দীপেন ভট্টাচার্যের ২০১৫ সালে পড়া গল্পের সালতামামি

দীপেন ভট্টাচার্য  এ সময়ের অন্যতম সেরা লেখক। পেশায় বিজ্ঞানী। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী। বিশ্বসাহিত্যের মগ্নপাঠক।চিন্তার দিক থেকে তিনি অগ্রসর। গল্পকার হিসেবে ইউনিক। এ-সময়ের গল্পকে কিভাবে দেখা হয়, কিরকম গল্প হওয়া দরকার তার একটি স্পষ্ট-সহজ-সুন্দর ভাষ্য দীপেন ভট্টাচার্য লিখেছেন। এ-লেখাটি এ সময়ের সকল গল্পকার-পাঠকের জন্য অবশ্যপাঠ হয়ে উঠেছে।
-----------------------------------------------------------------
গল্পপাঠ : ১. 
২০১৫ সালে কত সংখ্যক গল্প পড়েছেন?


দীপেন ভট্টাচার্য : ১

ক'টা গল্প পড়েছি এটা বলা মুশকিল। কয়েকটা উপন্যাস শুরু করেছিলাম, দুটো শেষ হয়েছে, বাকিগুলো হয় নি। গল্পের সংখ্যা ২৫/৩০টা মতন হবে।


গল্পপাঠ : ২. 
কোন কোন মাধ্যম থেকে গল্পগুলো পড়েছেন?

দীপেন ভট্টাচার্য : ২
ছাপানো বই ও ইন্টারনেট দুটোই ব্যবহার করেছি। 


গল্পপাঠ : ৩. 
কোন কোন গল্পকারের গল্প পড়েছেন?


দীপেন ভট্টাচার্য : ৩
সব নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। নবারুণ ভট্টাচার্য, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, শামীম আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, স্বকৃত নোমান, কুলদা রায়, জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা, রুমা মোদক, অমর মিত্র, ফাদার দ্যতিয়েনের গদ্যসংগ্রহ থেকে কিছু অংশ, Ernest Hemingway এর The Sun Also Rises, Ruth Ozekiর A Tale for the Time Being, Graemie Simsonয়ের The Rosie Project, রুশ গল্পকার ভিক্টর পেলেভিন। ইংরেজীতে যা পড়েছি সেগুলো ছোট গল্প নয়।



গল্পপাঠ : ৪. 
এর মধ্যে ভালো লাগার গল্পগুলোর কয়েকটি নাম করুন। গল্পগুলো ভালো হয়ে উঠেছে কি কি কারণে সেগুলো উল্লেখ করুন।

দীপেন ভট্টাচার্য : ৪
লেখক নিজের জন্য লেখেন, পাঠকের জন্যও লেখেন। যখন এই দুটি উদ্দেশ্য এক হয় তখন লেখাটি থেকে পাঠকেরা আনন্দ পান। আমি গল্পকারের কাছে এমন কিছু চাই যা আমার ভাবনার মধ্যে ছিল না, সেটা হতে পারে ভাষার ব্যবহার, খুব কৌতূহলোদ্দীপক বাক্য গঠন যেখানে প্রতিটি বাক্যকে আস্বাদন করে পড়তে হবে, কিংবা এমন একটি কাহিনীর ছক যাকে আমি আগে থেকে নির্দিষ্ট করতে পারব না। অন্যদিকে পাঠককেও লেখককে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সাহিত্য পড়াতেও এক ধরণের ট্রেনিং দরকার। সেই অনুশীলন ছাড়া পাঠকের জন্য ভাল গল্প বিস্বাদ হতে পারে। 

অনেক গল্প ভাল লেগেছে, সব ক'টার নাম দিতে পারছি না। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্প চক্ষুদান, নবারুণ ভট্টাচার্যের রেবন্তের স্ববধবিলাস, শামীম আহমেদের সোলেনামা মনে করতে পারছি, এছাড়া আরও অনেকের গল্পই ভাল লেগেছে। ভিক্টর পেলেভিনের ওমন রা ও কুলদা রায়ের কোমল পুষ্প নিয়ে নিচে আলোচনা করছি।


গল্পপাঠ : ৫. 
সেরা গল্পটি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ বলুন।

দীপেন ভট্টাচার্য : ৫
সেরা গল্প কোনটা বলা কঠিন, বিশেষতঃ আমি যখন বেশি গল্প পড়ি নি। এখানে রুশ লেখক ভিক্টর পেলেভিনের একটি বড় গল্পের কথা বলি। এটি সেরা কিনা জানি না, কিন্তু এর অ্যাবসার্ডিটি বা এক ধরণের চরম কারণহীনতা আমাকে ভাবিয়েছে। এটির নাম হল ওমন রা (Omon Ra)। গল্পটি সোভিয়েত মহাশূন্য প্রোগ্রামের ওপর একটি স্যাটায়ার, সময়কালটা ১৯৫০-এর শেষ থেকে ১৯৭০/৮০-র দশক পর্যন্ত বিস্তৃত, কিন্তু সেটা নির্দিষ্ট করা নয়, ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ঘটনা একই সময়ে সংঘঠিত হচ্ছে। 

গল্পের মূল প্রটাগনিস্ট ওমন রা (তার আসল নাম ওমন কিরোমাজভ) কিশোর বয়স থেকে স্বপ্ন দেখে রকেটে চেপে মহাশূন্যে যাবার, সে সুযোগও পায় এরকম একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে, কিন্তু তাকে বলা হয় চাঁদে যেসব স্বয়ংক্রিয় যান পাঠানো হয় সেগুলো স্বয়ংক্রিয় নয়, এমন কি রকেটের বিভিন্ন ধাপের অনুক্রমিক কার্যপ্রণালীগুলো যেগুলোকে আমরা স্বয়ংক্রিয় বলে জানি সেগুলোও লুকানো মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়। এগুলো করতে গিয়ে সেই মানুষরা মারা যায়, কিন্তু তাদের বলা হয় দেশের জন্য, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই আত্মত্যাগের প্রয়োজন আছে যদিও বাইরের বিশ্ব সেটা জানবে না। 

অবশেষে ওমনকে চাঁদে পাঠান হল, কিন্তু তাঁর পরিচ্ছদ মহাশূন্য যাত্রায় যা দরকার সেরকম ছিল না। সে শুনতে পেল তাঁর বন্ধুরা কেমন করে রকেটের বিভিন্ন ধাপ শুরু করতে করতে মারা যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে এই শেষ কথোপকথনগুলি দার্শনিক, কিছু তৎকালীন রুশ পপ-সংস্কৃতি সংক্রান্ত। চাঁদে পৌঁছে ওমনের কাজ ছিল স্বয়ংক্রিয় যানের একটা অ্যানটেনা পৃথিবীর দিকে তাক করে ঠিকমত বসান। তারপর নিজেকে গুলি করে মেরে ফেলা। কিন্তু তার বন্দুক যখন কাজ করল না, দেখা গেল অন্য কেউ তাকে মারতে এল। পালাতে গিয়ে ওমন আবিষ্কার করল সে চাঁদে নয় পৃথিবীতেই এক বিরাট স্টুডিওতে। সেখানে মহাশূন্যযান ইত্যাদির বিরাট বিরাট মডেলে মহাকাশচারীরা টেলিভিশনের সামনে এমন অভিনয় করেছে যেন তারা পৃথিবীর কক্ষপথেই আছে। সবকিছুই সাজানো। শেষাবধি ওমন ঐ জায়গা থেকে একটা মেট্রো স্টেশনে বেরিয়ে আসে, একটা ট্রেনে উঠে সে মুক্তি পায়। 

এই কাহিনীতে অ্যাবসার্ড বলতে আমরা যা বুঝাই তার কয়েকটি স্তর আছে। সোভিয়েত স্থূল প্রপাগান্ডা- শান্তির জন্য মহাশূন্যের বিজয়-এর সমালোচনা বলতে যা বোঝায় সেটা আছে, কিন্তু সেটা মুখ্য নয়। এখানে বাস্তবতার সংজ্ঞা নিয়ে একটা ধাঁধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। পুরো জিনিসটাই যদি অভিনয় তাহলে ওমনদের কেন মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে? সবকিছুই যদি সাজানো তবে দেশের জন্য আত্মাহুতির কী অর্থ? আর যারা এই প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছে, যেমন ওমন, তারা কেন বুঝতে পারছে না যে তারা মহাশূন্যে নয়, পৃথিবীতেই আছে। স্বয়ংক্রিয় যান লুনাখোদকে ওমন কোনও একটা সাইকেলের মত চালাল, চাঁদের বায়ুশূন্য পরিবেশে কোনও প্রতিরক্ষামূলক পোষাক ছাড়াই। এটা যে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার সেটা নিয়ে বেশি চিন্তা না করে সে পূর্বনির্দেশমত আত্মহত্যা করার চেষ্টা করল। 

গল্পটি সোভিয়েত ব্যবস্থা নিয়ে একটি স্যাটায়ার। কিন্তু স্যাটায়ারটি অ্যাবসার্ড। মনকে এমনভাবে প্রভাবিত করা যায় যে বাস্তবতার মাইল ফলকগুলোকে আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি, তখন অ্যাবসার্ডের মধ্যে অ্যাবসার্ডকে আমরা চিনতে পারি না। তাই আমাদের নায়ক যে একটা খেলনা মহাশূন্যযানে চড়ে স্টুডিওর চাঁদে গিয়ে একটা খেলনা গাড়ি চালাচ্ছে সেটাও তার মাথায় আসছে না। এমন কি শেষাবধি সে যখন ভাবছিল সে বিদ্রোহ করবে, অ্যানটেনা বসাবে না, তখন তার মনে হল তার বন্ধুরা এই অভিযানের জন্য প্রাণ দিয়েছে, তাই তাকে শেষ কাজটা সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। পাঠক বুঝতে পারছেন সেই অ্যানটেনা কোনও কাজের নয়, একটা খেলনা মাত্র, কিন্তু এমন একটি (অর্থহীন) কাজের শেষে ওমনের মৃত্যুকে রাষ্ট্র মহান বলে (অর্থহীন) ঘোষণা দেবে যদিও সেই মৃত্যু সাধারণের অজ্ঞাত থাকবে। 

রুশ সাহিত্যে অ্যাবসার্ডের এরকম একটি ধারা আছে যা কিনা বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়, সেটা নিকোলাই গোগল আর মিখাইল বুলগাকভ থেকে আরম্ভ করে ভিক্টর পেলেভিন পর্যন্ত বিস্তৃত। অবশ্য এই ধরনের কাহিনী লিখতে লেখকের সমাজকে নির্দিষ্ট কারিগরী ও সামাজিক স্তরে পৌঁছাতে হবে।



গল্পপাঠ : ৬. 
আপনি কি মনে করেন- এই গল্পগুলো বাংলাদেশের চিরায়ত গল্পগুলোর সমতুল্য বা তাদেরকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে?

দীপেন ভট্টাচার্য : ৬
সাহিত্যের ব্যাপারে আমি একজন শিক্ষানবীশ। বিশ্বসাহিত্যের মানে কোনও গল্প উঠেছে কিনা সেটা বিচার করার ক্ষমতা আমার হয়তো নেই। তবে আমার মনে হয় আমরা কষ্ট করে কাহিনীর ছককে বিশ্বজনীন করে তুলি না, আমাদের গল্প হয়ে যায় একধরণের ডকুমেন্টারি- জীবন সংগ্রাম, শ্রেণী সংগ্রাম, ধর্মীয় বিভেদ, মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন ক্যাচাল। যেমন আমাদের গল্পকাররা দৈনন্দিন জীবনে আমাদের হিপোক্রিসির কথা বলেন, এটা নিশ্চয় একটা গুরুত্ব্পূর্ণ বিষয়, কিন্তু এর পরবর্তী ধাপটা কী হতে পারে সেই সংক্রান্ত নতুন আইডিয়া নিয়ে আসেন না। গল্পের একটা denouement দরকার, অর্থাৎ সব জট ছাড়িয়ে লেখক পাঠককে গল্পের যত রহস্য তার সমাধান বলবেন অথবা পুরোপুরি বলবেন না, ভাবতে বাধ্য করাবেন। গল্প শেষে পাঠক যদি বলে, "বাহ, উনি তো দারিদ্রকে খুব হৃদয়-মোচড়ানোভাবে বর্ণনা করেছেন" অথবা "উনি আমাদের হিপক্রিসিকে চরমভাবে তুলে ধরেছেন" সেটা নিশ্চয় ভাল, কিন্তু এটাই যদি গল্পের মূল কথা হয় তবে লেখক গল্পকার হন না, লেখক হন ডকুমেন্টারিয়ান। গল্পকে বিশ্বজনীন হতে হলে এর পরের ধাপে যেতে হবে। যে-লেখক জানেন পৃথিবীর সব মানুষকে কিভাবে ভাবাতে হয় তাঁর লেখা বিশ্বসাহিত্যে স্থান পায়।

রবীন্দ্রনাথের পরে মহাশ্বেতা দেবী মার্কিন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্বসাহিত্য সংগ্রহের অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। আমার মতে বিভূতিভূষণের আরণ্যকও বিশ্বসাহিত্যের অংশ।


গল্পপাঠ : ৭. 
বিদেশি গল্পের সঙ্গে এ গল্পগুলোর মানকে কীভাবে তুলনা করবেন?


দীপেন ভট্টাচার্য : ৭
এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। আমি হয়তো বিদেশী গল্পর সঙ্গে তুলনা করব না, বরং জিজ্ঞেস করব এই গল্পগুলো বিশ্বজনীন কিনা। তার আবেদন বিশ্বের পড়ুয়াদের কাছে গ্রাহ্য হবে কিনা? আমার পক্ষে এটার উত্তর দেয়া কঠিন। তারচেয়ে বরং আমি ভিক্টর পেলেভিনের গল্পটির সঙ্গে কুলদা রায়ের একটি গল্পের তুলনা করি, দেখি কুলদার গল্পটি বিশ্বজনীন কিনা। 

গল্পটির নাম হল কোমল পুষ্প। দুই বোন, এক দাদা, কষ্টের সংসার। ছোট মেয়ে মা'কে প্রশ্ন করে, হ্যাগো মা, আমাগো কি কেউ কোথাও নাই? মনের আনাচ-কানাচ খোঁজ করে মা বলে, তোগো গীতাদিদি আছে। এই গল্প হল এখন গীতাদিদির সন্ধানের অভিযান। গীতাদিদি যে তাদের কে সেটা তারা জানল না, পাঠকও জানতে পারে না। গীতাদির বাড়ি খালি হাতে যাওয়া যায় না। এদিকে এদের এবেলা-ওবেলা খাওয়ার ঠিক নেই। ছোটবোন দুটো পেয়ারা নেয়, মেজো বোন একটা অর্ধেক-বোনা পুঁতির মালা, বড় ভাই খুদ-কুড়া চাল, এক প্যাকেট গ্লুকোজ বিস্কুট। সাহাপাড়ায় গীতাদির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তারা গীতাদিকে ডাকতে সংকোচ বোধ করে, তারা ঠিক জানেও না এটা গীতাদির বাড়ি কিনা। 

অবশেষে "ছোটো বোনটি দাদার গা ঘেঁষে ডেকে উঠল, গীতাদি। গীতাদি। আমরা বেড়াইতি আইছি।" 

গীতাদির দেখা পাওয়া যায়, পর্দার আড়ালে তার মুখ, লিপস্টিক মাখছিল সে, চেনার চেষ্টা করছিল এই তিনটি ছেলেমেয়েকে। গীতাদি বলে, তোরা আইছিস। খুব ভাল হইছে। কিন্তু গীতা ওদের ভেতরে ডাকে না। বলে, আজ থাক। কাল আসিস। তোগো গোপালদার জন্য আমি রেডি হচ্ছি। 

ওরা জানালার মধ্যে দিয়েই বিস্কুটের প্যাকেটটা গীতাদিকে এগিয়ে দেয়। তারপর চলে আসে। ঘরের ভেতর থেকে গীতাদির গান শোনা যায়- -যাওরে ভ্রমর উড়িয়া। বাড়ি ফিরে মেজো বোন ঐ গানটি গায়। তাদের বাবা বলে গীতার মামার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, গীতা নাকি গত চারমাস ফরিদপুর আছে, তার বাচ্চা হবে। 

দাদা বলে, বুঝলি মেজো সাহাপাড়ার গীতাদি আমাগো গীতাদি নয়। উনি অন্য কেউ। আমাগো অচেনা মানুষ। মেজো বোন বলে, না। আমরা গীতাদির বাড়িই আজ বেড়াইতে গেছিলাম। 

এটাই গল্প, কিন্তু গল্পের বুনন একটা স্বপ্ন তৈরি করে। তিনটি শিশুর একজন স্বজনকে দেখতে যাবার আকুতি, সেই অচেনা স্বজনকে খুশি করবার হৃদয়বিদারক আন্তরিক প্রয়াস। এই গীতাদি যে তাদের গীতাদি নয় তা পাঠক বুঝতে পারছেন এবং নিরপেক্ষ দর্শক হিসেবে এই ঘটনাটিকে অ্যাবসার্ড বলে সংজ্ঞায়িত করছেন। গীতাও বলছে, তোরা এসেছিস। অর্থাৎ গীতাও এই অ্যাবসার্ড নাটকে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে দিল না, সে হয়তো গোপালের রক্ষিতা, কিংবা বেশ্যা, কিংবা নেহাতই প্রেমিকা, আমরা এসব জানি না, জানার প্রয়োজনও নেই। শেষাবধি ছেলেমেয়েরা সব জেনেও এই গীতাদিকে আসল গীতাদি বলে যেন প্রতিষ্ঠা করতে চাইল। 

আমার কাছে গল্পটির তিনটি দিক ভাল লেগেছে: 
এক.  এর অ্যাবসার্ড দিকটি যেটা ওপরে লিখছিলাম; 
দুই. গল্পকারের স্বপ্ন তৈরি করার ভাষা- "তার (ছোট বোনের) ডাক শুনে একটা রোয়া তোলা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। বাইদ্যা পট্টি থেকে কে একজন মুন্সীগঞ্জের ফেরীওয়ালা হেকে উঠলো, চাই ছিট কাপড়। একজন পাগলের ঠা ঠা করে হাসির শব্দ শোনা গেল বহূদূরে। আর একটা পাতা সড় সড় করে পড়ল- শিরিষের, অথবা আমের--জামের।" 
তিন. ঐ তিনটি কিশোর কিশোরীর সংবেদী মন যারা অত যত্ন করে গীতাদির জন্য উপহার জোগাড় করেছিল, যারা উৎসুক হয়েছিল তাকে দেখার জন্য। কুলদা এমন কয়েকটি ছোট মানুষের কথা বলছেন যাদের চেতনা, অনুভব করার ক্ষমতা শিশু/কিশোর কেন সাধারণ মানুষদের চাইতে বেশি। 

আরও একটা ব্যাপার আছে। আমরা দারিদ্রকে পুঁজি করে সুদে-আসলে তার থেকে গল্প আদায় করে নিতে চাই, আত্মবেদনায় মুষড়ে পড়ি। কুলদা সেটা করেন নি। দারিদ্র এই তিনটি শিশু কিশোরকে বিচলিত করতে পারে নি, তারা নিজেরা না খেয়ে তাদের লোভনীয় খাদ্য গীতাদির জন্য নিয়ে গেছে, আমার কাছে এটা হল মানুষের আত্মার বিজয়, স্পিরিটের বিজয়। সেই বিজয়কে পৃথিবীর অন্যান্য সংস্কৃতি বুঝবে। 

দুটো গল্প আলোচনা করলাম। একটি সাট্যায়ার, সোভিয়েত মহাকাশ প্রোগ্রামের প্রেক্ষাপটে, আর একটি গ্রামবাংলার একটি পরিবারের তিনটি কিশোর কিশোরীর এক স্বজনকে দেখার ঐকান্তিক ইচ্ছার আঙ্গিকে। দুটোর মাঝেই অ্যাবসার্ড বর্তমান। আমার কাছে দুটোর মধ্যেই এমন কিছু আছে যা স্থান-কাল-ভাষা ছাড়িয়ে অন্য সংস্কৃতির কাছে বোধগম্য হতে পারে। সেই বোধগম্যতাইএই গল্পদুটির সার্থকতা। 

অনেক পুরোনো বাংলা গল্পই এই বোধগম্যতা আনতে পেরেছে। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্তের একধরণের বেড়া-দেয়া সমাজ আমাদেরকে ডকুমেন্টারি করার দিকে বড় বেশি ঠেলে দিয়েছে, বোধগম্য চমক দেয়া কিন্তু গভীর সৃজনধারার গল্পের বদলে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ