তিনদিন পর সন্ধ্যেয় সহদেব ঘরে ফিরে তার চোদ্দ বছুরে যে মেয়েটা ঘরের কোণে খিদেয় এলিয়ে ছিল তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কাল যাবি’?
মেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাপের দিকে তাকানোয় সহদেব এক গাল হেসে বলে, ‘সি. সিই মেলায়, আষাঢ়ী দ’র উপারে বড় মেলা দিখত্যা, সিবার বায়না ধরিছিলি, ইবার যাবি’?
বাপের কথা শুনে মেয়ে অবাক হয়ে নড়ে বসে। বাপের তার হ’লো কী, দিন তিনাক ধর্যা প্যাটে আগুন আর মিলা দেখার কথা কয়!
‘ই থলিতে চাল আছে রাঁধ, তুর মা কুমায়’?
এই বাক্যের সঙ্গে ক্ষুণ্নিবৃত্তির সঠিক সম্পর্ক থাকার দরুণ মেয়ে উঠে বসে, ছেঁড়া খোবড়া কাপড় দিয়ে উঠতি শরীর এদিক ঢাকে তো ওদিক আলগা হয়, অতঃপর বাপের দিকে নিঃসাড়ে চেয়ে থাকে।
সাধ করে মেয়ের নাম রেখেছিল লক্ষ্মী। সেই লক্ষ্মী এখন লক্ষ্মীছাড়া। দেহের আচ্ছাদনটি গামছার সমগোত্রীয়, বহরে যা একটু বড়। তা দিয়ে খোলামেলা দেহের পুরোটা ঢাকা হয় না সেহেতু চোদ্দ পার হওয়া পনেরো ছুঁই ছুঁই মেয়ের বাপের কাছে লজ্জা করে আর বাপেরও অস্বস্তি হওয়ার দরুণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে হয়। এইভাবে কিছুক্ষণ কাটার পর আঁধার ফুঁড়ে আর একটি জীবের আবির্ভাব হয়। সে সময় লক্ষ্মী উনানে আগুন লাগায়, বেশ কয়েকদিনের বাসি উনানে আবার রাঙা আগুন নড়েচড়ে। দুগ্গা জল নিয়ে ফেরে। অবস্থা তার কন্যারই মত। অবশ্য পাঁচ সন্তানের জননী হওয়ার দারুণ লাজলজ্জার বালাই নেই, সামান্য কটি বস্ত্রই যেন তার যথেষ্ট মনে হয়, শুষ্ক কোঁচকান বুক তেমনভাবে ঢাকার প্রয়োজন বোধ করে না বস্ত্রাভাবে। উনানে আগুন দেখে মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকানোয় লক্ষ্মী বলে, ‘বাপে এন্যাছে’ দুচোখ চকচক করে।
তিন তিনটে উলঙ্গ শিশু আর বছর দশেকের একটা উলঙ্গপ্রায় মেয়ের পাশে সহদেব বসে। দাওয়া মাটির সঙ্গে এক হয়ে গেছে, ঘরের চালের বাঁশ ঝুঁকে পড়ার ফলে ছাউনি নেমে এসেছে অনেক। শুকনো শন বাতাসে ওড়ে। এ বর্ষায় আর এ ঘর রক্ষা পাবে না এটা স্থির কেননা ধারালো দিনের আলো এখনই উঁকি ঝুঁকি মারে ফুটো চালের মধ্য দিয়ে।
‘তিন তিনটে দিন ছিল্যা কুথায়’? দুগ্গা জিজ্ঞেস করে।
‘ধান্ধায় ঘুরত্যা ঘুরত্যা আষাঢ়ী দ’র মেলায় চল্যা গিলাম, তুদের খাওয়া হইছে ই-কদিন।?’
থাকতিই দশদিন উপোস আর—দুগ্গা কথা শেষ করে না। শরীর অবসন্ন, খিদের জ্বালায় নেতানো, কথা বলতে কষ্ট হয়। ‘আর দুঃখু থাকবেনি, ট্যাকা জুগাড় হইছে, চাল এন্যাছি ভাত রাঁধ।’
‘ট্যাকা দিল কে?’ দুগ্গার জিহবায় তিক্ত স্বাদ, প্রশ্নেও।
‘অ জুটেছে ইক রকম, তো নক্ষীরে নি আষাঢ়ী যাব।’
‘কেনে?’
দুগ্গার প্রশ্নে সহদেব থতমত খায়, ‘না, ইমনি মেলা দিখার জন্যি।’
‘ইবার ই অবস্থায় মেলা হছে, কে যেন কয়ছিল হবেনি।’
এ কথায় সহদেব থমকায়, পর মুহূর্তে বলে, ‘ মুই ঘুইর্যা ইলাম আর মাইন্ষে কয় মেলা হচ্ছেনি।’ দুগ্গা নিশ্চুপ হয়ে শুনে যায়, প্রশ্ন করতে চায় না কেননা ক্রমাহত অন্নহীন থাকার পর মানুষের কৌতূহল লোপ পায়। অন্নের ভাবনা ছাড়া ভাবনা নেই।
সহদেব স্ত্রীর কাছে মালার গল্প করে, কদিন ধর্যা চলছ্যা সি মেলা, মুই ই-কদিন সিখেনে ছিলাম, সিখান থিকেই তো টাকা জুগাড় হ’লো। সিখেনে হরেকরকম মজা, রঙ বিরঙের জিনিশ, চুড়ী ডুড়ে শাড়ি, মণ্ডা মিঠাইর বাসে চাদ্দিক ম-ম করে, খেলাই বা কত রকমের, মরণ কূপ দিখে ডর লাগে, গা গতর ঠাণ্ডা মের্যা যায়, আন্ধারে উর তল দিখা যায়নি, পাগড়ি পরা মানুষ ঝপ কর্যা লাফ দিচ্ছে আবার হাসত্যা হাসত্যা উঠ্যা আসছ্যা উপরে, দুটো বাঘ আর ভল্লুক লিয়া সার্কেস আস্যাছে, হুরিপরি মেয়্যার দল ইকটুখানি পুষাক পর্যা কত ভয়ের খেলা দিখায়, নক্ষী দিকে মজা পাবে খুব, কত মজার খেলা!’
দুগ্গা চুপ ক’রে থাকে কেননা এ গল্প তার বহুবার গাঁয়ের নানান লোকের কাছে শোনা। যেতে ইচ্ছে হয় কিন্তু কোনোবার যাওয়া হয় না। সে বলে, ‘নক্ষী থাক বরং মুই যাই।’
সহদেব হা-হা ক’রে ওঠে, আরে না না উরে ক-বার কত্যাছি, পরের বার বরং তু যাস।
দুগ্গা আহত হয়, চুপ ক’রে ব’সে থাকে, অবশেষে বলে, উ যাক, ই ঘরে তো আর থাকবেনি বেশী দিন, সম্বন্ধ দিখার দরকার ইখন থিকে।
সহদেব কথা বলে না। চাদ্দিকে পাথর জমা অন্ধকার আর নৈঃশব্দ; দুইয়ে মিলে অন্ধকার গাঢ় এবং ভয়াবহ মনে হয়। কখনো বা দূরাগত কণ্ঠধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়। অন্ধকারে ব’সে থাকে সহদেব আকাশে চোখ রেখে দাওয়ার খুটোয় হেলান দিয়ে। ভাঙা উনানে জ্বালানো আগুনে আলো এসে কাঁপছে দাওয়ায়। ক্ষুধার্ত শিশুর দল উঠে উনান ঘিরে দাঁড়িয়েছে । তারা অবাক হয়ে ভাতের ভুট দেখে, আবছা গন্ধ ভেসে বেড়ায় সামনে পিছনে। গাঁয়ে আলো জ্বলে না সন্ধ্যেয়, মানুষজনও উধাও হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিরন্নের দল গাঁয়ের ধূলোয় পদচিহ্ন রেখে কোথায় চ’লে যাচ্ছে। যারা থাকছে তারা থাকবে কেননা সে কয়েকজনের গোলায় জমা আছে সারা গাঁয়ের মানুষের বছরের ধান। তারা কখনো মানুষ ভালো কেননা অসময়ে নিরন্ন মানুষকে দু-এক পালি ধান দিয়েও সাহায্য করে, যখন মর্জি হয় শোধ নেয় সুদে আসলে। আসল সুদের ঘায়ে পাহাড় হ’লে মানুষ হয় চার পেয়ে। সহদেবের ঘর শূন্য মাস দুয়েক আগে, এই প্রখর গ্রীষ্মে সে বুকে হাঁটা সরীসৃপ,। মজুরীহীন অন্নহীন মানুষ ক’দিন বাঁচে? ভাগের জমিতে বাবুর মজুর, লাঙ্গল ধরবে তারা। আর সে এখন এ-গাঁ সে-গাঁ দূর ওঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ায়—অন্ন চাই।
অন্নহীন পরিবারে বহুদিন পর অন্নের ছোঁয়া, তার গন্ধে সহদেবের স্ত্রী পুত্র কন্যা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। লোলুপ দৃষ্টিতে ফুটন্ত ভাতের দিকে তাকিয়ে।
‘মেলায় কাল হরেনের সঙ্গে দিখা, উ উখেনে বিড়ির কারবার ধরিছে, পয়সা হইছে বেশ, উ তুরে এটটা কাপড় দিল।’ সহদেব স্ত্রীর সামনে ভাঁজ করা কাপড় মেলে ধরে।
কাপড়ে লাল ডুরে। দুগ্গা ঝুঁকে পড়ে, আলো অপ্রতুল, আবছা আগুনে আলোয় কাপড়ের স্থানে স্থানে আগুনে রঙ ধরে। বোঝা যায় না স্পষ্ট কিছুই। দুগ্গা উলটে পালটে দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, অতঃপর বুকের উপর মেলে ধরে আধা ভাঁজ কাপড়।
‘ইডা পর্যা উ কাল মেলায় যাবে, কি কস তু?’ সহদেব স্ত্রীকে প্রশ্ন করে।
এ কথায় মেয়েমানুষটা চমকায়? ধড়ফড়িয়ে ওঠে। কাপড়টা কোলের কাছে পড়ে যায়। সহদেবের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে। নিরন্ন স্ত্রীলোকের সামনে পর্যাপ্ত সুখ। চারপাশে ফুটন্ত ভাতের গন্ধ, টগবগানো শব্দ, সে মাথা নামিয়ে সম্মতি জানায়। তবুও মেয়েমানুষের ভাবনা সহজে শেষ হয় না, সে উনানের কাছে বসা মেয়েকে দেখে, অবশেষে সহদেবকে উত্যক্ত করে প্রশ্নে, ‘তো হরেন ইতো ভাল হল কবে থিকে? পয়সা হলে তো মানষের মন ফিরে না, ইতো মনা হয়।’
সহদেব উত্তর করে না, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেমেয়ের মাকে দেখে, দুগ্গা ছটফট করে, অবশেষে আবার কথা বলে, ‘ ইত কষ্টের সময়ে আর মেলা দেখতি হবেনি, পয়সা থাক ঘরে।’
‘কেনে পয়সার অভাব তো আর হবেনি, হরেন উরে দেখতে চেয়্যাছে, বলল কত ছোট দিখেছি কত ডাগর হ’লো নক্ষ্মী।’
এই কথায় দুগ্গা নিশ্চুপ, দুহাত দিয়ে মাথার জট ছাড়ায়, চুল্কোয়। তার ভাবনা আসে না, খিদেয় শরীর টালমাটাল, চাদ্দিকে ভাতের গন্ধ গভীর হয়ে এসেছে। সহদেব স্তব্ধ হয়ে ব’সে থাকে। চতুর্দিকে এখন আঁধার গভীর, গাছপালায় দাঁত চাপা কাঠিন্য, বাতাস আসে না।
খাওয়ার সময় সুদেব লক্ষ্মীকে বলে, ‘খা খা বেশী ক’রে খা।‘
‘মুই বুঝিনি বাপু তুমার মতিগতি, প্যাটে ভাত জুটছেনি আর তুমি মিল্যা দিখার কথা কও,’ দুগ্গা মিন মিন করে করে।
‘তু থাম, বড্ড টকর মারিস, গিলছিস গিল’, সহদেব অধিকতর রুক্ষ।
খেতে খেতে সহদেব নিজের পাতের ভাত তুলে দেয় লক্ষ্মীর পাতে। দুগ্গা দেখে বলে না কিছুই। হাড়ে চামড়ায় আবদ্ধ বুক ধকপকায়, ভারী ঠেকে মাথাটা।
ভোর না হতেই দুগ্গা মেয়েকে সাজায়। লাল ডুরে শাড়ি পরায়, মাথায় বেড়াবিনুনী ক’অরে চুল বাঁধে। পুরনো বাক্সের কোণে একটা ইঁদুরে কাটা হলুদ ব্লাউজ ছিল, সেটাও পরায়, দুপায়ে গাঢ় করে আলতা দেয় আর ছোট্ট কপালে লাল টিপ যা আলতারই। তখন পুবের পৃথিবীতে গাঢ় লাল করে সূর্য ওঠে ঠিক যেন লক্ষ্মীর কপালের টিপ। অতি কোমল আলোয় লক্ষ্মীকে প্রতিমার মত দেখায়, সহদেবের ভাঙা ঘরে ছোট্ট কপালে লাল টিপ আর দুপায়ে গাঢ় আলতা পরে নবীন আলোয় দু;খী মেয়ে পৃথিবী হয়ে যায়, ভোরের পৃথিবী।
‘মেয়্যারে দিখায় বেশ।‘
‘হ্যা’ সহদেবের উত্তর।
‘বিয়ার দিন হইছে, ইরে ষোল সতেরো দিখায়, জন্ম তো সি সিই বড় বন্যার সময়, ইখেনে ম্যাজিসটিরি সাব এইছিল, তা চোদ্ধ পনেরো সাল হব্যা।’
সহদেব মাথা নাড়িয়ে দুগ্গাকে সমর্থন জানায়।
অন্নহীনের দেশে এমন চেহারা ক’জনের আছে! বাপের সঙ্গে লক্ষ্মী চলে মেলা দেখতে। উঠোনের ধূলোয় তার ছোটো নরম পায়েরর ছাপ পড়ে। এঁকে বেঁকে সামনে চলে যায় লক্ষ্মীর পদচিহ্ন; নরম ধুলোর পরে বৈশাখের আকাশতলে তার পদচিহ্নের আল্পনা আঁকা হয়।
‘হাঁটতি পারবনি?’ বাপের প্রশ্নে লক্ষ্মী সম্মতি জানায় মাথা নামিয়ে। দুগ্গা জীর্ণ কুটীরের সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে পথের দিকে, বুকটা তার ভার হয়ে আছে। কেমন যেন লাগছে! লক্ষ্মীর মাথার টিপ্—কমলা রঙের বিরাট বলয় পূবে রঙ ছড়াচ্ছে, সূর্য দেরী করে উপরে উঠুক না হলে তার মেয়ের কষ্ট হবে। তার লক্ষ্মী মেলা দেখতে যাচ্ছে।
বাঁধে বাঁধে রাস্তা। দু’পাশে আদিগন্ত অনাবাদী ধানী জমি, জলের জন্য আকাশের দিকে চেয়ে। সূর্য উঠেছে পূবের ঘন জঙ্গল ছাড়িয়ে প্রায় এক হাত। রাস্তার মাঝে মাঝে কোথাও বিশাল বট অশ্বত্থ দাঁড়িয়ে, সেখানে নরম ছায়া অতঃপর আকাশতলে হাঁটা। মাঠে লাঙ্গল নিয়ে যাচ্ছে দু’একজনা, তাদের কেউ হাঁকে, ‘ উ স’দেব চললি কুথায়, কুটুমঘর?’
সহদেব হাসে, জবাব দেয় না। লক্ষ্মী মাথা নামিয়ে হাঁটে। লাঙ্গল যারা ধরেছে, এখন তারা বাবুর বাড়ির লোক, পয়সার অভাব নেই। ‘শ্যালো এটটা থাকল্যা চাষ দিখায় দিতাম’, সহদেব আপন মনে বলে। বাবুরা শ্যালো পাম্প দিয়ে পাতালের জল জমিতে তুলবে আর হরিণা-ডাঙ্গি, মানিপুর, চন্দনপুর, আকালপৌষের অন্নহীন ভূমিহীনের দল মজুরির খোঁজে পরিবার অভুক্ত রেখে রাস্তায়।
‘সি-সিইযে তালগাছ দিখছিস, সি তালগাছের উপারে মানিকপুর, সিখেনে যাত্রা হইছিল, মনা আছে?’
লক্ষ্মী কোমল দুচোখ ফেলে দূরে—বহুদূরে মাঠ পার হয়ে আবছা কালো ছায়া ভেসে আছে তালগাছ বরাবর অনেক পিছনে। ঐ কালো ছায়ায় মানিকপুরের সীমা। সে হাঁটতে হাঁটতে দেখে পিতলরঙা রোদ উঠেছে চারপাশে। সে বলে , ‘মনা আছে, মুই যেছিলেম, ইবারেও যাব।’
সদেব দ্রুত হাঁটে, সুতরাং লক্ষ্মীও।
সহদেব বলে, জোরে হাঁট রোদ চড়া না হতি লোয়াদা পৌছাতি হব্যা, স্যখেন থেকে আরো কোশ দুই পথ।’
লক্ষ্মীর চারদিক পিতলরঙা রোদ আছে, বাতাসও, ফলত কষ্ট তেমন অনুভূত হয় না।
সহদেব বলে, ‘ই দেখ গরমিন্ট ইলিকটিরির তার লাগায়ছিল শাল খুঁটি পুত্যা, তো নাইট তো এলোনি-- কারা সি তার কেট্যা নি গেছে।’
লক্ষ্মী দেখে লম্বা লম্বা শালের খুঁটিগুলো মাঠের মাঝে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে, মাথায় মাথায় জোড় তার উধাও। এইসব দেখতে দেখতে দ্রুত বাপের সঙ্গে তাল রাখতে রাখতে লক্ষ্মী মাঝে মধ্যে বেসামাল, ছোট্ট আঁচল সামলাতে হিম্সিম্। অনেক পথ পিছনে চলে যায় অতিদ্রুততায়।
‘ই দেখ সি মন্দির, মা তালন্দা, শেতলা মারে পেন্নাম কর।’
পথের ধারে উদ্ধতের মত দাঁড়িয়ে বড় মন্দির। চূড়ায় চূড়ায় তার রোদ আটকে থাকে। লক্ষ্মী গলায় আঁচল জড়িয়ে গড় হয়ে প্রণাম করে। সহদেব এক পলকে দেবীকে প্রণাম ঠুকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে, বিড়বিড় ক’রে বলে, ‘বড় জাগন্ত দেবী ইনি বুঝলি, যা পাবি তাই পাবি।’
মন্দির ছেড়ে দু’জনে আবার পথে। বাজারে একটা মানুষও নেই, শুধু কয়েকটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝিমোয়। রোদে রূপার বর্ণ ধরেছে। বাপে মেয়ে পা চালায় জোরে। লক্ষ্মী দেখে সহদেব দেখায়, ‘ই দেখ ই হ’লো শীষগেড়্যা পোস্টাফিস, ইখেনে পত্তর যদি ইকবার ফিলা যায় তবে বিলাতও চল্যা যায়, ইমনি কিরামতি মাস্টারবাবুর, উ দেখ দাঁড়ায়ে।’
লক্ষ্মী অবাক হয়ে মাস্টারবাবুকে দেখে পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে লুঙ্গীর কষি বাঁধতে বাঁধতে এদিকে তাকিয়ে। সে লজ্জা পায়, দু হাত বুকে চাপা দিয়ে জোরে হাঁটে। শীষগেড়্যায় হলুদ রঙের পোস্ট অফিস্ পার হয়ে অনেকদূর এগিয়ে যায়। এগোতে এগোতে লক্ষ্মী হঠাৎ দাঁড়ায়, এবার সে তার বাপ্কে দেখায়, ‘উ দেখ ঢ্যামনা সাপডা মাছ ধরিছে, উঃ গা কিমন করছ্যা!’
সহদেব দেখে পাশের কর্দমাক্ত ডোবা থেকে কালো সরু সাপটা শুকনো ডাঙায় উঠে মাছটাকে গেলার চেষ্টা করছে। সে বলে, ‘ ধুর তুর ইতেই ভয়, মেয়্যামানুষতো, উ সাপ্ তো মাছ ধরব্যাই।’
লক্ষ্মীর সমস্ত দেহে শিহরণ লাগে, সে হাঁটতে শুরু করে, ‘মাছটা ট্যাংরা হলি বেশ হত, মজা বুঝত উ ঢ্যামনা’, চলতে চলতে লক্ষ্মী বলে।
এই ভাবে তারা দু’জনে কত পথ পার হয়ে যায়। উজ্জ্বল আলোয় লক্ষ্মী চারপাশ দেখে অবাক হয়। এমন ভাবে এদিক দেখেনি সে; গেছে যা দু’একবার যাত্রা দেখতে সে তো রাতে হরিণাডাঙ্গীর পথে মাঠ ভেঙে। তখন তো সব আঁধার আর আঁধার।
‘ই দ্যাখ সি কিলাপ, ইখেন থিকে সিবার বন্যের সময় রিলিফ নিতা আসতাম, মনা আছে?’ সহদেব কন্যাকে আকালপৌষের সেই জীর্ণ ক্লাব ঘর দেখায়, রাস্তার ধারে বড় নিঃসঙ্গ।
‘সি কিলাপ!’ লক্ষ্মী অবাক হয়, ‘সি রাস্তা ই নাকি, চিনাই যায়নি!’
‘চিনবি কি কর্যা তখন তো সব জলে এক।’
‘ইবার দিবে?’ লক্ষ্মী সাগ্রহে প্রশ্ন করে।
‘হ বন্যে তো হবেই আর দিবেও বুধয়, উ খালটার মুখ কেট্যা দিলা সব চুক্যা যায় তা গরমিন্ট তো আর কাটবেনি।’
ওরা হাঁটে, বহুদূরে এগোয় লক্ষ্মী। এসব অচেনা, দুপাশে অনাবাদী ধানী মাঠ মাঝে উঁচু ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা, গাঁয়ের লোক বলে বাঁধের রাস্তা, এক হাঁটু ধুলো, দরদরিয়ে ঘাম ঝরে। সুর্য উপরে উঠেছে, রোদ হয়েছে গাঢ়, রাস্তার ধারে বড় একটা বকুল গাছের তলা বকুল ফুলে ছেয়ে আছে। বাতাসে ফুলের গন্ধ ভাসে। এই বাতাস লক্ষ্মীকে ঘরের কথা মনে পড়ায় তাই সে উন্মনা। রোদ অর্থাৎ উত্তাপ দেহ সাপ্টে ধরেছে, মাথা ঝুঁকে পড়ছে মাটির দিকে তবুও সে হাঁটে। খিদে আবার নড়াচড়া করে তার শরীরে, মাথা ঝিম্ মারতে চায়। সহদেব বলে, ‘আর একটু হাঁট, কাঁসাই পার হলিই পৌঁছা যাব লোয়াদা’।
সহদেব কাসাই নদীর কথা বলে। লক্ষ্মী মোহগ্রস্তের মত হাঁটে। তীব্র রোদে শরীর টাটায় তার। ক্রমে উঁচু বাঁধ দেখা যায় নদীর। সহদেব তর্জনী তোলে দূরের দিকে, ‘উই নদী দিখা যায়, চল জোরে চল এস্যা গিলাম’।
লক্ষ্মী সামনে দৃষ্টি ফেলে, উঁচু বাঁধ দেখা যায় নদীর, ঘন গাছগাছালিতে ঢাকা, নদী কত কাছে। হঠাৎ হরিধ্বনিতে তার চমক ফেরে, ছিটকে সে সহদেবের গা ঘেষে দাঁড়ায়। কোনাকুনি মাঠ ধরে বাঁশের চালিতে একটা মড়া মেয়েমানুষকে শুইয়ে কটা লোক হরিধ্বনি দিতে দিতে বাঁধের রাস্তায় ওঠে। তারা এগোয়। লক্ষ্মী জোড় হাতে প্রণাম করে। মেয়েমানুষটার পা দুটো চালি থেকে বেরিয়ে দুলছিল। লক্ষ্মী সবিস্ময়ে দেখে মরা মেয়েমানুষটার পায়ে গাঢ় আলতা মাখানো, সে নিজের পায়ের দিকে তাকায়। দুঃখে তার দুচোখ ছাপিয়ে জল আসে, ধুলোর আস্তরণে পায়ের আলতা মুছে ধুলি ধূসরিত হয়ে গেছে পা দুটো তার।
‘কোন গাঁর গো’?
‘উ নরহরিপুর’।
‘কি হইছিল’? সহদেবের দ্বিতীয় প্রশ্নে শবযাত্রীরা তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয় না, গতিবেগ বাড়ায়। একজন বলে, ‘গলায় দড়ি, সুমত্ত মেয়্যামানুষ অভাবে নষ্ট হলো, গলায় রশি বেন্ধ্যা ঝুল্যা পড়ল।’
লক্ষ্মী বাপের হাত ধরে, শবযাত্রীর দল বাঁশের চালি বয়ে এগোয়, মাঠে নামে আবার ওরা, কাঁসাই-এর বাঁকে বালিতে পোড়াবে দেহ।
সূর্যে আগুন ধরেছে তাই বাতাসেও। ক্রমে নদীর পাড়ে পৌঁছায় তারা, এইখানে রাস্তা দ্রুত উপরে উঠে আবার নেমেছে নদীর বুকে। লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করে, ‘ইখনও কদ্দুর মেলা’? সহদেব নিরুত্ত।
‘এট্টা ফিতা কিনা দিবা, লাল ফিতা।’ সহদেব নিরুত্তর। লক্ষ্মী দেখে বাপের চোখ মুখ কেমন রুক্ষ হয়ে আসছে। প্রতি পদক্ষেপেই ছোট্ট একটা চায়ের দোকান, সহদেব দাঁড়ায় সেখানে। পাঁচটা মানুষ বসেছিল। একজন হেসে বলে, ‘এই বুঝি তোর লক্ষ্মীরে স’দেব?’
‘হাঁ’।
‘তা দেরী হ’লো কেনে?’
‘এজ্ঞে টায়েম তো ঠিক রেখ্যাছি’, সহদেব আস্তে করে বলে।
আধঘণ্টা দেরী, একটা মানুষ কবজি উলটে ঘড়ি দেখে।
পাঁচটা মানুষ লক্ষ্মীকে দেখে। জহুরীর চোখে দেখে।
ওরা আবার এগোয়। লক্ষ্মী এবার আগে আগে, সহদেব আর পাঁচটা মানুষ পিছনে। ক্রমে নদীতে নামে। মাথায় বোশেখের পোড়া আকাশ নিয়ে নদী পড়ে আছে সটান, জল শূন্য শুষ্ক বালি উজ্জ্বল রোদে ঝক্ঝক্ করছে। নদীর উপরে আগুনে বাতাস, নিরন্ন মানুষের মত নদী আকাশ দেখে। লক্ষ্মী জোরে হাঁটার চেষ্টা করে, তাড়াতাড়ি মেলায় পৌঁছান দরকার। গরম বালির ভিতর ডুবে যাচ্ছে তার পা-- হাঁটা দুষ্কর। শূন্যে ডানা ভাসিয়ে চকচকে বালির উপর গাঢ় বাদামী শকুন নামে ওই কোণে, বালির উপর আরো কয়েকটি ব’সে। ডানা বিছিয়ে ক’টা শকুন লাফিয়ে লাফিয়ে এগোয়, একটা অন্যকে ডানা বিছিয়ে তাড়া করে, কর্কশ চীৎকার বাতাসে ভাসে। লক্ষ্মী উন্মনা, এসব দেখে না-- তাই সেদিকে চলে যায় অনায়াসে, বাপ তার বেশ পিছনে। সে থমকে দাঁড়ায় শকুনের চীৎকার শুনে, ঘুরে ডান দিকে তাকায়, দেখে বালির উপর, ওকী! একটা বাচ্চার দেহ বালির ভিতর থেকে রাত্রে শিয়াল টেনে তুলেছে, এখন সেখানে শকুনের পাহারা। আগুনে বালির উপর ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে লক্ষ্মী ভয়ে ছুটে পালাতে চায় আর তখনই গরম বালির ভিতর তার পা ডুবে যায়, ভয়ে পা হড়কায়। তার চীৎকার শুনে সহদেব ছুটে আসে, লক্ষ্মী বাপের দেহ আঁকড়ে ধরে, ভয়ে ওর শরীর নীল, থরথরিয়ে কাঁপে। সহদেব দেখে লক্ষ্মীর পায়ের গাঢ় আলতার দাগ মুছে গেছে-- সেখানে কিছু নেই, কপালের টিপ্ মুছে গেছে, সযত্নে বাঁধা চুল খুলে ছড়িয়ে পড়েছে মুখময়, আঁচল লুটোয় বালিতে। বাতাসে এখন কঠিন উষ্ণতা, উপরে প্রখর রৌদ্র পায়ের নিচে তপ্ত বালি। বালির বিস্তার সামনে পিছনে, যতদূরে চোখ যায়।
‘আর মেলায় যাবনি বাপ্, ঘরে নিই চল।’ লক্ষ্মীর আর্তনাদে সহদেব নিরুত্তর। সহদেব কঠিন হয়ে বালির উপর দাঁড়িয়ে থাকে, কেননা কোমরে ওর এক কুড়ি টাকা আর জিহ্বায় গত রাত্রের অন্নের স্বাদ এখনো বর্তমান। সেই পাঁচটা মানুষ বালির উপর লাফায়, লাফিয়ে এগিয়ে এসে বলে, ‘অ স-হ-দেব হ’লো কী, মেয়্যা তুর কান্দে কেনে?’
(একাল ১৯৭৪)
4 মন্তব্যসমূহ
চমৎকার গতি আছে গল্পটায়। আর বিষয় যদিও অনেকবারই এসেছে সাহিত্যে তবু এই গল্পের অভিনবত্ব তার ভঙ্গিমায়। কিন্তু প্রকাশের ক্ষেত্রে বানানগুলি একটু দেখে নিলে ভালো হয়।
উত্তরমুছুনএকটা লেখা তৈরি করতে গিয়ে এই গল্পের নামটা পাই। খুঁজে পড়েও নিলাম। ভীষণভাবে চমকাতে হলো। এক তো অতি অবশ্যই শ্রদ্ধেয় অমর মিত্র'দা অসাধারণ লেখনশৈলী, দ্বিতীয় যে কারণ সেটা কাকতলীয়, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটা ছোট্ট খবরের সূত্র ধরে ২০১৯'র দিকে একটি গল্প লিখেছিলাম। এই গল্পের বিষয়বস্তুর সাথে তার এতটা মিল দেখে চমকেছি। সময় উজিয়ে এখনও কোনো কোনো বাবা কন্যা সন্তানকে বিক্রিযোগ্য পণ্য ভাবে...
উত্তরমুছুনমুগ্ধ হয়ে পড়ে গেলাম। অমরদার গল্প থামতে দেয় না। শ্রদ্ধা।
উত্তরমুছুনকী যে ভাল লাগল।
উত্তরমুছুন