চিনুয়া আচেবে : যেন এক আলোর ঘ্রাণ

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর


চিনুয়া আচেবে আফ্রিকার এমন এক কণ্ঠস্বর যাকে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করা যায়, এমনকি তিনি সৃজিত হওয়ার প্রক্রিয়ায়ও থাকেন- তার কথা নিয়ে কথনে নানাভাবে মত্ত হওয়া যায়, এই যে নানা ভাবে কথা বলার আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা তা কিন্তু আমরা চিনুয়ার কাছে ভালোভাবেই পাই। তিনি তার কথা বলেছেন, লিখেছেন- ইংরেজিতে, মৌলিক মানুষটি হচ্ছেন রিয়েল আফ্রিকান; সেখানে থেকেছেন, বড়ো হয়েছেন, এমনকি জীবনযাপন করেছেন নিউইয়র্কে।


তিনি শিক্ষকতাও করছেন সেখানে। কিন্তু যা করেননি তা হচ্ছে তার ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে ভালোবাসা থেকে নিজেকে আড়াল করেননি। তিনি ইংরেজিতেই যেহেতু লিখেছেন ভাবতেও পারতেন ইংরেজিতেই। তার সৃজিত ইংরেজিও প্রথাগত ইংরেজি হয় নাই। তিনি ভাষাটাই কেবল নিয়েছেন, কিন্তু স্বরটা তার নিজের, তার জাতিসত্তার, প্রকাশের আশ্চর্য এক ক্ষেত্র তিনি লালন করছেন সেখানে। কিন্তু তিনি অদ্ভুত এক কাজ করলেন, তিনি লিখলেন ইংরেজিতে, কিন্তু স্বপ্ন দেখছেন নাইজেরিয়ান ইগবো সম্প্রদায়ের মানুষজন নিয়ে। তাও যেই সেই ভাবনা নয়, একেবারে সাংস্কৃতিক কাঠামো দখলের মতো করেই ভেবেছেন তিনি। তার প্রথম উপন্যাস 'থিংস ফল এ্যাপার্ট'- যেখানে তিনি দারুণ সব কাজ করলেন। এ-উপন্যাসটিই তার ক্ষমতার চরম প্রকাশ বলা যায়। তা মাত্র সাতাশ বছর বয়সে লেখা। রক্তাক্ত শ্রমের এক নির্যাস হয়েছে এটি। এখানে তার সমাজ আছে, কলোনিয়াল পেষণ আছে। আছে এক বীরের কথা। যে তার সমাজ, সম্প্রদায় আর মানুষকে ভালোবাসেন। অকুনকো তার নাম--সে এক বীর, এক কুস্তিগীর। তার বীরত্ব কোনো চুপচাপের বিষয় নয়। পশ্চিম আফ্রিকার সর্বত্র তার স্পর্শ লাগে যেন। দ্রোহের কারণে তিনি একটা খুনই করে ফেলেন, তিনি তো যেই সেই মানুষকে খুন করেননি! অভিজাত সম্প্রদায়ের এক মানুষ তার হাতে খুন হয়। তবে তা হয় ভুলক্রমে। কিন্তু তার রেশ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আশ্চর্য এক ভিন্ন জগৎ আমরা তাতে দেখি, পতনের ভিতর দিয়েই আমরা দুনিয়ার নাগাল পাই যেন। এ মানুষটির সামগ্রিক এলাকা ক্রমশ দখল হতে থাকে। কলোনিয়াল পেষণ শুরু হয়। অকুনকো ক্রমশ এক জান্তব প্রতিষ্ঠানের খপ্পরে পড়েন। এভাবেই এক জনগোষ্ঠীর কাছেও তার জীবন পাল্টে যায়। আচেবের প্রকাশশৈলী একেবারে আলাদা, তাতে নির্জনতা থাকে না, থাকে সমাজের কথনভঙ্গি, তিনি আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এবং একটা সমাজের সাংস্কৃতিক আবহ নির্মাণে সতত স্পষ্ট থাকেন তিনি; এভাবেই একটা জনগোষ্ঠী শুধু উদ্ভাসিত নয় আলোকিতও হয়। অথবা বলা তার মানুষজন পুনর্বিন্যস্থও হয়। এ যেন এক সাংস্কৃতিক উত্থানের গল্প। অদ্ভুত টানটান এক লৌকিক গদ্যের আমেজ তাতে আছে। এটিই তাকে জগৎবিখ্যাত করে দেয়। অনেক ভাষায় এটি অনূদিতও হয়।

এর দুই বছর বাদে তিনি প্রকাশ করেন 'নো লঙ্গার এট ইজ', মানে 'স্বস্তি নেই আর'-- স্বাধীনতার সময়ের নানান অনুষঙ্গ তাতে আছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আচেবের আরেক গ্রন্থ 'এ্যারো অব গড'। এ-সব নিয়েই তার ট্রিলজি রচিত হয়। এ্যারো অব গড উপন্যাসে দেখা যায়, মূলত আফ্রিকার লোকজন কলোনিয়াল পেষণ অনেকটাই সহ্য করে নিয়েছে। ইংরেজদের বার্তা অনুযায়ী তাদের জীবনযাপন অনেকটাই ঠিক করছেন। গোত্রশাসক নিযুক্ত হচ্ছে। এমনকি ইগবো সমাজের ভিতর বাসা বেঁধেছে খ্রিস্টীয় সমাজ। তার মানে তাদের ভিতর বিরাট এক পরিবর্তন হচ্ছে। তবে পরিবর্তন হয়েছে বললেই তো সব হয়ে যায় না, হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি একটা সমাজের ভিতর একেবারে গোড়ায় গোড়ায় যুক্ত থাকে। এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড়ো জিনিস হচ্ছে, চিনুয়া আচেবে তার উপন্যাসে তার সমাজের পরিবর্তনটা একেবারে ভিতরে গিয়ে দেখেছেন বা সহ্যও করেছেন বলা যায়। তার ভিতর আলাদা প্রাণ ছিল, কারণ তিনি সেই সমাজেরই মানুষ। মানুষের অন্তর্গত জীবন, তাদের রক্তক্ষরণ একেবারে নিজের জীবনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করতে-করতে অনুভব করতে পেরেছেন তিনি। তবে তার বর্ণনা এখানে অত জ্যান্ত নয়। এ উপন্যাসের মূল চরিত্র ইজুলু। একপর্যায়ে তার ভিতর ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তিনিও যেন কলোনিয়াল পেষণের অংশীদার হতে থাকেন। মানুষকে অত্যাচারে ভরিয়ে দিতে শুরু করেন। কিন্তু মানুষ তো কেবল তো অত্যাচার সহ্যই করে না, তা থেকে পরিত্রাণের পথও খোঁজে। এমনই এক ঘৃণার বিষয় আমরা এ উপন্যাসে পাই। তার কাছ থেকে গ্রামকে গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়। একসময় তার ছেলেও মারা যায়। তখন দেখা যায়, মানুষজন তার থেকে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। তবে এ কথা মানতেই হবে থিংস ফল এ্যাপার্ট-এ বর্ণনার যে টানটান অবস্থা, লৌকিকতার ক্রমবিস্তার, একটা সমাজের কথন ঐতিহ্যকে লালন করার বিষয়, তা কিন্তু আমরা এ্যারো অব গড-এ পাই না। বর্ণনার খানিক আধুনিকতা, দীর্ঘময়তা আমাদের কাউকে কাউকে একধরনের হতাশার ভিতর ফেলতে পারে। বর্ণনার যে লৌকিকতা আমরা থিংস ফল এপার্ট-এ পাই, তা এ গ্রন্থে মানে এ্যারো অব গড-এ সেইভাবে নাই। এখানে দেবত্বের আধুনিকতাও দেখি, সনাতন সেই জীবনবোধ যেন কিছুটা বদলে যাচ্ছে। তবে এটা মানতে হবে, তার লেখায় বা বোধে বা স্মৃতিতে একধরনের সাহিত্যিক সত্য থাকলেও বাস্তবতার কাছে তিনি ফিরে এসেছেন। তিনি খামোকা চরিত্রের ভিতর হিরোইজম আরোপ করেননি। সমাজে যেইটুকু বদলে গেছে বা বদলানোর ইশারা আছে, তাকেই তিনি বিস্তৃত করতে চেয়েছেন।

আচেবের রচনার ভাষার দিকটা একটা বিষয় বটে। তিনি ইগবো সম্প্রদায়ের মুখের ভাষাটা ইংরেজি করলেন কিভাবে? তা তো সম্ভব নয়। তাদের লোক-ঐতিহ্য, প্রবচন, শ্লোক ইত্যাদিও তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন। ইগবো'র প্রচুর শব্দ তিনি ইংরেজিতে ব্যবহার করেছেন। এ এক সাংকেতিক প্রতিবাদ, শাদা চামড়ার প্রতি কালো চামড়ার তরফ থেকে চাবুকের সপাং সপাং আঘাত। তাতে শাদা চামড়ার ভাষা মোহনীয় কালো মানুষের ঘ্রাণে যেন মানুষ হয়ে ওঠেছে। এতে সাহিত্যিক সত্য তো আছেই, লেখকের যথার্থ ক্রোধও প্রকাশ পেয়েছে। ভাষা যেন প্রতিষ্ঠানের পালিত সম্পদ, তাকে যেভাবে ইচ্ছা ভদ্রলোক করার বাসনা তো শাদা চামড়ার থাকবেই, নতুবা তারা জ্ঞান-গরিমায় আলাদা হবে কি করে! কিন্তু তাতে আচেবের কোনো ভাবনা নাই, করুণামুখর কোনো আশা নাই, তিনি তার মতো করে লিখে গেছেন। জগৎকে প্রতিবাদ করার ধরন দেখিয়েছেন। এখানেই আচেবে সাহিত্যের বড়ো দিক। তবে কথাক্রমেই বলতে হয়, কলোনিয়াল পেষণের কালে যে খণ্ড খণ্ড তবে প্রবল দ্রোহের ইতিহাস আছে, তা কিন্তু এ উপন্যাসে পাই না। এও কি সাহিত্যিক বিবেচনা কিনা তা বোঝা মুশকিলই। ফলত, তার লেখায় সাহিত্যিক সত্য যত প্রকট সামাজিক দ্রোহের স্বভাতজাত বিস্তার তত নাই!

তবে তিনি নিজের সাথেই যেন একধরনের বোঝাপড়া বা মোকাবেলা করতে চেয়েছেন। আমাদের যে কারোর মনে হতেই পারে, লেখনের বাইরে কথার কোনো ইতিহাস নাই। মুদ্রণই কথাশিল্পের আসল চেহারা চিহ্নিত করেছেন- এমন একটা আচরণ হয়ত আচেবের ভিতরও ছিল, কিন্তু তিনি নিজেই সেই আচরণকে নস্যাৎ করেছেন। তিনি ভাষার যে লৌকিকতা দেখিয়েছেন, ইগবোদের কাণ্ডজ্ঞানের প্রতি, প্রচলিত ঐতিহ্যের প্রতি টান দেখেয়িছেন, নিজেদের শাসনকে নিজেদের ক্যাপচারে রাখতে চেয়েছেন, এমনকি কথিত ভদ্রলোকদের উপযুক্ত ভাষা হিসাবে একে ধরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কেউ কেউ, আচেবের কথনস্টাইলে তা নাই। থিংস ফল এপার্ট-এ তো নাইই। আমরা তাই তাকে প্রকৃতিজাত কথক বলতে পারি। তার সমস্ত ভঙ্গিমার ভিতর তা আছে।

তিনি তার আপসহীনতাকে উপভোগের পর্যায়ে রাখতেন, তিনি এক আফ্রিকান প্রবাদ থেকে বলতেন, সিংহশিকারের ইতিহাসে শিকারের ভিতর থেকেই ঐতিহাসিক জন্ম নেয়া দরকার, নতুবা শিকারের ইতিহাসই আমাদের শাসন করবে। তিনি সিংহদের ভিতর থেকে ঐতিহাসিক নাজেলের আশা করতেন। সাহিত্যিক সরসতা যোগ করে তিনি কথাও বলতেন। জ্ঞান দিতেন কথাচ্ছলে। তবে এও বলতে হয়, তার ব্যক্তি অত স্বাধীনতা নেয় না, তার সমাজ এর আচার-ব্যবহারকে অতিক্রম করে চূড়ান্ত স্বাধীনতা নিতে পারে না। এভাবেই হয়ত আচেবের জাতিসত্তার চেহারাটাই চরিত্রকে সমাজ আর ঐতিহ্যমুখী করে রাখে। তার সৃজনসৌন্দর্যই তাকে ইতিহাসের জায়গায় স্থান দিতে বাধ্য হবে। সাহিত্যিও যে ইতিহাস রচনা করতে পারে চিনুয়া তার প্রসঙ্গিক উদাহরণ।

চিনুয়া আচেবে ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে জন্ম নিয়েছেন, যিনি সেই ইতিহাসের অংশ বলে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন। তার লেখায় আছে আলোর ঘ্রাণ, সেই ঘ্রাণ দিয়ে চৌদিক মোহিত করতে আছেন। তার ব্যাপক সার্থকতা হচ্ছে, তার শিল্পে কলোনিয়াল ধান্ধাবাজি অনেকটাই ধরা খেয়েছে। আফ্রিকার কালো মানুষও যে সাংস্কৃতিক-ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ইতিহাসের স্পষ্ট রেখা হয়ে নিজেকে সামনে রাখতে পারে, তিনি তার প্রমাণ। এই মানুষটির পুরো নাম আলবার্ট চিনুয়ালুমোগে আচেবে, জন্ম পশ্চিম নাইজেরিয়ার এক বৃহদাকার গ্রাম ওগিডিতে, ১৯৩০ এর ১৬ নভেম্বর। এবং তার মৃত্যু হয়েছে ২১ মার্চ ২০১৩-এ।

তাঁর গ্রন্থসংখ্যা মাত্র পঁচিশ। এতেই বোঝা যায়, জনপ্রিয় ধারার ঠিক বিপরীতে তার অবস্থান--বহুলপ্রজ নন তিনি, সস্তা কিছু কখনোই লেখেননি, দায়বদ্ধতা ছিল মহৎ সাহিত্যের প্রতি। এদের মাঝে যে কেবল উপন্যাস রয়েছে তা নয়, তিনি ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও কবিতাও রচনা করেছেন। তবে তিনি তার বোধের কাছে একেবারে সাচ্চা থাকতে চেয়েছেন। যা চিন্তা করেছেন নিজের সত্তার পরিপূর্ণতার ভিতরই লিখেছেন। তিনি একধরনের সাহিত্যিক রাজত্ব লালন করতে চেয়েছেন, নিজের সংস্কৃতিকে দেখানোর বাসনা তার ছিল। তিনি ভাষা, সংস্কৃতি, বোধ দিয়ে অপরের ওপর রীতিমতো প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছেন। শিল্পের স্বোপার্জিত আচরণ এমনই হওয়া দরকার। তিনি এমন এক রাজত্ব কায়েম করেছেন, যিনি তার রাজা আবার এর প্রজাও!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ