মৌসুমী কাদেরের গল্প : বাদামী জুতোর গল্প

বাজারে যুতসই জুতো নেই। প্রচণ্ড শীত সহনীয়, কোনভাবেই পা ভিজবেনা, বাতাস ঢুকবেনা, পায়ের পাতা আর আঙ্গুলগুলো উষ্ণতায় ভরিয়ে দেবে, ঠিক এইরকম একজোড়া জুতো। এলডো, ফুট লকার, নাইকি, টাউন শুজ, সব দোকান ঘোরাঘুরি শেষ। দোকানীরা বললো, শীতের সব জুতো তুলে নিয়েছে ওরা। এদিকে পুরনো জুতো জোড়াও যাই যাই করছে। সবিতাদি ফোন করে বললো; ‘আরে কি কিনবে বলো? সবকিছুর দাম বাড়িয়ে বাড়িয়ে চারগুন করে রেখেছে। ৫০% ছাড় বললেই কি হোল নাকি? শালারা আদতে বদমাইশ। অরিজিনাল দামেই বিকিয়ে নিচ্ছে।’ এইসব কথাবার্তা শুনে মনটা কেমন দমে গিয়েছিল শিউলীর। যাই হোক, গেল সপ্তায় কোনরকম হুলুস্থুল ছাড়াই আবার নতুন উদ্যোমে জুতো কিনতে বেড়িয়েছিল সে। এ দোকান সে দোকান ঘুরে টুরে ‘সফট ম্যকে’ গিয়ে আটকে গেল চোখ। জেনুইন লেদার, লাল ফ্লিচে মোড়ানো, ওয়াটারপ্রুফ, একদম পারফেক্ট এক জোড়া বাদামী জুতো। শিউলীকে দেখেই ওরা হা হা হা করে হাসতে শুরু করল...। কিছুটা অপ্রস্তুত আর বিব্রত ভঙ্গীতে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো শিউলী, হচ্ছেটা কি!! জুতো জোড়া হাসে কেন??? একরকম হাপাতে হাপাতেই বাড়ী ফিরেছিল সেদিন । উৎপলকে জুতোর গল্পটা বলতেই সে হাসতে হাসতে মরে যায় আরকি। সব কথা উড়িয়ে দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাতে থাকে সে।


ডাক্তার ঘর থেকে উৎপলকে বের করে দিয়ে নানারকম প্রশ্ন করতে শুরু করে শিউলীকে;

-ক’দিন ধরে এই কুকুরগুলোকে দেখতে পাচ্ছো?

-প্রায় পাঁচ মাস । যখনই বাইরে যাই, মনে হয় ওরা ধাওয়া করছে। জোড়া জোড়া অদৃশ্য কুকুর দৌড়চ্ছে মানুষের পেছনে। ভয় হয়।

-বলোকি? স্বামীকে বলোনি?

-বলেছিলাম। বোধহয় মন দিয়ে শোনেনি, জানিনা......

-আচ্ছা বলতো? পৃথিবীর সব মানুষ কি জুতো পায়ে দিয়ে থাকে?

- না। কারো পায়ে দু ফিতের স্যান্ডল, অথবা চকচকে বুট। কোথাও কোন খালি পায়ে মানুষ নেই। কত সভ্য দেশ! খালি পায়ে মানুষ কেমন করে হবে?


-এদেশে হয়তো নেই? অন্য দেশে কি নেই?

-আছে। রসুলপুরে আছে। আন্নার পায়ে জুতো ছিলনা। বুবুর পায়ে খড়ম ছিল।

-আন্না কে?

-একজন কালো মানুষ। কুচকুচে কালো।

-তোমার কে হয়?

-কেউ হয়না।

-শোন মেয়ে; ঐ কুকুরগুলোতো আসলে ‘ডিপ্রেশন’। তুমি বুঝতে পারছো শিউলী? কি ভীষণ নেগেটিভ চিন্তা করছো তুমি? এটা কিন্তু করা যাবেনা। ‘স্মৃতি বা আবেগে’র উপর কোনরকম চাপ দেয়া যাবে না। ঘুম হয় ঠিক মত? সারাদিন বাড়ীতে একা থাকো বুঝি? স্বামী কাজ থেকে বাড়ী ফেরে কখন?

-ভোর পাঁচটায়। তখনই আমার ঘুম ভাঙ্গে।

-মানে কি? রাতে কাজ করে আর ভোর বেলায় তোমার ঘুম ভাঙায়?

-হ্যা

- কিন্তু কেন বলতো ?

শিউলী চুপ করে থাকে। স্তব্ধ অভিব্যক্তি। শক্ত চেহারা। কিছু বলেনা। অন্য দিকে তাঁকিয়ে থাকে, চোখ দিয়ে শুধু দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে...

ডাক্তার অবাক হয়না। নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দেয়। বাইরে সবুজ বাগান। দুজনেই চুপচাপ কিছুক্ষণ।

-তুমি মা হবার কথা কিছু ভাবছ্‌ শিউলী?

-খুব শান্ত আর ধীরস্থির গলায় শিউলী উত্তর দিল ‘না’...।

-কেন, জানতে পারি কি?

-‘জানিনা’, এই ‘না’ এর ঘন দ্বীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, কেউ কথা বলেনা।


বেশ কিছু কড়া ঘুমের অষুধ দিয়ে টিয়ে উৎপলকে ডেকে এনে ডাক্তার বললেন;

-‘একটু বাইরে থেকে ঘুরেটুরে আসুন, মশাই’। বিদেশে নতুন এসেছে, মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখছেন না কিন্তু আপনি’।

আমি জানি আপনার টাকাতেই সংসারটা চলে কিন্তু সারারাত আপনি কাজে থাকলে মেয়েটা কি করে বলুনতো? ও কি ঠিক মত ঘুমায়? আপনি ওকে ধর্মকর্ম পালন করতে জোর করেন? নাকি হঠাৎ আপনিই ধার্মিক হয়ে গেছেন, আগেতো এমন ছিলেন না! ছিলেন কি?

উৎপল মনে করার চেষ্টা করে। শিউলী বলেছিল;

-শোন, ফুট লকারে না অনেক জুতো সেল এ দিচ্ছে। একটা বাদামী জুতোনা ভীষণ পছন্দ হয়েছে।

বিরক্ত হয়ে যায় উৎপল । স্ত্রীর এইসব বাড়াবাড়ি চিন্তার উৎস নির্মূল করতে চেয়ে বলে;

-‘জুতোতো আছেই। কয় জোড়া জুতো লাগে তোমার? মাসে মাসে জুতো কেনা লাগে? এই সব বাজে চিন্তা বাদ দিয়ে নামাজ পড়’।

-জুতোর সাথে নামাজের কি সম্পর্ক?

-সম্পর্ক নেই। কিন্তু নামাজ পড়তে অসুবিধে কোথায়?

-আমার ভাল্লাগেনা।

-তোমার বাবা-মা তোমাকে কিচ্ছু শেখায়নি। সুরাগুলো জানোতো? নাকি সেটাও শেখোনি?


দ্বিতীয়বার জুতোর কথা মনে করিয়ে দেয়াতে উৎপল নিয়ে এলো একটা বিশাল মসজিদ আঁকা ‘অটো ইসলামিক আযান ক্লক উইথ কিবলা ডিরেকশন’। ওটা ঠিক ঠিক সময় মত আযান দেয়। গভীর ঘুমের নিমগ্নতা ভাঙিয়ে শাসন করে বলে ওঠে, ‘ওই ঘুম থেকে ওঠ...নামাজ পড়’...শিউলী লুকিয়ে লুকিয়ে ঘড়িটা স্টোর রুমে রেখে আসে। আযান শুনলে ভয় করে ওর.... ‘আল্লাহু আকবর...আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লা......’ জমে যেতে যেতে পাথর হয়ে যায় আরবী শব্দমালা ।

নামাজ পড়বার অভ্যাসটা আগে ছিলনা উৎপলের । কেমন করে যেন দিন দিন ধার্মিক হয়ে উঠলো সে। ভোরবেলা কাজ থেকে বাড়ী ফিরে ফজরের নামাজ আদায় করেই স্ত্রীর সঙ্গে শুতে হোত ওর। শিউলীর ভাললাগা মন্দলাগাগুলো দেয়ালে আটকে যাচ্ছিল। টিকটিকির ছায়া অনুসরন করছিল সে। উৎপল সেসব কিছুই টের পায়নি। মেয়েটা প্রেগনেন্ট হচ্ছিল না সেইটিই বড় চিন্তার বিষয় ছিল। বয়েস বাড়ছে, ছেলেপুলে হতে দেরী হলে কবে মানুষ করবে ওদের?

কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনের উৎপলের মন ভেঙে গেল। বিদেশে থাকে বলে সকলেই মনে করে ওদের অনেক টাকা। আসলে দৃশ্যটা একেবারেই ভিন্ন। একটা ভাল চাকরী খুঁজে পেতে অনেক চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সিকিউরিটি গার্ডের চাকরীতেই সংসার চালাতে হচ্ছে। তাও আবার নাইট ডিউটি। সপ্তাহের পাঁচ দিনই একা রেখে যেতে হয় শিউলীকে। বিষণ্ন থাকে মেয়েটা। কিছুই কি করার ছিলনা? অনেকদিন ধরেই বলছিল, ওর এক জোড়া জুতোর প্রয়োজন। দিনের বেলায় ঘুমাতে হয় বলে যাই যাই করে আর যাওয়া হচ্ছিল না । শেষ পর্যন্ত শিউলী একাই বেড়িয়ে পড়ছিল আজকাল। কিন্তু জুতো আর কেনা হচ্ছিল না সহজে। দেখতে ভাল তো দাম বেশী। দামে ভালতো আরামদায়ক নয়, এইসব কমপ্লেইন লেগেই ছিল। তবু ওর খুব ইচ্ছে ছিল এক জোড়া বাদামী জুতোর। সেকথা উৎপল এখন স্পষ্ট মনে করতে পারছে।


২.

ঝিরঝির বৃষ্টি। চট করে গায়ে লেগে যায় এরকম হঠাৎ হঠাৎ বাতাস। দু টুকরো পাটশলার ডগা দিয়ে কানের ছিদ্র দুটো বন্ধ। ডুব দিলে যেন কানের ভেতর জল না ঢোকে সেই জন্যে এই ব্যবস্থা। ফুপুর বাড়ীর পুকুর পাড়ে জল ছুঁই ছুঁই বড়ই গাছ। বড়ইগুলো ভারী টক আর বাইল্যা। জিভে দিলে যেন সুজির দানা গলে পড়ে। কাঁটা ভর্তি গাছের ডাল ধরে ঝাকুনি দিলে ঝুম ঝুমিয়ে বৃষ্টির মতন বড়ই পড়ে। মাথায়, কানে, শরীরে সেই শব্দ ঝিনঝিন ঝিনঝিন বাজে। পাড়ার খুব পরিচিত মুখ আন্নাভাই দিনের অর্ধেকটা সময় এই পুকুর পাড়ে বসে থাকে। ওর পাতিলের তলার মতন কালো মুখ কেউ দেখতে চায়না। সবাই তাকে ঘেন্না করে। কেউ কাজেও নেয়না। শিউলীর ঘেন্না নেই। ফুপুও আলাদা। সে আন্নাকে নিয়ম করে খেতে দেয়। বিশাল এক গামলা ভর্তি ভাত, কাঁচালংকা, মাছ বা মাংস, যা থাকে তাই। কাঁচা বা সিদ্ধ, আন্নার কোনটাতেই সমস্যা নেই। দূর্ভিক্ষের মতন গিলে খায় সে । বুভুক্ষ মানুষের স্বভাবই এমন, পায়ের পাতায় মাটি না লাগলে অচেনা লাগে শরীর।

আমন ধানের বাড়ন্ত সময় এখন। কামলারা জমিতে ইউরিয়া ছড়াচ্ছে আর আগাছা তুলছে। কারো বা জমিতে সেচও চলছে। এত কাজের ভীড় তারপরও আন্না কোথাও নেই। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে পুকুর পাড়ে। পাহারা দেয় শিউলীকে । রিজিয়া বেগমের কড়া নির্দেশ। মেয়ের পায়ে যেন কাঁটা না ফোঁটে। কানে যেন জল না ঢুঁকে। অর্ধেক জলে ডুবে শিউলী চিৎকার করে ডাকে;

-আন্নাভাই, ও আন্নাভাই, কতক্ষণ বইসা থাকবা? যাও, হিদল ভর্তা দিয়া ভাত খায়া আসো। ফুপুআম্মা ভাত বসাইসে।

-আফনি আগে উইট্টা আসুইনযে মা জননী। জুতা পড়বাইন, হেরফরে যাইতাম পারবাম। আম্মা আমার কল্লা কাট্টাইলবো। জুতা পরুইনযে।

রোদের আলো পড়ে দুই ফিতার বাদামী এক জোড়া প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পুকুরে পাড়ে জ্বলজ্বল করছে। তার পাশে চিত হয়ে শুয়ে আছে আন্না। শিউলী কোন কথাই শুনছেনা। অন্য পাড়ে কচু ক্ষেত। প্যাচপ্যাচে কাঁদায় হাসদল ছুটছে। পুটলী আর শিউলী জোড়া বেঁধে কলাগাছের ভেলায় উঠছে আর ঝাপিয়ে পড়ছে জলে। শিউলী চিৎকার করে চোখ রাঙিয়ে বললোঃ

-আন্নাভাই, আমি জুতা পরতাম না, তুমি যাও, ওই গুলান নিয়া যাও

আন্না রাগে গজ গজ করতে করতে হনহন করে হাটতে থাকে বাড়ীরে দিকে।

কাঁদার গর্তে গলে ডুবে যেতে যেতে ভেসে উঠে এক পাটি জুতো। আরেক জুতো তখনকার মতন বিচ্ছিন্ন।


৩.

শিউলীর হাতের লেখা লতানো নরম পান ডগার মতন। অল্প আঘাতেই ছিড়ে যায়। শব্দগুলো তাই যত্ন করে পড়তে হয়। খামহীন খোলা চিঠি। বিষণ্নতার বাতাস লেগে আছে তাতে। উড়ে যেতে যেতে এককোনায় স্থির হয়ে পড়ে আছে সে।

লেখাটা যখন পড়া হবে, তখন মেয়েটি অনেক দূরে। কারো সাথে দেখা হবার প্রতিক্ষা নেই। লাভ বা লোকসানের আঙ্গুলে তুড়ি মেরে বদলে যায় সময়। শৈশবকে টেনে হিঁচড়ে এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রাম করা যায়, কিন্তু মানুষটাতো একই রয়ে যায়। বেঁচে থাকার জন্য সময় বোনাটা হাতবদলের মতন। এক ক্রুশ থেকে আরেক ক্রুশ গুঁজে টেবিলক্লথের হাওয়ায় উড়া। ফুপুআম্মা শব্দ বুনেছিলেন; স্বপ্ন দেখতে নেই, ওরা এমনিতেই ভোর হয়ে আসে। দাঁড়িয়ে থাকে দরজায়। ঝাপটা দিয়ে হন্য হয়ে ছিদ্র খোঁজে। স্বামীর বাড়ীতে রাঁধতে হবে, রান্না শেখো। আদব কায়দা শিখতে হবে, নামাজ পড়ো। একের পর এক সুরা মুখস্ত করো। জাত পরিচয় দরকার নেই, হিন্দু মুসলমান যা পারো তাই শেখো। পাটশাক, কচুর লতি, শিমকুচি ভাজি, ছোটমাছের চর্চরী, ঘুঘু পাখি, রুই মাছ, করলা ভাজি; যাই পাও, তাই খাও। পাটশলার দাউ দাউ আগুনে সব রান্না জ্বলে জ্বলে খাঁটি হয়। অমৃতের মতন সেই স্বাদ। পুকুর জলে ডুব দিয় টক বড়ই মুখে দিলে পরেও সেই স্বাদ যায়না। জ্বীভে লেগেই থাকে।

-কতবার হাত পুড়িয়েছিলি রে শিউলী?

- ন’বার

- যা ভাল লাগেনা তা জোর করে করেছিস কেন?

-জোর করিনি। তীব্র বাতাস এসে বললো, ‘করো’

হাওয়ার দুলে আগুনটা শরীরে এসে লাগলো। পুড়ে গেল! পুড়ে গেল, পুড়ে গেল। সব পুড়ে গেল।

-তুই তোর ফুপুর মতন কথা বলছিস। জাবর কাটছিস কেন?

-কেউ শোনে, কেউ শোনেনা। ফুপুর স্বামীও কি শুনেছিলেন? মাটির চুলোর ভেতর কবার পুড়েছিল সেই হাত?

-তোরতো ওভেন ছিল। কোথায় মাটির চুলা আর কোথায় ওভেন। তোর মনটা কোথায় ছিল, বলতো?

- বেলুন সুতোয় চড়ে সে উড়ছিল। দেশের পর দেশ ঘুড়ে ঘুড়ে, হাত পুড়ে, মন পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

-তোর মাথায় গোলমাল হয়েছে নাকি? কি সব আবোল তাবোল বকছিস!

- গোলমাল কেন হবে? তবে নগ্ন ছবি দেখলে পিপড়া বাসা বাঁধে। বমি বমি ভাব হয়। এ বাড়ীর কম্পিউটারটা বেশ পুরনো। মাদারবোর্ড প্রসেসর সবকিছুতেই গোলমাল। মাঝে মাঝেই পপ-আপ করে উল্টোপাল্টা ছবি আসে।

-বিয়ের আগে পুরুষগুলো এক আধটু এরম হয় বোধহয়। এই নিয়ে এত ধরলে চলে?

-আমি কিছু ধরিনি। জীবনকে ধরেছে ভয়। কেন এতটা একঘেয়ে সেইটি বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকায় দোষী এবং পাপবিদ্ধ মানুষ আমি।

- সংসারে থাকলে একটু আধটু দোষ ত্রুটি হয়। আর স্বামীদের ত্রুটি বলা যায়না, সংসার নষ্ট হয়। সন্তান নষ্ট হয়।

- ‘অতঃপর ফলন চিন্তায় প্রভাবিত হইয়া তাহাদিগরা স্ত্রী লোকটিকে ক্রমাগত জোর করিতে লাগিলেন’।

- কি বলিস এইসব?

-এটা ‘একটা মেয়ের শরীর’ না হলে ভাল হতো। পুরুষ যদি সন্তান ধারন করতে পারতো তাহলে তাকেই বলা যেত, ‘কাজটা তুমিই করো। একাজটা আমার ভাল লাগেনা।

-তোর সত্যিই মাথাটা গ্যাছে। ডাক্তার দেখিয়েছিস?

-কারো শরীর এবং মন যদি স্বাধীনতা চায় তাতে দোষের কি কিছু আছে? তোমরা মেয়েরাও ঘ্যানঘ্যানে শ্যাওলা জাতীয় অপরিষ্কার।

-তুই কি হাড়িটা বুঝিস! গর্ধভ কোথাকার!


ডিমচাঁদ ভার হয়ে ঝুলে পড়ে। কথামালার লাল-নীল সুর এলোমেলো উড়তে থাকে।

ছেলেটি নামাজে বসে কলেমা পড়ে।

মেয়েটি কলার ভেলায় চড়ে পুকুরে ভাসে।

ছেলেটি সুরা ইখলাস বারবার পড়তে পড়তে থেমে যায়।

মেয়েটি কচুরীপানায় গুনে গুনে বড়ইয়ের বিচি ফেলে।

ছেলেটা আত্তাহিয়াদু তরজমা করে বাতাসে ফুঁ দেয়।

মেয়েটা এক পাটি বাদামী জুতো ভেসে যেতে দেখে থমকে তাকায়।


এইতো আর কটা দিন পর সে বাড়ী যাবে।

আহা, মেয়েটির কণ্ঠে হারিয়ে যাবে কলেমার বাহার।




১৪/৯/২০১৫


লেখক পরিচিতি
মৌসুমী কাদের
টরেন্টো, কানাডা।

কবি। গল্পকার। গ্রবন্ধকার। সুরকার। গায়িকা। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ একটা গল্প! এক পাটি বাদামী জুতোর অপেক্ষা না ফুরোনো'র গল্পটাতে আবহমানতা'র ঝোঁক! গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হতে থাকে, একটা ক্ল্যাসিক সুর ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাজছে...... কলেমার বাহার হারিয়ে যাবে, মেয়েটা বাড়ি ফিরবে - কেননা এক পাটি বাদামী জুতো কচুরীপানার সাথে পানিতে তার অপেক্ষায় এখনো ভাসমান।

    উত্তরমুছুন