গল্পের জায়গা জমি মানুষ

হাসান আজিজুল হকের গদ্য

আমাদের দেশ ছিল রুখো কর্কশ। গাছপালা প্রায় নেই। খুব বড়ো বড়ো মাঠ। তেপান্তর যাকে বলে। গরমের দিনে ঘাস জ্বলে যায়। মাটির রং হয় পোড়া তামাটে। শরতে সেই মাটিকেই দেখি হাড়ের মতো শাদা। তবে বর্ষায় কুচকুচে কালো রং-এর মাটিও দেখেছি। তিন মাইল চার মাইল লম্বা মাঠ ন্যাড়া। মহীরুহ। তাদের প্রায় সবাই শতাব্দী পেরিয়েছে। এদেরও অবশ্যি নতুন প্রজন্ম আছে। কচি বট অশ্বত্থ। কেউ তাদের গায়ে হাত না দিলে অবহেলায় শত বছর পরমায়ু পাবে। এই রকম বিরল কিছু বড়ো গাছ বাদ দিলে খোলা মাঠে বনফুল। শেয়াকুল, ভয়ানক রাগী জাতের ফণীমনসা কিছু কিছু দেখা যায়, তাদের গায়ে তামাটে ধুলোর পুরু আস্তর, বোশেখ জষ্টির রোদে ওৎ পাতা ভালুকের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে।


এই হলো রাঢ়। কি নির্দয় শুকনো কঠিন রাঢ়। আমাদের দেশ মধ্যরাঢ়। পশ্চিমে মঙ্গলকোট। গায়ে আগাগোড়া পুরনোর ছাপ। মজা দিঘি, পোকায় খাওয়া দাঁতের মতো ক্ষয় পাওয়া বটগাছ, পাতলা পাটালির মতো ইটে গাঁথা বাড়িঘর; দালান-কোঠা মাটির তলায় সেঁধিয়েছে। মঙ্গল কোটের গায়ে অজয় নদী শুকিয়ে গেছে। বছর পাঁচেক আগে শীতের এক সকালবেলায় বড়ো বড়ো দানার লাল বালি পার হয়ে অজয়ের হিম ঠাণ্ডা পানিতে নেমেছিলাম। পানি হাঁটুর উপর ওঠেনি। আমার তিনদিন স্নান হয়নি-- ধুলোয় আগাগোড়া ঢাকা। বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি আঁজলা ভরে নিয়ে মুখে ঝাপটা দিয়েছিলাম। ওপারে বোলপুরের বাস-সড়কের নিচে অজয়ের উঁচু পাড়ে তেলেভাজার দোকানে বারো-চৌদ্দ বছরের একটি মেয়ে চমৎকার আলুর চপ ভেজে খাইয়েছিল মনে আছে। এমন আক্রার দিনেও ভারি শস্তা।

পুবে মালডাঙা। পুরনো জমি। দেশে জমির খুব অভাব-- তাই লোকে আবাদ করে, নইলে এ জমি এমন পাথর, এমন কঠিন রসকষহীন যে আবাদ হতো না। চারদিকে উঁচু উঁচু টিলার মতো। প্রায় গিরি গোবর্ধন। খুবই পুরনো ডাঙা। নদী প্রায় নেই। যা আছে লোকে তাকে কাঁদর বলে। সরু সরু গভীর খাতের নালা। বর্ষায় তীব্র স্রোত হয়।

রাঢ়ের কথা মনে পড়লেই গরমকালের কথা আগে মনে পড়ে। মরুভূমির মতো। তীব্র শাদা কটকটে রোদে সব জ্বলে যায়। ধুলো ওড়ে। গাছপালা ঝোপঝাড় ধুলোয় ঢেকে যায়। জমিতে এই বড়ো বড়ো ফাটল দেখা দেয়। এইসব ফাটলে চোখ দিয়ে উবু হয়ে কতো দিন অন্ধকার পাতালরাজ্য দেখতে চেয়েছি। গাছের ছায়ায় জিব বের করে শেয়াল হাঁপাচ্ছে। বড়ো গাছের কোটর থেকে বা খোলা মাঠের কোনো গর্ত থেকে হঠাৎ খেঁকশিয়াল বেরিয়ে বিদ্যুতের বেগে ছুটে চলে গেছে। রোগা রোগা বেঁটে মেটে রং-এর গরুর পাল রোদের মধ্যে খিদে তেষ্টায় পাগলের মতো ঘাস বা পানি খুঁজছে। শুকনো খড়ের মতো ঘাস, ছিঁড়তে গেলে মাটি শুদ্ধ উঠে আসে। গরু ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে, মোলায়েম ধুলো উড়ে উড়ে যায়। জোর হাওয়া ওঠে কখনো কখনো। ধুলোর গোল থাম আকাশে উড়ে যায়।

এই দেশ যেন দুর্ভিক্ষ আর খিদের জন্য তৈরি হয়েই আছে। কারণ এখানে মানুষও বাস করে। পোড়া কালো রং-এর পাকানো পেশী বের করা মানুষ-- রাঢ়ের মানুষ রাঢ়েয় প্রকৃতিতে বসবাস করে। বরং বলা চলে বাংলাদেশের বহু অংশের চেয়ে অনেক কাল আগে থেকেই এই অঞ্চলে এরা বসবাস করে আসছে। একথার যদি কেউ প্রমাণ চান, তাঁকে ভূতাত্ত্বিকদের কাছে যেতে হবে না, নৃতাত্ত্বিকদের দ্বারস্থ হবারও প্রয়োজন নেই। রাঢ়ের কিছু গ্রাম ঘুরে এলেই হয়। জনপদ যাকে বলে। এমন গ্রাম বাংলাদেশের নতুনজাগা অঞ্চলে দেখিনি। বড়ো বড়ো গ্রাম, শহরের মতো সাজানো চওড়া সড়ক। দুপাশে টিনের বা খড়ো চালের বাড়ির পর বাড়ি। মাটির বাড়ি স্বছন্দে একশো বছর পেরিয়ে যায়। জীবন কাটে ধিকিয়ে ধিকিয়ে-- শত শত বছরেও হয়তো বিশেষ বদলায় না। ইংরেজ চলে যাবার পরেও নয়। চাষবাসের সাজসরঞ্জামে প্রায় কোনো পরিবর্তন নেই। কিছু কিছু ক্যানাল কেটে জলসেচের ব্যবস্থা হয়েছে-- নতুন নতুন সার ব্যবহার হচ্ছে আর কিছু নতুন ফসল। ব্যস-- পরিবর্তন বলতে এই। এছাড়া আর সব বাঁধা ব্যবস্থা। চাষবাস সারা বছরের সবকিছু। জন্মানো বা মরে যাওয়া, বিয়ে বা পালাপার্বণ। এই অঞ্চলে যখন মার্টিন কোম্পানির ছোটো লাইন বসে-- ম্যাটমেটে লাল রং-এর ট্রেন যখন ঢিক ঢিক খচো খচো শব্দে চলতে শুরু করে তার আগে কেমন ছিলো এদিকটা আমি আন্দাজ করতে পারি। শুনেছি তেপান্তরের মাঠে মজা দীঘির পাড়ে ঝুপসি বটতলায় ঠ্যাঙারের দল বসে থাকতো। ঠ্যাঙারে বলা হতো না, বলা হতো মামা-ভাগ্নের দল। তাদের কীর্তি বাংলাসাহিত্যে পরিচিত। আজকেও দেশের দিকে তাকিয়ে এই ব্যাপারে খুব অস্বাভাবিক মনে হয় না। যাই হোক ছোটো লাইনের ট্রেন নিয়ে হয়তো কাব্যি করা চলে, কিন্তু বলতেই হয় খানিকটা গতি এসেছিল বইকি মানুষের জীবনে। মাল আনা নেওয়ার সুবিধে--লোক চলাচলের সুবিধে হয়েছিল। তবে এই সময় থেকেই দুধ ঘি সব্জি শহরের দিকে চলে যেতে থাকে। মনে পড়ে ট্রেনের একটা বেশ বড়ো কম্পার্টমেন্টের গায়ে লেখা ভেন্ডর-- আশেপাশের গাঁয়ের তাবৎ গোয়ারা পিতল কাঁসার ঘড়ায় দুধ ভরে খেজুরের পাতা তাতে চুবিয়ে দিয়ে হতাশ বোকাটে চোখে ঘড়ায় হাত দিয়ে বসে আছে।

রাঢ়ে খুব ফসল ফলে শুনেছি। কিন্তু তার জন্যে যে পরিশ্রম করতে হয়, তা কল্পনা করাও কঠিন। রাঢ়ের চাষির চেয়ে বেশি শরীরের শ্রম করতে আমি আর কোথাও দেখিনি। বারকতক চেষ্টা করে হয়তো দেখা গেল লাঙলের ফাল মাটিতে কিছুতেই বসছে না। যেমন তেমন লাঙল নয়-- মোষের লাঙল। প্রায় এক হাত লম্বা আর সেই অনুপাতে চওড়া ফাল। শুকনো জমি চষে চষে রুপোর মতো শাদা। মোষও তেমনি-- ছোটোখাটো হাতির মতো। দুজাতের মোষের ব্যবহার হয়। হিরণপুরের মোষ কালো ছিপছিপে গড়নের, পাগুলো সরু, খুব ছোটো, বড় বাঁকানো শিং। আফ্রিকার বুনো মোষের মতো দেখতে হয়। আসলেই এগুলো বুনো। গেরস্থের বাড়িতে আসার পর এরা পুরুষত্ব হারায়। অত্যন্ত ছটফটে একগুঁয়ে তেজী জাতের এগুলো। পাঁচন্দিতে পাওয়া যেত বিশাল শরীর ঢিলেঢালা গড়নের মোষ-- ছোটো শিং, মোটা মোটা পা আর থ্যাবড়া খুব। খুবই ধীরস্থির, মন্থরগতি কিন্তু অসম্ভব বলবান। এইরকম মোষের লাঙলও কোনো কোনো জমিতে বসতো না। তখন রাঢ়ের শীর্ণ চাষির হাতে ওঠে গাঁইতি। মাটির এক একটি চাঙর ওঠে বিশাল ওজনের। সেই ভেঙে গুঁড়নো আর রেল রাস্তার কালো পাথর ভাঙার মধ্যে তফাৎ নেই কোনো। এই রকম করে জমি তৈরি করা। ধুলোর আর কাদার চাষের জন্যে আলাদা লাঙল ব্যবহারের ব্যবস্থা। বর্ষা এলে চারা তুলে জমিতে রোয়া। পিঠে আষাঢ়ের বৃষ্টি বা রোদ। দুটোই সমান সাংঘাতিক। আর সেই লোহার তারের মতো লালচে রং-এর ঘাস। চাষার কড়া পড়া হাতের চামড়াও যায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে। এরপর ধান কেটে আঁটি বাঁধা-- একটি একটি আঁটি জোগাড় করে ঢিপি তৈরি করা-- শিল্পীর মতো দরদের সঙ্গে মোষের গাড়ি বোঝাই-- আবার একটি একটি করে আঁটি আছড়ে ধান বের করা। সম্বৎসরের অন্তহীন অকথ্য পরিশ্রমের কাজ। আজো এসবের কোথাও বিজ্ঞান ঢোকেনি এক ফোঁটা। এইরকম কষ্ট বা আরও বেশি অন্য ফসলের বেলায়। আলু, গম, পেঁয়াজ প্রতিটি ফসলের জন্যে মাটির কাছে রাঢ়ের চাষি মাথা কোটে।

কিন্তু এই পরিশ্রম কার জন্যে কে করে? সব হিসেব ভণ্ডুল হয়ে যায় এইখানে এসে। রাঢ়ের একটা এলাকার কথা বলতে পারি। বড়ো চাষি যাকে জমিদার বা জোতদার বলা যায়-- তেমন খুব বেশি নেই এই এলাকায়। অধিকাংশই মাঝারি কৃষক-- দশ থেকে পনেরো বিঘের মতো এদের জমি। তবে দুতিন বিঘে থেকে শুরু করে আট-দশ বিঘের মালিক এমন গৃহস্থের সংখ্যাই বেশি। ভিটেটুকু বাদ দিলে এক টুকরোও জমি নেই-- তেমন লোকও অনেক আছে। মজা দেখতে পাই গত বিশ তিরিশ বছরের মধ্যে। জমির উপর কেবলই সরু সরু আল উঠছে। টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে জমি। পঙ্গপালের মতো লোক বাড়ছে। জমির ভাগীদার-- নতুন মুখ খাবারের জন্যে আকাশে এক ঠোঁট পাতালে এক ঠোঁট নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। আর জমি কেবলি ভাগ হচ্ছে। ভিটে ভাগাভাগি হওয়ায় বসতবাড়ি খণ্ড খণ্ড। থাকার ঘরের পরিসর কমে আসছে। বড়ো বড়ো মাঠকোঠার বদলে আট হাত বাই দশ হাত খুপরি। দশ পনেরো বছরের মধ্যে এক একটা গ্রামের গৃহ বিন্যাস একেবারে বদলে অন্য রকম। ফলে গ্রাম সংলগ্ন জোরালো জমির উপর বসতবাড়ি তৈরি হয়ে হয়ে গাঁ আকারে বেড়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো যৌথ উদ্যোগ নেই--থাকার কথাও নয় অবশ্যি-- প্রতিটি পুরুষ মানুষ আপন স্ত্রী আর একগাদা অপোগণ্ড নিয়ে স্রেফ বেঁচে থাকার লড়াইয়ে গলায় গলায় ডুবে আছে। বছর চারেক আগে এক জমায়েতে আমি গুনে দেখি আমাদের পাড়ায় মোট পুরুষ মানুষ কুল্লে একশো, কিন্তু পাশে যে বাচ্চার দল কিলবিল করছিলো তা গোনার চেষ্টা করতে আমার সাহস হয়নি। জ্যালজেলে কাপড়ের ফাঁক দিয়ে ওদের ধনুকের মতো বাঁকা সরু মাংসহীন ঠ্যাংগুলো আমার নজরে আসে। এদের মধ্যে যুবক প্রউঢ় বৃদ্ধ সবাই ছিল। উৎসবের দিন বলে সবাই সাধ্য মতো ক্ষারে-কাচা হাফ শার্ট ইত্যাদি পরে এসেছে--জবজবে করে তেলও মেখে এসেছে। এক এক করে এদের সকলের মুখের দিকে চেয়ে অকস্মাৎ এক ঝলকের মধ্যে একটা প্রায় আধ্যাত্মিক উপলব্ধি আমার হয়ে যায়। উপলব্ধিটা হলো : এদের কেউই মানুষের জীবন কাটালো না। সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি ইত্যাদির কথা ইয়ার্কি মারা ছাড়া আর কিছুই হবে না-- পশুর সঙ্গে মানুষের জীবনের যদি কোথাও কোনো ভেদরেখা থেকে থাকে সেটা এদের বেলায় লেপেমুছে গেছে। উচ্চ, মধ্য, প্রাথমিক সবরকম শিক্ষার দরজাই এদের জন্যে বন্ধ, তা প্রাথমিক শিক্ষা এদের জন্য বাধ্যতামূলকই হোক আর মাগনাই হোক। মানুষের জন্ম হলেই বাঁচার একটা যন্ত্র সে বিনা পয়সায় পেয়ে যায়--এই হিসেবেই এরা বেঁচে থাকে। তবে কতোদিন যন্ত্রটা চলবে তা কেউ জানে না। বিকল হলে প্রকৃতি দয়া করে দিন কতকের জন্যে মেরামত করে দিলো তো চললো-- না হলে গেল বন্ধ হয়ে। চিকিৎসার ব্যাপার হচ্ছে এই।

রাঢ়ের চাষির ঘরের ছেলের ছাতি আঠারো বিশ বছর বয়সে একবার প্রকৃতির নিয়মে ফুলে ওঠে। দেখবার মতোও হয়। তিরিশ থেকে চুল পাকতে থাকে, দাঁত আলগা হয়ে যায়, শরীরের খাঁচা বেড়িয়ে পড়ে-- চল্লিশের কাছে এসেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, যন্ত্র আর চলবে না। পৃথিবীতে খাদ্য আছে, বস্ত্র আছে, বিচিত্র ঘরবাড়ি, মানুষের হাজার হাজার বছরের সভ্যতা আছে--বিপুল মানব-সম্পদ, বিত্ত আর বৈষয়িকতা আছে, বিজ্ঞান আছে। রা ঢ় তা জানে না। ট্রানজিস্টারে খবর আসে-- উন্নয়নের কথাবার্তা হয়, চাষের উন্নতির জন্যে শলা-পরামর্শ দেয়া হয়। কিছুই যায় আসে না।

এইরকম দেখেছি। মনে আছে ১৯৪৭/৪৮-এর দিকে আমাদের পাড়ায় পাঁচজন বাদ দিয়ে সবাই ম্যালেরিয়ায় কাৎ হলো। গ্রামের একমাত্র এলোপ্যাথ ডাক্তার চাষবাস বাদ দিয়ে ইয়া মোটা সূচের সিরিঞ্জে কুইনাইন ইনজেকশান দিয়ে দু পয়সা কামাতে শুরু করেন। তাঁর পসার দেখে অসহায় হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বাবু ইনজেকশান রপ্ত করতে গিয়ে একজন রোগীর জীবন বিপন্ন করে ফেলেন। আমি দেখেছি। হলুদ আর মেটে রং-এর বড়ি আসে ইস্কুলের মাস্টার মশাইয়ের কাছে। কুইনাইন আর ম্যাপাক্রিন। তাই খেয়ে ম্যালেরিয়া সারে কিন্তু পিলে বেরিয়ে আসে-- কান ভোঁ ভোঁ করে--আফিংখোরের মতো সবাইকে বাধ্য হয়ে এক ঢোক করে দুধ খেতেই হয়। এই সময় আবার কাপড়, কেরোসিন, চিনি নেই। চটের মতো মোটা মিলে শাড়ি পাবার জন্যে কন্ট্রোলের দোকানে মানুষ সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকে।

উদয়াস্ত অকহতব্য পরিশ্রম দিয়ে রা ঢ়ের মানুষ এইসব কিনে আসছে। জমিদার-জোতদারের বিশেষ অত্যাচারের কোনো ব্যাপার নেই--সমাজের নির্মাণ কৌশলটাই এমনি চতুর যে কিছুই বদলাবার জো নেই। জোড়াতালির সেলাই কোথাও চোখে পড়বে না। চিৎকার-হল্লা করে প্রতিবাদ জানানোর প্রয়োজন নেই। কারণ, এমন তো কেউ অত্যাচার করছে না যাকে আঙুল দিয়ে দেখানো চলে। লোক বাড়ছে-- তাতে কার কী দোষ? শরিক বাড়ছে, জমি ভাগ হচ্ছে, বসতবাটি ছোটো হয়ে যাচ্ছে, পুকুর হাতছাড়া, জোয়াল থেকে গরু অদৃশ্য হচ্ছে, নিজের হাল বলদ চলে যাচ্ছে। জমির চাপান নষ্ট হয়ে ফসল কমছে--শুয়োরের মতো দিনরাত খেটেও যে ফসল পাওয়া যায়, তা দিয়ে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষার খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। সবই সত্যি। কিন্তু দোষ কার! এতে যদি খেতমজুর বাড়ে, অন্যের জমি ভাগে চষতে হয়, সেজন্যে কাউকে তো অপরাধী করা যায় না। এ ঠিক নাগরদোলার ঘূর্ণির মতো--ফিরে ফিরে একই জায়গায় এসে দাঁড়ানো।

এই হচ্ছে চিরায়ত রাঢ়। একটু টেনে কথাটা বললে চিরায়ত বাংলাদেশ। বাঙালীদের কথা বলতে গেলেই আমাদের ভদ্রলোকেরা লাফ দিয়ে টুলের উপর দাঁড়িয়ে গলা কাঁপিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলেন, আমাদের অতি প্রাচীন ঐতিহ্য-- বাঙালীদের একটা চিরায়ত সংস্কৃতি-- একটা ইয়ে, একটা ইয়ে আছে। ইয়ে যে আছে তা অস্বীকার করবো না-- তবে সেটা ঐ রকম। এটা স্বীকার করা ভালো এবং এ নিয়ে গর্ববোধ করার চেয়ে লজ্জাবোধ করাই বোধহয় বেশি সঙ্গত। তবু এই নিয়ে শহুরে শিক্ষিত মাঝারি ভদ্রলোকেরা করেন ভণ্ডামি। চোখে তাঁদের বাষ্প আসে আর উপরতলার ওঁরা করেন রাজনীতি। রাঢ়ের চাষির জীবনের একটি ধ্রুপদী গৎ এইখানে আমি বয়ান করি।

হানু শেখ--জন্ম ১৯২০। বাপ মরার সময় পনেরো বিঘে জমি, একটি বিধবা আর চারটি অপোগণ্ড ভাই রেখে গেছে। হানু শেখ ভাই কটিকে পাঠশালে দিয়ে সংসারের জোয়াল ঘাড়ে নিলো। নিজে সে বিয়ে করবে না-- ছোটো চার ভাইয়ের বড়ো ভাই রামচন্দ্র হয়ে থাকবে। পাড়ার লোকে ধরে শেষ পর্যন্ত হানু শেখের বিয়ে দেয় অবশ্যি। এর বছর পনেরো পরের কথা। পাঁচ ভাইয়ের স্বচ্ছল সংসার। সবকটি ভাইয়ের ছাতি ফুলেছে। বাপের রেখে যাওয়া জমি কিছুটা বেড়ে গেছে পর্যন্ত। হানু শেখ নিজে হাটে গিয়ে একজোড়া মোষ কিনে এনে তাদের পায়ের খুর থেকে শিং পর্যন্ত আগাগোড়া তেল মাখিয়ে গলায় ঘণ্টা ঝুলিয়ে পাড়ার লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করে, দ্যাখো তো বাপু, মোষ দুটো কেনলোম, কেমন হইছে?

এরপর জোরজার করে একে একে তিন ভাইয়ের বিয়ে দেওয়া হলো। কিছুতেই তারা বিয়ে করবে না, সংসার ভেঙে যাবে। তবু বিয়ে হয়ে গেলো। ছোটো ভাই কিছুতেই রাজি না-- শেষে বিয়ের দিন হানু নিজে ভিন পাড়ায় গিয়ে ভাইকে খুঁজে বের করে তার কানের উপর চড় লাগিয়ে বললো, বিয়ে করবি না? শালা বিয়ে তোকে করতেই হবে। হলো বিয়ে।

১৯৬০ সালে হানু শেখের বাড়ি ঢোকা দায়। কালো কালো নানা আকারের মানব কিলবিল করছে। পাঁচ ভাগে খণ্ডিত বসত বাড়িতে পা রাখার জায়গা নেই। এক এক ভাই দুই থেকে চার বিঘে জমি ভাগে পেয়েছে। সে জমিও দ্রুত চলে যাচ্ছে ভাটার স্রোতের মতো। কারো ছেলেমেয়ে পাঠশালায় যায় না। এ বাড়ি ও বাড়ি গরুটরু চরায়। হানু শেখের একটি অঙ্গ পড়ে গেছে। বালিশে কনুই, ভাঙা নড়বরে হানু শেখ বলে, বেলাড পেশার।

রাঢ়ের মানুষের দুর্গতি বর্ণনার জন্য এ লেখা নয়। করতে চাইলেই বা কে পারবে করতে! শতকরা একশো জনের অবস্থাও অবশ্যি এ রকম নয়। তবে ছটিটা মোটের উপর এই রকমই। বাজে সেন্টিমেন্টের প্রশ্রয় না দিলে সমাজের বাসবতার এই রং, এই চেহারা।

হ্যাঁ এর মধ্যেই মানুষ। এই বাস্তবতার মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকে। আনন্দ ফুর্তি করে, ভালোবাসে। আতিথ্য দয়াধর্ম আছে, রাগে ফোঁসে, হতাশায় ভাঙে, আশায় নৃত্য করে, প্রতিবেশীর মাথা ফাটায়-- মানুষকে বুকে টানে। সবই করে, কে অস্বীকার করবে তা? চিরায়ত কিছু থাকলে তা এই মানুষের ব্যাপারে। মানুষ বাঁচে বলেই মন্দির-মসজিদ তৈরি করে। হাত আছে, জ্যান্ত গতিশীল হাত, কাজ হয়-- তাই হাতের কাজে নৈপুণ্য আসে, দক্ষতা দেখা দেয়, মন্দির-মসজিদের গায়ে সৌন্দর্য ফোটে, গলায় ফোটে গান। মেকী গান নয়, ভালোবাসার সময় কাজ দেয়; যে গান খোলা মাঠের উপযোগী, যে গানের সুর জমি চাষের, ধান কাটার, শস্য ঝাড়াই-এর সঙ্গে মেলে। শিশু জন্মায়, তাদের ভোলাতে খেলনা, পুতুল লাগে। ব্যবহারের জিনিসে উপযোগিতা সৌন্দর্য দুটোই আস্তে আস্তে দেখা দেয়। এই নিয়েই তো সংস্কৃতি। এর বিকাশেরও একটি ধারাবাহিকতা আছে বৈকি-- বিকাশের সাধারণ নিয়ম-কানুনও আছে। তাই যতো পুরনো দেশ ততো পুরনো সংস্কৃতি।

এইসব বর্ণনা করাই কি শিল্প? যেমন যেমন আছে, তেমনি তেমনি নগদ বর্ণনা? তা মনে হয় না। তবে এই হচ্ছে ভিত্তি-- এটা জানা থাকলে দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবনের কাঠামো জানা হয়ে যায়। কিন্তু মানতেই হবে এই জানার সঙ্গে সাহিত্য-শিল্পের কাজের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ খুব স্পষ্ট হয় না। স্পষ্ট হয়ে ওঠে শুধু শিল্পের স্থাপনা ও তার পাদপীঠ। সেই পাদপীঠের সঙ্গে বাঁধা মানুষ-- শেষ পর্যন্ত যা ব্যক্তি-- সেই ব্যক্তি এবং তার অতি প্রাচীন বিকাশের অতীত; সংস্কারে বিশ্বাসে প্রাত্যহিকতায় জীবনের সংগ্রাম ও ভালোবাসায় যার প্রকাশ-- এমন ব্যক্তি এবং যৌথ জীবন জটিল ধাঁধার মতো শিল্পের জগতে প্রবেশ করে। সাহিত্য শিল্পের ব্যাপার যেন আলাদা হয়ে ওঠে। সাহিত্যে শিল্পী আত্মপ্রকাশেরই চেষ্টা করেন বটে। তবে শিল্পী নিছক ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জড়িত তাঁর স্বতন্ত্র জগতেরই প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেন তিনি। পাঁচজন বন্ধু মিলে যার জগৎ, তিনি যেভাবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করেন, একা থেকে বাল্যের কৈশোরের স্বপ্নে যিনি বুঁদ থাকেন, তিনি সেভাবে করেন না। এজন্যেই মনে হয় শিল্পী নিজেকে ছাড়াতে পারলেই ভালো। তাতে হয়কি তিনি এমন জরুরি কথা তুলতে পারেন যার সঙ্গে বহু মানুষের যোগ। যিনি বহুদূর ডালপালা মেলতে পারেন তিনি তাঁর কালের সবচেয়ে দরকারি কথাগুলো বলে ফেলতে পারেন। অফুরান জীবনের রস তিনি অফুরান-ভাবে পরিবেশন করতে পারেন।

এমন যে কঠিন কর্কশ দুঃখময় রাঢ়--ভাবতে গেলে অনেক কথাই আর মনে থাকে না। আমার কাছে রাঢ় তাই শীতরাত্রির হিম কালো আকাশ--বিশাল প্রান্তরের উপর যেন বিশালতর ঢাকনা, তার ঝকঝকে তারা, তারাদের অস্পষ্ট চাপা আলো; খোলা-মাঠের একদিকের বহুদূরের গ্রাম থেকে স্পষ্ট ভেসে আসা জমকালো চিৎকার, ওরে দেখে লে জনমের মতো; নিস্তব্ধতা; শেয়ালের হাঁক, বাচ্চাগুলোর শেষ হুয়া হুয়া হুকিউউ চিৎকারটি পর্যন্ত। রাঢ় হচ্ছে ধান কেটে নিয়ে যাবার পর জমির নাড়া, চৈত্রমাসের শুকনো এলোমেলো বাতাস, শাদা ধুলো। এইভাবে আমি এখন রাঢ় গড়ে তুলি-- কামারশালে গনগণে আগুন জ্বলে, মাঠের জমি নিয়ে মারামারিতে মানুষের মাথা ফাটে, জ্বরের ঘোরে কোঁকাতে কোঁকাতে মানুষ ইয়ার্কি করে, জমিতে কাজ করতে গিয়ে মোষের আর মানুষের জিব বেরিয়ে আসে, মানুষ রক্তমুখী হয়ে ওঠে, ভয়ানক স্বার্থ নীল বিষ ওগরায়, হিন্দু-মুসলমানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষে, মুসলমান হিন্দুকে পছন্দ করে না-- সাময়িকভাবে মানুষ হারিয়ে যায়-- আবার গলায় গলায় মানুষ ফিরে আসে। হুঁকো থেকে কলকেটি খুলে নিয়ে মানুষকে দেয়। এই রাঢ়-- কাদায় গোটা মোষ ডুবে গিয়ে শিরদাঁড়াটি মাত্র কালো চাবুকের মতো বেরিয়ে থাকে-- উলঙ্গ মানুষ কাদা মেখে মাঠের ডোবায় মাছ খোঁজে, জমিতে শস্য কুড়োয়, মেয়েরা ঘর নিকোয়, সন্ধ্যেবেলায় দাওয়ায় পুরুষমানুষকে গুড়-মুড়ি-পেঁয়াজ খেতে দেয়-- কঠিন শক্ত হাতে চাষি তার ঘরণীকে বুকে টেনে পেষে। তবে শেষ পর্যন্ত মানুষ মানুষকে পাইয়ে দেয়। সমগ্র তৈরি হয় এই ভাবেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ