ভাগ্যধন বড়ুয়া
এক। ঠিকানা হারিয়ে কি ভাল করেছ বন্ধু?
২৯শে মার্চ ২০১৫ আইসিসি বিশ্বকাপ সমাপনী অনুষ্ঠানে বিজয়ী অষ্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের কথাগুলো আমি আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই—‘তাঁর কথা আজীবন মনে থাকবে, ফিলিপ হিউজ! আমার বন্ধু, আমার সতীর্থ, যতদিন আছি মাঠে,তাঁর টেস্ট নাম্বার আমার ক্যাপে আর স্মরণের চিহ্ন থাকবে হাতের কালো ফিতায়।’ ওই কথাগুলো প্রতিধ্বনি করেছিল আমার অন্তরে ; মনে হচ্ছিল ফিলিপ হিউজ নয় , কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, বন্ধু আমার ; তোমাকে হৃদমাজারে রাখিব, যতদিন বেঁচে আছি।
পথে নামলেই মনে পড়ে তোমাকে, চেনা পথে তোমার পদশব্দ শুনি, লালখান বাজার ইস্পাহানী মোড়ে আড্ডায় মশগুল তুমি, চেরাগীর ভীড়ে তোমার কণ্ঠস্বর জেগে থাকে, বাতিঘরে হাস্যজ্জ্বোল উপস্থিতি, রেলওয়ে হাসপাতালের বারান্দায় তোমার নীরব পায়চারী ; জ্বলজ্বলে, জীবন্ত। চেতনা ফিরে এলে শূন্যতা নামে, তখনই মনে হয় তুমি নেই শুধু দিয়ে গেছ তোমার যাবতীয় কথাসমগ্র , অভিব্যক্তি, আকাঙ্ক্ষা ও যন্ত্রণার খতিয়ান।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর জীবনের দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, ট্রেনও ধরেছিলেন সঠিক সময়ে, কিন্তু ভুলে ঠিকানা হারিয়েছে কোথায় কেউ জানি না।..’‘পথ ছিল যত জুড়িয়া জগত, আধাঁরে গিয়েছে হারিয়ে’
দুই। অনেক কথা যাও যে বলে...
২০১৫ সালের ঢাকা বইমেলায় ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ আমাদের শেষ দেখা। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের সামনে আমি, কবি ওবায়েদ আকাশ, গল্পকার আহমদ জসিম আর কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর মিলে অনেকক্ষণ কথা হয় এবং শেষে আমরা সবাই মিলে একটা ছবি তুলি এবং তা আমি ফেইসবুকে দিই। তাতে উনি কমেন্ট লিখেছিলেন, ‘আমিওতো আছি দেখছি!!! ’ এ ছবিই যে শেষ ছবি হবে, এই বিস্ময়কর চিহ্নই যে চিহ্নিত বেদনা হবে জানা ছিল না।
২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত দেশের বাহিরে ভারত ভ্রমণ শেষে ৮তারিখ রিজেন্ট এয়ার নামক বিমানে চট্টগ্রামে নামার আর বেশি সময় নেই, ওই দিনের কালের কণ্ঠ পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠা খুলতেই জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ছবি, প্রথমে মনে হয়েছিল উনি কোন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, নইলে ছবি কেন? কিন্তু আমারই মতিভ্রম, আর দেখিনা কিছুই ; শুধুই একরাশ হাহাকার, যন্ত্রণা আর হারানোর বেদনার শোরগোল ছাড়া কিছুই নেই। পাশে আমার স্ত্রী, সামনে আমার দুই পুত্রসন্তান, কি বলব? কিভাবে বলব তাদেরকে ? বলার আগেই আমার স্ত্রী বলল: কি ব্যাপার? পেপারে কি দেখে তোমার হুশ- জ্ঞান লোপ পেল? আমি কিছইু না বলে, শুধু পেপারটা বাড়িয়ে দিলাম তার হাতে। আর কোন কথা নেই; নিঃশব্দ গোঙানির ঢেউ বুকের সমুদ্রে। বিমান থেকে নেমেই ছেলেদেরকে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর বললে ছোট ছেলে প্রতিম আমায় বলে: বাবা, তোমার আর ইস্পাহানীর মোড়ে আড্ডা মারা হবে না, কে ফোন করে বলবে অপেক্ষায় আছি, আইসো। আরেকজন আত্মীয় না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার বেদনায় বিপর্যস্ত অবস্থায় বিমান বন্দর থেকে বাসার উদ্দেশ্যে আমরা গাড়িতে উঠি, ফোন করলাম আহমদ জসিম ও মনিরুল মনিরকে, দু’জনের কণ্ঠে বিলাপ, ‘সবতো শেষ হয়ে গেল, চলে গেল প্রিয় বন্ধু প্রিয়জন কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ’। চারিদিকে গুমোট ভাব,লু-হাওয়া বুকে,অস্থির সময়। বাসায় নেমেই কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাইয়ের আবাসস্থলে যাই; গেইট খুলে উঠোনে ঢুকি,কেউ নেই,দরোজায় তালা। বাড়ির আঙিনা নানা জাতের ফুলে সজ্জ্বিত বসন্ত বরণে কিন্তু মানুষজন নেই,খালি ঘর। বোবা চোখে চেয়ে আছে উঁচু উঠান থেকে নেমে যাওয়া সদর রাস্তার পথ ; আমিও চেনা পথ ধরে যেতে যেতে পিছনে রেখে গেলাম স্মৃতির সিন্দুক।এইভাবেই কি ভালোবাসা সনে আলাদা সত্য রচিত হয় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর?
কথার ভীড় বাড়তেই থাকে,আমিও তরীর মাঝি হয়ে পাল ছেঁড়া স্মৃতির নায়ে পাড়ি দিতে ভাসতে থাকলাম উজানী বাতাসে অচেনা ঘাটে...
তিন। পথের টানেই ভিন্ন পথে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর...
পথের মানুষের কথা শুনেছ, উদগ্রীব ছিলে কখন কে কী বলে; গল্পের তাড়নায়, সংলাপের আশায়। শুনিয়েছ আমাদের কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্পের উপাদান সংগ্রহের কাহিনি,প্রান্তিক মানুষের গল্প। আশায় বুক বেঁধে তুমিও পথে মুক্তির শ্লোগান ধরেছিলে শাহবাগ চেতনায়, বহু পথ হেঁটে এসে আমাদের কাছে বন্ধুত্বের হাত পেতে দিলে তোমার শিশুসুলভ সারল্যে ; আমরা কিভাবে অভিবাদন জানাই বলো প্রিয় গল্পকার কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর? অথচ ব্যস্ততার কথা বলে তুমি সৌরচক্রে ঘূর্ণমান প্রহরের ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে লুকিয়ে লিখেছ মানব মনের আনন্দ-বেদনার পাণ্ডুলিপি। পথই আপন করেছে তোমাকে, তুমিও পথের টানে ঘর ছেড়েছ, ট্রেনের গতিকে হার মানিয়ে কসমিক ভ্রমণে বেরিয়েছ পুস্পকলি নার্সারীর পথ ভুলে।। একদিকে ফাঁকা পথ, শীতার্ত চৌরাস্তার মোড়, নিঃসঙ্গ চেরাগী! কি ব্যাপার? পূর্বাভাস না জানিয়ে ‘ কোন বা দোষে গেইলা ছাড়িরে... ’
প্রতিবছর একুশের বইমেলা হবে, প্রকাশিত বইয়ের ঘ্রাণ ও স্বরে মুখরিত থাকবে বইমেলা। যতদিন পৃথিবীর মায়া থাকে ততদিন আত্মা ছেড়ে যায় না নাকি! জাহাঙ্গীর ভাই, তোমার তো বইমেলা বা বইয়ের প্রতি মায়া যাবেনা কোনদিন, তবে কি তুমি ঘুরে ঘুরে বইয়ের স্টলে খোঁজ নিবে প্রিয় লেখকের নতুন বই কিংবা তুমিও কি তোমার নতুন গল্প-উপন্যাসে অটোগ্রাফ দিতে থাকবে! এই দৃশ্যই চোখে ভাসে বিশ্বাসে। অথচ আড়ালে রচনা করেছ নতুন এলিজি।
এক। ঠিকানা হারিয়ে কি ভাল করেছ বন্ধু?
২৯শে মার্চ ২০১৫ আইসিসি বিশ্বকাপ সমাপনী অনুষ্ঠানে বিজয়ী অষ্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের কথাগুলো আমি আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই—‘তাঁর কথা আজীবন মনে থাকবে, ফিলিপ হিউজ! আমার বন্ধু, আমার সতীর্থ, যতদিন আছি মাঠে,তাঁর টেস্ট নাম্বার আমার ক্যাপে আর স্মরণের চিহ্ন থাকবে হাতের কালো ফিতায়।’ ওই কথাগুলো প্রতিধ্বনি করেছিল আমার অন্তরে ; মনে হচ্ছিল ফিলিপ হিউজ নয় , কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, বন্ধু আমার ; তোমাকে হৃদমাজারে রাখিব, যতদিন বেঁচে আছি।
পথে নামলেই মনে পড়ে তোমাকে, চেনা পথে তোমার পদশব্দ শুনি, লালখান বাজার ইস্পাহানী মোড়ে আড্ডায় মশগুল তুমি, চেরাগীর ভীড়ে তোমার কণ্ঠস্বর জেগে থাকে, বাতিঘরে হাস্যজ্জ্বোল উপস্থিতি, রেলওয়ে হাসপাতালের বারান্দায় তোমার নীরব পায়চারী ; জ্বলজ্বলে, জীবন্ত। চেতনা ফিরে এলে শূন্যতা নামে, তখনই মনে হয় তুমি নেই শুধু দিয়ে গেছ তোমার যাবতীয় কথাসমগ্র , অভিব্যক্তি, আকাঙ্ক্ষা ও যন্ত্রণার খতিয়ান।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর জীবনের দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, ট্রেনও ধরেছিলেন সঠিক সময়ে, কিন্তু ভুলে ঠিকানা হারিয়েছে কোথায় কেউ জানি না।..’‘পথ ছিল যত জুড়িয়া জগত, আধাঁরে গিয়েছে হারিয়ে’
দুই। অনেক কথা যাও যে বলে...
২০১৫ সালের ঢাকা বইমেলায় ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ আমাদের শেষ দেখা। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের সামনে আমি, কবি ওবায়েদ আকাশ, গল্পকার আহমদ জসিম আর কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর মিলে অনেকক্ষণ কথা হয় এবং শেষে আমরা সবাই মিলে একটা ছবি তুলি এবং তা আমি ফেইসবুকে দিই। তাতে উনি কমেন্ট লিখেছিলেন, ‘আমিওতো আছি দেখছি!!! ’ এ ছবিই যে শেষ ছবি হবে, এই বিস্ময়কর চিহ্নই যে চিহ্নিত বেদনা হবে জানা ছিল না।
২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত দেশের বাহিরে ভারত ভ্রমণ শেষে ৮তারিখ রিজেন্ট এয়ার নামক বিমানে চট্টগ্রামে নামার আর বেশি সময় নেই, ওই দিনের কালের কণ্ঠ পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠা খুলতেই জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ছবি, প্রথমে মনে হয়েছিল উনি কোন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, নইলে ছবি কেন? কিন্তু আমারই মতিভ্রম, আর দেখিনা কিছুই ; শুধুই একরাশ হাহাকার, যন্ত্রণা আর হারানোর বেদনার শোরগোল ছাড়া কিছুই নেই। পাশে আমার স্ত্রী, সামনে আমার দুই পুত্রসন্তান, কি বলব? কিভাবে বলব তাদেরকে ? বলার আগেই আমার স্ত্রী বলল: কি ব্যাপার? পেপারে কি দেখে তোমার হুশ- জ্ঞান লোপ পেল? আমি কিছইু না বলে, শুধু পেপারটা বাড়িয়ে দিলাম তার হাতে। আর কোন কথা নেই; নিঃশব্দ গোঙানির ঢেউ বুকের সমুদ্রে। বিমান থেকে নেমেই ছেলেদেরকে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর বললে ছোট ছেলে প্রতিম আমায় বলে: বাবা, তোমার আর ইস্পাহানীর মোড়ে আড্ডা মারা হবে না, কে ফোন করে বলবে অপেক্ষায় আছি, আইসো। আরেকজন আত্মীয় না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার বেদনায় বিপর্যস্ত অবস্থায় বিমান বন্দর থেকে বাসার উদ্দেশ্যে আমরা গাড়িতে উঠি, ফোন করলাম আহমদ জসিম ও মনিরুল মনিরকে, দু’জনের কণ্ঠে বিলাপ, ‘সবতো শেষ হয়ে গেল, চলে গেল প্রিয় বন্ধু প্রিয়জন কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ’। চারিদিকে গুমোট ভাব,লু-হাওয়া বুকে,অস্থির সময়। বাসায় নেমেই কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাইয়ের আবাসস্থলে যাই; গেইট খুলে উঠোনে ঢুকি,কেউ নেই,দরোজায় তালা। বাড়ির আঙিনা নানা জাতের ফুলে সজ্জ্বিত বসন্ত বরণে কিন্তু মানুষজন নেই,খালি ঘর। বোবা চোখে চেয়ে আছে উঁচু উঠান থেকে নেমে যাওয়া সদর রাস্তার পথ ; আমিও চেনা পথ ধরে যেতে যেতে পিছনে রেখে গেলাম স্মৃতির সিন্দুক।এইভাবেই কি ভালোবাসা সনে আলাদা সত্য রচিত হয় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর?
কথার ভীড় বাড়তেই থাকে,আমিও তরীর মাঝি হয়ে পাল ছেঁড়া স্মৃতির নায়ে পাড়ি দিতে ভাসতে থাকলাম উজানী বাতাসে অচেনা ঘাটে...
তিন। পথের টানেই ভিন্ন পথে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর...
পথের মানুষের কথা শুনেছ, উদগ্রীব ছিলে কখন কে কী বলে; গল্পের তাড়নায়, সংলাপের আশায়। শুনিয়েছ আমাদের কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্পের উপাদান সংগ্রহের কাহিনি,প্রান্তিক মানুষের গল্প। আশায় বুক বেঁধে তুমিও পথে মুক্তির শ্লোগান ধরেছিলে শাহবাগ চেতনায়, বহু পথ হেঁটে এসে আমাদের কাছে বন্ধুত্বের হাত পেতে দিলে তোমার শিশুসুলভ সারল্যে ; আমরা কিভাবে অভিবাদন জানাই বলো প্রিয় গল্পকার কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর? অথচ ব্যস্ততার কথা বলে তুমি সৌরচক্রে ঘূর্ণমান প্রহরের ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে লুকিয়ে লিখেছ মানব মনের আনন্দ-বেদনার পাণ্ডুলিপি। পথই আপন করেছে তোমাকে, তুমিও পথের টানে ঘর ছেড়েছ, ট্রেনের গতিকে হার মানিয়ে কসমিক ভ্রমণে বেরিয়েছ পুস্পকলি নার্সারীর পথ ভুলে।। একদিকে ফাঁকা পথ, শীতার্ত চৌরাস্তার মোড়, নিঃসঙ্গ চেরাগী! কি ব্যাপার? পূর্বাভাস না জানিয়ে ‘ কোন বা দোষে গেইলা ছাড়িরে... ’
প্রতিবছর একুশের বইমেলা হবে, প্রকাশিত বইয়ের ঘ্রাণ ও স্বরে মুখরিত থাকবে বইমেলা। যতদিন পৃথিবীর মায়া থাকে ততদিন আত্মা ছেড়ে যায় না নাকি! জাহাঙ্গীর ভাই, তোমার তো বইমেলা বা বইয়ের প্রতি মায়া যাবেনা কোনদিন, তবে কি তুমি ঘুরে ঘুরে বইয়ের স্টলে খোঁজ নিবে প্রিয় লেখকের নতুন বই কিংবা তুমিও কি তোমার নতুন গল্প-উপন্যাসে অটোগ্রাফ দিতে থাকবে! এই দৃশ্যই চোখে ভাসে বিশ্বাসে। অথচ আড়ালে রচনা করেছ নতুন এলিজি।
0 মন্তব্যসমূহ