এমদাদ রহমান : ২০১৫ সালে পড়া গল্পের সালতামামি

গল্পপাঠ : ১.
 ২০১৫ সালে কত সংখ্যক গল্প পড়েছেন?


এমদাদ রহমান : ১
কয়েকটি মাত্র গল্পে, কয়েকটি পর্বে বা মাত্রায় যেন কেটে গেল এই বছরটা। ২০১৫ সাল। এই বছরের পাঠ-অভিজ্ঞতার গল্পগুলি আমাকে নস্টালজিক করেছে। ভাবিয়েছে। বাঁচিয়ে রেখেছে। আশাবাদী করেছে। আমি খুব জোর করে বলতে চাই- আমার ভেতর তারা জেগে থাকতে চেয়েছে। গল্প খুব বেশি পড়তে হয়নি। ঘুরে ফিরে আগের পঠিত গল্পগুলির কাছেই ফিরতে চেয়েছি। দেশ ছেড়ে বিদেশে এসে টের পেয়েছিলাম- আমি যেন সাহিত্য-পাঠ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছি।
নিজের ভেতর ভয়ানক শূন্যতা টের পাচ্ছিলাম। ইংল্যান্ডে পাঁচ বছরের বেশি হয়ে গেছে। হাতের কাছে বাংলা বই নেই। লন্ডনের বইঘরগুলিতে অপ্রয়োজনীয় বইয়ের ভীতিকর স্তূপ...
এক সময় আমাজন ডট কম থেকে বই কিনতে শুরু করি। মহামূল্যবান বই। কামুর নোটবুক। হেমিংওয়ের চিঠি। ক্যালভিনো'র গদ্য। বেকেটের জার্মান ডাইরি। মানের জীবনস্মৃতি। বোর্হেসের সাক্ষাৎকার। দারবিশের জার্নাল। ব্রেইতেন ব্রেইতেনবাখের দেশত্যাগ। দস্তয়েভস্কির স্কেচবুক। রিটার্ন টু মাই নেটিভ ল্যান্ড। দ্য ম্যাজিশিয়ান অভ লুবলিন... দেশে থাকলে আমি কোনওভাবেই এই বইগুলির ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারতাম না। দেশ থেকে আনা- আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, শিবনারায়ণ রায়ের নির্বাচিত প্রবন্ধ আর আত্মজা ও একটি করবী গাছ, অসীম রায়ের ডাইরি... হ্যাঁ, এই বইগুলি পড়েই দিন কেটেছে। তবে, সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনেই পড়তে হয়েছে- নতুন লেখকের গল্প। ক্ল্যাসিক গল্প। গল্পের কলকব্জা-গল্পের যাত্রা-গল্পের ভাঙাগড়া। আর্ট অভ ফিকশন। হ্যাঁ, বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত গল্পও পড়া হয়েছে। পড়া হয়েছে সরাসরি বই থেকে। কখনও লেখকের একটি বিশেষ সাক্ষাতকারও গল্পের স্বাদ দিয়েছে। কখনও একটি গল্প পড়ে উপন্যাসের বিশালতা টের পেয়েছি... কখনও একেবারে নতুন একজন গল্পকার। হয়ত তাঁর প্রথম গল্পটাই পড়েছি। কয়েকজন লেখকের লেখা এই বছরই প্রথম পড়েছি। আগে নাম শুনিনি... এই হল একটি বছরের আনন্দ আর বেদনা। এই হল ২০১৫ সালের কথা।   



গল্পপাঠ : ২
কোন কোন মাধ্যম থেকে গল্পগুলো পড়েছেন?


এমদাদ রহমান : ২
হাসান আজিজুল হকের নির্বাচিত গল্প বইটি দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলাম। সেই ২০১০-এর জানুয়ারিতে। সেই সঙ্গে এসেছে অসীম রায়ের গল্প। কলকাতার প্রতিক্ষণ থেকে বের হয়েছিল। আফসার আমেদের গল্পের একটি সংকলন এনেছিলাম। সেটাও প্রতিক্ষণের। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পগুলি পড়েছি পিডিএফ ফর্মে। অনলাইনে পাওয়া। নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্পগুলি পেয়েছি পিডিএফ ফরম্যাটে। প্রতিক্ষণ গল্প সিরিজের। 'গল্পপাঠ' ওয়েভজিন থেকে পড়েছি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কিছু গল্প, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্পগুলি। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প আরামকেদারা। সাদিক হোসেনের বই পাইনি। 'বুকপকেট' ওয়েভজিন থেকে, গল্পপাঠ থেকে তাঁর গল্প পড়তে হয়েছে। তমাল রায় সম্পাদিত ওয়েভজিন 'ঐহিক' থেকেও বহু লেখা পড়েছি। পড়েছি 'কালিমাটি' থেকেও। লন্ডনের বইয়ের দোকানগুলিতে, অর্থাৎ লন্ডনের ব্রিক লেইনের বাঙালি বইয়ের দোকানে গেলে হতাশ হতে হয়েছে। ভাল বই নেই। বই যে নেই তা নয়, কিনে পড়বার মত বই নেই। তবুও বেশ কিছু বই পাওয়া তো গেছেই। অমর মিত্র। ভগীরথ মিশ্র। স্বপ্নময় চক্রবর্তী। অমিতাভ ঘোষ। এদের বই পাওয়া গেছে। নির্বাচিত গল্প। উপন্যাস। ইত্যাদি।


গল্পপাঠ : ৩
কোন কোন গল্পকারের গল্প পড়েছেন?


এমদাদ রহমান : ৩
অনেকের গল্পই পড়া হয়েছে। তারাশঙ্কর থেকে মানিক হয়ে বিভূতি, সমরেশ বসু, দেবেশ রায়, অমর মিত্র, কুলদা রায়, শিপা সুলতানা, মোজাফফর হোসেন, ইশরাত তানিয়া, হাসান আওরঙ্গজেব-সহ আরও অনেকের গল্পের পাঠক হয়েছি। এই বছরই প্রথম দীপেন ভট্টাচার্যের কয়েকটি গল্প পড়েছি। এবং আমার বিশ্বাস, আগামী দিনগুলোতেও এই প্রণম্য লেখক অসাধারণ সব গল্প লিখবেন।

গল্পপাঠ : ৪
ভাল লাগার গল্পগুলোর কয়েকটি নাম করুন। গল্পগুলো ভালো হয়ে উঠেছে কি কি কারণে সেগুলো উল্লেখ করুন।


এমদাদ রহমান : ৪
ভাল-লাগা গল্প? স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্প পড়েছি। মাত্র কয়েকটি লাইনের গল্প। গল্পের নাম- কথা। দ্বিতীয় গল্পের নাম- রাধাকৃষ্ণ। অমর মিত্রের বেশকিছু গল্প পড়া হয়েছে। পড়েছি সাদিক হোসেনের গল্প। 'ললিপপ লাগিলু' নামের গল্পটির কথাই মনে থাকবে। পরের পড়েছি 'জ্যোতিদিদির বিড়াল।' লিখেছেন কুলদা রায়। 'পাড়ি' নামে সমরেশ বসুর একটা গল্প আছে। আগে বহুবার পড়েছি। এই কাহিনী নিয়ে গৌতম ঘোষ ছবি করেছেন। দেখেছি। এই বছরও গল্পটি পড়েছি। আবার। আবারও পড়তে হবে। গল্পটি টেনেছে। কী সেই টান? টান আসলে শক্তি। কোনও কোনও লেখা পড়লে নিজের ভিতর শক্তির সঞ্চার হয়। সেই শক্তিতে জীবনটাকে কিছুটা দেখা যায়। হ্যাঁ, কিছু গল্প ফিরে পড়তেও হয়। ফিরতে হয় সেই গল্পগুলির কাছে। হাসান আজিজুল হকের 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'-সহ অন্যান্য গল্পগুলি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নিরুদ্দেশ যাত্রা, তারা বিবির মরদ পোলা-সহ আরও কিছু গল্প। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পগুলি। মাঝে মাঝে সমস্ত পাঠ- অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্চর্য গল্প- ভণ্ডুলমামার বাড়ি। ভণ্ডুলমামার বাড়ি গাঁথা আর শেষ হয় না! পুরো একটি জীবন শেষ হয়ে যায়। বাংলার গ্রাম উজাড় হয়। অভাব, খরা, মারী'তে মানুষ জন্মভিটা ছেড়ে পালায়। শহর হয় মানুষের নিয়তি। গ্রামবাংলা রাতবিরেতে খা খা করে! ভণ্ডুলমামা তবু হাল ছাড়েন না| তার অসমাপ্ত বাড়ির কাজ বছরে বছরে, বছর ধরে এগোয়| তবু তিনি শেষ করতে পারেন না...গল্পটি বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য| যেন বিভূতিভূষণ গল্পে বাংলার ইতিহাস লেখলেন! যেন এক ডকুমেন্টারি। আমাদের জীবনবাস্তবতা। এই বাস্তবতার প্রতীক যেন ভণ্ডুলমামার বাড়ি! 
আমার জীবনে একটা বিশিষ্ট জায়গা দখল করেছে হাসান আজিজুল হকের একটি গল্প। ফেকু এনাম আর সুহাসদের গল্পটি। 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'। এই নিয়ে ঠিক কতবার প্রিয় এই গল্পটি পড়েছি খেয়াল নেই। প্রথম প্যারাটা তো প্রায় মুখস্থই হয়ে গেছে-
এখন নির্দয় শীতকাল, ঠাণ্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়... এখানে এই কথাটাকেই গল্প মনে হচ্ছে। চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়! তারপর?
হাসান লিখছেন- অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। কীভাবে জানি না। এই একটি দৃশ্য সারাজীবনের জন্য মনের ভেতর গেঁথে গেল। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিমের হ্যাম্পশায়ারে নির্দয় শীতকাল এসেছে, আবার। গত পাঁচ বছর ধরেই এসেছে। এসে জানালার পাশে মুখ ভার করে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে চলে গেছে... রোদন রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক এসে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছে... কখনও শীতরাত্রিতে পাশে বসে ঠেকেছে ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত এক শঙ্খচিল। দূরে, শীতে জবুথবু ম্যাগনোলিয়া...ইলিয়াসের নিরুদ্দেশ যাত্রাও তেমনি এক প্রিয় গল্প। 'এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তার রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বইছে, 'তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।' আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারেরর ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল... ইলিয়াসের গল্পটি এভাবে আমাদের মনোজগতে ঢুকে পড়তে চায়। আমাদের আক্রান্ত করে রাখে। আমরা গল্পের রঞ্জু হয়ে যাই আর ভাবতে থাকি- 'আম্মার ঘরে কি যেনো ফেলে এসেছি।' আম্মার ঘরে আমরা কী ফেলে আসি? ২০১৫ সালে পড়া গল্পগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গল্প- পাসিং শো... গল্পপাঠের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার কারণে পড়তে পেরেছি অনেক অনেক গল্প। তার ভেতর দিয়ে আবারও পড়তে শুরু করেছি মার্কেজের 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর'। জি এইচ হাবীব অনূদিত। পড়তে শুরু করেছি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বহু কাঙ্ক্ষিত বইটি। দীর্ঘ পাঁচ বছর দেশ থেকে বহু দূরে থেকে যে বইটির জন্য প্রতিটি দিন ভেবেছি হঠাৎ পেয়ে গেছি সেই বইটি। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডাইরি। আলবেয়ার কামুর ডাইরি পড়েছি। কবিদের লেখা চিঠি পড়েছি...তবু, গল্পপাঠের সঙ্গে রক্তেমাংশে জড়িয়ে পড়ার পর আসলে গল্পই পড়তে চেয়েছি আর বার বার ফিরে এসেছি হাসান আজিজুল হকের লেখার কাছে। আত্মজা ও একটি করবী গাছের সেই বুড়োর  কাছে। আমৃত্যু আজীবনের করমালি, রহমালির কাছে। পরবাসী গল্পের ওয়াজদ্দির কাছে। ঘরগেরস্থির রামশরণের মৃত মেয়েটির কাছে। নামহীন গোত্রহীনের মমতার কাছে। ক্রমাগত লম্বা হতে থাকা বাশেদের কাছে। জীবন ঘষে আগুনের পাশে। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর একটা গল্প পড়েছি, যে গল্পটা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে রেখে গেছে। আসলে, যায়নি। গল্পটির কাছে বার বার ফিরে গেছি। লোকে অনুগল্পই বলবে, ছাপাও হয়েছে অনুগল্প হিসেবে। কিন্তু আমার কাছে কোনওরকমেই গল্পটি অনু নয়। বিশাল ব্যাপ্তি আছে তার। কয়েকটি লাইনের ভেতর, কবিতার রহস্যময়তার মত সমস্ত জগত সংসার যেন ঢুকে পড়েছে! এখন মাঝে মাঝে ভাবি, কীভাবে লিখলেন স্বপ্নময় এই গল্পটি! ঈশ্বর কি তাঁর হাতের ওপর ভর করেছিলেন? তা জানি না। কোনও একদিন ঈশ্বর-সঙ্গে দেখা হলে জেনে নেয়া যাবে। আসলে, গল্প বলি, উপন্যাস বলি, পড়তে গেলেই, লেখকরা তাদের শব্দ-কথায় নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করেন। এই যে এখন কথাগুলি লিখছি, হাসানের সেই বুড়টাকে মনে পড়ছে- ভীষণ শীত করছে ওর, তবু বলছে, কাঁপতে কাঁপতে বলছে- বুঝলে, আমি যখন এখানে এলাম... আমি একটা করবী গাছ লাগাই, বুঝলে? চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে। 
আনোয়ার শাহাদাতের কয়েকটি গল্প পড়েছি। এর মধ্যে একটি গল্পের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- সরোজিনী কদমবিবির গামছা কবর। 
পড়েছি দীপেন ভট্টাচার্যের বেশ কিছু গল্প। এই একজন খুব প্রিয় গদ্যকার আমার। গদ্যকার বলছি। তাঁর হাতে জাদু আছে। তিনি গদ্য লিখতে জানেন। তাঁর শব্দগুলি ঝকঝকে। আলোময়। মহাকাল লুকিয়ে থাকে তাঁর লেখায়। আলোর ভাষায় লিখতে জানেন তিনি। এই বছর পড়া লেখকদের নামের সঙ্গে আরও একজনের কথা বিশেষভাবে বলতে হবে। তিনি তমাল রায়। তাঁর গল্প আকারে আয়তনে ছোট হলেও বোধ ও ভাবনা বিস্তারে ব্যাপকতা তৈরি করতে পারে। যেমন তাঁর ছোটগল্প 'বাতিল ক্যারাভান'। একটা পুরনো গাড়িতে উঠে পড়েছি আমরা: বাবা, মা, দাদু, রমা, কুকুর ভুলু, এমনকি গলায় দড়ি দেওয়া মানদা পিসি; -শিল নোড়া, পুরোনো বালতি, কৃষ্ণ তুলসীর গাছ, ছেঁড়া মাদুর, বিশ্বাসকাকুর হিসেবের খাতা- সব... একটি পুরনো গাড়িতে করে যাত্রা! কিছুটা যেন পুরনোই হয়ে গেছেন তারা পরস্পরের কাছে... জীবনের জটিল এক সমীকরণ যেন আমাদেরকে দেখালেন তমাল রায়| আমরা জানি, শুধু এক বার নয়, এরকম গল্প আমাদেরকে পড়তে হবে বার বার। বহু বছর পর আবারও বাতিল ক্যারাভানে চড়ে আমাদের আবার আমাদের নিজেদের কাছেই ফিরতে হবে। 


গল্পপাঠ : ৫
সেরা গল্পটি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ বলুন।


এমদাদ রহমান : ৫
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি গদ্যও আমার কাছে গল্পপাঠের আনন্দ দিয়েছে। গদ্যটির নাম- গল্প লেখার গল্প।  আমার মতে, যারা গল্প লিখবেন বলে ঠিক করেছেন, তারা গদ্যটি মূল্যবান মনে করেই পড়বেন। সাদিক হোসেনের গল্প ললিপপ লাগিলু। পড়লে পাঠক টের পাবেন তিনি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী একটি গল্প পড়ে ফেলেছেন। গল্পের ভিতর গল্প যেন মাতৃগর্ভ হয়ে আছে। গল্পের ভিতর গল্প যেন উন্মাদ নৃত্য করছে। যেখানে গল্পটি শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই যেন অন্য গল্পের শুরু। পাঠককে চমকে দেন সাদিক হোসেন। অমর মিত্রের পাসিং শো গল্পটি অসাধারণ। এমন গল্প কি আর দ্বিতীয়টি আছে?
... রেকর্ডের আর এক দিকে সেই গান, নদীটি গিয়াছে চলিয়া...নদীটি গিয়াছে...। ছিল সে এমনই সন্ধ্যা। বাবার হাতের পাসিং শো সিগারেট পুড়ে যাচ্ছে। মুখ থমথম করছে। বাবা-মা ছেড়ে এসেছিল কপোতাক্ষ। কিন্তু ব্রতীন ছেড়ে এল কোন নদী? ব্রতীন সুরটি তোলার চেষ্টা করে চল্লিশ বছর আগের স্মৃতি থেকে। এই তো ব্রতীন পারছে। রাগটি ছিল মারোয়া...নদীটি গিয়াছে চলিয়া... চলিয়া গিয়াছে। গুনগুন করে ওঠে ব্রতীন। পারবেন গুলাম ভাই?
গুলাম হুসেন না বলে না সাব, হাঁ বলছে, লেকিন টাইম লাগবে...
পাসিং শো- অমর মিত্রের অসাধারণ গল্প। গল্পটি আসলে পড়া শেষ হয় না। যতই শেষ হয়, সমাপ্তি আসে, ততোই শুরু হয়... অভিজিৎ সেনের গল্পটির নাম ব্যথার জগৎ। ব্যথার জগৎ, আমাদের সম্পর্কের জগৎ। এই গল্পটির উদ্দেশ্য কি জীবনের সঙ্গে জীবনের বন্ধন রচনা? গল্পের গোঁসাই কি সেই বন্ধনের প্রতীক? আমাদের কি মনে একবারও মনে পড়েছে কুরোশাওয়ার রশোমন ছবিটির কোনও অনুষঙ্গ? কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করবার দর্শনটিকে? আমি জানি না, অভিজিৎ সেনের গল্পটি পড়তে পড়তে কোনও পাঠকের 'নো ম্যান্স ল্যান্ড' ছবিটির কথা মনে পড়বে কিনা। একটি ভয়ানক বাউন্সিং মাইনের উপর শুয়ে থাকা এক আহত সৈনিকের অসহায়ত্বের কথা মনে পড়বে কিনা! 'যুদ্ধের হাসপাতালে কাটা পা চুলকোচ্ছিল আহত সৈনিকের। শেষ পর্যন্ত মর্গের ডাঁই করে রাখা মৃত মানুষ এবং ব্যবছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট পা খানা খুঁজে বের করে চুলকে দিলে সৈনিকটি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে'- এই গল্পটি পড়ে, আমরা বুঝতে পারি- মানবমনের গভীর গোপনে লুকিয়ে থাকা যুদ্ধের বিভীষিকা, যা যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, মানুষের মনে থেকে যায়, চিরস্থায়ী হয়ে। দীপেন ভট্টাচার্যের নিস্তার মোল্লার মহাভারত গল্পটিও দীর্ঘদিন পাঠকের মনে জেগে থাকবে। আলোর ভাষা পড়তে পারা কয়েকজন মানুষের ভিতর গল্পটি আবর্তিত হয়েছে। গল্পে অতীত এসেছে, বর্তমান আসছে, আয়নার ভিতর দিয়ে আলোর প্রবহমানতা অনাগত ভবিষ্যতকে নির্দেশ করছে... 

গল্পপাঠ : ৬
আপনি কি মনে করেন-এই গল্পগুলো বাংলাদেশের চিরায়ত গল্পগুলোর সমতুল্য বা তাদেরকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে?

এমদাদ রহমান : ৬
আমার পঠিত এই গল্পগুলি বাংলাদেশের কিংবা বাংলা ভাষার চিরায়ত গল্পগুলোর সমতুল্য। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে- এই সময়ে এই গল্পগুলিই প্রতিনিধিস্থানীয়। কখনও গল্পগুলি বহুদূর তাদের শাখা বিস্তার করে দিয়েছে। তবে, বিচ্ছিন্ন মনে হয়নি তাদের। গল্পগুলি একটা পরম্পরা মেনে চলেছে। বাংলা গল্পের পুরাতনী চেহারার সঙ্গে তাদের বিরোধ বা দূরত্ব তেমন নেই। হ্যাঁ। চিরায়ত ব্যাপারটা খুব জরুরি একটা ব্যাপার। শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টি সম্ভারে কিছু কিছু ল্যান্ডমার্ক থাকে। সেই ল্যান্ডমার্ক পরম্পরা তৈরি করে। একটা দিক নির্দেশকের মত কাজ করে। পথ দেখায়। মানিকের 'প্রাগৈতিহাসিক' গল্পটি কি চিরায়ত নয়? জীবন যতই বদলে যাক না কেন, ভিখুকে মনে থাকে। কিংবা সাম্প্রতিক হাসান আজিজুল হকের 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'-এই নামটাই কি চিরায়ত নয়? দেশভাগের ভয়ানক বেদনা কি মিশে নেই এই নামে?  


গল্পপাঠ : ৭
বিদেশি গল্পের সঙ্গে এ গল্পগুলোর মানকে কিভাবে তুলনা করবেন?


এমদাদ রহমান : ৭
বোর্হেস, কালভিনো, সিঙ্গার, মার্কেজ, বেন ও'করি কিংবা এলিস মুনরো'র গল্পের সঙ্গে আমাদের বাংলা ভাষার গল্পগুলির দাঁড়াবার সেই ক্ষমতাটুকু আছে। কিন্তু বিদেশের বা অন্যভাষার গল্পের মানের সঙ্গে আমার পঠিত গল্পগুলোর মানের তুলনা করতে হবে কেন? তার কারণটি কি এইটাই যে সাহিত্যকে বিচার করতে হয় দেশকালের সীমারেখা পার হয়ে? হ্যাঁ, এটা যেন একটা প্রবাহ। এক অনন্ত জীবন প্রবাহ। দেশ নয়, কাল, মহাকাল; মানুষ! বহুস্বর। বহু দেবতা। ছায়ারেখা। জন্ম। মৃত্যু। লড়াই। রামকিঙ্কর বেইজ একটা কথা বলেছিলেন। কথাটা আমার কাছে মন্ত্রের মতো- মহাশয় আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র... কিংবা বার্গম্যানের সেভেন্থ সীল... অন্ধকারে, অন্ধকারে; থ্রু অ্যা গ্লাস ডার্কলি! আসলে, অন্যরকম লেখার সঙ্গেও পরিচিত হতে হয়। দেখতে হয় তলস্তয় কী লিখেছেন। গ্যোটে ফাউস্তে কী করেছেন। বিদেশের গল্পের প্রকরণটা আমাদের জানা দরকার।   
আমরা যখন আউটসাইডার পড়ছি, দ্য ট্রায়াল পড়ছি, নো ম্যান্স ল্যান্ড সিনেমাটি দেখছি কিংবা পড়ছি এলিয়টের পড়ো জমি... আবার যখন হাঁসুলী বাঁকের উপাখ্যানের কাছে ফিরছি, পুতুলনাচের ইতিকথায় ফিরছি- কী দেখছি? হ্যাঁ, আমরা যখন বোর্হেস পড়ছি, তখন হয়ত ভাবছি- হায়, আমাদের ভাষায় তো এমন লেখক একজন নেই! আমরা যখন মার্কেজের সরলা এরেন্দিরা ও তার নিদয়া ঠাকুমার অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনীটি পড়ছি কিংবা পর্দায় দেখছি, তখন আমার পাঠের গল্পগুলিকেও দেদীপ্যমান হয়ে থাকতে দেখি। দেখি, মার্কেজের গল্পের পাশে আমার বাংলা ভাষার গল্প জ্যোতিদিদির বিড়াল, পাসিং শো, নিস্তার মোল্লার মহাভারত, সরোজিনী কদমবিবির গামছা কবর, ব্যথার জগৎ কিংবা ভণ্ডুলমামার বাড়ি বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছে... তবে, এখনকার গল্পকারদের লেখার ভাষাটি মৃত। লেখা মৃত। ভাবনাটি মৃত। আমাদের লেখকরা ঠিক লেখক বলতে যা বোঝায়, তা নন। ইমাজিনেশন নেই। কৌশলটি অজানা। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু আফ্রিকান গল্প পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে- গল্পে আমরা আগে এগিয়ে থাকলেও, এই সময়ে এসে পিছিয়ে পড়েছি। এখন সব মৃত লেখক। মৃত লেখা। এই সময়ে একজন পরিশ্রমী গল্পকার পাওয়া যাচ্ছে না। এখন প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা নেই। সাহিত্য সম্পাদকরা লেখাটি ছাপিয়ে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। একবার পড়েও দেখেননি... এদিকে, লেখকটির প্রস্তুতি নেই। পাঠ নেই। সাহিত্য-পরম্পরা সম্পর্কে জানাশোনা নেই। পাঠের দরকার নেই। পাঠের সময়ও নেই... 'মহাশয় আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র'!     


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ