জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা
মানচিত্রের কাটা-ছেঁড়ায় দু’ভাগ হয়ে যাওয়া ‘মন’ এবং ‘জন’ নিয়ে গল্প আছে অসংখ্য। খুলনা জেলার বেতনা-কপোতাক্ষ তীরে বেড়ে ওঠা এবং সাতচল্লিশের কিছু পরে দেশ-ছাড়া; মুকন্দ পালমশায় ও তাঁর স্ত্রী’র গল্পটি সে হিসেবে বেশ সাধারণ। কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র তাঁর সহজ সরল মা-বাবা’র এই গল্পটি বলেছেনও কেমন অন্যরকম নৈর্ব্যক্তিক ভাষায়, যেন সাদা চোখে দেখা রোজকার জীবন।
যে জীবনের কথায় ভাষার কারুকাজ লাগে না, লাগে না তথাকথিত অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বা জটিল কোন মোচড়। যেখানে নিপুন শিল্পী অনায়াসে আঁকেন বিশাল ব্যাপ্তির জীবন, ছোট্ট ক্যানভাসে। সে জীবনের বাঁকে জলে ভর ভর জলধি থাকে, থাকে নিয়তির ফাঁদে প্রিয় নদী হারানোর কথা, থাকে নদীর আড়ালে নর-নারী’র অপ্রকাশিত জীবনের সুপ্ত ব্যাথা। পাঠকের বুকের মাঝে নদী থাকুক বা না থাকুক; পাঠক গল্পটি পড়তে পড়তে আশ্চর্য ভাবে দেখতে পান, জীবন কেমন অদ্ভুত আছড়ে পড়ে কপোতাক্ষ থেকে বেতনায়, বেতনা থেকে গঙ্গায়। তারপর বহুকাল আগে হারিয়ে ফেলা নিজের নদীটিকে খুঁজতে খুঁজতে, কিংবা চলতি পথে পাওয়া নতুন নদীটির সাথে নিজেকে মেলাতে মেলাতে পাঠক সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেন- লেখক অমর মিত্র সেই শক্তিমান গল্পের জাদুকর যিনি পাঠককে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বদলে যাওয়া পৃথিবী দেখান। যিনি পাঠকের আবেগের মুল্যেই মিলিয়ে দেন সুখ-ঠিকানার সন্ধান! নিত্য ঘটা, ঘটনার এ গল্প ধীরে ধীরে কেমন করে পাঠকের কাছে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে তা বুঝতে, পড়তেই হবে ‘হারানো নদীর স্রোত’।
লেখক অমর মিত্রের বাবা-মা অর্থাৎ মুকুন্দ পালমশায় এবং তাঁর স্ত্রী’র জীবনকে জানলে মনে হয়, শিকড় উপড়ে অন্যখানে রোপিত দুটি গাছের প্রাণ। এই প্রাণদুটো কখনোই মানতে পারেননি কপোতাক্ষতীরের কাটিপাড়া, আর বেতনা পাড়ের বড়দল ছেড়ে কলকাতায় স্থায়ী হওয়া। আসলে উনিশ শতকের আগে দেশভাগের ব্যাপারটি এ উপমহাদেশের মানুষের কল্পনাতেও ছিল না! ইদানিংকার ধর্মের বিষময় বিদ্বেষটি তখনো ছিল না যে! ব্রিটিশ শাসকরা তাদের ক্ষমতা’র মোহে হিন্দু-মুসলিমকে, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-ফ্যাসাদের মাধ্যমে অবান্তর এই বিভাজনের পথ দেখিয়েছে! তাই এক অকল্পনীয়, বিভাজিত জীবনকে মুকুন্দ পালমশায়রা মেনে নিলেও, যতখানি সম্ভব সেই পূর্ববঙ্গের রূপকে জীবনে ধরতে চেয়েছেন। মুকুন্দ পালমশায় এবং তাঁর স্ত্রী বোধহয় সে কারণেই কলকাতায় এসে নিজেদের জীবন জড়িয়ে নেন গঙ্গায়। তাঁরা অদ্ভুত স্নিগ্ধ এক দর্শনও জীবনভর মানতে থাকেন – ‘নদী ছাড়া জীবন শুকিয়ে যায়; নদী-পাড়ের মানুষ সহজ-সরল-নরম মনের হয়’। তাঁদের নদীকেন্দ্রিক এই জলময় গল্প-কল্পনা চিরচেনা এক নদীপাড়ের ভেজা বাতাস ছড়িয়েছে সারা গল্প জুড়ে। ফলে বাড়ির পাশে নদী না থাকা পাঠকও সে দর্শনের অংশ হয়ে যান; জল-ভাবনায় মগ্ন হয়ে বুকের ভেতর নদী খুঁড়ে খুঁড়ে। এমন ‘শুধু লিখে’ কেমন করে পাঠককে নদীর জলে ভরিয়ে, ভাসিয়ে সিক্ত করা যায় - তা সত্যিই বিস্ময়!
তৎকালীন খুলনা জেলার বড়দলে (এখন সে গ্রাম সাতক্ষীরা জেলায়) জন্মালেও, লেখক বড় হয়েছেন অনাথ বিশ্বাস বাই লেনে’র দুকামরার ফ্ল্যাটে। যেখান থেকে রোজ রাতে শোনা যেত গঙ্গা থেকে ভেসে আসা লঞ্চের ভোঁ। একই ভোঁ তাঁর মাও শুনতেন; চোখ বুজলেই মা’র মনে হত কপোতাক্ষতীরের বাপের বাড়িতেই যেন আছেন! চেষ্টা করেও তাই ছোট্ট,পুরনো,স্যাঁতসেঁতে এ বাস ছেড়ে নতুন সুরম্য কোন বাসায় লেখকের ওঠা হয় না। নিজের ছেলের কথা ভেবে লেখক যখনই নতুন বাসা খোঁজেন, বাবা মুকুন্দ পালমশায় জানিয়ে দেন তিনি এবং তাঁর স্ত্রী থেকে যাবেন গঙ্গার ধারেই। লেখকের স্ত্রী রীনা অবাক হয়ে জানতে চান, কেন তাঁদেরকে নদীর তীরেই থাকতে হবে! মুকুন্দ পাল মশায় কিংবা তাঁর স্ত্রী স্মৃতিচারণ করে চলেন একই সে কথা। একসময় ওপার থেকে আসা কত মানুষের আশ্রয় ছিল এ বাসা! “মুকুন্দদা, মুকুন্দকা, মুকুন্দ জেঠা, মুকুন্দ মেসো, মুকুন্দ পিসে, শুধু মুকুন্দ পাল – একজনেরই ছিল কত নাম”। ভয়ে-ত্রস্তে দেশ ছাড়া কিংবা এমনিই চিকিৎসা বা অন্য কাজে কলকাতায় আসা সবার জন্যই অবারিত ছিল এ বাসার দ্বার। রীনা হয়তোবা কখনো দুঃখ সহকারে মনে করিয়ে দেন সেই আশ্রয়প্রার্থীদের কেউ আসে না তো খোঁজটুকুও নিতে! কিন্তু সে কথায় কোন আক্ষেপ থাকে না লেখকের বাবা-মায়ের। আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোর স্মৃতি কিংবা কপোতাক্ষে শোনা ষ্টীমারের ভোঁ কে বাগবাজারের গঙ্গায় ধারনে’র আকুতি কিংবা সব মিলিয়ে এ বাড়ি যেন হয়ে ওঠে কপোতাক্ষ তীরের! আর সে কারণেই বিকল্প ঠিকানা তৈরি হয় না, অনাথ বিশ্বাস বাই লেনের!
সকাল-দুপুর-রাতে, ঘুমে কিংবা জাগরণে, এ দম্পতির বুকে সদা-সর্বদাই জুড়ে থাকে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের দুই নদী – বেতনা আর কপোতাক্ষ। একই সে গল্প বারাবার শুনে চলেন রীনা; এবং রীনার মাধ্যমে লেখকও, দিন শেষে রাত্রে। পুরনো হতে হতে গল্প যখন প্রায় ফুরোবার পথে, মুকুন্দ পালমশায়ের বয়স যখন নব্বই ছুঁই ছুঁই তখন হঠাৎ একদিন বড়দলের আশ্চর্য-সরল, এক মানুষ আসেন দেশ-গ্রাম-নদীর খবর নিয়ে। প্রৌঢ় সে ভদ্রলোকের নাম সিকান্দার, বড়দল প্রাইমারি স্কুলের হেডমাষ্টার। তাঁর বাপ-চাচা, মা-চাচীর প্রাণের বন্ধু এই মুকুন্দ পালমশায় এবং তাঁর স্ত্রী। লেখকের বাবা-মা অসীম আগ্রহে সিকান্দারের কাছে জানতে চান তাঁদের অতি আপনজন এজাহার-মোজাহারের খবর, আঞ্জুমান-রোশোনারা’র খবর। শুনতে পান সই আঞ্জুমান ছাড়া আজ আর কেউ বেঁচে নেই। জানতে পারেন, অসম্ভব রূপবতী রোশোনারা নাকি তাঁর মৃত্যু-সংবাদ মুকুন্দ পালমশায়কে দিতে বলে গেছেন। অকস্মাৎ এ খবরে কোথাও থেকে ঝুপ করে কিছু পড়ে গেল কি? স্মৃতি-আলমিরার গোপন অলিন্দে ন্যাপথলিন-জড়ানো ছোট্ট কোন হীরে-পান্না-মতি? এই এত বছর পর জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও কি ভয়ানক চমকে ওঠেন মুকুন্দ পালমশায়ের স্ত্রী! কেমন করে রোশোনারা তাঁর মৃত্যুর পরও ছায়া ফেললেন এ দুজনের মাঝে? এ এক অপার রহস্য! কি অবলীলায় কেউ একজন থেকে যায় চুপটি করে; শৈশব, কৈশোর, যৌবনের জাদু-ঝোলায় ‘সে সময়’ এর রূপ ধরে; সময়টিকে কল্পনার সাতরঙে রঙিন করে! নর-নারী’র জটিল এবং রহস্যময় এ সম্পর্কেরর আলতো উপস্থাপনায় ‘হারানো নদীর স্রোত’ কে তখন পাঠকের মনে হয় আদিমতার ও আধুনিকতার সব সীমানায় যেন ছুঁয়ে গেছে। লেখক স্পষ্ট করে কোন বেদনার কথা বলেননি; তবু কোথা থেকে একরাশ কষ্টের ধোঁয়াটে কুয়াশা মেখে যায় পাঠকের গায়ে।
সিকান্দারের আগমনে আরো কত স্মৃতি ভেসে ওঠে মন-পর্দায়! বাবা মুকুন্দ পাল মশায়ের মনে পড়ে যায়, বন্ধু এজাহার-মোজারারের সাথে ভাত খেতেন এক থালায়। মন ভাসে মায়েরও কপোতাক্ষের ঢেউ-এ আর ওপারে’র মায়ায়। “মা বলল, আমি আর আঞ্জু দুটো গাছ পুতিলাম, আমাদের বাগানে আঞ্জু, তুমাদের বাগানে আমি, চুষির আম, আছে? সিকান্দার বলল, আপনের নাম ললিতা, ওই গাছডার নামও তাই, ললিতা আম, খুব মিষ্টি, ললিতা আম বড়দলে আর কারো ঘরে নেই”। বহুকাল আগের অদ্ভুত মধুময় সে সময় আবার উঠে আসে, এ সময়ের আরেক অসাম্প্রদায়িক মানুষ সিকান্দারের হাত ধরে। “বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ইস্কুলডা পাকা হয়েছে?” সিকান্দার উত্তর দেন, “হয়েছে, আপনার সই করা খাতা পত্তর এখনো আছে”। এ কথা, সে কথায় মুকুন্দ পাল মশায় এবং তাঁর স্ত্রী ললিতা ব্যাকুল হয়ে জানতে চান কপোতাক্ষ আর বেতনার কথা। সিকান্দারের আগমনের উদ্দেশ্যও তখন জানা যায়। দীর্ঘশ্বাশ ফেলে তিনি জানান, “গাঙ সব শুকোয় যাচ্ছে চাচী”। “বিড়বিড় করে সিকান্দার, হিন্দুরা শুধু দেশ ছাড়তেছে, ভিটেমাটি বাগান পড়ে থাকতেছে, লোভী মানুষে দখল করে নেচ্ছে, লোভে হিন্দুদের তাড়াচ্ছে, কিন্তু এডা যেমন সত্যি, তেমন সত্যি তারা দেশ ছেড়েই বা আসতেছে কেন কও দেখি চাচী, ওডা তাদেরও দেশ, যদি হিন্দু মোছলমান দুজনেই না থাকল একটা দেশে, গাঙ্গে পানি থাকে?” তীব্র এই বিশ্বাসের কথা সিকান্দার লেখককেও বলেন, “ওপারে হিন্দু, এপারে মোছলমান যদি না থাকে, কারে নে কে বাস করবে? গাঙের পানি কি এমনি শুকায় দাদা, পানি থাকবে না কুথাও”। ওপার ছেড়ে আসা বহুজনের ঠিকানা জোগাড় করেই নাকি সিকান্দার এবার এসেছেন; তিনি বদ্ধ পরিকর সবাইকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। আবেগতাড়িত হয়ে নয়; একান্ত বিশ্বাস থেকেই তিনি জানিয়ে যান, ধর্ম-বর্ণ-ধনী-গরিব মিলেমিশে নিজ দেশে বাস করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কপোতাক্ষ-বেতনা আর শুকোবে না; আবার তারা জলে ছলছল জলময় হবে! সিকান্দারের স্বপ্নিল এ প্রাণের ডাকে বিহ্বল হয়ে পড়েন মুকুন্দ পালমশায়। নিজের ভেতরে যে আহ্বান সবসময়ই ছিল - তা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বন্ধু-পুত্রের মুখে শুনতে পেয়েই বোধ হয়, হারিয়ে ফেলেন নিজেকে। অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে যেতে হয় তাঁকে। আর কি অবাক কাণ্ড; বহুকাল পূর্বে তাঁর কাছে আশ্রয়প্রাপ্ত কলকাতার এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বড়দলের মানুষগুলো জড় হতে থাকে সে নার্সিংহোমে। ‘একাকী’ বোধে আক্রান্ত রীনার মুখ আলোকিত হয়ে ওঠে, মুখে মুখে শোনা সেই মানুষগুলোকে ফিরে পেতে দেখে।
অসুস্থ মুকুন্দ পালমশায় স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে নিজের নামটি ভুলে যান; ভোলেন না বড়দলের কথা। নিজ গ্রামে ফিরে যাবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নার্সিংহোমে দেখতে আসা সবাইকে বলেন, নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। চেনা মুখের অভাবে নদী,গাঙ সব ধু ধু বালির মরুভূমি হচ্ছে! সকলকে জন্মভূমিতে ফিরতে হবে! এখানে ওখানে ছড়ানো মানুষগুলো কিভাবে তাঁর বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে এভাবে ছুটে এলো তা খুঁজতে গিয়ে উঠে আসে আরেক অদ্ভুত খবর। লেখকের মামাবাড়ি’র গ্রাম থেকেও কে যেন এসেছেন, নাম জাফর মণ্ডল। তিনিও এসেছেন দেশ-ত্যাগী সব মানুষগুলোকে সাথে নিয়ে দেশে ফিরতে। এ ঘটনায় মা ‘ললিতা’ যেন কেমন আচ্ছন্নের মত হয়ে যান! ভাবেন, নিশ্চয়ই ‘ইকাবালভাইদের কেউ হবে’। ‘ইকবাল ভাই’রা কারা -এ নিয়ে রীনার অসংখ্য প্রশ্নের উত্তরে মা অল্প করে বলেন, “স্বদেশী করত, জেল খেটেছিল তার তিন ভাই-ই, এখন কি কেউ বেঁচে আছে?” আবার আরেকটু বলেন, “খুব সুপুরুষ, লম্বা; বাংলার মাটি বাংলার জল গাইত ...”। এখনও সে গান তাঁর কানে লেগে আছে! জীবনের প্রথমবেলার জায়গাটি কতভাবে কত আবেগেই না মানুষের জীবনে গেঁথে যায় আষ্টেপৃষ্ঠে! গহীন এ জীবনে কে যে কার জন্য জমায় রঙিন-গোপন ময়ূরপুচ্ছ, কে তা জানে! বারংবার কপোতাক্ষে’র, কাটিপাড়া’র গল্প বলতেন মা; সে গল্পের মাঝে কৈশোরের এই ইকবাল ভাইও কি থাকতেন না খুব চুপিসারে? কে জানে! লেখক এবং লেখকের স্ত্রীও একটু আন্দোলিত হন, তাঁদের মাঝেও কি কোন ‘ইকবাল ভাই’ কিংবা ‘রোশোনারা’ বসে আছে আলো জ্বালিয়ে? এ গল্পের বিভিন্ন ধাপে পৌঁছে পাঠকের অসংখ্যবার মনে হবে, টুকরো টুকরো জটিলতা সহজ চোখে দেখার অসাধারণ এক সার্থকতা এই ‘হারানো নদীর স্রোত’।
নার্সিংহোমে বাবার অন্তিম শয্যায় বসে লেখক শুনতে পান, অনেকজন উঠে আসছে পাঁচতলার এ কেবিনে। “ওপার থেকে নদীর স্রোতের মতো মানুষ আসছে মুকুন্দ পালকে দেখতে। বেত্রবতী, কপোতাক্ষ ঢুকে পড়েছে নার্সিংহোমের ভিতরে”। মুকুন্দ পালমশায় সবাইকে দেশে ফেরার গুরুত্ব বোঝাতে থাকেন - “মানুষ দেশ ছাড়ছে, মানুষের ঘর পুড়ছে, নদী শুকোচ্ছে খোকা, এরপর আর কোথাও নদী থাকবে না, চিতা জ্বালালে আর নেভানো যাবে না, ......।” সম্প্রীতি আর মিলনাকাংখায় পূর্ণ মানব-হৃদয়কে নিজ চোখে দেখে নিতে, বাস্তবতার নিরিখে নিয়ে আবার তা অনুভব করতে পাঠক এই গল্প পড়বেন বারবার; এ গল্পকে করে নেবেন মনের মণিকোঠার! লেখক এ গল্পে সত্যিকারের মানবপ্রেমিক, হৃদয়বান কিছু মানুষকে নির্মোহ-দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং হুবহু এঁকেছেন তাঁদের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-জীবন-যুদ্ধকে। ছিমছাম কোন জীবনের আড়ালে বাস্তবতার সাথে ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা’র লড়তে থাকা অবিরাম এক যুদ্ধও লেখক এখানে দেখিয়েছেন। এত অনাড়ম্বরে এবং অনায়াসে এসেছে গল্পের প্রতিটি মুহূর্ত আর তার অনুভব, যে অধিকাংশ সময়ই একে গল্প মনে হয় না; মনে হয় সেলুফেন পেপারে এপার থেকে দেখা ওপারের জীবন!
পাঠক এ গল্পে আবেগতাড়িত যেমন হবেন অনেকখানি, তেমনি আবেগ থেকে দুম করে বেরিয়ে এসে দেখে নেবেন জীবনের খুঁটিনাটি। “হারানো নদীর স্রোত” পড়ে পাঠকের মনে হবে গল্পকার অমর মিত্র আঘাত না দিয়েও কাঁদাতে জানেন, পাঠককে বিষণ্ণ নদীতে ফেলেও আলোকিত এক আশায় রাখেন। অসাধারণ লেখকের নিপুন দৃশ্য বুননে পাঠক ভাববেন এটি অনতিলঙ্ঘ এক ইতিহাসের গল্প, ফেলে আসা ‘ময়ুরপুচ্ছ-জমানো’ জীবনের গল্প, দেশ ভাঙায় মন হারানোর গল্প, প্রমত্তা নদীর শুকিয়ে মরার গল্প, ক্রমশ সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠা এ সমাজের অসাম্প্রদায়িক মানুষগুলোর আকুল করা ব্যাকুল গল্প, সব ধর্মের এবং ছিন্নমূল মানুষের সম্প্রীতির প্রতি সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার গল্প- সব মিলিয়ে পাঠক পাবেন তার একান্ত এক নিজের গল্প! আর পাঠকের একান্ত এ গল্পটি নিঃসন্দেহে দেশ, জাতি, কালের সীমানা ডিঙোনো স্বপ্নময় এক ‘অমর গল্প’।
মানচিত্রের কাটা-ছেঁড়ায় দু’ভাগ হয়ে যাওয়া ‘মন’ এবং ‘জন’ নিয়ে গল্প আছে অসংখ্য। খুলনা জেলার বেতনা-কপোতাক্ষ তীরে বেড়ে ওঠা এবং সাতচল্লিশের কিছু পরে দেশ-ছাড়া; মুকন্দ পালমশায় ও তাঁর স্ত্রী’র গল্পটি সে হিসেবে বেশ সাধারণ। কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র তাঁর সহজ সরল মা-বাবা’র এই গল্পটি বলেছেনও কেমন অন্যরকম নৈর্ব্যক্তিক ভাষায়, যেন সাদা চোখে দেখা রোজকার জীবন।
যে জীবনের কথায় ভাষার কারুকাজ লাগে না, লাগে না তথাকথিত অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বা জটিল কোন মোচড়। যেখানে নিপুন শিল্পী অনায়াসে আঁকেন বিশাল ব্যাপ্তির জীবন, ছোট্ট ক্যানভাসে। সে জীবনের বাঁকে জলে ভর ভর জলধি থাকে, থাকে নিয়তির ফাঁদে প্রিয় নদী হারানোর কথা, থাকে নদীর আড়ালে নর-নারী’র অপ্রকাশিত জীবনের সুপ্ত ব্যাথা। পাঠকের বুকের মাঝে নদী থাকুক বা না থাকুক; পাঠক গল্পটি পড়তে পড়তে আশ্চর্য ভাবে দেখতে পান, জীবন কেমন অদ্ভুত আছড়ে পড়ে কপোতাক্ষ থেকে বেতনায়, বেতনা থেকে গঙ্গায়। তারপর বহুকাল আগে হারিয়ে ফেলা নিজের নদীটিকে খুঁজতে খুঁজতে, কিংবা চলতি পথে পাওয়া নতুন নদীটির সাথে নিজেকে মেলাতে মেলাতে পাঠক সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেন- লেখক অমর মিত্র সেই শক্তিমান গল্পের জাদুকর যিনি পাঠককে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বদলে যাওয়া পৃথিবী দেখান। যিনি পাঠকের আবেগের মুল্যেই মিলিয়ে দেন সুখ-ঠিকানার সন্ধান! নিত্য ঘটা, ঘটনার এ গল্প ধীরে ধীরে কেমন করে পাঠকের কাছে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে তা বুঝতে, পড়তেই হবে ‘হারানো নদীর স্রোত’।
লেখক অমর মিত্রের বাবা-মা অর্থাৎ মুকুন্দ পালমশায় এবং তাঁর স্ত্রী’র জীবনকে জানলে মনে হয়, শিকড় উপড়ে অন্যখানে রোপিত দুটি গাছের প্রাণ। এই প্রাণদুটো কখনোই মানতে পারেননি কপোতাক্ষতীরের কাটিপাড়া, আর বেতনা পাড়ের বড়দল ছেড়ে কলকাতায় স্থায়ী হওয়া। আসলে উনিশ শতকের আগে দেশভাগের ব্যাপারটি এ উপমহাদেশের মানুষের কল্পনাতেও ছিল না! ইদানিংকার ধর্মের বিষময় বিদ্বেষটি তখনো ছিল না যে! ব্রিটিশ শাসকরা তাদের ক্ষমতা’র মোহে হিন্দু-মুসলিমকে, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-ফ্যাসাদের মাধ্যমে অবান্তর এই বিভাজনের পথ দেখিয়েছে! তাই এক অকল্পনীয়, বিভাজিত জীবনকে মুকুন্দ পালমশায়রা মেনে নিলেও, যতখানি সম্ভব সেই পূর্ববঙ্গের রূপকে জীবনে ধরতে চেয়েছেন। মুকুন্দ পালমশায় এবং তাঁর স্ত্রী বোধহয় সে কারণেই কলকাতায় এসে নিজেদের জীবন জড়িয়ে নেন গঙ্গায়। তাঁরা অদ্ভুত স্নিগ্ধ এক দর্শনও জীবনভর মানতে থাকেন – ‘নদী ছাড়া জীবন শুকিয়ে যায়; নদী-পাড়ের মানুষ সহজ-সরল-নরম মনের হয়’। তাঁদের নদীকেন্দ্রিক এই জলময় গল্প-কল্পনা চিরচেনা এক নদীপাড়ের ভেজা বাতাস ছড়িয়েছে সারা গল্প জুড়ে। ফলে বাড়ির পাশে নদী না থাকা পাঠকও সে দর্শনের অংশ হয়ে যান; জল-ভাবনায় মগ্ন হয়ে বুকের ভেতর নদী খুঁড়ে খুঁড়ে। এমন ‘শুধু লিখে’ কেমন করে পাঠককে নদীর জলে ভরিয়ে, ভাসিয়ে সিক্ত করা যায় - তা সত্যিই বিস্ময়!
তৎকালীন খুলনা জেলার বড়দলে (এখন সে গ্রাম সাতক্ষীরা জেলায়) জন্মালেও, লেখক বড় হয়েছেন অনাথ বিশ্বাস বাই লেনে’র দুকামরার ফ্ল্যাটে। যেখান থেকে রোজ রাতে শোনা যেত গঙ্গা থেকে ভেসে আসা লঞ্চের ভোঁ। একই ভোঁ তাঁর মাও শুনতেন; চোখ বুজলেই মা’র মনে হত কপোতাক্ষতীরের বাপের বাড়িতেই যেন আছেন! চেষ্টা করেও তাই ছোট্ট,পুরনো,স্যাঁতসেঁতে এ বাস ছেড়ে নতুন সুরম্য কোন বাসায় লেখকের ওঠা হয় না। নিজের ছেলের কথা ভেবে লেখক যখনই নতুন বাসা খোঁজেন, বাবা মুকুন্দ পালমশায় জানিয়ে দেন তিনি এবং তাঁর স্ত্রী থেকে যাবেন গঙ্গার ধারেই। লেখকের স্ত্রী রীনা অবাক হয়ে জানতে চান, কেন তাঁদেরকে নদীর তীরেই থাকতে হবে! মুকুন্দ পাল মশায় কিংবা তাঁর স্ত্রী স্মৃতিচারণ করে চলেন একই সে কথা। একসময় ওপার থেকে আসা কত মানুষের আশ্রয় ছিল এ বাসা! “মুকুন্দদা, মুকুন্দকা, মুকুন্দ জেঠা, মুকুন্দ মেসো, মুকুন্দ পিসে, শুধু মুকুন্দ পাল – একজনেরই ছিল কত নাম”। ভয়ে-ত্রস্তে দেশ ছাড়া কিংবা এমনিই চিকিৎসা বা অন্য কাজে কলকাতায় আসা সবার জন্যই অবারিত ছিল এ বাসার দ্বার। রীনা হয়তোবা কখনো দুঃখ সহকারে মনে করিয়ে দেন সেই আশ্রয়প্রার্থীদের কেউ আসে না তো খোঁজটুকুও নিতে! কিন্তু সে কথায় কোন আক্ষেপ থাকে না লেখকের বাবা-মায়ের। আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোর স্মৃতি কিংবা কপোতাক্ষে শোনা ষ্টীমারের ভোঁ কে বাগবাজারের গঙ্গায় ধারনে’র আকুতি কিংবা সব মিলিয়ে এ বাড়ি যেন হয়ে ওঠে কপোতাক্ষ তীরের! আর সে কারণেই বিকল্প ঠিকানা তৈরি হয় না, অনাথ বিশ্বাস বাই লেনের!
সকাল-দুপুর-রাতে, ঘুমে কিংবা জাগরণে, এ দম্পতির বুকে সদা-সর্বদাই জুড়ে থাকে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের দুই নদী – বেতনা আর কপোতাক্ষ। একই সে গল্প বারাবার শুনে চলেন রীনা; এবং রীনার মাধ্যমে লেখকও, দিন শেষে রাত্রে। পুরনো হতে হতে গল্প যখন প্রায় ফুরোবার পথে, মুকুন্দ পালমশায়ের বয়স যখন নব্বই ছুঁই ছুঁই তখন হঠাৎ একদিন বড়দলের আশ্চর্য-সরল, এক মানুষ আসেন দেশ-গ্রাম-নদীর খবর নিয়ে। প্রৌঢ় সে ভদ্রলোকের নাম সিকান্দার, বড়দল প্রাইমারি স্কুলের হেডমাষ্টার। তাঁর বাপ-চাচা, মা-চাচীর প্রাণের বন্ধু এই মুকুন্দ পালমশায় এবং তাঁর স্ত্রী। লেখকের বাবা-মা অসীম আগ্রহে সিকান্দারের কাছে জানতে চান তাঁদের অতি আপনজন এজাহার-মোজাহারের খবর, আঞ্জুমান-রোশোনারা’র খবর। শুনতে পান সই আঞ্জুমান ছাড়া আজ আর কেউ বেঁচে নেই। জানতে পারেন, অসম্ভব রূপবতী রোশোনারা নাকি তাঁর মৃত্যু-সংবাদ মুকুন্দ পালমশায়কে দিতে বলে গেছেন। অকস্মাৎ এ খবরে কোথাও থেকে ঝুপ করে কিছু পড়ে গেল কি? স্মৃতি-আলমিরার গোপন অলিন্দে ন্যাপথলিন-জড়ানো ছোট্ট কোন হীরে-পান্না-মতি? এই এত বছর পর জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও কি ভয়ানক চমকে ওঠেন মুকুন্দ পালমশায়ের স্ত্রী! কেমন করে রোশোনারা তাঁর মৃত্যুর পরও ছায়া ফেললেন এ দুজনের মাঝে? এ এক অপার রহস্য! কি অবলীলায় কেউ একজন থেকে যায় চুপটি করে; শৈশব, কৈশোর, যৌবনের জাদু-ঝোলায় ‘সে সময়’ এর রূপ ধরে; সময়টিকে কল্পনার সাতরঙে রঙিন করে! নর-নারী’র জটিল এবং রহস্যময় এ সম্পর্কেরর আলতো উপস্থাপনায় ‘হারানো নদীর স্রোত’ কে তখন পাঠকের মনে হয় আদিমতার ও আধুনিকতার সব সীমানায় যেন ছুঁয়ে গেছে। লেখক স্পষ্ট করে কোন বেদনার কথা বলেননি; তবু কোথা থেকে একরাশ কষ্টের ধোঁয়াটে কুয়াশা মেখে যায় পাঠকের গায়ে।
সিকান্দারের আগমনে আরো কত স্মৃতি ভেসে ওঠে মন-পর্দায়! বাবা মুকুন্দ পাল মশায়ের মনে পড়ে যায়, বন্ধু এজাহার-মোজারারের সাথে ভাত খেতেন এক থালায়। মন ভাসে মায়েরও কপোতাক্ষের ঢেউ-এ আর ওপারে’র মায়ায়। “মা বলল, আমি আর আঞ্জু দুটো গাছ পুতিলাম, আমাদের বাগানে আঞ্জু, তুমাদের বাগানে আমি, চুষির আম, আছে? সিকান্দার বলল, আপনের নাম ললিতা, ওই গাছডার নামও তাই, ললিতা আম, খুব মিষ্টি, ললিতা আম বড়দলে আর কারো ঘরে নেই”। বহুকাল আগের অদ্ভুত মধুময় সে সময় আবার উঠে আসে, এ সময়ের আরেক অসাম্প্রদায়িক মানুষ সিকান্দারের হাত ধরে। “বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ইস্কুলডা পাকা হয়েছে?” সিকান্দার উত্তর দেন, “হয়েছে, আপনার সই করা খাতা পত্তর এখনো আছে”। এ কথা, সে কথায় মুকুন্দ পাল মশায় এবং তাঁর স্ত্রী ললিতা ব্যাকুল হয়ে জানতে চান কপোতাক্ষ আর বেতনার কথা। সিকান্দারের আগমনের উদ্দেশ্যও তখন জানা যায়। দীর্ঘশ্বাশ ফেলে তিনি জানান, “গাঙ সব শুকোয় যাচ্ছে চাচী”। “বিড়বিড় করে সিকান্দার, হিন্দুরা শুধু দেশ ছাড়তেছে, ভিটেমাটি বাগান পড়ে থাকতেছে, লোভী মানুষে দখল করে নেচ্ছে, লোভে হিন্দুদের তাড়াচ্ছে, কিন্তু এডা যেমন সত্যি, তেমন সত্যি তারা দেশ ছেড়েই বা আসতেছে কেন কও দেখি চাচী, ওডা তাদেরও দেশ, যদি হিন্দু মোছলমান দুজনেই না থাকল একটা দেশে, গাঙ্গে পানি থাকে?” তীব্র এই বিশ্বাসের কথা সিকান্দার লেখককেও বলেন, “ওপারে হিন্দু, এপারে মোছলমান যদি না থাকে, কারে নে কে বাস করবে? গাঙের পানি কি এমনি শুকায় দাদা, পানি থাকবে না কুথাও”। ওপার ছেড়ে আসা বহুজনের ঠিকানা জোগাড় করেই নাকি সিকান্দার এবার এসেছেন; তিনি বদ্ধ পরিকর সবাইকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। আবেগতাড়িত হয়ে নয়; একান্ত বিশ্বাস থেকেই তিনি জানিয়ে যান, ধর্ম-বর্ণ-ধনী-গরিব মিলেমিশে নিজ দেশে বাস করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কপোতাক্ষ-বেতনা আর শুকোবে না; আবার তারা জলে ছলছল জলময় হবে! সিকান্দারের স্বপ্নিল এ প্রাণের ডাকে বিহ্বল হয়ে পড়েন মুকুন্দ পালমশায়। নিজের ভেতরে যে আহ্বান সবসময়ই ছিল - তা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বন্ধু-পুত্রের মুখে শুনতে পেয়েই বোধ হয়, হারিয়ে ফেলেন নিজেকে। অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে যেতে হয় তাঁকে। আর কি অবাক কাণ্ড; বহুকাল পূর্বে তাঁর কাছে আশ্রয়প্রাপ্ত কলকাতার এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বড়দলের মানুষগুলো জড় হতে থাকে সে নার্সিংহোমে। ‘একাকী’ বোধে আক্রান্ত রীনার মুখ আলোকিত হয়ে ওঠে, মুখে মুখে শোনা সেই মানুষগুলোকে ফিরে পেতে দেখে।
অসুস্থ মুকুন্দ পালমশায় স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে নিজের নামটি ভুলে যান; ভোলেন না বড়দলের কথা। নিজ গ্রামে ফিরে যাবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নার্সিংহোমে দেখতে আসা সবাইকে বলেন, নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। চেনা মুখের অভাবে নদী,গাঙ সব ধু ধু বালির মরুভূমি হচ্ছে! সকলকে জন্মভূমিতে ফিরতে হবে! এখানে ওখানে ছড়ানো মানুষগুলো কিভাবে তাঁর বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে এভাবে ছুটে এলো তা খুঁজতে গিয়ে উঠে আসে আরেক অদ্ভুত খবর। লেখকের মামাবাড়ি’র গ্রাম থেকেও কে যেন এসেছেন, নাম জাফর মণ্ডল। তিনিও এসেছেন দেশ-ত্যাগী সব মানুষগুলোকে সাথে নিয়ে দেশে ফিরতে। এ ঘটনায় মা ‘ললিতা’ যেন কেমন আচ্ছন্নের মত হয়ে যান! ভাবেন, নিশ্চয়ই ‘ইকাবালভাইদের কেউ হবে’। ‘ইকবাল ভাই’রা কারা -এ নিয়ে রীনার অসংখ্য প্রশ্নের উত্তরে মা অল্প করে বলেন, “স্বদেশী করত, জেল খেটেছিল তার তিন ভাই-ই, এখন কি কেউ বেঁচে আছে?” আবার আরেকটু বলেন, “খুব সুপুরুষ, লম্বা; বাংলার মাটি বাংলার জল গাইত ...”। এখনও সে গান তাঁর কানে লেগে আছে! জীবনের প্রথমবেলার জায়গাটি কতভাবে কত আবেগেই না মানুষের জীবনে গেঁথে যায় আষ্টেপৃষ্ঠে! গহীন এ জীবনে কে যে কার জন্য জমায় রঙিন-গোপন ময়ূরপুচ্ছ, কে তা জানে! বারংবার কপোতাক্ষে’র, কাটিপাড়া’র গল্প বলতেন মা; সে গল্পের মাঝে কৈশোরের এই ইকবাল ভাইও কি থাকতেন না খুব চুপিসারে? কে জানে! লেখক এবং লেখকের স্ত্রীও একটু আন্দোলিত হন, তাঁদের মাঝেও কি কোন ‘ইকবাল ভাই’ কিংবা ‘রোশোনারা’ বসে আছে আলো জ্বালিয়ে? এ গল্পের বিভিন্ন ধাপে পৌঁছে পাঠকের অসংখ্যবার মনে হবে, টুকরো টুকরো জটিলতা সহজ চোখে দেখার অসাধারণ এক সার্থকতা এই ‘হারানো নদীর স্রোত’।
নার্সিংহোমে বাবার অন্তিম শয্যায় বসে লেখক শুনতে পান, অনেকজন উঠে আসছে পাঁচতলার এ কেবিনে। “ওপার থেকে নদীর স্রোতের মতো মানুষ আসছে মুকুন্দ পালকে দেখতে। বেত্রবতী, কপোতাক্ষ ঢুকে পড়েছে নার্সিংহোমের ভিতরে”। মুকুন্দ পালমশায় সবাইকে দেশে ফেরার গুরুত্ব বোঝাতে থাকেন - “মানুষ দেশ ছাড়ছে, মানুষের ঘর পুড়ছে, নদী শুকোচ্ছে খোকা, এরপর আর কোথাও নদী থাকবে না, চিতা জ্বালালে আর নেভানো যাবে না, ......।” সম্প্রীতি আর মিলনাকাংখায় পূর্ণ মানব-হৃদয়কে নিজ চোখে দেখে নিতে, বাস্তবতার নিরিখে নিয়ে আবার তা অনুভব করতে পাঠক এই গল্প পড়বেন বারবার; এ গল্পকে করে নেবেন মনের মণিকোঠার! লেখক এ গল্পে সত্যিকারের মানবপ্রেমিক, হৃদয়বান কিছু মানুষকে নির্মোহ-দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং হুবহু এঁকেছেন তাঁদের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-জীবন-যুদ্ধকে। ছিমছাম কোন জীবনের আড়ালে বাস্তবতার সাথে ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা’র লড়তে থাকা অবিরাম এক যুদ্ধও লেখক এখানে দেখিয়েছেন। এত অনাড়ম্বরে এবং অনায়াসে এসেছে গল্পের প্রতিটি মুহূর্ত আর তার অনুভব, যে অধিকাংশ সময়ই একে গল্প মনে হয় না; মনে হয় সেলুফেন পেপারে এপার থেকে দেখা ওপারের জীবন!
পাঠক এ গল্পে আবেগতাড়িত যেমন হবেন অনেকখানি, তেমনি আবেগ থেকে দুম করে বেরিয়ে এসে দেখে নেবেন জীবনের খুঁটিনাটি। “হারানো নদীর স্রোত” পড়ে পাঠকের মনে হবে গল্পকার অমর মিত্র আঘাত না দিয়েও কাঁদাতে জানেন, পাঠককে বিষণ্ণ নদীতে ফেলেও আলোকিত এক আশায় রাখেন। অসাধারণ লেখকের নিপুন দৃশ্য বুননে পাঠক ভাববেন এটি অনতিলঙ্ঘ এক ইতিহাসের গল্প, ফেলে আসা ‘ময়ুরপুচ্ছ-জমানো’ জীবনের গল্প, দেশ ভাঙায় মন হারানোর গল্প, প্রমত্তা নদীর শুকিয়ে মরার গল্প, ক্রমশ সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠা এ সমাজের অসাম্প্রদায়িক মানুষগুলোর আকুল করা ব্যাকুল গল্প, সব ধর্মের এবং ছিন্নমূল মানুষের সম্প্রীতির প্রতি সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার গল্প- সব মিলিয়ে পাঠক পাবেন তার একান্ত এক নিজের গল্প! আর পাঠকের একান্ত এ গল্পটি নিঃসন্দেহে দেশ, জাতি, কালের সীমানা ডিঙোনো স্বপ্নময় এক ‘অমর গল্প’।
0 মন্তব্যসমূহ