায়ুন ঠাকুর, আপনি একখান ঢোঁড়া সাপ। টাকা দেখাইসেন! এক রাতে হাজার টাকা কামাইতে পারি!’’ তিনি যদি নির্বিষ ডুণ্ডুভই হন তা হলে নিজেকে নিয়ে এত ভয় কেন! রুরুর দর্শনে ডুণ্ডুভ অবশ্য সহস্রপাত ঋষিতে পরিণত হন। এখন এই কলেজে যদি রমণী-শিক্ষয়িত্রী প্রবেশ করেন, তিনিও কি ঢোঁড়া সাপ থেকে ঋষিতে পরিণত হয়ে ফণা তুলবেন!
কবে তার পূর্বপুরুষ ওড়িশা থেকে এসে মেদিনীপুরের এক গ্রামে যজমানির কাজ নিয়ে এসেছিলেন, তা তার মনে নেই। বাল্যকালে কাবাডি খেলে মদনলাল পণ্ডিতের ব্রহ্মচর্য সুদৃঢ় হয়। কলেজ-জীবন থেকেই নারী হতে শত-সহস্র হস্ত দূরে থাকতেন। খগমের মতো পুরুষ বন্ধুদের নিয়ে কেটে গিয়েছে কলেজ-জীবন। শরীরে যাতে কামভাব তীব্র না হয়, সেজন্য তখন মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। কুক্কুটাণ্ড দেখলেই গা-বমি করত। এমনকি মুসুর ডালের পরিবর্তে মুগ ডাল খেতেন, এতে শরীর শীতল হয়। বিয়ের পর থেকে অবশ্য সব কিছুই খেতে শুরু করেন, বাছবিচার করেন না। তবে বিবাহিত হয়েও যে ব্রহ্মচর্য পালন করা যায়, তা তিনি হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। পণ্ডিতমশাই স্ত্রী-সহবাসকে কখনও পুরুষার্থ জ্ঞান করেননি। শাস্ত্রের অনুশাসন মেনেই কামের উপভোগ করেছেন। ঋত্বভিগমনে তার ব্রহ্মচর্য স্খলিত হয়নি। তবে এতে করেও দেহ-মনের চাঞ্চল্য কিছুতেই দূর করতে পারেন না। কাব্যই এর জন্য দায়ী বলে মনে হয় তার। রমণীয়ার্থপ্রতিপাদকঃ শব্দঃ কাব্যম্। মদনলাল পণ্ডিতের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, “কারে কব কাব্য কহ, যে যাহারে সঁপে দেহ, সে নাকি তাহার কাটে শির।’’
ছেলেদের এই কলেজে পুরুষ শিক্ষকদের মধ্যে এক মহিলা যোগ দেবেন, এই খবরটা শোনার পর থেকে পণ্ডিত আর মনের স্থিরতা বজায় রাখতে পারেন না। কাব্যচঞ্চল তার মস্তিষ্ক, তাই সর্বদা নানা আদিরসাত্মক কথা পেটের ভেতর থেকে ভুসভুস করে বেরোতে থাকে। স্টাফরুমে সে সব কথা শোনার জন্য বহু সহকর্মী উদগ্রীব হয়ে থাকেন। তিনিও না বলে থাকতে পারেন না। মনে হয় দম আটকে মারা পড়বেন। এখন যদি এক নারী এর মধ্যে প্রবেশ করেন, তিনি কী করবেন! মারা যাবেন, নাকি তার সামনেই বলবেন এই সব কামকলা আর ইন্দ্রিয়াসক্তির গল্পগাছা!
এই তো এক ক্লাসে সে দিন বলেই ফেললেন, “নেহাৎ এখানে মহিলা নেই, তাই তোমাদের এমন খোলাখুলি শিক্ষাদান করতে পারছি। নইলে অর্ধেক কথা তো আর বলা যেত না। কাব্যের ক্লাসে কি শব্দের বাছবিচার চলে! আরে বাবা, আমি কি আর সতীনাথের মতো বৈয়াকরণ!”
একটি শিক্ষার্থী বলে ওঠে, “শুনেছি একজন ম্যাম জয়েন করবেন!ছাত্রীরাও এলে ক্ষতি কি, স্যার?”
পণ্ডিত ধমক দেন, “ছাত্রী নয়, ছাত্রা। ছাত্রের স্ত্রী হলেন ছাত্রী। ব্যাকরণ শেখো ভালো করে। মনকে দৃঢ় করো। আর এখন নারী থেকে যত দূরে থাকবে তত মঙ্গল।’’
এক ছোকরা মশকরা করে, “এখন কি আর সে যুগ আছে স্যার! সর্বত্র তো সহশিক্ষা চালু হয়েছে, আমাদের এখানেই খালি…! পরে মেয়েদের সঙ্গে দেখা হলে আমরা সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আপনি মনে করেন?”
“খানিকটা সঠিক কথাই বলেছ তুমি। তোমার বাক্যসমূহ শুনে একটা একটা গল্প মনে গেল।’’
“কী গল্প স্যার, বলুন না!” ছাত্ররা পড়াশুনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একটি আদিরসাত্মক গল্পের অপেক্ষা করতে থাকে।
“একদিন হ্রদে স্নান করার সময় বিভাণ্ডক মুনি ঊর্বশীকে দেখে কামাতুর হলেন এবং ওই হ্রদেই তার বীর্যপাত হল। তৃষিতা এক হরিণী সেই হ্রদের জলের সঙ্গে ওই শুক্র পান করে গর্ভবতী হয় এবং যথাসময়ে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে প্রসব করে। মুনিপুত্র পিতার সঙ্গে আশ্রমে শিক্ষালাভ করতে লাগলেন। বাবা ছাড়া অন্য মানুষ তার চোখে পড়েনি কোনও দিন, নারী তো অনেক দূরের ব্যাপার!
এ দিকে অঙ্গদেশে বৃষ্টি না হওয়ার জন্য সেখানকার রাজা লোমপাদ এক তপস্বীর কাছে গেলেন। তার কাছ থেকে জানতে পারলেন, ঋষ্যশৃঙ্গ অঙ্গরাজ্যে পা দিলেই বৃষ্টি হবে। রাজা তখন শহরের প্রধান বারাঙ্গনাদের ডাকলেন। মানে বেশ্যাদের, এখন আবার তো ওসব কথা বলাও যাবে না; বলতে হবে যৌনকর্মী। সে যাক গে, তাদের রাজা বললেন, যাও ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলোভিত করে নিয়ে এসো। সকলেই ভীত হয়ে পড়লেন, কেবল এক বৃদ্ধা বারাঙ্গনা রাজি হলেন। তিনি কয়েকজন তরুণী সুন্দরী রমণীকে সঙ্গে নিয়ে বিভাণ্ডকের আশ্রমের কাছে নৌকো বাঁধলেন।
বিভাণ্ডক মুনি আশ্রমে নেই জেনে বৃদ্ধা এক সুন্দরীকে পাঠালেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কাছে। কন্যাকে দেখে ঋষ্যশৃঙ্গ অবাক, এমন মানুষ তিনি তো কখনও দেখেননি! সেই জ্যোতিঃপুঞ্জ দেখে তিনি যথাবিধ সৎকারে প্রয়াসী হলেন। বিভাণ্ডকপুত্র বিমোহিত ও বিকারগ্রস্ত হলেন।
পিতা আশ্রমে ফিরে পুত্রের এই মদনাবিষ্ট অবস্থা দেখে প্রমাদ গুনলেন। কেউ কি এসেছিল? জবাবে ঋষ্যশৃঙ্গ এক জটাধারী ব্রহ্মচারীর কথা বলেন। যিনি লম্বাও নন, বেঁটেও নন; গায়ের রঙ পাকা সোনার মতো, আয়ত চোখ, সুদীর্ঘ সুগন্ধী নির্মল জটা—সোনার সুতোয় বাঁধা। তার গলায় বিদ্যুতের মতো অলঙ্কার, তার নীচে দুটি রোমহীন অতি মনোহর মাংসপিণ্ড। কটিদেশ পিঁপড়ের মধ্যভাগের মতো ক্ষীণ। বসনের ভেতরে সুবর্ণ মেখলা দেখা যায়। তার সুন্দর মুখ, বাক্য হর্ষবর্ধক, কন্ঠস্বর কোকিলের মতো। ‘আমার মুখে মুখ ঠেকিয়ে তিনি শব্দ করেছেন, তার বিরহে আমি অসুখী, আমি তার কাছে যাব, তার সঙ্গেই তপস্যা করব।’
পিতা অনেক বোঝালেন। ঋষ্যশৃঙ্গের ভাবান্তর হল না। পরে একদিন পিতার অনুপস্থিতিতে তিনি ওই কন্যার সঙ্গে চলে গেলেন। অঙ্গদেশে বৃষ্টি হল, ফসল ফলল। রাজা লোমপাদ দশরথের কন্যা শান্তাকে প্রতিপালন করতেন। তার সঙ্গেই বিবাহ দিলেন ঋষ্যশৃঙ্গের।’’
ক্লাস শেষের ঘন্টা বাজল। মদনলাল পণ্ডিত ক্লাস থেকে বেরনোর আগে ছাত্রদের বললেন, “তোমাদের অবস্থা ওই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মতো না হয় যেন!’’
স্টাফরুমে এসে দেখেন ফিলসফির দেবাশিস বাঁড়ুজ্জে, পোলিটিক্যাল সায়েন্সের হামিদুর, বাংলার শুভব্রত, সোশিওলজির সুদীপ সমানে তর্ক করে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা কী, তা বুঝতে একটু সময় লাগবে পণ্ডিতের। তার পর তিনি মুখ খুলবেন।
বাঁড়ুজ্জে বলে ওঠে, “ওই তো মদনদা চলে এসেছে। আচ্ছা বলো তো গুরু, একজন মহিলা আসবেন এখানে জয়েন করতে আর তার জন্য আমরা একটা স্বাগত অনুষ্ঠান করব না! এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে প্রথম মহিলা টিচার!’’
পণ্ডিত বলেন, “এত আদিখ্যেতার কি আছে! তোমার এত ইনটারেস্ট কীসের হে! এর আগে তো আমার ভাইরাও জয়েন করেছে, তাদের তো একটা গোলাপও দাওনি!!’’
বাঁড়ুজ্জে ছোকরা শাণ্ডিল্য গোত্রের বামুন হলে কী হবে, ও ব্যাটা গোমাংস খায়। যখন তখন ছুঁয়ে দেয়, খাবার নিয়ে বসলে তাতে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনিও তেমনি। দূর থেকে পাঁউরুটির টুকরো বা বিস্কুট ভেঙে ছুঁড়ে দেন তাকে। ছোকরা ‘ভৌ ভৌ’ করে তা খেয়ে অবধি নেয়। ব্যাটা অধার্মিক জানে না যে ‘ভৌ ভৌ’ আসলে দেবভাষা। ওকে জিজ্ঞাসা করলেই বলবে, ‘ঘেউ ঘেউ’। দেবশুনী সরমার অপত্যরা অবশ্য এখন এমন শব্দই করে থাকে। ওর চেয়ে পোলিটিক্যাল সায়েন্সের হামিদুর অনেক ভাল। বাড়ি থেকে খাবার এনে তাকে দেয়। খেতেও মন্দ লাগে না। নিষ্ঠাবান, শুচি-অশুচি মানে।
পণ্ডিতের কথার উত্তরে ফিলসফির ফিচেল বাঁড়ুজ্জে বলে, “দাদা, তুমি দিয়েছ কাউকে গোলাপ?অন্য মেয়েদের কথা ছেড়ে দিলাম। বউদিকে দাওনি?”
“আমি কি তোমার মতো ইয়ে! গোলাপ দিয়ে বেড়াব! জানো তো, মেয়েদের ব্যাপারে আমার কিছু এথিক্স আছে।’’ পণ্ডিত বলে ওঠেন।
“ওহ!বেড়াল-তপস্বী!”
ক্লাস থেকে ফিরে কিছু না শুনে ফোড়ন কাটে ইতিহাসের মিঞাভাই। এর মতো অসভ্য ছেলে তিনি তার চাকরি-জীবনে আর একটাও দেখেননি। সব সময় তার পেছনে পড়ে থাকে। কিন্তু ইতিহাসের মিঞা তাকে বেড়াল তপস্বী বলল কেন! তিনি তো ভণ্ডামি করেননি কোনও দিন! একবার খালি ব্লু-ফিল্ম দেখেছিলেন শ্যালকের চাপে পড়ে।
সোশিওলজির সুদীপ জানায়, “বেড়াল নিয়ে ফাজলামি করিস না। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। ইন জাপান, দেয়ার ইজ আ মিথ দ্যাট ক্যাটস টার্ন ইনটু সুপার স্পিরিটস হোয়েন দে ডাই।’’
“কিন্তু ভায়া, এ দেশে বেড়ালকে ‘মার্জার’ বলে। মার্জার মানে মৎ-জার, নিষিদ্ধ প্রেমিক; পরজন্মে তারা শৃগালযোনিপ্রাপ্ত হয়।’’ পণ্ডিত মুচকি হেসে সংযোজন করেন।
“সেই শ্মশানে!” ইতিহাসের ফক্কড় ছেলেটা ফোড়ন কাটে।
ইংরেজির অধ্যাপক রণবীর বেদী বলেন, “সোসান তো ব্যুরিয়াল গ্রাউন্ড, নাকি! কিন্তু সেক্স যে পুড়ে না, পুড়ায়।’’
ফিচেল বাঁড়ুজ্জে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠে, “তা হলে আমি তো ঠিক কথাই বলেছি। মদনদা তুমি নিষিদ্ধ প্রেমিক। আমরা সেই গপ্পোটাই শুনতে চাই।’’
বাংলার শুভব্রত পায়ের উপর পা তুলে গোঁফে তা দিচ্ছিল। সে মুখ খোলে, “এ বার তো সেটাই শুরু হতে চলেছে।’’
“না ভাই। তোমাদের বিভাগে মেয়েটি যে দিন জয়েন করবে সে দিন থেকে আমি ডিপার্টমেন্টাল কিউবিকেলে গিয়ে বসতে শুরু করব।’’ পণ্ডিত বিরস বদনে জানান।
কয়েক দিন ধরে মদনলাল পণ্ডিত ভাবছিলেন, তার সাদা হয়ে যাওয়া লালুপ্রসাদের মতো চুলে রঞ্জক পদার্থ লাগাবেন। শাস্ত্রে কেশকলাপ করার কথা তিনি পড়েছেন। এ বার থেকে জামাকাপড় নিয়মিত ইস্ত্রি করবেন। বহ্নিশৌচ বস্ত্র পরলে মন ভাল থাকে। আর কয়েকটা কেতার জামাকাপড় এবং ভালো জুতো কিনবেন। বাংলার শুভব্রতের সঙ্গেই একদিন বেরোবেন। ও ছোকরা ভাল জামাকাপড় কেনে। তবে সংস্কৃতের অতিথি অধ্যাপক তাপসবাবুও চিত্রবিচিত্র বেশভূষা করেন। থাইল্যান্ডের প্যান্ট, সিঙ্গাপুরের শার্ট, চশমার কাচটা ফরাসি কিন্তু ডাঁটিটা খাঁটি জর্মান; একটা দাঁত নাকি সোনার, হাসলে চীনাংশুর মতো বেরিয়ে পড়ে। গেঞ্জি কেনেন গোবরডাঙা থেকে। একেবারে আন্তর্জাতিক বাবুয়ানা। উনি নামেই তাপস, আসলে রাজা—এ যেন কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। কিন্তু জামাকাপড়ের যা দাম বলেন তাতে ভিরমি খান মদনলাল পণ্ডিত। ইংরেজির কাউকে বলতে পারেন, তবে ওরা তাকে তেমন পাত্তা দেয় না। কিন্তু ওরা বোধহয় জানে না, এই কলেজে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পাঁচটা ভাষায় নির্ভুলভাবে লিখতে-বলতে পারেন। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও ওড়িয়া। বাংলার শুভব্রতের সঙ্গে বেরিয়ে কয়েকটা রঙীন জামাপ্যান্ট আর নতুন ফ্যাশনের হাইহিল চটি কাম জুতো কিনে আনবেন। এত দিন তো বড়বাজারে ছিট কিনে জামা-প্যান্ট বানিয়েছেন। এই মেয়েটা জয়েন করার আগে কয়েকটা ভাল জামাকাপড় কিনে রাখতে হবে।
কয়েক দিন পরে সত্যি-সত্যিই একটি মেয়ে কলেজে জয়েন করল। বাংলা বিভাগে।
আলাপ করতে এলে মদনলাল পণ্ডিত জিজ্ঞাসা করেন, “কী নাম মা তোমার?”
মেয়েটি বলে, “স্বাতী’’।
“ওহ, স্বাতি। কী লেখো, হ্রস্ব-ই না দীর্ঘ-ই?’’
“দীর্ঘ-ই।’’
“কেন?যে স্বাতি সাতাশ নক্ষত্রের অন্যতম, সে তো হ্রস্ব-ই!’’
“হ্যাঁ। কিন্তু আমি দীর্ঘ-ই লিখি।’’
“ভুল লেখো মা!এ বার থেকে হ্রস্ব-ই লিখবে।’’
“দীর্ঘ ই-টাই সঠিক।’’
এ তো আচ্ছা মেয়ে। না হয় তিনি কাব্যই পড়ান, তাই বলে কি একটুও ব্যাকরণ জানেন না! অভিধান খুলে ওকে বানানটা দেখিয়ে দিতে হবে। মুখে বললেন, “তা যা মনে করো। আমি তর্ক করব না। আমার যেটা মনে হয় সেটাই বললাম।’’
স্বাতী হঠাৎ বলে উঠল, “‘ঋশ্যশৃঙ্গ’ বানান কী লেখেন? মূর্ধণ্য-স না তালব্য-স?’’
মদনলাল পণ্ডিত অবাক হলেন। ও কি ছাত্রদের শোনানো ঋষ্যশৃঙ্গ-কাহিনির কথা ইতিমধ্যে শুনে ফেলেছে! উত্তরে বললেন, তালব্য-স লিখতে যাব কেন! মুর্ধণ্য-স তো সবাই লেখে, আমিও তাই লিখি। তেমনটাই পড়ে এসেছি এত কাল।’’
“ভুল লেখেন। ঋষ্য হল হরিণী আর ঋশ্য হরিণ। ওই মুনির শিং ছিল হরিণের মতো, হরিণীর মতো নয়। বুঝলেন!’’ স্বাতী জানায়।
“এ মেয়ে তো ব্যাকরণে ওস্তাদ দেখছি। তা স্বাতি হ্রস্ব-ই কেন?’’
“বলব, যদি আপনি আমার একটা কথা শোনেন!’’
“কী কথা?’’
“আপনি বিভাগীয় কিউবিকেলে গিয়ে বসবেন না, স্টাফরুমই আপনার আসল জায়গা। কাব্যবিশারদের ও রকম ব্যাকরণের ভুল না থাকলে কাব্য রমণীয় হয়ে ওঠে না।’’
মদনলাল পণ্ডিত এ কী শুনছেন! মেয়েটির প্রতি তার বাৎসল্য জেগে উঠল। এ বোধহয় তার কন্যার বয়সীই হবে। “ঠিক আছে, তাই হবে মা। কিন্তু তোমার নামের ব্যাকরণটা কী?’’
“স্বাতি হল পুং শব্দ। আর স্বাতী স্ত্রী শব্দ। আপনি আমাকে স্বাতি বলেই ডাকবেন। কবি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বৈয়াকরণ তাকে পথ ছেড়ে দেন।’’
মদনলাল পণ্ডিত ভাবেন, এইটুকু মেয়ে কত জানে! এর স্বাতি নাম সার্থক। মেধার তরবারি। অজ্ঞতাকে কচুকাটা করে।
ইতিহাসের অসভ্য ছেলেটি এসে ফোড়ন কাটে, “ব্যাস! তাহলে কাব্য-ব্যাকরণের মীমাংসা হয়ে গেল একেই বলে সোলেনামা।’’
মদনলাল পণ্ডিত বলে ওঠেন, “যবন শব্দবন্ধ।’’
লেখক পরিচিতি
শামিম আহমেদ
জন্ম ১৯৭৩। মুর্শিদাবাদের সালারে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্র।
পেশা বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক।
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ মিলিয়ে এযাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১০ টি।
বর্তমানে কলকাতায় বসবাস।
এইটুকু বলে থামলেন মদনলাল পণ্ডিত। নেহাত ছেলেদের কলেজ, তাই এই ভাবে শকুন্তলা-উপাখ্যান ব্যাখ্যা করতে পারছেন। এই অংশটুকু বললেই পণ্ডিত মশাইয়ের চোখমুখ আরক্ত হয়। শরীর থেকে দুরন্ত আগুনের প্রবাহ বয়ে যায়। ভাগ্যিস তার ক্লাসে কোনও রমণী নেই। থাকলে কি আর তিনি স্বাধীনভাবে পড়াতে পারতেন! দিন কয়েক হল, একটি বিষয় খুব ভাবাচ্ছে পণ্ডিতকে। সরকার নাকি নিয়ম করেছে, শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগে কোনও লিঙ্গ-বৈষম্য করা যাবে না। ‘ন লিঙ্গং ধর্ম্মকারণম্’—তারাকুমার কবিরত্নের হিতোপদেশ মনে পড়ল তার। কাব্যচর্চা করে দিন কাটে, আর এর মধ্যে রমণী ঢুকে পড়লে মহা সর্বনাশ হবে। যৌবনকালে এক সৈরন্ধ্রী তাকে বলেছিল, “বায়ুন ঠাকুর, আপনি একখান ঢোঁড়া সাপ। টাকা দেখাইসেন! এক রাতে হাজার টাকা কামাইতে পারি!’’ তিনি যদি নির্বিষ ডুণ্ডুভই হন তা হলে নিজেকে নিয়ে এত ভয় কেন! রুরুর দর্শনে ডুণ্ডুভ অবশ্য সহস্রপাত ঋষিতে পরিণত হন। এখন এই কলেজে যদি রমণী-শিক্ষয়িত্রী প্রবেশ করেন, তিনিও কি ঢোঁড়া সাপ থেকে ঋষিতে পরিণত হয়ে ফণা তুলবেন!
কবে তার পূর্বপুরুষ ওড়িশা থেকে এসে মেদিনীপুরের এক গ্রামে যজমানির কাজ নিয়ে এসেছিলেন, তা তার মনে নেই। বাল্যকালে কাবাডি খেলে মদনলাল পণ্ডিতের ব্রহ্মচর্য সুদৃঢ় হয়। কলেজ-জীবন থেকেই নারী হতে শত-সহস্র হস্ত দূরে থাকতেন। খগমের মতো পুরুষ বন্ধুদের নিয়ে কেটে গিয়েছে কলেজ-জীবন। শরীরে যাতে কামভাব তীব্র না হয়, সেজন্য তখন মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। কুক্কুটাণ্ড দেখলেই গা-বমি করত। এমনকি মুসুর ডালের পরিবর্তে মুগ ডাল খেতেন, এতে শরীর শীতল হয়। বিয়ের পর থেকে অবশ্য সব কিছুই খেতে শুরু করেন, বাছবিচার করেন না। তবে বিবাহিত হয়েও যে ব্রহ্মচর্য পালন করা যায়, তা তিনি হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। পণ্ডিতমশাই স্ত্রী-সহবাসকে কখনও পুরুষার্থ জ্ঞান করেননি। শাস্ত্রের অনুশাসন মেনেই কামের উপভোগ করেছেন। ঋত্বভিগমনে তার ব্রহ্মচর্য স্খলিত হয়নি। তবে এতে করেও দেহ-মনের চাঞ্চল্য কিছুতেই দূর করতে পারেন না। কাব্যই এর জন্য দায়ী বলে মনে হয় তার। রমণীয়ার্থপ্রতিপাদকঃ শব্দঃ কাব্যম্। মদনলাল পণ্ডিতের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, “কারে কব কাব্য কহ, যে যাহারে সঁপে দেহ, সে নাকি তাহার কাটে শির।’’
ছেলেদের এই কলেজে পুরুষ শিক্ষকদের মধ্যে এক মহিলা যোগ দেবেন, এই খবরটা শোনার পর থেকে পণ্ডিত আর মনের স্থিরতা বজায় রাখতে পারেন না। কাব্যচঞ্চল তার মস্তিষ্ক, তাই সর্বদা নানা আদিরসাত্মক কথা পেটের ভেতর থেকে ভুসভুস করে বেরোতে থাকে। স্টাফরুমে সে সব কথা শোনার জন্য বহু সহকর্মী উদগ্রীব হয়ে থাকেন। তিনিও না বলে থাকতে পারেন না। মনে হয় দম আটকে মারা পড়বেন। এখন যদি এক নারী এর মধ্যে প্রবেশ করেন, তিনি কী করবেন! মারা যাবেন, নাকি তার সামনেই বলবেন এই সব কামকলা আর ইন্দ্রিয়াসক্তির গল্পগাছা!
এই তো এক ক্লাসে সে দিন বলেই ফেললেন, “নেহাৎ এখানে মহিলা নেই, তাই তোমাদের এমন খোলাখুলি শিক্ষাদান করতে পারছি। নইলে অর্ধেক কথা তো আর বলা যেত না। কাব্যের ক্লাসে কি শব্দের বাছবিচার চলে! আরে বাবা, আমি কি আর সতীনাথের মতো বৈয়াকরণ!”
একটি শিক্ষার্থী বলে ওঠে, “শুনেছি একজন ম্যাম জয়েন করবেন!ছাত্রীরাও এলে ক্ষতি কি, স্যার?”
পণ্ডিত ধমক দেন, “ছাত্রী নয়, ছাত্রা। ছাত্রের স্ত্রী হলেন ছাত্রী। ব্যাকরণ শেখো ভালো করে। মনকে দৃঢ় করো। আর এখন নারী থেকে যত দূরে থাকবে তত মঙ্গল।’’
এক ছোকরা মশকরা করে, “এখন কি আর সে যুগ আছে স্যার! সর্বত্র তো সহশিক্ষা চালু হয়েছে, আমাদের এখানেই খালি…! পরে মেয়েদের সঙ্গে দেখা হলে আমরা সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আপনি মনে করেন?”
“খানিকটা সঠিক কথাই বলেছ তুমি। তোমার বাক্যসমূহ শুনে একটা একটা গল্প মনে গেল।’’
“কী গল্প স্যার, বলুন না!” ছাত্ররা পড়াশুনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একটি আদিরসাত্মক গল্পের অপেক্ষা করতে থাকে।
“একদিন হ্রদে স্নান করার সময় বিভাণ্ডক মুনি ঊর্বশীকে দেখে কামাতুর হলেন এবং ওই হ্রদেই তার বীর্যপাত হল। তৃষিতা এক হরিণী সেই হ্রদের জলের সঙ্গে ওই শুক্র পান করে গর্ভবতী হয় এবং যথাসময়ে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে প্রসব করে। মুনিপুত্র পিতার সঙ্গে আশ্রমে শিক্ষালাভ করতে লাগলেন। বাবা ছাড়া অন্য মানুষ তার চোখে পড়েনি কোনও দিন, নারী তো অনেক দূরের ব্যাপার!
এ দিকে অঙ্গদেশে বৃষ্টি না হওয়ার জন্য সেখানকার রাজা লোমপাদ এক তপস্বীর কাছে গেলেন। তার কাছ থেকে জানতে পারলেন, ঋষ্যশৃঙ্গ অঙ্গরাজ্যে পা দিলেই বৃষ্টি হবে। রাজা তখন শহরের প্রধান বারাঙ্গনাদের ডাকলেন। মানে বেশ্যাদের, এখন আবার তো ওসব কথা বলাও যাবে না; বলতে হবে যৌনকর্মী। সে যাক গে, তাদের রাজা বললেন, যাও ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলোভিত করে নিয়ে এসো। সকলেই ভীত হয়ে পড়লেন, কেবল এক বৃদ্ধা বারাঙ্গনা রাজি হলেন। তিনি কয়েকজন তরুণী সুন্দরী রমণীকে সঙ্গে নিয়ে বিভাণ্ডকের আশ্রমের কাছে নৌকো বাঁধলেন।
বিভাণ্ডক মুনি আশ্রমে নেই জেনে বৃদ্ধা এক সুন্দরীকে পাঠালেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কাছে। কন্যাকে দেখে ঋষ্যশৃঙ্গ অবাক, এমন মানুষ তিনি তো কখনও দেখেননি! সেই জ্যোতিঃপুঞ্জ দেখে তিনি যথাবিধ সৎকারে প্রয়াসী হলেন। বিভাণ্ডকপুত্র বিমোহিত ও বিকারগ্রস্ত হলেন।
পিতা আশ্রমে ফিরে পুত্রের এই মদনাবিষ্ট অবস্থা দেখে প্রমাদ গুনলেন। কেউ কি এসেছিল? জবাবে ঋষ্যশৃঙ্গ এক জটাধারী ব্রহ্মচারীর কথা বলেন। যিনি লম্বাও নন, বেঁটেও নন; গায়ের রঙ পাকা সোনার মতো, আয়ত চোখ, সুদীর্ঘ সুগন্ধী নির্মল জটা—সোনার সুতোয় বাঁধা। তার গলায় বিদ্যুতের মতো অলঙ্কার, তার নীচে দুটি রোমহীন অতি মনোহর মাংসপিণ্ড। কটিদেশ পিঁপড়ের মধ্যভাগের মতো ক্ষীণ। বসনের ভেতরে সুবর্ণ মেখলা দেখা যায়। তার সুন্দর মুখ, বাক্য হর্ষবর্ধক, কন্ঠস্বর কোকিলের মতো। ‘আমার মুখে মুখ ঠেকিয়ে তিনি শব্দ করেছেন, তার বিরহে আমি অসুখী, আমি তার কাছে যাব, তার সঙ্গেই তপস্যা করব।’
পিতা অনেক বোঝালেন। ঋষ্যশৃঙ্গের ভাবান্তর হল না। পরে একদিন পিতার অনুপস্থিতিতে তিনি ওই কন্যার সঙ্গে চলে গেলেন। অঙ্গদেশে বৃষ্টি হল, ফসল ফলল। রাজা লোমপাদ দশরথের কন্যা শান্তাকে প্রতিপালন করতেন। তার সঙ্গেই বিবাহ দিলেন ঋষ্যশৃঙ্গের।’’
ক্লাস শেষের ঘন্টা বাজল। মদনলাল পণ্ডিত ক্লাস থেকে বেরনোর আগে ছাত্রদের বললেন, “তোমাদের অবস্থা ওই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মতো না হয় যেন!’’
স্টাফরুমে এসে দেখেন ফিলসফির দেবাশিস বাঁড়ুজ্জে, পোলিটিক্যাল সায়েন্সের হামিদুর, বাংলার শুভব্রত, সোশিওলজির সুদীপ সমানে তর্ক করে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা কী, তা বুঝতে একটু সময় লাগবে পণ্ডিতের। তার পর তিনি মুখ খুলবেন।
বাঁড়ুজ্জে বলে ওঠে, “ওই তো মদনদা চলে এসেছে। আচ্ছা বলো তো গুরু, একজন মহিলা আসবেন এখানে জয়েন করতে আর তার জন্য আমরা একটা স্বাগত অনুষ্ঠান করব না! এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে প্রথম মহিলা টিচার!’’
পণ্ডিত বলেন, “এত আদিখ্যেতার কি আছে! তোমার এত ইনটারেস্ট কীসের হে! এর আগে তো আমার ভাইরাও জয়েন করেছে, তাদের তো একটা গোলাপও দাওনি!!’’
বাঁড়ুজ্জে ছোকরা শাণ্ডিল্য গোত্রের বামুন হলে কী হবে, ও ব্যাটা গোমাংস খায়। যখন তখন ছুঁয়ে দেয়, খাবার নিয়ে বসলে তাতে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনিও তেমনি। দূর থেকে পাঁউরুটির টুকরো বা বিস্কুট ভেঙে ছুঁড়ে দেন তাকে। ছোকরা ‘ভৌ ভৌ’ করে তা খেয়ে অবধি নেয়। ব্যাটা অধার্মিক জানে না যে ‘ভৌ ভৌ’ আসলে দেবভাষা। ওকে জিজ্ঞাসা করলেই বলবে, ‘ঘেউ ঘেউ’। দেবশুনী সরমার অপত্যরা অবশ্য এখন এমন শব্দই করে থাকে। ওর চেয়ে পোলিটিক্যাল সায়েন্সের হামিদুর অনেক ভাল। বাড়ি থেকে খাবার এনে তাকে দেয়। খেতেও মন্দ লাগে না। নিষ্ঠাবান, শুচি-অশুচি মানে।
পণ্ডিতের কথার উত্তরে ফিলসফির ফিচেল বাঁড়ুজ্জে বলে, “দাদা, তুমি দিয়েছ কাউকে গোলাপ?অন্য মেয়েদের কথা ছেড়ে দিলাম। বউদিকে দাওনি?”
“আমি কি তোমার মতো ইয়ে! গোলাপ দিয়ে বেড়াব! জানো তো, মেয়েদের ব্যাপারে আমার কিছু এথিক্স আছে।’’ পণ্ডিত বলে ওঠেন।
“ওহ!বেড়াল-তপস্বী!”
ক্লাস থেকে ফিরে কিছু না শুনে ফোড়ন কাটে ইতিহাসের মিঞাভাই। এর মতো অসভ্য ছেলে তিনি তার চাকরি-জীবনে আর একটাও দেখেননি। সব সময় তার পেছনে পড়ে থাকে। কিন্তু ইতিহাসের মিঞা তাকে বেড়াল তপস্বী বলল কেন! তিনি তো ভণ্ডামি করেননি কোনও দিন! একবার খালি ব্লু-ফিল্ম দেখেছিলেন শ্যালকের চাপে পড়ে।
সোশিওলজির সুদীপ জানায়, “বেড়াল নিয়ে ফাজলামি করিস না। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। ইন জাপান, দেয়ার ইজ আ মিথ দ্যাট ক্যাটস টার্ন ইনটু সুপার স্পিরিটস হোয়েন দে ডাই।’’
“কিন্তু ভায়া, এ দেশে বেড়ালকে ‘মার্জার’ বলে। মার্জার মানে মৎ-জার, নিষিদ্ধ প্রেমিক; পরজন্মে তারা শৃগালযোনিপ্রাপ্ত হয়।’’ পণ্ডিত মুচকি হেসে সংযোজন করেন।
“সেই শ্মশানে!” ইতিহাসের ফক্কড় ছেলেটা ফোড়ন কাটে।
ইংরেজির অধ্যাপক রণবীর বেদী বলেন, “সোসান তো ব্যুরিয়াল গ্রাউন্ড, নাকি! কিন্তু সেক্স যে পুড়ে না, পুড়ায়।’’
ফিচেল বাঁড়ুজ্জে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠে, “তা হলে আমি তো ঠিক কথাই বলেছি। মদনদা তুমি নিষিদ্ধ প্রেমিক। আমরা সেই গপ্পোটাই শুনতে চাই।’’
বাংলার শুভব্রত পায়ের উপর পা তুলে গোঁফে তা দিচ্ছিল। সে মুখ খোলে, “এ বার তো সেটাই শুরু হতে চলেছে।’’
“না ভাই। তোমাদের বিভাগে মেয়েটি যে দিন জয়েন করবে সে দিন থেকে আমি ডিপার্টমেন্টাল কিউবিকেলে গিয়ে বসতে শুরু করব।’’ পণ্ডিত বিরস বদনে জানান।
কয়েক দিন ধরে মদনলাল পণ্ডিত ভাবছিলেন, তার সাদা হয়ে যাওয়া লালুপ্রসাদের মতো চুলে রঞ্জক পদার্থ লাগাবেন। শাস্ত্রে কেশকলাপ করার কথা তিনি পড়েছেন। এ বার থেকে জামাকাপড় নিয়মিত ইস্ত্রি করবেন। বহ্নিশৌচ বস্ত্র পরলে মন ভাল থাকে। আর কয়েকটা কেতার জামাকাপড় এবং ভালো জুতো কিনবেন। বাংলার শুভব্রতের সঙ্গেই একদিন বেরোবেন। ও ছোকরা ভাল জামাকাপড় কেনে। তবে সংস্কৃতের অতিথি অধ্যাপক তাপসবাবুও চিত্রবিচিত্র বেশভূষা করেন। থাইল্যান্ডের প্যান্ট, সিঙ্গাপুরের শার্ট, চশমার কাচটা ফরাসি কিন্তু ডাঁটিটা খাঁটি জর্মান; একটা দাঁত নাকি সোনার, হাসলে চীনাংশুর মতো বেরিয়ে পড়ে। গেঞ্জি কেনেন গোবরডাঙা থেকে। একেবারে আন্তর্জাতিক বাবুয়ানা। উনি নামেই তাপস, আসলে রাজা—এ যেন কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। কিন্তু জামাকাপড়ের যা দাম বলেন তাতে ভিরমি খান মদনলাল পণ্ডিত। ইংরেজির কাউকে বলতে পারেন, তবে ওরা তাকে তেমন পাত্তা দেয় না। কিন্তু ওরা বোধহয় জানে না, এই কলেজে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পাঁচটা ভাষায় নির্ভুলভাবে লিখতে-বলতে পারেন। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও ওড়িয়া। বাংলার শুভব্রতের সঙ্গে বেরিয়ে কয়েকটা রঙীন জামাপ্যান্ট আর নতুন ফ্যাশনের হাইহিল চটি কাম জুতো কিনে আনবেন। এত দিন তো বড়বাজারে ছিট কিনে জামা-প্যান্ট বানিয়েছেন। এই মেয়েটা জয়েন করার আগে কয়েকটা ভাল জামাকাপড় কিনে রাখতে হবে।
কয়েক দিন পরে সত্যি-সত্যিই একটি মেয়ে কলেজে জয়েন করল। বাংলা বিভাগে।
আলাপ করতে এলে মদনলাল পণ্ডিত জিজ্ঞাসা করেন, “কী নাম মা তোমার?”
মেয়েটি বলে, “স্বাতী’’।
“ওহ, স্বাতি। কী লেখো, হ্রস্ব-ই না দীর্ঘ-ই?’’
“দীর্ঘ-ই।’’
“কেন?যে স্বাতি সাতাশ নক্ষত্রের অন্যতম, সে তো হ্রস্ব-ই!’’
“হ্যাঁ। কিন্তু আমি দীর্ঘ-ই লিখি।’’
“ভুল লেখো মা!এ বার থেকে হ্রস্ব-ই লিখবে।’’
“দীর্ঘ ই-টাই সঠিক।’’
এ তো আচ্ছা মেয়ে। না হয় তিনি কাব্যই পড়ান, তাই বলে কি একটুও ব্যাকরণ জানেন না! অভিধান খুলে ওকে বানানটা দেখিয়ে দিতে হবে। মুখে বললেন, “তা যা মনে করো। আমি তর্ক করব না। আমার যেটা মনে হয় সেটাই বললাম।’’
স্বাতী হঠাৎ বলে উঠল, “‘ঋশ্যশৃঙ্গ’ বানান কী লেখেন? মূর্ধণ্য-স না তালব্য-স?’’
মদনলাল পণ্ডিত অবাক হলেন। ও কি ছাত্রদের শোনানো ঋষ্যশৃঙ্গ-কাহিনির কথা ইতিমধ্যে শুনে ফেলেছে! উত্তরে বললেন, তালব্য-স লিখতে যাব কেন! মুর্ধণ্য-স তো সবাই লেখে, আমিও তাই লিখি। তেমনটাই পড়ে এসেছি এত কাল।’’
“ভুল লেখেন। ঋষ্য হল হরিণী আর ঋশ্য হরিণ। ওই মুনির শিং ছিল হরিণের মতো, হরিণীর মতো নয়। বুঝলেন!’’ স্বাতী জানায়।
“এ মেয়ে তো ব্যাকরণে ওস্তাদ দেখছি। তা স্বাতি হ্রস্ব-ই কেন?’’
“বলব, যদি আপনি আমার একটা কথা শোনেন!’’
“কী কথা?’’
“আপনি বিভাগীয় কিউবিকেলে গিয়ে বসবেন না, স্টাফরুমই আপনার আসল জায়গা। কাব্যবিশারদের ও রকম ব্যাকরণের ভুল না থাকলে কাব্য রমণীয় হয়ে ওঠে না।’’
মদনলাল পণ্ডিত এ কী শুনছেন! মেয়েটির প্রতি তার বাৎসল্য জেগে উঠল। এ বোধহয় তার কন্যার বয়সীই হবে। “ঠিক আছে, তাই হবে মা। কিন্তু তোমার নামের ব্যাকরণটা কী?’’
“স্বাতি হল পুং শব্দ। আর স্বাতী স্ত্রী শব্দ। আপনি আমাকে স্বাতি বলেই ডাকবেন। কবি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বৈয়াকরণ তাকে পথ ছেড়ে দেন।’’
মদনলাল পণ্ডিত ভাবেন, এইটুকু মেয়ে কত জানে! এর স্বাতি নাম সার্থক। মেধার তরবারি। অজ্ঞতাকে কচুকাটা করে।
ইতিহাসের অসভ্য ছেলেটি এসে ফোড়ন কাটে, “ব্যাস! তাহলে কাব্য-ব্যাকরণের মীমাংসা হয়ে গেল একেই বলে সোলেনামা।’’
মদনলাল পণ্ডিত বলে ওঠেন, “যবন শব্দবন্ধ।’’
লেখক পরিচিতি
শামিম আহমেদ
জন্ম ১৯৭৩। মুর্শিদাবাদের সালারে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্র।
পেশা বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক।
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ মিলিয়ে এযাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১০ টি।
বর্তমানে কলকাতায় বসবাস।
1 মন্তব্যসমূহ
শামিম আহমেদ শামিম আহমেদ শামিম আহমেদ. ....
উত্তরমুছুনএক পেঁচে শব্দ থেকে রস বের করে আনা চাড্ডিখানি কাজ নয়। বয়সের ফেরে দর্শনের ক্লাশ মিস করেছি, পাঠের সুযোগ, যা করেছি করেছি, আর নষ্ট করছি না। -সাধন দাস।