দীপেন ভট্টাচার্য
শামীম আহমেদ লিখেছেন সোলেনামা। প্রথমেই বলে রাখি গল্পটি আমার খুবই ভাল লেগেছে।
সোলেনামাকে বলা যায় এক ধরণের চুক্তিপত্র, সন্ধি বা শান্তি চুক্তিও বলা যায়। কার সাথে কার সন্ধি? মদনলাল পণ্ডিতের, কাব্য পড়ান তিনি, তার সাথে স্বাতীর সন্ধি। স্বাতী বাংলা পড়াতে এসেছেন কলেজে। কিন্তু গল্পের শেষটাই আগে বলে ফেললাম। আর আগে থেকেই গল্পের শেষটা জানা আমার একেবারেই অপছন্দ, কারণ লেখক যে চালে বাজিমাত করবেন সেই অজানাকে হঠাৎ করে জানার মাঝেই গল্পের আনন্দ। গল্পের denouement বা গ্রন্থিমোচনটা আগেভাগে জানতে নেই। শামীম আহমেদ আমাদের সেই হঠাৎ জানার আনন্দের মনোরথকে বিফল করেন নি। তাই স্বাতী কি করে মদনলালের মন ভুলালেন, তাঁকে নিরস্ত করলেন সেটা আমি এই ছোট আলোচনায় অনুল্লেখিত রাখব।
সোলেনামা থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সংস্কৃত কাব্য, পশ্চিম বঙ্গের কলেজের সংস্কৃতি, পুরুষের অনভ্যস্ত চোখে নারীর মূল্যায়ণ। এই কলেজে মহিলা শিক্ষিকা নেই, কিন্তু একজন আসছেন, তাকে নিয়েই যত গুঞ্জন। সেই নারীর আগমনবার্তায় অনেকের মনে ঢেউ লেগেছে, কিন্তু মনে হয় বেশী লেগেছে আমাদের মদনলাল পণ্ডিতের। তিনি ক্লাসে পৌরাণিক আদিরসাত্মক কাহিনী বলেন, দুষ্মন্তকে শকুন্তলার দেহদান, অথবা উর্বশীকে দেখে বিভাণ্ডক মুনির বীর্যপাত। এইসব কাহিনীর মাধ্যমে মদনলাল নারীদের ফাঁদ সম্পর্কে ছাত্রদের সতর্ক করতেন। আসলে হয়তো নিজের আরোপিত ব্রহ্মচর্য থেকে মুক্ত হতে এটা এক ধরণের কামক্রিয়া কারণ এই সব কাহিনী মনে করে মদনলাল পণ্ডিত দেহমনে চাঞ্চল্য বোধ করতেন।
পুরুষ নারীকে চেনে না, নারীকে হয়তো ভয় পায়, আর ভয় পেয়ে পুরুষ নারীকে নিপীড়ন করে। যদি নিপীড়ন না করতে পারে তবে তাকে নিয়ে গল্প ফলায়। অবিশ্বাস্য সব গুণ দিয়ে। সে সব গুণ সব পুরুষ বশীকরণের বদগুণ। তাই শকুন্তলা ভোলায় দুষ্মন্তকে, উর্বশী ভোলায় বিভাণ্ডক মুনিকে, দশরথ কন্যা শান্তা ঋশ্যশৃঙ্গকে।
প্রৌঢ় মদনলাল বাংলার তরুণী শিক্ষিকার আগমন সংবাদে চঞ্চল। বললেন তাকে গোলাপ দিয়ে অভিবাদন করবেন। তাই নিয়ে স্টাফ রুমে হাসি ঠাট্টা। কিন্তু পণ্ডিত মশাইয়ের মন উচাটন। ভাবলেন চুল কলপ করবেন, এক সৌখীন শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে রঙীন জামা কাপড় কিনবেন, হাই-হিল জুতো। হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবেন না ভেবে স্টাফ রুম ছেড়ে দিয়ে অনত্র বসা শুরু করলেন।
তাই সেই নতুন শিক্ষিকা তাঁর সাথে দেখা করতে এল নিজে থেকেই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপেই বাজল বানান বিভ্রাট। আমি এটা খোলসা করে বলতে চাই না সেখানে কি হল কারণ এই কাহিনীর coup de grace সেখানেই। শুধু বলব - পাঠক হয়তো আন্দাজ করে নিয়েছেন - স্বাতীর এক রকম জয়ই হল। স্বাতী মদনলালকে অনুরোধ করল আবার স্টাফ রুমে ফিরে আসতে। আর বলল কবি (মদনলাল) রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বৈয়াকরণ (স্বাতী) তাঁকে পথ ছেড়ে দেন। মদনলালের স্বাতীর প্রতি বাৎসল্য জাগল, কাম নয়। এর এতেই এই গল্পের সোলেনামা বা সন্ধি হল। অন্যভাবে বললে denouement বা গ্রন্থিমোচন - কাম থেকে বাৎসল্য। গল্পের শেষ কথা - "সোলেনামা", পণ্ডিত বললেন যবন শব্দবন্ধ, পশ্চিমা যবন থেকে গৃহীত কথা হল সোলেনামা, যবনের সঙ্গে যেন তিনি শান্তিচুক্তি করলেন।
লরি মুর নামে একজন মার্কিন লেখিকা বলেছিলেন, ছোট গল্প হল প্রেমের আখ্যান, উপন্যাস হল বিবাহ; ছোট গল্প হল ফটো, উপন্যাস হল চলচ্চিত্র। সোলেনামা মদনলালের শান্ত কিন্তু বোরিং অফিস জীবনে স্বাতীর আগমন-সংবাদের ঢেউ তোলার কাহিনী, এ যেন মদনলাল পণ্ডিতের অঘোষিত প্রেম কাহিনী। স্বাতীর সঙ্গে তাঁর পরবর্তী সম্পর্ক আমাদের কল্পনা করে নিতে হবে, কিন্তু শামীম আহমেদ তাঁর নিপুণ শব্দমালায় একটি ফটোর মাঝে স্থান দিয়েছেন অনেক ছোট ছোট পর্যবেক্ষণ যা কিনা ছিল আমার একেবারেই অজানা, আর সেই ক্ষুদ্র সতর্ক পর্যবেক্ষণের মাঝে মদনলাল পণ্ডিতের insecure বিচরণ সেই ফটোকে পূর্ণাঙ্গ করেছে। সেই ফটোর বিচিত্র রঙ আমাকে ভাবিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে।
লেখক পরিচিতি
ড. দীপেন (দেবদর্শী) ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৫৯ সালে। আদি নিবাস টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায়।
ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসার (NASA) গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইনস্টিটিউটে গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিআর) গামা-রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। মহাশুন্য থেকে আসা গামা-রশ্মি পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বায়ুমণ্ডলের ওপরে বেলুনবাহিত দূরবীন ওঠানোর অভিযানসমূহে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় রিভারসাইড কলেজে অধ্যাপক।
দীপেন ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ্ভাবে যুক্ত। ১৯৭৫ সাথে বন্ধুদের সহযোগিতায় 'অনুসন্ধিৎসু চক্র' নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ছাড়াও তাঁর নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো ও দিতার ঘড়ি নামে বিজ্ঞান-কল্পকাহিনিভিত্তিক ভিন্ন স্বাদের তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
শামীম আহমেদ লিখেছেন সোলেনামা। প্রথমেই বলে রাখি গল্পটি আমার খুবই ভাল লেগেছে।
সোলেনামাকে বলা যায় এক ধরণের চুক্তিপত্র, সন্ধি বা শান্তি চুক্তিও বলা যায়। কার সাথে কার সন্ধি? মদনলাল পণ্ডিতের, কাব্য পড়ান তিনি, তার সাথে স্বাতীর সন্ধি। স্বাতী বাংলা পড়াতে এসেছেন কলেজে। কিন্তু গল্পের শেষটাই আগে বলে ফেললাম। আর আগে থেকেই গল্পের শেষটা জানা আমার একেবারেই অপছন্দ, কারণ লেখক যে চালে বাজিমাত করবেন সেই অজানাকে হঠাৎ করে জানার মাঝেই গল্পের আনন্দ। গল্পের denouement বা গ্রন্থিমোচনটা আগেভাগে জানতে নেই। শামীম আহমেদ আমাদের সেই হঠাৎ জানার আনন্দের মনোরথকে বিফল করেন নি। তাই স্বাতী কি করে মদনলালের মন ভুলালেন, তাঁকে নিরস্ত করলেন সেটা আমি এই ছোট আলোচনায় অনুল্লেখিত রাখব।
সোলেনামা থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সংস্কৃত কাব্য, পশ্চিম বঙ্গের কলেজের সংস্কৃতি, পুরুষের অনভ্যস্ত চোখে নারীর মূল্যায়ণ। এই কলেজে মহিলা শিক্ষিকা নেই, কিন্তু একজন আসছেন, তাকে নিয়েই যত গুঞ্জন। সেই নারীর আগমনবার্তায় অনেকের মনে ঢেউ লেগেছে, কিন্তু মনে হয় বেশী লেগেছে আমাদের মদনলাল পণ্ডিতের। তিনি ক্লাসে পৌরাণিক আদিরসাত্মক কাহিনী বলেন, দুষ্মন্তকে শকুন্তলার দেহদান, অথবা উর্বশীকে দেখে বিভাণ্ডক মুনির বীর্যপাত। এইসব কাহিনীর মাধ্যমে মদনলাল নারীদের ফাঁদ সম্পর্কে ছাত্রদের সতর্ক করতেন। আসলে হয়তো নিজের আরোপিত ব্রহ্মচর্য থেকে মুক্ত হতে এটা এক ধরণের কামক্রিয়া কারণ এই সব কাহিনী মনে করে মদনলাল পণ্ডিত দেহমনে চাঞ্চল্য বোধ করতেন।
পুরুষ নারীকে চেনে না, নারীকে হয়তো ভয় পায়, আর ভয় পেয়ে পুরুষ নারীকে নিপীড়ন করে। যদি নিপীড়ন না করতে পারে তবে তাকে নিয়ে গল্প ফলায়। অবিশ্বাস্য সব গুণ দিয়ে। সে সব গুণ সব পুরুষ বশীকরণের বদগুণ। তাই শকুন্তলা ভোলায় দুষ্মন্তকে, উর্বশী ভোলায় বিভাণ্ডক মুনিকে, দশরথ কন্যা শান্তা ঋশ্যশৃঙ্গকে।
প্রৌঢ় মদনলাল বাংলার তরুণী শিক্ষিকার আগমন সংবাদে চঞ্চল। বললেন তাকে গোলাপ দিয়ে অভিবাদন করবেন। তাই নিয়ে স্টাফ রুমে হাসি ঠাট্টা। কিন্তু পণ্ডিত মশাইয়ের মন উচাটন। ভাবলেন চুল কলপ করবেন, এক সৌখীন শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে রঙীন জামা কাপড় কিনবেন, হাই-হিল জুতো। হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবেন না ভেবে স্টাফ রুম ছেড়ে দিয়ে অনত্র বসা শুরু করলেন।
তাই সেই নতুন শিক্ষিকা তাঁর সাথে দেখা করতে এল নিজে থেকেই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপেই বাজল বানান বিভ্রাট। আমি এটা খোলসা করে বলতে চাই না সেখানে কি হল কারণ এই কাহিনীর coup de grace সেখানেই। শুধু বলব - পাঠক হয়তো আন্দাজ করে নিয়েছেন - স্বাতীর এক রকম জয়ই হল। স্বাতী মদনলালকে অনুরোধ করল আবার স্টাফ রুমে ফিরে আসতে। আর বলল কবি (মদনলাল) রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বৈয়াকরণ (স্বাতী) তাঁকে পথ ছেড়ে দেন। মদনলালের স্বাতীর প্রতি বাৎসল্য জাগল, কাম নয়। এর এতেই এই গল্পের সোলেনামা বা সন্ধি হল। অন্যভাবে বললে denouement বা গ্রন্থিমোচন - কাম থেকে বাৎসল্য। গল্পের শেষ কথা - "সোলেনামা", পণ্ডিত বললেন যবন শব্দবন্ধ, পশ্চিমা যবন থেকে গৃহীত কথা হল সোলেনামা, যবনের সঙ্গে যেন তিনি শান্তিচুক্তি করলেন।
লরি মুর নামে একজন মার্কিন লেখিকা বলেছিলেন, ছোট গল্প হল প্রেমের আখ্যান, উপন্যাস হল বিবাহ; ছোট গল্প হল ফটো, উপন্যাস হল চলচ্চিত্র। সোলেনামা মদনলালের শান্ত কিন্তু বোরিং অফিস জীবনে স্বাতীর আগমন-সংবাদের ঢেউ তোলার কাহিনী, এ যেন মদনলাল পণ্ডিতের অঘোষিত প্রেম কাহিনী। স্বাতীর সঙ্গে তাঁর পরবর্তী সম্পর্ক আমাদের কল্পনা করে নিতে হবে, কিন্তু শামীম আহমেদ তাঁর নিপুণ শব্দমালায় একটি ফটোর মাঝে স্থান দিয়েছেন অনেক ছোট ছোট পর্যবেক্ষণ যা কিনা ছিল আমার একেবারেই অজানা, আর সেই ক্ষুদ্র সতর্ক পর্যবেক্ষণের মাঝে মদনলাল পণ্ডিতের insecure বিচরণ সেই ফটোকে পূর্ণাঙ্গ করেছে। সেই ফটোর বিচিত্র রঙ আমাকে ভাবিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে।
লেখক পরিচিতি
ড. দীপেন (দেবদর্শী) ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৫৯ সালে। আদি নিবাস টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায়।
ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসার (NASA) গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইনস্টিটিউটে গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিআর) গামা-রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। মহাশুন্য থেকে আসা গামা-রশ্মি পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বায়ুমণ্ডলের ওপরে বেলুনবাহিত দূরবীন ওঠানোর অভিযানসমূহে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় রিভারসাইড কলেজে অধ্যাপক।
দীপেন ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ্ভাবে যুক্ত। ১৯৭৫ সাথে বন্ধুদের সহযোগিতায় 'অনুসন্ধিৎসু চক্র' নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ছাড়াও তাঁর নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো ও দিতার ঘড়ি নামে বিজ্ঞান-কল্পকাহিনিভিত্তিক ভিন্ন স্বাদের তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ