সুবিমলমিশ্র নিয়ে কয়েকটি কথা : অমর মিত্র


আমার সংগ্রহে থাকা “হারাণ মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূর্তি” এবং “নাঙা হাড় জেগে উঠছে”, ভাইটো পাঁঠার ইস্টু ( নাটক ) হারিয়ে গেছে বারবার স্থানান্তরে। আমি সুবিমল মিশ্রকে পড়েছি সেই ১৯৬৯-৭০ থেকে। পড়েছি মানিক তারাশঙ্কর পড়তে পড়তে। রুশ গল্প উপন্যাস পড়তে পড়তে। মনে পড়ে আমাদের বেলগাছিয়া থেকে প্রকাশিত একাল পত্রিকার সম্পাদক নকুল মৈত্রর বস্তির ভিতরের সেই আশ্চয পাঠগৃহে তিনি পান্ডুলিপি থেকে পড়ছেন “নাঙা হাড় জেগে উঠছে” গল্পটি। পড়ছেন “নুয়ে গুয়ে দুই ভাই” ।

একাল পত্রিকায় পড়ছি তাঁর “বাগানের ঘোড়া নিম গাছে দেখন চাচা থাকতেন” সেই অসামান্য গল্পটি। পড়ছি পরী জাতক, আর্কিমিডিসের আবিস্কার ও তারপর, রক্তের স্বভাব, পার্ক স্ট্রিটের ট্রাফিক পোস্টে হলুদ রং। এইসব গল্প লেখা হয়েছিল ১৯৬৯,৭০,৭১—এই সময়ে। সেই কঠিন সময়ে এক তরুণ লেখক তাঁর রক্তের উষ্ণতা, মনের দীপ্তি নিয়ে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়েছেন এবং নিজের কলমকে ক্রমাগত শাণিত করেছেন। সুবিমল যে সাহিত্যের প্রচলিত পথ ত্যাগ করে যে দুর্গমতায় যাত্রা করেছিলেন সেই স্থান থেকে সরে আসেন নি। 

 এই সব গল্প আমাদের আরম্ভের দিনে অবাক করেছিল। সুবিমল মিশ্র কোন গল্প লিখবেন তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর আরম্ভেই। সুবিমল মিশ্র ( এখন তিনি লেখেন সুবিমলমিশ্র, পদবী আর নাম এক করে দিয়ে পদবী লুপ্ত করেছেন নিজেকে।) কোনো বড় বা মাঝারি প্রতিষ্ঠানিক, সংবাদপত্রে, সাহিত্যপত্রে একটি বর্ণও লেখেন নি। তাঁর নিজের নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত আছে। এই এত বছর ধরে দূর থেকে দেখেছি তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে হিমালয়ের মতো অটল। আমার দেখা এই একমাত্র লেখক যিনি নিজেকে সমস্ত প্রচার মাধ্যম, নামী সাহিত্য পত্রিকা থেকে সরিয়ে রেখে একাকী লিখে গেছেন। স্রোতের বিরোধিতা করেছেন প্রকৃত অর্থেই। সেখানে রাষ্ট্র, বড় প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র, একাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয় কিছুই বাদ দেন নি। কাহিনির বলয় ভাঙতে ভাঙতে এমন জায়গায় পৌঁছেছেন যা আমাদের সাহিত্যে তাঁকে এক বিরল প্রকৃতির লেখকের সম্মান দিয়েছে। এমন সাহসী সিদ্ধান্ত আর কোনো লেখকে দেখি নি আমি। বরং উল্টোটাই দেখেছি, প্রতিষ্ঠানের সব সুবিধে নিয়ে নিজেকে তার বিরোধী প্রমাণ করতে চাওয়া। 

সুবিমলের অ্যান্টিগল্প, অ্যান্টি উপন্যাস, নানা নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার চার খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই বইগুলি তাঁর রচনা সংগ্রহ নয়, যে যে বই এ পযন্ত প্রকাশিত হয়েছে, তারই সংগ্রহ। ফলে এই চার খন্ডের বই সংগ্রহে কোনো সম্পাদক নেই, নেই সংকলকও। কিন্তু প্রথম বইয়ে আছে ধীমান দাশগুপ্তের একটি নিবন্ধ, গল্প থেকে প্রতিগল্প থেকে নি-গল্প। নিবন্ধটিতে সুবিমলমিশ্রকে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। হ্যাঁ, যে গল্প আমি পড়েছি সেই বছর চল্লিশ আগে। এত বছর বাদে পড়তে গিয়ে টের পেলাম গল্পের অভিঘাত তেমনিই আছে। হারাণ মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূর্তি, নাঙা হাড় জেগে উঠছে বা তৃতীয় বই দু-তিনটে উদোম বাচ্চা ছুটোছুটি করচে লেবেলক্রশিং বরাবর ( বই সংগ্রহ-১ ), সব মিলিয়ে ৪৮টি গল্প অথবা প্রতিগল্প। 

তাঁর হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধী মূর্তি গল্পে হারাণ মাঝির ২২ বছরের বিধবা বৌ না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। তার ছিল আঁটো শরীর, সবাই তার শরীর নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়, না পেয়ে বদনাম দেয়। তাই সে ম’লো। মরে খালের জলে তরতর করে ভেসে যাচ্ছে। এই গল্প এক সময়ে আমাদের চিরাচরিত গল্পকে আঘাত করতে পেরেছিল, এখনো করে। হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া ভাসছিল, ভাসতে ভাসতে পচা খাল দিয়ে কলকাতা শহরে এসে পড়ে। তারপর সেই মড়া গিয়ে পড়ে থাকে রাইটার্স বিল্ডিঙ থেকে সুখী গেরস্তর দরজায়। 

এই গল্প লেখা হয়েছিল যখন, তখন কেন, এখনো এই সাহিত্যের এই বাস্তবতা সত্য। সত্য সময়ের এই গা ঘিনঘিনে অভিঘাত। বর্গা চাষ রেকর্ড করাতে গিয়ে ভূমিহীন চাষা হারাণ মাঝি তার চাষের অধিকার হারিয়েছিল। চাষের জমি দখলে গিয়ে মার খেয়ে মাথা দুফাল হয়ে মরে। তার বিধবার মড়া রাষ্ট্রের ঘুম কেড়ে নেয়। একাই তার শব দেহ পারে যত্র তত্র গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শান্তিকে তছনছ করে দিতে। সামনে ছিল নিবার্চন, সেই উপলক্ষে ময়দানে মিটিঙে খুব হাঙ্গামা হয়। হাঙ্গামায় ভেঙ্গে যায় মহাত্না গান্ধীর মূর্তি। আমেরিকা তখন বলে, তারা সোনার গান্ধী মূর্তি বানিয়ে কলকাতায় পাঠাচ্ছে। সেই মূর্তি এল বাক্স বন্দী হয়ে। মন্ত্রী, সান্ত্রী হাজির, বিউগল বাজে, জাতীয় সঙ্গীত হয়। এরপর বাক্স খোলা হয় সোনার গান্ধী মূর্তিকে স্যালিউট জানাতে। হায়, দেখা গেল, সেই সোনার গান্ধী মূর্তির উপরে শুয়ে আছে হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া। তাকে না সরালে, গান্ধী মূর্তিকে ছোঁয়া যাবে না। গল্পটি বছর পঁয়তাল্লিশ আগে লেখা, গল্পটি এখনো মনে হয় গতকাল লেখা কিংবা আগামী কাল লেখা হতে পারে। ১৯৬৯ এ লেখা এই গল্পেই সুবিমলমিশ্রের যাত্রা শুরু। 

প্রথম বই সংগ্রহের উৎসর্গ পত্রে তিনি বলছেন “ মহৎ সাহিত্য হয়ে উঠেছে কি গেল... তোমার লেখা যেন কোনভাবেই মহৎ না হয়ে যায়...” সেই গত শতাব্দীর ছয় আর সাতের দশকের প্রথম ভাগ ছিল টিকে থাকা, টিকিয়ে রাখাকে অস্বীকার করার সময়। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তা যেমন সত্য হয়েছে, সাহিত্যেও। দুটি সাহিত্য আন্দোলন, ক্ষুধার্ত প্রজন্ম আর শাস্ত্র বিরোধী, এই দুই আন্দোলনের বাইরে থেকে একা সুবিমল ভেঙে দিয়েছেন গল্পের প্রচলিত লিখন প্রক্রিয়া। আর হ্যাঁ, বিরোধিতার প্রচলিত ছকও। তাঁর সেই সব গল্প, পার্কস্ট্রিটের ট্রাফিক পোস্টে হলুদ রং, পরী জাতক, আর্কিমিদিসের আবিষ্কার ও তারপর, ৭২-এর ডিসেম্বরের এক বিকেল, ধারা বিবরণী-৭১, ব্যবসায়ীগণ সত্বর বকেয়া জমা দিন, নুয়ে গুয়ে দুই ভাই, আসুন ভারতবর্ষ দেখে যান, ময়নার মার ঘরে এখন বাবু এসেছে......আবার পড়তে গিয়ে মনে হতে থাকে সুবিমলের বিরোধিতাকে প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই। 

 সুবিমলকে পড়ে বিড়ম্বিত হবেন পাঠক। কিন্তু তাঁকে কাউন্টার করার কোনো উপায় খুঁজে পাবেন না। তার দরকারও নেই। মনে হয়েছে তাঁর এই স্রোতের বিরুদ্ধ-যাত্রা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কোনো কোনও অ্যান্টিস্টোরি পড়তে পড়তে বুক হিম হয়ে যায় ভয়ানক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে। চতুর্থ বই সংগ্রহের বাব্বি, বইটির অনেক গল্পই সেই হাড় হিম করা বাস্তবতাকে ছুঁয়েছে। বাব্বি, ঐতিহাসিক অবতরণ, শেকড়সুদ্ধ, হেরম্ব নস্কর, মৌসুমী নস্কর জটাধারী নস্কর...পড়তে পড়তে ধরা যায় গত ৪০ বছর ধরে আমরা বুঝি একই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি। বদলায় নি তা। সুবিমলমিশ্র গল্পকে ভেঙেছেন যেমন, আবার পরিপূর্ণ কাহিনিও লিখেছেন। তিনি কোনো একটি আঙ্গিকে স্থিত হন নি। যে লেখক জানেন নির্মাণ, তিনিই তো ভাঙতে পারেন। যিনি গড়তে না জেনে সুবিমলের আঙ্গিক ভাঙাকেই আশ্রয় করবেন প্রথমেই, তাঁকে কোথাও আটকে যেতে হবে। সুবিমল তো হারাণ মাঝি...দেখনচাচা...পরিজাতক, নাঙা হাড়...লিখেছেন। 

সুবিমল মিশ্র যে গল্প একসময় লিখেছেন, তা আমাদের পাঠ অভ্যাসকে আঘাত করেছিল। যা কিছু আমাদের সাহিত্য বোধ, তাকে শিকড় সমেত উৎপাটিত করে সুবিমল নতুন কথা নিয়ে এসেছিলেন। নতুন ভাবে শুনিয়েছেন গল্প। গল্পকে ভেঙে “আপনি যখন স্বপ্নে বিভোর কোল্ড ক্রিম তখন আপনার ত্বকের গভীরে কাজ করে” নামে যে গল্প লিখেছিলেন গত শতাব্দীর সাতের দশকে, সেই বিজ্ঞাপন-জীবন এখন তো গিলে খেয়েছে আমাদের। সেই গল্পের কথাই বলি, ‘ আপনি যখন স্বপ্নে বিভোর...... ’ । ১৯৭৪-এ লেখা এঈ গল্প তার শিরোনামেই বুঝিয়ে দেয়, সুবিমল মিশ্র এই বিজ্ঞাপিত-পণ্য নিয়ন্ত্রিত সভ্যতার কথা কত বছর আগে কী ভাবে বলেছিলেন। এই গল্প বা প্রতি-গল্প( অ্যান্টি গল্প ) যতি চিহ্নহীন করে লেখা। আর সমস্তটাই বিজ্ঞাপনের ভাষা। যে বিজ্ঞাপন সেই চল্লিশ বছর আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো, সুবিমল সেই বিজ্ঞাপন সাজিয়ে এমন এক নির্মাণ করেছেন, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এবং সুখী গৃহকোণকে বিব্রত করার পক্ষে অনেক। 

কী লিখছেন সুবিমল তা একটু দেখি, “ দাদ একজিমা সারিয়ে নিন চুলকানি সব সারিয়ে নিন ফুলের সুরভি শ্বাসে-প্রশ্বাসে মধুর পুলক ভেসে ভেসে আসে নাচুন নাচুন ধেই ধেই নাচুন ফিরিয়ে আনুন ত্বকের স্বাস্থ্য ট্যাঁকের স্বাস্থ্য যেটুকু না হলে নয় সেটুকুতেই কেনাকাটা সমঝে রাখুন দেখবেন দর বাড়বে না অসাধু ব্যবসায়ীরে পরাস্ত করুন কেমনে হে ক্রেতা ক্রেতা হে...” সুবিমল এই অ্যান্টি গল্পে আমাদের গল্পের প্রচলিত ধারাকেই যেন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। হ্যাঁ, এর ভিতরেও গল্প আছে, “ পাত্র আছে পাত্রী আছে গিটার নিপুণা সুচাকুরে উজ্জ্বল শ্যাম বহুত আছে পাঁচফুট তিনইঞ্চি ভক্তিমতী রসবতী রাঁধিতে পারে বাঁধিতে পারে প্রয়োজন বোধে কাঁদিতে পারে চটপট করুন......।“ 

সুবিমল পরিহাস করেছেন সুখী মধ্যবিত্তের স্বপ্ন বিভোরতা নিয়ে, এই বিভোরতা এখন আরো আরো থকথকে হয়েছে। আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা ফুটে ফুটে ক্ষীর হয়েছে। আর একটি গল্পের কথা বলি, নুয়ে গুয়ে দুই ভাই ( ১৯৭৩)। এই গল্প বলতে বসেছেন তিনি যেন কথক ঠাকুর হয়ে। “তারা ছিল দুই ভাই নুয়ে আর গুয়ে। আপন বলতে তাদের কেউ ছিল না এক দুঃসম্পর্কের মাসি ছাড়া।“ সুবিমলের এই গল্প একেকেবারেই প্রচলিত গল্পের আদলে বলা। কিন্তু তার ভিতরে চারিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রখর সমাজ বোধ। জীবন বোধও নিশ্চয়। বখাটে আর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাসি তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। নুয়ে গুয়ে একটি খেজুর গাছের গুঁড়িতে বসে ভাবে কী করে জীবনে উন্নতি করা যায়। বড় ভাই নুয়ে বলল, বেসাতি করবে, চালাক ছোট ভাই গুয়ে বলল, বাসাতি করার কড়ি আসবে কোথা থেকে? তার চেয়ে ওয়াগন ভাঙা অনেক ভাল, ওয়াগন ভেঙে শিবুর দল লাখোপতি হয়ে গেছে। তারা তখন ওয়াগন ভাঙতে গেল নিঝুম রাতে। চারদিকে কুয়াশা, জনমনিষ্যি নেই। ওয়াগান ভেঙেই তারা বড়লোক হয়ে যাবে, তো কাজের সময় সেই অন্ধকারে এক গান্ধীটুপি এসে খাঁচ করে তাদের হাত ধরে ফেলল। তারা ভয়ে তেত্রিশ কোটি দেবতার স্মরণ নিতে লাগল। নুয়ে গুয়েকে সেই গান্ধীটুপি দয়া করল। তাদের আরো বড় উন্নতির ব্যবস্থা করল ওয়াগন থেকে কী ভাবে নিজের মাল সরিয়ে তার নিজের গোডাউনে আগেই ঢুকিয়ে নেবে, সেই উপায় শিখিয়ে দিল। রেল ক্ষতিপুরণ দেবে, আবার নিজের মাল নিজের ঘরেও থাকবে। এই গল্প যেন এক আধুনিক অ-রূপকথা। নুয়ে গুয়েকে দিয়ে কাজ হাসিল করে তাদের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় সেই গান্ধীটুপি। এখনো পড়তে গিয়ে গা হিম হয়ে আসে। সুবিমল রাজনৈতিক কথা বলেন তাঁর সমস্ত গল্পে। তাঁর মতামত খুব স্পষ্ট, কিন্তু তা কখনোই ছকে বাঁধা ক্লিশে হয় না তাঁর বলার গুনে।

সুবিমল বার বার ভেঙেছেন নিজের গড়া দুর্গই। তাঁর বই সংগ্রহের দ্বিতীয় খন্ডে “ সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল” (বই সংগ্রহ-৩) বইটিতে তাঁর বিরোধিতার দর্শনটিকে আন্দাজ করা যায় মাত্র। আসলে সুবিমলমিশ্রর সেই বিরোধিতায় অন্য কোনো মতের স্থান নেই। তিনি অসম্ভব আক্রমণাত্মক। তিনি বলছেন, “প্রতিষ্ঠিত শক্তিই প্রতিষ্ঠান। তার চরিত্র হল জিজ্ঞাসাকে জাগিয়ে তোলা নয়, দাবিয়ে রাখা। যে কোনো স্বাধীন অভিব্যক্তির মুখ চেপে বন্ধ করা, তা অবশ্যই শ্রেণী স্বার্থে।“ সুবিমল বড় কাগজের বিপরীতে ছোট কাগজের কথা বলেছেন। তাঁর সমস্ত জীবনের লেখালেখি নিয়ে অবশ্যই তা মান্য। হ্যাঁ, তাঁর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আমাদের কাছে সাহিত্যের এক নতুন পরিসর উন্মুক্ত করেছে নিশ্চয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাঁর মন্তব্য নিয়ে বিরোধিতার জায়গা আছে। তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তিনি তাঁর বিরোধিতার সঙ্গে মিলিয়েছেন ঋত্বিক ঘটককে। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বা অমিয়ভূষণকে। 

এই খন্ডে আছে, ঋত্বিককুমার ঘটকঃ একটি ব্যক্তিগত তীর্থযাত্রা একটি আবেগায়িত উন্মোচন, আপাতভাবে। পাঠক বুঝতে চাইবেন, একমত হবেন কিংবা হবেন না কোনো কোনো সিদ্ধান্তে। অনেক জায়গায় একমত না হলেও সুবিমলকে সহ্য করতে হবে বহু সময় ধরে। তার গদ্য তীক্ষ্ণ ফলার মতো। বই সংগ্রহ-২ তাঁর অ্যান্টি উপন্যাস সংগ্রহ। প্রথম প্রতিউপন্যাসটি, “ আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো” ঢোঁড়াইয়ের গল্প নয়, কিন্তু তা হতে কোনো বাঁধা ছিল না। এই প্রতিউপন্যাস পাঠে কেন সমগ্র সুবিমল পাঠেই প্রয়োজন অন্যমনস্কতাহীন অভিনিবেশ। এখানে ব্যবহার করা হয়েছে খবরের কাগজের সংবাদ, চিঠি, রিপোরটাজ...... উপাদান তাইই। অনেক নিরূপায় জীবন মিলিয়ে যে একটি জীবন হয়, অনেক নিরূপায় মানুষ যে একে অন্যের সঙ্গে অন্বিত হয়ে থাকে, তা সুবিমলের এই রামায়ণ চামার না হয়েও হয়ে যাওয়া প্রতিউপন্যাসে প্রত্যয় হয়। সুবিমলের লেখায় আছে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা, এই সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর প্রতি সেই উপহাস যা ঘৃণা থেকেই উদ্গত হয়। যে সব ঘটনা বা কাহিনিরেখা এই প্রতি উপন্যাস সংগ্রহে আছে তা আপনাকে উপদ্রুত এলাকায় নিয়ে যাবে নিশ্চিত। তিনি আমাদের সাহিত্যে একটি উপদ্রুত এলাকা সৃষ্টি করেছেন। গাঙচিল তাঁর বই সংগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রকাশিত এই বই সংগ্রহে প্রকাশকের যত্নের চিহ্ন স্পষ্ট। খুব ভাল। কিন্তু ৩ নং সংগ্রহে ঋত্বিক বিষয়ক অংশ ১৬ থেকে ৪৫ পাতা দুকলমে ছাপা কেন, পড়তে গেলে কেন এলোমেলো হয়ে যায় পারম্পর্য? 

বই সংগ্রহ-১-৪ ঃ সুবিমলমিশ্র

গাঙচিল, ৪ খন্ডেরমূল্যঃ ১৭০০ টাকা।

লেখক পরিচিতি
অমর মিত্র

বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাছে ধুলিহর গ্রামে | বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে | তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্রউপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।]
প্রকাশিত বই : পাহাড়ের মত মানুষ, অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, ধুলোগ্রাম, অশ্বচরিত, আগুনের গাড়ী,ধ্রুবপুত্র, নদীবসত, কৃষ্ণগহ্বর, আসনবনি, নিস্তব্দ নগর, প্রান্তরের অন্ধকার, ভি আই পি রোড, শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, সমাবেশ, সারিঘর, সুবর্ণরেখা, সোনাই ছিলো নদীর নাম, হাঁসপাহাড়ি।
পুরস্কার : সাহিত্য একাডেমী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ