‘লেখক মূলত যে কথাটা বলতে চাইছেন, অনুবাদ হয়ে সেটাতে কোনও বিকৃতি যাতে না আসে’
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অলাত এহ্সান
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অলাত এহ্সান
অভিজিৎ মুখার্জি অধ্যাপনা করেন। পড়ান ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। একাধিকবার জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে সে দেশের ভাষার শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ, দেশে ধারাবাহিকভাবে দোভাষী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে তার।
ব্যক্তিগত ও পেশাদারি নৈকট্য, আর সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তার উৎসাহ ও চর্চার খতিয়ান এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাঠাভ্যাসের সূত্রে পরিচয়ের বিস্তৃত হিসেবে তিনি জাপানি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদের নিবিষ্ঠ হয়েছেন। প্রয়োজনে হারুকি মুরাকামির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনও করেছেন। মুরাকামির গল্প-উপন্যাস অনুবাদে তার সুখ্যাতি। অপ্রিয় সত্য কথাকেও বলেন সোঝাসুঝি, কোনো প্রকার ভনিতা ব্যতিরেকে। তারা স্বাক্ষাৎকারেও তার শ্লেষ পাওয়া যাবে। স্বাক্ষাৎকার নিয়েছেন গল্পকার অলাত এহ্সান।
অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো একটা পরিণত কাজ। আপনার কাছে অনুবাদক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি কি রকম?
অভিজিৎ মুখার্জি : প্রাথমিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হচ্ছে নিজের গদ্যকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় করে তোলা। অনুবাদকের নিজের গদ্যভঙ্গি পরিণত মানের না হলে অনুবাদের প্রচেষ্টা শুধু বিফল হয় তা-ই নয়, অনুবাদ পড়ার প্রতি পাঠকের অনীহা তৈরি হয়। এবং ভবিষ্যতের অন্যান্য অনুবাদকের পরিশ্রমও পাঠকের অনীহার কারণে মর্যাদা পায়না, অবহেলিত থাকে। এর বিষময় এবং অনভিপ্রেত ফল আজকের পশ্চিম বাংলায় হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে বলেই আপাতত এটির ওপরেই সার্বিক গুরুত্ব আরোপ করতে চাইছি।
এছাড়াও পাঠের চৌহদ্দীকে যথাসম্ভব বিস্তৃত করার নানা সুফল অনুবাদের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয়, তাই সাহিত্য ছাড়াও সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি সমস্ত বিষয়েই নিয়মিত পড়াশুনার অভ্যাস তৈরি করে নেওয়া বেশ জরুরি বলেই মনে করি।
অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো শুধু ভাষার পরিবর্তন নয়, ভাবের অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবের অনুবাদ তো একটা মৌলিক সমস্যা। আপনি এই সমস্যা দূর করতে কি করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : ভাব তো শুধু দর্শন নয়, ভাবের একটা সাংস্কৃতিক ভিত্তিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে। ভাব নিয়ে সমস্যা আদতে অসম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিচয়েরই ফল। আমি কিন্তু সাংস্কৃতিক বলতে তার মধ্যে রাজনৈতিক ও ইতিহাসগত দিককেও বোঝাচ্ছি। এই সমস্যা কতখানি অনুবাদককে মুশকিলে ফেলবে বা কী করে অনুবাদক সেই সমস্যা থেকে উত্তীর্ণ হবেন সেটা তাই অনুবাদকের অবগতির বিস্তারের ওপর নির্ভর করে। সমস্যা থেকে তাৎক্ষণিক উত্তরণের উপায় সেই কারণেই কম। পাঠাভ্যাস বাড়িয়ে যাওয়া আর বিদেশি ভাষার সেই সমাজ, সেখানকার ভূগোল ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ থাকলে সেই সুযোগ কাজে লাগানোই সবচেয়ে কার্যকরি উপায়। ভাবের সমস্যা মোচন তাই একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
এহ্সান : লেখার সঙ্গে, বিশেষত সাহিত্যের সঙ্গে দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি-মিথ ইত্যাদি গভীর ভাবে যুক্ত। সেক্ষেত্রে অনুবাদের জন্য লেখকের দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি। অনুবাদের দক্ষতা অর্জনের জন্য কোনো একটা দেশ বা মহাদেশ এবং ভাষাকেই বেছে নেয়া উত্তম। তাই না?
অভিজিৎ মুখার্জি : সে-কথাই আমি এর আগের প্রশ্নের উত্তরে বললাম। তবে মহাদেশ কিন্তু একটা বিরাট ব্যাপার! মহাদেশের একটি-কি-দুটি দেশ সম্বন্ধে জানলেই যে অন্যান্য দেশ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে রাখা যায়, তা তো নয়। এশিয়া মহাদেশের কথাই ভাবুন না কেন, মধ্যপ্রাচ্য সম্বন্ধে জানলে কি দূরপ্রাচ্য সম্বন্ধে ধারণায় তেমন আত্মবিশ্বাস আসা সম্ভব? ইয়োরোপের ফ্রান্স সম্বন্ধে জেনে কি তুরস্ক নিয়ে আলোচনায় তেমন সুবিধে হয়? অনেক সময় এমনকি দেশটি সম্বন্ধে জানলেও চলে না, বিশেষ জনগোষ্ঠি নিয়েও যথেষ্ট সময় ধরে চর্চা করে নিতে হয়। ভারতের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদের ক্ষেত্রেই তো সে-কথা খুবই খাটে।
এহ্সান : একজন লেখক তো লেখায় মেজাজ-মর্জি-ছন্দ-গতি দিয়ে লেখেন। অনুবাদেও সেই মেজাজ-ছন্দের জন্য সেই লেখকের ওপর প্রস্তুতি দরকার। এজন্য একজন লেখককে নির্বাচন করাই ঠিক, নয় কি?
অভিজিৎ মুখার্জি : সেটা অবশ্য অনুবাদকের এলেমের ওপর নির্ভর করে অনেকাংশে। প্রত্যেক লেখকের গদ্যভঙ্গির বিশেষত্ব আছে। সেই লেখকের লেখা অনুবাদ করতে গেলে রহস্যটির উদ্ঘাটন করতে হয়, কোথায় লুকিয়ে এই গদ্যভঙ্গির মহিমা। একাগ্র হয়ে নিবিড় চর্চায় অনেক সময়েই পাঠকের অজানিতে একসময় গদ্যভঙ্গির বিশেষত্বটি ধরা দেয়। সেইটেই চাবিকাঠি, লেখাটার একেবারে হৃদয়ে প্রবেশ করার। এবং তারপরেই একমাত্র সার্থক অর্থাৎ উপযুক্ত অর্থ সহকারে অনুবাদ সম্ভব। সেই দিক দিয়ে দেখলে সাধারণ অনুবাদকের ক্ষেত্রে হয়তো একজন লেখকেই নিবিষ্ট থাকা বিধেয়। কিন্তু ব্যতিক্রমী অনুবাদকও আছেন, যাঁরা নিজেরাই হয়তো জগৎবরেণ্য লেখক, বহুমাত্রিক গদ্য যাদের আয়ত্ত! তাঁরা যখন অনুবাদক, তখন একাধিক লেখকের লেখার সার্থক অনুবাদও অসম্ভব নয়। যেমন জাপানের হারুকি মুরাকামি, তাঁর নিজের লেখা কম বেশি পঞ্চাশটি ভাষায় অনুদিত হয়। কিন্তু জাপানের সাধারণ পাঠকের সাহিত্য-রুচি গড়ে দিতে তিনি বিপুল পরিমাণ অনুবাদও করেছেন, এবং একাধিক লেখকের। স্কট ফিটজেরাল্ড, ট্রুম্যান কাপোত, রেমন্ড কার্ভার ইত্যাদি মার্কিন লেখকের লেখা মুরাকামি জাপানিতে অনুবাদ করেছেন।
এহ্সান : একজন অনুবাদকের তৃপ্তি কোথায়, একটি অনুবাদ করায়, না একটি ভাষা-দেশ-সংস্কৃতি-লেখক সম্পর্কে গভীরভাবে জানায়?
অভিজিৎ মুখার্জি : সবার কথা বলতে পারি না, আমার নিজের ক্ষেত্রে যেটা খাটে সেটা হল, বিদেশি ভাষার একটা নির্দিষ্ট টেক্সটের প্রতি আমার যখন এতটাই পক্ষপাত জন্মায় যে আমি চাইলাম সকলেই কথাটা জানুক, এইভাবেই সেটা পেশ হোক, তখন আমি সেটা অনুবাদ করার ইচ্ছা পোষণ করতে থাকি, সুযোগ হলে করি। অর্থাৎ তাগিদটা এক অর্থে রাজনৈতিক, প্রোপাগ্যান্ডিস্টও বলা যায় ! এবার যদি দেখা যায় অনুবাদ পড়ে পাঠক মোটামুটি সেই অর্থেই টেক্সটটাকে অনুধাবন করছে যে অর্থে আমি করেছিলাম, এবং প্রভাবিত হচ্ছে, তবেই তৃপ্তি, তার আগে নয়।
এহ্সান : প্রায়ই শোনা যায়, অনুবাদ কোনো সাহিত্য নয়। অনুবাদের সাহিত্য হয়ে ওঠায় অন্তরায়টা কোথায়? অনুবাদ কি ভাবে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে?
অভিজিৎ মুখার্জি : প্রসঙ্গটা খানিকটা হলেও দর্শনের আওতায় পড়ে! যদি ধরে নিই যে, যেহেতু অনুবাদ হয়ে টেক্সটটা যা দাঁড়াবে সেটা নেহাতই অনুবাদকের ‘ফ্রী উইল’ সঞ্জাত নয় (মূল রচনার লেখককে অনুসরণ করতে হয়েছে) তাই ওটাকে মূল রচনার তুল্যমূল্য গুরুত্ব দেওয়া যাবে না, তাহলে কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে মূল রচনাটি লেখকের ফ্রী উইল কিংবা মুক্ত সৃষ্টিশীলতার ফসল। ঠিক কিনা? কিন্তু কালচারাল স্টাডিজ বলে আধুনিক শাস্ত্রটির চর্চা যাঁরা করেন তাঁরা কি রাজি হবেন এটা মেনে নিতে যে ইতিহাসে লেখকের সময়, সমাজ, সমাজে লেখকের স্থান, লেখকের পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিস্থিতি, এগুলো মোটেই তাঁর রচনার বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গি, চরিত্রসৃষ্টি ও অন্যান্য উপকরণকে নির্দিষ্ট করে দেয় না? তাহলে মুক্ত সৃষ্টিশীলতার গৌরবই বা মূল রচনার লেখককে অর্পণ করি কী করে?
আমার কথা হল, যদি অনুবাদ না হলে সাহিত্যটাই নাগালের বাইরে চলে যায় তাহলে অনুবাদককে খাটো করে আর মূল রচনাকারকে তুলনায় বড় বলে আমার প্রাপ্তিটুকু কী? শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে কিন্তু তবু স্বীকার করা ভাল, সাহিত্যসৃষ্টির মানের দিক থেকেও শিল্পোন্নত দেশগুলো যে এগিয়ে। তার একটা প্রধান কারণ হল আন্তর্জাতিক সাহিত্য, অনুবাদে হলেও, পাঠের সুযোগ সেখানকার মানুষজনের কাছে অনেক বেশি। অনুবাদ জিনিসটাকে উপযুক্ত সম্মান আর গুরুত্ব সেসব দেশে উন্নত সাহিত্যসৃষ্টির খাতিরেই দেওয়া হয়। সাহিত্যসৃষ্টি আর যথাযোগ্য অনুবাদ, এরা অবিচ্ছেদ্য এক ভূমিকা পালন করছে ওইসব দেশে। গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক প্রতিবেদন ঝুম্পা লাহিড়িকে উদ্ধৃত করে জানালো, Lahiri believes that "translation is the key" – that it is what has created "the bridge for so many of us to be able to read across our limitation"
আর অনুবাদের জগতে কি প্রতিযোগিতার অভাব নাকি? বিশ্বের সাহিত্য ও সাহিত্যের বাজার নিয়ে অর্থনীতির খবরটা আমাদের মতো উন্নতিশীল দেশের অধিকাংশ সাহিত্যপ্রেমীই রাখেন না, তাই অনুবাদকে কিছুটা হলেও হেলাফেলার প্রবণতা দেখা যায়!
এহ্সান : অনেক সময় দেখা যায়, কোনো লেখক বা দেশের কিছু গল্প অনুবাদ করেই তাকে ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ বলে দিচ্ছে। বইয়ের ভূমিকায়ও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু থাকে না যে, এগুলো কেন শ্রেষ্ঠ গল্প। কিভাবে বাছাই করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে পাঠকরা কি প্রতারিত হচ্ছেন না?
অভিজিৎ মুখার্জি : হ্যাঁ, হচ্ছেন বই কি। তবে পাঠকদেরই এই ধরণের সংকলনকে অগ্রাহ্য করার দায়িত্ব নিতে হবে। যদি দেখেন যে সংকলনটা মূলে মোটেই ‘শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলন’ এই টাইটেলে ছিল না (থাকলে সেই বইয়ের প্রকাশনার খুঁটিনাটি অনুদিত সংকলনেও উল্লেখ করার কথা), তবে ওটাকে একটা অনৈতিক ও অবাঞ্ছিত উদ্যোগ বলেই গণ্য করতে হবে—সেটাও পাঠকেরই দায়িত্ব।
এহ্সান : আমাদের দেশে সাধারণত যে অনুবাদগুলো হয় সেগুলো মূলভাষা থেকে নয়, দ্বিতীয় কোনো ভাষা, বিশেষত ইংরেজি থেকে। তাহলে আমরা ‘সূর্যের রশ্মি থেকে তাপ না নিয়ে বালি থেকে তাপ নিচ্ছি’ বলে মনে হয় না?
অভিজিৎ মুখার্জি : আমি যেসব গল্প বা প্রবন্ধ মূল জাপানি থেকে সরাসরি অনুবাদ করেছি। সেগুলোর অনেকগুলোরই ইংরিজি অনুবাদেও খানিক খানিক চোখ বুলিয়েছি। ইংরিজিতে কিন্তু বহুক্ষেত্রেই মারাত্মক স্বাধীনতা নেওয়া হয়, ক্ষেত্র বিশেষে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার মতোই ঝুঁকি নেওয়া হয়েছে বলে দেখেছি! তাই সরাসরি মূল ভাষা থেকে অনুবাদই শ্রেয়, তবে সেই সুযোগ না থাকলে কী আর করা, তখন অগত্যা ইংরিজি থেকেই...
এহ্সান : অধিকাংশ অনুবাদই বিশ্বের জনপ্রিয় বা বহুল আলোচিত, মানে ‘বেস্ট সেলার’ বইগুলো হয়ে থাকে। এই অনুবাদ দ্বারা একটি দেশের সাহিত্য কতটুকু উপকৃত হতে পারে?
অভিজিৎ মুখার্জি : যথেষ্টই উপকৃত হতে পারে। বেস্ট সেলার মানে কিন্তু যাঁরা বই কেনেন, বিশ্বজুড়ে তাঁদের কাছে সমাদর পেয়েছে যে বইগুলো। নিয়মিত বই যাঁরা কেনেন তাঁরা খুব রুচিহীন, বুদ্ধিহীন হওয়ার কথা নয়, আর বেস্ট সেলারও তাই একেবারে অকিঞ্চিতকর বইয়ের পক্ষে হয়ে ওঠা কঠিন। বিশ্ব জুড়ে বেশির ভাগ লোক যা পড়ছে তা আমার দেশের মানুষও পড়তে চাইলে দোষের তো কিছু নেই। অনুবাদেরও একটা অর্থনীতি আছে, বেস্ট সেলার হওয়ার সুবাদে যে বইটির বাজার তৈরি হয়েই আছে; সেটির অনুবাদ প্রকাশ করলে প্রকাশকের আর্থিক ঝুঁকি কম। ফলত বেস্ট সেলারের অনুবাদ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি হবেই। এইমুহূর্তে যেসব লেখকদের বই বেশি বিক্রি হয়, যেমন—গার্সিয়া মার্কেজ, নাইপল, কুন্দেরা, উমবের্তো একো, মুরাকামি, মার্গারেট অ্যাটউড, ফিলিপ রথ, রুশদি, ইশিগুরো, পামুক ইত্যাদি, এঁদের বই পড়ার ভালো বই কোনও খারাপ দিক তো নেই। বেস্ট সেলার হওয়ার সূত্রে লোকে বেশি করে এঁদের বই পড়লে ক্ষতি নেই বলেই আমার মনে হয়।
এহ্সান : বিশ্বের অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ আছে যে গুলো ভাল, কিন্তু বহুল আলোচিত নয়। যেখানে প্রকাশকরাও বিনিয়োগ করতে চায় না। সেক্ষেত্রে মানসম্মত সাহিত্য অনুবাদ কি করে পেতে পারি?
অভিজিৎ মুখার্জি : অনেক ভেবে দেখলাম, এর কোনও মোক্ষম ব্যবস্থা করে ওঠা মুশকিল। বাজার নিয়ে হোক বা রাজনৈতিক প্রাধান্যের প্রশ্নে হোক, বইয়ে বইয়ে প্রতিযোগিতা থাকবেই, একটাকে তুলে ধরে অন্যটাকে আড়াল করার চেষ্টা থাকবেই, আর সেহেতু ভালো বই উপযুক্ত আলোচনা পেলো না এরকম ক্ষোভের পূর্ণ প্রশমন অসম্ভব। আন্তর্জাতিক স্তরে সমমনস্ক পড়ুয়া লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চললে (সোশাল নেটওয়র্কিং সাইট-এর মাধ্যমেই হোক না কেন) বহু ভাল বইয়ের খবর সেই সূত্রে পাওয়া যায়, পত্রপত্রিকায় আলোচনা ব্যতিরেকেই। তবে অনুবাদ হওয়ার জন্য বাজারের দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর নইলে রাজনৈতিক প্রচারধর্মী মেটিরিয়াল হিসেবে সেই বইয়ের তাৎপর্য। আমার নিজের অবশ্য সমস্যা হল যত ভাল বইয়ের খবর আসে তার অধিকাংশই পড়ে ওঠার সময় করতে পারি না, অপঠিত রয়ে যায়।
এহ্সান : একটি দেশ উপনিবেশ মুক্ত হওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বিশ্বের সেরা সাহিত্য, জ্ঞানগর্ভ-মননশীল-চিন্তাশীল বইগুলো ব্যাপক ভাবে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই, দেশি ভাষায় অনুবাদ করা। আমাদের দেশে তা হয়নি। এটা কি আমাদের দেশের সাহিত্যের অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলেছে মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : শিল্প বা সাহিত্যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের কথা চিন্তায়ও আনবেন না, উচ্চারণেও আনবেন না। শিল্প ও সাহিত্যকে আমাদের মতো হাভাতেদের দেশে একেবারে সমূলে বিনষ্টিকরণের শ্রেষ্ঠ উপায় হল জিনিসগুলোকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের আওতায় আনা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি : আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বই বিক্রির হিসেব নিয়ে নানা আস্ফালন বইমেলা ইত্যাদির পরেপরেই শোনা যায় বটে, আদতে বই মোটেই বিক্রি হয় না। প্রকাশকদের ব্যবসায়ে টিকে থাকার খাতিরে যা যা করতে হয় তা ফাঁস হলে যে পরিবারে কখনও কেউ প্রকাশক ছিল সেই পরিবারে কেউ আর মেয়ের বিয়ে দেবেন না! তখন একমাত্র উপায় হচ্ছে সরকারি সিলেকশন প্যানেলকে খুশি করে কিংবা সরকারে আসীন দলের দাদা ধরে একেকটি বইয়ের বেশ কিছু কপি সরকারি রামমোহন ফাউন্ডেশনের কাছে অথবা অন্য লাইব্রেরি-চেইনে (সরকারি অনুদান গ্রাহক) গছিয়ে দেওয়া। এটি জনগণকে পুস্তক পাঠে সহায়তা করার অছিলায় ট্যাক্সপেয়ারের পয়সায় যত রাজ্যের হাবিজাবি বই কিনে প্রকাশকদের উদ্ধার করে। একদিকে বইয়ের বিক্রি নেই এবং সেইসূত্রে পাঠকের বিচারের তোয়াক্কা করে লাভ নেই; অপরদিকে সরকার সংগ্রহ না করলে ধনে-প্রাণে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা—প্রকাশকরা হন্যে হয়ে ছুটছে সরকারের নেকনজরে থাকা করিৎকর্মা লেখকদের পেছনে। সহজেই আন্দাজ করতে পারছেন তারা কেমন কিসিমের লেখক! জগতের কোনও খবরই তাদের কাছে নেই, মুখ্যত সমাজের সবচেয়ে সম্ভাবনাহীন অংশ নতুবা নিষ্কর্মা সরকারি অফিসারবর্গ। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (সেকালে এরচেয়ে উঁচুপদে কোনও দেশিয় উঠতে পারতো না), ঠাকুরবাড়িতে রোজ এসে খানাপিনা করতো সারা বিশ্বের নানা কোণ থেকে আসা সাহেবসুবোরা। এদের দিয়ে বাংলার আধুনিক সাহিত্যের শুরু আর এখন... থাক, সেসব কথা! বেকার যুবকদের অনেকেরই দিন গুজরান হয় টিউশনি করে, আমাদের সাহিত্যিকদের কাছে কেউ ভরসা করে টিউশন নিতেও পাঠাবে না বাচ্চাদের, এমনই তাদের এলেম! এইসব সরকারের ধামাধরা, সরকারি দলের নির্দেশে চলা লেখকদের ভাবমূর্তি ও মুরোদ বোঝা গিয়েছে, তাই এখন এ-বাংলায় বুদ্ধিজীবী বলতে বোঝায় মঞ্চাভিনেতা, সিনেমাভিনেতা, গায়ক ইত্যাদি, কিন্তু সাহিত্যিকরা বাদ! লোকের বই পড়ার ইচ্ছে থাকলে, যেমন রেস্তোরাঁয় গিয়ে, পোষাক কিংবা শাড়ি কিনে, নিত্য নানা ইলেকট্রনিক গ্যাজেট কিনে, বেড়িয়ে টেড়িয়ে পয়সা খরচ করে তেমনই পয়সা ব্যয় করে বই কিনুক। যদি কোনও সমাজে সে-রকম লোকের সংখ্যা বা সাধ্য এতই কমে যায় যে, ওতে বইয়ের ব্যবসার প্রসার ঘটে না। তবে ক’দিন অপেক্ষা করাই শ্রেয়। তাতে আর যা-ই হোক সাহিত্য ধ্বংস হবে না, সীমাবদ্ধ থাকবে। এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, অর্থনীতির সঙ্গে অন্যান্য উন্নতির যোগ খুব ঘনিষ্ট। কিন্তু একবার রাষ্ট্র এসেছে কি সাহিত্য শেষ, যেমন পশ্চিম বাংলায়। বাংলা সাহিত্য এবং তারচেয়ে বেশি করে সাহিত্যিকেরা, এখানে হাসাহাসির জিনিস! খবরদার ওপথে যাবেন না!
এহ্সান : টেকনিক্যাল শব্দগুলো ছাড়াও অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদে সংকট হলো যথাযথ পরিভাষার অভাব। আমাদের দেশে পরিভাষা তৈরির তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের কি করনীয়?
অভিজিৎ মুখার্জি : আমি সংস্কৃত জানি না, কিন্তু যাঁদের পণ্ডিত বলে মানি তাঁদের মুখে শুনে এরকম ধারণা হয়েছে যে নব্যন্যায়কে অনুসরণ করলে পরিভাষা তৈরির কাজটা বিনা ঝঞ্ঝাটে অল্প সময়ে সারা যায়। কিন্তু সেটাও তো দু-একজন লোকের কাজ নয়। সমাজের মানী লোকেদের আহ্বানে যদি সাধারণ মানুষ অর্থসাহায্য করে, ক’য়েকজন দায়িত্বশীল মানুষ যদি দু-এক বছরের জন্য হিসেব নিকেশ ও ব্যবস্থাপনার অন্যান্য দায়িত্ব নিতে রাজি হন, তবে ট্রাস্ট গঠন করে কাজটা করে ফেলা যায়। কিন্তু প্রশ্নটা আসলে জাতীয় চরিত্রের। পরিস্থিতি যে কী সে তো আমিও জানি আপনিও জানেন!
এহ্সান : অনেকেই মনে করেন অনুবাদের মান রক্ষার জন্য দেশে রেগুলেটরি বডি স্থাপন করা দরকার। আপনার কি মনে হয়? আমরা কিভাবে মানসম্মত অনুবাদ পেতে পারি?
অভিজিৎ মুখার্জি : এখন ও নিয়ে ভাবার সময় আসেনি। আপাতদৃষ্টিতে মান বজায় রাখার কাজটা কোনও সংস্থার হলেও প্রকৃতপক্ষে পাঠকের শিক্ষার মানের ওপর নির্ভর করে বাঞ্ছিত মান নির্ধারিত হওয়াটা। বিতর্ক উঠবে প্রতিটি পদে, তখন নিরসন করবে কে? কার কথা সর্বজনগ্রাহ্য হবে? সে-ই বা এ-কাজে সময় দেবে কেন মান যাচাইয়ের নিয়ম বারবার লঙ্ঘিত হলে? আর, যেখানে নিয়ম লঙ্ঘনের উপায় নেই অচিরেই সেই সংস্থাকে অকেজো করে দেওয়া হবে। মোটের ওপর পাঠক অবোধ শিশু হয়ে থাকলে কিছুই হবে না, তার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। দেশের শিক্ষার প্রসার আর শিক্ষার মান এটাই অনুবাদের মানকেও সরাসরি প্রভাবিত করে, এবং সেটা পাঠকের দিক দিয়ে।
এহ্সান : অনেকেই পাঠের জন্য মূলগ্রন্থ পাঠকেই গুরুত্ব দেন। লেখক প্রস্তুতি হিসেবে অনুবাদ সাহিত্য পাঠকে আপনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : অনুবাদ সাহিত্য না পড়ে সাহিত্যপাঠ হবে কী করে? বোর্হেস না পড়ে, তলস্তোয়, দস্তয়েভস্কি না পড়ে, থমাস মান না পড়ে, কাওয়াবাতা না পড়ে সাহিত্যপাঠের ন্যূনতম প্রচেষ্টাটুকুও তো করা হয় না! অথচ এগুলো অনুবাদ ছাড়া পড়ার উপায় কী?
এহ্সান : প্রতিবছরই দেশে প্রচুর অনুবাদ হয়। তার সবই জনপ্রিয় ও বহুলালোচিত গ্রন্থ। অপরিচিত কিন্তু শক্তিশালী লেখক বা বই, অনুবাদকের তেমন কোনো আবিষ্কার নেই। এটা কি অনুবাদকের দুর্বলতা, না অন্যকিছু?
অভিজিৎ মুখার্জি : অনুবাদক এ ব্যাপারে বেশি সবলতা দেখালে প্রকাশকের সহায়তা পাবেন তো? সীমাবদ্ধতাটা মূলত সেখানেই। বইয়ের বাজার যদি খুব স্ফীতিশীল হতে থাকে তবেই প্রকাশক উদারতার ঝুঁকি নেবেন, তখন অল্প-পরিচিত লেখকের অখ্যাত বইয়ের অনুবাদের পরিস্থিতি তৈরি হবে। বইয়ের জগতের যথেষ্ট খোঁজ রাখেন এরকম লোককে দিয়ে অনুবাদ করাতে গেলে অনুবাদকের প্রাপ্তির দিকটিও তো দেখতে হবে। শুধু সদিচ্ছা দিয়ে বেশিদিন কিছুই টানা যায় না।
এহ্সান : রবার্ট ফ্রস্ট, টি এস এলিয়ট, শার্ল বোদলেয়ার, শাহানামা অনেক অনুবাদ করেছেন; কিন্তু শামসুর রাহমান, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কেউ করতে পারেননি মনে করা হয়। কবিতার অনুবাদ কবি, গল্পের অনুবাদ একজন গল্পকার করলে সেরাটা পাওয়া সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। আপনি কি মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে মূলের থেকে অনেক বিচ্যুতি নির্দেশ করে অনেকে দেখিয়েছেন, কিন্তু তাতে ওঁর অনুবাদের জনপ্রিয়তা কমেনি। কারণ খুব সরল, লেখার প্রসাদগুণ। শামসুর রহমান, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এদের নিজস্ব রুচি ও রচনাভঙ্গি এতই পরিণত যে, এঁরা কখনও একটা কাঁচা টেক্সট, পাঠককে অত্যাচার করতে, প্রকাশকের হাতে ছাপাবার জন্য তুলে দেবেন না। এটা তো একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক! গল্পকার হওয়ার দরকার নেই, দক্ষ গদ্যলেখক হলেই হবে। কবিতার ক্ষেত্রে অবশ্য অনুবাদক কবি হলেই ভাল হয়, তবে অপ্রধান কবি হলেও ক্ষতি নেই। ক্লিনটন সীলির ইংরিজি অনুবাদ পড়েছেন তো জীবনানন্দ দাসের কবিতার? এককথায় অনবদ্য!
এহ্সান : অনুবাদ তো দুইভাবেই হতে পারে। বিদেশি সাহিত্য দেশি ভাষায়, দেশি সাহিত্য বিদেশি ভাষায়। আমরা কিন্তু তা দেখছি না। এর কারণ কি? এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী বলে মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : অর্থনৈতিক সুযোগ একটা পর্যায়ে না পৌঁছলে বিদেশি ভাষা নিষ্ঠা নিয়ে শেখার চল কমে যায় সমাজে। উদ্বৃত্ত অর্থ না থাকলে শিক্ষিত লোকেরা সেই অবসরটুকু পান না, যার প্রসাদে খেয়াল খুশি মতো দীর্ঘদিনের অধ্যয়নে বিদেশি ভাষা উপযুক্ত রকম শিখে নিয়ে দেশি টেক্সট বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করতে প্রয়াস পান। রবীন্দ্রনাথের প্রজন্মে ঠাকুরবাড়ির লোকেরা এরকম বহু অনুবাদ করেছিলেন। দারাশুকোর উপনিষদ অনুবাদ তো একটা মাইলস্টোন অবদান হয়ে আছে! সুফি আন্দোলনে ওঁর এই অনুবাদের অবদান ইতিহাসকেই পালটে দিয়েছে, Richard Eaton-এর Rise of Islam and the Bengal Frontiers বইতে পড়েছি। একটা ইংরিজি কথা আছে না, “It is the economy stupid !” সেদিকটা অতিক্রম করে কিছু করে ওঠা মুশকিল।
এহ্সান : এবারের বই মেলায় আপনার কি কি অনুবাদগ্রন্থ বের হচ্ছে, সে সম্পর্কে বলুন।
অভিজিৎ মুখার্জি : এই বইমেলায় নতুন কোনও অনুবাদের বই বেরুচ্ছে না। আমি মুরাকামির ‘উমিবে নো কাফকা’, অর্থাৎ ‘সমুদ্রতীরে কাফকা’ নামের উপন্যাসটা অনুবাদে হাত দিয়েছি, সেই কাজ চলছে এবং অন্তত আরো এক কী দেড় বছর লাগবে। প্রত্যেক বইমেলায় একটা করে বই বেরুনো জিনিসটাকে আমি একদমই ভাল চোখে দেখি না। কত অসাধারণ সব বই রয়ে গিয়েছে পড়ার জন্য, লোকে সেগুলো আগে পড়ে নিক, একান্ত পড়া দরকার যেগুলো। তার বদলে তড়িঘড়ি করে ডজন ডজন মধ্যমানের বই বের করে জঞ্জাল বাড়ানো কেন?
এহ্সান : অনুবাদের জন্য লেখকের এই উপন্যাসকে বেছে নেয়ার কারণ কি?
অভিজিৎ মুখার্জি : সে অনেক কথা! বাংলার লেখককুলের কথা ছেড়েই দিন, পাঠককুলেরও যেন নজর আর আজকাল তেমন ওপরের দিকে ওঠে না। চাহিদা না থাকলে লেখার মান উন্নত হওয়ার তো কথা নয়। কী বিষয়বস্তুতে, কী ফর্মে, জগৎজুড়ে নতুন চিন্তার যেসব ঢেউ, তা আর বাংলা সাহিত্যের আঙিনা অবধি এসে পৌঁছয় না। সম্প্রতিকালে যে বইটি দর্শনে, বিষয়ে, ন্যারেটিভ ফর্মে, চরিত্র সৃষ্টিতে, স্টাইলে একেবারে মাইলস্টোন উপন্যাস হয়ে থাকার সমস্ত শর্ত পূরণ করেছে বলে আমি মনে করি সেটি কিন্তু এই ‘উমিবে নো কাফকা’। বাংলার পাঠক, সাহিত্যমোদী এই বই পড়ার সুযোগ পেলে বুঝবে বিশ্বসাহিত্য কোথায় চলে গেছে, উত্তেজিত হবে, আপ্লুত হবে—এই প্রত্যাশা নিয়েই আমি এই বইটাকেই বেছে নিয়েছি। মানবসভ্যতা বলে যদি কোনও একটি ধারাকে নির্দেশ করা যায়, তার কাছে ঠিক এইসময়ের উপযোগী এক অতি জরুরি দর্শনকে অভিনব আঙ্গিকে পেশ করছে এই উপন্যাস।
এহ্সান : মুরাকামির ছোটগল্প অনুবাদ করে আপনি তার একটি সংকলন করেছেন। এখানে অনেক গল্প তো আগেও অনুবাদ হয়েছে। আপনিও করলেন। ব্যাপারটা মনোটোনাস হয়ে গেল না? কিংবা আপনার বিশেষত্ব কোথায়?
অভিজিৎ মুখার্জি : এক মহিলা আমার কোনও এক পরিচিতজনের রেফারেন্সে একবার আমাকে ফোন করে করে বেশ কিছু জাপানি নামের প্রকৃত উচ্চারণ কী হবে জেনে নেন। জাপানের সংস্কৃতি সংক্রান্ত অন্যান্য কিছু প্রশ্নও তাঁর ছিল। পরে একজন আমাকে জানাল যে উনি নাকি মুরাকামির কয়েকটা গল্প অনুবাদ করে বই বের করেছেন। অনুবাদ, প্রত্যাশিত ভাবেই, ইংরিজি থেকে হয়েছে। ভূমিকায় উনি লিখে দিয়েছেন যে উচ্চারণ ইত্যাদি ব্যাপারে উনি একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়েছেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞের নাম উল্লেখ করেননি। করেননি যেহেতু, বইয়ের কোনও কপি সেই বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি। আমি তাহলে জানবো কী করে—কোন কোন গল্প অনুবাদ হয়েছে? আমি সত্যি বলতে কী, ইংরিজি থেকে অনুবাদের ব্যাপারে তেমন কৌতূহলিও নই।
জাপানি কোনও গল্প বা উপন্যাস বাংলায় আমি অনুবাদ করলে আর অন্য অনুবাদ পড়ার তেমন প্রয়োজন নেই! হাঃ হাঃ, রসিকতা করলাম। তবে বিনয় করতে হলে কী লিখতে হত তা আপনারাই বরং অনুমান করে নিন। আমার কোনও বিশেষত্ব থাকলে তা আছে জাপানি ভাষায় ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার অভিজ্ঞতা, বহুবার সেদেশে গিয়ে সেই সমাজের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ও পেশাদারি নৈকট্য, একাধিকবার জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে সে দেশের ভাষার শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ, দেশে ধারাবাহিকভাবে দোভাষী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আর সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় আমার উৎসাহ ও চর্চার খতিয়ান, বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাঠাভ্যাসের সূত্রে পরিচয়ের বিস্তৃতি, এইসবের মধ্যে। এর বেশি কিছু নিজের সম্বন্ধে বলাটা শোভন নয়। তবে অনুবাদক হিসেবে আমি যে বিবেচনাটাকে সবচেয়ে অগ্রাহিকার দিই সেটা হল, অনুদিত অবস্থায় এটি পড়তে পাঠকের ভাল লাগবে কিনা, আর, লেখক মূলত যে কথাটা বলতে চাইছেন, অনুবাদ হয়ে সেটাতে কোনও বিকৃতি যাতে না আসে।
এহ্সান : অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেকে ভাষা, অনেকে ভাব, অনেকে মূলবক্তব্য অনুসরণ করেন। এতে কি একটি সাহিত্যের প্রকৃতাবস্থার হেরফের ঘটে যায় না?
অভিজিৎ মুখার্জি : হ্যাঁ ঘটে। কিন্তু এ সমস্যা এতই জটিল যে প্রতিকারহীন। আসলে ট্রান্সলেশনের ধারণাটাই তো ভ্রান্ত, সবক্ষেত্রেই পুনর্লিখন করতে হয়, এমনকি দলিল দস্তাবেজের ক্ষেত্রেও।
এহ্সান : অনেকে মূল বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে মানে আক্ষরিক বা মূলানুগ অনুবাদ, কেউ ভাবগত বা মূলবক্তব্যের দিক খেয়াল রেখে অনুবাদ করেন। কোন ধরনের অনুবাদে প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে বলে আপনি মনে করেন? কেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : সৌন্দর্য তো আপনা আপনি ফোটেনা, ওটা অনুবাদকের নিজস্ব মুনশিয়ানা। অনুবাদক যথেষ্ট স্বাধীনতা নিলে হয়তো সৌন্দর্য ফোটাতে তাঁর সুবিধেই হয়, কিন্তু সেটা কি সমীচীন? তবে দু’টো ভাষার ও সংস্কৃতির মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এতরকম ভিন্নতা থাকে যে খুব বেশি আক্ষরিক অনুবাদ করলে সেটা অস্বস্তিকর হওয়ার উদাহরণই বেশি।
এহ্সান : অন্যান্য অনুবাদক থেকে নিজেকে কিভাবে আলাদা করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : অন্য অনুবাদকদের নিয়ে কখনোই খুব বেশি ভাবিনি।
এহ্সান : অনুবাদকের স্বাধীনতা, শব্দ তৈরি ইত্যাদি দিক অনেকে সামনে আনেন। এটাকে আপনি কি ভাবে দেখেন? তা ছাড়া অনুবাদকের আদৌ কোনো স্বাধীনতা আছে কি?
অভিজিৎ মুখার্জি : অনুবাদক যথেষ্ট সংবেদনশীল ও অভিজ্ঞ হলে তাঁকে যথেচ্ছ স্বাধীনতা দেওয়াই উচিত বলে মনে করি। আমি তো প্রয়োজনে সেই স্বাধীনতা নিই। হাঃ হাঃ! তবে পরিস্থিতি বর্ণনায় একান্তই প্রয়োজন হলে তবেই।
এহ্সান : অনুবাদ আমাদের সাহিত্যে কী অবদান রাখছে?
অভিজিৎ মুখার্জি : আমাদের সাহিত্যে দুর্ভাগ্যবশত তেমন চোখে পড়ার মতো অবদান রাখতে পারছে না। কারণ আমাদের সাহিত্যের জগতে অনুবাদ যেমন অবহেলিত—তেমনই অবহেলিত সাহিত্য বিচার, সাহিত্য নিয়ে ক্রিটিকাল আলোচনা। এর ফল হচ্ছে যে অমিতাভ ঘোষ কেন সুনীল গাঙ্গুলির চেয়ে অনেক অনেক বড় লেখক—সেটুকুও অধিকাংশ পাঠক অনুধাবন করে উঠতে পারেন না। অনুবাদের থেকে সুফল নিতে গেলে তো অনুদিত সাহিত্যকৃতিটির বিশেষত্ব কী সেটা অনুধাবন করতে হবে। সেই আলোচনাও যে তেমন হয় না, অনুবাদের ওপরেও যে তেমন জোর নেই, এসবই কিন্তু স্থানীয় লেখালেখির বাজারটা ধরে রাখতে মাতব্বরদের কায়েমি স্বার্থ। সাহিত্যটা প্যাশন হয়ে ওঠার বদলে হাভাতেদের করে খাওয়ার যায়গা হয়ে গেলে এরকমটাই হয়। বুর্জোয়া ডেভেলপমেন্ট বলে যে কথাটা আছে, সেটির অভাব সাহিত্যের সর্বস্তরে লক্ষ্য করা যায়। আমার খুব প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম—দস্তয়েভস্কিই যে ওঁর কাছে অন্যদের থেকেও একটু বিশেষ স্থান পাওয়া লেখক। ওঁর লেখনশৈলিতে মোটেই দস্তয়েভস্কি তেমন প্রত্যক্ষভাবে ফুটে ওঠেন না, কিন্তু কিছু কিছু ইস্যু যেভাবে ঐ রুশ স্রষ্টা তাঁর লেখায় এনেছেন, নিজের চিন্তাকে যেভাবে অভিব্যক্তি দিয়েছেন, তার থেকে গভীর অভিনিবেশে নিজের মতো করে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিছু আহরণ করেছেন নিশ্চয়। অনুবাদ যতদিন না যথেষ্ট অবদান রাখতে পারার মতো পরিস্থিতি পাচ্ছে, স্থানীয় সাহিত্যের মান ততদিনই অকিঞ্চিতকর হয়েই থাকবে।
এহ্সান : অন্য একটি ভাষায় লেখা অনুবাদ হচ্ছে। অথচ লেখক জানছেন না, রয়েলটি পাচ্ছেন না। মূলানুগ অনুবাদের জন্যও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে না। বিষয়টা কিভাবে দেখেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : সৌভাগ্যের বিষয় হল, অনুবাদ যাঁরা করাচ্ছেন আর মূল রচনাটি যাদের প্রকাশনার এবং মূল রচনার লেখক, এই তিন পক্ষই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষয়টাকে একই চোখে দেখে! বাংলা বইয়ের বাজার যে সীমিত এই খবরটা বিদেশি প্রকাশকরা জানেন, লেখকরাও জানেন। আর তাই তাদের অনুমতি না নিয়েই যে অনুবাদ বাজারে ছাড়া হচ্ছে এটা সরাসরি অনুমোদন না করলেও ঝামেলা সাধারণত করেন না। যেটা খেদের দিক সেটা হল, যদি কোনও প্রকাশক সৎভাবে যথোপযুক্ত অনুমতি নিয়ে রয়্যালটি দিয়ে বা লাইসেন্স ফী দিয়ে অনুবাদটি প্রকাশ করার প্রকল্প নেন, তখন বারবার সেই মর্মে আবেদন করেও মূলের প্রকাশকের ও লেখকের থেকে কোনওরকম সাড়া পাওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে, প্রতীক্ষা করতে হয় অনন্তকাল, তারপর হয়তো কোনও একসময় গড়িমসি করে তাঁরা সাড়া দেন, কাগজপত্রে সই-সাবুদ হয়, কিন্তু এর মধ্যে কেটে যায় দেড় কি দু’বছর ! প্রকৃত পরিস্থিতি হচ্ছে প্রকাশকরা স্থানীয় সীমিত সামর্থের লেখককেই যেখানে প্রাপ্য টাকা না দিয়ে পার পেয়ে যায়, সেখানে শত শত কোটি টাকার মালিক বিদেশি লেখককে রয়্যালটির টাকা দেবে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, এ প্রত্যাশাই করা যায় না। জাতিগত ভাবে আমাদের চরিত্রে বড় খামতি, ন্যায়ের কোনও আসন নেই, তাই উন্নতিও হয় না।
এহ্সান : লেখালেখির ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের কথা প্রায়ই শোনা যায়। আমাদের দেশে অনুবাদের তেমন পেশাদারিত্ব দেখছি না। অনুবাদের মানোন্নয়নের জন্য পেশাদারিত্বের ভূমিকা কী মনে করেন আপনি?
অভিজিৎ মুখার্জি : পেশাদারিত্বের প্রসঙ্গ তখনই ওঠে যখন একটা আইন মোতাবেক অর্থনৈতিক উদ্যোগের পরিবেশ তৈরি হয়। উঞ্ছবৃত্তিই যেখানে একেবারে স্বাভাবিক মূলস্রোত বলে গ্রাহ্য সেখানে পেশাদারিত্বের কথা আসে না। আমি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি, বাংলাদেশ সম্বন্ধে মন্তব্য করার মতো যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নই।
এহ্সান : নতুন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। আজকের দিনে অনেকের মধ্যে অনুবাদক হওয়ার চিন্তাও দেখা যায়। অনুবাদক তৈরির ক্ষেত্রে কোনো মাধ্যমটি আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? আদৌ কি তেমন কোনো মাধ্যম আছে?
অভিজিৎ মুখার্জি : মূল লেখককে রয়্যালটি দেওয়া হচ্ছে না, এই দিকটার থেকে যদি আপাতত একটু চোখ সরিয়ে রাখি তাহলে আমাদের চাহিদা হওয়া উচিত যত ব্যাপকভাবে সম্ভব অনুবাদ হওয়া। তথাকথিত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা নিজেদের মতো করে নানা ক্যালকুলেশন করে ঠিক করে কোন ধরণের লেখাকে কতটা যায়গা দেওয়া হবে। সেখানে যথেচ্ছ অনুবাদ ছাপানোর সুযোগ হওয়া মুশকিল। সেক্ষেত্রে রইল লিটল ম্যাগাজিন। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের রাজনীতিও বহুক্ষেত্রেই একপেশে, একধরণের গোঁয়ার-গোবিন্দ নির্বোধ নীতিতে পর্যবসিত হয়! তখন সাহিত্য-মূল্য বা অন্যান্য নিরিখের তুলনায় রাজনৈতিক মত প্রচারে তাৎক্ষণিক উপযোগিতাই অনুদিত হওয়ার জন্য অগ্রাধিকার পেতে থাকে। সেই প্রবণতা এড়াতে পারলে লিটল ম্যাগাজিন ভাল অনুবাদক তৈরি হওয়ার আতুড়ঘর হয়ে উঠতে পারে।
এহ্সান : অনুবাদের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকও দেয়া হচ্ছে। এটা আমাদের দেশে মানসম্মত অনুবাদের ক্ষেত্রে কি কোনো ভূমিকা রাখছে?
অভিজিৎ মুখার্জি : এই ব্যাপারে মন্তব্য করার মতো আমি অবহিত নই পরিস্থিতি সম্পর্কে। তবে পদক-টদকের ওপর খুব গুরুত্ব না দেওয়াই ভাল। আত্মসম্মানজ্ঞানহীন নিম্নরুচির লোকেরা মরিয়া হয়ে পদক জোটাতে উঠে পড়ে লাগে, খোসামুদির বান ডেকে যায়, খুব ছোট মাপের মানুষেরা সব নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে আর প্রকৃত যোগ্য লোক সাহিত্যের অঙ্গন এড়িয়ে চলে।
এহ্সান : এই মুহুর্তে দেশে যে অনুবাদ হচ্ছে, তার মান নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট?
অভিজিৎ মুখার্জি : না।
এহ্সান : আমাদের দেশে অনেক অনুবাদক আছেন। বাজারে তাদের অনেক বইও আছে। আপনি কাদেরকে আদর্শ অনুবাদক বলে মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : অব্যাহতি দিন। হয়তো আছেন, উচ্চমানের অনুবাদ করেছেন এরকম অনুবাদক, তাদের প্রতি অবিচার করা হয় নামোল্লেখ না করলে। তবে এই মুহূর্তে আমি নীরব।*
এহসান : আপনাকে ধন্যবাদ।
অভিজিৎ মুখার্জি : আপনাকেও ধন্যবাদ।
লেখক পরিচিত:
অভিজিৎমুখার্জি
কলকাতায় জাপানি ভাষা ও সাহিত্যের যুগপৎ চর্চার প্রসঙ্গ উঠলে যে-নামটা প্রথমেই আসবে সেটা অভিজিৎ মুখার্জি। একসময় জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর অধ্যাপক নিযুক্ত হয়ে আর তারপর কখনো বিশ্বব্যাঙ্কের কোনো প্রকল্পে, তাছাড়াও বার তিনেক প্রখ্যাত জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তি পেয়ে। অনুবাদ করেছেন হারুকি মুরাকামির নির্বাচিত গল্প সংকলন ‘এক ডজন মুরাকামি’। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন জাপানের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের নিয়ে অথবা জাপানি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত যাঁরা ইংরিজি সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত লেখক, তাঁদের সাহিত্যকৃতির বিশ্লেষণ নিয়ে ওঁর বহুপঠিত বই, ‘যে ভারতীয়রা ইংরিজিতে লিখছেন’।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান জাপানি ভাষার শিক্ষকতার সূত্রে স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ-এর প্রাক্তন জয়েন্ট ডিরেক্টর শ্রী মুখার্জির প্রিয় লেখক স্যর ভি.এস. নাইপল, গ্রাহাম গ্রীন, হারুকি মুরাকামি ও কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।
ব্যক্তিগত ও পেশাদারি নৈকট্য, আর সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তার উৎসাহ ও চর্চার খতিয়ান এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাঠাভ্যাসের সূত্রে পরিচয়ের বিস্তৃত হিসেবে তিনি জাপানি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদের নিবিষ্ঠ হয়েছেন। প্রয়োজনে হারুকি মুরাকামির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনও করেছেন। মুরাকামির গল্প-উপন্যাস অনুবাদে তার সুখ্যাতি। অপ্রিয় সত্য কথাকেও বলেন সোঝাসুঝি, কোনো প্রকার ভনিতা ব্যতিরেকে। তারা স্বাক্ষাৎকারেও তার শ্লেষ পাওয়া যাবে। স্বাক্ষাৎকার নিয়েছেন গল্পকার অলাত এহ্সান।
অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো একটা পরিণত কাজ। আপনার কাছে অনুবাদক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি কি রকম?
অভিজিৎ মুখার্জি : প্রাথমিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হচ্ছে নিজের গদ্যকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় করে তোলা। অনুবাদকের নিজের গদ্যভঙ্গি পরিণত মানের না হলে অনুবাদের প্রচেষ্টা শুধু বিফল হয় তা-ই নয়, অনুবাদ পড়ার প্রতি পাঠকের অনীহা তৈরি হয়। এবং ভবিষ্যতের অন্যান্য অনুবাদকের পরিশ্রমও পাঠকের অনীহার কারণে মর্যাদা পায়না, অবহেলিত থাকে। এর বিষময় এবং অনভিপ্রেত ফল আজকের পশ্চিম বাংলায় হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে বলেই আপাতত এটির ওপরেই সার্বিক গুরুত্ব আরোপ করতে চাইছি।
এছাড়াও পাঠের চৌহদ্দীকে যথাসম্ভব বিস্তৃত করার নানা সুফল অনুবাদের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয়, তাই সাহিত্য ছাড়াও সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি সমস্ত বিষয়েই নিয়মিত পড়াশুনার অভ্যাস তৈরি করে নেওয়া বেশ জরুরি বলেই মনে করি।
অলাত এহ্সান : অনুবাদ তো শুধু ভাষার পরিবর্তন নয়, ভাবের অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবের অনুবাদ তো একটা মৌলিক সমস্যা। আপনি এই সমস্যা দূর করতে কি করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : ভাব তো শুধু দর্শন নয়, ভাবের একটা সাংস্কৃতিক ভিত্তিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে। ভাব নিয়ে সমস্যা আদতে অসম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিচয়েরই ফল। আমি কিন্তু সাংস্কৃতিক বলতে তার মধ্যে রাজনৈতিক ও ইতিহাসগত দিককেও বোঝাচ্ছি। এই সমস্যা কতখানি অনুবাদককে মুশকিলে ফেলবে বা কী করে অনুবাদক সেই সমস্যা থেকে উত্তীর্ণ হবেন সেটা তাই অনুবাদকের অবগতির বিস্তারের ওপর নির্ভর করে। সমস্যা থেকে তাৎক্ষণিক উত্তরণের উপায় সেই কারণেই কম। পাঠাভ্যাস বাড়িয়ে যাওয়া আর বিদেশি ভাষার সেই সমাজ, সেখানকার ভূগোল ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ থাকলে সেই সুযোগ কাজে লাগানোই সবচেয়ে কার্যকরি উপায়। ভাবের সমস্যা মোচন তাই একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
এহ্সান : লেখার সঙ্গে, বিশেষত সাহিত্যের সঙ্গে দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি-মিথ ইত্যাদি গভীর ভাবে যুক্ত। সেক্ষেত্রে অনুবাদের জন্য লেখকের দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি। অনুবাদের দক্ষতা অর্জনের জন্য কোনো একটা দেশ বা মহাদেশ এবং ভাষাকেই বেছে নেয়া উত্তম। তাই না?
অভিজিৎ মুখার্জি : সে-কথাই আমি এর আগের প্রশ্নের উত্তরে বললাম। তবে মহাদেশ কিন্তু একটা বিরাট ব্যাপার! মহাদেশের একটি-কি-দুটি দেশ সম্বন্ধে জানলেই যে অন্যান্য দেশ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে রাখা যায়, তা তো নয়। এশিয়া মহাদেশের কথাই ভাবুন না কেন, মধ্যপ্রাচ্য সম্বন্ধে জানলে কি দূরপ্রাচ্য সম্বন্ধে ধারণায় তেমন আত্মবিশ্বাস আসা সম্ভব? ইয়োরোপের ফ্রান্স সম্বন্ধে জেনে কি তুরস্ক নিয়ে আলোচনায় তেমন সুবিধে হয়? অনেক সময় এমনকি দেশটি সম্বন্ধে জানলেও চলে না, বিশেষ জনগোষ্ঠি নিয়েও যথেষ্ট সময় ধরে চর্চা করে নিতে হয়। ভারতের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদের ক্ষেত্রেই তো সে-কথা খুবই খাটে।
এহ্সান : একজন লেখক তো লেখায় মেজাজ-মর্জি-ছন্দ-গতি দিয়ে লেখেন। অনুবাদেও সেই মেজাজ-ছন্দের জন্য সেই লেখকের ওপর প্রস্তুতি দরকার। এজন্য একজন লেখককে নির্বাচন করাই ঠিক, নয় কি?
অভিজিৎ মুখার্জি : সেটা অবশ্য অনুবাদকের এলেমের ওপর নির্ভর করে অনেকাংশে। প্রত্যেক লেখকের গদ্যভঙ্গির বিশেষত্ব আছে। সেই লেখকের লেখা অনুবাদ করতে গেলে রহস্যটির উদ্ঘাটন করতে হয়, কোথায় লুকিয়ে এই গদ্যভঙ্গির মহিমা। একাগ্র হয়ে নিবিড় চর্চায় অনেক সময়েই পাঠকের অজানিতে একসময় গদ্যভঙ্গির বিশেষত্বটি ধরা দেয়। সেইটেই চাবিকাঠি, লেখাটার একেবারে হৃদয়ে প্রবেশ করার। এবং তারপরেই একমাত্র সার্থক অর্থাৎ উপযুক্ত অর্থ সহকারে অনুবাদ সম্ভব। সেই দিক দিয়ে দেখলে সাধারণ অনুবাদকের ক্ষেত্রে হয়তো একজন লেখকেই নিবিষ্ট থাকা বিধেয়। কিন্তু ব্যতিক্রমী অনুবাদকও আছেন, যাঁরা নিজেরাই হয়তো জগৎবরেণ্য লেখক, বহুমাত্রিক গদ্য যাদের আয়ত্ত! তাঁরা যখন অনুবাদক, তখন একাধিক লেখকের লেখার সার্থক অনুবাদও অসম্ভব নয়। যেমন জাপানের হারুকি মুরাকামি, তাঁর নিজের লেখা কম বেশি পঞ্চাশটি ভাষায় অনুদিত হয়। কিন্তু জাপানের সাধারণ পাঠকের সাহিত্য-রুচি গড়ে দিতে তিনি বিপুল পরিমাণ অনুবাদও করেছেন, এবং একাধিক লেখকের। স্কট ফিটজেরাল্ড, ট্রুম্যান কাপোত, রেমন্ড কার্ভার ইত্যাদি মার্কিন লেখকের লেখা মুরাকামি জাপানিতে অনুবাদ করেছেন।
এহ্সান : একজন অনুবাদকের তৃপ্তি কোথায়, একটি অনুবাদ করায়, না একটি ভাষা-দেশ-সংস্কৃতি-লেখক সম্পর্কে গভীরভাবে জানায়?
অভিজিৎ মুখার্জি : সবার কথা বলতে পারি না, আমার নিজের ক্ষেত্রে যেটা খাটে সেটা হল, বিদেশি ভাষার একটা নির্দিষ্ট টেক্সটের প্রতি আমার যখন এতটাই পক্ষপাত জন্মায় যে আমি চাইলাম সকলেই কথাটা জানুক, এইভাবেই সেটা পেশ হোক, তখন আমি সেটা অনুবাদ করার ইচ্ছা পোষণ করতে থাকি, সুযোগ হলে করি। অর্থাৎ তাগিদটা এক অর্থে রাজনৈতিক, প্রোপাগ্যান্ডিস্টও বলা যায় ! এবার যদি দেখা যায় অনুবাদ পড়ে পাঠক মোটামুটি সেই অর্থেই টেক্সটটাকে অনুধাবন করছে যে অর্থে আমি করেছিলাম, এবং প্রভাবিত হচ্ছে, তবেই তৃপ্তি, তার আগে নয়।
এহ্সান : প্রায়ই শোনা যায়, অনুবাদ কোনো সাহিত্য নয়। অনুবাদের সাহিত্য হয়ে ওঠায় অন্তরায়টা কোথায়? অনুবাদ কি ভাবে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে?
অভিজিৎ মুখার্জি : প্রসঙ্গটা খানিকটা হলেও দর্শনের আওতায় পড়ে! যদি ধরে নিই যে, যেহেতু অনুবাদ হয়ে টেক্সটটা যা দাঁড়াবে সেটা নেহাতই অনুবাদকের ‘ফ্রী উইল’ সঞ্জাত নয় (মূল রচনার লেখককে অনুসরণ করতে হয়েছে) তাই ওটাকে মূল রচনার তুল্যমূল্য গুরুত্ব দেওয়া যাবে না, তাহলে কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে মূল রচনাটি লেখকের ফ্রী উইল কিংবা মুক্ত সৃষ্টিশীলতার ফসল। ঠিক কিনা? কিন্তু কালচারাল স্টাডিজ বলে আধুনিক শাস্ত্রটির চর্চা যাঁরা করেন তাঁরা কি রাজি হবেন এটা মেনে নিতে যে ইতিহাসে লেখকের সময়, সমাজ, সমাজে লেখকের স্থান, লেখকের পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিস্থিতি, এগুলো মোটেই তাঁর রচনার বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গি, চরিত্রসৃষ্টি ও অন্যান্য উপকরণকে নির্দিষ্ট করে দেয় না? তাহলে মুক্ত সৃষ্টিশীলতার গৌরবই বা মূল রচনার লেখককে অর্পণ করি কী করে?
আমার কথা হল, যদি অনুবাদ না হলে সাহিত্যটাই নাগালের বাইরে চলে যায় তাহলে অনুবাদককে খাটো করে আর মূল রচনাকারকে তুলনায় বড় বলে আমার প্রাপ্তিটুকু কী? শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে কিন্তু তবু স্বীকার করা ভাল, সাহিত্যসৃষ্টির মানের দিক থেকেও শিল্পোন্নত দেশগুলো যে এগিয়ে। তার একটা প্রধান কারণ হল আন্তর্জাতিক সাহিত্য, অনুবাদে হলেও, পাঠের সুযোগ সেখানকার মানুষজনের কাছে অনেক বেশি। অনুবাদ জিনিসটাকে উপযুক্ত সম্মান আর গুরুত্ব সেসব দেশে উন্নত সাহিত্যসৃষ্টির খাতিরেই দেওয়া হয়। সাহিত্যসৃষ্টি আর যথাযোগ্য অনুবাদ, এরা অবিচ্ছেদ্য এক ভূমিকা পালন করছে ওইসব দেশে। গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক প্রতিবেদন ঝুম্পা লাহিড়িকে উদ্ধৃত করে জানালো, Lahiri believes that "translation is the key" – that it is what has created "the bridge for so many of us to be able to read across our limitation"
আর অনুবাদের জগতে কি প্রতিযোগিতার অভাব নাকি? বিশ্বের সাহিত্য ও সাহিত্যের বাজার নিয়ে অর্থনীতির খবরটা আমাদের মতো উন্নতিশীল দেশের অধিকাংশ সাহিত্যপ্রেমীই রাখেন না, তাই অনুবাদকে কিছুটা হলেও হেলাফেলার প্রবণতা দেখা যায়!
এহ্সান : অনেক সময় দেখা যায়, কোনো লেখক বা দেশের কিছু গল্প অনুবাদ করেই তাকে ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ বলে দিচ্ছে। বইয়ের ভূমিকায়ও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু থাকে না যে, এগুলো কেন শ্রেষ্ঠ গল্প। কিভাবে বাছাই করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে পাঠকরা কি প্রতারিত হচ্ছেন না?
অভিজিৎ মুখার্জি : হ্যাঁ, হচ্ছেন বই কি। তবে পাঠকদেরই এই ধরণের সংকলনকে অগ্রাহ্য করার দায়িত্ব নিতে হবে। যদি দেখেন যে সংকলনটা মূলে মোটেই ‘শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলন’ এই টাইটেলে ছিল না (থাকলে সেই বইয়ের প্রকাশনার খুঁটিনাটি অনুদিত সংকলনেও উল্লেখ করার কথা), তবে ওটাকে একটা অনৈতিক ও অবাঞ্ছিত উদ্যোগ বলেই গণ্য করতে হবে—সেটাও পাঠকেরই দায়িত্ব।
এহ্সান : আমাদের দেশে সাধারণত যে অনুবাদগুলো হয় সেগুলো মূলভাষা থেকে নয়, দ্বিতীয় কোনো ভাষা, বিশেষত ইংরেজি থেকে। তাহলে আমরা ‘সূর্যের রশ্মি থেকে তাপ না নিয়ে বালি থেকে তাপ নিচ্ছি’ বলে মনে হয় না?
অভিজিৎ মুখার্জি : আমি যেসব গল্প বা প্রবন্ধ মূল জাপানি থেকে সরাসরি অনুবাদ করেছি। সেগুলোর অনেকগুলোরই ইংরিজি অনুবাদেও খানিক খানিক চোখ বুলিয়েছি। ইংরিজিতে কিন্তু বহুক্ষেত্রেই মারাত্মক স্বাধীনতা নেওয়া হয়, ক্ষেত্র বিশেষে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার মতোই ঝুঁকি নেওয়া হয়েছে বলে দেখেছি! তাই সরাসরি মূল ভাষা থেকে অনুবাদই শ্রেয়, তবে সেই সুযোগ না থাকলে কী আর করা, তখন অগত্যা ইংরিজি থেকেই...
এহ্সান : অধিকাংশ অনুবাদই বিশ্বের জনপ্রিয় বা বহুল আলোচিত, মানে ‘বেস্ট সেলার’ বইগুলো হয়ে থাকে। এই অনুবাদ দ্বারা একটি দেশের সাহিত্য কতটুকু উপকৃত হতে পারে?
অভিজিৎ মুখার্জি : যথেষ্টই উপকৃত হতে পারে। বেস্ট সেলার মানে কিন্তু যাঁরা বই কেনেন, বিশ্বজুড়ে তাঁদের কাছে সমাদর পেয়েছে যে বইগুলো। নিয়মিত বই যাঁরা কেনেন তাঁরা খুব রুচিহীন, বুদ্ধিহীন হওয়ার কথা নয়, আর বেস্ট সেলারও তাই একেবারে অকিঞ্চিতকর বইয়ের পক্ষে হয়ে ওঠা কঠিন। বিশ্ব জুড়ে বেশির ভাগ লোক যা পড়ছে তা আমার দেশের মানুষও পড়তে চাইলে দোষের তো কিছু নেই। অনুবাদেরও একটা অর্থনীতি আছে, বেস্ট সেলার হওয়ার সুবাদে যে বইটির বাজার তৈরি হয়েই আছে; সেটির অনুবাদ প্রকাশ করলে প্রকাশকের আর্থিক ঝুঁকি কম। ফলত বেস্ট সেলারের অনুবাদ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি হবেই। এইমুহূর্তে যেসব লেখকদের বই বেশি বিক্রি হয়, যেমন—গার্সিয়া মার্কেজ, নাইপল, কুন্দেরা, উমবের্তো একো, মুরাকামি, মার্গারেট অ্যাটউড, ফিলিপ রথ, রুশদি, ইশিগুরো, পামুক ইত্যাদি, এঁদের বই পড়ার ভালো বই কোনও খারাপ দিক তো নেই। বেস্ট সেলার হওয়ার সূত্রে লোকে বেশি করে এঁদের বই পড়লে ক্ষতি নেই বলেই আমার মনে হয়।
এহ্সান : বিশ্বের অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ আছে যে গুলো ভাল, কিন্তু বহুল আলোচিত নয়। যেখানে প্রকাশকরাও বিনিয়োগ করতে চায় না। সেক্ষেত্রে মানসম্মত সাহিত্য অনুবাদ কি করে পেতে পারি?
অভিজিৎ মুখার্জি : অনেক ভেবে দেখলাম, এর কোনও মোক্ষম ব্যবস্থা করে ওঠা মুশকিল। বাজার নিয়ে হোক বা রাজনৈতিক প্রাধান্যের প্রশ্নে হোক, বইয়ে বইয়ে প্রতিযোগিতা থাকবেই, একটাকে তুলে ধরে অন্যটাকে আড়াল করার চেষ্টা থাকবেই, আর সেহেতু ভালো বই উপযুক্ত আলোচনা পেলো না এরকম ক্ষোভের পূর্ণ প্রশমন অসম্ভব। আন্তর্জাতিক স্তরে সমমনস্ক পড়ুয়া লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চললে (সোশাল নেটওয়র্কিং সাইট-এর মাধ্যমেই হোক না কেন) বহু ভাল বইয়ের খবর সেই সূত্রে পাওয়া যায়, পত্রপত্রিকায় আলোচনা ব্যতিরেকেই। তবে অনুবাদ হওয়ার জন্য বাজারের দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর নইলে রাজনৈতিক প্রচারধর্মী মেটিরিয়াল হিসেবে সেই বইয়ের তাৎপর্য। আমার নিজের অবশ্য সমস্যা হল যত ভাল বইয়ের খবর আসে তার অধিকাংশই পড়ে ওঠার সময় করতে পারি না, অপঠিত রয়ে যায়।
এহ্সান : একটি দেশ উপনিবেশ মুক্ত হওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বিশ্বের সেরা সাহিত্য, জ্ঞানগর্ভ-মননশীল-চিন্তাশীল বইগুলো ব্যাপক ভাবে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই, দেশি ভাষায় অনুবাদ করা। আমাদের দেশে তা হয়নি। এটা কি আমাদের দেশের সাহিত্যের অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলেছে মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : শিল্প বা সাহিত্যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের কথা চিন্তায়ও আনবেন না, উচ্চারণেও আনবেন না। শিল্প ও সাহিত্যকে আমাদের মতো হাভাতেদের দেশে একেবারে সমূলে বিনষ্টিকরণের শ্রেষ্ঠ উপায় হল জিনিসগুলোকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের আওতায় আনা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি : আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বই বিক্রির হিসেব নিয়ে নানা আস্ফালন বইমেলা ইত্যাদির পরেপরেই শোনা যায় বটে, আদতে বই মোটেই বিক্রি হয় না। প্রকাশকদের ব্যবসায়ে টিকে থাকার খাতিরে যা যা করতে হয় তা ফাঁস হলে যে পরিবারে কখনও কেউ প্রকাশক ছিল সেই পরিবারে কেউ আর মেয়ের বিয়ে দেবেন না! তখন একমাত্র উপায় হচ্ছে সরকারি সিলেকশন প্যানেলকে খুশি করে কিংবা সরকারে আসীন দলের দাদা ধরে একেকটি বইয়ের বেশ কিছু কপি সরকারি রামমোহন ফাউন্ডেশনের কাছে অথবা অন্য লাইব্রেরি-চেইনে (সরকারি অনুদান গ্রাহক) গছিয়ে দেওয়া। এটি জনগণকে পুস্তক পাঠে সহায়তা করার অছিলায় ট্যাক্সপেয়ারের পয়সায় যত রাজ্যের হাবিজাবি বই কিনে প্রকাশকদের উদ্ধার করে। একদিকে বইয়ের বিক্রি নেই এবং সেইসূত্রে পাঠকের বিচারের তোয়াক্কা করে লাভ নেই; অপরদিকে সরকার সংগ্রহ না করলে ধনে-প্রাণে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা—প্রকাশকরা হন্যে হয়ে ছুটছে সরকারের নেকনজরে থাকা করিৎকর্মা লেখকদের পেছনে। সহজেই আন্দাজ করতে পারছেন তারা কেমন কিসিমের লেখক! জগতের কোনও খবরই তাদের কাছে নেই, মুখ্যত সমাজের সবচেয়ে সম্ভাবনাহীন অংশ নতুবা নিষ্কর্মা সরকারি অফিসারবর্গ। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (সেকালে এরচেয়ে উঁচুপদে কোনও দেশিয় উঠতে পারতো না), ঠাকুরবাড়িতে রোজ এসে খানাপিনা করতো সারা বিশ্বের নানা কোণ থেকে আসা সাহেবসুবোরা। এদের দিয়ে বাংলার আধুনিক সাহিত্যের শুরু আর এখন... থাক, সেসব কথা! বেকার যুবকদের অনেকেরই দিন গুজরান হয় টিউশনি করে, আমাদের সাহিত্যিকদের কাছে কেউ ভরসা করে টিউশন নিতেও পাঠাবে না বাচ্চাদের, এমনই তাদের এলেম! এইসব সরকারের ধামাধরা, সরকারি দলের নির্দেশে চলা লেখকদের ভাবমূর্তি ও মুরোদ বোঝা গিয়েছে, তাই এখন এ-বাংলায় বুদ্ধিজীবী বলতে বোঝায় মঞ্চাভিনেতা, সিনেমাভিনেতা, গায়ক ইত্যাদি, কিন্তু সাহিত্যিকরা বাদ! লোকের বই পড়ার ইচ্ছে থাকলে, যেমন রেস্তোরাঁয় গিয়ে, পোষাক কিংবা শাড়ি কিনে, নিত্য নানা ইলেকট্রনিক গ্যাজেট কিনে, বেড়িয়ে টেড়িয়ে পয়সা খরচ করে তেমনই পয়সা ব্যয় করে বই কিনুক। যদি কোনও সমাজে সে-রকম লোকের সংখ্যা বা সাধ্য এতই কমে যায় যে, ওতে বইয়ের ব্যবসার প্রসার ঘটে না। তবে ক’দিন অপেক্ষা করাই শ্রেয়। তাতে আর যা-ই হোক সাহিত্য ধ্বংস হবে না, সীমাবদ্ধ থাকবে। এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, অর্থনীতির সঙ্গে অন্যান্য উন্নতির যোগ খুব ঘনিষ্ট। কিন্তু একবার রাষ্ট্র এসেছে কি সাহিত্য শেষ, যেমন পশ্চিম বাংলায়। বাংলা সাহিত্য এবং তারচেয়ে বেশি করে সাহিত্যিকেরা, এখানে হাসাহাসির জিনিস! খবরদার ওপথে যাবেন না!
এহ্সান : টেকনিক্যাল শব্দগুলো ছাড়াও অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদে সংকট হলো যথাযথ পরিভাষার অভাব। আমাদের দেশে পরিভাষা তৈরির তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের কি করনীয়?
অভিজিৎ মুখার্জি : আমি সংস্কৃত জানি না, কিন্তু যাঁদের পণ্ডিত বলে মানি তাঁদের মুখে শুনে এরকম ধারণা হয়েছে যে নব্যন্যায়কে অনুসরণ করলে পরিভাষা তৈরির কাজটা বিনা ঝঞ্ঝাটে অল্প সময়ে সারা যায়। কিন্তু সেটাও তো দু-একজন লোকের কাজ নয়। সমাজের মানী লোকেদের আহ্বানে যদি সাধারণ মানুষ অর্থসাহায্য করে, ক’য়েকজন দায়িত্বশীল মানুষ যদি দু-এক বছরের জন্য হিসেব নিকেশ ও ব্যবস্থাপনার অন্যান্য দায়িত্ব নিতে রাজি হন, তবে ট্রাস্ট গঠন করে কাজটা করে ফেলা যায়। কিন্তু প্রশ্নটা আসলে জাতীয় চরিত্রের। পরিস্থিতি যে কী সে তো আমিও জানি আপনিও জানেন!
এহ্সান : অনেকেই মনে করেন অনুবাদের মান রক্ষার জন্য দেশে রেগুলেটরি বডি স্থাপন করা দরকার। আপনার কি মনে হয়? আমরা কিভাবে মানসম্মত অনুবাদ পেতে পারি?
অভিজিৎ মুখার্জি : এখন ও নিয়ে ভাবার সময় আসেনি। আপাতদৃষ্টিতে মান বজায় রাখার কাজটা কোনও সংস্থার হলেও প্রকৃতপক্ষে পাঠকের শিক্ষার মানের ওপর নির্ভর করে বাঞ্ছিত মান নির্ধারিত হওয়াটা। বিতর্ক উঠবে প্রতিটি পদে, তখন নিরসন করবে কে? কার কথা সর্বজনগ্রাহ্য হবে? সে-ই বা এ-কাজে সময় দেবে কেন মান যাচাইয়ের নিয়ম বারবার লঙ্ঘিত হলে? আর, যেখানে নিয়ম লঙ্ঘনের উপায় নেই অচিরেই সেই সংস্থাকে অকেজো করে দেওয়া হবে। মোটের ওপর পাঠক অবোধ শিশু হয়ে থাকলে কিছুই হবে না, তার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। দেশের শিক্ষার প্রসার আর শিক্ষার মান এটাই অনুবাদের মানকেও সরাসরি প্রভাবিত করে, এবং সেটা পাঠকের দিক দিয়ে।
এহ্সান : অনেকেই পাঠের জন্য মূলগ্রন্থ পাঠকেই গুরুত্ব দেন। লেখক প্রস্তুতি হিসেবে অনুবাদ সাহিত্য পাঠকে আপনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : অনুবাদ সাহিত্য না পড়ে সাহিত্যপাঠ হবে কী করে? বোর্হেস না পড়ে, তলস্তোয়, দস্তয়েভস্কি না পড়ে, থমাস মান না পড়ে, কাওয়াবাতা না পড়ে সাহিত্যপাঠের ন্যূনতম প্রচেষ্টাটুকুও তো করা হয় না! অথচ এগুলো অনুবাদ ছাড়া পড়ার উপায় কী?
এহ্সান : প্রতিবছরই দেশে প্রচুর অনুবাদ হয়। তার সবই জনপ্রিয় ও বহুলালোচিত গ্রন্থ। অপরিচিত কিন্তু শক্তিশালী লেখক বা বই, অনুবাদকের তেমন কোনো আবিষ্কার নেই। এটা কি অনুবাদকের দুর্বলতা, না অন্যকিছু?
অভিজিৎ মুখার্জি : অনুবাদক এ ব্যাপারে বেশি সবলতা দেখালে প্রকাশকের সহায়তা পাবেন তো? সীমাবদ্ধতাটা মূলত সেখানেই। বইয়ের বাজার যদি খুব স্ফীতিশীল হতে থাকে তবেই প্রকাশক উদারতার ঝুঁকি নেবেন, তখন অল্প-পরিচিত লেখকের অখ্যাত বইয়ের অনুবাদের পরিস্থিতি তৈরি হবে। বইয়ের জগতের যথেষ্ট খোঁজ রাখেন এরকম লোককে দিয়ে অনুবাদ করাতে গেলে অনুবাদকের প্রাপ্তির দিকটিও তো দেখতে হবে। শুধু সদিচ্ছা দিয়ে বেশিদিন কিছুই টানা যায় না।
এহ্সান : রবার্ট ফ্রস্ট, টি এস এলিয়ট, শার্ল বোদলেয়ার, শাহানামা অনেক অনুবাদ করেছেন; কিন্তু শামসুর রাহমান, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কেউ করতে পারেননি মনে করা হয়। কবিতার অনুবাদ কবি, গল্পের অনুবাদ একজন গল্পকার করলে সেরাটা পাওয়া সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। আপনি কি মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে মূলের থেকে অনেক বিচ্যুতি নির্দেশ করে অনেকে দেখিয়েছেন, কিন্তু তাতে ওঁর অনুবাদের জনপ্রিয়তা কমেনি। কারণ খুব সরল, লেখার প্রসাদগুণ। শামসুর রহমান, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এদের নিজস্ব রুচি ও রচনাভঙ্গি এতই পরিণত যে, এঁরা কখনও একটা কাঁচা টেক্সট, পাঠককে অত্যাচার করতে, প্রকাশকের হাতে ছাপাবার জন্য তুলে দেবেন না। এটা তো একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক! গল্পকার হওয়ার দরকার নেই, দক্ষ গদ্যলেখক হলেই হবে। কবিতার ক্ষেত্রে অবশ্য অনুবাদক কবি হলেই ভাল হয়, তবে অপ্রধান কবি হলেও ক্ষতি নেই। ক্লিনটন সীলির ইংরিজি অনুবাদ পড়েছেন তো জীবনানন্দ দাসের কবিতার? এককথায় অনবদ্য!
এহ্সান : অনুবাদ তো দুইভাবেই হতে পারে। বিদেশি সাহিত্য দেশি ভাষায়, দেশি সাহিত্য বিদেশি ভাষায়। আমরা কিন্তু তা দেখছি না। এর কারণ কি? এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী বলে মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : অর্থনৈতিক সুযোগ একটা পর্যায়ে না পৌঁছলে বিদেশি ভাষা নিষ্ঠা নিয়ে শেখার চল কমে যায় সমাজে। উদ্বৃত্ত অর্থ না থাকলে শিক্ষিত লোকেরা সেই অবসরটুকু পান না, যার প্রসাদে খেয়াল খুশি মতো দীর্ঘদিনের অধ্যয়নে বিদেশি ভাষা উপযুক্ত রকম শিখে নিয়ে দেশি টেক্সট বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করতে প্রয়াস পান। রবীন্দ্রনাথের প্রজন্মে ঠাকুরবাড়ির লোকেরা এরকম বহু অনুবাদ করেছিলেন। দারাশুকোর উপনিষদ অনুবাদ তো একটা মাইলস্টোন অবদান হয়ে আছে! সুফি আন্দোলনে ওঁর এই অনুবাদের অবদান ইতিহাসকেই পালটে দিয়েছে, Richard Eaton-এর Rise of Islam and the Bengal Frontiers বইতে পড়েছি। একটা ইংরিজি কথা আছে না, “It is the economy stupid !” সেদিকটা অতিক্রম করে কিছু করে ওঠা মুশকিল।
এহ্সান : এবারের বই মেলায় আপনার কি কি অনুবাদগ্রন্থ বের হচ্ছে, সে সম্পর্কে বলুন।
অভিজিৎ মুখার্জি : এই বইমেলায় নতুন কোনও অনুবাদের বই বেরুচ্ছে না। আমি মুরাকামির ‘উমিবে নো কাফকা’, অর্থাৎ ‘সমুদ্রতীরে কাফকা’ নামের উপন্যাসটা অনুবাদে হাত দিয়েছি, সেই কাজ চলছে এবং অন্তত আরো এক কী দেড় বছর লাগবে। প্রত্যেক বইমেলায় একটা করে বই বেরুনো জিনিসটাকে আমি একদমই ভাল চোখে দেখি না। কত অসাধারণ সব বই রয়ে গিয়েছে পড়ার জন্য, লোকে সেগুলো আগে পড়ে নিক, একান্ত পড়া দরকার যেগুলো। তার বদলে তড়িঘড়ি করে ডজন ডজন মধ্যমানের বই বের করে জঞ্জাল বাড়ানো কেন?
এহ্সান : অনুবাদের জন্য লেখকের এই উপন্যাসকে বেছে নেয়ার কারণ কি?
অভিজিৎ মুখার্জি : সে অনেক কথা! বাংলার লেখককুলের কথা ছেড়েই দিন, পাঠককুলেরও যেন নজর আর আজকাল তেমন ওপরের দিকে ওঠে না। চাহিদা না থাকলে লেখার মান উন্নত হওয়ার তো কথা নয়। কী বিষয়বস্তুতে, কী ফর্মে, জগৎজুড়ে নতুন চিন্তার যেসব ঢেউ, তা আর বাংলা সাহিত্যের আঙিনা অবধি এসে পৌঁছয় না। সম্প্রতিকালে যে বইটি দর্শনে, বিষয়ে, ন্যারেটিভ ফর্মে, চরিত্র সৃষ্টিতে, স্টাইলে একেবারে মাইলস্টোন উপন্যাস হয়ে থাকার সমস্ত শর্ত পূরণ করেছে বলে আমি মনে করি সেটি কিন্তু এই ‘উমিবে নো কাফকা’। বাংলার পাঠক, সাহিত্যমোদী এই বই পড়ার সুযোগ পেলে বুঝবে বিশ্বসাহিত্য কোথায় চলে গেছে, উত্তেজিত হবে, আপ্লুত হবে—এই প্রত্যাশা নিয়েই আমি এই বইটাকেই বেছে নিয়েছি। মানবসভ্যতা বলে যদি কোনও একটি ধারাকে নির্দেশ করা যায়, তার কাছে ঠিক এইসময়ের উপযোগী এক অতি জরুরি দর্শনকে অভিনব আঙ্গিকে পেশ করছে এই উপন্যাস।
এহ্সান : মুরাকামির ছোটগল্প অনুবাদ করে আপনি তার একটি সংকলন করেছেন। এখানে অনেক গল্প তো আগেও অনুবাদ হয়েছে। আপনিও করলেন। ব্যাপারটা মনোটোনাস হয়ে গেল না? কিংবা আপনার বিশেষত্ব কোথায়?
অভিজিৎ মুখার্জি : এক মহিলা আমার কোনও এক পরিচিতজনের রেফারেন্সে একবার আমাকে ফোন করে করে বেশ কিছু জাপানি নামের প্রকৃত উচ্চারণ কী হবে জেনে নেন। জাপানের সংস্কৃতি সংক্রান্ত অন্যান্য কিছু প্রশ্নও তাঁর ছিল। পরে একজন আমাকে জানাল যে উনি নাকি মুরাকামির কয়েকটা গল্প অনুবাদ করে বই বের করেছেন। অনুবাদ, প্রত্যাশিত ভাবেই, ইংরিজি থেকে হয়েছে। ভূমিকায় উনি লিখে দিয়েছেন যে উচ্চারণ ইত্যাদি ব্যাপারে উনি একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়েছেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞের নাম উল্লেখ করেননি। করেননি যেহেতু, বইয়ের কোনও কপি সেই বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি। আমি তাহলে জানবো কী করে—কোন কোন গল্প অনুবাদ হয়েছে? আমি সত্যি বলতে কী, ইংরিজি থেকে অনুবাদের ব্যাপারে তেমন কৌতূহলিও নই।
জাপানি কোনও গল্প বা উপন্যাস বাংলায় আমি অনুবাদ করলে আর অন্য অনুবাদ পড়ার তেমন প্রয়োজন নেই! হাঃ হাঃ, রসিকতা করলাম। তবে বিনয় করতে হলে কী লিখতে হত তা আপনারাই বরং অনুমান করে নিন। আমার কোনও বিশেষত্ব থাকলে তা আছে জাপানি ভাষায় ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার অভিজ্ঞতা, বহুবার সেদেশে গিয়ে সেই সমাজের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ও পেশাদারি নৈকট্য, একাধিকবার জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে সে দেশের ভাষার শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ, দেশে ধারাবাহিকভাবে দোভাষী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আর সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় আমার উৎসাহ ও চর্চার খতিয়ান, বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাঠাভ্যাসের সূত্রে পরিচয়ের বিস্তৃতি, এইসবের মধ্যে। এর বেশি কিছু নিজের সম্বন্ধে বলাটা শোভন নয়। তবে অনুবাদক হিসেবে আমি যে বিবেচনাটাকে সবচেয়ে অগ্রাহিকার দিই সেটা হল, অনুদিত অবস্থায় এটি পড়তে পাঠকের ভাল লাগবে কিনা, আর, লেখক মূলত যে কথাটা বলতে চাইছেন, অনুবাদ হয়ে সেটাতে কোনও বিকৃতি যাতে না আসে।
এহ্সান : অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেকে ভাষা, অনেকে ভাব, অনেকে মূলবক্তব্য অনুসরণ করেন। এতে কি একটি সাহিত্যের প্রকৃতাবস্থার হেরফের ঘটে যায় না?
অভিজিৎ মুখার্জি : হ্যাঁ ঘটে। কিন্তু এ সমস্যা এতই জটিল যে প্রতিকারহীন। আসলে ট্রান্সলেশনের ধারণাটাই তো ভ্রান্ত, সবক্ষেত্রেই পুনর্লিখন করতে হয়, এমনকি দলিল দস্তাবেজের ক্ষেত্রেও।
এহ্সান : অনেকে মূল বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে মানে আক্ষরিক বা মূলানুগ অনুবাদ, কেউ ভাবগত বা মূলবক্তব্যের দিক খেয়াল রেখে অনুবাদ করেন। কোন ধরনের অনুবাদে প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে বলে আপনি মনে করেন? কেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : সৌন্দর্য তো আপনা আপনি ফোটেনা, ওটা অনুবাদকের নিজস্ব মুনশিয়ানা। অনুবাদক যথেষ্ট স্বাধীনতা নিলে হয়তো সৌন্দর্য ফোটাতে তাঁর সুবিধেই হয়, কিন্তু সেটা কি সমীচীন? তবে দু’টো ভাষার ও সংস্কৃতির মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এতরকম ভিন্নতা থাকে যে খুব বেশি আক্ষরিক অনুবাদ করলে সেটা অস্বস্তিকর হওয়ার উদাহরণই বেশি।
এহ্সান : অন্যান্য অনুবাদক থেকে নিজেকে কিভাবে আলাদা করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : অন্য অনুবাদকদের নিয়ে কখনোই খুব বেশি ভাবিনি।
এহ্সান : অনুবাদকের স্বাধীনতা, শব্দ তৈরি ইত্যাদি দিক অনেকে সামনে আনেন। এটাকে আপনি কি ভাবে দেখেন? তা ছাড়া অনুবাদকের আদৌ কোনো স্বাধীনতা আছে কি?
অভিজিৎ মুখার্জি : অনুবাদক যথেষ্ট সংবেদনশীল ও অভিজ্ঞ হলে তাঁকে যথেচ্ছ স্বাধীনতা দেওয়াই উচিত বলে মনে করি। আমি তো প্রয়োজনে সেই স্বাধীনতা নিই। হাঃ হাঃ! তবে পরিস্থিতি বর্ণনায় একান্তই প্রয়োজন হলে তবেই।
এহ্সান : অনুবাদ আমাদের সাহিত্যে কী অবদান রাখছে?
অভিজিৎ মুখার্জি : আমাদের সাহিত্যে দুর্ভাগ্যবশত তেমন চোখে পড়ার মতো অবদান রাখতে পারছে না। কারণ আমাদের সাহিত্যের জগতে অনুবাদ যেমন অবহেলিত—তেমনই অবহেলিত সাহিত্য বিচার, সাহিত্য নিয়ে ক্রিটিকাল আলোচনা। এর ফল হচ্ছে যে অমিতাভ ঘোষ কেন সুনীল গাঙ্গুলির চেয়ে অনেক অনেক বড় লেখক—সেটুকুও অধিকাংশ পাঠক অনুধাবন করে উঠতে পারেন না। অনুবাদের থেকে সুফল নিতে গেলে তো অনুদিত সাহিত্যকৃতিটির বিশেষত্ব কী সেটা অনুধাবন করতে হবে। সেই আলোচনাও যে তেমন হয় না, অনুবাদের ওপরেও যে তেমন জোর নেই, এসবই কিন্তু স্থানীয় লেখালেখির বাজারটা ধরে রাখতে মাতব্বরদের কায়েমি স্বার্থ। সাহিত্যটা প্যাশন হয়ে ওঠার বদলে হাভাতেদের করে খাওয়ার যায়গা হয়ে গেলে এরকমটাই হয়। বুর্জোয়া ডেভেলপমেন্ট বলে যে কথাটা আছে, সেটির অভাব সাহিত্যের সর্বস্তরে লক্ষ্য করা যায়। আমার খুব প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম—দস্তয়েভস্কিই যে ওঁর কাছে অন্যদের থেকেও একটু বিশেষ স্থান পাওয়া লেখক। ওঁর লেখনশৈলিতে মোটেই দস্তয়েভস্কি তেমন প্রত্যক্ষভাবে ফুটে ওঠেন না, কিন্তু কিছু কিছু ইস্যু যেভাবে ঐ রুশ স্রষ্টা তাঁর লেখায় এনেছেন, নিজের চিন্তাকে যেভাবে অভিব্যক্তি দিয়েছেন, তার থেকে গভীর অভিনিবেশে নিজের মতো করে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিছু আহরণ করেছেন নিশ্চয়। অনুবাদ যতদিন না যথেষ্ট অবদান রাখতে পারার মতো পরিস্থিতি পাচ্ছে, স্থানীয় সাহিত্যের মান ততদিনই অকিঞ্চিতকর হয়েই থাকবে।
এহ্সান : অন্য একটি ভাষায় লেখা অনুবাদ হচ্ছে। অথচ লেখক জানছেন না, রয়েলটি পাচ্ছেন না। মূলানুগ অনুবাদের জন্যও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে না। বিষয়টা কিভাবে দেখেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : সৌভাগ্যের বিষয় হল, অনুবাদ যাঁরা করাচ্ছেন আর মূল রচনাটি যাদের প্রকাশনার এবং মূল রচনার লেখক, এই তিন পক্ষই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষয়টাকে একই চোখে দেখে! বাংলা বইয়ের বাজার যে সীমিত এই খবরটা বিদেশি প্রকাশকরা জানেন, লেখকরাও জানেন। আর তাই তাদের অনুমতি না নিয়েই যে অনুবাদ বাজারে ছাড়া হচ্ছে এটা সরাসরি অনুমোদন না করলেও ঝামেলা সাধারণত করেন না। যেটা খেদের দিক সেটা হল, যদি কোনও প্রকাশক সৎভাবে যথোপযুক্ত অনুমতি নিয়ে রয়্যালটি দিয়ে বা লাইসেন্স ফী দিয়ে অনুবাদটি প্রকাশ করার প্রকল্প নেন, তখন বারবার সেই মর্মে আবেদন করেও মূলের প্রকাশকের ও লেখকের থেকে কোনওরকম সাড়া পাওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে, প্রতীক্ষা করতে হয় অনন্তকাল, তারপর হয়তো কোনও একসময় গড়িমসি করে তাঁরা সাড়া দেন, কাগজপত্রে সই-সাবুদ হয়, কিন্তু এর মধ্যে কেটে যায় দেড় কি দু’বছর ! প্রকৃত পরিস্থিতি হচ্ছে প্রকাশকরা স্থানীয় সীমিত সামর্থের লেখককেই যেখানে প্রাপ্য টাকা না দিয়ে পার পেয়ে যায়, সেখানে শত শত কোটি টাকার মালিক বিদেশি লেখককে রয়্যালটির টাকা দেবে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, এ প্রত্যাশাই করা যায় না। জাতিগত ভাবে আমাদের চরিত্রে বড় খামতি, ন্যায়ের কোনও আসন নেই, তাই উন্নতিও হয় না।
এহ্সান : লেখালেখির ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের কথা প্রায়ই শোনা যায়। আমাদের দেশে অনুবাদের তেমন পেশাদারিত্ব দেখছি না। অনুবাদের মানোন্নয়নের জন্য পেশাদারিত্বের ভূমিকা কী মনে করেন আপনি?
অভিজিৎ মুখার্জি : পেশাদারিত্বের প্রসঙ্গ তখনই ওঠে যখন একটা আইন মোতাবেক অর্থনৈতিক উদ্যোগের পরিবেশ তৈরি হয়। উঞ্ছবৃত্তিই যেখানে একেবারে স্বাভাবিক মূলস্রোত বলে গ্রাহ্য সেখানে পেশাদারিত্বের কথা আসে না। আমি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি, বাংলাদেশ সম্বন্ধে মন্তব্য করার মতো যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নই।
এহ্সান : নতুন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। আজকের দিনে অনেকের মধ্যে অনুবাদক হওয়ার চিন্তাও দেখা যায়। অনুবাদক তৈরির ক্ষেত্রে কোনো মাধ্যমটি আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? আদৌ কি তেমন কোনো মাধ্যম আছে?
অভিজিৎ মুখার্জি : মূল লেখককে রয়্যালটি দেওয়া হচ্ছে না, এই দিকটার থেকে যদি আপাতত একটু চোখ সরিয়ে রাখি তাহলে আমাদের চাহিদা হওয়া উচিত যত ব্যাপকভাবে সম্ভব অনুবাদ হওয়া। তথাকথিত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা নিজেদের মতো করে নানা ক্যালকুলেশন করে ঠিক করে কোন ধরণের লেখাকে কতটা যায়গা দেওয়া হবে। সেখানে যথেচ্ছ অনুবাদ ছাপানোর সুযোগ হওয়া মুশকিল। সেক্ষেত্রে রইল লিটল ম্যাগাজিন। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের রাজনীতিও বহুক্ষেত্রেই একপেশে, একধরণের গোঁয়ার-গোবিন্দ নির্বোধ নীতিতে পর্যবসিত হয়! তখন সাহিত্য-মূল্য বা অন্যান্য নিরিখের তুলনায় রাজনৈতিক মত প্রচারে তাৎক্ষণিক উপযোগিতাই অনুদিত হওয়ার জন্য অগ্রাধিকার পেতে থাকে। সেই প্রবণতা এড়াতে পারলে লিটল ম্যাগাজিন ভাল অনুবাদক তৈরি হওয়ার আতুড়ঘর হয়ে উঠতে পারে।
এহ্সান : অনুবাদের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকও দেয়া হচ্ছে। এটা আমাদের দেশে মানসম্মত অনুবাদের ক্ষেত্রে কি কোনো ভূমিকা রাখছে?
অভিজিৎ মুখার্জি : এই ব্যাপারে মন্তব্য করার মতো আমি অবহিত নই পরিস্থিতি সম্পর্কে। তবে পদক-টদকের ওপর খুব গুরুত্ব না দেওয়াই ভাল। আত্মসম্মানজ্ঞানহীন নিম্নরুচির লোকেরা মরিয়া হয়ে পদক জোটাতে উঠে পড়ে লাগে, খোসামুদির বান ডেকে যায়, খুব ছোট মাপের মানুষেরা সব নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে আর প্রকৃত যোগ্য লোক সাহিত্যের অঙ্গন এড়িয়ে চলে।
এহ্সান : এই মুহুর্তে দেশে যে অনুবাদ হচ্ছে, তার মান নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট?
অভিজিৎ মুখার্জি : না।
এহ্সান : আমাদের দেশে অনেক অনুবাদক আছেন। বাজারে তাদের অনেক বইও আছে। আপনি কাদেরকে আদর্শ অনুবাদক বলে মনে করেন?
অভিজিৎ মুখার্জি : অব্যাহতি দিন। হয়তো আছেন, উচ্চমানের অনুবাদ করেছেন এরকম অনুবাদক, তাদের প্রতি অবিচার করা হয় নামোল্লেখ না করলে। তবে এই মুহূর্তে আমি নীরব।*
এহসান : আপনাকে ধন্যবাদ।
অভিজিৎ মুখার্জি : আপনাকেও ধন্যবাদ।
লেখক পরিচিত:
অভিজিৎমুখার্জি
কলকাতায় জাপানি ভাষা ও সাহিত্যের যুগপৎ চর্চার প্রসঙ্গ উঠলে যে-নামটা প্রথমেই আসবে সেটা অভিজিৎ মুখার্জি। একসময় জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর অধ্যাপক নিযুক্ত হয়ে আর তারপর কখনো বিশ্বব্যাঙ্কের কোনো প্রকল্পে, তাছাড়াও বার তিনেক প্রখ্যাত জাপান ফাউন্ডেশনের বৃত্তি পেয়ে। অনুবাদ করেছেন হারুকি মুরাকামির নির্বাচিত গল্প সংকলন ‘এক ডজন মুরাকামি’। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন জাপানের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের নিয়ে অথবা জাপানি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত যাঁরা ইংরিজি সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত লেখক, তাঁদের সাহিত্যকৃতির বিশ্লেষণ নিয়ে ওঁর বহুপঠিত বই, ‘যে ভারতীয়রা ইংরিজিতে লিখছেন’।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান জাপানি ভাষার শিক্ষকতার সূত্রে স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ-এর প্রাক্তন জয়েন্ট ডিরেক্টর শ্রী মুখার্জির প্রিয় লেখক স্যর ভি.এস. নাইপল, গ্রাহাম গ্রীন, হারুকি মুরাকামি ও কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।
0 মন্তব্যসমূহ