শাহীন আখতার-এর ধারাবাহিক উপন্যাস : সখী রঙ্গমালা--পর্ব ১

১.

রঙ্গমালার কাটা মুন্ডু নিয়ে চান্দা বীর রাজবাড়ির দিকে আসছে - ভোর হওয়ার আগেই এত্তেলাটা বাতাসের বেগে ছুটে আসে। তার আগে কোথা থেকে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক। কাছারিবাড়ি, দরদালান, অলিন্দ, ফলবাগিচা, পুকুরপাড় কাকের কা কা চিৎকারে ভরে ওঠে। রাজবাড়িতে হুলুস্থুল। যেন নিচু জাতের মেয়েটির কাটা মুন্ডু নয়, রূপসিংহের পাথার দিয়ে ছুটে আসছে দাবানল, যার আগুনে চৌধুরী বংশ ছারেখারে যাবে। তখনো বাহিরবাড়ির ঘরে রাজচন্দ্র চৌধুরী ভাঙের শরবতের ঘোরে অচেতন। ছেলে-বুড়ো সবাই সন্ত্রস্ত - হুঁশ ফিরলে বাবা ভোলানাথের মতো রঙ্গমালার ছিন্ন মস্তক নিয়ে যখন প্রলয়নৃত্য শুরু করবে, তখন তাকে ঠেকাবে কে।


ফুলেশ্বরী রাইয়ের খোঁজে মহলের পর মহল তোলপাড় করছে হীরা দাসী। সে ঝড়ের বেগে এক ঘরে ঢুকে আরেক ঘরের দুয়ার দিয়ে বেরোয়। তার মধ্যে পায়ে নল জড়িয়ে মেজো ঠাকুরানির গড়গড়াসহ হুমড়ি খেয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো বিপত্তি ঘটেনি। গড়গড়ার বাসি জলে শখের শতরঞ্জি মাখামাখি - ঠাকুরানির সেদিকে আজ তাকিয়ে দেখার ফুরসত নেই। তিনি মেয়ে সুনন্দার একমাত্র ছেলে, সবেধন নীলমণি প্রফুল্লকুমারকে হেথা-সেথা লুকানোর পাঁয়তারা করছেন। আজ কার বিপদ কোন দিক থেকে আসে, কেউ জানে না। আজ রোজকেয়ামত - মুসলমান ধর্মের লোক হলে এরা সবাই ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করত। এমন নিদানকালে রাই গেল কই?

তখন ফলবাগিচায় দোলনায় দোল খেতে খেতে ফুলেশ্বরী রাই আঙুল টিপে কাক গুনছিল। মাথার ওপর হাজার-বিজার কাকপক্ষীর ডাকাডাকি, ওড়াউড়ি। খাঁচার পাখির ডানা-ঝটপটানি, তারস্বরে চিৎকার - সে এক এলাহি কান্ড। তার গোনা-গুনতি বারবার ভন্ডুল হয়ে যায়। এক-একবারে বিশ পর্যন্ত গুনে আর এগোতে না পেরে ফের প্রথম থেকে শুরু করতে হয়। সে সময় আচম্বিতে হীরার ‘দিদিমণি, দিদিমণি’ হাঁকডাকে যোগ-বিয়োগ খেলায় ছেদ পড়ে ফুলেশ্বরীর।

‘দিদিমণি, দিদিমণি,’ হীরা দম নিয়ে বলে, ‘আঁই আমনেরে তামান দুইন্যাই খুঁজি খুঁজি মরি - আমনে ইয়ানে?’ ফুলেশ্বরী রাই আঙুলের টিপ ছেড়ে দাসীর চুলের মুঠি লাফিয়ে ধরতে যাবে, তখন হীরা মোক্ষম খবরটা তিরের মতো ছুড়ে দেয়।

কাছারিঘরে রঙ্গমালার কাটা মুন্ডু!

‘আয়ো। চান্দা বীর কল্লা কাডি লই আইছে। মহারাজ রাজিন্দ্র খুড়ার হুকুম তামিল কইচ্ছে।’

তখনই বাগানের ঝোপঝাড় ভেঙে দৌড়ে যাওয়ার থপথপ ভারী আওয়াজ। পেছনের খিড়কি-দুয়ার দিয়ে কে পালায়? চান্দা বীর আর রাজেন্দ্র খুড়া না! কাকের পুরো দঙ্গলটা তাদের পেছন পেছন কা কা রবে উড়ে গেলে নিমেষে রাজবাড়ি কাকশূন্য। হীরা ফের সব কটা মহল ঘুরে এসে রাইকে জানায় - যদিও বারবাড়িতে এখনো রাজচন্দ্রের নাক ডাকছে, ঘরে ঘরে প্রত্যেকে ভেতর থেকে দুয়ারে খিল তুলে দিয়েছে। রসাল গুঞ্জন দূরে থাক, কোথাও দাস-দাসীর চিহ্নমাত্র নেই। রসুইখানা ফাঁকা। রাঁধুনি বামুনেরা রান্নাঘর ছেড়ে পুকুরপাড়ের জঙ্গলে ঠাঁই নিয়েছে। মাথায় বায়ু চড়ে গেছে পুরোহিত ব্রাহ্মণের। কাছারির সামনের দিঘিতে তার টিকিধারী মাথাটা নারকেলের খোলের মতো ডুবছে আর ভাসছে। মা সুমিত্রা ঠাকুরঘরে চোখ বুজে জোড়হাতে ঠাকুর ঠাকুর করছেন। তার দোরই কেবল খোলা। রাজচন্দ্র মাকে রেয়াত করলেও বউকে করবে? ফুলেশ্বরী রাই তো পয়লা নম্বর আসামি। রঙ্গমালা তার সতিন না হয়েও সতিনের বাড়া ছিল। এমন সতিনকাঁটার দংশনে যে পাগলিনী, দিবানিশি কান্দে জারেজার, রাজচন্দ্র আর কাউকে হাতের কাছে না পেলে তার ওপরই তো চড়াও হবে। এ আবুদ্ধিয়া বেটি তা বুঝলে তো! এই এক বচ্ছরে রাইয়ের বোধ-বুদ্ধি সব বানের জলে ভেসে গেছে। হালে সে পাগলেরও অধম। আলামত ভালো ঠেকে না হীরা দাসীর। ফুলেশ্বরীর তালপাতার মতো পাতলা শরীরটা সে এক টানে ঘরের ভেতর ঢোকায়। একবার ভাবে, ভেতর থেকে খিল তুলে দুজন ঘাপটি মেরে পড়ে থাকবে। কিন্তু রাজচন্দ্র যদি লাত্থি মেরে কপাট ভেঙে ঘরে ঢোকে? ফুলেশ্বরী কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখে, সে ঘরবন্দী। হীরা বাইরে থেকে দোরে শিকল টেনে তালা লাগিয়ে চাবির গোছা নিয়ে সরে পড়েছে।

‘বজ্জাত মাগি!’ হীরা দাসীকে গাল দেয় ফুলেশ্বরী আর বন্ধ দরজায় গুমগুম কিল মারে - ‘আঁই রঙ্গমালারে এককানা এক নজর চাইয়্যুম। তুই দুয়ার খুলি দে।’ বিলাপের সঙ্গে সঙ্গে তার গাল বেয়ে দরদরিয়ে অশ্রু ঝরে। রাইয়ের এ আকুল কান্নায় যে দুজনের সাড়া দেবার কথা, তাঁদের একজন শাশুড়িমা সুমিত্রা, যিনি চোখ বুজে ঠাকুর ঠাকুর করছেন। অন্যজন হীরা দাসী, সে এখন পুকুরপাড়ের জঙ্গলে বিষপিঁপড়ার কামড় খাচ্ছে।



চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কিছুটা সুস্থির হয় ফুলেশ্বরী। এ স্বপ্ন, না বাস্তব - রঙ্গমালা মারা গেছে! সাধের দিঘি কাটতে গিয়ে মরণ হলো অভাগীর। কী বীভৎস মৃত্যু! কল্লা কেটে ফেলেছে পাষন্ড খাসবরদার চান্দা বীর, কর্তাঠাকুর রাজেন্দ্র নারায়ণের হুকুমে। এখন রঙ্গি মরলে রাইয়ের ফায়দা কী। সংসারজলে সে তো আজ শেওলার মতো ভাসছে। শিকড় গাড়ার দিন শেষ। রাইয়ের চোখে আবার হু হু করে কান্না আসে। যার জন্য ফুলেশ্বরীর এ সর্বনাশ, স্বামী থেকেও বিধবা, তার মরামুখ দূরে থাক, জিয়ন্তে তাকে সাধ মিটিয়ে দেখতে পারল না! স্বপ্নে দেখলে যদি দেখা হয়, জলের বুকে তার ছায়া যদি সে হয়, তাহলে তো ফুলেশ্বরী রাই বছর খানেক আগে রঙ্গমালাকে দেখেছে। এখনো তার বাঁধভাঙা হাসি দূর থেকে কান্নার মতো রাতের বাতাসে ভেসে আসে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ