দি আর্ট অব ফিকশন সাক্ষাৎকার : শহীদুল জহিরের সঙ্গে আলাপ


চঞ্চল আশরাফ ও রনজু রাইম

শহীদুল জহির তাঁর চেনা জগত নিয়েই গল্প লিখেছেন, বেশিরভাগ গল্পেই পুরনো ঢাকার মানুষের আটপৌরে জীবন, এইসব মানুষের ভেতর দিয়েই বাস্তবে-পরাবাস্তবে তিনি বলে গেছেন তাঁর কথাগুলি; কিন্তু তাঁর, বলার ভঙ্গিটা যেন একটু ভিন্ন, আর ভিন্ন বলেই তিনি পাঠকের মনোযোগে বেঁচে থাকেন, তাঁকে নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয় আর তাই তিনি সমসাময়িকদের মধ্যে বেশি আলোচিতও; কারণ, মানুষের অস্তিত্বের সংকটকে লেখায় তিনি ধরতে চেয়েছেন নিরীক্ষাধর্মী প্রকরণে আর হয়তো,
সেই কারণেই, তাঁর পাঠকের মনে- দক্ষিণ মৈশুন্দি, ভূতের গলি, নয়নতারা ফুল, বদু মওলানা, ডুমুরখেকো মানুষ, আবদুল জলিল, মহল্লা, বান্দর... ইত্যাদি স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ পারাপার (১৯৮৫), দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প (১৯৯৯), তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৪)। উপন্যাস- জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮), সে রাতে পূর্ণিমা ছিল (১৯৯৯), মুখের দিকে দেখি (২০০৬), আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু (২০০৯)। 
প্রিয় ও আগ্রহের লেখকের সাক্ষাৎকার পাঠেও পাঠক তাঁর লেখন শৈলী সম্পর্কে ধারণা পান। চঞ্চল আশরাফ এবং রাইম রাইমের নেওয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই সাক্ষাৎকারটিতে শহীদুল জহির উপস্থিত হয়েছেন তাঁর লেখালেখির কৌশল নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি এখানে প্রকাশিত হল- 

চঞ্চল আশরাফ : আপনি আপনার লেখায়, গল্প বা উপন্যাসে কোন ব্যাপারকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন- আঙ্গিক না বিষয়, নাকি এ দুটোর সমন্বয়ের পক্ষপাতী?
শহীদুল জহির : আমার মনে হয় যে এটা সমন্বয়ের ব্যাপার নয়, আসলে আমি এটা মাথায় নিয়ে কিছু করি না। কিন্তু আমি এক সময় আঙ্গিকের ব্যাপারে সচেতন ছিলাম; আমি কাঠামোর ব্যাপারে সচেতন ছিলাম, অন্তত সাম্প্রতিককালে আমার মনে হয়েছে যে আমার গল্পে গল্প থাকতে হবে, কথাবস্তু বা বিষয়বস্তু এটা খুবই ইম্পরটেন্ট। কাজেই আমার গল্পে গল্প থাকে, এটা কেবলই কাঠামোনির্ভর বা খালি ভাষার বিষয় নয়। এখানে গল্প থাকে এবং এ ব্যাপারে খুবই পার্টিকুলার যে গল্প থাকতে হবে। কিন্তু এখন আমার মনে হয় যে দুটোই খুব ইম্পরটেন্ট, গল্প থাকা যেমন জরুরি, আমি মনে করি, তেমনি কাঠামোর বিষয় যে জরুরি নয় এটা আমি মনে করি না। যদি আমরা সৃজনশীলতার প্রসঙ্গ আসি তা হলে সৃজনশীলতা কোথায় কাজ করে। এটা কি খালি গল্প তৈরিতে কাজ করে, না কাঠামো তৈরিতেও সৃজনশীলতা কাজ করে। আমার তো মনে হয় সৃজনশীলতার প্রসঙ্গটা রচনাশৈলীর সঙ্গেও জড়িত। এবং আমি দুটোর মধ্যেই কাজ করি। কোনটার সঙ্গে কোনটার সমন্বয় ঘটে আমি শিওর না। আমার মনে হয়, আমি খুব সচেতনভাবে সেটা করি না। গল্প তো আছেই, আর কাঠামো আমার গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে।
চঞ্চল আশরাফ : এ ক্ষেত্রে আপনি কোনো পূর্ব পরিকল্পিত ছকের ওপর নির্ভরশীল কি না?
শহীদুল জহির : খুব একটা না, আমি যে পূর্ব পরিকল্পিত ছক পার্টিকুলার গল্পের ক্ষেত্রে, গল্পের যে ধারা, তা কোনদিকে যাবে, এটার একটা প্রাথমিক ধারণা থাকে। যেমন আমি এই বিষয়ে করতে চাই, তারপর এর পুরো ছকটার আগাগোড়াই তৈরি থাকে না। সেটা নিজে নিজেই নির্মিত হয়। আর কাঠামোর ক্ষেত্রে কাঠামো আমি লিখি এটা আমার নয়, এটা আমি তৈরি করিনি। আগেও কিছু গল্প লিখেছি যেটা সনাতনী ধারায় লেখা সেটাও আমি তৈরি করিনি। আর এখন ধরেন যে ধারায় লিখি, যদি যাদুবাস্তবতার কথা ধরেন, যেটা আমি শিখেছি সেটা আমি ফলো করি এবং এটা ফলো করার ক্ষেত্রে যে ছক তা পুরোটা তৈরি থাকে না। এটা আমি মনে করি যদি এভাবে লিখি তা হলে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা সহজ হবে, এটা উপস্থাপনার বিষয়। কাঠামোটা উপস্থাপনারই একটা জিনিস। আমার সেটা মনে হয়, আমি যেটা করি। দ্যাটস অল। আমার এটা মনে হয় না যে পুরো কাঠামোটা আগাগোড়া ঠিক করে নেওয়া যায়। তবে জানা থাকে, আমি মাঝে মাঝে ব্যবহার করি যে, জনগণ বলছে, আমি কিছুদূর এগুনোর পর ঠিক করে নিই এই স্টাইলটা ফলো করবো কি না, নাকি আমি অন্য কোনো গল্পে এই স্টাইলটা ব্যবহার করি, না, আমি সরাসরি চলে যাই।
চঞ্চল আশরাফ : এতে গল্পের যে স্বতঃস্ফূর্ত গতি সেটার উপর চাপ সৃষ্টি হয় কি না?
শহীদুল জহির : হ্যাঁ, হতে পারে, আমি গল্প বলার ক্ষেত্রে অনেক সময় গল্পকে সহজ রাখতে চাই না। এটা আছে, আমার অনেক গল্পই কঠিন মনে হবে, তবে সেটা কিছুটা যে ইচ্ছাকৃত তা ঠিক।
রনজু রাইম : আমাদের কথাসাহিত্যের যে ধারা, তা থেকে আপনি যাদুবাস্তবতার দিকে গেলেও কিন্তু এতদিনে বিশ্বে অন্যত্র বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় এ ধারাটা বেশ প্রতিষ্ঠিত। আপনার কেন মনে হলো লেখায় যাদুবাস্তবতা আনতে হবে?
শহীদুল জহির : এটা একদম হঠাৎ করে হয়েছে আমার ক্ষেত্রে। আমি যে বইটির জন্য এটা ব্যবহার করি সেটা হচ্ছে 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'। এটাতে আমি গেছি কারণ আমি সময়ের কতগুলো তলে কাজ করতে চেয়েছিলাম। যেমন সেভেনটি ওয়ান; একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ, এটি ঠিক কাহিনীটা যেখানে শুরু হয়েছে সেটা একটা সময়, এরপরে সেই সময়টি পার হয়ে আরেকটি সময়ে যাওযা। তার মানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের তিনটি তলে আমি কাজ করতে চাচ্ছিলাম একটি বিষয়ে এবং এ সময় আমি লিখতে গিয়ে দেখছিলাম যে আমি খুব ক্লান্তবোধ করছি, বর্ণনা করছিলাম, তারপর এটা ঘটল, তারপর এটা ঘটল, তারপর এটা ঘটল, খুবই কষ্টকর মনে হচ্ছিল। আমি তখনও এই লেখাটা শেষ করিনি আমি বুঝি যে, আমি পড়ি মার্কেজ। আমি সঙ্গে সঙ্গেই জানি যে আমি এই ফর্মেই লিখব বইটা।
চঞ্চল আশরাফ : কিন্তু আপনার এই ফর্মটা, আপনার 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' উপন্যাসে এই ফর্মটার খুব একটা বিস্তার লক্ষ করি না।
শহীদুল জহির : বিস্তার বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
চঞ্চল আশরাফ : যাদুবাস্তবতা যেভাবে ঘটনাগুলোর ওপর এটা আনপ্রেডিক্টেবল প্রবাহ থাকে এবং পাঠকের অনেকটা অভিজ্ঞতার বাইরে ঘটনাগুলো ঘটতে দেখি, দেখা গেছে 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল'-তে সে ধরনের আবহ তৈরি হয়নি।
শহীদুল জহির : যাদুবাস্তবতা! ইটস ওকে, যাদুবাস্তবতা আমি বই পড়ে শিখিনি। আমি জানি না যে যাদুবাস্তবতার ডেফিনেশন কী। আপনি যে কথা বলেছেন যে নতুন কিছু করতে হবে আনথিংকেবল, আমি এটা জেনে যাদুবাস্তবতা লেখা শুরু করিনি। যাদুবাস্তবতার আমি একটা বই পড়েছি 'তপোবন', আমি আরও বই পড়েছি। সেটা পড়ে, আমি যেভাবে বিষয়টা বুঝেছি তারপরও যদি সেটা যাদুবাস্তবতা না হয়ে থাকে তা হলে সেটা অন্যকিছু। কিন্তু এটা সনাতন কাঠামোর লেখা কিনা, আমার এ লেখাগুলো পড়ে আমার যে রকম মনে হয়েছে যে আমি সময়টাকে ভাঙতে পারি। আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা লিখতে পারি এবং বারে বারে ফিরে আসতে পারি, আমি আবারও সেটা ডেভেলপ করতে পারি এবং আমি আবার অন্য তলে চলে যেতে পারি, গিয়ে বারে বারে আমি সবগুলো জিনিস এক সঙ্গে ডেভেলপ করে নিয়ে যেতে পারি। আমাকে একটা ডেভেলপ করে সেটা ছেড়ে অন্যটা ডেভেলপ করতে হচ্ছে না।
চঞ্চল আশরাফ : আমি...।
শহীদুল জহির : আমি আপনার প্রশ্ন বুঝেছি। আমার কথা হচ্ছে সেটা যদি হয়ে থাকত তা হলে যাদুবাস্তবতা নয়, এবং আমার দাবি করার কোনো দরকার নাই। আমার কথা হচ্ছে যে আমি যে কাঠামো তৈরি করেছি এই কাঠামো কাহিনীর কাছে গেছে কিনা। যদি গিয়ে থাকে তাহলে ওইটার স্ট্যাটাস, কাঠামোগত স্ট্যাটাস, আর এটা যদি যাদুবাস্তবতা আর তার যদি সামান্য অংশ হয় বা আসে তা হলে তো সেটাই আসছে। কিছু এলিমেন্ট থাকতে পারে যাতে আপনার কাছে যাদুবাস্তবতা মনে হবে, কিন্তু আপনি ভাবছেন যে এটা অতটা দূরে নয়, অতটা আশ্চর্যজনক, এটা হতে পারে।
চঞ্চল আশরাফ : আপনার লেখা পড়ে একটা কথা আমার মনে হয়েছে যে, বাংলা সাহিত্যে যেখানে রিয়ালিজম পরিপূর্ণভাবে বিকশিত নয়, সেখানে আপনি যেমন ধরেন আধুনিকতাবাদ বা মডার্নিজম যেখানে প্রতিষ্ঠিত নয় সেখানে পোস্টমডার্নিজমের কথা হচ্ছে এক্ষেত্রে ঠিক তেমনি একটি অবিকশিত ফর্মের পরে আপনি কেন ম্যাজিক রিয়ালিজমের দ্বারস্থ হলেন, এই আঙ্গিকটাকে আপনি কেন পছন্দ করলেন? এটা আমার একটা প্রশ্ন...
শহীদুল জহির : এটা সেই একই কথা, হতে পারে আমি পছন্দ করি নাই। বিকশিত হয়নি ঠিক আছে, কিন্তু সেটা বিকশিত করার, ফর্ম বিকশিত করার দায়িত্ব আমার না। ফর্ম তৈরি করার কাজে আমি নেই, ধরেন এই ট্র্যাডিশন্যাল যে ফর্মটা ছিল সেখানে আপনি বলছেন যে রিয়ালিস্টিক যে ফর্ম সেখানে ফর্মটি ডেভেলপ করে নাই, বিকশিত হয় নাই। আসলে ফর্ম ডেভেলপ করার কাজ আমার না, আমি আসলে ফর্ম ডেভেলপ করছি না, এবং অনেকে খালি ফর্ম নিয়ে কথা বলেন- ওর ভিতরের কথা বলেন না। ফর্ম তৈরি করা আমার কাজ না, আমার কাজ হলো খালি গল্পটা লেখা, এবং আমি এটায় বেশ কমফোর্ট ফিল করি। আমার মনে হচ্ছে যেন আমি বলেছি আগে আমার মনে হয়েছিল যে এই বিষয়টি, যেমন গল্প ভেঙে খ- খ- করে এক ধরনের মোজাইক তৈরি করা। এটা আমার কাছে মনে হয়েছিল যে আমার কথাবার্তাগুলো বলার ক্ষেত্রেও আমার সুবিধা হবে। এটা হতে পারে, আগের ফর্মটা হয়তো ডেভেলপড হয় নাই। এবং আমাকেই যে ওই কাজটি করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই, এটা অন্য কেউ করতে পারে।
রনজু রাইম : ফর্মের ক্ষেত্রে আপনি ম্যাজিক রিয়ালিজমের দ্বারস্থ হলেও আপনার যে গল্পভাষা তা আমাদের পূর্ববর্তী লেখকদের কেউ কেউ, যেমন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ভাষার সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ। আপনার কি মনে হয়নি যে ভাষার ক্ষেত্রেও আলাদা বৈশিষ্ট্যসূচক কিছু করার প্রয়োজন ছিল?
শহীদুল জহির : ম্যাজিক রিয়ালিজমের অন্য কোনো ভাষা আছে কিনা বাংলায় আমি শিওর না। তো এটা বলা মুশকিল, ধরেন ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক ওয়েতে লিখতে গেলে আরেকটি ভাষা তৈরি করতে হবে কিনা আমি শিওর না। আর ভাষাও তৈরি করা আমার পক্ষে পসিবল না। ভাষা, হ্যাঁ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং আরও নিচের দিকে সৈয়দ শামসুল হক, এই ধারায়। এবং একটু কঠিন, একটু ভারী, এবং আমার যা মনে হয়েছে যে ভাষাটা একটু কঠিন হতে পারে। এই ধারাটায় একটু ভারী ভাষা, বাক্যের যে প্রণয়ন প্রণালি একটু জটিল এবং শব্দও একটু ভারী। তো আমি সে অংশটা ফলো করি, এবং এখন যে শৈলীটা ব্যবহার করি সেটা একটু জটিল। এটার সঙ্গে এটা যায় কিনা আমি বলতে পারব না। কারণ ধরেন অন্যরা যারা দেশের বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক লেখা লেখে সেটার সঙ্গে অন্য ভাষার কী পার্থক্য সেটা আমার জানা নাই এবং সেটার জন্য অন্য কোনো ভাষা তৈরি করতে হবে কিনা আমি জানি না, আমার মনে হয় না।
চঞ্চল আশরাফ : আচ্ছা, আমরা পৃথিবীর মহৎ সাহিত্যে দেখেছি যে তারা জীবনকে কীভাবে দেখেছেন তা দেখাতে পেরেছেন এবং তারা সে কারণেই বিশিষ্ট হয়েছেন। জীবনকে দেখার ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গি বা এটিচিউড টুওয়ার্ডস লাইফ এটা আমাদের এখানে সাম্প্রতিক সময়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, এটার কারণ কী, এটাকে কীভাবে আপনি মূল্যায়ন করবেন?
শহীদুল জহির : আপনি সাহিত্যের কথা বলছেন। সাহিত্যের জীবনকে না দেখার...
চঞ্চল আশরাফ : পার্টিকুলার।
শহীদুল জহির : পার্টিকুলার নতুন জেনারেশনের লোকজন না সামগ্রিকভাবে?
চঞ্চল আশরাফ : সামগ্রিকভাবে আমি প্রশ্ন করছি।
শহীদুল জহির : তবে আমি বলতে চাচ্ছি...
চঞ্চল : যুদ্ধোত্তর যে সাহিত্য, হাসান আজিজুল হক, এদের পরে...
শহীদুল জহির : আসলে সেটাই, স্বাধীনতার আগে যারা ছিলেন তারা তো পরেও লিখছেন হাসান আজিজুল হক বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা মাহমুদুল হক এঁরা।
চঞ্চল আশরাফ : জীবন সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা দিতেন, এই ব্যাখ্যাটা কেন আমরা...
শহীদুল জহির : আমার ধারণা যে এরা খুবই একটি ভালো ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। পরে কী হয়েছে হয়নি, না হওয়ার কারণ, হতে পারে যে তাদের সামনে একটা টার্গেট ছিল, টার্গেটটা স্বাধীনতার। ফলে মিশনটা ক্লিয়ার ছিল হতে পারে, সেই টার্গেটটা চলে যাওয়ার কারণে- স্বাধীন হওয়ার অনেক সমস্যা আছে। মিশন ঠিক করা ডিফিকাল্ট হয়। হতে পারে যে সেই আইডিয়ালিস্টিক মিশন এই মূহূর্তে ঠিক করা যাচ্ছে না। মানবতাবাদ, মানুষের দুঃখ, মানুষের পীড়ন, এগুলো ইন্টারেস্টিং, কারণ হচ্ছে যে, সব সময় এইসব বিষয় বা এইসব বড় বিষয় সবসময় সূক্ষ্ম প্রমাণিত হচ্ছে। আমরা দেখেছি বাঙালি নিজের ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য আন্দোলন করেছে, তারা অন্য সব বিষয় নিয়ে আন্দোলন করে নাই, স্বাধীনতার জন্য গেছে। হ্যাঁ স্বাধীনতা তো অবশ্যই মানবতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির একটি বড় সোপান, অবশ্যই। কিন্তু স্বাধীনতার পরে আমার মনে হয়েছে যে এগুলোই থেকেছে ভাষার প্রসঙ্গ বা স্বাধীনতার প্রসঙ্গ ছিল না। এটি একটি কারণ হতে পারে, অন্য কারণ হতে পারে যে সামাজিক অস্থিরতাও ওদিকে গেছে, সামাজিক পুরো বিষয়গুলো ওদিকে গেছে, সামাজিক সব মানুষের ভেতরে আর ওই জিনিসগুলো কাজ করে না। আর এখন স্বাধীন হয়েছে বলে তারা একটি স্বার্থ চরিতার্থতার অধিকার রাখেন এবং তারা গেছেন। এবং সেটা যারা গেছে, এই দেশে তো অনেক গরিব আছে, যারা যাচ্ছেন, তাদেরকে তো কতকগুলো জিনিস অস্বীকার করে যেতে হচ্ছে। এদেশে বড় লোক হওয়া, সামাজিকভাবে চোখ কান খোলা রেখে বড়লোক হওয়া খুব ডিফিকাল্ট। কিন্তু লেখকের দায়িত্ব তো খুব বড়লোক হওয়া না, সে তা করে না, কিন্তু দেখতে হবে যে, এসব জিনিস তাকে প্রভাবিত করেছে কিনা। আরেকটা বিষয় আমার মনে হয় আগের চেয়ে নিজের লেখা প্রকাশ করার সুযোগ বেড়েছে। যদিও সাহিত্যপত্রিকা বেশি নেই, তবুও পত্রিকাগুলোতে সাহিত্যের পাতা বেরুচ্ছে এবং সহজেই লেখা ছাপা হওয়ার একটা ব্যাপার ঘটেছে এটাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার এবং এখানে লেখকদের তো দোষ আছে অবশ্যই, কারণ তারা নিজেদের উপর নিজেরা নিয়ন্ত্রণ আনতে পারছে না যে আমি কতটুকু লিখব কতটুকু লিখব না। কিন্তু সাহিত্যের যারা কাগজ সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত তাদের অনুদান থাকতে পারে যে, তাদেরও তো কাগজটি তৈরি করতে হবে এবং এটি চালানো একটি বড় ব্যাপার। সে জন্যে লেখাও লাগবে। ফলে আমার ধারণা এটি উভয় পক্ষের একটি বিষয় হচ্ছে। না হলে এটির বেশি সম্ভাবনা ক্ষতি হয়ে যাওয়া। অনেক দুঃখ, অনেক বেদনা, একটি বিষয় বা প্রসঙ্গ থাকতে পারে এবং এর জন্য প্রয়োজন সময় দেওয়া, তা না দিয়ে যদি একদিন, দুদিন বা পাঁচদিন গল্প লিখতে বসা হয় তা হলে ভালো কিছু উঠে আসতে পারে না, না আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
চঞ্চল আশরাফ : এখন আমি আপনার লেখায় জীবন সম্পর্কে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে সে সম্পর্কে কিছু বলবো। যেমন আপনার 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' উপন্যাসে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির জন্য একটা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার স্থানান্তরে যেতে বাধ্য হয়, এটার সঙ্গে বাস্তবতার সাদৃশ্য কতটুকু?
শহীদুল জহির : এটা আমি বলতে পারব না। এখন এটা অবশ্য দাবি করা বেশি হয়ে যায় যে জনগণ ঠিক করবে, আমি ঠিক করব না, এটা জনগণের ওপর ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আসলে তাই, কারণ আমার ধারণা যে, এখন হয়তো অবস্থা একটু পরিবর্তিত হয়েছে। আমার ওই লেখাটার একটা অংশ আমরা হয়তো বেশির ভাগ লোকই খেয়াল করি না, সেটা হচ্ছে যে, এই যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্থান, এই অপশক্তির পক্ষে বিপক্ষে সবাই এনকারেজ করছি। প্রত্যেকে, এটা সাধারণ লোকজন বা জনগণ স্বীকার করছে না, ওই শক্তি যদিও রাজনৈতিক শক্তি এবং অন্য রাজনৈতিক যতো শক্তি আছে সবাই ওই শক্তিটাকে সাহায্য করছে এবং তাদের উত্থান এবং প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। এইটি হচ্ছে ওই গল্পের মূল বক্তব্য। মূলত আর কিছু না। তা সিচুয়েশন তখন তাই ছিল। ওই গল্পটিতে একটা সময়ের ব্যাপার আছে। ওই স্ট্রাকচারের জন্য গল্পটিকে আমি শেষ তিন লাইনের পরে বদলাইছি। আর ওই বইটির সেকেন্ড এডিশনে শেষ তিন লাইন বদলানো হয়েছে। এটা হচ্ছে কাহিনী।
রনজু রাইম : আপনার লেখায় আপনি ম্যাজিক রিয়ালিজমের ব্যবহার দেখালেন- এটা কি আমদানি করা নাকি আমাদের লোকজীবনে, সাহিত্যে এর একটা অস্তিত্ব ছিল?
শহীদুল জহির : আমাদের সাহিত্যে ছিল কি-না আমি বলতে পারব না, আমি তো বলেছি যে আমি এই জিনিসটা পুরোপুরি জেনেছি মার্কেজের কাছ থেকে। যদি আমদানি বলেন আমদানি, আর যদি আমদানি না বলেন আমদানি না। কিন্তু আমি পুরোপুরিই জেনেছি ম্যাজিক রিয়ালিজমের ব্যাপারটি, এটা যদি ফিনোমিনা বলেন, এই ফিনোমিনা আমাদের জীবনে সব সময় আছে, সব সময় ছিল। আমরা জানি নাই, আমি জানি না। এটলিস্ট আমাদের সাহিত্যে ছিল কিনা, আমি জানি না, আমি বলতে পারব না, অন্য কেউ বলতে পারবেন, সাহিত্যের অধ্যাপক বলতে পারবেন। আমার সব সাহিত্য পড়া নাই। কিন্তু যদি ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা বলেন, আমি ম্যাজিক রিয়ালিজম যে রকম বুঝি, এটা একদম ডেফিনেশন ধরে নয়, কারণ আমি আগেও বলেছি যে, আমার এই জিনিসগুলো ম্যাজিক রিয়ালিজম নাও হতে পারে। হতে পারে যে এটি একটি খণ্ডিত ম্যাজিক রিয়েলিজম। হ্যাঁ, ওকে, ফাইন, দিস ইজ এ ফর্ম। যদি খণ্ডিত হয় তবে এটাই একটা ফর্ম, আর যদি ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক হয় তবে এটাই একটা ফর্ম। এখন আমি যেটা বুঝি যে আমাদের জীবনের সাধারণ চলাচলের মধ্যে একটা ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক জীবন আছে। পাশাপাশি না একই সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমরা যদি চুলার ভিতর থেকে কই মাছ ধরি, তা হলে যদি আপনি সেটাকে গল্পে একটা মুখ্য বিষয় করেন, ইট বিকামস ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক। কারণ নরমাল সাহিত্যে আমরা চুলার ভিতর থেকে কই মাছ ধরে বিক্রি করে ব্যবসা করার কথা বলি না, তো এই যে জিনিসগুলো, এই জিনিসগুলো কাভার করতে চাই। আমার কাছে মনে হয়েছে এ রকম আমি ম্যাজিক রিয়ালিজম বুঝেছি এর ডেফিনেশন পড়ে নয়, আমি ম্যাজিক রিয়ালিজম বুঝেছি একটা সাহিত্য পড়ে। ফলে ওই সাহিত্যের ভিতরে কী কী শর্ত মেনে লেখা হয়েছে আমার জানা নাই। আমি বইটা পড়ে এভাবে বুঝি। ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক জীবনের একটা তল এটা আমাদের আছে এবং সব সময় ছিল। হাজার বছর, কোটি বছর, এটা সবসময় ছিল। এটা অন্য কেউ করছে কিনা আমার জানা নেই, আমরা ছিলাম এবং থাকব।
চঞ্চল আশরাফ : আচ্ছা, আমার একটা প্রশ্ন ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে, আমরা যেটা বুঝি বা জানি যে ম্যাজিক রিয়ালিজম অবরুদ্ধ সমাজের একটা আঙ্গিক, কারণ যে সমাজে সরাসরি কথা বলা যায় না সে সমাজে ঘুরিয়ে বলা বা আখ্যানরূপকে সাহায্য নেওয়া হয়। তা হলে এই সমাজের প্রতি আপনার একটা ব্যাখ্যা আছে, এই সমাজকে কি আমরা অবরুদ্ধ সমাজ ধরে নেব?
শহীদুল জহির : অবরুদ্ধ ওই অর্থে নয়, আমরা স্বাধীন- এটা ঠিক আছে এই মুহূর্তে। একাত্তর সালে যে স্বাধীনতা হয়েছে ওটাকে ওই অর্থে অবরুদ্ধ বলা হবে না। কিন্তু আমাদের সমস্যা আছে অবশ্যই। আমাদের সামাজিক অবস্থা যেগুলো, আমাদের এখানে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা ছিল, আমি একদম ডেফিনিট না যে ম্যাজিক রিয়ালিজম একদম অবরুদ্ধ সমাজেরই হতে হবে কি-না। যে সামাজিক অবস্থায় ম্যাজিক রিয়ালিজম ব্যবহৃত হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকায়, আমাদের এখানে আশি বা নব্বইয়ের দশকে সে রকম সিচুয়েশন ছিল কি-না। এটি হচ্ছে একটি দিক। অন্যদিক হচ্ছে যে, যেটা আমি এখন চিন্তা করি বা নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে এখন চিন্তা করি। আমরা স্বাধীন বটে কিন্তু অবরুদ্ধ নই, কিন্তু আমাদের জীবনের যে ঘটনা আমাদের জীবনের যে অন্য ধারাক্রম সেটা যদি আমরা ফলো করি এটা কি খুব ফ্যান্টাসটিক না? মুক্ত দেশ এটা ঠিক আছে কিন্তু মুক্ত দেশ হলেও...।
চঞ্চল আশরাফ : এর সঙ্গে স্বাভাবিকতার কোনো সম্পর্ক নেই।
শহীদুল জহির : আমাদের জীবনের, মানুষের যে রিঅ্যাকশন, নব্বই সাল থেকে রাজনৈতিক ধারা, পুরো নব্বই সাল থেকে, আমরা দেখলাম যে স্বৈরাচারের পতন ঘটে গেছে, তারপর যে রাজনৈতিক ধারা, তারপর মানুষের আচরণ, তারপরে ব্যবসার আচরণ, তারপরে ছাত্রদের আচরণ, আমলাদের আচরণ।
চঞ্চল আশরাফ : ঋণখেলাপিদের।
শহীদুল জহির : ঋণখেলাপিদের আচরণ, এগুলো বাস্তবতার কত কাছাকাছি। ফ্যান্টাসটিক সব। তো এটা অবরুদ্ধ সংস্কৃতির কিছু নয়-
চঞ্চল আশরাফ : কিন্তু এটার ভিতরে অবরুদ্ধ সংস্কৃতির কিছু বিষয় আশয় আছে।
শহীদুল জহির : এই প্রসঙ্গগুলো, একটি সিভিল সোসাইটি বা সভ্য সমাজের কাছাকাছি অতোটা নয়। বেশ খানিকটা দূরে। এটা আমার মনে হয় যে আমরা একেবারে অসভ্য না, কিন্তু আমরা বেশ দূরে আছি।
চঞ্চল আশরাফ : তা হলে কি আপনি বিশ্বাস করছেন যে সামাজিক অবস্থা নির্ধারণ করে দেয় সাহিত্যের আঙ্গিক?
শহীদুল জহির : আমি এটা কনশাসলি করি না, আপনি যেটা বলছেন এটা আমি অবিশ্বাস করতে চাচ্ছি না। কিন্তু আমি এই কারণেই এটি করি নাই। সুতরাং কেউ যদি বলে যে এখানে এ জন্যই ম্যাজিক রিয়ালিজমের উত্থান ঘটে নাই কেননা, এখানে অবরুদ্ধ সোসাইটি ছিল না। আমি এই কারণে এটা করি নাই। আমি অবরুদ্ধ না মুক্ত সমাজ এটা চিন্তা করে এটা করি নাই। আমি করেছিলাম- হ্যাঁ, একটা সাহিত্যিক প্রয়োজনে। আমার গল্পটা প্রকাশের একটা কাঠামো দরকার ছিল, আমার মনে হয়েছিল এটাই বোধহয় সুবিধাজনক হবে এবং সে জন্য আমি করেছিলাম।
চঞ্চল আশরাফ : আপনার 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' উপন্যাসে একজন পতিতা, সে জীবন দিয়ে একজন মানুষকে রক্ষা করেছিল। আমরা দেখি যে একজন প্রতিষ্ঠিত রাক্ষস রাবণকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহামানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিলেন। আপনি কি এক্ষেত্রে একজন আউটকাস্ট ওম্যানকে সে রকম সাবলিমেশন দিতে চেয়েছিলেন?
শহীদুল জহির : এ্যাবসলিউটলি, একদম ব্যাপারটা তাই, এটা একদম কনশাসলি করা। এক্ষেত্রে মেয়েটি মরে যাওয়ার পরে বা যে লোকটিকে সে বাঁচালো, পরবর্তী পর্যায়ে যে সময়ের বর্ণনা করা হয়েছে, এই মেয়েটির নাম করে করে করা হয়েছে। একটা লেমেনটেশনের মত। মেয়েটাকে ভালোবাসবেন, মেয়েলোককে মাথায় রাখবেন, বারে বারে বলা হয়েছে। এবং এটা অবশ্যই আশ্বস্ত করার জন্য।
রনজু রাইম : এ সময়কার তরুণ লেখকদের মধ্যে একটা প্রবণতা যে তারা প্রবীণ লেখকদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ বা লিয়াজোঁ মেইনটেইন এবং এটা তারা করে মূলত স্বীকৃতির জন্য। এবং প্রবীণ লেখক কবিদের কেউ কেউ এ কাজটি করছেনও, স্বীকৃতি তারা দিচ্ছেন যতোটা না লেখার উৎকর্ষ বিচারে, তার চেয়ে বেশি লেখকের বা কবির সঙ্গে ব্যক্তি সম্পর্কের নিরিখে। একজন তরুণ লেখকের বিকাশের জন্য এ ধরনের কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে?
শহীদুল জহির : এটার দুইটা উত্তর হয়। প্রথম কথা আমার মনে হয় যে এটার দরকার নাই। কারণ লেখকের এক ধরনের জেদ থাকা উচিত, অবশ্য আমি হয়তো ভাগ্যবান, সেটা হয়তো হয়ে গেছে। লিয়াজোঁ রেখে তা কোনো লাভ হবে না যদি ভালো সাহিত্যকর্ম না হয়। কেউ যদি ভালো লেখে তা হলে যোগাযোগ কম থাকলেও আলটিমেটলি তাদের স্বীকৃতি পেতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু খালি যোগাযোগ রেখে স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব না, আমার ধারণা যোগাযোগ রেখে তাদের ক্ষতি হচ্ছে উল্টো। এটা আমার পার্সোনাল ধারণা। যোগাযোগের কারণে তারা লেখা পাবলিশ করার একটা সহজ পথ পেয়ে যাচ্ছে। লেখা পাবলিশ হওয়া দরকার। কারণ সাহিত্যপত্র বা বিভিন্ন জায়গায় ছাপানোর ব্যবস্থা না থাকলে সাহিত্য কখনোই ডেভেলপ করবে না। কিন্তু এটি, এই এক্সারসাইজটা খুব সহজ হওয়া উচিত না, যে, আমি তিন পৃষ্ঠা গল্প লিখে ফেললাম তা কোথাও না কোথাও ছাপা হয়ে গেল। এই অবস্থাটায় আসা ঠিক হয়নি। এবং লিয়াজোঁ রাখা উচিত। উৎসাহ যদি থাকে তা হলে ক্ষতি নেই, তারা ভালো কাজ করতে পারবে। আমি তো লিয়াজোঁ রাখি না আসলে।
চঞ্চল আশরাফ : সংঘবদ্ধ তৎপরতার মধ্যে আপনি নেই?
শহীদুল জহির : না।
চঞ্চল আশরাফ : তো আমাদের এখানে আশির দশকের শেষের দিকে কথাসাহিত্যে ভালো করছেন, এমন দু-একজন আছেন, আছেন বলেই মনে হয়। আপনার কী ধারণা এ ব্যাপারে, আমি যদি নাম উল্লেখ করে বলি?
শহীদুল জহির : দরকার নাই, আচ্ছা বলেন।
চঞ্চল আশরাফ : যেমন শাহাদুজ্জামান, মামুন হুসাইন, তারপরে নাসরীন জাহান, যদিও নাসরীন জাহান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন, বাকি দুজন সম্পর্কে আপনার কী ধারণা।
শহীদুল জহির : খুবই ভালো ধারণা আমার। বাকি দুজন, আরও হয়তো দু-একজন আছেন। প্রথমে আপনি এদের নাম করেছেন, ঠিকই আছে। আমার খুবই ভালো ধারণা, মামুন হুসাইন তো, আমার ধারণা মামুন হুসাইন পোস্ট মডার্ন লেখা লেখেন এবং তার লেখার, আমি আবারও বলি যে আমার ধারণা এ ব্যাপারে খুব অস্পষ্ট ভালো ধারণা আমার নাই। আমি একাডেমিক ধারণায় খুব ভালো বলতে পারব না। কিন্তু আমার ধারণা মামুন হুসাইনের লেখা খুবই ভালো। আমি একটি গল্পের কথা বলি, একটি স্পিচ লিখতে পারাও তো কম না। যে গল্পটা 'এ এক পুনরুত্থান' এটা খুবই ভালো গল্প এবং খুবই স্ট্যান্ডার্ড এবং কোনোভাবেই এ্যামেচারিস্ট কিছু না যে, গল্পে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে এমন কিছু না, এটা একেবারেই প্রস্ফুটিত একটা গল্প। এতো ম্যাচিউরড। শাহাদুজ্জামানও তাই। ওর একটা গল্প আছে, একটা গল্পের বই আমি কিনেছিলাম, অনেকগুলো গল্প আছে।
চঞ্চল আশরাফ : পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ?
শহীদুল জহির : হ্যাঁ হ্যাঁ সেখানে একটা ভালো গল্প আছে 'কাগজের এরোপ্লেন' নামে।
চঞ্চল আশরাফ : গল্পটি আমারও খুবই ভালো লেগেছে।
শহীদুল জহির : তা-ই, সাংঘাতিক ব্যাপার। আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে এবং এসব ক্ষেত্রে রচনা যেহেতু মুষ্টিযুদ্ধ নয় যে একজন আরেকজনকে ঘুষি মেরে একা দাঁড়িয়ে থাকবে, তা নয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে দশজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। আমার মনে হয় যে এইসব গল্প যে লিখেছে সেই লিখতে পারে। মামুন হুসাইনের ওই লেখা, শাহাদুজ্জামানের এই লেখা, ওরাই লিখতে পারে।
চঞ্চল আশরাফ : আর?
শহীদুল জহির : কাজল শাহনেওয়াজ, আমি কাজল শাহনেওয়াজের গল্প খুবই পছন্দ করি।
রনজু রাইম : গল্পের জন্য ল্যাংগুয়েজের স্ট্যান্ডার্ড কী রকম হওয়া উচিত?
শহীদুল জহির : খুব বেশি হওয়া উচিত। মানে ল্যাংগুয়েজ, গল্পের বিষয়বস্তু, গল্পের কথা, কৌশল, কাঠামো এবং ভাষা এইসব সমন্বিত হতে হবে। আপনি কোনো একটার দুর্বলতা দেখালে হবে না। কিন্তু তারপরও যে একটি সফল গল্প লিখতে পারবেন না, এরকম না। এটা আসলে তো আর বলে দেওয়া যাবে না যে গল্প কীভাবে সফল করা যাবে। আপনি আগে কিছু জানেনও, এই সব মাল-মসলা থাকতে হবে, থাকলে পরে আপনি একটি সফল গল্প লিখতেও পারেন।
রনজু রাইম : গল্প উপন্যাস লেখার আগে আপনি কি ছক এঁকে গল্পের বিষয়বস্তু কী হবে এবং কোথায় গিয়ে শুরু বা শেষ হবে এরকম পরিকল্পনা আগেভাগেই করে নেন, না এমনিতেই একটা ফ্লো বা প্রবহমানতা চলে আসে যা লেখাটিকে পূর্ণতা ও পরিণতির দিকে নিয়ে যায়?
শহীদুল জহির : এটা কাঠামো না, গল্প লেখার আগে আমার একটা অস্পষ্ট ধারণা থাকে যে কারণে আমার একটা গল্প লিখতে গিয়ে সে গল্পটাকে অনেকদিন মনের মধ্যে লালন করি, আমার এতো দেরি হওয়ার একটা কারণ যে আমি লেখা শুরু করে দেরি না, আমার এমনিতেই অনেকদিন যায়, মাসের পর মাস। আইডিয়া, মূলত আমি গল্পের আইডিয়া বিভিন্নভাবে পেতে পারি, গল্পের ঘটনা থেকে পেতে পারি। শব্দ থেকে হতে পারে। যেমন আমি একটি গল্প লিখেছি, রিসেন্টলি, আমি একটি শব্দ ব্যবহার করার জন্য গল্পটি লিখেছি, বান্দর। মূলত ওই শব্দটি ব্যবহার করার জন্য আমি গল্পটি লিখেছি এবং এটা খুঁজতে, মানে গল্পটা খুঁজতে বা লিখতে আমার ছ’মাস বা এক বছর লেগেছে। ভার্চুয়েলি আমি এক বছরের মধ্যে লিখি নাই আর কিছু। তো কাঠামো যখন আমি খুঁজি যে কীভাবে আমি ধরাশায়ী করবো জিনিসটাকে, তখন আমি কাঠামোর একটি জিনিস তৈরি করি। তারপর যখন আমি তা লিখতে শুরু করি তখন এটা কাঠামোর ভেতরে থাকে তা না, তবে কাছাকাছি থাকে।
চঞ্চল আশরাফ : আপনি কি অটোমেশিনের উপর ডিপেন্ড করেন? মানে এক ধরনের স্বতঃক্রিয়তা যে গল্প যেদিকে যাচ্ছে যাক, এক ধরনের অনিয়ন্ত্রিত।
শহীদুল জহির : পুরো না, আমি একটা অংশ প্রথমে চিন্তা করে নিই। একদম হঠাৎ করে লিখতে বসি না যে একটা গল্প লিখে দিতে হবে, আমাকে একটা গল্প লিখতে হবে। আমি হঠাৎ করে একদিন কম্পিউটার বা কাগজ কলম নিয়ে বসে গেলাম, আমি শুরু করলাম, চিন্তা করতে থাকলাম আমার হাত যে দিকেই যায়। তা না, আমি চিন্তার বিষয়টির একটা অংশ করেই রাখি এবং সে জন্য আমি যথেষ্ট সময় দিই।
চঞ্চল আশরাফ : সে ক্ষেত্রে কি আপনি আবেগকে না মস্তিষ্ককে কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দেন?
শহীদুল জহির : এটা বলা মুশকিল। আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বোধহয় আবেগকেই গুরুত্ব দিই, আমি আবেগপ্রবণই বোধহয় বেশি। আমার যেটা মনে হয়, গল্পে আবেগটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রনজু রাইম : গল্পের ক্ষেত্রে কতটুকু ফ্রিডম দেন ক্যারেকটারকে?
শহীদুল জহির : হ্যাঁ, কিছুটা, আসলে কোন ক্যারেকটার যে খুব স্বাধীন লেখকের চাইতে, এটা আমার খুব মনে হয়নি কখনো। যদিও মনে হতে পারে যে ক্যারেকটারগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবেই চলে যাচ্ছে, সেই চলে যাওয়াকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
রনজু রাইম : এটাকে লেখকই নিয়ন্ত্রণ করবেন?
শহীদুল জহির : হ্যাঁ লেখকই নিয়ন্ত্রণ করবেন। এটা হতে পারে কেউ কেউ বলেন যে, বদলে যাচ্ছে, ঘটে যাচ্ছে, সেটাও আমার ইচ্ছার ভেতরে থেকেই যায়। কারণ লিখতে বসেও আমি চিন্তা-ভাবনা করতে থাকি গল্প তো গড়ায়, গড়িয়ে একদিকে যেতে থাকে- এই যেতে থাকাটা আমার কাছে অনুমোদনযোগ্য মনে হয় না। ফলে আমি এটাকে এলাও করি না এবং এই গড়াতে গিয়ে আমি হয়তো যেভাবে শেষ করতে চেয়েছিলাম, এটা হয়তো সেভাবে শেষ হয় না, অন্যভাবে শেষ হয়, কারণ আমার হয়তো যেভাবে শেষ করতে চাওয়া সেটা হয়তো বেসামাল ছিল না। পরে যখন এটি এভাবে শেষ হয়, তখন হয়ত আমার কাছে একটু বেসামাল মনে হয়। তখন আমি একটু সরে যাই। কিন্তু আমার একটি কাঠামো মোটামুটি থাকে। তার আশপাশের দুইকূল থাকে কিন্তু নদীর মাঝখানটা আমার থাকে। ফলে দুই সাইড কী হবে সেটা অনেকটা স্বাধীন থাকে। কিন্তু সে স্বাধীনতাও আমার নিয়ন্ত্রণের ভেতরে।
চঞ্চল আশরাফ : পশ্চিমবঙ্গে এক ধরনের সাহিত্য দেখা যায়, আমি এক ধরনের বলছি এ জন্য যে সুবিমল মিশ্র, এঁরা লিখছেন। এই ধরনের সাহিত্য যে আজীবন এক্সপেরিমেন্ট করে যাওয়া, এই এক্সপেরিমেন্ট কী করে, সে তো পরীক্ষা করে যে কোন আঙ্গিকে সে লিখবে, কোন জায়গায় সে স্থিত হবে এটা এক ধরনের পরীক্ষামূলক একটা প্রক্রিয়া। এই যে, নিরন্তর যে এক্সপেরিমেন্ট চলছে এটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শহীদুল জহির : আমি আসলে আগেও একবার বলেছিলাম যে এ ব্যাপারে আমার ভালো ধারণা নাই। আমি সুবিমল মিশ্র পড়ি নাই আসলে। ফলে এইটা জানি না। কিন্তু এক্সপেরিমেন্ট কন্টিনিওয়াসলি স্ট্রাকচারাল এক্সপেরিমেন্ট যদি হয় এটা তাহলে আমি শিওর না, কনটিনিওয়াসলি আলটিমেটলি ভেতরে গল্প আছে কিনা। গল্প যদি কনটিনিওয়াসলি স্ট্রাকচার বদলানোর পরেও সে যদি একটা গল্পকেই তৈরি করে তা হলে স্ট্রাকচার বদলালেও কোনো সমস্যা নেই। আর যদি স্ট্রাকচারের প্রসঙ্গ ওঠে, যে গল্পটা মুখ্য নয় স্ট্রাকচারটাই ইম্পরটেন্ট তা হলে কোনো স্ট্রাকচারই বোধহয় তেমন একটা গুরুত্ব পাবে না। আমার কাছে এখনও মনে হয় স্ট্রাকচার ইজ ভেরি ইম্পরট্যান্ট, সেটা আমি বলি, কিন্তু স্ট্রাকচারটা গল্প নয়, এটার ভেতরে গল্পটাই গল্প, তো সেই গল্পটার স্ট্রাকচার না থাকলেও কিছু এসে যায় না। না বদলালেও কিছু আসে যায় না। আর গল্প থাকলে বারে বারে স্ট্রাকচার বদলিয়ে যদি গল্পটা তৈরি করতে পারে তা হলে অসুবিধা কী, গল্প থাকলেই হলো।
চঞ্চল আশরাফ : একটা সফল গল্প তৈরি করতে লেখকের কর্তব্য কী হওয়া উচিত।
শহীদুল জহির : এটাই একটা বড় সমস্যা, আসলে সফল গল্প লেখার কোনো ফর্মুলা নাই। যারা হয়তো সফল গল্প অতীতে লিখেছেন, তারা হয়তো আমাদেরকে বলে দিতে পারবেন না যে তুমি এইভাবে লিখলে তুমি সফল গল্প লিখতে পারবে। কাজেই এটা সম্ভব না এবং মেধাও কার আছে এটা জানা নাই।
রনজু রাইম : লেখক হয়তো নিজেও জানেন না যে কোন গল্পটা লিখলে সফল হবে।
শহীদুল জহির : হ্যাঁ, লেখক নিজেও জানেন না। তবে আমার ধারণা লেখক নিজে যখন অনেস্ট হয়, রেসপনসিবল হয় তখন সে নিজের রচনা বুঝতে পারে যে এটা কতোটা ভালো লাগছে তার।
রনজু রাইম : এক্ষেত্রে লেখকের অনেস্টি কি শুধুই তার নিজের লেখা সম্পর্কে, নাকি তিনি অনেস্ট হবেন সামাজিকভাবেও?
শহীদুল জহির : তার লেখা সম্পর্কে- সাহিত্যিক সততা, সে জিনিসটি তৈরি করেছে, পাঠক হিসেবে তা নিজের কাছে কতটুকু ভালো লেগেছে। সে পাঠক হিসেবে কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। এটা তাকে প্রভাবিত করে কি না, সে ইফেক্টিভ হয় কি না। সে যদি ইফেক্টিভ হয় এবং সে যদি অনেস্টলি মনে করে যে এটা আমার ভালো লাগছে তবে একজন লেখকের বাংলাদেশে যারা লেখেন তারা তো শিক্ষিত লোকজন, তাদের একটা মিনিমাম এডুকেশন এবং তাদের লেখাপড়া আছে। তিনি বিএ পাশ হতে পারেন, বিএ পাশ যথেষ্ট এডুকেশন এবং তাদের লেখাপড়া আছে, এ সময়ের ইয়াং ছেলেপেলেদের অনেক লেখাপড়া আছে। তার না বুঝতে পারার কারণ নাই, পাঠক হিসেবে আমি যা লিখছি এটা ইফেক্টেড করছে। তো এই জিনিসগুলো বলা যায় না। এখন যে জিনিসগুলো আমার ধারণা করা যায়, সেটা হচ্ছে পরিশ্রম করা, এখন মেধা একশজনের মধ্যে ক'জনের আছে নো বডি নোজ। পরিশ্রম না করলে মেধা বোঝা যাবে না। পরিশ্রম যদি কেউ করে তা হলে বোঝা যাবে যে এর মেধা ছিল। সফল জিনিসটা যখন কারো হাত থেকে বেরিয়ে আসবে এবং তখনই বোঝা যাবে যে এর মেধা ছিল।
চঞ্চল আশরাফ : বিশ্বসাহিত্য তো আপনি কিছু না কিছু অধ্যয়ন করেছেন, আমরা নিশ্চিত। সেই পাঠ থেকে যদি পাঁচটি গ্রন্থ নির্বাচন করতে বলি তা হলে আপনি কোন পাঁচটি গ্রন্থ নির্বাচন করবেন?
শহীদুল জহির : সফল গল্প আমি যেভাবে পড়েছি, স্ট্রাকচারেলি, যেমন ধরেন জ্যাক লন্ডনের 'টু বিল্ড এ ফায়ারস', আমার কাছে সবচেয়ে ভালো গল্প এইটা। আমি এটাকে কেন ভালো বলবো কেন সফল বলবো আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। কারণ এর মধ্যে গল্প আছে, কিন্তু খুবই সিম্পল। মনে হয় সফল গল্প যেটি, আপনার বিষয়বস্তু যেটি, সেই বিষয়ের একটি সাবলীল গ্রহণযোগ্যতা। হতে পারে এটি পার্টিকুলার চিন্তা বা মনন, তার সঙ্গে একটা রেসোনেন্স থাকতে হবে। এটি একটি বিষয় এটি তৈরি করতে হবে আপনাকে, উই হ্যাভ টু ফ্রি। এটি একটি। এটি হচ্ছে বিষয়বস্তু। আরেকটি হচ্ছে কাঠামোগতভাবে এটাকে কীভাবে তৈরি করবেন। কারণ যে বিষয় নিয়ে গল্প লেখা হচ্ছে ওই বিষয় নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখা হতে পারে। কাজেই আপনাকে ওইটাকে পৃথক করতে হবে, এটা যে প্রবন্ধ নয়, এটা যে সাহিত্য, আপনাকে স্ট্রাকচারেলি এটাকে সাহিত্য করে তুলতে হবে। তবে সেখানে ক্রিয়েটিভিটির প্রসঙ্গ আছে। বিষয়বস্তু উপস্থাপনার একটি বিষয় আছে। বিষয়বস্তুর মাত্রায় এক ধরনের ক্রিয়েটিভিটি লাগবে। এতে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এক ধরনের ক্রিয়েটিভিটি লাগবে। এ দুটো যদি একত্রিত করা যায় তা হলে হতে পারে।
চঞ্চল আশরাফ : আপনার কথাসাহিত্যিক জীবনে, বাংলা এবং বিদেশি ভাষায় আপনার অনুপ্রেরণাদানকারী লেখক কারা?
শহীদুল জহির : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মার্কেজ, রাশিয়ান ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে যারা সবাই, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়। তুর্গেনিভ, চেখভ। এরা সবাই এক সঙ্গে বেঁচে ছিলেন, এক সঙ্গে কাজ করেছিলেন এবং বড় লেখক। বাংলাদেশের সাহিত্যে মনে করি, সাম্প্রতিক হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, শওকত আলী, তারপরে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, এরা আমার কাছে মনে হয় যে ঠিক একই রকম, এরা খুব ভালো লিখেছেন।
চঞ্চল আশরাফ : কিন্তু একটু আগে আপনি যে কথা বললেন গল্পভাষার ক্ষেত্রে- যে গল্পে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ সেই মানদণ্ডে যদি আমরা বিচার করি তা হলে দেখব যে শওকত আলীর গল্পের ভাষা খুব সৃষ্টিশীল নয়।
শহীদুল জহির : হতে পারে হ্যাঁ বলেন...।
চঞ্চল আশরাফ : এমনকি মাহমুদল হকের ভাষাও কিন্তু খুব সৃষ্টিশীল নয়। মাহমুদুল হক, শওকত আলীর ভাষার দিকটা যদি বিচার করি তা হলে তারা কিন্তু এতোটা সৃষ্টিশীল নন, অন্যান্য লেখকের তুলনায়। তারপরও আপনার তাদের লেখা ভালো লাগল কেন?
শহীদুল জহির : হতে পারে, আমি ভাষার ব্যাপারে এতটা কেয়ারফুল না। শওকত আলী, না, আমি মাহমুদুল হক-এর কথা, মাহমুদুল হক খুব সিম্পল ভাষায় লেখেন, আমি মাহমুদুল হকের ভাষার ব্যাপারে একটি কথা বলতে চাই যে, তার ভাষা আমি এ্যাকাডেমিক্যালি ব্যাখ্যা করতে পারব না কিন্তু আমার ধারণা, মাহমুদুল হকের ভাষা সহজ। কিন্তু আমার কাছে ভালোই লাগে মাহমুদুল হকের ভাষা। আর শওকত আলী ও মাহমুদুল হকের লেখার বিষয়বস্তু খুবই ভালো। আমার কাছে যেটা মনে হয় যে খুবই ভালো বিষয়বস্তু একটু ভালো হলে আরও পর্যায়ে যেত, কিন্তু আমি মনে করি এই পাঁচ ছয়জন।
চঞ্চল আশরাফ : হাসান আজিজুল হকের ভাষা কিন্তু খুবই চমৎকার এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষারও একটা গঠন আছে। সেটাও অন্যতর।
শহীদুল জহির : মাহমুদুল হকের মধ্যে এটা একেবারে কম। কারণ, মাহমুদুল হকের মধ্যে ভাষার বিষয়ে এটা একেবারেই নাই। মাহমুদুল হকের ভাষা, আমার ধারণা, এটা কনশাসলি সাদামাটাভাবে লেখা।
রনজু রাইম : কিন্তু আমাদের এই স্যাটেলাইটের যুগে স্বল্প সময়ে প্রায় বিনা পরিশ্রমে মানুষ অনেক কিছু উপভোগ করছে, ফলে জনপ্রিয় লেখকদের বইয়ের বাজারও মন্দা, তার ওপর যদি লেখাকে জটিল করা হয় তবে এর পাঠক সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
শহীদুল জহির : আমি এ ব্যাপারে শিওর না, আমি চিন্তিত ছিলাম না কখনো। খুব বেশি পাঠক আমার মতো বা আমাদের মতো লেখকের বই পড়বে না কখনো।
রনজু রাইম : যদি খুব বেশি পাঠক আপনার বই না পড়ে, তা হলে আপনি লেখার মাধ্যমে যা বলতে চাচ্ছেন, যা প্রচার করতে চাচ্ছেন সেটা তো সম্ভব হবে না। মেসেজটা পৌঁছে দেবার জন্য একজন লেখকের পক্ষে নিজের লেখা বহুল পঠিত হবে এটাই কাম্য।
শহীদুল জহির : এটা একটা কনট্রাডিশন। আমি জানি না তিনি কী করবেন। আপনি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চাইবেন ঠিকই। আপনার রচনা আপনারই, আমি কিছুটা লঘু করেছি, তারপরও আমার রচনা ততটা লঘু হবে না, যতটা লঘু হলে ডিশ মিডিয়া বা ক্যাবল টিভির বিকল্প করা হয়, শামসুল হকের লেখাও খুব কম লোক পড়ে, আমার ধারণা হুমায়ূন আহমেদ-ই বেশি লোকে পড়ে এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনার তুলনায় আমার কিছু রচনা বেশ কঠিন। মানে স্ট্রাকচারারি। তো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তো আমার চেয়ে সহজ, স্ট্রাকচারেলি, কাঠামোগতভাবে, বর্ণনায়, অন্যদিকে বলছি না, বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে বলছি না। এইসব ক্ষেত্রে, যে কারণে বেশি লোক পড়েনি। এখন আপনি কত সহজ হবেন এটা একটা প্রশ্ন, আমি আগের চেয়ে রচনার ক্ষেত্রে লঘু হয়েছি বলতে চাচ্ছি না, কিন্তু আগের চেয়ে একটু রিলাক্সড। আমার মনে হচ্ছে, কারণ আমি একটা গল্প লিখেছি যা একেবারেই সহজভাবে। তবে তাতেই যে সব মানুষ এটা পড়বে, এটা বিশ্বাস করা ডিফিকাল্ট।
রনজু রাইম : তাহলে আপনি লেখায় সমকালীনতার একটা প্রতিচিত্র তুলে ধরতে চান যা পরবর্তীকালে মানুষ ইতিহাসের মতো একটা কিছু বলে জানবে, তা সমকালে কোনো ভূমিকা রাখবে বা সমাজমানসকে প্রভাবিত করে একটা পরিবর্তন আনবে এটা আপনি চান না।
শহীদুল জহির : না, পরিবর্তন লেখক চাইলেই আনতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ প্রত্যেকে, যারা সাহিত্য করে তারা একটি বিষয়বস্তু নিয়েই সাহিত্য করে। কিন্তু সেই সাহিত্য যদি প্রবল বিপণনধর্মী সাহিত্য না হয় তবে সব সাহিত্যেই একটা মেসেজ থাকার কথা। কিন্তু সেই মেসেজটা প্রকট নয়, কেউ প্রকটভাবে প্রচার করে না এবং কোনো মেসেজ না থাকলেও সাহিত্যে একটা মেসেজ থাকে। মানবিকতাবোধের মেসেজ থাকে, একটি সহমর্মিতার মেসেজ থাকে, আপনার যদি রাজনৈতিক মেসেজ নাও থাকে, ভালো মানুষ হওয়ার একটি মেসেজ থাকে, খারাপের কাছে যে ভালো হেরে যাচ্ছে এর মধ্যেও একটি মেসেজ থাকে। যে মন ভালোর দিন খুবই সঙ্গীন, তো ভালোর জন্য এগিয়ে আসা দরকার। কিন্তু মেসেজ থাকলেই যে সমাজ বদলে যাবে তা না, আসলে সাহিত্য সমাজ বদলায় না, সাহিত্য মানুষের ভেতরে কতগুলো...।
রনজু রাইম : মানবিকতা।
শহীদুল জহির : কতগুলো মানবিকতা ডেভেলপ করে না ওইভাবে, কতগুলো কেমিক্যাল পরিবর্তন আনে যে বিষয়ে সে সচেতন থাকে না। আপনার ঘরের পাশে যদি একটি ফুলগাছ থাকে, বাড়ির পাশে মহল্লার পাশে, এই ফুলগাছ আপনাকে কীভাবে হেল্প করে? এটা কীভাবে হেল্প করে আপনি জানেন না, কিন্তু করে, আপনাকে সাহিত্যও তাই, সাহিত্য মানুষকে এইভাবে ইফেক্ট করে। সেটা ভালো মানুষের ক্ষেত্রে অবশ্যই, মানবিক হওয়ার ক্ষেত্রে, রেসপনসিভ ক্ষেত্রে। সাংস্কৃতিক দিক থেকে আরও উঁচু হওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। কিন্তু এগুলো একদম কনশাসলি করা হয়। একদম সচেতনভাবে সাহিত্য পড়ার ফলে অল্প অল্প করে মানুষের মনে এই পরিবর্তনটা হয়। সেটা ঠিক গবেষণা না করলে তো আইডেন্টিফাই করতে পারব না যে এই সাহিত্য পড়ার ফলে এই জনগোষ্ঠী হয়েছে।
রনজু রাইম : একজন লেখকের জীবৎকালে স্বীকৃতির ব্যাপারটাকে আপনি কতোটা পজিটিভলি নেবেন?
শহীদুল জহির : পেলে ভালো, না পেলে তো জোর করে নেওয়া যাবে না।
চঞ্চল আশরাফ : এই উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা এখন একটা আলোচিত বিষয়, উপমহাদেশের এমনকি তার বাইরেও। ঝুম্পা লাহিড়ী পুরস্কার পেলেন, এখন এই ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা কি উপমহাদেশের আমাদের নিজস্ব ভাষার সাহিত্যের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে?
শহীদুল জহির : আমার মনে হয়, প্রভাবিত করবে, কারণ আমাদের অনেকেই এখন বাজে ইংরেজিতে সাহিত্য রচনার চেষ্টা করবে। তারা বাংলায় লিখলে ভালো লিখত কিনা আমি সেটা বলতে পারব না, কারণ এমনও হতে পারে যে সে বাংলায় লিখলে হয়তো ভালো লিখত না, কিন্তু এটা একটা প্রবণতা হবে, ইংরেজিতে লিখে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়া এটার লোভ তো থাকবেই, বাংলাদেশে এটা এখনও হয় নাই। তবে ইন্ডিয়ায় এটা হচ্ছে।
চঞ্চল আশরাফ : কিন্তু সেলিনা হোসেন সম্প্রতি বলেছেন যে বাঙালিরা ভালো ইংরেজি জানে না। যে কারণে তারা আন্তর্জাতিকভাবে পৌঁছাতে পারছে না, এ জন্যে আমরা পিছিয়ে পড়ছি এবং ভারতীয়রা এগিয়ে যাচ্ছে।
রনজু রাইম : এটা হয়তো ঠিক যে রবীন্দ্র উত্তরকালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা যদি ইংরেজিতে অনুবাদ হতো তাহলে হয়তোবা সাহিত্যে আর একটি নোবেল আমাদের ঘরে আসতে পারতো।
শহীদুল জহির : হুঁ, হুঁ, আমি তো মনে করি এইটা, যে পৃথিবীর লোকেরা আমাদের কাজ সম্পর্কে জানে না। সেটা ঠিক আছে। এবং পৃথিবীর লোকের আমাদের সাহিত্য জানা উচিত ছিল। তো পৃথিবীর লোকের আমাদের মতো গরিব দেশের সাহিত্য এসে পড়ে জানবে না। তো আমাদেরকে এগিয়ে গিয়ে ইংরেজিতে লিখে তাদেরকে জানাতে হবে।
রনজু রাইম : এক্ষেত্রে আমার মনে হয় সরাসরি ইংরেজিতে না লিখে নিজেদের ভাষার অনবদ্য রচনাকর্মগুলো ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করাই শ্রেয়।
শহীদুল জহির : আমারও সেটাই মনে হয়, যে লেখক, এবং সব লেখকই যে ভালো ইংরেজি লিখবে এমন কোনো কথা নেই। তাকে যে ভালো ইংরেজি লিখতে হবে এমনও কথা নেই এবং ভালো ইংরেজি লিখলে বাংলাদেশ কনটেক্সেটে সমস্যা, ইন্ডিয়ার কথা আলাদা। ইন্ডিয়া একটা বাইলিংগুয়াল কান্ট্রি অলমোস্ট এবং তারা কনশাসলি এটা করছে। দে ডিড ইট, ভেরি কনশাসলি। এবং তারা মধ্যবিত্ত পর্যায়ে ইংরেজি যে চর্চা করেছে, এটা ভালো করেছে। সেটা আমাদের ক্ষেত্রে হয়নি। তো আমাদের এখানে লিখে এটা করা সম্ভব না, আমাদের এখানে ট্রান্সলেশন হতে পারে। স্বীকৃতির বিষয়টি, সাহিত্যকর্মে কেন করা হয়? বাংলাদেশের মানুষ সাহিত্যকর্ম কেন করে, কার জন্য করে? আমার তো মনে হয় যে আমাদের প্রথম টার্গেট বাংলাদেশেরই লোক। আমি একটু আগে যেটা বললাম যে আপনার বাড়ির সামনে যদি একটা ফুলের বাগান থাকে, সেটির দ্বারা ওই এলাকার জনগণ ইফেক্টেড হয়, তো আপনি তো ওইটা তৈরি করেন ওই এলাকার লোকের জন্য। আপনি সাহিত্যকর্ম করেন যাদের জন্য তারা তো আপনার একেবারে ইমিডিয়েট প্রতিবেশী। যারা এদেশের লোক তাদের জন্য। এবং এটা সেখানে ফেলে রাখার মতো, আপনি কতগুলো বই ফেলে রাখলেন, তার ভেতর মানুষ মনে করেন এই বই তারা একটা গুণগত পরিবর্তনের জন্য। সেটা কনশাসলি না, খুবই সারটেইন ওয়েতে একটা পরিবর্তন। এর পরে বিদেশের লোক এটা জানলো কি না, কারণ এখন স্বীকৃতির প্রশ্ন এসে গেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। আমি জানি না বাংলাদেশের লোক ইংরেজি লিখে ভালো করতে পারবে কিনা, তবে যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে, বাইরে যাচ্ছে তাদের ভেতরে থেকে যদি কেউ ইংরেজিতে লিখে ঝুম্পা লাহিড়ী হয় হতে পারে।
চঞ্চল আশরাফ : ঝুম্পা লাহিড়ীর যে ইংরেজি সেটাও কিন্তু খুব উন্নত ইংরেজি না।
শহীদুল জহির : ইন্ডিয়ান সাহিত্যের একটি বিষয় আছে, ইন্ডিয়ান সাহিত্যের একটি বিষয় হচ্ছে যে, যারা ইন্ডিয়ান সাহিত্য পড়ে, তারা দুটি আগ্রহ নিয়ে পড়ে, এদের একটি নৃ-তাত্ত্বিক আগ্রহ থাকে। কারণ এদের টার্গেট প্রুফ করা, ঝুম্পা লাহিড়ীর বই বা অরুন্ধতী রায়ের বই, এটা টার্গেট প্রুফ করা। কিন্তু ইন্ডিয়ান লোক, তাদের তো ইংরেজিতে এগুলো পড়ার দরকার নাই। তারা তো এইসব বিষয়, অরুন্ধতী রায় বা ঝুম্পা লাহিড়ী যেসব লিখছে, এসব জানে। ঝুম্পা লাহিড়ীর যে সাহিত্য সে সাহিত্য ইন্ডিয়াতে বহু হয়েছে। এরকম বহু সাহিত্যিক আছেন ইন্ডিয়ায় যাদের নাম পৃথিবীতে কেউ জানে না, কিন্তু ইন্ডিয়ার লোক জানে। কাজেই ইন্ডিয়ার লোকের জন্য ঝুম্পা লাহিড়ীর বই অত ইম্পরটেন্ট না। ওই যে চমৎকারিত্ব, এবং ওই যে একটি জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনের যে চিত্র বৈচিত্র্য যা অন্যের কাছে ধরা পড়ে। সেটা তো ইন্ডিয়ার লোকের কাছে নেই। বিদেশের লোকের কাছে নেই। বিদেশের লোকের কাছে এটা আছে। এবং এবং বিদেশিরা এসব সাহিত্য একটি নৃ-তাত্ত্বিক স্টাডির অংশ হিসেবে বোধহয় পড়ে। আফ্রিকান স্টাডি আছে ইংল্যান্ডে, ওরিয়েন্টাল লংম্যান আফ্রিকানদের ব্যাপারগুলো চমৎকার, তারা পিঠের ওপর ছাগলের চামড়া নিয়ে হেঁটে যায়, হাতে বল্লম। এই যে বিষয়গুলো, এটি একটি প্রসঙ্গ হয়। এবং এই প্রবণতা তো সাহিত্যে আছেই। ঝুম্পা লাহিড়ী বলেন, ঝুম্পা লাহিড়ীতে তো কম, কিন্তু অরুন্ধতী রায়ে প্রবলভাবে আছে। এই জিনিসগুলো পরিবেশন করার, তাই না? এই যে টার্গেট মানে ইংরেজি পাঠকের জন্য এইগুলো পরিবেশনের একটা প্রবল আগ্রহ আছে এখানে। এইগুলো ভালো মতো কাজ করে। তারা সাহিত্য পরিবেশনের যে স্ট্রাকচারড ওয়ে সেটা অবজারভ করে তারা এজেন্ট নিয়োগ করে। লিটারেরি এজেন্ট নিয়োগ করে, অরুন্ধতী রায় যেটা করেছেন। তারা প্রমোট করে এটাকে।
চঞ্চল আশরাফ : এটা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই।
শহীদুল জহির : অবশ্যই, কারণ ওখানে প্রকাশকদেরও তো পাঠক আছে এবং প্রকাশকদেরও তো লেখা লাগে। তারাও সাহিত্যকর্ম চায়। তো এই যে নিয়োগ করে এজেন্ট, সে এটাকে প্রমোট করে। তো এখানে একজন সেলিনা হোসেন, একজন শহীদুল জহির তো এগুলোর ধারে কাছেও নাই। কারণ আমরা এই কাজটায় যেতে পারিনি। প্রফেশনালিজমই ডেভেলপ করেনি আমাদের মাঝে। লবিং করে, আমার ধারণা ইন্ডিয়ান লবিং ইজ ভেরি ইম্পরটেন্ট। পৃথিবীতে ইন্ডিয়ান হওয়াটা খুবই ইম্পরটেন্ট এবং সেটার কতগুলো যথার্থ কারণ আছে। একটা বাংলাদেশি ভালো পাণ্ডুলিপি যতো পরিশ্রম করে পাশ করার জন্য আমার ধারণা ইন্ডিয়ান পাণ্ডুলিপি সহজে পাশ হয়ে যাবে যদি তা ভালো হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রথমেই একটা নেগেটিভ আইডিয়া হবেই। বাংলাদেশের গোষ্ঠীগত পরিচয় খুবই খারাপ পৃথিবীতে। এখানে অনেক লোক আছেন যারা আইনস্টাইন না হতে পারেন, কিন্তু গোষ্ঠীগতভাবে বাংলাদেশের কথা যদি বলেন, সে পরিচয় তো আপনি ছাড়তে পারবেন না, আপনি যদি বলেন যে আপনি চঞ্চল আশরাফ, আপনার কথাবার্তা বা কোথাও গিয়ে যদি অংশগ্রহণ করেন আপনার একটা গুণগত মাত্রা আছে। তখন আপনাকে একভাবে বিচার করবে এবং আপনি যখন বলবেন যে আই এম ফ্রম বাংলাদেশ, তখন আপনাকে বিচারের অন্য একটি মাত্রা তৈরি হবে। এইসব মাত্রা ভালো না। বাংলাদেশের একটি পাণ্ডুলিপি বহির্বিশ্বে আমার ধারণা কম গুরুত্ব পাবে।
চঞ্চল আশরাফ : কিন্তু শওকত ওসমান অনূদিত হয়েছেন পেঙ্গুইন থেকে-
শহীদুল জহির : শওকত ওসমান অনূদিত যেটা হয়েছে, হতে পারে, আমার ধারণা এটা প্যাট্রোনাইজেশনে কেউ ছিলেন। শওকত ওসমানের অনুবাদ এটা পেঙ্গুইন করছে তো নিশ্চয়ই, এটা ইন্ডিয়ান পেঙ্গুইন করেছে মনে হয়। নাকি ইংল্যান্ড থেকে হয়েছে? পেঙ্গুইনের একটি অংশ কিন্তু ইন্ডিয়ায় আছে। ফলে বাংলাদেশের কিছু লেখা তো এখান থেকেও যেতে পারে। এর মাধ্যমেও যেতে পারে। আমরা আসলে ইন্টারন্যাশনাল কনটেক্সটে অনুবাদ এখন দাঁড় করাতে পারব কিনা আমার সন্দেহ আছে। তো এই যে ইন্ডিয়ান পেঙ্গুইন, শওকত ওসমান, আমার ধারণা এইভাবে গেছে, এই পরিচিতির চ্যানেলে। এরা এটার সঙ্গে জড়িত। তারা পেঙ্গুইনের আসল অফিস, তার সঙ্গেও জড়িত। আমার ধারণা শওকত ওসমানের এটা এখান থেকে হয়েছে এবং এটার মূল্যমান টাকায় লেখা, রুপিতে লেখা।
চঞ্চল আশরাফ : হ্যাঁ রুপি, ডলারেও আছে।
শহীদুল জহির : হ্যাঁ ডলারে থাকতে পারে, কিন্তু যেহেতু এটা রুপিতে সুতরাং বেসিক্যালি এটা এখান থেকে করা। যেমন সত্যজিৎ রায়ের কিংবা অদ্বৈত মল্লবর্মণের যে অনুবাদটা, এটা অনুবাদ হয়েছে তো ঐ 'তিতাস একটি নদীর নাম'। ঐ একই জায়গা থেকে হয়েছে, একই পেঙ্গুইন, এরা করেছে।
চঞ্চল আশরাফ : কিন্তু আফটার অল সেটা তো যাচ্ছে?
শহীদুল জহির : হ্যাঁ তা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যেটা ধরছি ইন্ডিয়ান পাইপ লাইনটা, ওকে ফাইন এটা ঠিক আছে। কিন্তু এই যাওয়াটায় পরিচয়ের প্রসঙ্গটাও আছে। যেমন ঝুম্পা লাহিড়ী, বা অরুন্ধতী রায় একদম অপরিচিত একজন লেখক, তিনি একজন লিটারেরি এজেন্ট নিয়োগ করে ওটা প্রমোট করলেন, সেটা তারা পারলেন, বিকজ অব বিগ ইন্ডিয়া। কারণ ইন্ডিয়ার ব্যাপারে মানুষের একটা শ্রদ্ধাবোধ আছে। এবং তাদের কৌতূহলও আছে। সে জন্য এটা অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবং বাংলাদেশের ওইটা চলে গেলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা খুব ডিফিকাল্ট, এখানে এটা মাধ্যম হতে পারে। ইন্ডিয়ান পেঙ্গুইনের মাধ্যমে।
চঞ্চল আশরাফ : আমরা যদি আপনাকে এখন বলি যে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতার ভিতর থেকে বিশ্ব সাহিত্যের পাঁচটি উপন্যাস নির্বাচন করুন?
শহীদুল জহির : 'পুতুলনাচের ইতিকথা' বাংলা সাহিত্য, বিশ্ব সাহিত্যের অংশ, 'সি-উলফ' ধরব, মার্কেজের 'ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড', আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'কাঁদো নদী কাঁদো', দেবেশ রায়ের 'তিস্তা পারের বৃত্তান্ত'।
চঞ্চল আশরাফ : মিলান কুন্ডেরা?
শহীদুল জহির : মিলান কুন্ডেরা পড়িনি।
চঞ্চল আশরাফ : সালমান রুশদি?
শহীদুল জহির : না, সালমান রুশদি একদমই প্রিয় না। আপনি এটা বলতে পারেন, 'থিংস ফল এপার্ট' অসাধারণ একটা লেখা, এটা পাঁচটা বইয়ের মধ্যে থাকতে পারে।
চঞ্চল আশরাফ : আমাদের এখানকার কারো কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। আমাদের এখনকার সাহিত্য, যেমন আমরা লিখছি, কেমন; আপনার কী ইমপ্রেশন?
রনজু রাইম : লিটল ম্যাগাজিন এবং দৈনিক দু-ধারার গল্প লেখকদের মধ্য থেকে-
শহীদুল জহির : হ্যাঁ, দৈনিকের চেয়ে লিটল ম্যাগাজিনের লেখাই আমার ভালো লাগে, কারণ লিটল ম্যাগাজিনের লেখক অনেক স্বাধীনভাবে দেখেন। দৈনিকে বোধহয় এক ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকে যে লিমিটের ভেতরে লিখতে হবে। আমি জানি না আপনাকে বলে কি-না। এক পেজের ভিতরে বা আধা পেজের ভিতরে, ওদের তো, হিসাব থাকে, কিন্তু ওরা কিছু করতেও পারে না। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের এটা নেই, ফলে আপনি ফ্রিলি লিখতে পারেন। আমি সবার লেখা পড়িনি, কিন্তু আমাদের ইয়াংগার গ্রুপের যেটা মনে হয় আমার যে, কয়েকজনের কথা বলছি আমি আগে, যে এরা খুবই ভালো লেখে। আরও যারা ইয়াংগার লেখক আছে তাদের ভিতরে আমি সম্ভাবনাটা দেখতে পাচ্ছি, এটাই হচ্ছে প্রথম কথা। কিন্তু এই সম্ভাবনাটাকে এগিয়ে নিতে হবে এবং এই সম্ভাবনাটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত আছে। সম্ভাবনাটা দেখার একটা অর্থ হচ্ছে তাদের মেধা আছে বলে মনে হচ্ছে। আমি আগেই বলেছি, মেধা এবং শ্রম এক সঙ্গে হলেই এটা হবে, আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই। কারণ কার মেধা আছে আমি জানি না তো-
চঞ্চল আশরাফ : এটা আনপ্রেডিক্টেবল।
শহীদুল জহির : আনপ্রেডিক্টেবল, ফুল ফুটলেই না বুঝব যে, এই গাছে ফুল ফুটত, আর না ফুটলে কী করে বুঝব যে ওই গাছে ফুল ফুটত কি ফুটত না। দেয়ার ইজ নো গ্যারান্টি। এবং এটা কীভাবে ফুটবে, নো বডি নোজ। আমার ভেতর মেধা আছে কি-না কীভাবে বুঝব, কাজ করতে করতে হবে, না হয় হবে না। তখনই বোঝা যাবে, যখন ফুলটা ফুটবে, যে মেধা ছিল না হলে হতো না। লঘু শ্রমে ফুল ফোটে না, সাহিত্যিক ফুল, তো, আমার ধারণা যে মেধার পরিচয় যদি পাওয়া যায়, বাকিটা তারা করবে কি-না, এবং সেটা যদি করে, তাহলে মনে হবে আমাদের এতো হতাশ হওয়ার কিছু নাই। আমরা একশ' দু'শ সাহিত্যিক পাব না, আমরা যদি একটা জেনারেশনে পাঁচজন করেও পাই, তা হলে তো আমাদের হয়ে যায়। আমার মনে হয় হয়ে যায়, এটা হচ্ছে ঘটনা যে অনেক দূর পর্যন্ত চেষ্টা করতে হবে। অনেক দূর পর্যন্ত।
চঞ্চল আশরাফ : আমরা বরং এই প্রশ্ন দিয়েই শেষ করি, কি রনজু, নাকি তোমার আর কোনো প্রশ্ন আছে? আমি বলি, আপনার সামনে কী সাহিত্যিক পরিকল্পনা আছে?
শহীদুল জহির : আমার সামনে সাহিত্যিক পরিকল্পনা হচ্ছে যে, আমি একটা উপন্যাস লিখব, এটা হচ্ছে আপাতত আমার টার্গেট। এটাই ফার্স্ট টার্গেট আমার, এর পরে কী করব, জানি না। তো একটি উপন্যাস তো লিখবই।
রনজু রাইম : কী নিয়ে, কোন আঙ্গিকে লিখবেন তা কি পরিকল্পনা করে ফেলেছেন?
শহীদুল জহির : পরিকল্পনা এখনও করিনি, আমি এটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। বিচার বিবেচনা করে দেখছি। কিন্তু সেটা লিখব, লিখতে শুরুও করিনি, ধরেন এক মাস দু’মাসের মধ্যে শুরু করব তা-ও না, তবে এটা আমার মাথার মধ্যে আছে। তবে আমার ধারণা যে গল্প লেখাটা কিছু সময়ের জন্য বাদ দিতে হবে। মাঝেমধ্যে যে ছোটখাটো দু’একটা গল্প লিখছি এ জিনিসটাকে বাদ দিতে হবে, বাদ দিয়ে এটা করতে হবে।
চঞ্চল আশরাফ : ধন্যবাদ আপনাকে।
শহীদুল জহির : অনেক ধন্যবাদ; আপনারা এই যে কষ্ট করে ইন্টারভিউ করলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ