অনুবাদকের সাক্ষাৎকার: রাজু আলাউদ্দিন

‘এখন আমরা যে সভ্যতার কথা বলি, সেটা হচ্ছে আ হিস্টি অব ট্রানস্লেশন।’

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: অলাত এহ্সান


রাজু আলাউদ্দিন অনুবাদক। কবি ও প্রাবন্ধিক। বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যে নিজের গুরুত্ব তৈরি করেছেন। বিশ্বসাহিত্যের শক্তিশালী অনেক লেখককে সামগ্রিক পরিচিয়ে পরিচিত করেছেন আমাদের। হোর্হে লুইস বোর্হেসের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভাষণ অনুবাদ, সম্পাদনা করে তিনি তার অনুবাদ শক্তি ও গভীরতা পরিচয় দিয়েছেন। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর স্প্যানিস ভাষিক সাহিত্যিকদের বিরল রচনা তুলে এনে রবীন্দ্র চিন্তার প্রসার দেখিয়েছেন। তার আবিষ্কার ও মননের একনিষ্ঠতা-অনুসন্ধিসা গভীর। তিনি মূলত স্প্যানিস ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করেন। তার বাইরেও করেন। তবে ওই ভাষা চর্চায় ও জানায় তিনি বিশেষ ভাবেই দক্ষ। অনুবাদের তার সঙ্গে জাড়িত দুই যুগ ধরে। পেশায় সাংবাদিক। সম্প্রতি তার সঙ্গে অনুবাদের বিভিন্ন দিক, দেশে অনুবাদ চর্চা, মান নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়। তিনি অকপট ভাবে বলেছেন সব কথা—বিনয়ী ও শক্তিশালী বক্তব্যে। তার সঙ্গে আলাপচারিতা অংশনেন গল্পকার অলাত এহ্সান।


অলাত এহ্সান :  আপনি দীর্ঘদিন যাবত লেখালেখি করছেন, অনুবাদ করছেন। অনুবাদক হিসেবে আপনি অধিক পরিচিত। একটা পরিচিতি দাঁড়িয়েছে। কত দিন যাবত অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন?

রাজু আলাউদ্দিন : আমার লেখক জীবনের শুরু অনুবাদ দিয়ে। লেখক জীবনের অনেকটাই অনুবাদের ইতিহাস বলা যায়। আমরা প্রথম বইটিই ছিল অনুবাদের বই। ওটা এখন আর পাওয়া যায় না। আউট অফ প্রিন্ট অনেক আগে থেকেই। ওটা ছিল জার্মানভাষী অস্ট্রিয়ার কবি গেয়র্গ ট্রাকলের কবিতা। খুব পাতলা, ছোট আয়তনে একটা বই। আপনি পুস্তিকা বলতে পারেন। বইটা বেরিয়েছিল ১৯৯২ সালে, মঙ্গলসন্ধ্যা প্রকাশনী থেকে। এখনো যেহেতু আমি কোনো-না-কোনো ভাবে অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত আছি। তাই বলা যেতে পারে ২২-২৩ বছরের অধিক সময় ধরে অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত আছি।


অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো একটা পরিণত কাজ। আপনার কাছে অনুবাদক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি কি রকম?

রাজু আলাউদ্দিন : আমার মনে হয় আমাদের এখানে অনুবাদকের প্রস্তুতিটা খুব স্বচ্ছ জায়গায় যায়নি। প্রথমত যে ভাষা থেকে অনুবাদ করা হবে, এবং যে ভাষায় অনুবাদ করা হবে—এই দুই ভাষা সম্পর্কে অবশ্যই ভাল ভাবে জানতে হবে। সন্দেহ নাই, এই দুইটো ভাষা জানার ওপরই একজন ভাল অনুবাদকের বৈশিষ্ট্য, সাফল্য নির্ভর করে না। কারণ ভাষা হচ্ছে, আমি যদি কবিতার কথা বলি, যে ভাষায় কবিতা লেখা হচ্ছে সেটা ওই কবিতার কাঠামো হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আপনি শুধুমাত্র কাঠামো জেনে অনুবাদ করতে পারেন না। একটা কবিতার মধ্যে তার নিজের সংস্কৃতি, সময়, ইতিহাস ইত্যাদি বহু কিছু, বহু অনুসঙ্গ জড়িয়ে থাকে। আবার কবিতা যেহেতু, তা গদ্যের মতো নয়, এটা অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি নয়। তার একটা পরোক্ষ প্রকরণ আছে। এটা নানা রকম জ্ঞানের একটা ক্রিস্টালাইজ একটি ফর্ম। সে সরাসরি অনেক কথা বলে না। নানা রকম উদাহরণ, উপেক্ষা, উৎপ্রেক্ষা, ইঙ্গিতময়তা, দৃশ্যকল্প, কূটাভাস অনেক রকমের অলংকার তার আছে। এর মধ্যদিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার অনেক কথা আমাদের কাছে অস্পষ্ট হয়। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে এই সব বিষয় তো আছেই, তার সঙ্গে কবি ও কবিতা বিষয়ক যে অনুসঙ্গগুলো আছে তা আপনাকে জানতে হবে। তা ছাড়া অনুবাদ সফল হবে বলে আমি মনে করি না। অনুবাদককে এই সব বিষয়ে প্রস্তুতি থাকতে হবে। তার পঠন-পাঠন গভীর হতে হবে। অনুবাদকের যদি সাইক্লোপিডিক জ্ঞান, মানে বহুমুখী জ্ঞান হয় তাহলে আরো ভালো অনুবাদ করতে পারবেন। আমাদের এখানে অনুবাদের খুব পরিচিত উদাহরণ হচ্ছে বুদ্ধদেব বসু। তিনি শার্ল বোদলেয়ার অনুবাদ করলেন। তিনি শুধু অনুবাদই করলেন না—অনেক টিকা-টিপ্পনী, ভূমিকা, অনুসঙ্গগুলো লিখলেন। কবিতার বাইরে এই সব কিছুইর ভেতর দিয়েই কিন্তু আমরা বুঝতে পারি বুদ্ধদেব বসু বিপুল জ্ঞান ওর মধ্যে দিয়েছেন, কবিতা অনুবাদকে সমৃদ্ধ-সফল করেছেন। এগুলো দরকার ছিল, তিনি বুঝেছিলেন। এই দরকার ও জানা থাকা দু’টো কিন্তু ভিন্ন জিনিস। এই দু’টোর সম্মিলনের ফলেই তার বইটির এতো ইমপ্যাক্ট তৈরি করেছে। নয়তো সম্ভব হতো না।


এহ্সান : অনুবাদ তো কেবল ভাষার পরিবর্তন নয়, ভাবের সঙ্গেও যুক্ত। অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবের অনুবাদ একটা মৌলিক সমস্যা। আপনি এই সমস্যা দূর করতে কি করেন?

রাজু আলাউদ্দিন : ওই তো, অনুবাদকের ওই প্রস্তুতিটা থাকতে হয়। ওই প্রস্তুতিটা না থাকলে তিনি তো ভাবও বুঝতে পারবেন না। ওতেই বোঝা যায়, লেখক বা কবি আসলে কি বলতে চাইছে। আবার কবিতা নিয়ে তো নানা রকম কথা-বার্তাও আছে—কবিতা কোনো কিছুই বোঝায় না, কবিতা শুধু অনুভব। যেমন আরসিবল ম্যাকলিসের একটি কবিতা আছে। যেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, কবিতা আসলে বোঝার জিনিস নয়, অনুভবের জিনিস। সেই অনুভব করা জন্য আপনাকে যোগ্য হতে হবে। যেমন—পশ্চিমা সঙ্গীত। অনেকে বলবে, ভাল লাগে না। কেন লাগে না? কারণ তার মধ্যে যে আবেগ আছে তা তিনি বোঝেন না, তাকে আচ্ছাদিতও করে না। সে জন্য প্রস্তুতিটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা না থাকলে কিছুই করতে পারবেন না।


এহ্সান : একজন লেখক তো লেখায় মেজাজ-মর্জি-ছন্দ-গতি দিয়ে লেখেন। অনুবাদেও সেই মেজাজ—ছন্দের জন্য সেই লেখকের ওপর প্রস্তুতি দরকার। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত অনুবাদক আছেন, যারা একজনকে প্রধান করে অনুবাকে সাফল্য সমৃদ্ধি দেখিয়েছেন। যেমন আমরা খুব সহজেই নরমান টমাস ডি যোভান্নির কথা বলতে পারি। আপনার কি মনে হয় যে, অনুবাদের সাফল্যের জন্য একজন লেখককে নির্বাচন করাই ঠিক। বা ভাল অনুবাদের জন্য এটা একটা দিক?

রাজু আলাউদ্দিন : না, আমার তা মনে হয় না। একজনকে ধরে নিতে হবে। আর নরমান টমাস ডি যোভান্নি শুধু বোর্হেস অনুবাদ করেছেন, তা কিন্তু নয়। সেক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নাই, বোর্হেস তার বেসিক জায়গা। তার কাজের বিপুল অংশ হচ্ছে বোর্হেসকে নিয়ে। তার আরো অনুবাদ আছে। যেমন তানিয়েল মইয়ূ বলে একজন আর্জেনটাইন লেখক আছেন, তার অনুবাদ করেছেন। আরো অনেকের অনুবাদ করেছেন। তো, আমার মনে হয় না কোনো লেখকে বেছে নেয়ার ধরা-বাঁধা নিয়ম আছে।


এহ্সান : লেখার সঙ্গে, বিশেষত সাহিত্যের সঙ্গে দেশটির ইতিহাস-সংস্কৃতি-মিথ ইত্যাদির গভীর ভাবে যুক্ত। সেক্ষেত্রে অনুবাদের জন্য লেখকের দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি। আপনি যেমন একটা ভাষা বা ওই ভাষাভাষি সাহিত্য গোষ্ঠীকে বেছে নিয়েছেন। অনুবাদের দক্ষতা অর্জন, ভাল অনুবাদের জন্য কোনো একটা দেশ এবং ভাষাকেই বেছে নেয়া উত্তম কি না। আপনি কি মনে করেন?

রাজু আলাউদ্দিন : না, তা নয়। অনেক যোগ্য অনুবাদক আছেন যারা দুই-তিনটি বা আরো বেশি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন। ভাল অনুবাদ করেছেন। যেমন রবার্ট ব্লাই। তিনি অনেক ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন। তার সে যোগ্যতাও ছিল। হ্যা, আপনি বলতে পারেন, আপনি কেন একটি ভাষা নিয়ে কাজ করছেন। তা বলবো, আমার অযোগ্যতা। আমার অযোগ্যতার কারণে একটা ভাষাভাষি সাহিত্য গোষ্ঠীকে বেছে নিয়েছি। আমি যদি পর্তুগিত, জার্মান, ইতালিয়, ফ্রেন্স ভাষা জানতাম, আমি নিশ্চয়ই ওই ভাষার অনুবাদ করতাম। তেমন যোগ্য অনুবাদক আছেন, বাইরের দেশে। তাতে করে আসলে অনুবাদের মান পরে গেছে, ব্যাপারটা তেমন নয়। ব্যাপারটা হলো, যোগ্যতার প্রশ্ন।


এহ্সান : অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদক একটি সাহিত্য জানছেন। তার সঙ্গে একটি ভাষা-দেশ-সংস্কৃতি-লেখক সম্পর্কে জানছেন। এক্ষেত্রে অনুবাদকের তৃপ্তিটা আসলে কোথায়, সাহিত্য অনুবাদে, না ওই দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীরভাবে জানায়?

রাজু আলাউদ্দিন : অনুভূতিটা দুই ধরনেরই। অনুবাদটা সফল ভাবে করতে পারলাম কি না-তার উপর অনুবাদকের একটা ব্যক্তিগত তৃপ্তি তৈরি হয় যে—হ্যা, আমি ভাল অনুবাদ করতে পারলাম। আরেকটা হচ্ছে, এটা যখন প্রকাশ হবে তখন সমঝদার পাঠক যখন বুঝেন, জানাবেন। সমালোচকগণ যখন উল্লেখ্য অংশ নিয়ে, ধরে ধরে আলোচনা করেন, সেটা থেকে একটা তৃপ্তি পাওয়া যায়। তাছাড়া, ওই জানার বিষয় তো আছেই।


এহ্সান : প্রায়ই শোনা যায়, মন্তব্যের ছড়াছড়িও আছে যে, অনুবাদ কোনো সাহিত্য নয়। তাহলে অনুবাদকে সাহিত্য হয়ে ওঠায় অন্তরায়টা কোথায়? কীভাবে সাহিত্য হয়ে ওঠতে পারে?

রাজু আলাউদ্দিন : এটা হচ্ছে সাহিত্য সম্পর্কে যারা সত্যি সত্যি মূর্খ তাদের কথা। আপনি এ পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্যে যারা বড় বড় লেখক হিসেবে পরিচিত তাদের কাছ থেকে শুনেছেন যে—অনুবাদ কোনো সাহিত্য না? আমাদের দেশে যারা তথাকথিত ‘মৌলিকতা’র হীনমন্যতাপূর্ণ ধারণায় ভোগেন, তারা এই ধরনের পার্থক্য বোধ বিশ্বাস করেন। সেন্স অফ ডিসক্রিমিনেশন। আসলে আমরা যেমন দেখি—আগেকার দিনে সমাজে বা সম্প্রদায়ে যেমন কাস্ট সিসটেম ছিল, এটা তারই তারই প্রভাব, একটি সাহিত্য রূপ। এরা মানসিক ভাবে যাকে জাতি বিদ্বেশি বলা হয়, এরা হচ্ছে সাহিত্যে ওই রকম বর্ণ বিদ্বেশি। এতে একধরনের অবদমন, পারভারসন তো আছেই। এরা হয়তো তারা জানেন না, এখন বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুবাদ আলাদা একটা ডিসিপ্লিন হিসেবে পড়ানো হয়। এখন ওইসব তথাকথিত মৌলজীবীরা হয়তো বলবেন—একাডেমিয়ানদের কথায় কি আসে যায়। আসলে আমরা যে সভ্যতার কথা বলি, সেটা হচ্ছে আ হিস্টি অব ট্রানস্লেশন।

আপনাকে একটা উদাহরণ দেই। পশ্চিমে আজকে যেটা আধুনিক সভ্যতা বলা হয়, আধুনিক সভ্যতার যে মৌলিক উপাদানগুলো সেটা ছিল মুসলমানদের হাতে। মানে মধ্যযুগের, স্পেনের মুসলমানদের যে যুগ, সেখানে যে জ্ঞানের চর্চা হয়েছে তাতে ইউরোপের অনেক জ্ঞান তাদের হাতে রক্ষা পেয়েছে। সেই জ্ঞান পশ্চিমা ভাষায় অনুদিত হলো। আরবি থেকে লাতিনে। লাতিন থেকে বিভিন্ন ভাষায় ছড়িয়েছে। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য সবই ছিল। সেটা যদি না ঘটতো, ইউরোপ আজকে যে সভ্যতার গর্ব করে সেটা সম্ভব হতো কি-না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অনেক বিখ্যাত ঐতিহাসিকই সেই ঋণের কথা স্বীকার করেন। এটা হচ্ছে অনুবাদের প্রভাব। অনুবাদ ছাড়া সম্ভবই ছিল না, এই নজেলটাকে একটা ভাষা থেকে আরেকটা ভাষায় নিয়ে যাওয়ার। এটা হলো একটা দিক।

আরেকটা দিকের উদাহরণ আপনাকে দেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে কোরআন, বইবেল। আরো ধর্মীয় গ্রন্থের কথা বলতে পারেন। এই ধর্মগ্রন্থ দু’টি কোনো ভাষায় ছিল? একটা হিব্রু ভাষায়, মধ্যপ্রাচ্যের একটা ভাষায় লিখিত হয়েছিল। কোরআন শরিফও মধ্যপ্রাচ্যের একটি ভাষায় লিখিত হয়েছিল। এখন এটি পৃথিবীর সব ভাষাতেই অনুবাদ হয়েছে। এই বইগুলোর পাঠক সংখ্যা কত? যারা এই বই দু’টি যারা ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন, তাদের সংখ্যা কত? বিপুল। এই মানুষগুলো কি এই বোধ দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন যে, এই বই দু’টি অনুদিত বলে এটি সাহিত্য না, বা অনুবাদ বলে পাঠ্য না? করেন নি। তার মানে বড় লেখক থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত—এই ইগো নেই। এই ইগোটা আমাদের এখানে যারা একেবারে মূর্খ-অজ্ঞ-অযোগ্য, তারাই এই কথা বলে। আমি এই সব কথার কোনো তোয়াক্কা করি না।

আর সাহিত্য হয়ে ওঠার ব্যাপারে অনুবাদক প্রস্তুতি ও অন্যান্য বিষয়ে আগেই বলা হয়েছে। অনুবাদকের সংকেদনশীলতা ও চিন্তা-কল্পনা শক্তিও জরুরি। যেমন গ্রেগরি রাবাসার কথা বলা যায়। রাবাসার যখন মার্কেজের ‘হানড্রেট ইয়ার অফ সলিচ্যুড’ অনুবাদ করলেন, দেখে মার্কেজই বলেছেন, তুমি মূলের চেয়ে ভাল অনুবাদ করেছ। কিংবা বোর্হেস তার অনুবাদক যোভান্নিকে বলেছেন, বিশ্বস্ত বিশ্বাস ঘাতক। মানে অনুবাদ তো বটেই তবে বিশ্বস্ত। তাহলে তাদের সাহিত্য হয়ে ওঠায় সমস্যা কোথায়। বরং স্বীকৃত।


এহ্সান : আমাদের দেশে সাধারণত যে অনুবাদগুলো হয় সেগুলো মূলভাষা থেকে নয়, দ্বিতীয় কোনো ভাষা, বিশেষত ইংরেজি থেকে। আমরা তাকে পাচ্ছি তৃতীয় ভাষা হিসেবে। এক্ষেত্রে মূল সাহিত্যের নির্যাস না পেয়ে, বা সরাসরি সংযোগ স্থাপন হচ্ছে না। আমরা কি ‘সূর্যের রশ্মি থেকে তাপ না নিয়ে বালি থেকে তাপ নিচ্ছি’ বলে মনে হয় না?

রাজু আলাউদ্দিন : তা তো হয়ই। একটা ভাষা থেকে আরেকটা ভাষা, তা থেকে আরেকটা ভাষা মানে তৃতীয় ভাষা, এতে মূল থেকে তো অনেক সময় সরে যায়ই। অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেকগুণা ধারণাই আছে। অনেক সময়, মূল ভাষা থেকে অনুবাদ করে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে পারে। যদি অনুবাদক অযোগ্য লোক হয়। ব্যর্থতা কেন? আপনাকে উদাহরণ দিচ্ছি । ধরা যাক, কেউ যদি জীবনানন্দ দাশের কবিতা অনুবাদ করে জসীমউদ্দীনের ভাষায়; কিংবা সুধীন দত্তের কোনো কবিতা কেউ যদি সাধারণ-সহজতম ভাষায় যারা কবিতা লিখেন, তাদের ভাষায় অনুবাদ করলেন। তাতে মূল থেকে করলেই সফল অনুবাদ হবে? কোনো অর্থ বহন করবে? তা হবে একেবারে ব্যর্থ। আবার কেউ দ্বিতীয় ভাষা থেকেই অনুবাদ করছেন, তার সংবেদনশীলতা এতই প্রখর যে, সেই কবিতা পড়ে কল্পণাতে মূলের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। আমি বলছি কল্পনা দিয়েই সেখানে পৌঁছুতে হয়। অনুবাদ যখন করছেন, সেটা একধরনের কল্পনাই। কল্পনা দিয়ে আপনাকে পৌছুতে হবে। এটা দিয়েই সে দূরত্বকে ঘোঁচাতে পারে। ফলে দ্বিতীয় ভাষা থেকেই কেউ সফল অনুবাদ বলতে পারেন, আবার মূল ভাষা থেকেও ব্যর্থতার পরিচয় দিতে পারেন। এটা নির্ভর করছেন, যিনি অনুবাদ করছেন তার সেই প্রস্তুতি, সেই যোগ্যতা কতখানি। যেমন মালার্মে আর বোদলেয়ার একই ধরনে কবিতা লিখতেন না। দুইজন দুই ধরনের। এখন আপনি মালার্মে ভাল ভাবে অনুবাদ করতে চান। তাহলে কবিতায় তিনি কোন ধরনে ওপর জোর দিয়েছিলেন—তিনি কি স্টাইল ওপর বেশি জোর দিতেন, নাকি বাচনের ওপর, নাকি শব্দের ওপর জোর দিতেন—এই বিষয়গুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে কোনো অনুবাদক সেইরকম প্রস্তুতি নেন, তাহলে অনুবাদ অনেকটাই সফল হবেন।


এহ্সান : অনেক সময় দেখা যায়, কোনো দেশের-কোনো লেখকের কিছু গল্প বা কবিতা অনুবাদ করেই তাকে সেই দেশ বা লেখকের ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ বা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বলে দেয়া হচ্ছে। বইয়ের ভূমিকায়ও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু থাকে না যে, এগুলো কেন শ্রেষ্ঠ। কিভাবে বাছাই করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে পাঠকরা কি প্রতারিত হচ্ছেন না?

রাজু আলাউদ্দিন : তা তো বটেই, সেটা একধরনের প্রতারণা। অনেকে এক্ষেত্রে বলেন যে, ভাল কবিতা বা গল্পের ক্ষেত্রে ভূমিকার প্রয়োজন নেই। হতে পারে সেটা। আমি মনে করি যে, ভূমিকা দরকার হয় না নিজের কোনো ভাষায় লেখার ক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্রেও কিন্তু ভূমিকার প্রয়োজন একেবারে উড়িয়ে দিলে চলে না। কিন্তু অন্য একটি ভাষা বা দেশের কবিতা-গল্প যখন অনুবাদ করবেন, সেটাকে শ্রেষ্ঠ বা নির্বাচিত—যা-ই বলুন, তাতে ভূমিকা থাকা উচিত। আমি মনে করি—কোন আবহে এটা রচিত হলো, কোন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তা গুরুত্বপূর্ণও, বুঝিয়ে দেয়া, পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার আছে। সম্পাদক বা অনুবাদ এটাকে কেন শ্রেষ্ঠ বলছেন, তা কি কারণে শ্রেষ্ঠ—তার ব্যাখ্যা থাকা উচিত।


এহ্সান : আমাদের দেশে যে অনুবাদগুলো হয়, তার অধিকাংশ বিশ্বের জনপ্রিয় বা বহুল আলোচিত, মানে ‘বেস্ট সেলার’ বইগুলোর অনুবাদ। এই ধরনের অনুবাদের মধ্যদিয়ে একটি দেশের সাহিত্য কতটুকু উপকৃত হতে পারে?

রাজু আলাউদ্দিন : এই ধরনের বেস্ট সেলার কিছু বই রাতারাতি অনুদিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে যতখানি না সাহিত্য প্রণোদনা কাজ করে, তারচেয়ে বেশি বা একেবারেই প্রাথমিক ভাবে, বাণিজ্যিক ব্যাপার কাজ করে। প্রকাশকের বাণিজ্যিক লক্ষ্য ও অনুবাদকের বাণিজ্যিক লক্ষ্য—দু’টো একসাথে হয়ে এই কাণ্ডগুলো ঘটে। সেখানে সাহিত্যিক প্রণোদনা কতটুকু, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।


এহ্সান : আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বের অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ আছে যেগুলো ভাল, সাহিত্যের জায়গায় শ্রেষ্ঠ, লেখকও গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বহুল আলোচিত নয়। প্রকাশকদেরও তাতে কোনো বিনিয়োগ, উৎসাহ নেই। বহুলালোচিতগুলো হচ্ছে, এগুলো হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে এই ভাল বা মানসম্মত সাহিত্য অনুবাদ কি করে পেতে পারি?

রাজু আলাউদ্দিন : সেটা মনে করেন, কাউকে সে-রকম আন্তরিকতা নিয়ে প্রকাশককে এগিয়ে আসতে হবে। অনুবাদককে এগিয়ে আসতে হবে। তাতে ওই দায়িত্ববোধ কাজ করতে হবে। তাকে সেই উন্নত রুচির অনুবাদক হয়েই কাজটি করতে হবে। আমি বিদেশের ভাল সাহিত্যের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, এই পরিচয়ের মাধ্যমে আমাদের রুচির বিস্তার ঘটবে। রুচির একটা উন্নতি ঘটবে—এই দায়িত্ব বোধ লেখক বা অনুবাদক এবং প্রকাশকের ব্যাপার।


এহ্সান : একটি দেশ যখন উপনিবেশ মুক্ত হয়, স্বাধীন হয়, তার একটা জরুরি কাজ হচ্ছে বিশ্বের সেরা সাহিত্য, জ্ঞানগর্ভ-মননশীল-চিন্তাশীল বইগুলো ব্যাপক ভাবে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই, দেশি ভাষায় অনুবাদ করা। বিশ্বের অনেক দেশের ক্ষেত্রে আমরা তা-ই দেখি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন বা ইউরোপের ক্ষেত্রে তা ব্যাপক মাত্রায় দেখি। আমাদের দেশে তা ব্যাপক মাত্রায় হয়নি বা হয়নি বললেই চলে। এই না হওয়ার ফলে আমাদের দেশে তা ধরনের প্রভাব ফেলেছে বলে আপনি মনে করেন?

রাজু আলাউদ্দিন : যে-সব দেশের কথা বললেন, সে-সব দেশের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ ছিল। আমাদের এখানে স্বাধীনতার পরে বাংলা একাডেমি বা কোনো প্রতিষ্ঠান তেমন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সে-রকম কোনো নজির নাই। বরং পাকিস্তান আমলে অনুবাদের কিছু কাজ হয়েছিল। তবে সেটা স্পষ্টত রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হয়নি। সে সময় অনুবাদ কিছু ভাল, কিছু মন্দ অনুবাদ হয়েছে, মানে মুটোমুটি একটা হয়েছিল। বাংলাদেশ হওয়ার পর পরই তেমন ভাবে খুব একটা অনুবাদ হয়নি। সেটা হলো অনেক পরে। আশির দশকের পরে আমাদের দেশে অনুবাদের একটা জোয়ার লক্ষ্য করা যায়। সেটা ব্যক্তিগত ও সাধারণ মানুষের একটা উদ্যোগ ছিল। আমি তো মনে করি সেই হওয়াটায় ভাল-মন্দ দুই ধরনেরেই প্রভাব হয়েছে। এই অনুবাদের ফলে পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়তাও পেল।

বলা হয়, দেশিয় বইয়ের চেয়ে অনুদিত বইয়ের বিক্রি ভাল। তার মানে, পাঠকের দৃষ্টি বহির্বিশ্বে ছড়ানো আছে। তার কাছে ভাল বই যদি দেন—পাঠ করে। এখানে কবিতার বই বিক্রি হয় না একশ কপি, কিন্তু অনুবাদ গ্রন্থ বিক্রি হয়। তা না হলে প্রকাশকরা অনুবাদের জন্য উৎসাহ দেখাতেন না। আমি তো কোনো জনপ্রিয়ধারার অনুবাদক না। তাছাড়া তথাকথিতার্থে খ্যাতও না। তারপরও প্রকাশকরা আমার কাছে পাণ্ডুলিপি চাইছেন। শুধু আমার কাছে না, আরো যারা আছেন তাদের কাছে চাইছেন। বই মেলায় গেলেই দেখতে পাবেন, প্রচুর অনুবাদ হচ্ছে। ফলে আমি মনে করি, ওই দিকে থেকে একটা প্রভাব তো অবশ্যই আছে। কিন্তু খারাপ যেটা, প্রকাশনাগুলো অনুবাদ সম্পাদনার দায়-দায়িত্ব নেয়নি। তাই যা-ইচ্ছে-তাই অনুবাদও বেরিয়ে যাচ্ছে। রুচি পড়ে যাবে। পাঠক বিরক্ত ও রুষ্ট হচ্ছে।


এহ্সান : সেক্ষেত্রে অনেকেই মনে করেন অনুবাদের মান রক্ষার জন্য দেশে রেগুলেটরি বা সম্পাদনা পরিষদ স্থাপন করা দরকার। আপনার কি মনে হয়?

রাজু আলাউদ্দিন : অবশ্যই। যে-ই অনুবাদক হোন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখক হোন, সেটা বিশেষজ্ঞ দ্বারা, যাকে বলে সম্পাদনা পরিষদের মধ্যদিয়ে যেতে হবে। বাইরের দেশে সব বড় বড় প্রকাশনায় সেই ব্যবস্থা আছে। আমাদের এখানে নেই বলে, আপনি যে পাণ্ডুলিপি দেন সঙ্গে সঙ্গে বেড়িয়ে যায়। এর ফলে অনেক ভাল অনুবাদক, হয়তো সামান্য অসতর্কতার কারণে কোথাও কোথাও ভুল থেকে যায়। সেটা থাকতেই পারে। কিন্তু ঠিক করা হয় না। এ একটা ব্যাপার। তাছাড়া অযোগ্য হাতে অনুবাদ হচ্ছে, কিন্তু চিহ্নিত বা ধরা পড়ছে না। এর ফলে যার লেখা অনুবাদ হলো তার সম্পর্কে কতগুলো ভুল ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠছেন। এটা হলো খারাপ দিক। তাই প্রত্যেকটা প্রকাশকেরই তেমন সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি।


এহ্সান : অনুবাদের ক্ষেত্রে ট্যাকনিক্যাল শব্দগুলো ছাড়াও অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদে সংকট হলো যথাযথ পরিভাষার অভাব। কি ইংরেজি কি অন্য যে ভাষার কথাই বলি। আবার আমাদের দেশে পরিভাষা তৈরিতে রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোনো উদ্যোগও নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের কি করনীয়?

রাজু আলাউদ্দিন : পরিভাষার সংকট অবশ্যই আছে। আর পরিভাষা তৈরির দায়িত্ব রাষ্ট্রে না, বা রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের না। এটা যিনি কাজ করবেন, যিনি অনুবাদ করবেন তার-ই দায়িত্ব। যিনি এই সমস্যা অনুভব করবেন, তিনিই সবেচেয়ে সফল ভাবে পরিভাষা তৈরি করতে পারবেন। আবার অনেক সময় পরিভাষা তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা গৃহীত হয়নি, তেমনও হয়েছে। আমি মনে করি, পরিভাষা তৈরি অনুবাদকেরই কাজ।

আমি বিশ্বাস করি বাংলা ভাষার গ্রহণ ক্ষমতা উঁচু, সৃজন ক্ষমতা ব্যাপক। যদি সংবেদনশীল অনুবাদক হন, যোগ্য অনুবাদক হন, পরিভাষা তিনি তৈরি করতে পারেন। আমি উদাহরণ দিতে পারি। এটা অনুবাদ করতে গিয়েই পেয়েছি। স্প্যানিসে একটা সুবিধা হলো যে কোনো ক্রিয়াকে বিশেষণে রূপ দিতে পারেন, আবার বিশেষণকে ক্রিয়া রূপান্তর করতে পারেন। বাংলায় এটা কঠিন, অনেক ক্ষেত্রেই তা করা যায় না। স্প্যানিস একটা শব্দ ছিল ‘বোগোতাসু’। এটা ছিল ফিদের ক্যাস্ত্রোর একটা লেখা, মার্কেসকে নিয়ে। বোগোতাসু হলো, বোগোতায় যে ঘটনাটা ঘটেছিল তা। আমি দেখলাম যে, বোগোতাসু যা বোঝাতে চায় তা হল, বোগোতায় যে তাণ্ডব। তখন সেটার পরিভাষা করেছিলাম, ‘বোগো-তাণ্ডব’। মানে বোগো হলো বোগাটা, কলাম্বিয়ার রাজধানী আর তাণ্ডব হলো যে তাণ্ডব যা হয়েছিল। এই দু’টো এক করে আমি বোগো-তাণ্ডব করেছিলাম। আমাকে এখনো কেউ বলেননি যে, এটা তিনি বুঝতে পারছেন না। বরং অনেকে প্রশংসাই করেছেন যে, আমি একটা সহজবোধ্য পরিভাষা করেছি। আরো একটা হলো, মারিও বার্গাস যোসার একটা বিখ্যাস উপন্যাস আছে, ওটার স্প্যানিস নাম ‘পানতালেওন ইস সুস বিছিতা দোরাস’। সেখানে পানতালেওন একটা চরিত্র। সে যেখানে কাজ করছে, সেই জায়গাটিকে ইঙ্গিত করার জন্য বলা হলো ‘পান্তালেন পান্তালেন্ডিয়ায়’। স্প্যানিসে যা বোঝাতে চায় তা হলো, পানতালোন পানতালেওনের জায়গাটি। বাংলায় আমি সহজেই বলতে পারছি, পান্তালেন্ডিয়া মানে পান্তালেনিস্তান। পাকিস্তান, আফগানিস্তান-এর মতো। তার মানে আমার বাংলা ভাষার গ্রহণ ক্ষমতা, সৃজন ক্ষমতা ব্যাপক, অসম্ভব রকমে প্রসারিত। ফলে আমি মনে করি না যে, পরিভাষা তৈরি ক্ষেত্রে খুব বেশি সমস্যা বা সংকট থাকার কথা। সংকট হলো আমাদের অযোগ্যতা, প্রস্তুতি ও স্বাদিচ্ছা।


এহ্সান : আগেও বলেছি, প্রতিবছরই দেশে প্রচুর অনুবাদ হচ্ছে। তার সবই জনপ্রিয়, বহুলালোচিত নয়তো পুরষ্কার প্রাপ্ত গ্রন্থ। তার বাইরে অনুবাদকদেরও কোনো আবিষ্কার দেখছি না। একজন অপরিচিত কিন্তু শক্তিশালী লেখক, যিনি ভাল লেখেন, কিংবা কোনো বই যেটা উঁচু মানের। এটা অনুবাদকের দূর্বলতা, না কি?

রাজু আলাউদ্দিন : এটা দূর্বলতাও বলা যায়। তাছাড়া যারা বেস্ট সেলার বই অনুবাদ করছেন, সেটা আমাদের উপকারই। তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি মনে করি, অনুবাদকদের একই সঙ্গে দায়িত্ব হওয়া উচিত অপরিচিতি বা অল্পপরিচিত লেখক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ, তাদের কাজগুলো করা। তাছাড়া যেটা দেখা যায় পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পরপরই অনুবাদের তোরজোড় পড়ে যায়। এটা হলে তিনি একজন শুধু অনুবাদকই হয়ে থাকবেন। কিন্তু কোনো গুরুত্বপূর্ণ, দায়িত্বশীল, সৃষ্টিশীল অনুবাদক হিসেবে স্বীকৃত বা আলাদা ভাবে চিহ্নিত যে ব্যাপারটি, সেটা আসলে হবেন না। আবারও সেই বুদ্ধদেব বসুর কাছে ফিরে যেতে হয়। তিনি অনুভর করেছেন যে, রেকের বা বোদলেয়ারের অনুবাদ করা উচিত। তিনি এইসব অনুবাদ যখন করেন তখন তো নোবেল পুরস্কার দেয়া শুরু হয়েগেছে। তিনি তো ইচ্ছে করলেই পারতেন, সে বছর যে নোবেল পেল তাকে অনুবাদের জন্য বেছে নিতে। তিনি শুধু খ্যাতি বা বাণিজ্যিক স্পৃহা দ্বারা তাড়িত হননি।


এহ্সান : বুদ্ধদেব বসুর প্রসঙ্গ ধরেই আসে—রবার্ট ফ্রস্ট, টি এস এলিয়ট, শার্ল বোদলেয়ার, শাহনামা অনুবাদের কথা। এগুলো অনেকেই অনুবাদ করেছেন। কিন্তু তা শামসুর রাহমান, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কেউ করতে পারেননি, ভাল বা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তাই কবিতার অনুবাদ কবি, গল্পের অনুবাদ একজন গল্পকার করলেই কি সেরাটা পাওয়া সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। আপনার কি মনে হয়?

রাজু আলাউদ্দিন : না। বুদ্ধদেব বসুই সম্ভবত কোথাও বলেছিলেন, কবিরাই পারে কবিদের ব্যাপারে সংক্রামক ভাবে সাড়া দিতে। এটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। অনেকেই বিশ্বের অনেক বড় বড় লেখক-কবি-সাহিত্যিককে আবিষ্কার করেছেন, এবং সেই সব আবিষ্কার অসম্ভব রকমের প্রভাব ফেলেছে বা পাঠকদের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। যদি কবিতা দিকে দিয়েই দেখি, তাদের অনেকই কবি ছিলেন না। তারা বেশি ছিলেন সাহিত্য সমালোচক হিসেবে পরিচিত। কিংবা একেবারে একাডেমিশিয়ান হিসেবে বেশি পরিচিতি। তারা অনুবাদগুলো ভাল এবং অসামান্য সাংবেদনশীলতা দিয়েই অনুবাদ করেছেন। ফলে ওই কথাটির সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে। হয়তো দেখা গেল সে গল্পকার না, কবি না বা ভাল সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও পরিচিত না, কিন্তু ভাল একাডেমিশিয়ান। তিনিও ভাল অনুবাদ করতে পারেন। সাধারণত দেখা গেছে যারা সাহিত্য ভাল অনুবাদ করেছেন, তারা ভাল সাহিত্য সমালোচকও। রাভাসার কথা বলা যেতে পারে। গ্রেগরি রাভাসার তো কোনো সমালোচনা সাহিত্য নিয়ে তার কোনো কাজ নেই। তিনি তো ভাল অনুবাদ করেছেন মার্কেজের ‘সোয়েন আনিয়স দে সোলেদাদ’ মানে ‘ওয়ান হানড্রেট ইয়ার অব সলিচ্যুড’। মার্কেজ নিজেই মুগ্ধ হয়েছেন। সেটা হতেই পারে।


এহ্সান : অনুবাদ তো দুইভাবেই হতে পারে। বিদেশি সাহিত্য দেশি ভাষায়, দেশি সাহিত্য বিদেশি ভাষায়। আমাদের সাহিত্য কিন্তু সে ভাষায় যাচ্ছে না। এর কারণ কি? এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের উপায় কি বলে মনে করেন?

রাজু আলাউদ্দিন : উপায় কি আমি ঠিক জানি না। তবে সমস্যাগুলো হচ্ছে, বাংলা সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের পরে যে ব্যাপক ভাবে অনুদিত হচ্ছে না, এর জন্য মূলত দায়ি আমাদের সাহিত্যের অক্ষমতা। রবীন্দ্রনাথের পরেও বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক আছেন যাদের সাহিত্য ব্যাপাক ভাবে অনুদিত হতে পারতো। সেগুলো হয় নি, এটা আমাদের জন্য দূর্ভাগ্য। দূর্ভাগ্য আমরা জাতি হিসেবে, দেশ হিসেবে প্রবল ক্ষমতা সম্পন্ন না। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও নাই। তাই আমরা পশ্চিমা প্রকাশকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারি নাই।

পাকিস্তান ঐশ্বর্যের দিক দিয়ে কি এমন দেশ কিংবা তাদের সাহিত্য ক্ষেত্র কি এমন উর্বর!আমি স্বীকার করি পাকিস্তানে কয়েকজন বড় সাহিত্যিক আছেন। কিন্তু সমস্ত যোগফল আপনি যদি চিন্তা করেন দেখবেন, তা বাংলা সাহিত্যের চেয়ে বড় না। ভাষার দিকদিয়েও উর্দু ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে প্রাচীন না। সে তো বহু বছর আগেই আমি দেখেছি, পেঙ্গুইন পাবলিসার্স থেকে ‘পেঙ্গুইন বুক অফ উর্দু ভার্স’ বেরিয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। আমাদেরও তো হতে পারতো ‘পেঙ্গুইন বুক অব বাংলা ভার্স’ বা বাংলাদেশি ভার্স। সেটা হয়নি। কেন হল না? তারা যেকোনো ভাবেই হোক, তাদের সে রাজনৈতিক প্রভাব আছে, বা, হয় তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব বা এটম বোম আছে। যেটা তাদের সাহিত্যের বিস্তারেও ভূমিকা রেখেছে। আমাদের তো সে ভাবে কিছু নেই।

আরেকটা ব্যাপার আমার মনে হয়, যদিও অপ্রাকাশ্য, কতগুলি লবির ব্যাপার থাকে। ইন্টেলেকচুয়ালি ফোর্স করার ব্যাপার থাকে। লবি-টাকে আমি পজেটিভ অর্থে বলছি। একাডেমিকালি আমাদের এখানে সে রকম উঁচুমানের লোক থাকতেন যারা ওই বাইরের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সংযোগ আছে। তাদের যদি বোঝাতে পারতেন, এই ধারণায় যদি কোনো ভাবে যেতে পারতেন যে, বাংলাদেশে বা বাংলা ভাষায় অনেক বড় বড় লেখক আছেন, যাদের অনুদিত হওয়া উচিত। একাডেমিক লেবেলে বা লেখকদের মধ্যে যেটা দরকার সেটাও মনে হয় আমাদের মধ্যে নাই। যে কারণে আমাদের বাংলা ভাষার সাহিত্যের বাহির্বিশ্বে পরিচিত নেই।


এহ্সান : অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেকে ভাষা, অনেকে ভাব, অনেকে মূলবক্তব্য অনুসরণ করেন। এতে কি একটি সাহিত্যের প্রকৃতাবস্থার হের ফের ঘটে যায় না?

রাজু আলাউদ্দিন : অনুবাদে আমাদের পরিচিত কয়েকটি আদর্শ হচ্ছে যে—রূপান্তর, ভাবানুবাদ, মূলানুগত ইত্যাদি। এখন আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ভাব—মানে লেখক যেটা বলতে চেয়েছেন, কবিতায় যেটা বোঝাতে চেয়েছেন—অনুবাদেও সেটা যতটা সম্ভব হুবহু রাখা, তার বচন ভঙ্গিকে যতদূর সম্ভব হুবহু রাখা। কারণ একজন লেখকের শুধু ভাব নয়, বচনের ভঙ্গি আছে। স্টাইল আছে। তাকে যতদূর সম্ভব আরেকটি ভাষায় নিয়ে যাওয়া। তাতে করে যে-ভাষার লেখককে আমি অনুবাদ করছি তার প্রতি সুবিচার করা হবে। সফলতাও দেখা দিবে।


এহ্সান : অনুবাদকের স্বাধীনতা­—শব্দ তৈরি, বাক্য ভাঙা ইত্যাদি দিক— অনেকে সামনে আনেন। এটাকে আপনি কি ভাবে দেখেন? তা ছাড়া অনুবাদকের আদৌ কোনো স্বাধীনতা আছে কি?

রাজু আলাউদ্দিন : অনুবাদক মূলতই পরাধীন। এই পরাধীনতার মধ্যে আবার স্বাধীনতাও আছে। পরাধীনতা হচ্ছে, তিনি যে লেখাটি অনুবাদ করবেন, তার খাঁচায় উনি বন্দি। কোনো ভাষায় জন্মগ্রহণ করা, ওই ভাষা অনুভব করার সঙ্গে অন্য ভাষায় অনুভবের মধ্যে পার্থক্য আছে। এই দূরত্ব কোনোদিন ঘুঁচবে না। এই দূরত্বকে ঘুঁচার জন্য কল্পনার আশ্রয় নিতে পারেন। এইটা হচ্ছে তার স্বাধীনতা। তাই একজন সফল অনুবাদক স্বাধীন ও পরাধীন। এটা হচ্ছে প্র্যারাডক্স, স্ববিরোধীতায় অবস্থান।


এহ্সান : অন্য একটি ভাষায় লেখা অনুবাদ হচ্ছে। লেখক তা জানছেন না, রয়েলটি পাচ্ছেন না। রয়েলটি না হয় গেল, কিন্তু তথ্যটি জানা বা মূলানুগ অনুবাদের জন্যও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারতো। তাও হচ্ছে না। বিষয়টা কিভাবে দেখেন?

রাজু আলাউদ্দিন : সেই অর্থে কিন্তু আপনি আমাকেও অভিযুক্ত করতে পারেন। আমি গেয়র্গ ট্রাকলকে যখন অনুবাদ করলাম, ততদিনে তিনি মৃত। টেড হিউজ আমি শুরু করেছিলাম তাঁকে না জানিয়ে। পরে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, বই বের হওয়ার আগে। আমি তাকে জানিয়েছি যে, আমি বই বের করতে যাচ্ছি। পরে তার সঙ্গে অনুবাদে কি কি সমস্যা হয় তা নিয়ে কথা বলেছি। আমি যখন সি. পি. কাভাফির কবিতা অনুবাদ করেছিলাম, তিনিও ততদিন মৃত। সেটা ইংরেজি থেকে করেছিলাম। তিনি ছিলেন গ্রিক কবি। পরে আমি যাদের অনুবাদ করেছি, তারা ততদিনে ছিলেন হয় মৃত, নয়তো তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ করে ওঠা সম্ভব হয়নি।

মূল লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিতে পারলে ভাল। তাঁর মতামতের ভিত্তিতে, আলোচনার মাধ্যমে হলে আরো ভাল। কিন্তু আামাদের দেশে এটা একটা সমস্যাই।


এহ্সান : লেখালেখির ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে অনুবাদের তেমন পেশাদারিত্ব দেখছি না। তবে অনেকে পেশাদার অনুবাদক হয়ে ওঠতে চান। এটা আনন্দের। অনুবাদের মানোন্নয়নের জন্য পেশাদারিত্বের ভূমিকা কি?

রাজু আলাউদ্দিন : কেউ কেউ যদি পেশাদারি মনোভাবের বাইরের থেকে নিজেকে সফল অনুবাদক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে ভাল। সেটা ব্যাতিক্রম। কিন্তু পেশাদারিত্বের মধ্যদিয়ে গেলেই সফল হয়েও সম্ভব। আমি মনে করি, পেশাদারিত্ব থাকা জরুরি। এটা শুধু মাত্র অনুবাদকের উপর নির্ভর করে না। তিনি অনুবাদ করার পর সেটা বাজারের একটা প্রোডাক্ট হয়ে যায়। সেই প্রোডাক্ট বিক্রি করা, সেখান থেকে অর্থ উপার্জন তো প্রকাশকের হাতে। এটা প্রকাশক ও লেখকের দ্বৈত বিষয়। এক্ষেত্রে পত্রিকাগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। একটা অনুবাদ পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া, সে বাবদ যথাযথ সম্মানি দেয়া হলে পেশাদারিত্বের প্রসঙ্গ আসে। নয়তো নয়। আমাদের এখানে কেউ সে-ভাবে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।


এহ্সান : এবার বই মেলায় আপনার দু’টি অনুবাদ গ্রন্থ বের হচ্ছে, সে সম্পর্কে বলুন।

রাজু আলাউদ্দিন : এবারের বই মেলায় বের হওয়া দু’টি অনুবাদগ্রন্থে একটা মারিও বার্গাস যোসাকে নিয়ে স্প্যানিস একটি বইয়ের অনুবাদ। তার মধ্যে বাইরে থেকে সংযোজিত লিখাও থাকবে। যেগুলোর অধিকাংশই স্প্যানিস থেকে অনুদিত, কিছু ইংরেজি থেকে। নাম ‘মারিও বার্গাস যোগার জীবন ও মিথ্যার সত্য’। যোসার বইটা বা লেখাগুলো আগে অনুদিত হয়নি। একটা লেখা অনুদিত হয়েছে মাত্র, তাও আমার পরে। যদি অনুদিত হতো তাহলে আমি অনুবাদ করতাম না। আরেকটা বই বের হবে কথা প্রকাশ থেকে। আমি এ পর্যন্ত যতগুরো ইন্টারভিউ অনুবাদ করেছিলাম তার সংকলিত রূপ, নাম ‘অনুদিত কথা সমগ্র’।


এহ্সান : আমাদের দেশে অনেকই অনুবাদ করছেন। আপনার সমসাময়িক তো করছেই, আগেও করেছে, অনুজও করছে। বাজারে তাদের বইও আছে। এদের থেকে আপনি নিজেকে কিভাবে আলাদা করেন?

রাজু আলাউদ্দিন : আমি গেয়র্গ ট্রাকল যখন অনুবাদ করেছি তখন তা কেউ করেননি। কেউ অনুবাদ করেননি বলে করবো, আর কেউ করেছে বলে করবো—ব্যাপারটা তাও না। ব্যাপারটা হলো ট্রাকল আমার ভালো লেগেছে। প্রথম শর্ত হলো, আমার ভাল লাগতে হবে। দ্বিতীয় কথা হলো, আমার তা পড়তে, অনুবাদ করতে ভালো লাগেই। কিন্তু তা যদি কেউ অনুবাদ করে থাকতো, আমি অনুবাদ করতাম না। সেটা ট্রাকলের ব্যাপারে ছিল না, কাভাফির ব্যাপারে ছিল না। টেড হিউজের ব্যাপার হলো, আমার অনুবাদের আগে একজন তার অনুবাদ ছেড়েছিলেন। কিন্তু অনুবাদ এতোটাই খারাপ ছিল, এতোটাই ভুলে ভরা ছিল যে বলার মতো নয়। আমি আসলে ততদিন টেড হিউজে মত্ত ছিলাম, অনুবাদ শুরুও করে দিয়েছি। যদিও বই বেরিয়েছে পরে। উনার ওইটা অনুবাদ দেখেও মনে করেছিলাম—না, আমি বইটা করবো। কারণ তাঁর অনুবাদ মোটেই ভাল নয়।


এহ্সান : এই প্রসঙ্গে আরেকটা প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এই মুহুর্তে দেশে যে অনুবাদগুলো হচ্ছে, বইয়ে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে তার মান নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? আপনার চোখে কারা ভাল অনুবাদ করছে?

রাজু আলাউদ্দিন : কারো কারো অনুবাদের মান নিয়ে তো আমি অবশ্যই সন্তুষ্ট। যেমন খালেকুজ্জামান ইলিয়াসের অনুবাদের মান চমৎকার। আবদুস সেলিম আছেন, তার কয়েকটা বইও বেরিয়েছে। তাকে নিয়ে আমাদের এখানে কোনো আলোচনা হয় না। তাঁর অনুবাদের মান ভাল। আলী আহমদ আছেন, তিনি খুবই ভাল অনুবাদ করেন। আরেকজন আছেন, যিনি মূলত সেবা প্রকাশনীর অনুবাদক হিসেবে পরিচিত। রওশন জামিল। যাকে বলে ‘সিরিয়াস সাহিত্যের অনুবাদ’, আমি তাঁর সেই অনুবাদের সঙ্গেও পরিচিত। সেগুলো ভাল মানের অনুবাদ। সত্যি বলতে কি, আমি তাঁর অনুবাদের ভক্ত। এরমধ্যে নিশ্চয়ই আরো কয়েকজন আছেন, যাদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

আমাদের সমসাময়িক অনুবাদকদের মধ্যে যারা পছন্দ তাদের মধ্যে আছেন—কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। তাপস গায়েনের অনুবাদ আমার পছন্দ। মাসুদখান খান ভাল অনুবাদ করেন। আলম খোরশেদ আছে। মাসরুর আরেফিন ভাল অনুবাদ করছেন বলতেই হবে। তরুণদের মধ্যে মাহবুব জোবায়ের আছেন, তিনি স্প্যানিস থেকেই অনুবাদ করেন, ইংরেজি থেকেও করেন। বিনয় বর্মণ ভাল অনুবাদ করেন। আরো কয়েকজন আছেন ।

কথা হচ্ছে এরাই যদি শুধু অনুবাদক হতেন, তাহলে বলতাম মান নিয়ে সন্তুষ্ট। এর বাইরেও তো বিপুল সংখ্যক অনুবাদক আছেন। তাদের কারো কারো অনুবাদ ভাল। তবে তাদের ব্যাপারে আপত্তির জায়গাগুলো হচ্ছে, তারা যদি তাড়াহুড়ো না করতেন, আরেকটু যত্ন নিতেন; বা প্রথমেই যে বললাম প্রস্তুতির কথা, সেই প্রস্তুতিটা যদি আরো ভালভাবে নিয়েতেন, ভাল করতেন। প্রকাশকের এক্ষেত্রে ভূমিকা আছে। তারা যদি তড়িঘড়ির চাপ না দিতেন বা অনুবাদের সম্পাদনার ব্যবস্থা করতেন তবে ভাল অনুবাদ আসতো। মোট কথা, এই যে অনুবাদের মানে সন্তুষ্টি নেই, ভাল অনুবাদক গড়ে ওঠছে না, তার পেছনে অনুবাদক-প্রকাশক-পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকরা অনেকাংশে দায়ি। কারণ পত্রিকায় অফিসে যে লেখাগুলো দেয়া হচ্ছে তা যাচাই বাছাই না করে ছাপা হচ্ছে। এতে করে নতুন যে অনুবাদক তৈরি হচ্ছেন, সে নিজের সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন না। এর জন্য একক ভাবে অনুবাদককে দায়ি করা যাচ্ছে না। কিন্তু, আমাদের পোড়ার দেশে অনুবাদের মানের দায় অনুবাদককেই নিতে হবে। কারণ যে দেশে অনুবাদের সম্পাদনা নেই, ভুল ধরিয়ে দেয়ার মানুষ নেই, সেখানে নিজেই নিজেকে নির্মাণ করতে হবে।


এহ্সান : লিখালেখির এখন বহু মাধ্যম তৈরি হয়েছে। এখনো নতুন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। অনেকে অনুবাদক হওয়ার চিন্তাও করেন। অনুবাদক তৈরির ক্ষেত্রে কোনো মাধ্যমটি আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?

রাজু আলাউদ্দিন : লিটলম্যাগেও অনুবাদক তৈরি হতে পারেন। সেখানেও তো অনুবাদ প্রকাশ হয়, হয়েছে। কিন্তু কোনো মাধ্যমকে গুরুত্ব না দিয়ে সামগ্রিক ভাবেই দেখা ভাল। নিজের প্রস্তুতি ছাড়া কি বা হতে পারে।


এহ্সান : অনুবাদের ক্ষেত্রে একই সাহিত্য অনেকে অনুবাদ করবেন সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্ত ইতোপূর্বে আমরা জেনেছি, অনেক অনুবাদ (হুবহু বা লাইনের পর লাইন) ‘কাট-পেস্ট’ করে নিজের নামের চালিয়েদিছেন। আবার দ্বিতীয় ভাষা থেকে অনুবাদ করে মূল ভাষা থেকে অনুবাদের কৃতিত্ত দাবি করেছেন। নাম জাহির করেছেন। এরা ধরাও পড়েছে। আপনার মন্তব্য কি?

রাজু আলাউদ্দিন : এটা খুবই অনৈতিক কাজ। একটা একধরনে ক্রাইম। কেউ অনুবাদ ভুল বা দূর্বল অনুবাদ করতে পারে। এটা কোনো ক্রাইম না, তার অযোগ্যতা। এটা আপনি সামালোচনা করতে পারেন, নিন্দা করতে পারেন। তাকে অপরাধী বলতে পারেন না। কিন্তু অন্যের কাজকে নিজের বলে চলানো একটা অপরাধ। আরেকটা হচ্ছে জালিয়াতি। যেটা নিয়ে কয়েকদিন আগে আমি লিখেছিলাম। যারা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে মূল ভাষা স্প্যানিস, গ্রিক, ফ্রেন্স ইত্যাদি থেকে অনুবাদের কৃতিত্ব দেখাতে চান। কিংবা ইংরেজি থেকেও অনুবাদ করেনি, কাট-পেস্ট। এটা নিম্ন স্তরের কেউ করেছে বা যারা চিহ্নিত হয়েছে, ধরা পড়েছে শুধু তারাই করেছে, ব্যাপারটা তা না। এটা যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয় বা তথ্য নেয়া, তাহলে বাংলাদেশে এর তালিকা কম দীর্ঘ হবে না। এমন হয়েছে, কলকাতায় বইটি বেরিয়েছে, এদেশে অনুবাদ দেখিয়েছেন উনারা। একটা বই একাধিক হাতে অনুবাদ হতেই পারে। সেটা হওয়া উচিত আমি যদি দেখি ওমুকে যে অনুবাদ করেছেন সেটা ভুল অনুবাদ, ব্যার্থ অনুবাদ; এবং আমার কাছে মনে হয়ে এটা সফল ভাবে অনুবাদ করতে পারবো, তখন অনুবাদ করা উচিত। আর যদি বলেন তারা দ্বিতীয় ভাষা থেকে করেছেন, আমি মূল ভাষা থেকে করবো, তাও করতে পারেন। কিন্তু আমাদের এখানে কেউ কেউ হয়তো বাণিজ্যিক কারণে, খ্যাতি কামানোর জন্য অন্যের সম্পদ অপহরণ করছেন। কিছুদিন আগে আমি যেটা ধরিয়ে দিয়েছিলাম, সেটা আরো গুরুতর। সেখানে বইটা স্প্যানিস থেকে অনুবাদ করা হয়েছে দাবি করা হলেও সেটি আসলে অনুদিত হয়েছে ইংরেজি বইয়ের ভিত্তিতে। এটা খুবই বড় রকমের অন্যায়। কারণ আমাদের এখানে স্প্যানিস থেকে অনুবাদ করেন এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। তাই সাধারণ পাঠকের পক্ষে এটা জানাটা কঠিন। যদিও অনেকেই ইংরেজি জানেন। ফলে তারা ধরে ফেলতে পারেন তা ইংরেজি থেকে হয়েছে কিনা, নাকি অন্যের বাংলাকে মেরে দেয়া হয়েছে। স্প্যানিসের ক্ষেত্রে কঠিন। সেক্ষেত্রে দেশের মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে আপনি প্রতারণা করছেন, অপরাধ করছেন। সেটা একটা জালিয়াতি। যে অনুবাদটি হয়েছে আলফ্রেড ম্যাখাডেমের ইংরেজি অনুবাদের ভিত্তিতে। তারপর সেটি বেরিয়েছে আমাদের এখানে একটা বহুল জনপ্রিয় ও প্রচারিত প্রকাশনা সংস্থা থেকে।

এটা পশ্চিমের হলে তো মামলা হতো। কনজিউমার রাইটস বলতে একটা কথা আছে। আপনি আমাকে বলবেন এটা গ্যাটের বই, আর ভেতর দিবেন কালিদাসের বই। এটা অপরাধ। এটা আমাদের দেশে চলছে বলে আমি মনে করি। এজন্য প্রকাশনা সংস্থাগুলো আরো সতর্ক হওয়া দরকার। সেজন্য প্রয়োজন সম্পাদনা পরিষদ। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক আছে। তার বাইরে বিভিন্ন ভাষায় দক্ষ মানুষও আছেন, তাদের সম্পৃক্ত করা দরকার। তাদের স্বক্রীয় হওয়া দরকার। এখন কাউকে-না-কাউকে ভুল ধরিয়ে দেয়ার যে চ্যালেঞ্জ, তা নিতে হবে। তার সে সাহস, সে মেধা দিয়ে তা করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সে ধরনের লোক কম। যার জন্য এই সব আবর্জনার বিস্তার বেশি হচ্ছে। জালিয়াতির বিস্তার হচ্ছে।



এহ্সান : অনুবাদের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার, একুশে পদক দেয়া হচ্ছে। এটা আমাদের দেশে মানসম্মত অনুবাদের ক্ষেত্রে কি কোনো ভূমিকা রাখছে?

রাজু আলাউদ্দিন : পুরষ্কার খুব যে ভূমিকা রাখতে পারছে তা মনে হয় না। অনুবাদের তো কয়েক বছর যাবত, এবছর গবেষণাতেও উনারা পুরস্কার দেননি। উনারা কি ধরেই নিয়েছেন যে, এই বিষয়ে পুরষ্কার পাওয়া মতো কেউ নেই। গবেষণাতে যদি কিছুই না হয়ে থাকে, তারাও তো প্রচুর টাকা খরচ না করে গবেষণা গ্রন্থ বের করছেন। সেগুলোর পুরোটাই কি অর্থহীন? তাদের বাইরেও কত প্রকাশনী থেকে কত গ্রন্থ বের হচ্ছে। তাহলে সেগুলো কি কোনো গবেষণাই হয়নি? তাছাড়া এত এত অনুবাদ গ্রন্থ বের হচ্ছে। সেখানে একটি অনুবাদগ্রন্থও কি ছিল না, পুরষ্কার পাওয়ার জন্য? সুতরাং এই পুরষ্কার নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।


এহসান : আপনাকে ধন্যবাদ ।
রাজু আলাউদ্দিন : আপনাকেও ধন্যবাদ।




লেখক পরিচিতি :
রাজু আলাউদ্দিন
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। ১৯৬৫ সালের ৬ মে শরিয়তপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম-এ কাজ করছেন। দেশি ও বিদেশি সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লেখার পাশাপাশি ইংরেজি ও স্প্যানিস থেকে প্রচুর অনুবাদ করেছেন। স্প্যানিস ভাষায় দখল গভীর।
অনুবাদ ও সম্পাদিত গ্রন্থ : গেয়র্গ ট্রাকলের কবিতা (মঙ্গলসন্ধ্যা), টেড হিউজের নির্বাচিত কবিতা (বাংলা একাডেমী), সি. পি. কাভাফির কবিতা (শিল্পতরু প্রকাশনী), কথোপকথন (বাংলা একাডেমী), সাক্ষাৎকার (দিব্যপ্রকাশ), খ্যাতিমানদের মজারকাণ্ড (মাওলা ব্রাদার্স), নির্বাচিত বোর্হেস (ঐতিহ্য প্রকাশনী, ৫ খণ্ড, সম্পাদনা) বোর্হেসের আত্মজীবনী (সংহতি প্রকাশনী, সহ-অনুবাদক), আলাপচারিতা (পাঠকসমাবেশ, গৃহীত সাক্ষাতকার), অন্য আলোয় অন্য ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বিদেশি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের আলাপচারিতা(সংহতি প্রকাশনী), দক্ষিণে সূর্যোদয় : লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্রচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস(অবসর প্রকাশনী), অনূদিত কথাসমগ্র : অনূদিত সাক্ষাৎকার সমগ্র (কথা প্রকাশনী), মারিয়ও বার্গাস যোসা : জীবন ও মিথ্যার সত্য।







সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর  পরিচিতি
অলাত এহ্সান 

জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ