পার্কের পূব দিকের ঘন ঝোপকে পিছনে ফেলে বসে আছেন অধ্যাপক আফছার আজম। বিকালের চিকন আলো হালকা আঁচ নিয়ে তার কপালে এসে বাড়ি খেয়ে খসে পড়ছে শরীর বেয়ে। মাঘ মাসে এই উত্তাপ বেশ স্বস্তিদায়ক। তার আরও একটা পরিচয় আছে, তিনি হলেন চলতি সময়ের প্রভাবশালী কবিদের একজন। কবিতার পাঠক-অপাঠক সবার মুখে মুখে এখন চর্চিত হচ্ছে তার নাম।
প্রতিটা কাগজের পাতা জুড়ে আলোচনা হচ্ছে তার কবিতার, যেনো কোনো এক পাগলা রাজা ঘোষণা দিয়েছেন। তিনদিনের মধ্যে আফছারের কবিতার নাড়ি নক্ষত্র জাহির করতে হবে। পারলে এনাম না পারলে কতল হবে গর্দান। এখানে কারণটা অবশ্য অন্য। দুই দিন হলো ঢাকাগামী একটি বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন কবি আফছার আজম। খবরের কাগজ ও টেলিভিশন-নিউজ এমনটিই বলছে। এই মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি সাতিশয় ক্ষুব্ধ। তার দাবি, ঐ বাসে ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল সত্যি, টিকিটও কেটেছিলেন, বাসে উঠেও বসেছিলেন কিন্তু দুর্ঘটনার কিছু কাল আগেই আগের এক স্টপেজে নেমে পড়েন। আর ওঠেন নি। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গিয়েছিল, কবিতার খাতাটা ফেলে এসেছেন টেবিলের উপরে। আফছার আজম যেদিন থেকে কবিতা লেখা ধরেছেন সেদিন থেকে কবিতার খাতা ছাড়া এক পাও এদিক ওদিক হননি। কিছু কিছু ধূমপায়ী যেমন লাইটার ছাড়া ঘর ছাড়েন না তেমনি। ফলও পেয়েছেন বেশ। তার কোন কবিতার কোন শব্দটার কোথায় জন্ম তা বলা মুশকিল। একবার তার মাথায় ভূত চেপে বসলো সমুদ্রের ফেনায়িত জলে হাঁটু চুবিয়ে কবিতা লিখবেন, সম্ভব হলে আস্ত একটি কবিতার বই ফেঁদে ফেলবেন। বইয়ের নামও ঠিক করে ফেললেন। ‘জল জ্বালিয়ে শব্দ কণা’। কোনো এক মে মাসে বেতন উঠিয়েই রওনা হলেন কক্সবাজারের উদ্দেশে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সমুদ্রের জলের কোল ঘেঁষে চেয়ার পেতে বসলেন। জলের ডগা এসে ছুঁয়ে যেতে থাকলো পায়ের পাতা। সাদা ফেনার বুঁদবুঁদ এসে ঢেকে দিলো কবি আফছারের শ্যামলা শক্ত পা দুখানি। এখনই সময়। খাতা বের করলেন তিনি, আঙুলের ডগায় ঢাকনা হটিয়ে প্রস্তুত পেন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পাল্টালেন, খালি নেই এক ইঞ্চিও। সেদিন কোনো শব্দ না লিখেই ফেরত আসলেন। পরে আর এক মে-তে আবার গেলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পা চুবিয়ে বসে রইলেন সমুদ্রের সফেদ ফেনায়িত জলে। সারাদিনে খালি একটিই শব্দ বের করা সম্ভব হলো কলমের মুখ থেকে। নৈশব্দ। বাকি শব্দগুলো তিনি সমুদ্রের কিনারে হেঁটে হেঁটে, ফিরতি ট্রেনের বগিতে বগিতে ঘুরে জোগাড় করলেন। শব্দগুলো জোড়াতালি দিলে একটি আট লাইনের কবিতা দাঁড়ালো--
‘শব্দে নৈশব্দে
জীবনভোর কাটলো তার
পরকালে ভগবান শুধায়-- শব্দ না নৈশব্দ?
বেকুবের মতো বলল সে-- যদি দুটোই চাই।
ছয় মাস এখন স্বর্গে, ছয় মাস নরকে।
পালাবদলের সময় মনে মনে ভাবে সে--
পৃথিবীতে তাহলে দুটোই ছিল, একটু
কায়দা করে আলাদা করতে পারলেই...।’
তিনি যখন বাস থেকে নেমে আসেন তখন যে লোকটি তাকে নামতে দেখেছিল সে মারা গেছে দুর্ঘটনায়। আফছার আজম বহু কষ্টে ঠিকানা ম্যানেজ করে লোকটির বাড়ি গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন বাড়িতে কেবলই শোকের মাতম। আবার কবিতার খাতা নিতে যখন বাড়িতে ঢুকেছিলেন তখন পোষা কুকুরটি ছাড়া আর কেউ দেখেনি তাকে। ততক্ষণে খবর পৌঁছে গেছে দুর্ঘটনার। সবাই তখন টেলিভিশনের সামনে। তখনও সময় ছিল, ওদের সামনে গিয়ে যদি আফছার আজম বলতেন। আমি যাইনি। এই দেখো ফিরে এসেছি। তাও কথা ছিল। কিন্তু তা না করে তিনি ট্রেন ধরে চলে এলেন ঢাকায়। দুর্ঘটনার ঘটনাটা তখনও তিনি জানতেন না। জানতো না অনেকেই। পরদিন দুপুরে চীন মৈত্রী সেতুতে কবিদের সম্মেলন। আফছার আজম হোটেল থেকে ফ্রেস হয়ে বার টার দিকে রওনা হলেন। ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দৈনিকের হেডলাইনে বোল্ড অক্ষরে ছাপা হয়েছে। ঢাকাগামী একটি বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন দেশ বরেণ্য কবি অধ্যাপক আফছার আজম। টেলিভিশনেও পরিপাটি করে প্রচার করা হচ্ছে খবরটি। তিনি নিজে জানতে পারলেন কবিদের সম্মেলনে গিয়ে। সবার মুখে আফছার আজমের কথা। যেমন তার কবিতার প্রশংসা তেমন তার মানব সত্তার। শত্রুদের মুখেও ফুল চন্দন পড়েছে যেন। আফছার আজম তার এতো কদর দেখে রীতিমত অভিভূত। আরও অভিভূত হলেন যখন জানতে পারলেন। আজকের অনুষ্ঠানটি সদ্য অকাল প্রয়াত কবি আফছার আজমকে উৎসর্গ করা হয়েছে। ‘মানে আমি আর দুনিয়াতে নেই। রীতিমত আহাম্মকি ব্যাপার। জীবিত থেকে নিজের এই অন্তর্ধান কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। নিশ্চয় এ সব কোনো মহল থেকে চক্রান্ত করে করা হয়েছে।’ মনে মনে ভাবলেন তিনি। তারপর যখন আসল ঘটনাটা জানতে পারলেন, তখন এতো কষ্টের মাঝেও একচোট না হেসে পারলেন না। মানলেন ঘটনার সূত্রপাত তিনি নিজেই করেছেন। ‘ঐ ভাবে নেমে আসাটা ঠিক হয়নি আমার। আবার না নামলেও যে সত্যি সত্যিই এতক্ষণে। ভাগ্য সহায় ছিল বলতেই হবে। কিন্তু এতোগুলো লোককে একসাথে সেটা কি করে বোঝাবো আমি? তারপর আবার সারা দেশের মানুষ। কি মুশকিলে পড়ে গেলাম।’ তারপর তিনি একটা প্রাথমিক উদ্যোগস্বরূপ কয়েক জনকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন বিষয়টি। অতি নিকটতম কয়েকজন বন্ধুর কাছেও গেলেন। ফল শূন্য। কেউ মন দিয়ে শুনলো না তার কথা। যারা খানিকটা শুনলো বলে মনে হলো তারা হেসে উড়িয়ে দিলো-- ‘বাহ। আপনি ভালো মজা করতে পারেন তো।’ সবগুলো পেপারের ফ্রন্ট পেজে গোটা গোটা অক্ষরে ছাপা হয়েছে। চ্যানেলে চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ ঝুলে আছে সকাল থেকে। ‘ না। আমাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণও দেখছি না।’ কিঞ্চিৎ হতাশার সাথে গোটা অনুষ্ঠান জুড়ে চেষ্টা চালালেন। কোনো ফল হলো না। ‘এখানে মনে হচ্ছে জীবিতের চেয়ে মৃতের কদর বেশি। নিজের কদর দেখে যেমন ভালো লাগছে, তেমন জীবিত আমিকে যেভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে তাতে কষ্টও কম হচ্ছে না। আশ্চর্য, পেপার আর চ্যানেল বলল আর আমি নিমিষে নেই হয়ে গেলাম। এখন উপায় কিছু একটা বের করতে হবেই।’ পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলেন। ‘ঐদিকে বাড়িতে কি হচ্ছে তার একটা খোঁজ নেওয়া দরকার। মেয়েটা নিশ্চয় কাঁদতে কাঁদতে এতক্ষণে চারপাশ ভাসিয়ে দিলো। বৌটারও না জানি কেঁদে কেঁদে কি দশা। আত্মীয়স্বজন কতো কাজকর্ম ফেলে ভিড় জমাচ্ছে বাড়িতে। ওখানেই আগে জানানো দরকার যে আমি বেঁচে আছি। তারপর ওরাই না হয় একে একে সবাইকে জানিয়ে দেবে।’ মেয়ের নাম্বারে কল করলেন তিনি। কিন্তু এরর দেখাচ্ছে। আফছারের সিম কার্ড বন্ধ। সিম কোম্পানিও জেনে গেছে তার মৃত্যু-সংবাদ। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। আপাতত সশরীরে বাড়িতে হাজির হওয়া ছাড়া উপায় নেই। দুপুরের বাসে রওনা হলেন রাজশাহী অভিমুখে। বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তিনি যা ধারণা করেছিলেন তাই হলো। সমস্ত বাড়ি এখন মানুষে গিজগিজ করছে। কেউ কাঁদছে, কেউ সান্তনা দিচ্ছে। নিজের চোখে নিজের মৃত্যুকে এভাবে দেখে যেতে পারবেন তা তিনি কোনো দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কখনো। ভাববারও কোনো কারণ ছিল না। শুধু এই সামান্য একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে আজ এই বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ‘দুর্ঘটনার জন্যে কি ঐ বাসটায় জুটেছিল কপালে। বুঝলাম বেশির ভাগ লাশ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। মাথা না হয় থেঁতলে গেল, পোশাকের কি কোনো মূল্য নেই? আমার সাদা শার্ট, না হয় আমার জুতা জোড়াও কি পরিবারের কেউ চিনতো না? মেয়েটা কতো পালিশ করে দিয়েছে, ভুলে গেলো? কত দূর থেকে, কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এতোগুলো মানুষ আমার বাড়িতে সমবেত হয়েছে, এতো শোক, কান্নাকাটি করছে, হঠাৎ করে এদের বেঁচে আছি এই খবরটা দেওয়া কি ঠিক হবে? ওদের সেন্টিমেন্টকে তো নূন্যতম শ্রদ্ধা দেখানো উচিত, নাকি। খবরটা কি তাহলে কাল দেবো? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমি মেয়েটার একেবারে টিকির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাম পাশে বড় বোন, ডান পাশে ছোটো ভাইয়ের বউ। কেউ আমাকে চিনছে না? একবার কেউ ঘুরেও তাকাচ্ছে না আমার দিকে। এভাবে মরা-বাড়িতে একটা মানুষ ছ্যাবলার মতো ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে তাকিয়ে দেখছে, চোখে কান্নার ছিটে ফোঁটাও নেই। এটা দেখেও তো একবার তাকানো উচিত। মেয়েটা আমার কলিজার টুকরা, সাত রাজার ধন সে। ওর কান্না আমার কখনই সহ্য হয় না। পাশে গিয়ে বসলাম। রাত ভোর কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমি মাথায় হাত দিয়ে আদর করতেই আমার বুকে এলিয়ে পড়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। বাবা নেই। বাবা গো। ওর কান্নায় আমি আর থির থাকতে পারলাম না। পাল্লা দিয়ে আমিও কাঁদলাম।’ নিজের মৃত্যুতে পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম বোধ হয় কেউ কাঁদলো।
‘সারারাত আমি সবাইকে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সান্ত্বনা দিলাম। কেউ আমাকে চিনলো না। ওদেরকেই বা দোষ দিই কেমন করে। এতগুলো চ্যানেল, পেপার। একসাথে সবাই তো আর মিথ্যা বলবে না। আমি একা একটা মানুষ বললেই তো আর সব মিথ্যা হয়ে যাবে না। পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। এখন ছাত্রদেরকে এক জায়গায় করে যদি একটা র্যালি বের করতে পারি ‘প্রিয় আফছার স্যার মরে নাই।’ এই শিরোনামে, তারপর একটা সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারলেই কাজ ফতে। তখন সবগুলো চ্যানেল পত্রিকা ভুল সংবাদ পরিবেশনের জন্যে বাপ বাপ করে দুঃখ প্রকাশ করবে। আমি চাইলে মানহানির মামলা ঠুকে কয়েক লক্ষ টাকা কামিয়ে নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে কি কোর্ট কোনো মানহানির মামলা নেবে? কি জানি।’
ছাত্ররা ইতোমধ্যে র্যালি বের করে ফেলেছে। শোক র্যালি। আফছারের সহকর্মী কিছু শিক্ষকও আছেন সামনের সারিতে। যে সহকর্মীর সাথে তার কখনই বনিবনা হয়নি তার হাতের প্ল্যাকার্ডে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘আফছার সাহেব, আপনার শোকে আমরা মর্মাহত।’ হাতের লেখাও তার। এই ডিপার্টমেন্টে এত বাজে লেখা আর কারও হতে পারে না। আফছার গিয়ে দাঁড়ালেন র্যালির সামনে। নিজের শোক র্যালির আগে আগে হাঁটছেন তিনি নিজেই অথচ কেউ তাকে আমলে নিচ্ছে না। হ্যালুসিনেশন ভেবে দেখেও না দেখার ভান করছে সকলেই। এখানেও তিনি মহা বেকায়দায় পড়ে গেলেন।
হকারের কাছ থেকে পেপার কিনলেন। যার মৃত্যু-সংবাদে তার পেপারের কাটতি বেড়ে গেছে দ্বিগুণ তাকে সামনে পেয়েও খেয়াল করলো না সে। চায়ের দোকানে বসে পেপারটা খুললেন। প্রথম পাতায় লেখা হয়েছে তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী পৃথক পৃথক বার্তায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিরোধী দলের নেত্রী এই দুর্ঘটনার জন্যে সরকারকে দুষতেও ভোলেন নি। একটা বিশেষ পাতা ছাপা হয়েছে। ভালোই লাগছে তার। আবার খারাপও। প্রথমেই তরুণ বয়সের একটি ফটো। নিচে বোল্ড অক্ষরে লেখা ‘অসময়ে চলে যেতে হলো কবি আফছার আজমকে।’ এমন খবর কোনোদিন মিথ্যে হয়েছে? নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে কেমন কষ্ট হচ্ছিলো তার। নিচে এ সময়ের একজন বড় কবি তাকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন। আরও কয়েকজন কবি লিখেছেন তাকে ও তার কবিতা নিয়ে। নিজেকে নিয়ে স্মৃতিকথা পড়ার সৌভাগ্য কারও হয় না। যে কারণেই হোক তার হয়েছে। একে একে সবগুলো লেখা পড়ে শেষ করলেন। বেশির ভাগই বানিয়ে বানিয়ে লেখা। যার সাথে তার কোনোদিনই দেখা হয়নি সেও কেমন সুন্দর করে একসাথে চা খাওয়ার গল্প ফেঁদেছে। ‘শুধু চা খাওয়া হলে না হয় মানা যেতো। আমি নাকি বলেছি, দাম্পত্য জীবনে আমি সুখী নই। ডাহা মিথ্যা কথা। ব্যাটাকে হাতের কাছে পেলে টুঁটি চেপে ধরতাম। আমি মরে গেছি ভেবে যা তা লিখবা তা তো হতে দেওয়া যায় না। একজন লিখেছে, আমার কবিতা বিশ্বমানের। আমার নোবেল পাওয়া উচিত ছিল। এটা বেশি হয়ে গেল। স্তুতিরও তো একটা সীমা থাকে নাকি।’ বেশির ভাগ কথায় মানতে পারেন না তিনি।
তবে তিনি সবচেয়ে মজা পেলেন অন্য একটা খবরে। কবি জীবনের প্রথম দিকে তার একটি কবিতা ছিল ‘তোমাকে দেখি সবসময়’ এই শিরোনামে। একজন বীরের স্তুতিগাঁথা। বিরোধীদলের ধারণা কবিতাটি তিনি তাদের নেতাকে নিয়ে লিখেছিলেন। আর সরকারি দল ফলাও করে প্রচার করছে যে কবিতাটি আসলে তিনি তাদের নেতাকে নিয়ে লিখেছিলেন। কবিতাটি এখন উভয় দলের রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে দুই পন্থীদের কলম যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে যার মতো করে প্রমাণ করছে তাদের ক্লেইম। মজা পাচ্ছেন এই জন্যে যে তিনি আসলে কবিতাটি লিখেছিলেন তার মহল্লার এক বৃদ্ধ নাইট গার্ডকে স্মরণ করে। চোর বাটপারদের অসহযোগিতা করার কারণে এক মধ্যরাতে তাকে মেরে চৌরাস্তার বটগাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পেপার পড়তে পড়তেই তিনি একটা আইডিয়া পেলেন। এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। পাশেই ছিল বিজ্ঞাপন অফিস, ঢুকে গেলেন ভিতরে। যারা তার মরার খবর বিনে পয়সায় ফলাও করে প্রচার করেছে তাদের কাগজেই এখন তিনি না মরার বিজ্ঞাপন দেবেন। ‘বিজ্ঞাপনে আমি আমার শরীরের বর্ণনা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পিতৃপরিচয় সবকিছু বিস্তারিত উপস্থাপন করবো যাতে কারও সন্দেহ না হয়। প্রয়োজন হলে সঙ্গে আধখানা ফটোও জুড়ে দেবো।’ মনে মনে ভাবেন তিনি। ভেতরে ঢুকে দেখেন বিশাল সাইজের একটা টেবিলে মাঝবয়স্ক খাটো একটা লোক বসে কিছু কাগজ নাড়াচাড়া করছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে টেবিলের উপর বসা একটা বাচ্চা ছেলে কাগজ নিয়ে খেলা খেলছে। সোজা লোকটির কাছে চলে গেলেন। লোকটি ইশারা করার সাথে সাথে সামনের চেয়ারটি টেনে বসলেন। কাগজগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে মুখ খুললেন তিনি। ‘সমস্যা বলুন?’ ভাবখানা এমন যেনো তিনি ডাক্তার আর সামনে যিনি বসে আছেন তিনি তার রোগী।
‘এখানে বিজ্ঞাপনের বিষয়টা কে দেখে?’ আফছার জানতে চাইলো।
‘আমিই। কোনো কাগজপাতি হারিয়ে গেছে নাকি?’
‘না।’
‘ওহ। বলুন কিসের বিজ্ঞাপন দিতে চান?’
‘আমার।’
‘আপনার মানে কি? প্রাইভেট পড়াতে চান নাকি বিয়ের বিজ্ঞাপন? দুটোর কোনোটাই তো আপনার বয়সের সাথে যায় না।’
‘আমি আসলে বলতে চাই। আমি ফিরে এসেছি।’
‘ওহ। হারিয়ে গিয়েছিলেন বুঝি? আপনার নাম কি?’
‘আফছার আজম।’
‘তা আফছার আজম, আমাকে কি লিখতে হবে একটু খোলসা করে বলুন তো?’
‘কবি ও অধ্যাপক আফছার আজম।’
‘বুঝলেম মফিজ সাহেব, কিছুক্ষণ আগে লটকা করে যে লোকটি এসেছিল, তার আমেরিকা প্রবাসী ডিভোর্সি বোনের বিয়ের জন্যে বিজ্ঞাপন দিতে চায়। ভাবছি আপনার ভাবীর নামে ‘খাঁটি বাংলাদেশী ডিভোর্সি নারীর জন্যে পাত্র চাই, যেমন তেমন পাত্র’ লিখে আমিই ঐ মহিলাকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে যাবো। সাদা চামড়ার দেশে, বুঝলেন না?’ লোকটি আফছারের কথায় গা না করে পাশের টেবিলের ভদ্রলোকের সাথে অকাজের কথা বলা শুরু করলেন।
‘ও হ্যাঁ। বিজ্ঞাপনের রেট জানেন তো?’ আফছারের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে জানতে চাইলেন। যেনো বিজ্ঞাপন না, টাকাটা নেয়ার জন্যেই তাকে রাখা হয়েছে।
‘প্রয়োজন নেই। যা লাগে তাই পাবেন।’
‘গুড। কালার না সাদা কালো? কোন পৃষ্ঠায় দিতে চান?’
‘সাদা কালো হলেও চলবে। প্রথম পৃষ্ঠায় হলে ভাল হয়।’
‘তাও গুড। ওকে। বলুন কি লিখবো?’
‘লিখবেন। কবি ও অধ্যাপক আফছার আজম সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলে যে...।’
‘দাঁড়ান। একটু থামেন। বকতে বকতে গলাটা একদম গ্যাছে। এত বকতে হয় আজকাল। বুঝলেন না? এই শফিক আমার টেবিলে দুইটা আদা চা লাগা তো। দেখিস পানি গরম থাকে যেনো। আদা চা চলবে তো? আমার আবার কৌটার দুধে জমে না। হা হা।’
‘হ্যাঁ চলবে। চিনিটা একটু কম হলে ভালো হয়।’
‘আমাদের অফিসে চিনির বাজেট খুব কম। কম দিতে বললে আর খেতে পারবেন না। বুঝলেন না? তারপর বলুন?’
‘কবি ও অধ্যাপক আফছার আজম সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে বলে যে খবর দেশ জুড়ে প্রচারিত হয়েছে, সেটা আসলে একটা গুজব ছাড়া আর কিছু নয়।’
‘থামেন থামেন। কি যা-তা বকছেন আপনি। আপনি কি এটাই বিজ্ঞাপন দিতে চান নাকি?’
‘হ্যাঁ। আসলে ছোট একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। আফছার মরেনি।’
‘না না। এ খবর আমি নিতে পারবো না। আফছার আজম মরেনি তার প্রমাণ কি? আপনি বললেই তো আর হলো না।’
‘আপনি কি প্রমাণ চান বলুন? আফছার আজম নিজে এসে যদি বলে?’
‘সে ভিন্ন কথা।’
‘আমিই অধ্যাপক আফছার আজম। এখন বিজ্ঞাপন নিতে কোনো সমস্যা আছে আপনার?’
‘দেখুন, সকাল থেকে আমার মেজাজটা এমনিতে বিগড়ে আছে। বৌ আমার বড়লোকের বেটি, বুঝলেন না? আর বিগড়ানোর চেষ্টা করবেন না প্লিজ।’
‘আমি সত্যি বলছি; আমিই অধ্যাপক আফছার আজম। ঐদিন ঐ বাসে ছিলাম না আমি। মানে ছিলাম ঠিকই কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ছিলাম না। কিছুদূর আগেই নেমে পড়েছিলাম।’
‘তো ভাল কথা। বিজ্ঞাপন দেওয়ার কি আছে। আপনি আপনার পরিবারে ফিরে যান। বন্ধু বান্ধবদের ফোন করে জানিয়ে দিন সুখবরটা। আমাদেরও মিষ্টি মুখ করান।’
‘সমস্যা তো ওখানেই। মিডিয়াতে খবরটি প্রচার হবার পর থেকে কাউকে বোঝাতে পারছি না। কেউ আমার কথা শুনছে না। দেখেও না দেখার ভান করছে সকলেই।’
‘মহা মুশকিল তো । দেখুন মশাই, সমস্যা যদি কিছু হয়েই থাকে আপনি পুলিশের কাছে যান। এটা নরমাল কেস বলে মনে হচ্ছে না। আমি বিজ্ঞাপন নিতে পারবো না। এটা আমাদের পেপারের মান ইজ্জতের ব্যাপার। আজ আপনি এসে বললেন আমি মরিনি। কাল আর একজন এসে বলবে তার বাপ মরেনি। এটা তো হয় না, বুঝলেন না?’
‘মানে? ফাজলামো করেন আপনারা? একটা মানুষকে নিশ্চিত না হয়েই মেরে ফেললেন। এখন সেই মানুষটা পকেটের টাকা খরচ করে আপনাদের প্রচার করতে বলছে যে সে মরেনি। আর আপনারা বলছেন মান ইজ্জতের ব্যাপার। আপনারা আমাকে ডুবিয়েছেন মশাই। এখন আপনারাই আমাকে উঠাবেন।’
‘আপনি আসুন তো। আমার হাতে মেলা কাজ। আর আপনি সম্ভব হলে পুলিশে যাওয়ার আগে একজন মানসিক ডাক্তারের চেম্বার হয়ে যান। গ-গোল অন্য কোথাও মনে হচ্ছে।’
আপাতত বিরক্ত হয়ে বিজ্ঞাপন অফিস থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার। হাতের ইশারায় একটা রিকশা থামিয়ে থানার দিকে যেতে বললেন আফছার আজম। থানায় ইনস্পেক্টর সবে ডিউটিতে এসেছেন। ইনস্পেক্টর তার পূর্ব পরিচিত।
‘কেমন আছেন ফিরোজ সাহেব?’ ইনস্পেক্টরের দিকে এক হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন আফছার আজম।
‘চোর বাটপারের সাথে আবার থাকা না থাকা। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক...?’
‘আমাকে চিনলেন না? আমি আফছার আজম।’
‘হ্যাঁ। চেনা চেনা লাগছে। দুঃখিত, কোন আফছার আজম বলুন তো?’
‘অধ্যাপক আফছার আজম।’
‘কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন। আপনি কি ঐ আফছার আজমের কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ। আমিই সেই আফছার আজম। আসলে আমি মারা যাইনি।’
‘ও বুঝেছি। সম্পত্তির মামলা মনে হচ্ছে। আপনার যমজ ভাই-টাই নাকি?’
‘আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমি সত্যিই মরিনি। এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি ছাড়া আর কিছু না।’
‘হুম। বেশ শক্ত কেস বলে মনে হচ্ছে। আপনি যে মরেন নি সেটা আমাকে প্রমাণ করে দিতে হবে, এই তো?’
‘ঠিক তাই।’
‘পারি কিন্তু এক শর্তে-- ভাগ ফিফটি ফিফটি। রিক্স আপনার।’
‘আপনি বিষয়টি গুলিয়ে ফেলছেন। আমি বোধ হয় বোঝাতে পারছি না আপনাকে।’
‘খুব বুঝেছি। চেহারা দেখেই আপনার ভেতরের কু মতলব আমি টের পেয়েছি। এই লাইনে চৌত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা মিয়া।’
থানার ইনস্পেক্টরকে কোনো রকমে বুঝিয়ে এ যাত্রা তার হাত থেকে বেরিয়ে আসলেন আফছার আজম। তিনি তো পারলে আফছার আজমকে জেলে ঢুকিয়ে দেন। ভাগ্যিস পকেটে বড় কিছু নোট ছিল।
থানা থেকে পার্কে এসে বসেছেন। সমস্ত বিকালটা তিনি এখানেই কাটালেন। আর কোনো চিন্তা তার মাথায় আসছে না। খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে চারপাশ। কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারছেন না। ‘তবে কি আমারই ভুল হচ্ছে?’ মনে মনে ভাবেন তিনি। ‘এতগুলো মানুষ কেউ আমাকে চিনবে না তা কি করে হয়। নিশ্চয় কোথাও কোনো গ-গোল আছে। তাহলে কি আমি অন্য কেউ? তবে কি কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে গিয়ে খুলে বলবো সব কথা-- বলবো যে নিজেকে অধ্যাপক আফছার আজম আফছার আজম মনে হচ্ছে। তার সব স্মৃতি আমার ওপরে ভর করেছে। এমন কি তার কবিতাগুলোও মনে হচ্ছে আমিই রচনা করেছি। বিশ্বাস না হলে গড়গড় করে বলে দিতে পারি কয়েকশ কবিতা, সঙ্গে তাদের জন্ম কথাও। ডাক্তার না হয় মেনে নিলেন আমার সব সমস্যা। উপযুক্ত চিকিৎসাও দিলেন। ঠিক আছে আমিও না হয় মানলাম। কিন্তু আমার পরিচয়টা কি দাঁড়ালো শেষমেশ? কে আমি? স্রেফ নোবডি? ডাজ এ নোবডি এক্সিস্ট? ডু আই এক্সিস্ট?’
সূর্যটা পশ্চিমের আকাশ বেয়ে নামতে নামতে কখন যেন নেই হয়ে গেছে। সকালে সে আবার আসবে অন্য রাস্তা ধরে। অন্ধকারে ঝোপের আড়ালে আফছার আজমের উপস্থিতি বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে কয়েকটি জোনাকি পোকা টর্স মেরে এদিক-ওদিক কি যেন খুঁজে ফেরে, এত কিছু চোখে পড়ে আফছারকে পড়ে না। একটি শেয়াল ক্লান্ত হয়ে তার পাশের বেঞ্চে উঠে বসে, আফছার শব্দ করে ভয় দেখায়, সে বসে থাকে নির্বিকার। একটা নিশাচর পাখি তার কাঁধে এসে বসে, মাঝেমধ্যে বিকট শব্দে ডেকে ওঠে, আফছারের কানের পর্দা ভেঙ্গে খানখান হয়। পাল্লা দিয়ে শব্দ করেন আফছার। পাখিটি টের পায় না কিছুই।
প্রতিটা কাগজের পাতা জুড়ে আলোচনা হচ্ছে তার কবিতার, যেনো কোনো এক পাগলা রাজা ঘোষণা দিয়েছেন। তিনদিনের মধ্যে আফছারের কবিতার নাড়ি নক্ষত্র জাহির করতে হবে। পারলে এনাম না পারলে কতল হবে গর্দান। এখানে কারণটা অবশ্য অন্য। দুই দিন হলো ঢাকাগামী একটি বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন কবি আফছার আজম। খবরের কাগজ ও টেলিভিশন-নিউজ এমনটিই বলছে। এই মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি সাতিশয় ক্ষুব্ধ। তার দাবি, ঐ বাসে ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল সত্যি, টিকিটও কেটেছিলেন, বাসে উঠেও বসেছিলেন কিন্তু দুর্ঘটনার কিছু কাল আগেই আগের এক স্টপেজে নেমে পড়েন। আর ওঠেন নি। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গিয়েছিল, কবিতার খাতাটা ফেলে এসেছেন টেবিলের উপরে। আফছার আজম যেদিন থেকে কবিতা লেখা ধরেছেন সেদিন থেকে কবিতার খাতা ছাড়া এক পাও এদিক ওদিক হননি। কিছু কিছু ধূমপায়ী যেমন লাইটার ছাড়া ঘর ছাড়েন না তেমনি। ফলও পেয়েছেন বেশ। তার কোন কবিতার কোন শব্দটার কোথায় জন্ম তা বলা মুশকিল। একবার তার মাথায় ভূত চেপে বসলো সমুদ্রের ফেনায়িত জলে হাঁটু চুবিয়ে কবিতা লিখবেন, সম্ভব হলে আস্ত একটি কবিতার বই ফেঁদে ফেলবেন। বইয়ের নামও ঠিক করে ফেললেন। ‘জল জ্বালিয়ে শব্দ কণা’। কোনো এক মে মাসে বেতন উঠিয়েই রওনা হলেন কক্সবাজারের উদ্দেশে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সমুদ্রের জলের কোল ঘেঁষে চেয়ার পেতে বসলেন। জলের ডগা এসে ছুঁয়ে যেতে থাকলো পায়ের পাতা। সাদা ফেনার বুঁদবুঁদ এসে ঢেকে দিলো কবি আফছারের শ্যামলা শক্ত পা দুখানি। এখনই সময়। খাতা বের করলেন তিনি, আঙুলের ডগায় ঢাকনা হটিয়ে প্রস্তুত পেন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পাল্টালেন, খালি নেই এক ইঞ্চিও। সেদিন কোনো শব্দ না লিখেই ফেরত আসলেন। পরে আর এক মে-তে আবার গেলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পা চুবিয়ে বসে রইলেন সমুদ্রের সফেদ ফেনায়িত জলে। সারাদিনে খালি একটিই শব্দ বের করা সম্ভব হলো কলমের মুখ থেকে। নৈশব্দ। বাকি শব্দগুলো তিনি সমুদ্রের কিনারে হেঁটে হেঁটে, ফিরতি ট্রেনের বগিতে বগিতে ঘুরে জোগাড় করলেন। শব্দগুলো জোড়াতালি দিলে একটি আট লাইনের কবিতা দাঁড়ালো--
‘শব্দে নৈশব্দে
জীবনভোর কাটলো তার
পরকালে ভগবান শুধায়-- শব্দ না নৈশব্দ?
বেকুবের মতো বলল সে-- যদি দুটোই চাই।
ছয় মাস এখন স্বর্গে, ছয় মাস নরকে।
পালাবদলের সময় মনে মনে ভাবে সে--
পৃথিবীতে তাহলে দুটোই ছিল, একটু
কায়দা করে আলাদা করতে পারলেই...।’
তিনি যখন বাস থেকে নেমে আসেন তখন যে লোকটি তাকে নামতে দেখেছিল সে মারা গেছে দুর্ঘটনায়। আফছার আজম বহু কষ্টে ঠিকানা ম্যানেজ করে লোকটির বাড়ি গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন বাড়িতে কেবলই শোকের মাতম। আবার কবিতার খাতা নিতে যখন বাড়িতে ঢুকেছিলেন তখন পোষা কুকুরটি ছাড়া আর কেউ দেখেনি তাকে। ততক্ষণে খবর পৌঁছে গেছে দুর্ঘটনার। সবাই তখন টেলিভিশনের সামনে। তখনও সময় ছিল, ওদের সামনে গিয়ে যদি আফছার আজম বলতেন। আমি যাইনি। এই দেখো ফিরে এসেছি। তাও কথা ছিল। কিন্তু তা না করে তিনি ট্রেন ধরে চলে এলেন ঢাকায়। দুর্ঘটনার ঘটনাটা তখনও তিনি জানতেন না। জানতো না অনেকেই। পরদিন দুপুরে চীন মৈত্রী সেতুতে কবিদের সম্মেলন। আফছার আজম হোটেল থেকে ফ্রেস হয়ে বার টার দিকে রওনা হলেন। ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দৈনিকের হেডলাইনে বোল্ড অক্ষরে ছাপা হয়েছে। ঢাকাগামী একটি বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন দেশ বরেণ্য কবি অধ্যাপক আফছার আজম। টেলিভিশনেও পরিপাটি করে প্রচার করা হচ্ছে খবরটি। তিনি নিজে জানতে পারলেন কবিদের সম্মেলনে গিয়ে। সবার মুখে আফছার আজমের কথা। যেমন তার কবিতার প্রশংসা তেমন তার মানব সত্তার। শত্রুদের মুখেও ফুল চন্দন পড়েছে যেন। আফছার আজম তার এতো কদর দেখে রীতিমত অভিভূত। আরও অভিভূত হলেন যখন জানতে পারলেন। আজকের অনুষ্ঠানটি সদ্য অকাল প্রয়াত কবি আফছার আজমকে উৎসর্গ করা হয়েছে। ‘মানে আমি আর দুনিয়াতে নেই। রীতিমত আহাম্মকি ব্যাপার। জীবিত থেকে নিজের এই অন্তর্ধান কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। নিশ্চয় এ সব কোনো মহল থেকে চক্রান্ত করে করা হয়েছে।’ মনে মনে ভাবলেন তিনি। তারপর যখন আসল ঘটনাটা জানতে পারলেন, তখন এতো কষ্টের মাঝেও একচোট না হেসে পারলেন না। মানলেন ঘটনার সূত্রপাত তিনি নিজেই করেছেন। ‘ঐ ভাবে নেমে আসাটা ঠিক হয়নি আমার। আবার না নামলেও যে সত্যি সত্যিই এতক্ষণে। ভাগ্য সহায় ছিল বলতেই হবে। কিন্তু এতোগুলো লোককে একসাথে সেটা কি করে বোঝাবো আমি? তারপর আবার সারা দেশের মানুষ। কি মুশকিলে পড়ে গেলাম।’ তারপর তিনি একটা প্রাথমিক উদ্যোগস্বরূপ কয়েক জনকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন বিষয়টি। অতি নিকটতম কয়েকজন বন্ধুর কাছেও গেলেন। ফল শূন্য। কেউ মন দিয়ে শুনলো না তার কথা। যারা খানিকটা শুনলো বলে মনে হলো তারা হেসে উড়িয়ে দিলো-- ‘বাহ। আপনি ভালো মজা করতে পারেন তো।’ সবগুলো পেপারের ফ্রন্ট পেজে গোটা গোটা অক্ষরে ছাপা হয়েছে। চ্যানেলে চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ ঝুলে আছে সকাল থেকে। ‘ না। আমাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণও দেখছি না।’ কিঞ্চিৎ হতাশার সাথে গোটা অনুষ্ঠান জুড়ে চেষ্টা চালালেন। কোনো ফল হলো না। ‘এখানে মনে হচ্ছে জীবিতের চেয়ে মৃতের কদর বেশি। নিজের কদর দেখে যেমন ভালো লাগছে, তেমন জীবিত আমিকে যেভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে তাতে কষ্টও কম হচ্ছে না। আশ্চর্য, পেপার আর চ্যানেল বলল আর আমি নিমিষে নেই হয়ে গেলাম। এখন উপায় কিছু একটা বের করতে হবেই।’ পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলেন। ‘ঐদিকে বাড়িতে কি হচ্ছে তার একটা খোঁজ নেওয়া দরকার। মেয়েটা নিশ্চয় কাঁদতে কাঁদতে এতক্ষণে চারপাশ ভাসিয়ে দিলো। বৌটারও না জানি কেঁদে কেঁদে কি দশা। আত্মীয়স্বজন কতো কাজকর্ম ফেলে ভিড় জমাচ্ছে বাড়িতে। ওখানেই আগে জানানো দরকার যে আমি বেঁচে আছি। তারপর ওরাই না হয় একে একে সবাইকে জানিয়ে দেবে।’ মেয়ের নাম্বারে কল করলেন তিনি। কিন্তু এরর দেখাচ্ছে। আফছারের সিম কার্ড বন্ধ। সিম কোম্পানিও জেনে গেছে তার মৃত্যু-সংবাদ। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। আপাতত সশরীরে বাড়িতে হাজির হওয়া ছাড়া উপায় নেই। দুপুরের বাসে রওনা হলেন রাজশাহী অভিমুখে। বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তিনি যা ধারণা করেছিলেন তাই হলো। সমস্ত বাড়ি এখন মানুষে গিজগিজ করছে। কেউ কাঁদছে, কেউ সান্তনা দিচ্ছে। নিজের চোখে নিজের মৃত্যুকে এভাবে দেখে যেতে পারবেন তা তিনি কোনো দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কখনো। ভাববারও কোনো কারণ ছিল না। শুধু এই সামান্য একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে আজ এই বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ‘দুর্ঘটনার জন্যে কি ঐ বাসটায় জুটেছিল কপালে। বুঝলাম বেশির ভাগ লাশ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। মাথা না হয় থেঁতলে গেল, পোশাকের কি কোনো মূল্য নেই? আমার সাদা শার্ট, না হয় আমার জুতা জোড়াও কি পরিবারের কেউ চিনতো না? মেয়েটা কতো পালিশ করে দিয়েছে, ভুলে গেলো? কত দূর থেকে, কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এতোগুলো মানুষ আমার বাড়িতে সমবেত হয়েছে, এতো শোক, কান্নাকাটি করছে, হঠাৎ করে এদের বেঁচে আছি এই খবরটা দেওয়া কি ঠিক হবে? ওদের সেন্টিমেন্টকে তো নূন্যতম শ্রদ্ধা দেখানো উচিত, নাকি। খবরটা কি তাহলে কাল দেবো? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমি মেয়েটার একেবারে টিকির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাম পাশে বড় বোন, ডান পাশে ছোটো ভাইয়ের বউ। কেউ আমাকে চিনছে না? একবার কেউ ঘুরেও তাকাচ্ছে না আমার দিকে। এভাবে মরা-বাড়িতে একটা মানুষ ছ্যাবলার মতো ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে তাকিয়ে দেখছে, চোখে কান্নার ছিটে ফোঁটাও নেই। এটা দেখেও তো একবার তাকানো উচিত। মেয়েটা আমার কলিজার টুকরা, সাত রাজার ধন সে। ওর কান্না আমার কখনই সহ্য হয় না। পাশে গিয়ে বসলাম। রাত ভোর কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমি মাথায় হাত দিয়ে আদর করতেই আমার বুকে এলিয়ে পড়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। বাবা নেই। বাবা গো। ওর কান্নায় আমি আর থির থাকতে পারলাম না। পাল্লা দিয়ে আমিও কাঁদলাম।’ নিজের মৃত্যুতে পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম বোধ হয় কেউ কাঁদলো।
‘সারারাত আমি সবাইকে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সান্ত্বনা দিলাম। কেউ আমাকে চিনলো না। ওদেরকেই বা দোষ দিই কেমন করে। এতগুলো চ্যানেল, পেপার। একসাথে সবাই তো আর মিথ্যা বলবে না। আমি একা একটা মানুষ বললেই তো আর সব মিথ্যা হয়ে যাবে না। পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। এখন ছাত্রদেরকে এক জায়গায় করে যদি একটা র্যালি বের করতে পারি ‘প্রিয় আফছার স্যার মরে নাই।’ এই শিরোনামে, তারপর একটা সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারলেই কাজ ফতে। তখন সবগুলো চ্যানেল পত্রিকা ভুল সংবাদ পরিবেশনের জন্যে বাপ বাপ করে দুঃখ প্রকাশ করবে। আমি চাইলে মানহানির মামলা ঠুকে কয়েক লক্ষ টাকা কামিয়ে নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে কি কোর্ট কোনো মানহানির মামলা নেবে? কি জানি।’
ছাত্ররা ইতোমধ্যে র্যালি বের করে ফেলেছে। শোক র্যালি। আফছারের সহকর্মী কিছু শিক্ষকও আছেন সামনের সারিতে। যে সহকর্মীর সাথে তার কখনই বনিবনা হয়নি তার হাতের প্ল্যাকার্ডে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘আফছার সাহেব, আপনার শোকে আমরা মর্মাহত।’ হাতের লেখাও তার। এই ডিপার্টমেন্টে এত বাজে লেখা আর কারও হতে পারে না। আফছার গিয়ে দাঁড়ালেন র্যালির সামনে। নিজের শোক র্যালির আগে আগে হাঁটছেন তিনি নিজেই অথচ কেউ তাকে আমলে নিচ্ছে না। হ্যালুসিনেশন ভেবে দেখেও না দেখার ভান করছে সকলেই। এখানেও তিনি মহা বেকায়দায় পড়ে গেলেন।
হকারের কাছ থেকে পেপার কিনলেন। যার মৃত্যু-সংবাদে তার পেপারের কাটতি বেড়ে গেছে দ্বিগুণ তাকে সামনে পেয়েও খেয়াল করলো না সে। চায়ের দোকানে বসে পেপারটা খুললেন। প্রথম পাতায় লেখা হয়েছে তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী পৃথক পৃথক বার্তায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিরোধী দলের নেত্রী এই দুর্ঘটনার জন্যে সরকারকে দুষতেও ভোলেন নি। একটা বিশেষ পাতা ছাপা হয়েছে। ভালোই লাগছে তার। আবার খারাপও। প্রথমেই তরুণ বয়সের একটি ফটো। নিচে বোল্ড অক্ষরে লেখা ‘অসময়ে চলে যেতে হলো কবি আফছার আজমকে।’ এমন খবর কোনোদিন মিথ্যে হয়েছে? নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে কেমন কষ্ট হচ্ছিলো তার। নিচে এ সময়ের একজন বড় কবি তাকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন। আরও কয়েকজন কবি লিখেছেন তাকে ও তার কবিতা নিয়ে। নিজেকে নিয়ে স্মৃতিকথা পড়ার সৌভাগ্য কারও হয় না। যে কারণেই হোক তার হয়েছে। একে একে সবগুলো লেখা পড়ে শেষ করলেন। বেশির ভাগই বানিয়ে বানিয়ে লেখা। যার সাথে তার কোনোদিনই দেখা হয়নি সেও কেমন সুন্দর করে একসাথে চা খাওয়ার গল্প ফেঁদেছে। ‘শুধু চা খাওয়া হলে না হয় মানা যেতো। আমি নাকি বলেছি, দাম্পত্য জীবনে আমি সুখী নই। ডাহা মিথ্যা কথা। ব্যাটাকে হাতের কাছে পেলে টুঁটি চেপে ধরতাম। আমি মরে গেছি ভেবে যা তা লিখবা তা তো হতে দেওয়া যায় না। একজন লিখেছে, আমার কবিতা বিশ্বমানের। আমার নোবেল পাওয়া উচিত ছিল। এটা বেশি হয়ে গেল। স্তুতিরও তো একটা সীমা থাকে নাকি।’ বেশির ভাগ কথায় মানতে পারেন না তিনি।
তবে তিনি সবচেয়ে মজা পেলেন অন্য একটা খবরে। কবি জীবনের প্রথম দিকে তার একটি কবিতা ছিল ‘তোমাকে দেখি সবসময়’ এই শিরোনামে। একজন বীরের স্তুতিগাঁথা। বিরোধীদলের ধারণা কবিতাটি তিনি তাদের নেতাকে নিয়ে লিখেছিলেন। আর সরকারি দল ফলাও করে প্রচার করছে যে কবিতাটি আসলে তিনি তাদের নেতাকে নিয়ে লিখেছিলেন। কবিতাটি এখন উভয় দলের রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে দুই পন্থীদের কলম যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে যার মতো করে প্রমাণ করছে তাদের ক্লেইম। মজা পাচ্ছেন এই জন্যে যে তিনি আসলে কবিতাটি লিখেছিলেন তার মহল্লার এক বৃদ্ধ নাইট গার্ডকে স্মরণ করে। চোর বাটপারদের অসহযোগিতা করার কারণে এক মধ্যরাতে তাকে মেরে চৌরাস্তার বটগাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পেপার পড়তে পড়তেই তিনি একটা আইডিয়া পেলেন। এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। পাশেই ছিল বিজ্ঞাপন অফিস, ঢুকে গেলেন ভিতরে। যারা তার মরার খবর বিনে পয়সায় ফলাও করে প্রচার করেছে তাদের কাগজেই এখন তিনি না মরার বিজ্ঞাপন দেবেন। ‘বিজ্ঞাপনে আমি আমার শরীরের বর্ণনা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পিতৃপরিচয় সবকিছু বিস্তারিত উপস্থাপন করবো যাতে কারও সন্দেহ না হয়। প্রয়োজন হলে সঙ্গে আধখানা ফটোও জুড়ে দেবো।’ মনে মনে ভাবেন তিনি। ভেতরে ঢুকে দেখেন বিশাল সাইজের একটা টেবিলে মাঝবয়স্ক খাটো একটা লোক বসে কিছু কাগজ নাড়াচাড়া করছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে টেবিলের উপর বসা একটা বাচ্চা ছেলে কাগজ নিয়ে খেলা খেলছে। সোজা লোকটির কাছে চলে গেলেন। লোকটি ইশারা করার সাথে সাথে সামনের চেয়ারটি টেনে বসলেন। কাগজগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে মুখ খুললেন তিনি। ‘সমস্যা বলুন?’ ভাবখানা এমন যেনো তিনি ডাক্তার আর সামনে যিনি বসে আছেন তিনি তার রোগী।
‘এখানে বিজ্ঞাপনের বিষয়টা কে দেখে?’ আফছার জানতে চাইলো।
‘আমিই। কোনো কাগজপাতি হারিয়ে গেছে নাকি?’
‘না।’
‘ওহ। বলুন কিসের বিজ্ঞাপন দিতে চান?’
‘আমার।’
‘আপনার মানে কি? প্রাইভেট পড়াতে চান নাকি বিয়ের বিজ্ঞাপন? দুটোর কোনোটাই তো আপনার বয়সের সাথে যায় না।’
‘আমি আসলে বলতে চাই। আমি ফিরে এসেছি।’
‘ওহ। হারিয়ে গিয়েছিলেন বুঝি? আপনার নাম কি?’
‘আফছার আজম।’
‘তা আফছার আজম, আমাকে কি লিখতে হবে একটু খোলসা করে বলুন তো?’
‘কবি ও অধ্যাপক আফছার আজম।’
‘বুঝলেম মফিজ সাহেব, কিছুক্ষণ আগে লটকা করে যে লোকটি এসেছিল, তার আমেরিকা প্রবাসী ডিভোর্সি বোনের বিয়ের জন্যে বিজ্ঞাপন দিতে চায়। ভাবছি আপনার ভাবীর নামে ‘খাঁটি বাংলাদেশী ডিভোর্সি নারীর জন্যে পাত্র চাই, যেমন তেমন পাত্র’ লিখে আমিই ঐ মহিলাকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে যাবো। সাদা চামড়ার দেশে, বুঝলেন না?’ লোকটি আফছারের কথায় গা না করে পাশের টেবিলের ভদ্রলোকের সাথে অকাজের কথা বলা শুরু করলেন।
‘ও হ্যাঁ। বিজ্ঞাপনের রেট জানেন তো?’ আফছারের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে জানতে চাইলেন। যেনো বিজ্ঞাপন না, টাকাটা নেয়ার জন্যেই তাকে রাখা হয়েছে।
‘প্রয়োজন নেই। যা লাগে তাই পাবেন।’
‘গুড। কালার না সাদা কালো? কোন পৃষ্ঠায় দিতে চান?’
‘সাদা কালো হলেও চলবে। প্রথম পৃষ্ঠায় হলে ভাল হয়।’
‘তাও গুড। ওকে। বলুন কি লিখবো?’
‘লিখবেন। কবি ও অধ্যাপক আফছার আজম সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলে যে...।’
‘দাঁড়ান। একটু থামেন। বকতে বকতে গলাটা একদম গ্যাছে। এত বকতে হয় আজকাল। বুঝলেন না? এই শফিক আমার টেবিলে দুইটা আদা চা লাগা তো। দেখিস পানি গরম থাকে যেনো। আদা চা চলবে তো? আমার আবার কৌটার দুধে জমে না। হা হা।’
‘হ্যাঁ চলবে। চিনিটা একটু কম হলে ভালো হয়।’
‘আমাদের অফিসে চিনির বাজেট খুব কম। কম দিতে বললে আর খেতে পারবেন না। বুঝলেন না? তারপর বলুন?’
‘কবি ও অধ্যাপক আফছার আজম সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে বলে যে খবর দেশ জুড়ে প্রচারিত হয়েছে, সেটা আসলে একটা গুজব ছাড়া আর কিছু নয়।’
‘থামেন থামেন। কি যা-তা বকছেন আপনি। আপনি কি এটাই বিজ্ঞাপন দিতে চান নাকি?’
‘হ্যাঁ। আসলে ছোট একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। আফছার মরেনি।’
‘না না। এ খবর আমি নিতে পারবো না। আফছার আজম মরেনি তার প্রমাণ কি? আপনি বললেই তো আর হলো না।’
‘আপনি কি প্রমাণ চান বলুন? আফছার আজম নিজে এসে যদি বলে?’
‘সে ভিন্ন কথা।’
‘আমিই অধ্যাপক আফছার আজম। এখন বিজ্ঞাপন নিতে কোনো সমস্যা আছে আপনার?’
‘দেখুন, সকাল থেকে আমার মেজাজটা এমনিতে বিগড়ে আছে। বৌ আমার বড়লোকের বেটি, বুঝলেন না? আর বিগড়ানোর চেষ্টা করবেন না প্লিজ।’
‘আমি সত্যি বলছি; আমিই অধ্যাপক আফছার আজম। ঐদিন ঐ বাসে ছিলাম না আমি। মানে ছিলাম ঠিকই কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ছিলাম না। কিছুদূর আগেই নেমে পড়েছিলাম।’
‘তো ভাল কথা। বিজ্ঞাপন দেওয়ার কি আছে। আপনি আপনার পরিবারে ফিরে যান। বন্ধু বান্ধবদের ফোন করে জানিয়ে দিন সুখবরটা। আমাদেরও মিষ্টি মুখ করান।’
‘সমস্যা তো ওখানেই। মিডিয়াতে খবরটি প্রচার হবার পর থেকে কাউকে বোঝাতে পারছি না। কেউ আমার কথা শুনছে না। দেখেও না দেখার ভান করছে সকলেই।’
‘মহা মুশকিল তো । দেখুন মশাই, সমস্যা যদি কিছু হয়েই থাকে আপনি পুলিশের কাছে যান। এটা নরমাল কেস বলে মনে হচ্ছে না। আমি বিজ্ঞাপন নিতে পারবো না। এটা আমাদের পেপারের মান ইজ্জতের ব্যাপার। আজ আপনি এসে বললেন আমি মরিনি। কাল আর একজন এসে বলবে তার বাপ মরেনি। এটা তো হয় না, বুঝলেন না?’
‘মানে? ফাজলামো করেন আপনারা? একটা মানুষকে নিশ্চিত না হয়েই মেরে ফেললেন। এখন সেই মানুষটা পকেটের টাকা খরচ করে আপনাদের প্রচার করতে বলছে যে সে মরেনি। আর আপনারা বলছেন মান ইজ্জতের ব্যাপার। আপনারা আমাকে ডুবিয়েছেন মশাই। এখন আপনারাই আমাকে উঠাবেন।’
‘আপনি আসুন তো। আমার হাতে মেলা কাজ। আর আপনি সম্ভব হলে পুলিশে যাওয়ার আগে একজন মানসিক ডাক্তারের চেম্বার হয়ে যান। গ-গোল অন্য কোথাও মনে হচ্ছে।’
আপাতত বিরক্ত হয়ে বিজ্ঞাপন অফিস থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার। হাতের ইশারায় একটা রিকশা থামিয়ে থানার দিকে যেতে বললেন আফছার আজম। থানায় ইনস্পেক্টর সবে ডিউটিতে এসেছেন। ইনস্পেক্টর তার পূর্ব পরিচিত।
‘কেমন আছেন ফিরোজ সাহেব?’ ইনস্পেক্টরের দিকে এক হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন আফছার আজম।
‘চোর বাটপারের সাথে আবার থাকা না থাকা। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক...?’
‘আমাকে চিনলেন না? আমি আফছার আজম।’
‘হ্যাঁ। চেনা চেনা লাগছে। দুঃখিত, কোন আফছার আজম বলুন তো?’
‘অধ্যাপক আফছার আজম।’
‘কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন। আপনি কি ঐ আফছার আজমের কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ। আমিই সেই আফছার আজম। আসলে আমি মারা যাইনি।’
‘ও বুঝেছি। সম্পত্তির মামলা মনে হচ্ছে। আপনার যমজ ভাই-টাই নাকি?’
‘আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমি সত্যিই মরিনি। এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি ছাড়া আর কিছু না।’
‘হুম। বেশ শক্ত কেস বলে মনে হচ্ছে। আপনি যে মরেন নি সেটা আমাকে প্রমাণ করে দিতে হবে, এই তো?’
‘ঠিক তাই।’
‘পারি কিন্তু এক শর্তে-- ভাগ ফিফটি ফিফটি। রিক্স আপনার।’
‘আপনি বিষয়টি গুলিয়ে ফেলছেন। আমি বোধ হয় বোঝাতে পারছি না আপনাকে।’
‘খুব বুঝেছি। চেহারা দেখেই আপনার ভেতরের কু মতলব আমি টের পেয়েছি। এই লাইনে চৌত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা মিয়া।’
থানার ইনস্পেক্টরকে কোনো রকমে বুঝিয়ে এ যাত্রা তার হাত থেকে বেরিয়ে আসলেন আফছার আজম। তিনি তো পারলে আফছার আজমকে জেলে ঢুকিয়ে দেন। ভাগ্যিস পকেটে বড় কিছু নোট ছিল।
থানা থেকে পার্কে এসে বসেছেন। সমস্ত বিকালটা তিনি এখানেই কাটালেন। আর কোনো চিন্তা তার মাথায় আসছে না। খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে চারপাশ। কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারছেন না। ‘তবে কি আমারই ভুল হচ্ছে?’ মনে মনে ভাবেন তিনি। ‘এতগুলো মানুষ কেউ আমাকে চিনবে না তা কি করে হয়। নিশ্চয় কোথাও কোনো গ-গোল আছে। তাহলে কি আমি অন্য কেউ? তবে কি কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে গিয়ে খুলে বলবো সব কথা-- বলবো যে নিজেকে অধ্যাপক আফছার আজম আফছার আজম মনে হচ্ছে। তার সব স্মৃতি আমার ওপরে ভর করেছে। এমন কি তার কবিতাগুলোও মনে হচ্ছে আমিই রচনা করেছি। বিশ্বাস না হলে গড়গড় করে বলে দিতে পারি কয়েকশ কবিতা, সঙ্গে তাদের জন্ম কথাও। ডাক্তার না হয় মেনে নিলেন আমার সব সমস্যা। উপযুক্ত চিকিৎসাও দিলেন। ঠিক আছে আমিও না হয় মানলাম। কিন্তু আমার পরিচয়টা কি দাঁড়ালো শেষমেশ? কে আমি? স্রেফ নোবডি? ডাজ এ নোবডি এক্সিস্ট? ডু আই এক্সিস্ট?’
সূর্যটা পশ্চিমের আকাশ বেয়ে নামতে নামতে কখন যেন নেই হয়ে গেছে। সকালে সে আবার আসবে অন্য রাস্তা ধরে। অন্ধকারে ঝোপের আড়ালে আফছার আজমের উপস্থিতি বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে কয়েকটি জোনাকি পোকা টর্স মেরে এদিক-ওদিক কি যেন খুঁজে ফেরে, এত কিছু চোখে পড়ে আফছারকে পড়ে না। একটি শেয়াল ক্লান্ত হয়ে তার পাশের বেঞ্চে উঠে বসে, আফছার শব্দ করে ভয় দেখায়, সে বসে থাকে নির্বিকার। একটা নিশাচর পাখি তার কাঁধে এসে বসে, মাঝেমধ্যে বিকট শব্দে ডেকে ওঠে, আফছারের কানের পর্দা ভেঙ্গে খানখান হয়। পাল্লা দিয়ে শব্দ করেন আফছার। পাখিটি টের পায় না কিছুই।
0 মন্তব্যসমূহ