গল্পকারের সাক্ষাৎকার : রায়হান রাইন
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: অলাত এহ্সান
[কবি ও
গল্পকার রায়হান রাইন। ছাত্র অবস্থায় কবিতার মধ্যদিয়ে আত্ম প্রকাশ। ক্রমেই সাহিত্যের
অন্যান্য ধারায় বিস্তৃত হয়েছে তার লেখা। সাহিত্য সিদ্ধিতে তার হাতে ভরে ওঠছে সমৃদ্ধ
দ্যোতনায়। অনুবাদ ও গবেষণা যুক্ত হয়েছে অভীপ্সা-অনিদ্দিষ্টতা থেকে। শিক্ষাজীবনের মতো
সাহিত্যেও তিনি মেধাবী ও মননশীল। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। দর্শনে পড়ালেখা এবং
ওই বিষয়েই অধ্যাপনা করার সুবাদে তার সাহিত্যে দর্শনের মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়েছেন।
তবে তিনি
চাপিয়ে দেন না কিছুই। বরং গল্পের সাধারণ চরিত্রে-জীবনে মিশে থাকা দর্শনের আভাস পাওয়া
যায়। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গল্পের যৌক্তিক প্রকরণ ও কলাকৌশল। তার যাত্রা সাহিত্যেরই
দিকে। সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছে সম্প্রতি। সাহিত্যের মতো সাক্ষাৎকারেও
তিনি গভীর মনন আর চিন্তার অনুসারি। সম্প্রতি তার সঙ্গে গল্পলেখার কৌশল-সাহিত্য ভাবনা-সামকালিন
সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছেন গল্পকার অলাত এহ্সান]
অলাত এহ্সান : গল্পকার হিসেবে আপনার প্রস্তুতি
ও চর্চা অনেক দিনের, ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে
৩টি গল্পগ্রন্থ।
তা গল্পলেখা শুরু করলেন কবে?
রায়হান রাইন : প্রথম গল্প লিখি ১৯৯৬ সালে, ‘নিসর্গ’ ছোটকাগজে। গল্পটার
নাম ছিল ‘এক অনার্য যুবকের ভ্রমণপথ’। মনে পড়ছে, কোনো এক দুপুর বেলায় জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির বারান্দায় বসে গল্পটির কিছু অংশ একটা
নোটবুকে লিখেছিলাম, কিছু অংশ লিখেছিলাম বটতলায় আনোয়ার ভাইয়ের দোকানের ফাঁকা
বেঞ্চিতে বসে, ছিয়ানব্বুয়ের গ্রীষ্মের কোনো দুপুর কি বিকালবেলায়।
অলাত এহ্সান : এ-বছর বই মেলায় আপনার কি কি বই প্রকাশ
হয়েছে, কারা করেছে?
রায়হান রাইন : এ বছর কোনো বই প্রকাশিত হয়নি।
অলাত এহ্সান : আপনার সর্বশেষে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ
‘স্বপ্নের আমি ও অন্যরা’ বেরিয়েছে গত বছর। এটা আপনার
তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। কতদিন
ধরে লেখা গল্পগুলো
এই বইতে যুক্ত হয়েছে?
রায়হান রাইন : ‘স্বপ্নের আমি ও
অন্যরা’ বইয়ের গল্পগুলো বেশ আগের। ২০০১ সালের পর থেকে কিছু গল্প
লিখেছিলাম খুব ভিন্ন ধাঁচে। স্বপ্ন যেভাবে তৈরি হয়, সেই কাঠামো ব্যবহার করে
গল্পগুলো লেখা। কাগজে প্রকাশের পর কেউ কেউ এসব গল্পকে ফ্যান্টাসি বা হ্যালুচিনেটরী
বলে একেবারেই ঝেড়ে ফেলছিলেন। তখন এসব গল্প প্রকাশের ব্যাপারে একটা দ্বিধা কাজ
করছিল। কিন্তু পরে কিছু পাঠক গল্পগুলোর ব্যাপারে উৎসাহী হলে এগুলোকে গ্রন্থভুক্ত
করার কথা ভাবি। ৭/৮ বছর সময় ধরে বিভিন্ন সময়ে এসব গল্প লেখা।
অলাত এহ্সান : এই সময় ধরে লেখা
গল্পগুলোর মধ্যে আপনি পরিবর্তন
লক্ষ্য করেছেন কি?
রায়হান রাইন : আঙ্গিকের বদল হয়নি। তবে গল্পের ট্রিটমেন্টের ধরন বদলেছে
নিশ্চয়ই। যেমন মনে করতে পারি, ‘মৃত্যুর অধিবিদ্যা’, ‘ধর্মরহস্য’, এই গল্প দু’টিতে
স্বপ্নের সংগে মিথিক্যাল এলিমেন্টের সংশ্লেষ ঘটিয়েছি। আবার কিছু কিছু গল্প কবিতার
খুব নিকটবর্তী হয়েছে। এ-রকম গল্পের মধ্যে আছে ‘অভিভাবন’ এবং ‘কালচক্র’। বেশির ভাগ
গল্পই স্বপ্নের প্রতীক তৈরি হবার স্বাভাবিক গতিকে অনুসরণ করে লেখা।
এহ্সান : এই বইতে ২০টি গল্প আছে। গল্পগুলো
কি
কি
বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা?
রায়হান রাইন : নির্দিষ্ট বিষয় নেই, যেমন স্বপ্নেরও কোনো নির্দিষ্ট বিষয়
নেই। তবে গল্পগুলির কেন্দ্রে আছে একজন ‘আমি’। যেমন সব স্বপ্নের ভেতরই ছায়ার মতো
রয়ে যায় এই ‘আমি’। বস্তুত তাকে ঘিরেই অন্যরা এবং অন্য সমস্ত ঘটনা আবর্তিত হয়। এসব
গল্পঘটনার অর্থপূর্ণতা জীবনব্যাপী।
এহ্সান : গল্পগুলো লেখার গল্পটা বলুন।
রায়হান রাইন : ঠিক গল্প নয়, ঘুমের ভেতর স্বপ্ন কিভাবে
তৈরি হয়, তা নিয়ে কৌতূহল ছিল। স্বপ্নের ইমেজগুলোকে যখন আমরা বর্ণনা করি তখন সেসবের
ভেতর একটা আন্তসম্পর্ক তৈরি করি, তা যত অ্যাবসার্ডই হোক। কিন্তু পরিণামে তা একটি গল্প
হয়ে ওঠে। এসব গল্পকে হয়তো উপমা-গল্প বলা যায়। কিন্তু একটা ব্যাপার ভাববার ছিল যে,
এসব ফ্যান্টাসির মূল্য কোথায়? ভেবেছি, শক্তিশালী ইমেজগুলোকে যদি পুঁতে দেয়া যায়
এমন কিছুর ভেতর যা বেঁচে থাকার অনিবার্য অনুষঙ্গ, তবে হয়তো এর একটা মূল্য তৈরি হয়।
এসব ভাবনাই গল্পগুলোর পেছনে কাজ করেছে।
এহ্সান : গল্প লেখার জন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ উৎস। একটি ঘটনা বা অভিজ্ঞতা
কি
করে
আপনি
গল্পে রূপান্তর করেন? গল্পগুলোতে আপনার
ব্যক্তিগত ছাপ কিভাবে এসেছে?
রায়হান রাইন : নিশ্চয়ই। ব্যাপারটা কিভাবে ঘটে তার কোনো সূত্র নেই। একটি
গল্প লেখার কৌশল অন্য আরেকটি লেখার ক্ষেত্রেও কোনো পথ দেখায় না। বিশেষ একটি
'অভিজ্ঞতা'ই বিশেষ একটি পথ দেখায়, যেভাবে লিখলে তা একটি নান্দনিক ঘটনা হয়ে উঠবে বা
বিশেষ একটি ব্যাপারকে পাঠকের সংগে কমিউনিকেট করা যাবে। লিখবার প্রক্রিয়ায় যে
বাক্যবিন্যাস যে শব্দচয়ন কি লিখব কি লিখব না'র যে হিসাব সবকিছুর ভেতর একটি
ব্যক্তিগত ছাপ পড়তে থাকে।
এহ্সান : শুধু উস্থাপনের স্টাইল দ্বারা তো আর
একজন গল্পকার মহৎ বা কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠেন না। চিন্তার-দেখার বৈচিত্র্য ও গভীরতা দরকার হয়। আপনি গল্পগুলোতে জীবনের তেমন কোনো সত্য আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন?
রায়হান রাইন : দেখার বৈচিত্র তো দেখার ভেতরেই থাকে। একই ঘটনাকে সবাই একই চোখে দেখেন না। কোনো
একটি ঘটনাকে যিনি যত বেশি অন্যান্য বিষয়ের সংগে যুক্ত করে দেখেন তার দেখাটা তত
বেশি গভীর। অর্থাৎ দেখার গভীরতা থাকে বিষয়বস্তুর বিভিন্ন অংশের ভেতর সম্পর্ক তৈরির
ভেতর। আর, যা যা জীবনের তার সবই তো জীবনের সত্য। ইতোমধ্যে যে সত্যের উন্মোচন হয়ে
গেছে তা নিয়ে গল্প লিখে কি আর হবে। ইতিহাসের বদল ঘটে যাবার সংগে সংগে গল্প লেখার
কতই তো নতুন বিষয় এসেছে, মানুষের সাইবার পরিচয়, সাইবার জগৎ, পোস্ট হিউম্যান
এফেয়ার্স, প্রযুক্তি ও পুঁজিসৃষ্ট মানুষের নতুন নতুন অভিলাষ, সাইবার যৌনতা, অদ্ভুত
অর্থহীন নানা মৃত্যু কত কি যে নতুন আর বিচিত্র বিষয় এসে গেছে আমাদের চারপাশে যা
নিয়ে গল্প লেখা হতে পারে। গল্পের প্রধান কাজ মনে করি নতুন সময়ে জীবনের ঘটনাবলির যে
নতুন মানে তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত তাকে আবিষ্কার করা।
এহ্সান : গল্পের বিষয়বস্তু
আপনি
কি
ভাবে
নির্ধারণ করেন? গল্পের বিষয়বস্তুর
নির্বাচনের সঙ্গে তো দর্শনের
একটা
যোগাযোগ আছে।
আপনি
গল্পে তেমন কি কোনো দর্শনের
প্রতিফলন বা প্রভাব দেখাতে চেষ্টা করেছেন?
রায়হান রাইন : আগেই বলেছি গল্পকারকে জানতে হয় কোন গল্পটি তিনি লিখবেন
আর কোনটি লিখবেন না। দু’দিক থেকে কথাটি সত্য। কিন্তু মানে একটাই। প্রথমত বিষয়বস্তু
বাছতে ভুল করা যাবে না। অনেক গল্প যা নিয়ে লেখার দরকার নেই। হতে পারে বিষয়টি নিয়ে
লেখা আগেই হয়ে গেছে। কিংবা গল্পটিতে নতুন মানে সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। দুই. এমন
বিষয় বেছে নেয়া যাবে না যা দিয়ে গল্পকারের নিজের ধরনের শক্তিমত্তা দিয়ে যুৎসইভাবে
গল্পটি তৈরি হতে পারবে না। এই বাছাবাছির ভেতর নিজের সংগে বিষয়বস্তুর সঠিক বোঝাপড়া
তৈরি হয়।
গল্পে কোনো বিশেষ দর্শনের প্রতিফলন ঘটানো আমার উদ্দেশ্য
থাকে না। তবে বিষয়বস্তু নিজেই যদি কোনো নতুন এবং কোনো বিশেষ দৃষ্টিকে ধারণ করে তবে
তা হতে দেয়াই সমীচীন হবে।
এহ্সান : আপনার গল্পগুলোকে
কি
কোনো
বিশেষ ধারা বা ঘরাণার-যেমন মার্কসবাদী, জীবনবাদী, নারীবাদী, ফ্রয়েডিয়
ইত্যাদি বলে মনে করেন?
রায়হান রাইন : না। একদমই না। তেমন মনে করবার কোনো কারণ নেই। কোনো বিশেষ ঘরানার হয়ে ওঠাটা
গল্প লেখার সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় কোনো সাহায্যই করে না।
এহ্সান : আমরা দেখি বাংলা সাহিত্যে
উত্তারাধিকারের ধারা বহন করেছেন অনেক লেখক। আপনি
নিজেকে কোনো সাহিত্যধারার
উত্তরাধিকারী মনে করেন?
রায়হান রাইন : বিশেষ কোনো সাহিত্যধারা নয়। বাংলা সাহিত্যের সমস্ত ধারা
তো বটেই বিশ্বসাহিত্যের নানা ধারার উত্তরাধিকারী নিজেকে মনে করি আমি। যোগাযোগের
দ্রুততার কারণেই যে লেখা গতকাল নিউইয়র্কারে ছাপা হচ্ছে আমরা কিন্তু সেদিনই তা পড়তে
পারছি। আমরা জানি, লাতিন আমেরিকায় এখন কেমন লেখা হচ্ছে কিংবা জাপানে। ফলে নিজেদের
সাহিত্যের পাশাপাশি আমরা এখন বিশ্বসাহিত্যেরও উত্তরাধিকারী।
এহ্সান : বাংলা সাহিত্যে
এখন
উত্তরাধুনিক সাহিত্যের নামে একধরনের
সাহিত্য চর্চা হচ্ছে, এতে ব্যক্তি
স্বাতন্ত্রকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তাই প্রত্যেক
গল্পকার তার স্বাতন্ত্র
নিয়ে
ভাবেন, এটা অবাঞ্চিত
কিছু
নয়। এই ব্যক্তি
স্বাতন্ত্র আমাদের সাহিত্যের
কি
রূপ
দিচ্ছে?
রায়হান রাইন : প্রথমেই বলি, বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধুনিক অংশকে আলাদা করার বিপত্তি আছে।
যদি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে এই সাহিত্যের একটা বৈশিষ্ট্য ধরা হয় এবং আমরা দেখি যে, এই
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বাংলাদেশের জন্য আধুনিক-পূর্ব ব্যাপার তবে এই বিপত্তি বাধবেই।
ব্যক্তিবাদ কত আগের ব্যাপার আসলে? সাংস্কৃতিক বিকাশের মূলে যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র
কাজ করে তা আমাদের ইতিহাসের আদি থেকেই ছিল। যে নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলো আমাদের
সংস্কৃতির ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে দিয়েছেন, যে বিশ্বাসধারা আমাদের রক্তস্রোতের ভেতর
দিয়ে বয়ে চলেছে তার ভেতর আছে আত্ম-অন্বেষণ, আত্মের উৎকর্ষ, ব্যক্তিত্বের বিকাশ
ইত্যাদি। যদিও এর পাশাপাশি যে বস্তুটির অভাব ছিল তা হচ্ছে, পশুর সংহতি, যাকে
রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে দেখা যায়। ফলে, আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ, ধর্মের বিকাশ,
সাহিত্য-শিল্পের বিকাশ যেমন হয়েছে তেমন বিকাশ হয়নি রাষ্ট্র নির্মাণে, এমনকি আমাদের
সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও খুব দুর্বল। আমাদের সাহিত্যের গোড়ার দিক থেকেই দেখব,
সাহিত্যকারগণ স্বতন্ত্র হতে চেয়েছেন। সরহ, ভুসুকু আর শান্তরক্ষিতে বিস্তর ব্যবধান।
ব্যবধান আছে মাধবাচার্যে আর লালনে। আবার ঈশ্বরগুপ্ত, মধুসূদন আর রবীন্দ্রনাথে এই
স্বাতন্ত্র বা একই কালে দু’জন সাহিত্যিকের ব্যক্তিত্বের ভেদ স্পষ্ট দেখতে পাব। তার
জন্য এসব সাহিত্যিককে উত্তর আধুনিক হবার জরুরৎ নাই।
এহ্সান : সাহিত্যের
দশক
বিচার প্রচলিত আছে। আপনি আপনার দশককে কিভাবে উপস্থাপন
বা
চিহ্নিত করছেন?
রায়হান রাইন : স্থানকে ভাগ করার মতো কালকেও ভাগ করা হয়ে থাকে। কিন্তু
স্থান ও কাল উভয়ই নীরবচ্ছিন্ন ব্যাপার। এদের ভাগ করা হয় কিছু ব্যবহারিক সুবিধা
থেকে। জমির আইল দিয়ে স্থানকে ভাগ করার একটা বড় জরুরৎ তৈরি হয়েছিল ব্যক্তিমালিকার
উদ্ভবের পর। ‘এই জমিটুকু আমার’ এ-রকম একটা ধারণা স্থানকে ভাগ করার মূলে কাজ করেছে।
সময়কে জীবন পরিধি দিয়ে ভাগ করা হয়, আরও নানা কারণে যুগ, শতক, সহস্রাব্দ ইত্যাদি
নামে সময়কে ভাগ করা হয়। দশকও তেমনি। সাহিত্য আলোচনায় যখন দশক ভাগ করা হয় তখন এর
মূলে ব্যক্তিমালিকানা বা ব্যক্তি-অস্তিত্বের সংগে একটা সময়কে যুক্ত করা হয়। যেমন
লেখকেরা বলে থাকেন, ‘এটা আমার দশক’। কিংবা ‘আমি আশির দশকের’। দশক বিভাজন তাই পরিচয়
নির্মাণেরও একটা হাতিয়ার। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা যদি সময়কে বস্তুগত অর্থে ধরে
নিই, তো একই সময়ে অনেক লেখকই লিখছেন যারা অন্য কোনো দশকে লিখতে শুরু করেছিলেন। ধরা
যাক, যখন শূন্যের দশক চলছে, তখন কিন্তু ষাট-সত্তুর-আশি-নব্বুইয়ের দশকের লেখকেরাও
লিখছেন, কিন্তু দশক বিভাজন করে একদল লেখক নিজেদের আলাদা করলেন কিংবা একটা সময়কে
নিজেদের অস্তিত্বের সংগে যুক্ত করলেন, একটা দশক নিয়ে কথা বলার সময় অন্য লেখকদের
বাদও দেয়া গেল। এসব কারণে দশক বিভাজন লেখকদের অস্তিত্বরক্ষা ও পরিচয়ের রাজনীতির
একটি উপাদান।
এহ্সান : একটা বই প্রকাশ করা আর একটা ভাল গল্প লেখা, কোনটা আপনাকে বেশি তৃপ্তি দিবে?
রায়হান রাইন : বই প্রকাশের আনন্দ আর লেখার আনন্দের সংগে তুলনা চলে না।
আর লেখা ব্যাপারটা তৃপ্তিদায়ক কিছু না। এটা বেঁচে থাকার অনেক অনেক ধরনের একটি। কেউ
যদি বলেন, বেঁচে থেকে আপনি কেমন তৃপ্তি পাচ্ছেন, তা যেমন অর্থহীন তেমনি লিখে কেমন
তৃপ্তি এ কথা বলাও একই রকম।
এহ্সান : এবার বই মেলায় আপনার গল্পের বই আসেনি।
পরবর্তী বই নিয়ে আপনার কি চিন্তা?
রায়হান রাইন : বই প্রকাশের একটা প্রেগন্যান্ট মোমেন্ট থাকে। ধীরে ধীরে
সেই সময়টা আসে। বাইরে থেকে কোনো শর্ত বই প্রকাশের সংগে যুক্ত হলে বিকলাঙ্গ
শিশুজন্মের মতো ব্যাপার বইয়ের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। পরবর্তী বই কী হবে? উপন্যাস
প্রকাশিত হতে পারে, যে উপন্যাসটি এখন লিখছি। একটা কবিতার বইও হতে পারে। আবার
শান্তরক্ষিতের ‘মাধ্যমকলংকার’ নামের
বইটার অনুবাদ ও সম্পাদনাও বের হতে পারে, উপন্যাস শেষ করার পর যদি সময় পাই, অন্য
কোনো লেখা শুরুর আগে।
এহ্সান : আপনার না লেখা কোনো গল্প আছে, যা আপনি লিখতে চান?
রায়হান রাইন : অবশ্যই। অনেক গল্পই মাথায় আছে যেগুলো একসময় লেখা হতে
পারে। মাথায় থাকতে থাকতে যেসব গল্প বিদায় নেয়, তাদের বিদায় দেয়াই উচিৎ কারণ জরুরৎ
থাকলে মাথার ভেতর থেকে একটা গল্প কখনোই হারাবে না, যত সময় যেতে থাকবে ততই
গল্প-ভাবটির গায়ে রক্তমাংস জমতে থাকবে। অন্যথায় তা হয়তো হারিয়ে যাবে, যদি তা
হারিয়ে যাবার মতোই হয়ে থাকে।
এহ্সান : এক বসায় গল্প লেখেন
না
ধীরে
ধীরে, কেটে-ছিঁড়ে
লিখে
থাকেন? গল্পটা কি আগে ভেবে লিখতে বসেন, নাকি লিখতে লিখতে ভাবেন?
রায়হান রাইন : ‘স্বপ্নের আমি ও অন্যরা’ বইয়ের গল্পগুলো খুবই ছোট ছোট। এগুলোর বেশির ভাগই এক বসায় লেখা। কিন্তু
অন্য সব গল্প এক সপ্তাহের মতোও লেগে গেছে লিখতে। মাথায় গল্পের ভাব না থাকলে লেখা
হবে কি নিয়ে? লিখতে লিখতে নিশ্চয়ই কিছু ডালপালা গজাতে থাকে। সেগুলো গল্পের মূল
ভাবের বিস্তার ঘটায় অবশ্যই। লেখা অনেক সময় বার বার খসড়া করতে হয়।
এহ্সান : আজকের দিনে সবাই যখন উপন্যাসের
দিকে
ঝুঁকছে, আপনি সেখানে ছোটগল্পকে
কিভাবে দেখছেন?
রায়হান রাইন : সবাই কি উপন্যাসের দিকে ঝুঁকছে? ছোটগল্পও লেখা হচ্ছে,
বইমেলায় খোঁজ নিলেই জানা যাবে। তবে ছোটগল্প নিশ্চয়ই মারা যাবে না।
এহ্সান : আমাদের দেশে শুধু লেখালেখি করে জীবন যাপন করেছেন বা
সমৃদ্ধ হয়েছেন এমন খুবই কম। অথচ লেখালেখিতে পেশাদারিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু
লেখালেখির বাণিজ্যমূল্য খুবই কম। তাহলে পেশাদারিত্বের সঙ্গে জীবন মেলাবেন কি ভাবে?
কিংবা লেখালেখির বাণিজ্যিক মূল্য থাকাটাই বা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
রায়হান রাইন : পেশাদারিত্ব শব্দটা দিয়ে কী বুঝব? পেশাদার লেখক কে? লেখকের সংগে লেখার
বাণিজ্যের সম্পর্কটাকে অনেক দুরবর্তী বলে মনে হয়। যেমন আমরা জানি যে, পেশাদার বাবা-মা,
পেশাদার ভাই-বোন বলে কেউ নাই। পেশাদার নারী বললেও বিশেষ নারীদের বুঝা যাবে।
পেশাদার বিজ্ঞানী আসলে কে? কিংবা পেশাদার সংগীত-শিল্পী? লেখক যদি তার লেখার
বাণিজ্যিক মূল্য নিয়ে ভাবতে থাকেন বা তিনি পেশাদার লেখক হয়ে উঠতে চান নির্ঘাৎ তার
লেখার বারোটা বাজবে।
কেবল লেখালেখি করে সেই অর্থে জীবন নির্বাহ করতে চাইতে পারেন কেউ, কেবল লেখাতেই পুরোটা সময় দিতে চাইতে পারেন তারা। কিন্তু এটা একটা সামগ্রিক পরিকল্পনার ব্যাপার। লেখক ভেদে এই পরিকল্পনা আলাদা আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। কেবল মাথায় রাখতে হবে যে, নিজের লেখার অর্থমূল্যের ভাবনা যেন লেখাকে খেয়ে না ফেলে।
কেবল লেখালেখি করে সেই অর্থে জীবন নির্বাহ করতে চাইতে পারেন কেউ, কেবল লেখাতেই পুরোটা সময় দিতে চাইতে পারেন তারা। কিন্তু এটা একটা সামগ্রিক পরিকল্পনার ব্যাপার। লেখক ভেদে এই পরিকল্পনা আলাদা আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। কেবল মাথায় রাখতে হবে যে, নিজের লেখার অর্থমূল্যের ভাবনা যেন লেখাকে খেয়ে না ফেলে।
এহ্সান : বলা হচ্ছে একদিন সবকিছু ভার্চুয়াল বা কৃত্রিম জগতের আয়ত্তে চলে আসবে। এর মাঝে বইয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত?
রায়হান রাইন : বই বেঁচে
থাকবে বলেই মনে হয়। ভার্চুয়াল বই আর শক্ত মলাটের বইয়ের ভেতর তফাৎ অনেক। এই পার্থক্যের
কারণেই আলাদাভাবে বই বেঁচে থাকবে, যে বইটাকে শেলফে রাখা যায় এবং প্রয়োজনে টেনে
নিয়ে পড়া যায়।
এহ্সান : লেখার ধারা সব সময়ই বদলায়। এক এক সময় এক এক ধারা উদ্ভব হয়, সামনে আসে, জনপ্রিয়তা পায়। এই মুহূর্তে
বিশ্বসাহিত্যের যে জনপ্রিয় ধারা, মানে যা বহুল পরিচিত-চর্চিত হচ্ছে, তার সঙ্গে সমসাময়িক
বাংলাসাহিত্যের ভেতর মূল পার্থক্যটা কোথায়?
রায়হান রাইন : একটা বড় পার্থক্য খুব চোখে পড়ে। সেটা হলো বাস্তববাদিতা
আর ফিকশনের পার্থক্য। বাংলাদেশে বেশির ভাগই বাস্তববাদী গল্প-উপন্যাস লেখা হয়।
চল্লিশের দশক থেকে মার্কসবাদের প্রসার এবং পাকিস্তানের স্বপ্নভঙ্গের পর পঞ্চাশের
দশকে সাহিত্যিকদের সমাজ-ঘনিষ্টতা সাহিত্যকে বাস্তবের সংগে আঁটোসাঁটো করে বেঁধে
ফেলেছে। সেই ধারাই এখনো চলছে। কথাসাহিত্য এর বাইরে পা ফেলার সাহস করেনি। বাস্তবের
রক্তমাংসের মানুষ সাহিত্যের বিষয় হবে এতে কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যা প্রকাশভংগির।
বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের কাছে এরকম একটা ট্যাবু তৈরি হয়েছে যে, কল্পনাকে লেখার
ধারে-কাছে ঘেঁষতে দেয়া যাবে না। যে কারণে ফিকশনাল লেখা তৈরি হতে পারেনি আমাদের
সাহিত্যে। ফিকশন যে রক্তমাংসের মানুষ ও মানুষের সমাজকে সাহিত্যে জায়গা দেবে না,
ব্যাপার তা নয়। ফিকশনে কল্পনার ডানা যেখানেই উড়ে যাক তার সুতো আটকানো থাকে
মানুষেরই সমাজে। বিশ্বসাহিত্যে ফিকশনের একটা জোয়ার বইছে। কিন্তু আমাদের সাহিত্যে
এর ঢেউ লাগেনি। যদিও মধ্যযুগের সাহিত্যের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে এই ফিকশনের
অনেক উপাদান চোখে পড়বে। নাথ-সাহিত্যে কিংবা আখ্যান-কাব্যে। কিন্তু এর উত্তরাধিকার
আমরা নিতে পারিনি।
এহ্সান
: লেখালেখিতে এখানে অল্প হলেও কিছু পুরস্কার দেয়া হয়। সেগুলো অর্থ মূল্য আদৌ
সম্মানজনক কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তার চেয়ে বড় কথা, পুরস্কারের জন্য সাহিত্যের
মান বিচার নিয়ে প্রায়ই গুরুতর অভিযোগ বা যোগসাজস কিংবা ঘরানা মেন্টেনের প্রশ্ন
ওঠে। এনিয়ে আপনার মন্তব্য কি? একজন লেখকের জন্য পুরস্কার কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?
রায়হান
রাইন : সাহিত্যে পুরস্কার সাহিত্য-সৃষ্টির জন্য এসেন্সিয়াল
কিছু না। পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা না থাকলে সাহিত্যের ক্ষতির কোনো কারণ হতো না।
পুরস্কারের প্রক্রিয়াটি যদি সম্মানজনকভাবে এবং নিরপেক্ষভাবে হয় তবে তাতে ক্ষতির
কিছু দেখি না। বরং পুরস্কারপ্রাপ্ত একটা ভালো গ্রন্থকে অনেক পাঠকের কাছে পরিচিত
করতে তুলতে পারে। আর অভিযোগ বা যোগসাজস ইত্যাদি দিয়ে যারা পুরস্কার, সাহিত্য
ইত্যাদি করেন তাদের নিয়ে কথা বলে কী আর হবে।
এহ্সান : আপনি কি বাংলাদেশের বর্তমানে রচিত গল্পগুলো নিয়ে
সন্তুষ্ট? একটু বিস্তারিত যদি বলেন।
রায়হান রাইন : সন্তুষ্ট হওয়া বলতে যা বোঝায় তেমন গল্পতো সব সময় প্রত্যাশার জায়গাতেই
থাকে। তবে ভালো গল্প লেখা হচ্ছে বাংলা ভাষায়। তেমন গল্প নিশ্চয়ই কখনো লেখা হবে, যে
গল্প পড়ে অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকা যায়। চারদিকে আবার নতুন করে তাকানো যায়।
মনের ভেতর একটা দারুণ ঘটনা ঘটিয়ে দেবার মতো গল্প পড়ার জন্য সব সময় অপেক্ষা করি।
নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তেমন গল্প লিখবেন।
লেখক পরিচিতি
রায়হান রাইন
জন্ম: ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ, সিরাজগঞ্জ।
অধ্যয়ন: বি এল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, রাজশাহী সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি। জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, দর্শন বিষয়ে।
পেশা: শিক্ষকতা, সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত গ্রন্থগ্রন্থ: আকাশের কৃপাপ্রার্থী তরু, পাতানো মায়ের পাহাড়, স্বপ্নের আমি ও অন্যরা, কবিতা: তুমি ও সবুজ ঘোড়া।
উপন্যাস: আগুন ও ছায়া।
সম্পাদনা: বাংলার ধর্ম ও দর্শন। অনুবাদ: মনসুর
আল-হাল্লাজের কিতাব আল-তাওয়াসিন, পাবলো নেরুদার প্রশ্নপুস্তক।
আগুন ও ছায়া উপন্যাসটি প্রথম আলো
বর্ষসেরা বই-১৪২০ পুরস্কার লাভ করে।০
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর
পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার অদূরে নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। কঠিন-কঠোর জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ও ঢাকা কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে।০
0 মন্তব্যসমূহ