গল্পকারের সাক্ষাৎকার : আহমাদ মোস্তফা কামাল
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অলাত এহ্সান
প্রতিশ্রুত
গল্পকার আহমাদ মোস্তফা কামাল। সাহিত্যের বোঝাপড়াও গভীর। গল্পে বিষয় নির্বাচন ও স্বল্পবাকে
আখ্যান তৈরিতে তিনি সিদ্ধ, আন্তরিক। বৈষ্যয়িক উন্নতির বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও তার মেধা
ও মননকে নিয়োজিত করেছেন সাহিত্যেই। এখানেই তার সুখ্যাতি। তার লেখা এখন বহুমুখি। লিখছেন
গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ। সাহিত্যের শৈশব-কৈশর পেরিয়ে তিনি এখন মধ্যযৌবনে। পেশা বেসরকরি
বিশ্ববিদ্যায়ে অধ্যপনা। মানুষের জীবন বৈচিত্র্য-বৈভব তিনি দেখেন, দেখান। ভাঙা-গড়ার
মধ্য দিয়ে জীবন ও চিন্তায় তার লেখাগুলো সমৃদ্ধ। বুনন ও সাহিত্যপ্রসাদের কারণ তার নিজস্ব
পাঠক গোষ্ঠীও আছে। সাক্ষাৎকারে নিজেকে মেলে ধরেছেন শানিত ভাবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
গল্পকার অলাত এহ্সান।
অলাত
এহ্সান :
গল্পকার হিসেবে আপনার প্রস্তুতি ও চর্চা অনেকদিনের, ইতোমধ্যে
প্রকাশিত হয়েছে আটটি গল্পগ্রন্থ। তা গল্পলেখা
শুরু
করলেন কিভাবে, কখন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল :
শুরু করেছিলাম স্কুল-জীবনেই, যদিও তখন সিরিয়াসলি কিছু
ভাবিনি এ নিয়ে। স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা আমার প্রথম গল্পটি পড়ে আমার অতি প্রিয়
এবং শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক হরিপদ সূত্রধর বললেন—‘লেগে
থাকিস, লেগে থাকলে তোর হবে।’ মানে, আমি যদি গল্প লেখার
বেদনা বহন করেও লেগে থাকি, তাহলে আমার হবে! তো, আমি লেগে রইলাম। পরবর্তী পাঁচ-ছ
বছর একটানা লিখে চললাম গল্প, খাতার পাতায়, লুকিয়ে। সেই খাতাগুলো হারিয়ে ফেলেছি বলে
মাঝে মাঝে দুঃখ হয়। কী যে লিখছিলাম এত, মনে নেই। সেটিই ছিল আমার প্রস্তুতিকাল।
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মনে হলো—এবার বোধ হয়
দু-একটা গল্প প্রকাশ করা যায়। এই তো প্রকাশ্যে লিখতে শুরু করার গল্প।
এহ্সান
: এ-বছর বই মেলায় আপনার কী কী বই প্রকাশিত হয়েছে,
কারা করেছে?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল :
একটিই বই, মুক্তগদ্যের সংকলন ‘একদিন সব কিছু গল্প হয়ে যায়’,
প্রকাশ করেছে ‘নান্দনিক।‘
এহ্সান
: আপনার সর্বশেষে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘প্রেম ও অপ্রেমের গল্প’, বেরিয়েছিল গত বছর। এটা আপনার অষ্টম গল্পগ্রন্থ। কতদিন ধরে লেখা গল্পগুলো
এই
বইতে
যুক্ত হয়েছে?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : প্রায় বিশ-একুশ বছর ধরে লেখা
প্রেমের গল্পগুলো এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
এহ্সান
: এই দীর্ঘ সময় ধরে লেখা গল্পগুলোর
মধ্যে আপনি পরিবর্তন
লক্ষ্য করেছেন কি?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : আমি তো নানা ধরনের গল্প লিখেছি,
এই বইতে যেহেতু কেবল প্রেমের গল্পই রেখেছি, তাই প্রেম সম্পর্কে আমার দৃষ্টভঙ্গির
পরিচয় পাওয়া যাবে এই গল্পগুলোতে। পরিবর্তন তো হয়েছেই। বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতা
বেড়েছে, অনুভূতি আরো সজাগ ও তীক্ষ্ণ হয়েছে, আবেগ সরিয়ে নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকাতে
শিখেছি, এসব পরিবর্তন তো ধরা পড়বেই। আলাদাভাবে কি সেইসব পরিবর্তনের তালিকা করা
যায়?
এহ্সান
: গল্পগুলো লেখার গল্পটা বলুন।
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : একেকসময় একেক গল্প লিখেছি,
প্রতিটি গল্পের পেছনে আলাদা আলাদা গল্প। সেগুলো বলতে গেলে তো আরেকটা গল্পগ্রন্থ
হয়ে যাবে!
এহ্সান
: তার আগে প্রকাশিত
গ্রন্থের সঙ্গে এই বইয়ের গল্পগুলোর
বিশেষ কি পার্থক্য
আছে?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : আগের গ্রন্থগুলোতে যেসব গল্পগুলো
সংকলিত হয়েছে সেগুলোর বিষয়বস্তু আলাদা। নানা বিষয়ে গল্প লিখেছি আমি।
সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে গল্প, ব্যক্তিমানুষের মনস্তাত্বিক সংকট নিয়ে গল্প, মানুষের
দার্শনিক সংকট নিয়ে গল্প ইত্যাদি। এবং আগের বইগুলোতে প্রধানত এই গল্পগুলোই রেখেছি।
প্রেমের গল্পগুলো একটু অবহেলায় পড়ে ছিল, তাই আলাদা একটা গ্রন্থে তাদের জায়গা করে
দিয়েছি।
এহ্সান
: আপনি কি কোনো নির্দিষ্ট
বিষয়বস্তু—ফর্ম নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন বা দূর্বলতা আছে কি? লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোনটাকে
বেশি গুরুত্ব দেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : না, কোনো ‘নির্দিষ্ট’ বিষয়বস্তুর প্রতি
দুর্বলতা নেই। মানুষকে তার ব্যক্তিগত জগতের ভেতরে রেখে, তার পারিবারিক-সামাজিক
সম্পর্কের ভিত্তিতে, তার আর্থ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিপার্শ্বের প্রেক্ষিতে, তার
দার্শনিক সংকটের নিরিখে দেখাতে চেয়েছি বিভিন্ন গল্পে। আর এসব দেখাতে গিয়ে বারবার
আমাকে ফর্ম পরিবর্তন করতে হয়েছে। আগে ফর্মের কথা ভেবে গল্প লিখতে বসিনি, বরং
গল্পের বিষয়বস্তুই দেখিয়ে দিয়েছে কোন ফর্মে লিখতে হবে।
এহ্সান
: গল্পগুলোতে আপনি কি বলতে চেয়েছেন, মানে
কোনো
বিশেষ বিষয়কে উপস্থান
বা
ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন
কি না?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : না, কোনো মেসেজ দিতে চাইনি।
মেসেজ দেয়ার জন্য আমি গল্প লিখি না। আমি কেবল মানুষের গল্প বলতে চেয়েছি। এটুকুই।
সেই গল্প থেকে পাঠকরা যদি কোনো মেসেজ পেয়ে যান তো ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই।
এহ্সান
: এই সময়ের প্রকাশিত
গল্পগ্রন্থগুলোর সঙ্গে আপনার গল্পের পার্থক্য
কি?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : এই পার্থক্য নির্দেশ করা আমার
কাজ নয়। এগুলো পাঠক-সমালোচকের কাজ।
এহ্সান
: গল্প লেখার জন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
উৎস। একটি
ঘটনা
বা
অভিজ্ঞতা কি করে আপনি গল্পে রূপান্তর
করেন? গল্পগুলোতে আপনার
ব্যক্তিগত ছাপ কিভাবে এসেছে?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল :
এটা অনেকটাই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো ব্যাপার। আকস্মিকভাবে
কোনো একটি গল্পের সূচনা হয় মস্তিষ্কে, হয়তো বিষয়টি আমার মনের ভেতরে ছিল, সচেতনে না
থাকলেও অবচেতনে ছিল, হঠাৎ করেই তার উপত্তি ঘটে, কিন্তু সম্পূর্ণ নির্মাণ হয় না।
লিখতে বসলেই বাকিটা তৈরি হয়ে যায়। ব্যক্তিগত অনেক অভিজ্ঞতাই আমি গল্পে ব্যবহার
করেছি, তবে হুবহু নয়। এ ব্যাপারে আমার গল্পের এক চরিত্রই বলেছে—‘গল্প কখনো বাস্তব নয়, কল্পনাই সেখানে প্রধান। তার মানে,
গল্প হলো কল্পনার ওপর বাস্তবের প্রজেকশন।’
এহ্সান
: গল্প উপস্থাপনের
ক্ষেত্রে আপনি কি মেটাফোর, নিজস্ব শব্দ তৈরি করেন? তা কি রকম?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : সেসব তো কতই করেছি। সব কি আর মনে
আছে, নাকি ‘নিজস্ব’ বলে
দাবি করা যায়?
এহ্সান
: প্রত্যেক লেখকই চায় তার একটা নিজস্বতা
তৈরি
করতে, তো বর্তমান
গল্পকারদের সঙ্গে আপনার গল্পের পার্থক্য
করেন
কী ভাবে?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : উঁহু, এ প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো
না। নিজের স্বাতন্ত্র্য নিজেই চিহ্নিত করার ব্যাপারে আমার সৌজন্যবোধ আমাকে বাধা
দেয়।
এহ্সান
: শুধু উস্থাপনের
স্টাইল দ্বারা তো আর একজন গল্প মহৎ বা কালোত্তীর্ণ
হয়ে
ওঠেন
না। চিন্তার
ও
দেখার বৈচিত্র্য ও গভীরতা দরকার হয়। আপনি গল্পগুলোতে
জীবনের তেমন কোনো সত্য আবিষ্কার
করার
চেষ্টা করেছেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : আমি সম্ভবত মানুষের বৈচিত্র্যময়
বেঁচে থাকা আর বহুবর্ণিল জীবনযাপনকেই উপস্থাপন করতে চেয়েছি। বেঁচে থাকাকে আমার
কাছে আশ্চর্য সুন্দর এক বিষয় বলে মনে হয়। এই বেঁচে থাকা, এই জীবন, এই যুদ্ধ—এসবই আমার কাছে সত্য, ভীষণ সত্য। হয়তো সেগুলোই নানাভাবে
এসেছে আমার গল্পে। কিংবা কে জানে, আরো কিছু এসেছে কী না। নিজের লেখা তো আর বারবার
ফিরে দেখা হয় না, এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমার কোনো মনোযোগী পাঠকই ভালো দিতে
পারবেন।
এহ্সান
: প্রায় সব গল্পেই তো কোনো না কোনো অনুসন্ধান
থাকে। যেমন—দার্শনিক,
আত্ম, নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মেট্রপলিটন
ইত্যাদি। আপনি কোন ধরনের অনুসন্ধানে
গল্প
তৈরি
করেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : অনুসন্ধান করতেই হবে, এমন কোনো
বাধ্যবাধকতা কিন্তু গল্পকারের নেই। একটা গল্প বলাই কি যথেষ্ঠ নয়? আর সেই গল্পের
ভেতরেই কি থাকতে পারে না এসব উপাদান? ‘অনুসন্ধান
করবো’ এরকম মন নিয়ে গল্প লেখা সম্ভব নয় বলেই মনে করি আমি।
এগুলো আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই।
এহ্সান
: গল্পের বিষয়বস্তু
আপনি
কিভাবে নির্ধারণ করেন? গল্পের বিষয়বস্তুর
নির্বাচনের সঙ্গে তো দর্শনের
একটা
যোগাযোগ আছে।
আপনি
গল্পে তেমন কি কোনো দর্শনের
প্রতিফল বা প্রভাব দেখাতে চেষ্টা করেছেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : মূল বিষয় কিন্তু মানুষই। নানা
প্রেক্ষিতে, নানা সময়ে, নানা বয়সে মানুষের জীবন-যাপন, ভাব-ভাবনা, এসব নিয়েই তো
লিখলাম এতকাল ধরে। জীবনের পরম সত্য হলো মৃত্যু, আর সেই মৃত্যুর ওপর দাঁড়িয়ে জীবনের
জয়গান গায় যে মানুষ তার চেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় আর কী-ই বা হতে পারে? আর হ্যাঁ, দর্শন
বলুন, মনস্তত্ব বলুন, কিংবা যা-ই বলুন না কেন, সেগুলো গল্প আর চরিত্রের প্রয়োজনেই
আসে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না আমি। বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেগুলো আসে, আমি
কেবল একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে উপস্থাপন করি।
এহ্সান
: আপনার গল্পগুলোকে কি কোনো বিশেষ ধারা বা ঘরানার-যেমন মার্কসবাদী, জীবনবাদী, নারীবাদী, ফ্রয়েডিয়
ইত্যাদি বলে মনে করেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : নাহ। এরকম কোনো ট্যাগ বোধ হয়
আমার গল্পগুলোর শরীরে লাগানো যাবে না। তারা তাদের মতো, অন্য কারো মতো নয়।
এহ্সান
: আমরা দেখি বাংলা সাহিত্যে
উত্তরাধিকারের ধারা বহন করেছেন অনেক লেখক। এ নিয়ে আপনার একটি বইও
আছে। আপনি নিজেকে কোনো সাহিত্যধারার
উত্তরাধিকারী মনে করেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : বর্তমানের সব লেখকই তো তাদের
পূর্বসুরীদের উত্তরাধিকারত্ব বহন করছে। আমিও তাই। এবং নির্দিষ্ট কোনো ধারার নয়,
আমি নিজেকে সামগ্রিকভাবে পুরো বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনে করি।
আরেকটু বিস্তৃত করে বলা যায়, আমি বিশ্বাসাহিত্যেরও উত্তরাধিকারী। পূর্বসুরিদের কাছ
থেকে অনেক শিখেছি আমি, অনেক জেনেছি, অনেক নিয়েছি। এই ঋণ কি আর অস্বীকার করা যায়?
এহ্সান
: সাহিত্যের দশক বিচার প্রচলিত
আছে। আপনি আপনার দশককে কিভাবে উপস্থাপন
বা
চিহ্নিত করছেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : খুব সচল এবং সক্রিয় দশক। নিয়মিত
লিখে যাচ্ছেন আমার সহযাত্রীরা, ক্লান্তহীন-বিরামহীন। অংশ নিচ্ছেন নানা সাহিত্যিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক
কর্মকান্ড ও আন্দোলনে। চুপচাপ বসে নেই কেউ। এমন সক্রিয়তা বাংলাদেশের অন্যান্য
দশকের লেখকদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়।
এহ্সান
: একটা
বই
প্রকাশ করা আর একটা ভাল গল্প লেখা, কোনটা আপনাকে বেশি তৃপ্তি দিবে?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : অবশ্যই একটা ভালো গল্প বা
উপন্যাস লেখা। বই প্রকাশের তো প্রশ্নই ওঠে না যদি না ভালো কিছু লিখে উঠতে পারি!
এহ্সান
: এবার বই মেলায় আপনার গল্পের বই আসেনি। পরবর্তী
বই
নিয়ে
আপনার কি চিন্তা?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল :
অনেকগুলো গল্প অগ্রন্থিত অবস্থায় পড়ে আছে। অনেক প্রবন্ধ,
মুক্তগদ্য, নভলেটও আছে। এই বইমেলায়ও সেগুলো নিয়ে বই হতে পারতো, ব্যক্তিগতভাবে খুব
বিপর্যস্ত সময় কাটিয়েছি বলে হয়ে ওঠেনি। দেখা যাক, আগামীতে পেরে উঠি কী না। যদি
গোছাতে পারি তাহলে একটা গল্পগ্রন্থ করবো যার নাম ঠিক করে রেখেছি ‘এখনো কোথাও মায়া রহিয়া গেল’। এই
পঙক্তিটা কমলকুমারের। কী যে অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় একটা পঙক্তি! বুকের ভেতরটা দুলে
ওঠে। ধার করবো নামটা, তাঁর কাছ থেকে।
এহ্সান
: আপনার না লেখা কোনো গল্প আছে, যা আপনি লিখতে চান?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল :
অসংখ্য আছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমার লেখা গল্পের চেয়ে
না লেখা গল্পের সংখ্যাই বেশি। কে জানে, আদৌ সেগুলো কোনোদিন লিখে উঠতে পারবো কী না!
এহ্সান
: এক বসায় গল্প লেখেন
না
ধীরে
ধীরে, কেঁটে-ছিড়ে লিখে থাকেন? গল্পের গাঁথুনি কিভাবে
তৈরি করেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : এরকম সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাপার নেই
আমার ক্ষেত্রে। এক বসায়ও লিখেছি কোনো কোনো গল্প, আবার দু-তিন দিনে লিখেছি কোনোটা,
এমনকি কোনো কোনো গল্প লিখতে বছরখানেক সময়ও লেগেছে। এগুলো আসলে কীভাবে হয়, বলা
মুশকিল। সম্ভবত লেখার পর একটু দূর থেকে তাকিয়ে দেখলে, মানে লেখক হিসেবে না দেখে
পাঠক হিসেবে দেখলে, হয়তো কোনোটিকে সম্পূর্ণ মনে হয়, কোনোটিকে মনে হয় অসম্পূর্ণ। এই
অসম্পূর্ণগুলোকে নিয়েই সমস্যা, ওরা ছাড়তে চায় না আমাকে, আমিও ছাড়তে পারি না
ওদেরকে।
এহ্সান
: গল্প লেখার কোনো অতৃপ্তি আছে কি?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : প্রচুর অতৃপ্তি। বস্তুত অতৃপ্তিই
আমাকে ঠেলে দেয় আরেকটি গল্প লেখার দিকে। লিখিও। কিন্তু অতৃপ্তি তাতে ঘোচে না।
এহ্সান
: আজকের দিনে সবাই যখন উপন্যাসের
দিকে
ঝুঁকছে, আপনি সেখানে ছোটগল্পকে
কিভাবে দেখছেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : শুধু আজকের দিনে কেন, সবসময়ই তো উপন্যাসের
দিকে ঝুঁকেছিল
লেখক-পাঠকরা, তাতে ছোটগল্পের আবেদন তো ফুরায়নি! ফুরাবেও না। উপন্যাস উপন্যাসের
জায়গায় থাকবে, গল্প থাকবে গল্পের জায়গায়। কেউ কারো জায়গা দখল করতে পারবে বলে মনে
হয় না।
এহ্সান
: লেখক প্রস্তুতি হিসেবে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি,
ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, বিশেষত দেশিয় সাহিত্যপাঠ ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে
অনেক অবশ্য এত গভীরে
যেতে চান না। আপনার কাছে এগুলো কেমন মনে হয়?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : পড়া এবং পড়া ছাড়া কেউ লেখক হতে
পারে নাকি? আমার তো মনে হয় না।
এহ্সান
: ভাল গল্প বলতে আপনি কোনগুলোকে
বোঝেন, মানে আপনার চোখে কোন গল্পগুলো
ভাল? আপনার সমসাময়িক
সাহিত্যিকদের মধ্যে কার কার
সাহিত্য আপনার ভাল লাগে, নতুন কারা ভাল করছেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : একটা ‘ভালো’ গল্প পড়লে মনের ভেতরে
কোথাও না কোথাও একটা চোখ খুলে যায়, দেখার একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়, কিংবা
বুকের মধ্যে কোথাও যেন আলো জ্বলে ওঠে। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে সব
গল্প-পাঠকেরই এরকম অভিজ্ঞতা হয় বলে ধারণা করি। আমাদের সময়ে অনেকের লেখাই আমার ভালো
লাগে। আমাদের পরেও কেউ কেউ ভালো লিখছেন। আলাদাভাবে নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন দেখছি
না।
এহ্সান
: আমাদের দেশে শুধু লেখালেখি করে জীবন যাপন করেছেন বা সমৃদ্ধ হয়েছেন এমন খুবই
কম। অথচ লেখালেখিতে পেশাদারিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেখালেখির বাণিজ্যমূল্যও খুবই কম। তাহলে পেশাদারিত্বের সঙ্গে জীবন মেলাবেন
কিভাবে? কিংবা লেখালেখির বাণিজ্যিক মূল্য থাকাটাই বা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে
করেন?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : মেলানো সম্ভব নয়। শুধু লেখালেখি
করে এ দেশে জীবন-ধারণ করা অসম্ভব। পেশাদারিত্ব তাই বহুদূরের ব্যাপার। আর বাণিজ্যিক
মূল্য? এটা সৃষ্টি করার দায়িত্ব লেখকের নয়, প্রকাশকের। লেখকের কাছে তাঁর লেখা হলো ‘সৃষ্টি’ আর প্রকাশকের কাছে ‘পণ্য’। প্রকাশকরা পেশাদারি হলেই কেবল অধিকতর
পাঠকের কাছে পৌঁছে যেতে পারে একটি বই, বিক্রি হতে পারে অধিক সংখ্যায়, এবং লেখকরাও
উপকৃত হতে পারেন এর ফলে। কিন্তু লেখকদের পক্ষে নিজ উদ্যোগে এরকম কিছু করা অসম্ভব
ব্যাপার।
এহ্সান
: বলা হচ্ছে একদিন সবকিছু ভার্চুয়াল বা কৃত্রিম জগতের আয়ত্বে চলে
আসবে। এর মাঝে বইয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল : কোনোদিনই ‘সবকিছু’ ভার্চুয়াল জগতের আয়ত্বে চলে যাবে না, কারণ, ওই জগৎ যতই মোহনীয় মনে হোক না কেন,
মানুষ বাস করে বাস্তব জগতে, বাস্তবে তাকে ফিরতেই হয়। আর ওই মোহও ক্ষণিকের,
দু-চারদিন পর কেটে যায়। ভার্চুয়াল জগতের এই রমরমা সময়েও সারা পৃথিবীতে বইদের কদর
কমেনি, ভবিষ্যতেও কমবে না।
এহ্সান
: লেখার ধারা সব সময়ই বদলায়। এক এক সময় এক এক ধারা উৎভব হয়, সামনে
আসে, জনপ্রিয়তা পায়। এই মুহূর্তে বিশ্বসাহিত্যের যে জনপ্রিয় ধারা, মানে যা বহুল পরিচিত-চর্চিত
হচ্ছে, তার সঙ্গে সমসাময়িক বাংলাসাহিত্যের ভেতর মূল পার্থক্যটা কোথায়?
আহমাদ
মোস্তফা কামাল :
বিশ্বসাহিত্যের কোন ধারাটি এখন জনপ্রিয় বা বহুল-চর্চিত? আসলেই কি এমন কোনো ধারা
থাকতে পারে যা পুরো বিশ্বসাহিত্যকে ডমিনেট করে? আমার তা মনে হয় না। প্রতিটি দেশের
সাহিত্য আলাদা, আলাদাভাবেই তাদের চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করা ভালো।
এহ্সান
: আপনি কি বাংলাদেশের বর্তমানে রচিত গল্পগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট? একটু বিস্তারিত
যদি বলেন।
আহমাদ
মোস্তফা কামাল :
বর্তমানের সব গল্পই তো আর পড়া হয় না, বিস্তারিত বলা একটু
কঠিনই। তবে এক সময় আমি প্রচুর গল্প পড়েছি, দুই বাংলায় যাঁরা গল্প লেখেন তাঁদের
প্রায় সবারই দু-চারটে গল্প পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি,
এমন অনেক লেখক আছেন যাঁরা হয়তো ততটা শক্তিমান নন, কিন্তু সবারই অন্তত একটি
উঁচুমানের গল্প আছে। আর শক্তিমান লেখকদের আছে একাধিক উঁচুমানের গল্প। উঁচুমান বলতে
আমি বোঝাচ্ছি—বিশ্বমানের গল্প। অর্থাৎ পৃথিবীর যে-কোনো ভাষার মহৎ
গল্পগুলোর পাশে বাংলা সাহিত্যের এসব গল্পকে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়। বর্তমানের গল্পও
তো সেইসব গল্পেরই উত্তরাধিকারী। খুব খারাপ হওয়ার কথা নয়।
এহ্সান : লেখালেখিতে এখানে অল্প হলেও কিছু পুরস্কার দেয়া হয়। সেগুলো অর্থ মূল্য আদৌ
সম্মান জনক কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তার চেয়ে বড় কথা, পুরস্কারের জন্য
সাহিত্যের মান বিচার নিয়ে প্রায়ই গুরুতর অভিযোগ বা যোগসাজোসের প্রশ্ন ওঠে। একজন
লেখকের জন্য পুরস্কার কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কি মন্তব্য?
আহমাদ মোস্তফা কামাল : আপনার এ প্রশ্নের উত্তর
দিতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষের একটা সাক্ষাৎকারের
কথা মনে পড়লো। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল : ‘বাংলা সাহিত্যের এমন
তিনটা নাম বলুন যাঁদের এক্ষুণি আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া উচিত—তদবির করে নয়, আপনার মতো যোগ্যতার
ভিত্তিতে।’
উত্তরে তিনি বলেছিলেন : ‘কিন্তু কী করে জানলেন যে আমিও তদবির
করেই পাইনি? কথাটা কি জানেন, অল্প দু-চারজনেই হয়তো করে এসব কাণ্ড, কলঙ্কটা পৌঁছয়
সকলের গায়ে। যাঁদের আমরা পছন্দ করি না, তাঁরা পুরস্কৃত হলেই রাগ করে ধরে নিই যে এর
মধ্যে কোনো অসাধুতা আছে। অর্থাৎ আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দই হচ্ছে
যোগ্যতা-অযোগ্যতা এবং সাধুতা-অসাধুতার মাপকাঠি।’
তাঁর
এই কথাগুলোর ভেতরেই আপনার প্রশ্নের উত্তর আছে। ওই যে ‘প্রায়ই
গুরুতর অভিযোগ বা যোগসাজসের প্রশ্ন’ ওঠার
কথা বললেন, এই প্রশ্নগুলো কারা তোলেন? খেয়াল করলে দেখবেন—অপছন্দের
কেউ পুরস্কার পেলেই এই অভিযোগটি তোলে অন্যরা। কিন্তু সত্যিই কি সবাই এইসব
যোগাযোগ-যোগসাজস করে পুরস্কার হাতিয়ে নেয়? যে পুরস্কারগুলো প্রচলিত আছে এ দেশে
সেগুলো কি এতই মহামূল্যবান যে ‘যোগসাজস’
ছাড়া সেগুলো পাওয়ার যোগ্যতা কোনো লেখকেরই নেই? একজন লেখক কি তাঁর লেখার গুণে
পুরস্কৃত হতে পারেন না? কেন এই সম্ভাবনাটি কেউ মাথায় রাখেন না? একজন কেউ পুরস্কার
পেলেই অন্যরা এমনভাবে চেঁচাতে থাকেন যে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি লজ্জায় মিইয়ে
থাকেন। এত ঈর্ষা কেন? এত ঘৃণা কেন? কেন এত বিদ্বেষ? একটা পুরস্কার এমন কি বড়ো
ব্যাপার যে আপনারা এ নিয়ে এত এত কথা বলেন?
বলাবাহুল্য
যে, পুরস্কার কখনো একজন লেখকের লেখার গুণগত মানের পরিবর্তন আনতে পারে না। এটা
স্রেফ সামাজিক স্বীকৃতি। এ দেশে তো লেখালেখিকে কোনো কাজ বলেই গণ্য করা হয় না, বরং
লিখতে গিয়ে একজন মানুষ হয়ে পড়েন নিঃসঙ্গ, সামাজিক জীবন থেকে বিযুক্তি ঘটে যায় তার,
পারিবারিক জীবনেও সময় দিতে পারেন না সেভাবে। এরকম একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর
পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন। ওই দু-একটি পুরস্কার পেলে সেই
পারিবারিক-সামাজিক জীবনে হয়তো তাঁর একটু সম্মান জোটে। পুরস্কারের অর্থ দিয়ে হয়তো
তিনি ঋণ শোধ করেন, দু-একটা শখের জিনিস কেনেন—এটুকুই তো! অথচ এ নিয়ে কত গঞ্জনাই না
তাঁকে পোহাতে হয় সহযাত্রী লেখক-কবিদের কাছ থেকে! এটা দুঃখজনক। দু-একজনের
কর্মকান্ডের ভার সবার কাঁধে চাপানোর এই প্রবণতাটা যে কবে দূর হবে!
লেখক পরিচিতি
আহমাদ মোস্তফা কামাল
আহমাদ মোস্তফা কামালের জন্ম ১৪
ডিসেম্বর ১৯৬৯-এ। পড়াশোনা : পাটগ্রাম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, মানিকগঞ্জ থেকে এসএসসি; নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএসসি ও এমএসসি; এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ও পিএইচডি। ছাত্রজীবনে প্রতিটি স্তরে রেখেছেন দুর্দান্ত মেধার সাক্ষর, কিন্তু যাবতীয় বৈষয়িক সাফল্যের সম্ভাবনাকে নাকচ করে শুধুমাত্র লেখালেখিকেই
জীবনের সকল স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছেন। পেশাগত জীবনের শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। বর্তমানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ-এ কর্মরত।
লেখালেখির শুরু ’৯০ দশকের গোড়া
থেকেই। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দ্বিতীয় মানুষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে, এরপর আরো সাতটি গল্পগ্রন্থ, ছয়টি উপন্যাস, চারটি প্রবন্ধগ্রন্থ ও একটি মুক্তগদ্যের সংকলন প্রকাশিত
হয়েছে। সম্পাদনা করছেন আরো বারোটি গ্রন্থ। তাঁর চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ‘ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ্য’ ২০০৭ সালে লাভ করেছে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ পুরস্কার, দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অন্ধ জাদুকর’ ভূষিত হয়েছে ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার ২০০৯’-এ এবং তৃতীয় উপন্যাস ‘কান্নাপর্ব’ ২০১২ সালের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে লাভ করেছে ‘জেমকন সাহিত্য পুরস্কার ২০১৩।’০
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর
পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে।
কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত
অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন মানিকগঞ্জের
সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ(ইন্টারমিডিয়েট) ও ঢাকা কলেজে(অনার্স-মাস্টর্স)। ছাত্র জীবন থেকেই
বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ
লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের
কাজ চলছে।০
0 মন্তব্যসমূহ