তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও কর্মের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলা ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক, বিশেষ করে ভাষা-আন্দোলনের সূত্র ধরে অভ্যুদয় হওয়া বাংলাদেশের জন্য। কারণ ‘গণমাধ্যমকর্মী, কারিগর, প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীসহ সকল পেশা ও মননজীবী যখন তাঁদের চিন্তা-চেতনার অন্যতম বাহন হিসেবে মাতৃভাষাকে গ্রহণ করেন তখন সেই ভাষার শক্তি ও সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং নিরলস ও উদ্ভাবনাময় অনুশীলনে উন্মোচিত হয় তার নতুন নতুন দিগন্ত।’১ বাংলা ভাষা ব্যবহারের যতই ক্ষেত্র বাড়ছে ততই বাড়ছে অপপ্রয়োগ ও অসতর্কতা। দৈনন্দিন ব্যবহারে এ ভাষার অশুদ্ধি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
সংক্রামক ব্যাধি যেমন একজন থেকে বহুজনের মধ্যে সংক্রমিত হয়, বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগও একইভাবে একজন থেকে অনেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সাহিত্যকর্ম, বিজ্ঞাপন, সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশন, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম, সাইনবোর্ড, পোস্টার, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদিতে বাংলা ভাষার অশুদ্ধি ও অপপ্রয়োগ ঘটছে প্রতিনিয়ত।
শব্দের ব্যুৎপত্তি ও উচ্চারণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাবেই প্রধানত বানান ভুল হয়ে থাকে।২ এছাড়া ব্যাকরণের নিয়মকানুন না জানার কারণেও ভাষার অপপ্রয়োগ হয়। অপ্রয়োগের ক্ষেত্রগুলো নিম্নরূপ :
বিশেষ্য পদের দ্বিত্বজনিত অপ্রয়োগ
মূল শব্দ যদি বিশেষ্য হয় এবং তার সাথে যদি আবারও বিশেষ্যবাচক তা, ত্ব প্রত্যয় যুক্ত করা হয় তবে অপপ্রয়োগজনিত ভুল হয়। যেমন―অপকর্ষতা (হবে অপকর্ষ), অপ্রতুলতা (অপ্রতুল) উৎকর্ষতা (উৎকর্ষ), কৃচ্ছ্রতা (কৃচ্ছ্র), মৌনতা (মৌন), প্রসারতা (প্রসার), ঐক্যতা (ঐক্য), কার্পণ্যতা (কার্পণ্য), গাম্ভীর্যতা (গাম্ভীর্য), দৈন্যতা (দৈন্য), দারিদ্রতা (দারিদ্র্য/দরিদ্রতা), বাহুল্যতা (বাহুল্য), মাধুর্যতা (মাধুর্য), সখ্যতা (সখ্য), সৌজন্যতা (সৌজন্য)।
বিশেষণ পদের দ্বিত্বজনিত অপপ্রয়োগ
বিশেষণ পদের সঙ্গে বিভ্রান্তিবশত পুনরায় বিশেষণবাচক উপসর্গ বা প্রত্যয় যোগ করার ফলে কিছু কিছু ভুল শব্দ গঠিত হয়।৩ যথা―সচেষ্টিত (হবে চেষ্টিত/সচেষ্ট), মার্কিনী (মার্কিন), সবিনয়পূর্বক (সবিনয়ে/বিনয়পূর্বক), সলজ্জিত (সলজ্জ/লজ্জিত), সশঙ্কিত (সশঙ্ক/শঙ্কিত), সানন্দিত (সানন্দ)।
উৎকর্ষবাচক প্রত্যয়ের অপপ্রয়োগ
বাংলা ভাষার বহু গুণবাচক শব্দ আছে। যেগুলোতে উৎকর্ষ বোঝাতে ‘ইষ্ঠ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়। যথা―কনিষ্ঠ, গরিষ্ঠ, জ্যেষ্ঠ, পাপিষ্ঠ, বলিষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ প্রভৃতি। এ জাতীয় শব্দের সঙ্গে অজ্ঞতাবশত কখনও কখনও ‘তর’ এবং ‘তম’ প্রত্যয় ব্যবহার করা হয়। একে উৎকর্ষবাচক প্রত্যয়ের অপপ্রয়োগ বলে। যেমন―কনিষ্ঠতম/কনিষ্ঠতর,শ্রেষ্ঠতম/ শ্রেষ্ঠতর, বলিষ্ঠতম/বলিষ্ঠতর ইত্যাদি।
সমার্থ শব্দের বাহুল্যজনিত অপপ্রয়োগ
বাংলা ভাষায় অসংখ্য শব্দ প্রচলিত আছে যেগুলোতে সমার্থবোধক একাধিক শব্দের প্রয়োগ-বাহুল্য লক্ষ করা যায়। এ জাতীয় প্রয়োগ ব্যাকরণসিদ্ধ নয়। যথা―অদ্যপিও (অদ্যপি), অশ্রুজল (অশ্রু), আয়ত্তাধীন (আয়ত্ত/অধীন), কেবলমাত্র (কেবল/মাত্র), বিবিধপ্রকার (বিবিধ), শুধুমাত্র (শুধু/মাত্র), সমূলসহ (সমূল/মূলসহ), সময়কাল (সময়/কাল), সুস্বাগত (স্বাগত), সুস্বাস্থ্য (স্বাস্থ্য) ইত্যাদি।
সন্ধি-ঘটিত অপপ্রয়োগ
সন্ধি-ঘটিত অপ্রয়োগের কারণে অনেক ক্ষেত্রে বানান ভুল হয়। যেমন―জ্যোতীন্দ্র (জ্যোতিঃ + ইন্দ্র = জ্যোতিরিন্দ্র), শরদেন্দু (শরৎ + ইন্দু = শরদিন্দু), জগৎবন্ধু (জগৎ + বন্ধু = জগদ্বন্ধু), মনমোহন (মনঃ + মোহন = মনোমোহন), বাগেশ্বরী (বাক্ + ঈশ্বরী = বাগীশ্বরী), দুরাবস্থা (দুরবস্থা), পৃথকন্ন (পৃথগন্ন), তরুছায়া (তরুচ্ছায়া), মুখছবি (মুখচ্ছবি), উপরোক্ত (উপর্যুক্ত), উপরিপরি (উপর্যুপরি), প্রাতঃরাশ (প্রাতরাশ) ইত্যাদি।
লিঙ্গজনিত অপপ্রয়োগ
লিঙ্গজনিত অপপ্রয়োগের কারণে বানানে ভুল হয়। যেমন―অভাগিনী (হবে অভাগী), বন্দিনী (বন্দী), অর্ধাঙ্গিনী (অর্ধাঙ্গী), রজকিনী (রজকী), চাতকিনী (চাতকী), অনাথিনী (অনাথা), সুকেশিনী (সুকেশা), অপ্সরী (অপ্সরা), পিশাচিনী (পিশাচী), ভুজঙ্গিনী (ভুজঙ্গা), বিহঙ্গিনী (বিহঙ্গী), দিগম্বরী (দিগম্বরা)।
সমাস-ঘটিত অপপ্রয়োগ
সমাস-ঘটিত অপপ্রয়োগের কারণে বানানভুল হয়। যেমন―রাজাগণ (শুদ্ধ রাজগণ), সুকেশিনী (সুকেশা/সুকেশী), সুলোচনী (সুলোচনা), মৃগনয়নী (মৃগনয়না), সশঙ্কিত (শঙ্কিত), নিষ্পাপী (নিষ্পাপ), নিরপরাধী (নিরপরাধ)।
প্রত্যয়জনিত অপপ্রয়োগ
প্রত্যয়ের অপপ্রয়োগের কারণে বানানভুল হয়। যথা―অধীনস্থ (হবে অধীন), আবশ্যকীয় (আবশ্যক), উদ্বেলিত (উদ্বেল), একত্রিত (একত্র), জ্ঞানমান (জ্ঞানবান), দৌরাত্ম (দৌরাত্ম্য), বাহ্যিক (বাহ্য), বিবাদমান (বিবদমান), বৈচিত্র (বৈচিত্র্য), সত্বা (সত্তা), স্বত্ত্ব (স্বত্ব), স্বাতন্ত্র (স্বাতন্ত্র্য)।
বচনের অপপ্রয়োগ
বাংলা ভাষায় বিশেষণ দ্বারা অসংখ্য শব্দের বহুত্ব নির্দেশ করা হয়। এ জাতীয় শব্দের পরে বহুবচনের বিভক্তি অথবা গণ, বৃন্দ ইত্যাদি পদ ব্যবহৃত হয় না। যেমন :
অশুদ্ধ→ শুদ্ধ
সকল পরীক্ষকগণ→ সকল পরীক্ষক
সব মাছগুলো→ সব মাছ/মাছগুলো
যেসব ছাত্ররা→ যেসব ছাত্র/ছাত্ররা
সকল বালকেরা→ সকল বালক/বালকেরা
অন্বয়ের অপপ্রয়োগজনিত অশুদ্ধি
অন্বয়ের অপপ্রয়োগের কারণে অশুদ্ধ বাক্য তৈরি হয়। যেমন :
অশুদ্ধ―অদ্য সভায় মহতী অধিবেশন হইবে।
শুদ্ধ―অদ্য মহতী সভার অধিবেশন হইবে।
অশুদ্ধ―এই স্কুলে যে কয়জন শিক্ষক আছেন, তাঁহার মধ্যে জলিলই শ্রেষ্ঠ।
শুদ্ধ―এই স্কুলে যে কয়জন শিক্ষক আছেন, তাঁহাদের মধ্যে জলিল সাহেবই শ্রেষ্ঠ।
অশুদ্ধ―তিনি অফিসে উপস্থিত ও উপবেশন মাত্র চলিয়া গেলেন।
শুদ্ধ―তিনি অফিসে উপস্থিত হইলেন ও উপবেশন মাত্রই চলিয়া গেলেন।
অর্থ-সামঞ্জস্যহীন পদের অপপ্রয়োগ
অনেক সময় বাক্যের মধ্যে এমনভাবে শব্দ ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ-সঙ্গতি থাকে না। যথা :
অশুদ্ধ―ছেলেটি ভয়ানক মেধাবী।
শুদ্ধ―ছেলেটি অত্যন্ত মেধাবী।
অশুদ্ধ―অধ্যাপনই ছাত্রদের তপস্যা।
শুদ্ধ―অধ্যয়নই ছাত্রদের তপস্যা।
অশুদ্ধ―আমরা উন্নতির পথে কুঠারাঘাত করছি।
শুদ্ধ―আমরা উন্নতির মূলে কুঠারাঘাত করছি।
অর্থ-সামঞ্জস্যহীন বাক্যের অপপ্রয়োগ
অর্থ-সামঞ্জস্যহীন পদের অপপ্রয়োগ যেমন আছে তেমনি অর্থ-সামঞ্জস্যহীন বাক্যেরও অপপ্রয়োগ লক্ষ করা যায়। যথা :
অশুদ্ধ―শুধুমাত্র গায়ের জোরে কাজ হয় না।
শুদ্ধ―শুধু গায়ের জোরে কাজ হয় না।
অশুদ্ধ―ছেলেটি বংশের মাথায় চুনকালি দিল।
শুদ্ধ―ছেলেটি বংশের মুখে চুনকালি দিল।
অশুদ্ধ―কথাটা শুনে তিনি কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করলেন।
শুদ্ধ―কথাটা শুনে তিনি কপটাশ্রু বিসর্জন করলেন।
উপর্যুক্ত উদাহরণগুলো থেকে পরিষ্কার হল যে, অপপ্রয়োগের ক্ষেত্র বিস্তৃত এবং কারণ বহুবিধ। এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কিছু উপায় আছে। এ ক্ষেত্রে ‘শব্দ প্রয়োগের নিয়ম জানা থাকলে অপপ্রয়োগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।’৪ যেমন :
অতিক্রম/অতিক্রান্ত
অতিক্রম অর্থ―লঙ্ঘন করা বা পার হওয়া, অতিক্রান্ত অর্থ―লঙ্ঘিত, অতীত বা গত। অতিক্রম-এর সাথে করা এবং অতিক্রান্ত-এর সাথে হওয়া ক্রিয়াপদ যুক্ত করতে হবে। যেমন―অনেক রাস্তা অতিক্রম করে এসেছি। অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।
অত্র যত্র তত্র
শব্দ তিনটির অর্থ―এখানে, যেখানে, সেখানে। কিন্তু ‘এই’ বোঝাতে ব্যাপকভাবে ‘অত্র’ শব্দটির অপপ্রয়োগ করা হয়। যেমন―‘অত্র কলেজ’, ‘অত্র এলাকা’, ‘অত্র অফিস’। এর পরিবর্তে লিখতে হবে―‘এই কলেজ’, ‘এই এলাকা, ‘এই অফিস’।
অনুগত/বাধ্যগত
‘বাধ্যগত’ শব্দটি ভুল। তবে আবেদনপত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। অনুগমন (অর্থাৎ অনুগমন করেন যিনি) থেকে অনুগামী বা অনুগত শব্দের উৎপত্তি হলেও বাধ্যগমন থেকে বাধ্যগামী বা বাধ্যগত হতে পারে না। তাই বাধ্যগত না লিখে লিখতে হবে অনুগত।
অর্থনৈতিক/রাজনৈতিক/কূটনৈতিক
অর্থ থেকে আর্থিক, রাজনীতি থেকে রাজনীতিক, বর্ষ থেকে বার্ষিক, কূটনীতি থেকে কূটনীতিক। কিন্তু অশুদ্ধরূপে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক। এগুলোর সঙ্গে নীতির প্রশ্ন জড়িত, নৈতিকতার নয়। তাই শুদ্ধরূপ হল― আর্থনীতিক, রাজনীতিক, কূটনীতিক।
অধস্তন/অধঃস্তন
অধস্তন অর্থ―নিম্নপদস্থ, অন্যদিকে অধঃস্তন অর্থ―নিম্নস্থ স্তন বা নিচের স্তন। তাই প্রয়োগে সাবধান থাকতে হবে। অধস্তন-এর স্থলে অধঃস্তন ব্যবহার করলে বিপদ অনিবার্য।
অশ্রু/অশ্রুজল
অশ্রু অর্থ চোখের জল। তাই চোখের জল অর্থে অশ্রুজল ব্যবহার অসিদ্ধ। ব্যবহার করতে হবে অশ্রু।
আকণ্ঠ/আকণ্ঠ পর্যন্ত
‘আকণ্ঠ’ শব্দের অর্থ কণ্ঠ পর্যন্ত। তাই আকণ্ঠের পর পর্যন্ত লেখা বা বলা উচিত নয়। লিখতে হবে কণ্ঠ পর্যন্ত বা আকণ্ঠ।
আয়ত্ত/আয়ত্তাধীন
আয়ত্ত শব্দের অর্থ অধীন। সেজন্য আয়ত্তের পর অধীন ব্যবহার করা যাবে না। কেবল আয়ত্ত শব্দটি লিখলেই অর্থ পরিষ্কার হয়।
ইদানীং/ইদানীংকাল
ইদানীং অর্থ বর্তমান কাল, তাই এর সঙ্গে কাল যোগ করা বাহুল্য। শুধু ইদানীং লিখলেই যথার্থ অর্থ পাওয়া যায়।
উদ্দেশ/উদ্দেশ্য
শব্দ দুটি ব্যবহারে অনেক সময় বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। উদ্দেশ শব্দের অর্থ―গন্তব্য, খোঁজ ইত্যাদি। যেমন―নির্ঝর নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছে। অন্যদিকে, উদ্দেশ্য শব্দের অর্থ―অভিপ্রায়, মতলব, তাৎপর্য, প্রয়োজন ইত্যাদি। যেমন―নীলকরদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনা করেছিলেন।
উল্লিখিত/উল্লেখিত
‘উল্লেখিত’ শব্দটি ব্যাকরণসিদ্ধ নয়। অভিধানেও নেই। শুদ্ধ শব্দটি হল উল্লিখিত । শব্দটি সন্ধির নিয়মে গঠিত। উল্লিখিত (উৎ + লিখিত) শব্দের অর্থ―উপরে, পূর্বে বা আগে লিখিত (উৎ অর্থ― ‘ওপরে, আগে, পূর্বে’; লিখিত অর্থ―‘যা লেখা হয়েছে।’)। তাই, উপরে উল্লিখিত, উপরোল্লিখিত বা পূর্বোল্লিখিত প্রয়োগ অশুদ্ধ।
কর্তৃপক্ষগণ
কর্তৃপক্ষ শব্দটি বহুবচনবাচক। এর অর্থ পরিচালকগণ, শাসকগণ। তাই এর সঙ্গে ‘গণ’ প্রয়োগ অশুদ্ধ।
কার্যকর/কার্যকরী
কার্যকর অর্থ উপযোগী বা ফলদায়ক। এ-শব্দে ঈ-কার প্রয়োগ বাহুল্য-দোষেদুষ্ট। লিখতে হবে কার্যকর।
কৃতদাস/ক্রীতদাস
‘কৃতদাস’ শব্দের অর্থ―দাসত্বে আবদ্ধ, অন্যদিকে ক্রীতদাস হল―দাসরূপে ক্রয় করা ব্যক্তি। লেখার সময় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন―একসময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রীতদাস প্রথা চালু ছিল।
কৃতী/কৃতি
‘কৃতী’ অর্থ―কৃতিত্ব অর্জনকারী ব্যক্তি। এটি একটি বিশেষণ পদ। অন্যদিকে ‘কৃতি’ হচ্ছে কৃতিত্ব অর্জনকারী ব্যক্তির কর্ম। যেমন―নজরুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতি ‘অগ্নিবীণা’ কাব্য।
গড্ডলিকা/গড্ডালিকা
গড্ডলিকা শব্দের অর্থ ভেড়ার মতো অন্ধ অনুকরণ। কেউ কেউ গড্ডালিকা লিখে থাকেন―এটা ভুলপ্রয়োগ। শুদ্ধ হবে গড্ডলিকা। যেমন―যদি গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাও, তবে পরীক্ষার ফলাফল ভাল হবে না।
চলাকালীন সময়/থাকাকালীন সময়/তৎকালীন সময়
‘কাল’ শব্দের বিশেষণ হল ‘কালীন’; এর অর্থ সময়। চলাকালীন শব্দের অর্থ―চলার সময়ে বা চালু থাকা কালে। তাই চলাকালীন, থাকাকালীন ও তৎকালীন-এর পর সময় লেখা হলে তা বাহুল্য-দোষদুষ্ট হয়। তাই ‘পরীক্ষা চলাকালীন সময় সকল শিক্ষককে উপস্থিত থাকতে হবে।’―এ ধরনের বাক্য না লিখে লিখতে হবে―‘পরীক্ষা চলাকালীন সকল শিক্ষককে উপস্থিত থাকতে হবে।’
জরুরি/জরুরী
বিদেশি শব্দ বলে জরুরি হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লিখতে হবে। অনেকে দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে লেখেন ‘জরুরী’―এটা ঠিক নয়।।
জন্মবার্ষিক/জন্মবার্ষিকী
জন্মবার্ষিক ব্যবহার করলেই যথেষ্ট। অযথা ‘পুংলিঙ্গ বা ক্লীবলিঙ্গ বিশেষ্য-পদে স্ত্রীলিঙ্গ বিশেষণ-পদ’৫ কিংবা স্ত্রী-প্রত্যয় যোগ করা অশুদ্ধ। তাই ‘শতবার্ষিকী উৎসব’, ‘মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠান’, ‘জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান’ না লিখে লেখা উচিত―‘শতবার্ষিক উৎসব’, ‘মৃত্যুবার্ষিক অনুষ্ঠান’, ‘জন্মবার্ষিক অনুষ্ঠান’।
প্রচার/প্রচারণা
শব্দ দুটির মধ্যে সূক্ষ্ম অর্থপার্থক্য রয়েছে। ইতিবাচক অর্থে প্রচার, নেতিবাচক অর্থে প্রচারণা। যেমন―আকবর দীন ইলাহী ধর্ম প্রচার করেন। ধর্মান্ধদের প্রচারণায় সরকারের নারীনীতি সম্পর্কে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে।
প্রেক্ষিত/পরিপ্রেক্ষিত
প্রেক্ষিত অর্থ দর্শিত বা যা দেখা হয়েছে। তাই পরিপ্রেক্ষিত (ইধপশমৎড়ঁহফ) বোঝাতে শব্দটির ব্যবহার অশুদ্ধ।
ফলশ্রুতি/ ফল/ ফলাফল
‘ফলশ্রুতি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ পুণ্যকর্ম করলে যে ফল হয় তা শ্রবণ বা বিবরণ। ফল, পরিণাম, রেজাল্ট বা ফলাফল অর্থে শব্দটির ব্যাপক অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এই অপপ্রয়োগের হাত থেকে রক্ষা পেতে ফলশ্রুতির পরিবর্তে ফল, পরিণাম, ফলাফল, পরিণতি লিখতে হবে।
বন্দী/বন্দি
বন্দনা অর্থে বন্দী, কিন্তু আটক অর্থে ব্যবহার করতে হবে বন্দি।
ব্যবসা/ব্যবসায়
ব্যবসা শুদ্ধ নয়, শুদ্ধ হল ব্যবসায়। ব্যবসা ব্যাপক প্রচলিত হলেও তা না লিখে লিখতে হবে ব্যবসায়।
বাধ্য/বাধ্যগত
‘বাধ্য’ শব্দটি শুদ্ধ, ‘বাধ্যগত’ শুদ্ধ নয়―শুধু তাই নয়, এটি কোনো শব্দই নয়। অনুগত শব্দের সাদৃশ্যে বিভিন্ন দরখাস্তে ‘বাধ্যগত’ লেখা হয়। ‘বাধ্যগত’ ব্যবহার না করে শুধু ‘বাধ্য’ শব্দটি ব্যবহার করতে হবে।
বাল্ব/ভাল্ভ/ভাল্ব
ইংরেজি বাল্ব এবং ভাল্ভ শব্দ দুটির অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। “বাল্ব শব্দের অর্থ―কন্দ বা গুটিকা। বিদ্যুতের আলো যে যন্ত্র দিয়ে বের হয় সে যন্ত্রটি কন্দ বা গুটিকার মতো বলে তাকে বাল্ব বরা হয়। অন্যদিকে ‘ভাল্ভ’ শব্দের অর্থ এমন একটি কপাট যা আগমন-নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন―হৃৎপিণ্ডের ভাল্ভ।”৬ বিদ্যুতের বাল্ব আর হৃৎপিণ্ডের ভাল্ভ সম্পূর্ণ আলাদা। অনেকে এ দুটি বানানের ভুল লিখে থাকে ভাল্ব। এ ধরনের প্রয়োগ থেকে সাবধান থাকতে হবে।
মুখপত্র/মুখপাত্র
‘মুখপত্র’ বলতে কোনো সংস্থা বা সংগঠনের ইস্তাহার বা প্রচারপত্রকে বোঝায়। অন্যদিকে মুখপাত্র হল―প্রতিনিধি।
মো./মি.মি./বি.এসসি/এম.বি.বি.এস/এম.এসসি/পিএইচ.ডি/ড.
শব্দ-সংক্ষেপ করার জন্য আগে বিসর্গ এবং অনুস্বার ব্যবহার করা হতো। যেমন―আঃ, মিঃ, ডঃ, প্রাং, কিঃমিঃ, ডঃ প্রভৃতি। বর্তমানে প্রমিত বানানে শব্দ-সংক্ষেপ করার ক্ষেত্রে কেবল ডট ( . ) চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন―মো./মি.মি./কি.মি. ইত্যাদি। বিভিন্ন ডিগ্রি বা পদবি লেখার ক্ষেত্রেও কিছু বিষয় মনে রাখতে হয়। বিশেষ করে বি.এসসি/ এম.এসসি/পিএইচ.ডি লেখার সময়। অনেকে লিখে থাকেন বি.এস.সি./এম.এস.সি./ পি.এইচ.ডি. অথবা বি,এস,সি/এম,এস,সি,/পি,এইচ,ডি। এভাবে না লিখে লিখতে হবে―বি.এসসি/এম.এসসি/পিএইচ.ডি। ষষ্ঠী বিভক্তিযুক্ত শব্দ সংক্ষেপ করার ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তি ঘটে।
লজ্জাকর/লজ্জাস্কর
লজ্জাকর শব্দটি গঠিত হয়েছে সন্ধির নিয়মে (লজ্জা + কর = লজ্জাকর)। কেউ কেউ লেখেন এবং বলেনও ‘লজ্জাস্কর’। এটা ঠিক নয়। লিখতে হবে লজ্জাকর।
শিক্ষক/অধ্যাপক/অধ্যক্ষ
পদবি বা পদ-মর্যাদা বোঝানোর জন্য অনেক সময় স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়। পদবি একটি ধারণাগত ব্যাপার এবং এতে স্ত্রী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। তাই পদবি ধারণকারী ব্যক্তি নারী-পুরুষ যেই হোক-না কেন পদবি একই রকম থাকবে। যেমন―শিক্ষিকা নয়, শিক্ষক ; অধ্যাপিকা নয়, অধ্যাপক ; অধ্যক্ষা নয়, অধ্যক্ষ।
সহসা
সহসা শব্দের অর্থ―অতর্কিতভাবে, হঠাৎ, অকস্মাৎ। তাই শীঘ্র, তাড়াতাড়ি, সত্বর বোঝাতে ‘সহসা’ প্রয়োগ করা উচিত নয়।
সাক্ষর/স্বাক্ষর
সাক্ষর অর্থ―অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, কিন্তু স্বাক্ষর অর্থ―নিজের সই।
স্বপরিবার/সপরিবার
স্বপরিবার শব্দটির অর্থ নিজ পরিবার। পরিবার তো নিজেরই হয়। তাই ‘আপনি স্বপরিবারে আমন্ত্রিত’―এরূপ প্রয়োগ ভুল। শুদ্ধ হবে সপরিবার অর্থাৎ পরিবারসহ। একইভাবে স্বস্ত্রীক নয়, লিখতে হবে সস্ত্রীক।
তথ্যনির্দেশ
১.আবু হেনা মোস্তফা কামাল, “প্রসঙ্গ কথা”, বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী ও অন্যান্য (সম্পা.), ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ. ৫
২.নরেন বিশ্বাস, প্রসঙ্গ : বাংলা ভাষা, অনন্যা, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ৩৯
৩.মাহবুবুল হক, বাংলা বানানের নিয়ম, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ১৫৪
৪.শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী এবং অন্যান্য, বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ঢাকা, ১৯৮৮ , পৃ. ৩৫
৫.মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, পূর্বোক্ত, পৃ.১১৯
৬. মোহাম্মদ আমীন, বাংলা বানানে ভুল : কারণ ও প্রতিকার, ঢাকা, ২০১১, ১৬৫
4 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনবাংলা বানান নিয়ে আলাপ : তথ্যপ্রযুক্তি অপপ্রয়োগ নয় যেন সংক্রামক রোগ বিষয়ক লেখাটি পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া
উত্তরমুছুনলেখাটির তথ্যসূত্রের কয়েকটি বই পড়া ও দুয়েকটি নিজের সংগ্রহে থাকলেও প্রশ্নগুলো করার সুযোগ ছিল না। তথ্যসূত্রের বাইরেও এ ধরণের বই পড়া ও সংগ্রহে আছে। যেমন- কী লিখবেন কিভাবে লিখবেন (?)(ভারতীয় বইটি, সম্ভবত আনন্দ বাজার পাবলিশার্স) হায়াৎ মামুদের আরেকটি বই।নামটি মনে নেই। বই মেলায় শোভা প্রকাশনী (?) স্বরোচিত বা এমনই কার যেন আরেকটা বই কিনেছিলাম। সবগুলোই পড়া। এ মুহুর্তে ঢাকার বাইরে চাকরি করছি বলে ঢাকার বাসায় রাখা বইগুলো দেখে নিতে পারছি না। দুঃখিত।
যাহোক, নিজের মূর্খামি প্রকাশ পেলেও আমার মনের দ্বন্দ্বগুলোর কিছু তুলে ধরলাম।
উৎকর্ষবাচক প্রত্যয়ের অপপ্রয়োগ হলেও শ্রেষ্ঠদের মধ্যে যে উৎকৃষ্ট / শ্রেষ্ঠ তাকে কি বলব?
সমার্থ শব্দের বাহুল্যজনিত অপপ্রয়োগ হিসেবে সুস্বাস্থ্য শব্দটির উদাহরণ মেনে নিতে পারছি না। সুস্বাস্থ্য মানে স্বাস্থ্য নয়। সুস্বাস্থ্য মানে সুস্থ্যতা , ভালো স্বাস্থ্য । তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তিনি স্বাস্থ্যের অধিকারী ন্য।
লিঙ্গজনিত অপপ্রয়োগের কারণে বানানে ভুল হয় বলে উদাহরণ দেয়া হয়েছে---- বন্দিনী (বন্দী), আবার একই লেখায় বন্দী/বন্দি অর্থাৎ বন্দনা অর্থে বন্দী, কিন্তু আটক অর্থে ব্যবহার করতে হবে বন্দি বলেছে।
এ বিষয়টি আমি বুঝতে অপারগ।
নিরপরাধী(নিরপরাধ)কে সমাস-ঘটিত অপপ্রয়োগ বলা হলেও অপরাধী ও অপরাধ শব্দদ্বয় নিয়ে কি ব্যাখ্যা হবে?
বলা হয়েছে---- প্রত্যয়ের অপপ্রয়োগের কারণে বানানভুল হয়। যথা―অধীনস্থ (হবে অধীন), কিন্তু কোন অফিসে কর্মরত কেউ দরখাস্তের নিচে লিখে আপনার অধীনস্ত অমুক । এ ক্ষেত্রে কি লিখবে আপনার অধীনে অমুক । বুঝতে পারছি না।
অর্থ-সামঞ্জস্যহীন পদের অপপ্রয়োগের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। যথা ----
অশুদ্ধ―আমরা উন্নতির পথে কুঠারাঘাত করছি।
শুদ্ধ―আমরা উন্নতির মূলে কুঠারাঘাত করছি।
আমার কাছে সামঞ্জস্যহীন লাগছে না। কারণ এমন শব্দ প্রয়োগ তো সাহিত্যের অপরিহার্য অংশ। তাহলে সাহিত্যসৃষ্টি কীভাবে হবে! এমন ব্যাখ্যা দিলে বাংলা সাহিত্যের বহু বাক্যকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে।
বলা হয়েছে ---- প্রচার/প্রচারণা শব্দ দুটির মধ্যে সূক্ষ্ম অর্থপার্থক্য রয়েছে। ইতিবাচক অর্থে প্রচার, নেতিবাচক অর্থে প্রচারণা। যেমন―আকবর দীন ইলাহী ধর্ম প্রচার করেন। ধর্মান্ধদের প্রচারণায় সরকারের নারীনীতি সম্পর্কে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু টেলিভিশনে প্রার্থী নির্বাচনী প্রচাররণায় ব্যস্ত বললে কি ভুল বাক্য হবে?
প্রেক্ষিত/পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে লেখা হয়েছে ----- প্রেক্ষিত অর্থ দর্শিত বা যা দেখা হয়েছে। তাই পরিপ্রেক্ষিত (ইধপশমৎড়ঁহফ) বোঝাতে শব্দটির ব্যবহার অশুদ্ধ। বিষয়টি আর একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
মাথাটা গোলমাল হয়ে গেছে যখন পড়লাম--- ব্যবসা/ব্যবসায় নিয়ে। ব্যবসা শুদ্ধ নয়, শুদ্ধ হল ব্যবসায়। ব্যবসা ব্যাপক প্রচলিত হলেও তা না লিখে লিখতে হবে ব্যবসায়। তবে কি বলব--- আমি ব্যবসায় করি !
যাহোক, সংক্ষেপে আমি আমার মনের দ্বন্দ্বগুলো প্রকাশ করলাম। এতে অনেকের দ্বিমত তো অবশ্যই আছে এবং আমার মত কম জানা লোককে শিক্ষা দেয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসলে আমি খুশি হব।
একত্র ও একত্রিত শব্দের ব্যাখ্যা নিয়েও আমার মনে সংশয় রয়েছে।
উত্তরমুছুন