পাঠ প্রতিক্রিয়া : রহু চণ্ডালের হাড়-- হার-মানা হাড়

হিল্লোল দত্ত

বহুগামী আমি, বহুকামীও। উপভোগ করতে ভালোবাসি রূপ, রঙ, গন্ধ, স্পর্শ, সব-সবগুলো ইন্দ্রিয় দিয়েই। ভাসতে চাই, হারিয়ে যেতে চাই আবেগ, শিহরণ, উত্তেজনা, নেশাতুরতা, অনুরাগের ময়ূরপঙ্খী নৌকায়। একে আমার তৃপ্তি হয় না, চাই অনেক, অনেককে। যেমনটা বলেছিলেন প্রাক্তন লুল কবি নজরুল: "প্রেম সত্য, পাত্র সত্য নয়/ যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও, সেই নেশা হয়।" মৌতাত জমাতে একেও চলে, আবার বহুতেও অরুচি নেই। সব ঋতু, সব সময়, সব জায়গাতেই আমি আমার প্রেম প্রদর্শন করতে ভালোবাসি, প্রকাশ্যে অনুরাগ প্রদর্শনে আমি অশ্লীলভাবে অক্লান্ত ও নিরতিশয় নির্লজ্জ।

ওহো, বলছিলাম বইয়ের কথা! যাদের হতাশ করলাম, তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা চেয়ে বলছি, আমি বড় হতভাগ্য। এতেই ক্ষমা পাবো আশা করি।


কাজেই, স্বভাবতই, আমি কখনোই বলতে পারি না আমার প্রিয় বই কোনটা। কে-ই বা আমার প্রিয় লেখক। যখন যেটা পড়ে ভালো লাগে, সেটারই প্রেমে পড়ে যাই। সেই লেখার ভাষার মতোই আমার ভাবনা সেদিক পানে ধায়। নিজেকেই ভর্ৎসনায় বলি সেই ইংরেজি শব্দটা, "তুমি বড় impressionable। এখনো বয়ঃসন্ধি ঘুচলো না তোমার।"

আমাদের বিষাদগীতিগুলোই যদি আমাদের মধুরতম সঙ্গীত হয়, তবে বইয়ের তাক খুঁজে ধুলো ঝেড়ে তুলে নেই সেই বইটা। যে আমায় দিয়েছিলো বইটা, সে আমার তীব্র দুঃখের অপ্রাপ্তির সাধন। নাম বা কোন অভিজ্ঞানই রাখে নি সে বইটায়, হয়তো নারীদের অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে বুঝেছিলো আগেই, বাড়াতে চায় নি কষ্টের বা বুক-চলকানোর কোয়ান্টা। তবে, লেখক আর বইটা দুটোই আমার পূর্বপরিচিত, সমালোচনার মাধ্যমে। আর সমালোচনাও করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের আরেক দিঙ্‌নাগ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তাঁর 'অভিজিৎ সেনের হাড়তরঙ্গ' পড়েই লেখকের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। আজ দু'চার কথকতা হবে সেই বইটা নিয়েই।

অভিজিৎ সেন প্রায় পঁচিশ বছর আগে লেখেন এই বই। আজও সেই বই এতো আধুনিক, আমি নিশ্চিত আগামী পঞ্চাশ বছর পরেও এই বইয়ের আবেদন থাকবে অনন্য। এককথায় সাহিত্যিক নৃতত্ত্বের শ্রমসাধ্য শিল্পিত সংকলন 'রহু চণ্ডালের হাড়'।

প্রথমত, বইটার বিষয়েই চমক। বলি নি বুঝি, এটা উপন্যাস একটা! বাজিকর নামের ক্ষুদ্র এক যাযাবরি গোত্রের মানুষ-মানুষীর জীবন ঘষে আগুন জ্বালানোর ক্লান্তিকর কিন্তু অনিবার্য অলাতচক্রে ঘোরার, প্রাণ টিকিয়ে রাখার অনন্ত অধ্যবসায়ের শিল্পময় বিবরণে গতিশীল এই উপন্যাস। আমার কথাটা যতোটাই নীরস আর অনির্দেশ্য হলো, ততটাই শিল্পরসঋদ্ধ এই লেখা।

তিনি ইতিহাস টানেন এতে, তাদের কল্পপৌরাণিক কাহিনি, তাদের ভাষা, তাদের সংস্কৃতি বিশদ করেন অন্য আরো ভূমিপুত্র আর অন্ত্যজদের টুকিটাকি জীবনযাত্রার সুপাঠ্য মিশেলে। কিন্তু ভোলেন না তিনি গল্পই শোনাতে এসেছেন শেষমেষ, নৃতত্ত্বের তত্ত্বগত পাঠ দিতে নয়।

বাজিকর চুরি করে গেরস্থের ঘরে, হাতসাফাই দেখায়, ডুগডুগ করে বেজে-ওঠা ঢোলের ভোঁতা আওয়াজ তাদের বিজ্ঞাপন, দলের অর্ধবন্য নারীদের লাস্য তাদের আকর্ষণ, প্রতারণা আর লোভ তাদের অলঙ্কার। কী করে আসলে তারা?

"বাজিকরের আপন কুনো ধরম নাই। করম এ্যটা আছে বটে, তো সিটা হোল ভিখ্-মাঙ্গার কাম। মুলুক মুলুক ঘুরে বান্দর লাচানো, ভাল্লু লাচানো, পিচ্‌লু-বুঢ়া পিচ্‌লু-বুঢ়ির কাঠের পুতলা লাচানো, ভান্‌মতির খেল, বাঁশবাজি, দড়িবাজি, নররাক্ষস হয়ে কাঁচা হাঁস, কাঁচা মুরগা কড়মড় কড়মড় কর্যে খাওয়া, নাচানা গাহানা-এলা সব বাজিকরের কাম। এলা সব ভিখ্-মাঙ্গার কাম।"

মানিকের মতো লেখকেরও পা আর মাথা থাকে মাটিতে, মাটির দিকে নিবদ্ধ। তাই 'পান্না কোথায়' নামের ত্যাঁত্যাঁর চাররঙা কমিকসের মতো নিঝুম চাঁদনি রাতে জিপসিদের গিটারিত গান শুনে উদাস হয়ে কেউ বলে না, "মনকে কেমন আচ্ছন্ন করে দেয় এই সুর"। স্তেপে ঘোড়া-ছোটানোর বন্য উদ্দামতা বা প্রেইরিতে কিংবা রুক্ষ গেরুয়াধুলো পশ্চিমা খামারে ক্যারাভান জীবনের চলমানতা কি মাথায় রংবেরঙের স্কার্ফপরা জিপসি মেয়ের ছুরির মতো চকিত চাহনিময় রোম্যান্টিকতা তাই কারোর চোখে উঠে আসে না। অচিন্ত্যকুমারের 'বেদে' বা প্রেমেনের 'যাযাবর', নিদেনপক্ষে জসীমউদ্‌দীনের 'বেদের মেয়ে'-র "বাবু সেলাম বারে বারে"-এর কিছুটা নিরাপদ উপভোগের ভাতঘুমের সম্ভাবনাও এর মাধ্যমে আহরিত হয় না। বরং, গ্রামে বা গঞ্জে তারা এলে কাজের চাপে যৌবন হারানো পেটমোটা ব্যবসাদার বাজিকরের হাত-দেখা রমণীর কাছে নিদান খোঁজে বাজীকরণের, সুলুকসন্ধান চায় ইন্দ্রিয়তৃপ্তির। ক্ষমতার তাগড়াই হাত কখনো দারোগা, কখনো তার ছেলে, কখনো পত্তনিদার, কখনো জমিদার, কখনো ভিনজাতের মাথা সেজে তাদের কাছ থেকে টাকা চায়, পশু চায়, নারী চায়। সে শুধু পালায়, শুধু সূর্য-ওঠার দিকে পালাতে থাকে সদলে, পুবের দেশে যেতে থাকে সে অনবরত। তাদের পূর্বপুরুষেরাই এই পূর্বগমনের পূর্ববাণী করেছিলো: "হাঁ শারিবা, তোর নানার নানা পীতেম, তার বাপ দনু, তো সি কহিল, পীতেম, তুমু পচ্ছিমেৎ নয়, পুবেৎ যাবা। কেন কি, পুবেৎ তর্ক উঠে আর পচ্ছিমেৎ ডুবে যায়।" এতো অরুণোদয়ের সাক্ষী হয়েও তাদের ঘরে আলো আসে না, শত শত বছরের আঁধার ঘিরে থাকে তার পরিপার্শ্ব।

কেন এই নিয়ত সদলবল চংক্রমণ তাদের?

কিংবদন্তী বলে, তাদের এক পূর্বপুরুষ পুরা বিয়ে করে তারই বোন পালিকে। দেবতার অভিশাপে তারা হয় উন্মূল। "তারা কোথাও আশ্রয় পায় না এবং দেবতা তাদের অভিশাপ দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় করে দেয়। তোমরা এক বৃক্ষের ফল দু-বার খেতে পারবে না, এক জলাশয়ের জল দু-বার পান করতে পারবে না, এক আচ্ছাদনের নিচে একাধিক রাত্রি বাস করতে পারবে না এবং সব থেকে ভয়ানক-এক মৃত্তিকায় দু-বার নৃত্য করা দূরে থাকুক, দু-বার পদপাত পর্যন্ত করতে পারবে না। এই ছিল দেবতার অভিশাপ।
সেই থেকে বাজিকর পথেপ্রান্তরে ঘুরছে। সেই থেকে সে দেবতা থেকে বঞ্চিত। গৃহস্থের গৃহের নিকট পর্যন্ত সে যায়, কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।
সুতরাং বাজিকর এক ভিন্ন জীবন, এক অস্থির চলমান জীবনকে আশ্রয় করে আছে।"

তিনি জাদুকরি ভাষায় ব্যবচ্ছেদ করতে থাকেন তাদের সদাচর জঙ্গমতা এবং তাদের পথিক জীবনচর্যা, বইয়ের এবং লেখকের আরেকটা অনন্য সদগুণ। "সে নিজেকে ভুলিয়েছে নাচ গান এবং চিন্তাহীন সরল জীবনযাত্রায়। সে শিখেছে মানুষকে ঠকাতে এবং তা নিয়েই তার অহংকার। সে গ্রহণ করেছে বিচিত্র ভিক্ষাবৃত্তি, যার জন্য কোন সংকোচ তার নেই।
তবুও প্রাচীন কিছু স্মৃতি বা পাপবোধ কিংবা নিতান্তই বিশ্বাস তাকে এখনো চালিত করে, এখনো নিযুক্ত রাখে কিছু আস্তিক চিন্তায়। কিছু ভীতি অথবা দারুণ দুর্দিনের আশংকা তাদের সমস্ত বিধিহীন জীবনযাত্রাকেও বেঁধে রাখে নিয়মের নিগড়ে।"

আমি সৌম্যেন পালের মধুবনী শিল্পকলা প্রভাবিত দুরঙের প্রচ্ছদ উল্টে দেখি আবারো। বইটা বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছিলো ১৯৯২-তে, বালখিল্য প্রচেষ্টা একটা বটবৃক্ষকে বনসাই করার।

ফিরে যাই বর্ণনাত্মক ঘটনাপ্রবাহে।

মানুষের মতো কৌতূহলপ্রবণ হয়ে তাদের কেউ বেরিয়ে পড়ে দলের বাইরে, সাঁওতালদের সাথে ভিড়ে পড়ে কেউ। ফিরে আসে আবার। সাঁওতালদের প্রাণোচ্ছল যূথবদ্ধতার এবং অকৃত্রিম বন্ধুত্বের কিছু কিছু নিয়ে আসে তারা, আবারো তাদের কেউ কেউ যায় কালো মানুষগুলোর ভালোবাসার টানে। এমনকি, সাঁওতালদের মারণ 'হুল'-এ অস্ত্রও হাতে তুলে নেয় কেউ কেউ তাদের কাপুরুষসুলভ মিমের উল্টোরথে গিয়ে। দামিন-ই-কো, ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম এলাকায় জ্বলে ওঠে কালো মাটির মানুষগুলো। সাঁওতাল যুবকেরা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে টামাং নিয়ে গ্রামে গ্রামে গেয়ে আগুন ছড়িয়ে দেয়। মহাজন, ব্যবসায়ীদের লোভের নির্বিচার নিঃসীম শিকার সরল গেঁয়ো শক্তিধরগুলো ক্ষোভের আগুন তীক্ষ্ণধার করে তির আর বল্লমের ফলায়, ঘৃণায় গেঁথে দেয় শোষকদের শরীরে। হুল মাহা হয় এটা, হুল মাহা হয় এটা।

কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদের সাথে পারবে কেন ভূমিপুত্রেরা, যেখানে হেরে গেছে হিন্দু রাজা আর মুসলিম সালতানাত? কানু মুর্মু, সিদু মুর্মু, চাঁদরাই যতোই অদম্য আত্মার অধিকারী হোক, বুলেট তো আর ঠেকানো যায় না শুধু সংকল্প দিয়ে! সূর্য সেন আর সুভাষ বোসই পারেন নি!

ব্রিটিশ বাহিনীর নির্মম সংঘবদ্ধতায় আর সামরিক শক্তিতে পরাজিত সাঁওতালদের ফেলে পালাতেও তারা কসুর করে না বাজিকরদের চিরাচরিত পলাতকপ্রাণের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে।

এদিকে তাদের দল বসত গাড়তে চায় বাজিকরের চিরকেলে চলনের সমাপ্তি টানবে বলে। থানাদারের কাছ থেকে জায়গা পাট্টা নেয় তারা, বন কেটে, জল সরিয়ে জমি বানায়। বীজ ছেটায় ফসল ফলাবে বলে। ফসল ফলে, কিন্তু শেষমেষ নানা প্রতিকূলতায় সে-বসতিও হারায় তারা।

ক্রমে মৃত্যু আর দুর্যোগ আর সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের আবারো মাটিছাড়া করে।

তাদের ভরসা কোথায়?

কোথায় বাজিকরের একটু ঠাঁই হয়?

কাকেই বা ডাকবে সে?

হিন্দুর ভগবান, কৃষ্ণ, কালী, কি মুসলিমের আল্লা, কি খ্রিস্টানের গড তাকে অচ্ছুৎ করেছে। নীরবে, সরবে প্রশ্ন করে সে নিজেকে বা দলের অন্যকে, কে হবে তার শরণ? "তো হামরার বাজিকরের রহুই সি ভগবান, কি আল্লা, কি যেশু। লয়?" কিন্তু কে দেবে উত্তর? যার কাছে প্রশ্ন, তার তো নিজেরই সংশয়। "প্রশ্নটা তার নিজের কাছেই। চতুষ্পার্শ্বের সমাজবদ্ধ মানুষের কাছে এটা কোন সমস্যাই নয়। সর্বশক্তিমান এক বা একাধিক অস্তিত্বের উপস্থিতি যেখানে জন্মের পরেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো সাধারণ বিষয়, সেখানে বাজিকর নামক সম্প্রদায়ের এ ধরনের কোন আশ্রয় নেই-একথা অন্য কারো বোধগম্য নয়। অন্য কারো সমস্যাও নয়।"

শেষাবধি কঠোর জীবনচলার পথে-থাকা পথের মানুষগুলোর হয়তো অনুভব হয়, "যে আছে তার নাম রহু। কিন্তু সে কি এমন অমোঘ? পীতেমের মতো জামিরেরও মনে হয়, না, তা কখনোই নয়। আসলে রহু, দনু, পীতেম কিংবা জামির মূলত প্রায় একই। আর বিগামাই, কালীমাই, কি ওলামাই? সেও তো শুধু পথের সংগ্রহ, তার বেশি কিছু নয়।"

গল্প চলে চার পুরুষ ধরে। কিন্তু, স্থিতি কোথাও তো মেলে না। শত পুরুষ ধরেই মেলে নি।

তারপরও মানুষের অনমনীয় জেদ! হোক সে বাদিয়া, বানজারা কি বাজিকর। হোক সে শতাব্দী যাবৎ অস্পৃশ্য বা নিপীড়িত। মাটিতে খুঁটিগাড়ার দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইটা সে আবারো লড়তে চায়। আবারো গেরস্থালির নিরুপদ্রব, যাযাবরের কাছে আগে উপহাস্য ও তুচ্ছ, জীবনই এখন বুঝি তার কাম্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু, হায় বাজিকর, হায় শ্রেণীবিভেদ, হায় মনুষ্যত্ব!

শুধু বিলাপে ব্যর্থতা মূর্ত করা ছাড়া তার অসহায়ত্বের প্রতিকার কী? "বাজিকর পাটখেত নিড়াতে জানে না, মার খায়। বাজিকর হাল মই দিতে জানে না, মার খায়। আচানক চুরির দায়ে ধরা পড়ে, মার খায়, জেল হয়। গ্রামে মড়ক লাগে, দোষ হয় বাজিকরের। বাচ্চাকাচ্চা চুরি গেল, হারিয়ে গেল, মারো শালা বাজিকরকে, দেও তার ঘর জ্বালিয়ে।"

তাহলে অন্তত প্রেম? ওই অমৃতের মাধ্যমে এই অন্ত্যজদের মূলধারায় প্রবেশের ছাড়পত্র জোটে?

পেমা প্রেমে পড়ে দারোগার ছেলের। সোজন ভালোবাসে ঝালোদের মেয়ে পাখিকে, যার হয়তো দুটো খাটো শাড়ি কেনার ক্ষমতাও নেই। ওমর লুকিয়ে ঘর বাঁধে নমশূদ্রের মেয়ে মালতীর সাথে। প্রতিটারই পরিণতি কষ্টে, বিচ্ছেদে...এবং কখনো মৃত্যুতে। আর নিচুত্বের আরো একধাপ নিচে যেন বাজিকর যাযাবরী। "বাজিকরের বিটিক পাট খ্যাতে চিৎ করা চলে, বাজিকরের বিটিক লুঠ করা চলে, ঢেমনি বানাবার চলে, আর বাজিকরের ব্যাটাক্ জামাই করা চলে না।"

তবুও, তবুও...অদম্য বাজিকর গৃহকোণ চায়। জমির নিরাপত্তা, নিশ্চিন্তি, নিরিবিলি চায়।

এবার বাধা আসে রাজনীতির ঢেউয়ে ভেসে।

প্রশ্ন ওঠে, কারণ ওটা সেই সময়েরই অনিবার্য মানসিক ঘেরাটোপ।
"...তখন চৌধুরী সাহেব ঐ কথাটি তুলেছে, তুরা হিঁদু না মোছলমান, অ্যাঁ? মহিমবাবু প্রশ্ন তুলেছে, হাঁই বাপু, তোরা গরুও খাস, শুয়ারও খাস, ই কেম্‌কা জাত রে বাবা?"

তাই এবার তাদের গোত্রের বেশিরভাগ জুম্মাবারে কলমা পড়ে মুসলিম বনে যায়, কারণ এমনকি হিন্দুদের অন্তেবাসী নমঃশূদ্রদের ভেতরও তাদের ঠাঁই মেলে না। পথের দেবতা পথেই ফিরে যায়, রহুর হাড় তোলা থাকে তাকে, লাগ ভেল্কি লাগ মন্তরগুলো ফুসমন্তর হয়ে যায়।

কিন্তু হায়, প্রতারণা যার রক্তে ছিলো, সে যে বরাবরের মতো এবারও প্রতারিত সমাজের হাতে। যে-সমাজের বঞ্চনার, অবমানননার মুখে পদাঘাত করে নিজের সমাজ গড়ে তুলেছিলো তারা, বাজিকরের ওপর সেই বকেয়া প্রতিশোধ সমাজ বুঝি নিয়েই ছাড়ে এবার। সমাজের র্যাংক এন্ড ফাইলে তাদের নামই থাকে না এরপরও। "সেই একই নিরন্ন হাঘরে সমাজ বহির্ভূত অসহায় বাজিকর।"

ছিটকে যায় শুধু শারিবা। প্রশ্নকর্তা যে-শাকিবার সাথে চিনপরিচয় হতে হতে খোলে উপন্যাসের সদরদরজা, সেই শাকিবা হিন্দুও হয় না, মুসলিমও বনে না। সে বাজিকরই থাকে, কিন্তু স্রেফ ধর্মত। তার ভেতরেই বসত করে বুঝি রহু-দনু-পীতম-জামিরেরা। কিন্তু, বাস্তববাদী সে। পথে পথে বোহেমীয় ধূলিধূসরতা তার মধ্যে রোমান্টিকতার জন্ম দেয় না। কাজ জোটায় সে গ্যারেজে। দেখে ঘর-বাঁধার আর সন্তানের চিরাচরিত স্বার্থপর জিনাবলম্বী স্বপ্ন। কিন্তু, পাশাপাশি তার ভেতরমনে উঁকি দিয়ে যায় অপরাধক্ষালনের মানবীয় খোঁচা। যে-বন্ধুকে সে বাঁচাতে পারে নি, তারই বিধবাকে ও অসহায় সন্তানকে বুকে তুলে নিতে চায় আত্মশরণ হয়ে।

লেখক বাজিকরদের নিঃশেষ করে দেন বাস্তবতার ট্রাক্টরের তলায়। জাতহীনেরা জাত পায়, কিন্তু তাদের আদি পরিচয় মুছে যায় আস্তে আস্তে নতুন দিনের সূর্যের তলায়। কী হবে শেষাবধি তাদের? প্রশ্নের উত্তর অনুচ্চারিত কিন্তু বোধগম্য রেখে লেখক বোধহয় পরের বইয়ের জন্যে কলম ধরেন তাঁর বিপুল শ্রমসাধ্য সৃষ্টিটি নীরবে সফল করে।

অক্ষম এক বিষাদে লীন হয়ে আমিও মুড়ে দেই বইয়ের মেলা ডানাদুটো। সবার ভেতরেই উদাসী এক ঘরছাড়া যাযাবর ডাকে, কেউ শোনে, কেউ শোনে না। আমি হাজারবারের মতো আরো একবার বইয়ে খুঁজি আমার ফেলে-আসা পুনর্জন্মের চিহ্ন, ঘ্রাণ নেই মন-কেমন-করার আশায়। আবারো না-পাওয়ার স্মৃতিটা মিলে যায়, ইকথিয়ান্ডারের খ্যাপা বুড়ো বাপ বালথাজারের মতো পরশপাথর হারানোর দুঃখে আকুল বিষাদসিন্ধুর পাড়ে আমার অসহায় মনটা আছড়ে পড়ে, কিন্তু সমুদ্র কোন রহস্য উন্মোচন করে না।

বই তুলে রাখি বোবা তাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ