সতীনাথ ভাদুড়ীকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্য : পূর্ণিয়া জেলার উইলিয়াম ফকনার

সতীনাথ ভাদুড়ীর 'ঢোঁড়াই চরিতমানস' যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন যে এই উপন্যাসখানি সন্ত তুলসীদাসের 'শ্রীরামচরিত মানস' এর আদলে লেখা। তুলসীদাসের গ্রন্থখানি অন্তত চার শতাব্দী ধরে সারা ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ। বাঙালিরা অবশ্য এ বইয়ের স্বাদ তেমন করে পায়নি, বাঙালিরা রামায়ণ পেয়েছে কৃত্তিবাস মারফত। প্রতিভার নিরিখে তুলসীদাস অনেকটা ঝাপসা পরিচয়ের, কৃত্তিবাসের চেয়ে বহুগুণ বড়। তুলসীদাসের ভাষাও খুব দুর্বোধ্য নয়, অনেকটা ব্রজবুলির মতন। হিন্দু বাঙালিরা রামকেও দেবতা হিসেবে তেমন উচ্চে স্থান দেয়নি, তাদের আরাধ্য কৃষ্ণ কিংবা শিব। তুলসীদাসের প্রভাবে সমগ্র হিন্দিভাষী অঞ্চলে রামই একমাত্র ভগবান। শুধু তাই নয়, ওই অঞ্চলের অক্ষর পরিচয়হীন সাধারণ মানুষও জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে রামচরিতমানসের কোনও না কোনও শ্লোক থেকে নির্দেশ খুঁজে পান।


তুলসীদাসের নায়ক রাম, সতীনাথের নায়ক ঢোঁড়াই। বিহারের পূর্ণিয়া অঞ্চলে ছোট শহরটির নাম জিরানিয়া, রামায়ণের জীর্ণারণ্যের সঙ্গে এর মিল কষ্ট কল্পনা করা যায়। তাঁর অদূরে তাৎমাটুলি। তাৎমারা কোনও এক কালে তাঁতি ছিল, এখন সে পেশা ভুলে গেছে, নিছক এটা সেটা করে একবেলা পেট ভরাবার মতন অন্নসংস্থান করে। মধ্যে একটা পাক্কি, অর্থাৎ পাকা রাস্তা, তাঁর ওপাশে মেথরদের বস্তি। এই দুই অন্ত্যজদের গ্রামই এই উপন্যাসের মূল পটভূমি। তাৎমাটুলির ছেলে ঢোঁড়াই অতি অল্প বয়েসে বাবাকে হারায়। তাঁর মা দ্বিতীয় বিয়ে করার সময়, ছেলেকে সঙ্গে রাখা সম্ভব নয় বলে তিন বছরের ঢোঁড়াইকে এক সাধুর পায়ের কাছে রেখে আসে। মহাকাব্যের নায়ক রামের সমান্তরালভাবে বেড়ে উঠতে থাকে এক অনাথ ঢোঁড়াই।

উপন্যাসের এই পরিকল্পনাটাই বিস্ময়কর।

বাঙালিদের কাছে বিহার খুবই পরিচিত। বহু বাঙালি এককালে ছড়িয়ে ছিল বিহারের সর্বত্র, যাতায়াতও অনবরত। বাংলা সাহিত্যে বিহারের কিছু কিছু ছবি পাওয়া গেছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায়। সে সবই আংশিক। বিহারের দরিদ্র, সাধারণ মানুষের কথা আছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যকে। খুবই উচ্চাঙ্গের বই নিঃসন্দেহে, কিন্তু বিভূতিভূষণ অতি রোমান্টিক, মানুষের চেয়েও প্রকৃতি তাঁর কাছে অনেক সময় প্রধান হয়ে ওঠে, তাঁর চক্ষু সব সময় সৌন্দর্যসন্ধানী। আরণ্যক-এর সঙ্গে ঢোঁড়াই চরিতমানসের কোনও তুলনাই চলে না।

অন্যান্য লেখকরা লেখেন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সতীনাথের যেন কোনও দৃষ্টিভঙ্গিই নেই। এমনকী তিনি যে বাঙালি লেখক, তাও কোথাও বোঝা যাবে না। অত্যন্ত কুশলতায় তিনি জিরানিয়া-তাৎমাটুলি-ধাঙড়টুলির যে জনজীবনের কথা লিখেছেন, তা যেন আপনা আপনি ফুটে উঠেছে, লেখকের কোনও ভূমিকাই নেই এখানে। ভাষাটা বাংলা বটে, কিন্তু চরিত্রগুলির সংলাপে, এমনকী বর্ণনাতেও অনর্গল দেহাতি হিন্দি শব্দ, তুলসীদাসের দোঁহার টুকরো ছড়ানো যে মনে হয়, সমগ্র উপন্যাসটি ওখানকার নিজস্ব ভাষাতেই রচিত। এই দক্ষতা তুলনাহীন, নিজেদের পরিচিত গণ্ডির বাইরের কথা যারা কিছুই জানে না, দেশ সম্পর্কে যাদের কোনও ধারণাই নেই, সেই রকম একটা তুচ্ছ অঞ্চলের মানুষের ওপর গাঁধীজী ও স্বদ্বেশী আন্দোলনের প্রভাব কীভাবে পড়তে পারে, তা সতীনাথের আগে আমাদের কেউ দেখাননি। এই মানুষগুলির অন্ন নেই, তবু একটা বিশেষ জীবনবোধ আছে, এমনকী সংস্কৃতিও আছে। সেই জন্যই উপন্যাসটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আঞ্চলিক হয়েও সর্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছে।

ঢোঁড়াই ছেলেটি দোষে-গুণে ভরা। একটি জীবন্ত চরিত্রকেই মডেল হিসেবে নিয়েছিলেন সতীনাথ। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে ছাপিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব পরিবেশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র অঞ্চলটি একটু একটু বদলাচ্ছে। অতি ধীর ও সূক্ষ্ম সেই পরিবর্তন, সম্পূর্ণ নাটকীয়তা বর্জিত। এখানে কোনও উচ্চ আদর্শ চাপিয়ে দেয়া হয়নি। ইচ্ছাপূরণেরও কোনও স্থান নেই, সেই জন্যই এই বর্ণনা অসাধারণ। লকলক করছে প্রখর বাস্তব, কিন্তু আদিখ্যেতা করা হয়নি দারিদ্র নিয়ে।

অনাথ ঢোঁড়াই এক সময় গোরুগাড়ির চালক হল। প্রথম খণ্ড শেষ হয়েছে তরুণ ঢোঁড়াইয়ের তার পচ্ছিমে স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদে। তুলসীদাস বলেছেন, যদিবা আরশির ওপর নিজের ছায়া ধরে রাখা সম্ভব, কিন্তু মেয়েদের মনের গতি জানা সম্ভব নয়। অত ভালবেসেও স্ত্রীর কেন মন পাওয়া গেল না, তা বুঝল না ঢোঁড়াই। রাগে-দুঃখে সে বিবাগী হয়ে গেল।

দ্বিতীয় খণ্ডে ঢোঁড়াই-এর অভিজ্ঞতার জগৎ আরও বিস্তৃত হয়। বিপ্লবী বা ক্রান্তিদলের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। রামায়ণ ছাড়াও অন্যান্য কেতাবের কথা সে শোনে। নতুন রামায়ণ আর পুরনো রামায়ণে জট পাকিয়ে যায় তার মনে।

এই উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ড বা পরপর আরও অনেক খণ্ড লেখার ইচ্ছে ছিল সতীনাথের। লিখলেন না, মধ্যপথে ছেড়ে দিলেন। প্রথম কারণ তাঁর অপূর্ণতাবোধ। তিনি ভেবেছিলেন, ঢোঁড়াইদের মতন মানুষদের চরিত্র মানস সরোবরের মতন বিশাল ও গভীর, সেটা তিনি ঠিক ফোটাতে পারছেন না। শিল্পী মাত্রেরই এ রকম অতৃপ্তি থাকে, আমাদের আফসোস, কেন তিনি আরও লিখলেন না।

না লেখার আরও একটি কারণ তিনি কৌতুকচ্ছলে জানিয়েছেন। ঠিক করেছিলেন, তৃতীয় খণ্ডে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ঢোঁড়াইদের মনের রূপরেখার পরিবর্তনও ধরে রাখবেন। সে খণ্ডের নাম দেবেন 'উত্তর ঢোঁড়াই চরিত'। সে পরিকল্পনা শিকেয় তুলে রাখলেন, তার কারণ, এই উপন্যাস বাংলার পাঠকরা ঠিক মতন গ্রহণ করেনি। বইটি বিক্রি হয়নি, প্রকাশক বেজার হয়েছিলেন। সতীনাথ ডায়েরিতে লিখেছেন, 'বইখানা যদি খুব বিক্রি হত, তাহলেও কি নায়কের চরিত্রের অপর্যাপ্ততার কথা তোমার মনে আসত? তা হলে কি তুমি, শুধু উত্তর ঢোঁড়াই চরিত কেন, উত্তরোত্তর ঢোঁড়াই চরিত পর্যন্ত লিখে চলতে না?

আমাদের অধীত বিদ্যার মধ্যে উইলিয়াম ফকনারের কথা বিশেষ মনে পড়ে এই উপন্যাস প্রসঙ্গে। সতীনাথ ভাদুড়ী আজীবন পূর্ণিয়াতেই কাটিয়ে গেলেন। সেখানকার পারিপার্শ্বিকের যে-সমস্ত মানুষজন তিনি দেখেছেন, তাঁদেরকথাই বেশি লিখে গেছেন। ফকনারেরও একটা নিজস্ব অঞ্চল ছিল। নিজের বাসস্থানের কুড়ি মেইল গণ্ডির মানুষজন, সাদা, কালো বা লাল, তাদের কথাই তিনি ফুতিয়ে তুলেছেন একের পর এক উপন্যাসে। ফকনারের সেই অঞ্চলটির নাম 'ইয়োকনাপাটাওফা কাউণ্টি', (Yoknapatawpha County), যার ভিত্তিতে 'স্যারকুচয়ারি', 'লাইট ইন অগাস্ট', 'দা আনভ্যাংকুইশড', 'দা হ্যামলেট', 'গো ডাউন মোমেজ' প্রভৃতি উপন্যাস লেখেন। আঞ্চলিক হয়েও সেগুলি সর্বজনীন।

ফকনার নোবেল পুরস্কার পেয়ছিলেন। যে-সব উপন্যাসের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, তার অনেকগুলিই তো আমরা পড়ে দেখি। সেই মানদণ্ডে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলার একাধিক লেখক নোবেল পুরস্কার অনেক আগেই পেতে পারতেন। 'ঢোঁড়াই চরিতমানস' অবশ্যই সে রকম পুরস্কারের যোগ্য। নোবেল কমিটির দুর্ভাগ্য, তাঁরা এরকম রচনার সন্ধান পান না।

ফকনারের সঙ্গে তুলনাটা আরও কিছুদূর টানা যায়। ফকনার বুদ্ধিজীবীদের কাছে বাহবা পেলেও জনপ্রিয় হননি। জীবনের একটা সময় তাঁর বই বিক্রি খুবই কমে যায়, প্রকাশকরাও বিমুখ হন, চল্লিশের দশকের গোড়ায় ফকনার প্রায় বিস্মৃত, একটিমাত্র বই ছাড়া আর কোনও বইই পাওয়া যেত না। ফকনারের সৌভাগ্য, জীবদ্দশাতেই তিনি পুনরাবিষ্কৃত হন, রবার্ট পেন ওয়ারেন-এর মতন তরুণ লেখকরা তাঁর বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন, যার ফলে র‍্যান্ডম হাউজের মতন বড় প্রকাশক আকৃষ্ট হয়ে পুরনো বইগুলি ছাপতে শুরু করে আবার, পুরস্কারও আসতে থাকে একে একে।

সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম উপন্যাস, 'জাগরী'র জন্যই রবীন্দ্র পুরস্কার পান, অনেক মান্য সমালোচকের প্রশস্তিও পেয়েছেন, কিন্তু সে রকম জনপ্রিয়তা কখনও পাননি, বেঁচে থাকতে থাকতেই তা আরও কমতে থাকে। মৃত্যুর কিছুদিন পরেই তিনি যেন বিস্মৃত লেখকের পর্যায়ে চলে যান, তাঁর বইগুলিও দুর্লভ হয়ে পড়ে। 'ঢোঁড়াই চরিতমানস' আর ছাপা হয়নি। তাঁর মৃত্যু ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে।

১৯৭২ সালে সনাতন পাঠক নামে এক তরুণ কলমনবীশ সতীনাথ ভাদুড়ীর বইগুলির অপ্রাপ্যতা বিষয়ে আক্ষেপ করে একাধিকবার লিখেছেন এই 'দেশ' পত্রিকায়। তিনি এই পত্রিকায় তখন নিয়মিত সাহিত্য সংবাদ লিখতেন। তখন সতীনাথের দাদা ভূতনাথ ভাদুড়ী উক্ত সনাতন পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বইগুলি পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করতে চান। কোনও বড় প্রকাশক আগ্রহী হননি, তবে সনাতন পাঠকের প্ররোচনায় আকৃষ্ট হন অরুণা প্রকাশনী। অচিরকালের মধ্যেই শঙ্খ ঘোষ ও নির্মাল্য আচার্যের অতি সযত্ন ও সুযোগ্য সম্পাদনায় এবং সুমুদ্রিতভাবে সতীনাথ ভাদুড়ীর সমগ্র রচনাবলী প্রকাশিত হয় চার খণ্ডে। সেই রচনাবলীই এখনও সুলভ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. আমাদের দুর্ভাগ্য শুধু নয়, সাগরপ্রমাণ অজ্ঞতা এমন রচনা পড়ে না। ঢোঁড়াই চরিত মানস পড়ে চমকে উঠেছিলাম। এক পটভূমিতে আরণ্যক যেখানে প্রকৃতির পূজক, মানুষ সে পুজোর উপচার মাত্র, ঢোঁড়াই সেখানে মানুষের কথা বলে। বিচিত্র এক দেশের প্রান্তিক মানুষের জীবন ও দর্শনের কথা বলে। সেখানে মানুষ পূজ্য। রামের মতো। প্রকৃতি উপচার মাত্র।

    উত্তরমুছুন