অজিত কৌর এর গল্প - আলীবাবার মৃত্যু

অনুবাদ : রশীদ হায়দার

পরিণামে যেসব লোক ধুঁকতে ধুঁকতে মরে যায়, অসংখ্য মানুষের ভিড়ে যারা একটা অফিসে যাবতীয় কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাকরি করে, তাদের নাম কেরানি। তাদেরই একজন টাউন হল অফিসের সর্বোচ্চ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মরে গেছে।

পরদিন খবরের কাগজের তৃতীয় পৃষ্ঠায় নিচের দিকে, যেখানে স্থানীয় সংবাদে ডাকাতি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা ও দুর্ঘটনার মতো খবরাদি ছাপা হয়, সেখানে আড়াই লাইনের একটা খবর বেরোল যে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের রামলাল নামে এক কেরানি টাউন হলের সবচেয়ে ওপরের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

ওই একই দিন, বিকেলে মিসেস মিধার বাসায় মহাধুমধামে বিড়াল ছানাদের নিয়ে একটা পার্টি চলছিল। মিসেস মাথুর এ ধরনের পার্টি হলে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে। কারণ পাঁচ বছর ধরে তার স্বামী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এমন একটা শাখায় চাকরি করে, যেখানে বাড়তি দুই পয়সা কামানোর কোনো রাস্তা নেই। তার সেই সামর্থ্য নেই যে সর্বশেষ ডিজাইনের একটা শাড়ি কিনতে কিংবা অন্য মহিলাদের মতো এ ধরনের অনুষ্ঠানে ডাট দেখিয়ে এককভাবে কিছু করে; কিন্তু সে তো জগৎ সংসারে এভাবে নিজেকে পেছনে ফেলে রাখতে পারে না। এই ভিড়ভাট্টার মধ্যে তার একটা জায়গা করে নিতেই হবে। না করলে সে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ একাকী কী করে দিন কাটাবে?

অতএব প্রত্যেক দিন সকালে খবরের কাগজে পার্টির খবরাখবর খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করে। আসলেই খবরের কাগজই আসল জায়গা, যেখানে টাটকা খবরের মতো খবর থাকে। আহম্মকের বাক্স নামে যে জিনিসটি আছে, সেখানে শুধু ক্ষমতাবানদের খবরই শুধু খবর, বাকি সব বেনোজলে ভেসে যাওয়ার মতো সংবাদ। মনে হয় আহম্মকের বাক্সে কোনো খবর না থাকার খবরই মোদ্দা কথা।

হ্যাঁ, মিসেস মাথুর সকাল বেলায়ই খবরটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছে। পড়া শেষে আলস্য ভরে কাঁটা চামচের মাথায় এক টুকরো চিকেন টিক্কা গেঁথে নিয়ে গভীর শ্বাস ফেলে ভাবে, কে জানে হতভাগা রামলাল আসলে কে, আর কে-ই বা টাউন হলের সর্বোচ্চ ছাদ থেকে গতকাল লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করল?

অত সকালে তেমন কেউ-ই খবরটি পড়েনি। সাজুগুজু করা, মুক্তায় ঝকমকে, বাহারি চোখের পাতা, চোখ ধাঁধানো কানের গয়না ও সুগন্ধি প্রসাধনীতে সজ্জিতা মিসেস মিধা কাজ শেষ করে নিজেকেই ফিসফিস করে বলল, 'হতভাগা শয়তান!'

পরে, দুপুরে খাবারের আগে বিকেলে প্রেসক্লাবে সাংবাদিকরা টেবিলের বিয়ারের ক্যানগুলো গা-ছাড়াভাবে পরিষ্কার করছিল। ছড়ানো-ছিটানো টেবিল ও অগোছালো অপরিষ্কার চারপাশ সাফসুতরো করছে। তারা গলার স্বর চড়িয়ে মাওবাদী ও নক্সালদের সম্পর্কে কথাও বলছে। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়াও ইন্দো-চীন সম্পর্কও আছে তাদের কথায়। আজ কোন হোমড়াচোমড়া কোথায় জমকালো পার্টির আয়োজন করছেন, সেটাও আছে তাদের আলোচনায়।

গুপ্ত নামের যে লোকটি দুই বছর আগে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন, যিনি এখন চার পৃষ্ঠার একটা সান্ধ্য দৈনিক বের করেন। তিনি তাঁর টেবিলের একজনকে জিজ্ঞেস করেন, 'রামলালের আর কোনো খবর আছে?'

'রামলাল একটা বলির পাঁঠা। প্রত্যেক মুখ্যমন্ত্রীই ক্ষমতা ছাড়ার আগে কিংবা তাঁর জায়গায় অন্য কেউ আসার আগ দিয়ে এমন একটা ঘটনা ঘটান। তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ কে, তা জেনে তাঁর বর্তমান ঘাপলাবাজি খুঁজে বের করা ছাড়াও আর কী কী অপকর্ম থাকতে পারে, তাও প্রকাশ করে প্রচারণা চালান, হাই কমান্ডের কাছে পেশ করেন। এটা এমন একটা নোংরা চক্র, যা কোনো দিনই শেষ হয় না। আমাদের এই হোমড়াচোমড়ারা মরে গেলে আসে আরেকজন। রামলালও এই নিয়মিত দুষ্টচক্রের এক শিকার।' কথাগুলো বলল 'হিন্দুস্তান টাইমস'-এর রাজ। 'না, আমি সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর কথা বলছি না। বলছি ওই রামলালের কথা, যে কিনা গতকাল আত্মহত্যা করেছে।'

'আমাদের ক্রাইম রিপোর্টার এটা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। ঘটনায় যদি কোনো মালমাত্তা থাকে তাহলে আজ রাতেই সেটা জমা দেবে।'

আসলে এ ঘটনাটার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকেরই পকেট কিংবা ব্যাগে তথ্যটি রয়েছে। পাওয়ান মানচান্দা নামের মানুষটি, যে কিনা গত সন্ধ্যায়ই সবাইকে সত্য ঘটনাটা জানিয়েছে। যদিও আমরা জানি শেষেরও কিছু না কিছু শেষ আছে। ওটাকে বলে নিপুণ হাতে কারসাজি, যার নাম অসত্যের বাটালি ছাঁদ।

পাওয়ান মানচান্দা! চিনলেন না পাওয়ান মানচান্দাকে? আশ্চর্য! রাজধানীর সব সামাজিক অনুষ্ঠানে যার উপস্থিতি অবধারিত, যেখানে নগরীর প্রায় সব চাকচিক্যের অধিকারিণীরা একে অপরকে দেখাতে ও দেখতে একত্র হয়। ওখানে প্রায় সবাই খুবই শক্তিমালন ভোজবাজিকর, যাদের কাজই হচ্ছে খালি চোখে যা দেখা যায় না, তা তারা দেখিয়ে দেয়।

না, আপনার কোনো ভুল হয়নি। এখানে কোনো ধাপ্পাবাজি নেই। এটা খুবই সাধারণ একটা মানুষের চাকরি। সে এই কাজের জন্যই এই করপোরেশনে চাকরি নিয়েছিল। প্রত্যেক বড় কম্পানি, জনপ্রতিষ্ঠান, সব সরকারি সংস্থা, সব নামকরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিজের খাতায় পর্যন্ত এ জাতীয় বেতনভুক কর্মচারীর নাম আছে।

আপনার ধারণাই ঠিক। পাওয়ান মানচান্দা একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, তার গোষ্ঠীর অন্য ভাই-বেরাদর তার মতো একজন দরের মানুষ প্রায় দেখা-সাক্ষাৎই পায় না। কারণ ওই যে 'চতুর্থ রাষ্ট্র' অর্থাৎ মিডিয়া জগতের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ, ওঠাবসা করতেই তার সব সময়টুকু ব্যয় হয়ে যায়।

যেকোনো খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য এই মৃত্যু বা আত্মহত্যা, ধর্মঘট অথবা লকআউট, শ্রমিক অসন্তোষ কিংবা অস্বস্তিকর কোনো পরিস্থিতি বড্ড বিব্রতকর। অতএব এ ধরনের খবরাদি খুব কায়দা করে ও কৌশলী হয়ে পরিবেশন করতে হয়। তবে এসব খবর যদি ছলচাতুরি করে হাওয়া করে দেওয়া না যায়, তাহলে এটাকে কিভাবে স্বাদু করে গেলানো যায়, তারও ব্যবস্থা আছে। মূল ঘটনা নয়ছয় করে, সেটা হেলাফেলা ভরে, সংবাদপত্রের ভাষায় লঘু করে প্রকাশ করলেই হলো।

মোদ্দা কথা, গতকাল দুপুরে মিউনিসিপল কমিশনার পাওয়ান মানচান্দাকে নিজ ঘরে ডেকেছিলেন।

'কী হচ্ছে এসব? রামলাল নামের আজেবাজে এই লোকটি কে? ওই শকুনের মতো সংবাদপত্রগুলোর কাছে খবরটি গেলই বা কিভাবে? সকাল থেকে এ পর্যন্ত ছয়-ছয়টি ফোন পেয়েছি। এ ব্যাপারে কেন কিছু করতে পারোনি?'

পাওয়ান মানচান্দা তার সুখী-সুখী মুখখানায় সামান্য একটু হাসির রেখার সঙ্গে ভীতির ভাব ফুটিয়ে বলল, 'স্যার, রামলাল যখন ডোডো পাখির মতো সশব্দে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে অক্কা পেল, তখন আমি কী করে তার লাশ গায়েব করে ফেলব?'

'আমি কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। তুমি যখন তার লাশ গায়েবই করতে পারলে না, তখন তোমার উচিত ছিল এ খবর যাতে খবরের কাগজে না যায়'-খেপে গিয়ে কমিশনার যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখনো পাওয়ান মানচান্দার সেই দুঃখ-দুঃখ ভাবের করুণ হাসিটা মুখে লেপ্টে ছিল।

সে যা-ই হোক, দুজনই একমত হলো যে এই সাংবাদিক জাতটা বড্ড অকৃতজ্ঞ। যখনই তারা গন্ধ পায় এই খবরে কিছু মালমাত্তা আছে, তখনই তাদের সব ভালো মানুষী উড়ে যায় এবং সেই দয়াবানদের দান গপগপ করে গিলতে থাকে। তারা স্বীকার করে, হ্যাঁ, গণমাধ্যমের সবারই পেটে বড় ক্ষিদে। সব সময়ই। সর্বক্ষণ মৃত হোক আর জীবিত, তাদের প্রয়োজন মাংস, আরো মাংস।

পাওয়ান মানচান্দা খুব দ্রুত তার কাজে লেগে যায়।

প্রথমেই সে রামলালের নিজের বাড়ি থেকে আত্মহত্যার মূল কারণটি খুঁজতে শুরু করে। বহু লোক আছে, যারা নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেয় পারিবারিক অশান্তির কারণে। করে না তারা?

হাজারও কারণ থাকতে পারে : রামলালের বউয়ের সঙ্গে আর কারো পরকীয়া চলছে, রামলালের অবিবাহিতা মেয়েটি হয়তো গর্ভবতী হয়েছে, কে জানে রামলালের ছেলেটি ডাকাতি বা রাহাজানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে কি না! যেকোনো কিছু হতে পারে।

কিন্তু তার সব তদন্ত-চেষ্টা একেবারে মৃতবৎ নিষ্ফলা হয়ে গেল।

রামলালের বউ তার তিরিশ বছরের জীবনটার গোড়াটা পাগলের মতো খুঁজতে থাক, সেখানে সে শুধু পায় ছেঁড়াফাটা রংচটা কাপড়ের কিছু টুকরো। রামলালের মেয়েটির বয়স মাত্র সাত; অতএব তাকে ফুসলে বের করে নিয়ে যাওয়া বা গর্ভবতী করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তার ছেলেটা একটা সরকারি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে মাত্র, যেখানে শুধু লেখাপড়া ছাড়া ডাকাতি, রাহাজানির কিছুই পড়ানো হয় না।

আপনারা জানেন, একমাত্র একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী রাজনীতিবিদ। অথচ অঢেল মালকড়ির মালিক ব্যবসায়ীর সন্তানরা দেশের সবচেয়ে ভালো পাবলিক স্কুলে যায়। তারা সেখানে শেখে কী করে কৌশলে আইন অমান্য করতে হয়, আরো শেখে লাখ লাখ ডলার ধাপ্পাবাজির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব, এমনকি এটাও শেখে ফুটপাতে অজস্র ঘুমন্ত মানুষের শরীরের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বিএমডাব্লিউ গাড়ি চালিয়ে দেওয়া যায়। এটাও জানে মধ্যরাতেরও পরে পানশালায় যেসব মেয়ে পানীয় সরবরাহ করতে রাজি হয় না, তাদের কী করে গুলি করে মেরে ফেলতে হয়, কিভাবে তাদের সর্বশেষ মডেলের অস্ত্রটা প্রদর্শন এবং পানীয়টা ব্যবহার করতে হবে।

কেন নয়? গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণেতারা ভালো করেই জানে, তারা আইনের ঊর্ধ্বে এবং সে অধিকার তার আছে। পাওয়ান মানচান্দা গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে, একটা কিছু অবশ্যই করা দরকার। প্রকৃতপক্ষে তার চাকরির জন্য সে প্রতি মাসে একটা মোটা অঙ্কের বেতন পায়। এটাই তার প্রবল আত্মবিশ্বাস।

আর এ কারণেই সে একটা ফাইল তৈরি করে ফেলে। ফাইলটা অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে টেবিল থেকে টেবিলে চালাচালি হতে থাকে। দ্রুতগতির চলাচলে বক্তব্যটা ছিল যে জনৈক ভরদ্বাজের (পাওয়ান মানচান্দা এতই ব্যস্ত ছিল যে সে ওই নামটির বাইরে আর কোনো নাম তার মাথায় আসেনি। কারণ মানচান্দার বিয়ের ব্যাপারে ভরদ্বাজের মেয়ের ঘটকালির একটা ভূমিকা ছিল) কারণটি হচ্ছে তার সহায়-সম্পত্তির আয়কর কিছুটা কমিয়ে দিতে হবে।

বিস্তারিত তদন্তের পর প্রকাশ পায় যে ঘুষ নেওয়ার সময় রামলাল হাতেনাতে ধরা পড়ে। আমরা সবাই জানি মাঝেমধ্যে চুনোপুঁটি কেরানি বা ছোটবাবুদের তিন বা চার অঙ্কের ঘুষ হাতেনাতেই ধরা পড়ে। কারণ লঘু ঘুষের ব্যাপারটা ওপর-ওপরই ভাসে এবং সেটা দেখা যায়, কিন্তু ওজনদার ঘুষগুলো ভারের কারণেই টুপ করে ডুবে যায় এবং চোখে পড়ে না।

আপনি তন্নতন্ন করে খুঁজে, বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন, স্বাধীন ভারতে যুগের পর যুগ এসব নগণ্য ব্যক্তিরাই ওই নোংরা কাজের জন্য আইনের হাতে ধরা খেয়েছে। ওই ফাইলে রয়েছে একটি অভিযোগনামা এবং চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশও। এখন এটি রয়েছে অফিসের সর্বোচ্চ কর্তার স্বাক্ষরের অপেক্ষায়।

এটা তো অবধারিত যে যখন অফিসের এ ঘর ও ঘরে একটি অভিযোগনামা এবং অব্যাহতির সুপারিশ চালাচালি হয়, তখন সংশ্লিষ্ট লোকটির গর্দান যে কাটা যাবেই, সে বিষয়ে তো সে জ্ঞাত থাকবেই। মানচান্দা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেই সাংবাদিক ও রিপোর্টারদের সন্ধ্যায় একটা পাঁচতারা হোটেলে একটু পানাহারের আমন্ত্রণ জানায়।

ঘাপলা আছে এমন খবরে কিছুটা জল ঢেলে তরল করে দিতে পারে স্কচ। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, দুই পক্ষই জানে ও বোঝে যে একে অপরকে ঘোল খাওয়াচ্ছে।

'এই বেজন্মা পিআরও ব্যাটা একটা বেশ্যার মতো মিটমিট করে হাসছে। যেন আমরা কিছুই জানি না...' খুব মনোযোগ দিয়ে গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে এবং টিক্কা, কাবাব ও আরো কিছু উপাদেয় খাদ্য খেতে খেতে রিপোর্টাররা ভাবছিল। অপরদিকে পিআরওর মগজেও ধারণাটা খেলা করছিল যে 'নে শালা বেজন্মারা, মাগনা মদ গিলে নে, জারজের বাচ্চাগুলো। যে কয় পয়সা মাইনে পাস, তা দিয়ে দেশি মাল কেনারও তো ক্ষ্যাম নেই। তোদের কলমের সঙ্গেই যে তোরা বেশ্যাপনা করছিস তা কে না জানে?'

কিন্তু পিআরও ও রিপোর্টাররা হাসি বিনিময় করেই চলেছে। কারণ ওই দুর্গন্ধময় সংবাদগুলো সম্মানজনকভাবেই ছাপতে হবে। কেন, আপনি কি জানেন না যে আমরা সভ্য ও সংস্কৃতিবান মানুষ? সংস্কৃতিবান নগ্ন সত্যকে এড়িয়ে চলে, তারা সত্যকে সুন্দরভাবে কাপড়ে মুড়িয়ে রাখে।

প্রত্যেক পিআরও-ই জানে, পেটে মদ পড়ার পর তাদের আর অফিসে যাওয়ার মুরোদ থাকবে না, লেখার ইচ্ছাও উবে যাবে। বরং বাড়ি গিয়ে সটান বিছানায়। মধ্যরাতের পর তাদের ঘুম কিছুটা পাতলা হলেও নেশাটা যে থাকবে, তাতেই বউকে নিয়ে ঘুমানোর সময় ভাববে হেমা মালিনী কিংবা মাধুরী দীক্ষিতদের বউ ভেবে নিয়ে ঘুমোচ্ছি।

এই অবস্থায় মূল ঘটনার কী হবে? এর শেষই বা কোথায়? কিন্তু এর পরও প্রত্যেক সমস্যার মধ্যেই একটা সমাধান থাকে। মানচান্দার পরিকল্পনাটা কাজে দিয়েছে এবং ঘটনাটা কিছু সময়ের জন্য প্রচারমাধ্যমে আসেনি। প্রত্যেকেই তাদের নিউজ এডিটরের কাছে রিপোর্টটা দেবে তার পরদিন।

প্রতিটি পেশারই তো একটা নীতি-আদর্শ থাকে!

অতএব রামলালের নিজের কারণেই তার মৃত্যুর ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের জানাশোনার বাইরে থেকে গেল। তবে সম্ভাবনাটা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এটা একসময় প্রকাশ পাবে, যখন তার দেহটা হবে এক মুঠো ছাই এবং এক বস্তা হাড়।

আত্মা? আত্মা তো বাতাসের ফুঁ। এ ছাড়া ওই আত্মা নিয়ে কে এখন মাথা ঘামায়? ওটা নিয়ে খামোখা ঘাঁটাঘাঁটি করার মানেই হয় না। যা চোখে দেখা যায় না কিংবা ক্ষতিকর নয়, তার জন্য বিচলিত হওয়ার কী আছে! পরদিন, অর্থাৎ তৃতীয় দিনে প্রত্যেক খবরের কাগজে খবরটা বেরোল যে রামলাল আত্মহত্যা করেছে এবং প্রত্যেকটি কাগজে এমন খবরই বেরিয়েছে। তার বিরুদ্ধে যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে তাতে উল্লেখ আছে, দুর্নীতি ও ঘুষের অভিযোগ রয়েছে। সে যে সাসপেন্ড হয়ে যাবে, এ ভয়েই সে টাউন হলের সর্বোচ্চ তলা থেকে লাফ দিয়ে তার জীবন শেষ করে দিয়েছে।

সেই দুই দিনে রামলালের বিধবা বউ ও সন্তানরা শুধু ভেবেছে তারা পাথরকুচির নিচে চাপা পড়ে ছিল। তার মৃত্যুটা তাদের কাছে ছিল একটা ভূমিকম্পের মতো।

সেই দিনগুলোতে তার প্রতিবেশীরাই খাবারদাবার সরবরাহ করেছে। এখন এটা এমন একটা বিষয় যে এ ধরনের ঘটনা যেন উঁচুতলার সমাজে ঘটে না। সেখানে কেউ মারা গেলে মৃত্যুর মতো নিঃশব্দ অবস্থা বিরাজ করে ঠিকই; কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। যে যেখানেই হোক, চাকরবাকররা খায়, সান্ত্বনা বা সহানুভূতি জানানোর জন্য লোক এলে তাদের চা দিয়ে আপ্যায়ন করতেই হয়, এসব কারণে রান্নাঘরের কাজ কখনো বন্ধ থাকে না।

তুলনায় দেখা যায় নিম্নবিত্তদের চেয়ে উচ্চবিত্তদের শোক প্রকাশ অনেক বেশি মার্জিত ও ভদ্রসম্মত।

একেবারে নিম্নস্তরের মানুষদের এসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। কারণ অধিকাংশেরই বাসার চেহারা একেবারেই হতচ্ছাড়া গোছের। তাদের এই ক্ষুদ্র ও জঘন্য বাসা অধিকাংশ সময়ই থাকে ঠাণ্ডা। এসব বাসায় মৃত্যু মানেই একটা বাড়তি খরচের বোঝা। এই অতিরিক্ত খরচের জন্য ধারদেনা করতে প্রতিবেশী বা বন্ধুদের বাড়িতে যাতায়াতে এতই ব্যস্ত থাকতে হয় যে একটু জিরোবে কিংবা দুদণ্ড আহাজারি করবে, সে সুযোগও হয় না।

তৃতীয় দিনে রামলালের দুর্নীতি, চার্জশিট ও সাময়িক বরখাস্তের খবর যখন কাগজে বেরোল, তখনো তার বউ কিছুই জানে না। খবরের কাগজ এমন একটা বিলাসিতা যে তার বউয়ের মতো মানুষের পক্ষে সেই খরচ বহন করা সম্ভব নয়। এই শ্রেণির মানুষ উড়ন্ত বা কার্নিশের ওপর বসে থাকা কাকদের মাধ্যমেই জানতে পারে। এই 'উড়ন্ত সংবাদ', যা কিনা সাধারণ গুজব নামেই পরিচিত। সাধারণত এসব খবরের যোগসূত্র থাকে প্রতিবেশী কোনো বাড়ির কোনো ঘটনার সঙ্গে। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই হচ্ছে প্রতিবেশীদের বাড়ির কোনো ছেলের সঙ্গে কোনো মেয়ের প্রেম-পিরিতি।

ধীরে ধীরে শহরের এসব ঘটনা একসময় মিইয়ে আসে, প্রধানত ডাকাতি বা খুন কিংবা আত্মহত্যা। আর জাতীয় পর্যায়ের কোনো ঘটনার ব্যাপারটা কানাকানি হতে হতে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির পর্যায়ে চলে যায়। ওই যে খবরটা, ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলেটা বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলে ইন্দিরা চিৎকার করে কাঁদেনইনি। আর বড় ছেলে রাজীব চালাতেন বিমান, এখন চালাচ্ছেন ভারত নামের একটি ঘুড়ি। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, তিনি একজন সুদর্শন ও বুদ্ধিমান এবং তাঁর রয়েছে একজন সুন্দরী ইতালিয়ান স্ত্রী ইত্যাদি। তুমি যদি বাস্তবতার নিরিখে দেখো, তাহলে অন্যান্য খবর সাধারণ মানুষের মনে কোনো প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে না। গর্বাচেভ-রিগান চুক্তি এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন অথবা পারমাণবিক চুক্তি, ওই স্পেনে কালোরা না লালেরা ক্ষমতায় এলো তাতে মানুষের কিচ্ছু এসে-যায় না।

যুগোস্লাভিয়া কিংবা কম্পুচিয়াতে কী ঘটছে না-ঘটছে, তাতে থোরাইকেয়ার সাধারণ মানুষের। এরা হচ্ছে তারা, যারা পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে-বসে দিন কাটায়। কারণ তাদের অবস্থান না ঘরকা না ঘাটকা।

রামলালের বউয়ের খোশগল্প করে বেড়ানোর সময় কোথায়! সে জানেও না দুনিয়ায় কী ঘটছে না-ঘটছে। সে গভীর ধর্মপরায়ণা মহিলা, কিন্তু ধর্মকর্ম করার মতো সময়ই তার জোটে না। তার বাড়িতে ছোট্ট একটা মাটির মূর্তি আছে। সে প্রতি সকালে তাকে প্রণাম করে এবং ছোট্ট প্রার্থনার মধ্যে তার পরিবারের মঙ্গলের আশাবাদের কথা জানায়।

ফুল আর ধূপ-ধুনোর এত দাম যে তাদের ভগবান রামলালের বাসায় এটা উপভোগই করতে পারে না।

কিন্তু জন্মাষ্টমীর মতো বিশেষ দিনে রামলাল দুধের আড়ত থেকে ফেরার পথে ফুলের পার্ক থেকে কিছু ফুল নিয়ে এসে দেবতাকে অর্ঘ্য দেয়। এই ফুল ও ধূপ-ধুনোর অর্ঘ্য দেবতার 'শুভ জন্মদিন'-এর জন্য যথেষ্ট।

যদিও রামলালের স্ত্রী তার স্বামীকে নিয়ে খবরের কাগজে এত ঘটনা ছাপা হচ্ছে তার কিছুই সে জানে না। কিন্তু ইতিমধ্যেই বিষয়টি চারদিকে রটতে শুরু করেছে এবং রসাল ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে প্রতিবেশীদের কান থেকে কানে চলে গেছে।

শেষতক রামলালের পরিবারে পৌঁছায় খবরটি। খবরটি যেন উড়ে এসে রামলালের বউ প্রেমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সে বুক চাপড়ে চিৎকার করে কেঁদে বলে, 'এটা মিথ্যা। ডাহা মিথ্যা। শুধু আমিই জানি মাসের তিরিশটি দিন কিভাবে চলে। পাই পাই হিসাব করে হেঁসেলের চুলা জ্বালিয়ে রাখতে হয়। তার বেতনে মাসের বিশ দিনও যায় না। বাকি দশ দিন? ওই ধারদেনা। যে কেউ মুদির দোকানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারে। তার কাছে আমাদের সব সময় দেনা থাকে। বউজি যদি ঘুষ নিত, আমি এখানে বসে আহাজারি করতাম না, আগামীকাল বাচ্চাদের মুখে কী তুলে দেব তা নিয়েও দাপাদাপি করতাম না।'

প্রতিবেশীরা রামলালের বউয়ের সব কথা শুনে সমবেদনাও প্রকাশ করে যার যার কাজে চলে গেল।

এসব লোক কড়াইয়ে তলানির মতো পড়ে থাকে, তারা মধ্যবিত্ত ও খুব স্বার্থপর। তাদের সারাক্ষণের চিন্তা বাড়ি আর চুলো।

রামলালের বউ সারা রাত ঘুমাতে পারে না। তার সারাক্ষণই মনে হয় সে জ্বলন্ত কয়লার ওপর শুয়ে আছে।

সহসা তার এলোমেলো চিন্তার মাঝে একটা কথা মনে হয়-'বউজি' একজন শান্ত মানুষ। সারাক্ষণ নিজের চিন্তায় ডুবে থাকে। পারতপক্ষে কোনো বিষয়ে কথা বলে না। হতে পারে তার জীবনে আরো একজন নারী ছিল, যার পেছনে সে বাড়তি আয়গুলো ঢেলেছে। তুমি কখনো এসব মানুষ চেনো না।

এবং এভাবেই এই সাধারণ মানুষটি, যে কিনা চোখে ঠুলি পরে ঘানির তেল বের করে যাচ্ছে। সে একজন সাধারণ কেরানি, মাত্র আড়াই রাতের মধ্যে সব মান-সম্মান হারিয়ে মরে গেল!

তার গোত্রে সে ছিল একটা ছাগল মার্কা লোক, যদিও এই গোত্রটি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে এই ভেবে সান্ত্বনা দিত যে এমন দিনও আসবে যেদিন তার সন্তানরা মাথা উঁচু করে চলবে এবং ভাববে তার পিতৃদেব আগাগোড়া একজন সৎ মানুষ ছিলেন। এ জন্য তারা গর্ভও বোধ করবে। তার বেতনে যে সারা মাসও চলত না, এই বিষয়টি তার কাছে একেবারেই মূল্যহীন। তার পরিবারের লোকেরা তো দেখত না সে কত বেতন পায়, না পায়; গত বিশ বছরে সে নতুন একটা স্যুটও বানাতে পারেনি। তার জুতা জোড়ার তলাও এমন ক্ষয়ে গেছে যে মাঝেমধ্যে মনে হয় রাস্তার গনগনে গরম আলকাতরা তলা ভেদ করে তার পায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে। তার একমাত্র সান্ত্বনা যে সে তার সন্তানদের সব রকম দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে বাঁচিয়ে বড় করে তুলেছে।

চরিত্রের দৃঢ়তা নিয়ে তার একটা গর্ভ ছিল; একটানা কাজ করেছে, উচ্চ নৈতিক মনোবল ছিল তার বড় ভিত্তি, যদিও সে জানে নৈতিকতার এই ভিত্তিফিত্তির দাম বাজারের পেঁয়াজের দামের চেয়েও কম।

তার অপরাধবোধ ছিল দুটো। একটা দারিদ্র্য, অন্যটা সততা।

একজন গরিব মানুষের প্রয়োজন যুক্তি দিয়ে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারা কিংবা গায়ের জোরে দখল করে নেওয়া। সে এই দুটোর যদি কোনোটাই করতে না পারে, তাহলে সে নিজেই দখল হয়ে যেতে পারে।

রামলাল এভাবেই দখল হয়ে গেল, যখন সে আর বেঁচে নেই।

আসলে সে ডাকাতির ব্যাপারটা জেনেছিল তার মৃত্যুর সামান্য কিছু আগে। আর খবরটা সে যখন জানতে পারে তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় দিনমানেই সে বিষয়টি জানিয়ে দেবে।

এভাবেই ব্যাপারটা ঘটে যায়।

এটার শুরুটা এভাবে : যখন গণপূর্ত বিভাগের কমিশনারের বিশাল, মনোরম, আকর্ষণীয় ও ক্ষমতাবান প্রাইভেট সেক্রেটারির টেবিলে তার বদলি হওয়ার নথিটি আসে, তখনই জানাজানি হয় তার সহকর্মীরা তাকে অভিনন্দন জানায়।

সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে জানতে চায়, অভিনন্দন! কিন্তু কেন? এটা তেমন কোনো পদোন্নতি নয়। একজন কেরানি একটি জোয়ালে বাঁধা গরু ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে জোয়ালটা তুমি বাইছো মাঠে, না গরুর গাড়িতে। পার্থক্য তেমন কিছুই নয়।

'পার্থক্য? তোমরা পার্থক্যের কথা বলছ? ওহে বন্ধুরা আমার! তোমরা যদি কেউ এই জাদুর চেয়ারে একবার বসতে পারো, তখনই এর পার্থক্যটা বুঝতে পারবে। তোমার নতুন উপরওয়ালার ঘরে টনকে টন মালপানির লেনদেন হয়। ভক্তরা তখন দেবতার উদ্দেশ্যে ভক্তির ডালি সাজিয়ে আসে। তখন পুরোহিতও কিছু ভাগ পায়'-একজন অর্থপূর্ণ হাসি হেসে কথাটি বলে।

সবাই হাসে, কিন্তু রামপালের মুখ লাল হয়ে যায়। ভাবে সবাই বুঝি তার দিকে পাথরের নুড়ি ছুড়ে মারছে।

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, 'হায় ভগবান! এই নরক যন্ত্রণা থেকে তুমি আমার সম্মান ও সততা রক্ষা করো।'

এখন সে নতুন কর্তার সঙ্গে কাজ শুরু করে। তখনই কর্তা তাকে একটি তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, 'এই তালিকার সবাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি; এরা ফোন করলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে লাইন দেবে; আর যদি সশরীরে আসে তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই আমার ঘরে নিয়ে আসবে।'

বাকিটা নিজে বুঝতে সে কিছুটা সময় নেয়, ধীরে ধীরে, অভিজ্ঞতা দিয়ে। তাকে কর্তার মনোভাব বুঝতে হয় তার চোখের পাতার ওঠানামা দেখে, চোখের দৃষ্টিভঙ্গির চেহারা বুঝে। কর্তার বিভিন্ন মনোভাবের সঠিক অর্থটা বুঝে যথাযথভাবে কাজ করা তার চাকরির একটা অতি আবশ্যক অংশও।

তাকে অনেক সময় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় ওই মহাক্ষমতাবান শয়তান লোকটার ঘরে কাকে ঢুকতে দেবে বা দেবে না; বস যখন মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকে তখন চা দেওয়া না-দেওয়া, তিনি ফ্রি থাকলেও সামান্য নেশাটেশা সরবরাহ করা, ভব্যতাহীন কিছু লোকের পাইপ টানা মেনে নিতে হয়। এর পরও তার 'লাভজনক' কোনো কাজের জন্য যদুমধুকেও কর্তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিতে হয়। তার খামোখা সময় নষ্ট করার সময় কোথায়?

প্রাইভেট সেক্রেটারির চেয়ারে বসে রামলাল বুঝতে পারে এই রহস্যময় জগৎটার বিধাতা হচ্ছে সর্বক্ষমতাধর অর্থ। যদি তারও রাজনৈতিক দলের উপরওয়ালা কেউ ফোন করে একটু সাহায্য চায়, তাহলেই বুঝতে হবে টাকা-পয়সার লেনদেন আগেই হয়ে গেছে।

রামলাল বুঝে গেছে চোরেরা তাকে ঘিরে ফেলেছে। তার মনে হয় সে যেন আলীবাবা। আসলেই তাই, তবে তাকে ঘিরে ফেলেছে চল্লিশজন নয়, চল্লিশ হাজার চোর।

চিন্তা করে দেখল রামলাল, সব কাউন্সিলর, রাজ্য সরকার ও সংসদের সব সদস্য, যারা নির্বাচনের সময় সহায়তা করেছে, তাদের সব সময়ই যত্নের সঙ্গে তোয়াজ করে যেতে হবে।

এসব মালই চোরের হাড্ডি।

সব সময়ই দেখা যায় বড় চোরদের পেছনে একদল ছোট চোর থাকে। এরা সেই রাশিয়ান বড় পুতুলের মতো, যার একটা খুললে আরেকটা বেরোয়; সেটা খুললে আরেকটা, তারপরে খুললে আরো এবং সবার শেষে সবচেয়ে ছোটটা। চোরের মধ্যে চোর।

আরব্য রজনীর চল্লিশ চোরকে আলীবাবা যেভাবে চেটেপুটে শেষ করেছিল, রামলালের পক্ষে তার কিছুই করা সম্ভব হলো না। যেদিন সে এই পদে যোগ দিতে আসে, সেদিনটাকে সে কেবল অভিশাপই দেয়। সে অনুভব করে এরা তার শুধু বারোটাই বাজাতে পারে। কারণ ভারতের আয়তনে সে একটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয়, সব দেশের উত্তরাধিকারের বিচারে তার সব কিছুই লোপাট হয়ে যেতে পারে।

এই চেয়ারে বসে মনে হয় তার তৃতীয় চক্ষু খুলে গেছে। যদিও এটাকে শিবের তৃতীয় চোখ বলা হয়। কিন্তু শিব যেমন তৃতীয় চোখের ক্রোধে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পুড়িয়ে দিতে পারে, পচা-গলা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, রামলাল তার তিন নম্বর চোখ দিয়ে কিছুই করতে পারে না। শিব যেমন বিষপান করে নতুন চেতনা অর্জন করেছিল, সে ক্ষেত্রে সে কেবল ওই চোখেই শুধু দেখতে পায়।

তৃতীয় চোখ দিয়ে রামলাল দেখে কিভাবে বিনা ওষুধে লাখ লাখ লোক মারা যায়, শিশুরা কেন শিক্ষা পায় না, যুবাদের হাড়-মাংস ঘুণপোকার আক্রমণে ক্ষয়ে যাচ্ছে, যে বয়সটায় কাজ করার বয়স, তখনই দেখা যায় তাদের জন্য কোনো কাজ নেই; এমনই অবস্থা যে আলকাতরা দিয়ে সদ্য তৈরি করা রাস্তা বর্ষার প্রথম মৌসুমেই ধুয়েমুছে গেছে, রাস্তা খানাখন্দে চলাচলে ঝাঁকুনির চোখে জান শেষ। কিন্তু সব রাজনীতিবিদই নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। সে জানে নির্বাচিত হওয়ার পর তার সব বেতনের কাছে রামলালের আয় তুচ্ছাতিতুচ্ছ। কিন্তু রামলাল এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না। পারার মধ্যে পারে শুধু 'জি স্যার', 'ঠিক আছে স্যার' বলতে।

তার করণীয় হচ্ছে, বড় কর্তার ডিকটেশন নেওয়া, চিঠি ও নোটগুলো টাইপ এবং টেলিফোন রিসিভ করা।

রামলালের চাকরির একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে তার কাঁধের ব্যাজ।

'রামলাল? কোন রামলাল?'

'রামলাল! ওহ, যে ভাইরন প্রসাদের ছেলে।'

'কোন হতভাগা ভাইরন প্রসাদ? এই দেশে লাখ লাখ রামলাল আর ভাইরন প্রসাদ তারপিন তেলের চেয়েও কম দামে বেচাবিক্রি হচ্ছে, গুদামে জমা আছে।'

'আরে রামলাল হচ্ছে পাবলিক ওয়ার্কসের কমিশনারের একান্ত সচিব। চাকরি করে টাউন হলে।'

'তাই বলো! ওই রামলাল!'-এই পরিচয়টাই তাকে আর দশজন থেকে আলাদা করেছে।

তার সন্তান তিনটি। তাদের প্রয়োজন খাদ্য, ওষুধ, স্কুলের বেতন, নোটবই আর বইয়ের জন্য টাকা। তারাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে তাদের যথেষ্ট পরিমাণ খাবার ছিল না, নতুন ক্লাসে যাওয়ার সময় কখনোই নতুন বইও ছিল না। তাদের পায়জামা ছেঁড়াই থাকত, বিশেষ করে পেছনের দিকে, আর জামার কলার? সব সময়ই ছেঁড়াফাটা।

রামলালের বৌয়ের হাতে যেন জাদু ছিল। বাচ্চাদের ওই সব ছেঁড়াফাটা জামাকাপড়ের অংশ এমনভাবে সেলাই করে দিত যে ধরাই যেত না। আর সেগুলো ম্যাজিকের মতো করত রামলালের বাতিল জামাকাপড়ের টুকরো দিয়ে। ঝুল বেশি থাকলে ছোট করে দিতে পারত, হাতার আকার ছেঁটেছুটে এমন করে দিত যেন জাদুবিদ্যা। কিন্তু সে কখনোই জামার কলার সেলাই করতে পারত না। ফলে ওই কলার রামলালের কলার থেকে তার বাচ্চাদের কলার পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো।

দেশের দারিদ্র্য ও ক্ষুধার মতোই এই কলার চলত বংশপরম্পরায়; শোভা পেত দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের গলায়।

শিক্ষকরা সব সময়ই তাদের বকাঝকা, গালমন্দ করত; বকত দেরি করে আসার জন্য, ঠিকমতো বাড়ির কাজ না করা, সময়মতো স্কুলের বেতন দিতে না পারা, আর অসভ্যতা ও বাঁদরামির জন্য।

আসলে রামলালের ক্লান্ত ভারাক্রন্ত কাঁধে 'দেশের ভবিষ্যতের বোঝা'র ভার, সে জন্য 'পৌরাণিক শিল্পীত মানচিত্র'-এর মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফেলেও দিতে পারত না। কিন্তু সে মানচিত্র প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরই তো!

ঈশ্বর তো সবই করতে পারে! তারা ঘাড় ঝাঁকুনি দিতে পারে, পাহাড়-পর্বতকে হাতের তালুর ওপর তোলা কোনো ব্যাপারই নয়, মাখন চুরি করতে পারে এবং বিবাহযোগ্য ন্যাংটো মেয়েদের স্নান দেখতে পারে, বিবাহিতা মহিলাদের সঙ্গে জোর গলায় প্রেম-ভালোবাসার কথা বলা, যাদের ওপর প্রভুত্ব খাটাতে চায় তাদের কাছে গর্ভবতী স্ত্রীকেও পাঠানো, স্ত্রীর সতীত্ব প্রমাণের জন্য জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাঁটাতেও পারে, তারা সবই পারে, কারণ তারা প্রভু।

রামলাল তার কাঁধ থেকে এসব ঝেড়ে ফেলার কথা চিন্তাই করতে পারত না; যদি পারত তাহলে আসন্ন ভূমিকম্পের আঘাত পাথরের কণার মধ্যে চাপা পড়ে থাকত।

অতএব, রামলাল কাজ করে যেত নিঃশব্দে। নতুন নতুন যেসব অভিজ্ঞতা সে অর্জন করত সেগুলো বিষ গেলার মতো হজম করে ফেলত।

বৃষ্টির মৌসুম শুরু হয়েছে। গত দুদিন মুষলধারে বৃষ্টির তৃতীয় দিনে নতুন বানানো স্কুলের ছাদ ধসে পড়ল তাসের ঘরের মতো এবং সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই মারা গেল চারটে শিশু। মারাত্মক আহত চারটে শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।

যে কন্ট্রাক্টরকে স্কুল বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় রামলাল তাকে চেনে। রামলালের মাধ্যমেই তার বস কন্ট্রাক্টরকে হাজার গজ আয়তনের একটা প্লট সম্পর্কে আভাস দিয়ে জানিয়েছিল একজন ভালো আর্কিটেক্ট দিতে। সবজান্তার মতো হাসি দিয়ে বলেছিল কন্ট্রাক্টর, 'আর্কিটেক্ট কেন? আমিই তো ওটা বানিয়ে দিতে পারি। সাহেবকে এটা নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করো। আমাকে শুধু দশটা স্কুল বিল্ডিং বানানোর কার্যাদেশটা পাইয়ে দাও। দিয়ে স্যারকে বলে রেখো তার চিরবিশ্বস্ত দাসানুদাস সব কাজ করে দেবে।'

রামলাল জানত এর মধ্যে একটা নোংরা খেলা আছে। তবে সে বিশ্বস্ততার সঙ্গেই তথ্যগুলো তার সাহেবকে বলেছিল।

রামলালের নিজেকে একজন দুষ্কর্মের সহযোগী মনে হয়।

কন্ট্রাক্টর তার কথা রেখেছে এবং ছয় কি সাত মাসের মধ্যে বাড়ির কাজ শেষ। একটা দেড়তলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। মার্বেল আনা হয়েছে মাকরানা থেকে, বোম্বাই থেকে এসেছে টাইলস। সাহেবের বৌয়ের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে এসেছে স্যানিটারি ফিটিংস, লাইট ও ঝাড়বাতি, ফ্যান এবং এয়ারকন্ডিশনার।

রামলালের ওপর কখনো কখনো মেমসাহেবকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে ইটালিয়ান ও জার্মান সরঞ্জামাদি কেনার নির্দেশ এসেছে। এসবের দাম শোধ করত কন্ট্রাক্টর।

বাড়ির কাজ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল একটা অপরূপ সুন্দর ও মজবুত বাড়ি। এমন একটি বাড়িতে কর্তার তৃতীয় ও চতুর্থ বংশধরও বসবাস করতে পারবে।

স্কুল ভবন তৈরি হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে ভেঙে পড়ল কি না তা নিয়ে এখন কে আর মাথা ঘামায়? যেসব শিশু ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জীবন দিল তারা হিসাবের মধ্যেই এলো না। অমন বেহিসাবি মৃত্যু দেশে হাজারে হাজারে ঘটছে; প্রত্যেক দিন গাদায় গাদায় জন্মও তো নিচ্ছে।

যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো, কে এই শিশুদের স্কুলে যেতে বলেছিল? কেন বলেছিল তাদের? তারা ফুটপাতে জুতা পালিশের কাজ করতে পারে, রাস্তার পাশে 'ধাবা'র থালাবাসন ধুতে পারে, বাসাবাড়ির চাকরগিরি কিংবা কোনো কারখানার পেছনে ভাগাড়ে কাজ রয়েছে, কুলিগিরি করা যায়, রাস্তার মোড়ে খবরের কাগজ বিক্রির কাজও তো করা সম্ভব। হ্যাঁ, তারা যা খুশি তাই করতে পারে। কিসের পাল্লায় পড়ে তারা বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যায়? তারা কি জানে না শুধু শোভা বাড়ানোর জন্য স্কুলটি বানানো হয়েছে, আর বর্ষা মৌসুমের প্রথম ধাক্কাতেই ওটা ধসে পড়বে?

খেপে গেছে রামলাল।

তার রাগ নিহত বাচ্চাগুলো ও বসের ওপর, কন্ট্রাক্টর এবং নিজের ওপরও।

বিকেলে বস মাখন মাখানো গলায় রামলালকে ডেকে বলল, এই বিল্ডিং বানানোর ব্যাপারে কন্ট্রাক্টরকে দেওয়া যত ফাইল আছে, সব নিয়ে সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসবে।

সন্ধ্যার সময় বিল্ডিং বানানোর সংশ্লিষ্ট যত ফাইল, সব নিয়ে বসের বাসায় পৌঁছে দেখল ড্রয়িংরুমে বসের সঙ্গে কন্ট্রাক্টর ও তার ছেলে একসঙ্গে বসে মদ গিলছে।

বস বলল, রামলাল, ফাইলগুলো ওই টেবিলে রাখো, আর বিল্ডিং বানানোর ব্যাপারে ফাইলে যেখানে যেখানে উল্লেখ আছে, সেখানে কাগজ দিয়ে দিয়ে রাখো।

রামলাল শান্তভাবে যন্ত্রের মতো বসের নির্দেশ পালন করতে থাকে।

কন্ট্রাক্টর রামলালের কাজের গুরুত্ব বুঝতে পেরে একটা গ্লাসে মদ ঢেলে রামলালকে দেয়। রামলাল অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি জীবনেও ও জিনিস চোখে দেখিনি। কিন্তু কন্ট্রাক্টর পীড়াপীড়ি করতে থাকে, আরে একটু খাও না! আমরা তোমাকে সম্মানিত করতে চাইছি। রামলাল, তোমাকে একটা চুমুক দিতেই হবে। তুমি যদি না দাও, আমরা কিন্তু সত্যি আহত হব।

নিঃশব্দে মিটিমিটি হাসছিল বস। শুধু তাই নয়, একটা নির্লিপ্ত ধৈর্য নিয়ে গোটা ঘটনাটা দেখছিল। এটা সে সচরাচর করে না।

রামলাল তার দিকে তাকায়; তাকিয়ে একবার কৃতজ্ঞ বোধ করে, সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিশোধের ইচ্ছাটা তীব্র হতেই গ্লাসের সবটুকু মদ এক চুমুকে গিলে ফেলে। শেষ করেই গ্লাসটা আবার এগিয়ে দেয়, কন্ট্রাক্টর আবার সেটি ভরে দিল।

দ্বিতীয় পেগটি শেষ করে সে গা ছাড়া দিয়ে পেছনে হেলান দিয়ে বসে। সে চোখ খুলে চায়, তাকায় চারপাশে। এই ঘরে সে বহুবার এসেছে, কিন্তু কখনো চোখ তুলে কথা বলতে পারেনি। এইবার জীবনের প্রথমবার চারদিকে চোখ মেলে দেখল, ঘরে রয়েছে টিভি, ভিডিও, পারস্যের কার্পেট, মনোরম ফুলদানিতে সাজানো ফুল, ডিনার সেট, বাদ্যযন্ত্রের সরঞ্জাম এবং আলো ঝলমল ঝাড়বাতি।

উঠে দাঁড়ায় রামলাল। হাঁটা দেয় বাইরে।

বাসায় ফেরার পথে সে নিজেকেই ধিক্কার দিতে দিতে বলে, ওহে বেজন্মা রামলাল! জীবনে কী করতে পারলে? অর্জনটাই বা কী তোমার? পরিবারের মুখে তো দুই পদের খাবারও তুলে দিতে পারোনি! কোনো সুখ দেওয়ার ক্ষমতা তোমার হয়নি। তুমি স্কুলের ওই হতভাগ্য শিশুদের স্কুল ভবন ধ্বংসের মৃত্যুর হাত থেকেও তো বাঁচাতে পারলে না!

রামলাল, তুমি, তুমি একটা মরা কুত্তার চেয়েও অধম। সে ছিল মাতাল এবং জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। তার সারাটা রাত গেল নিজের সঙ্গেই বোঝাপড়া করতে করতে, কথা বলতে বলতে। সমগ্র বিশ্বের ওপর সে তখন মহাক্ষুব্ধ।

সকালে ঘুম থেকে উঠল রামলাল। শান্ত, সমাহিত রামলাল একটা নতুন ব্লেড বের করে দাড়ি কামায়, স্নান সারে, কাপড় পরে এবং অফিসে যায়।

ওপরে উঠতে থাকে রামলাল, উঠতেই থাকে; যতক্ষণ না সে ছাদে পৌঁছায়, উঠতে থাকে। সেখান থেকে সে নিচে ঝাঁপ দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ