মৌসুমী কাদের
মানুষ কীভাবে বাঁচে, কিভাবে আমরা জীবন পার করি ‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পটি তাই নিয়ে ভাবায়। গল্পের শুরুটি একটি হাসপাতালের এমারজেন্সি দৃশ্য দিয়ে। দুজন আধবয়েসি আর এক বুড়ো একটা লোককে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটা পা ঝুললে আর একটা পা আঁকশির মতো বুড়োর কাঁধে আটকানো। লোকটার শরীরের বাকি অংশে আধবয়েসি দুজনের ঘাড়ে কুকুরকুণ্ডলি হয়ে আছে। এমারজেন্সি অভ্যর্থনার লোকটি চোখ তুলে তাকালো,কিছু দেখলো না। টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আর ভুরুতে গিঁট তুলতে থাকলো।
বুড়ো ঘড়ঘড়ে গলায় বললো, হুজুর রোগী এনেছি।
এমারজেন্সির লোকটি খেঁকিয়ে উঠে বললো, বেশ করেছো। নাচবো?
‘কথি রাখবো?’
আমার মাথায়। বলে গলা পাল্টে বললো,নামাও,আরে মেঝেতে নামাও।
এই দৃশ্যটি গল্পের শুরুতেই বেদনা জাগায়। বাংলাদেশের কোটি কোটি নিরন্ন ভূমিহীন গ্রামের সাধারণ চাষাদের জীবন এইরকমই সত্য এবং অবহেলিত। অভ্যর্থনাতো দূরে থাক, ঠিক মত বসবার অধিকার তাদের জীবনে নেই। এমনকি প্রাত্যহিক জীবনের জরুরী চাওয়াটাও এমন বিপর্যস্ত! এই গল্প সেইসবের একটি উদাহরন।
গল্পের সারাংশ
ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে জমিরুদ্দির পায়ে ঢোকে বাবলার কাঁটা, টেনে বের করতে গিয়ে ভেঙ্গে অর্ধেকটা বেরিয়ে আসে। কয়েকদিনপর সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে পুঁজ। কাঁটা বের করতে ডাকা হয় নাপিতকে। কিন্তু সে ছিদ্রমুখে নরুন ঢুকিয়ে ভাঙ্গা কাটা বের করতে গিয়ে ঢুকিয়ে দেয় বিষ। সপ্তাখানেকের মধ্যে পা ফুলে ঢোল। ব্যথার জ্বালায় অস্থির জমিরুদ্দিন। আর এই সূত্রেই গ্রামবাসীদের কাঁধে চড়ে হাসপাতালে যাওয়া। এবং তারপরই মুখোমুখি এমারজেন্সি রিসেপশনের। ডাক্তার জমিরুদ্দির কাছে এসে তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষণ দেখে বুড়োর দিকে চেয়ে বলেন, এ বাঁচবে না। যা হবার হয়ে গিয়েছে। এখন কিছু করার নেই’। সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। এমারজেন্সির লোকটি উচ্ছাস করে বলে, ‘হাসপাতালে মরার শখ হয়েছে’।
চোখের সামনে সারি সারি রোগী। হাসপাতালে জায়গা না থাকলে কোথায় রাখা হবে? মেঝেতে পা ফেলবার ঠাঁই নেই,বারান্দা দিয়ে হাঁটার উপায় নেই। ডাক্তার নেই,ওষুধ নেই। চারিদিকে অব্যবস্থা, অনাচার। মানুষ মানুষের ভাষাতেই কথা বলে, কিন্তু কেউ কারোটা শোনেনা। তবু বুড়ো তার ময়লা হাফ-শার্টের পকেট খুঁজে আধখানা শক্ত টক গন্ধঅলা রুটি বের করে জমিরুদ্দিকে দেয়। ফোঁস করে তার কানের উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলে জমিরুদ্দি বললো, মরে তো যাবো চাচা- আর দেখা হবে না। মনে কিছু লিয়ো না।
মূল ঘটনা
ষাট থেকে আশির দশক (যখন গল্পটা লেখা হয়েছিল), এই পঞ্চাশ বছরে সমাজে মৃত্যু আর ক্ষুদা ছাড়া গল্পকার আর কিছু দেখেননি। সমাজের ক্ষয়, মানুষের ক্ষয়,যন্ত্রণা আর নিষ্পেশন এগুলো তার লেখায় অক্ষরে অক্ষরে দাগ কেটেছে। মৃত্যুকে তিনি এঁকেছেন জীবনকে চেনার জন্য এবং তার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। জীবনের গায়ে চাবুকের দাগগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখায়। শোষক এবং শোষিত উভয়ের কন্ঠেই তিনি দেখেছেন হতাশা, অনাস্থা। ‘ঘোড়ার ডিম হবে, গরমেন্ট কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে ঘোড়ার ডিম পাড়বে। এক হাজার টাকা বেতন দিচ্ছে-কোন গ্রেড দেবে আমাদের? সিক্সথ না সেভেনথ? বেতন বাড়িয়ে লাভ? জিনিসের দাম না কমলে বেতন বাড়লে কি হবে? জিনিসের দাম কমাও। মানে উৎপাদন বাড়াও। বেঞ্চি বললো, বেতন দিয়েই বা দরকার কি! বৌ সারা মাসের একটা ফর্দ করে দেবে- সরকারকে দিয়ে দেবো। সেই সব জিনিস তুমি গরমেন্ট সাপ্লাই করো। বেতন চাই না। সেই জন্যেই তো সরকার বলছে, উৎপাদন বাড়াও। বেঞ্চি ভয়ানক রেগে গেল, তুই চুপ করে কর শালা,তোর পাছার গর্ত মাটি দিয়ে বুজিয়ে ধানগাছ লাগাবো। উৎপাদন বাড়াও! ঐ চাষাগুলো বসে আছে- বলে সে আঙুল দিয়ে বুড়ো আর আধবয়েসি দুজনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, ওদের বলে দ্যাখ, উৎপাদন বাড়াও। কি চাচা,উৎপাদন বাড়াবে? উৎপাদন? সে বুড়োকে জিগ্যেস করে।’
একটা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হবার পরো যেন কাংখিত সমাজটি দূরেই রয়ে গেছে। সেই ক্ষুধা,সেই দারিদ্র্য,সেই শোষণই বারবার পত্রিকার মূল সংবাদ। যত উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে,যত অর্জনের কথা হচ্ছে, ততটাই বেড়ে চলেছে অবক্ষয়। তার নিজস্ব ভাষায় ‘যদি শিল্প-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে উৎপাদন বা সম্পদের সব অর্জন পোঁটলা বাঁধি,তাহলেও পনেরো কোটি মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখবে,ওসব কিচ্ছু না। কাজেই সেই মৃত্যু আর ক্ষুধাই আমাদের সমাজ।‘
মূল চরিত্র
গল্পের মূল চরিত্র জমিরুদ্দি। পেশায় দিনমজুর, চাষা। নিরন্ন ভূমিহীন অবহেলিত মানুষ। হাসপাতালের রোগী। মূল কাহিনীটি যাকে ঘিরে ডালপালা মেলেছে। আর তার সঙ্গে আছে আরো দুই মজুর আর বাবার বয়েসী বৃদ্ধ। এরা সবাই গ্রামবাসী। বিপন্ন শ্রেনী। বিপরীতে আছে সরকারী হাসপাতালের সুবিধাভোগী ঘুষখোর ডাক্তার আর নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী। আরো আছে অন্যান্য রোগী; পুলিশ, দারোগা আর রাশেদ। বিত্তের দ্বন্দ, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, চারিত্রিক সমস্যার প্রকট, সবকিছুর সংগে গল্পের চরিত্রগুলো একাকার হয়ে গেছে। এবং শেষ পর্যন্ত নিম্নশ্রনীর ছিন্নমূল ও উদ্বাস্তু পরিচয়টিই আরো করে উন্মুক্ত হয়েছে।
ভাষা ব্যবহার
হাসানের ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা বরাবরই অনবদ্য। কিন্তু সেটাই কখনো তাঁর শেষ লক্ষ্য থাকেনা। বা কোন বিশেষ কারনের জন্যে তিনি ভাষাকে ব্যবহার করেননা। যেকোন পরিস্থিতি বা পরিবেশ বিবেচনায় খুব সহজভাবে তার ভাষা বদলে যায় এবং খুব স্বতস্ফুর্ত ও সহজভাবে এর প্রয়োগ করেন। এই গল্পটিও তার ব্যতিক্রম নয়, সরলরৈখিক কাহিনী এবং ঘটনার নির্মাণ। আমরা দেখি গ্রামবাসীরা আঞ্চলিক ভাষায় টেনে টেনে কথা বলছে আর ঘটনাগুলো একের পর বয়ে চলছে। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ তো আর প্রতিদিন মৌলিকভাবে বদলায় না। তার চোখ মোটামুটি ঠিকই থাকে। সেদিক থেকে হয়তো এই বৈচিত্র্যের মধ্যেও আমার ভাষাটাকে আলাদা করে চেনাও যেতে পারে।‘
হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক এবং শ্রেষ্ট ছোটগল্পকার। লিখে চলেছেন ছয় দশক ধরে। কেবল গল্প লিখেও যে শক্ত লেখক হিসেবে অবস্থান করা যায় এবং স্থায়ী আসন পাওয়া যায়, তিনি তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বানিয়ে বানিয়ে উনি গল্প লেখেননি। বাস্তবে যা দেখছেন তারই বর্ণনা করছেন নিজস্ব শৈলী এবং আংগিকে। তার গল্প পড়লে মনে হয় যেন দৃশ্যগুলি চোখের সামনে ভাসছে। ক্যামেরা নয়, কলমেই তিনি ছবি তুলছেন। আসলে তিনি ছবিও তোলেননা, ছবি লেখেন। তাই অবিকল সত্যগুলো চিরচেনা দৃশ্য হয়ে চোখের সামনে ঝুলতে থাকে।
-------------
পাতালে হাসপাতালে গল্পটি পড়ার লিঙ্ক
৩১/১০/২০১৫
লেখক পরিচিতি
মৌসুমী কাদের
গল্পকার। সুরকার।
কানাডা প্রবাসী।
মানুষ কীভাবে বাঁচে, কিভাবে আমরা জীবন পার করি ‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পটি তাই নিয়ে ভাবায়। গল্পের শুরুটি একটি হাসপাতালের এমারজেন্সি দৃশ্য দিয়ে। দুজন আধবয়েসি আর এক বুড়ো একটা লোককে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটা পা ঝুললে আর একটা পা আঁকশির মতো বুড়োর কাঁধে আটকানো। লোকটার শরীরের বাকি অংশে আধবয়েসি দুজনের ঘাড়ে কুকুরকুণ্ডলি হয়ে আছে। এমারজেন্সি অভ্যর্থনার লোকটি চোখ তুলে তাকালো,কিছু দেখলো না। টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আর ভুরুতে গিঁট তুলতে থাকলো।
বুড়ো ঘড়ঘড়ে গলায় বললো, হুজুর রোগী এনেছি।
এমারজেন্সির লোকটি খেঁকিয়ে উঠে বললো, বেশ করেছো। নাচবো?
‘কথি রাখবো?’
আমার মাথায়। বলে গলা পাল্টে বললো,নামাও,আরে মেঝেতে নামাও।
এই দৃশ্যটি গল্পের শুরুতেই বেদনা জাগায়। বাংলাদেশের কোটি কোটি নিরন্ন ভূমিহীন গ্রামের সাধারণ চাষাদের জীবন এইরকমই সত্য এবং অবহেলিত। অভ্যর্থনাতো দূরে থাক, ঠিক মত বসবার অধিকার তাদের জীবনে নেই। এমনকি প্রাত্যহিক জীবনের জরুরী চাওয়াটাও এমন বিপর্যস্ত! এই গল্প সেইসবের একটি উদাহরন।
গল্পের সারাংশ
ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে জমিরুদ্দির পায়ে ঢোকে বাবলার কাঁটা, টেনে বের করতে গিয়ে ভেঙ্গে অর্ধেকটা বেরিয়ে আসে। কয়েকদিনপর সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে পুঁজ। কাঁটা বের করতে ডাকা হয় নাপিতকে। কিন্তু সে ছিদ্রমুখে নরুন ঢুকিয়ে ভাঙ্গা কাটা বের করতে গিয়ে ঢুকিয়ে দেয় বিষ। সপ্তাখানেকের মধ্যে পা ফুলে ঢোল। ব্যথার জ্বালায় অস্থির জমিরুদ্দিন। আর এই সূত্রেই গ্রামবাসীদের কাঁধে চড়ে হাসপাতালে যাওয়া। এবং তারপরই মুখোমুখি এমারজেন্সি রিসেপশনের। ডাক্তার জমিরুদ্দির কাছে এসে তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষণ দেখে বুড়োর দিকে চেয়ে বলেন, এ বাঁচবে না। যা হবার হয়ে গিয়েছে। এখন কিছু করার নেই’। সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। এমারজেন্সির লোকটি উচ্ছাস করে বলে, ‘হাসপাতালে মরার শখ হয়েছে’।
চোখের সামনে সারি সারি রোগী। হাসপাতালে জায়গা না থাকলে কোথায় রাখা হবে? মেঝেতে পা ফেলবার ঠাঁই নেই,বারান্দা দিয়ে হাঁটার উপায় নেই। ডাক্তার নেই,ওষুধ নেই। চারিদিকে অব্যবস্থা, অনাচার। মানুষ মানুষের ভাষাতেই কথা বলে, কিন্তু কেউ কারোটা শোনেনা। তবু বুড়ো তার ময়লা হাফ-শার্টের পকেট খুঁজে আধখানা শক্ত টক গন্ধঅলা রুটি বের করে জমিরুদ্দিকে দেয়। ফোঁস করে তার কানের উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলে জমিরুদ্দি বললো, মরে তো যাবো চাচা- আর দেখা হবে না। মনে কিছু লিয়ো না।
মূল ঘটনা
ষাট থেকে আশির দশক (যখন গল্পটা লেখা হয়েছিল), এই পঞ্চাশ বছরে সমাজে মৃত্যু আর ক্ষুদা ছাড়া গল্পকার আর কিছু দেখেননি। সমাজের ক্ষয়, মানুষের ক্ষয়,যন্ত্রণা আর নিষ্পেশন এগুলো তার লেখায় অক্ষরে অক্ষরে দাগ কেটেছে। মৃত্যুকে তিনি এঁকেছেন জীবনকে চেনার জন্য এবং তার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। জীবনের গায়ে চাবুকের দাগগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখায়। শোষক এবং শোষিত উভয়ের কন্ঠেই তিনি দেখেছেন হতাশা, অনাস্থা। ‘ঘোড়ার ডিম হবে, গরমেন্ট কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে ঘোড়ার ডিম পাড়বে। এক হাজার টাকা বেতন দিচ্ছে-কোন গ্রেড দেবে আমাদের? সিক্সথ না সেভেনথ? বেতন বাড়িয়ে লাভ? জিনিসের দাম না কমলে বেতন বাড়লে কি হবে? জিনিসের দাম কমাও। মানে উৎপাদন বাড়াও। বেঞ্চি বললো, বেতন দিয়েই বা দরকার কি! বৌ সারা মাসের একটা ফর্দ করে দেবে- সরকারকে দিয়ে দেবো। সেই সব জিনিস তুমি গরমেন্ট সাপ্লাই করো। বেতন চাই না। সেই জন্যেই তো সরকার বলছে, উৎপাদন বাড়াও। বেঞ্চি ভয়ানক রেগে গেল, তুই চুপ করে কর শালা,তোর পাছার গর্ত মাটি দিয়ে বুজিয়ে ধানগাছ লাগাবো। উৎপাদন বাড়াও! ঐ চাষাগুলো বসে আছে- বলে সে আঙুল দিয়ে বুড়ো আর আধবয়েসি দুজনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, ওদের বলে দ্যাখ, উৎপাদন বাড়াও। কি চাচা,উৎপাদন বাড়াবে? উৎপাদন? সে বুড়োকে জিগ্যেস করে।’
একটা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হবার পরো যেন কাংখিত সমাজটি দূরেই রয়ে গেছে। সেই ক্ষুধা,সেই দারিদ্র্য,সেই শোষণই বারবার পত্রিকার মূল সংবাদ। যত উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে,যত অর্জনের কথা হচ্ছে, ততটাই বেড়ে চলেছে অবক্ষয়। তার নিজস্ব ভাষায় ‘যদি শিল্প-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে উৎপাদন বা সম্পদের সব অর্জন পোঁটলা বাঁধি,তাহলেও পনেরো কোটি মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখবে,ওসব কিচ্ছু না। কাজেই সেই মৃত্যু আর ক্ষুধাই আমাদের সমাজ।‘
মূল চরিত্র
গল্পের মূল চরিত্র জমিরুদ্দি। পেশায় দিনমজুর, চাষা। নিরন্ন ভূমিহীন অবহেলিত মানুষ। হাসপাতালের রোগী। মূল কাহিনীটি যাকে ঘিরে ডালপালা মেলেছে। আর তার সঙ্গে আছে আরো দুই মজুর আর বাবার বয়েসী বৃদ্ধ। এরা সবাই গ্রামবাসী। বিপন্ন শ্রেনী। বিপরীতে আছে সরকারী হাসপাতালের সুবিধাভোগী ঘুষখোর ডাক্তার আর নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী। আরো আছে অন্যান্য রোগী; পুলিশ, দারোগা আর রাশেদ। বিত্তের দ্বন্দ, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, চারিত্রিক সমস্যার প্রকট, সবকিছুর সংগে গল্পের চরিত্রগুলো একাকার হয়ে গেছে। এবং শেষ পর্যন্ত নিম্নশ্রনীর ছিন্নমূল ও উদ্বাস্তু পরিচয়টিই আরো করে উন্মুক্ত হয়েছে।
ভাষা ব্যবহার
হাসানের ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা বরাবরই অনবদ্য। কিন্তু সেটাই কখনো তাঁর শেষ লক্ষ্য থাকেনা। বা কোন বিশেষ কারনের জন্যে তিনি ভাষাকে ব্যবহার করেননা। যেকোন পরিস্থিতি বা পরিবেশ বিবেচনায় খুব সহজভাবে তার ভাষা বদলে যায় এবং খুব স্বতস্ফুর্ত ও সহজভাবে এর প্রয়োগ করেন। এই গল্পটিও তার ব্যতিক্রম নয়, সরলরৈখিক কাহিনী এবং ঘটনার নির্মাণ। আমরা দেখি গ্রামবাসীরা আঞ্চলিক ভাষায় টেনে টেনে কথা বলছে আর ঘটনাগুলো একের পর বয়ে চলছে। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ তো আর প্রতিদিন মৌলিকভাবে বদলায় না। তার চোখ মোটামুটি ঠিকই থাকে। সেদিক থেকে হয়তো এই বৈচিত্র্যের মধ্যেও আমার ভাষাটাকে আলাদা করে চেনাও যেতে পারে।‘
হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক এবং শ্রেষ্ট ছোটগল্পকার। লিখে চলেছেন ছয় দশক ধরে। কেবল গল্প লিখেও যে শক্ত লেখক হিসেবে অবস্থান করা যায় এবং স্থায়ী আসন পাওয়া যায়, তিনি তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বানিয়ে বানিয়ে উনি গল্প লেখেননি। বাস্তবে যা দেখছেন তারই বর্ণনা করছেন নিজস্ব শৈলী এবং আংগিকে। তার গল্প পড়লে মনে হয় যেন দৃশ্যগুলি চোখের সামনে ভাসছে। ক্যামেরা নয়, কলমেই তিনি ছবি তুলছেন। আসলে তিনি ছবিও তোলেননা, ছবি লেখেন। তাই অবিকল সত্যগুলো চিরচেনা দৃশ্য হয়ে চোখের সামনে ঝুলতে থাকে।
-------------
পাতালে হাসপাতালে গল্পটি পড়ার লিঙ্ক
৩১/১০/২০১৫
লেখক পরিচিতি
মৌসুমী কাদের
গল্পকার। সুরকার।
কানাডা প্রবাসী।
4 মন্তব্যসমূহ
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুনঅনেক ভালো লাগলো। খুবই উপকৃত হলাম।
উত্তরমুছুনthanks
উত্তরমুছুনসেরা ছিল✌️
উত্তরমুছুন