ছোটগল্প পাঠকের প্রস্তুতি

হামীম কামরুল হক

ছোটগল্পের প্রকৃত পাঠক খুব ভালো করে একটি বিষয় জানেন যে, গদ্যে লেখা এবং আকারে ছোট একটা কাহিনীকেই ছোটগল্প বলা হয় না। সাহিত্যর শুরুতেই গল্প ছিল। আদিবাসী বলে যাদের বুঝে থাকি তাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তাদের অনেকেরই সেই ভাষার বর্ণমালা নেই। ফলে লিখিত সাহিত্যও নেই। কিন্তু তাদের ভেতরও গল্পকথনের ধারা আছে। নানা উপকথা গাথা কেচ্ছা কাহিনী হরদম চর্চিত হচ্ছে। এশিয়া বা আফ্রিকার এইসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সেই কেচ্ছাকাহিনীর ভেতরে আছে দুর্দান্ত সব গল্প। আছে অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার প্রকাশ।
আছে দার্শনিক প্রতীতী। আর বিশ্বসাহিত্যের মূল ধারায় বৃহৎকথা, কথাসরিৎসাগর, জাতকের কাহিনী, বেতালপঞ্চবিংশতি, ঠাকুরমার ঝুলি থেকে আরব্যরজনী, পারস্যরজনী হয়ে ডেকামেরন, হেপ্টামেরন, ক্যান্টরবেরি টেলসসহ গ্রীমভাইদের উপকথা তো গল্পকথন ও নির্মাণের অসামান্য কীর্তি। কিন্তু এগুলো কোনোটাই ছোটগল্প নয়। এরপর অনেক ধাপ পার হয়ে ছোটগল্পের আবির্ভাব। মূলত তার আগমন ঘটে পত্রপত্রিকার পাঠকের জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে একটি কাহিনী উপস্থাপনার চিন্তা থেকে। ছোটগল্প আধুনিক পত্রপত্রিকার প্রাথমিক যুগে বিক্রি কতটা বাড়িয়েছিল বা বিক্রি বাড়াতে কতটা ভূমিকা রেখেছিল সেসব তো গবেষণার বিষয়। কিন্তু পাঠকের মন ভরেছিল ছোটগল্প পড়ে। কিন্তু তখনো প্রকৃত ছোটগল্প বলতে যা বোঝায় তার আর্বিভাব ঘটেনি। লেখকরা নকশাজাতীয় একটা কাহিনী বর্ণনা করতেন। তাকে সমাজের নানান অসংগতির প্রতি ব্যঙ্গ বিদ্রুপ থাকত। পাঠকও পড়ে মজা পেতেন। এসব প্রয়াস বলতে গেলে ওই প্রাচীন গল্পকথনের ধারায় আধুনিক কেচ্ছাকাহিনী মাত্র। লেখকের ব্যক্তিত্ব যতক্ষণ না তার প্রখন স্বাতন্ত্র্য নিয়ে হাজির না হল ততদিন ছোটগল্প তার হয়ে ওঠার পথ থেকে দূরবর্তীই থেকে গেল। লেখক তার জীবনবোধউদ্ভূত নিজস্বশৈলীতে ছোটগল্প রচনা শুরু করলেন তখনই বদলে গেল গল্প। তা কেবল একটা কাহিনী বর্ণনার স্তরে পড়ে রইল না। তার প্রখর আভাস ইংগিতে জীবনকে দেখা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজির হল। হতচেতনাতে ঘা দিল। এবং তা ঘটল মূলত গল্পের ভেতরে গল্পকে আড়াল করে দিয়ে।
বিষয়টি আরেকটু খোলতাই করে বলার চেষ্টা করা যাক। আমরা দেখেছি, লিখিত গল্পটি যখন কেউ মুখে অন্যকে বলতে যায় তাতে লেখক যেভাবে গল্পটি লিখেছেন সেভাবে তো আর তাকে গল্পটি শোনানো যায় না, বলার সময় পঠিত গল্পটির যা থাকে সেটি গল্পের গল্প, কিন্তু গল্পের লিখিত রূপটি আসলে ছোটগল্প। কারণ লিখিত রূপের ভেতরে থাকে লেখক প্রতিটি শব্দব্যাক্য কীভাবে ব্যবহার করছেন, কীভাবে পরিস্থিতি (সিকোয়েন্স) নির্মাণ করে ছোটগল্পটিকে স¤পন্নতা দান করলেন। ভাষাভঙ্গির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং যার মূল আশ্রয় এমন একটি বিষয় যা আসলে ছোটগল্পর বিষয়। ছোটগল্পের আদল ছাড়া যেটিকে আর কোনো মাধ্যমেই প্রকাশ হবে অসর্ম্পূণ। তাই কোনো লেখক যখন ছোটগল্পের নামে যা লিখছেন সেটি আসলে ছোটগল্পে বিষয় কিনা-- তা চিহ্নিত করা প্রকৃত ছোটগল্পের সবচেয়ে বড় দিক। কেবল বিষয় হলেই তো চলে না তাকে ছোটগল্প করে তুলতে হয়। কেউ কেউ বলেন, বিষয়-ই বলে দেবে গল্পটি কীভাবে লিখত হবে। বলে দেবে ভাষার প্রয়োগ, সূচনা থেকে সমপ্তি পর্যন্ত পৌঁছতে লেখকে কী করা লাগবে। এবং তখন এর ভাষা ও নির্মাণ এবং চরিত্র ও পরিস্থিতি মিলে একটি নতুন ছোটগল্পের জন্ম হবে।
এর ভেতরে সবার আগে লক্ষ্যণীয় হল ভাষা। আদতে লেখকের সেই ভাষার স্বাদ না পেলে ছোটগল্পটি পড়া হয় না। কিন্তু গল্পটি যদি অনূদিত হয়, তাহলে ভাষার চেয়ে এর নির্মাণ পরিস্থিতির ক্রমবিস্তার ও পরিণতিটিই প্রধান হয়ে ওঠে। রুশভাষায় লেখা চেখভের গল্প আমরা বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদে পড়ে থাকি। তাতে চেখভের ভাষার স্বাদ পাই না, এছাড়া যা পাই তাতেই গল্পকার হিসেবে চেখভের বিশিষ্টতা চিনে নিতে কষ্ট হয় না। অ্যালন পো, গোগল, মোপাসাঁ বা রবীন্দ্রনাথের তুলনায় তার আবেদনটি কতটা ভিন্ন তা সহজেই আলাদা করে নেওয়া যায়। এই যে চিনে নেওয়ার সামর্থ্য তা-ই ছোটগল্পের প্রকৃত পাঠকের সামর্থ্য। কিন্তু এই সামর্থ্য একদিনে তৈরি হয় না।
লেখক যেমন হুট করে জন্ম নেয় না। একই ব্যাপার আছে পাঠকের ক্ষেত্রে। যারা লেখেন তারা সবাই যেমন লেখন নন, গণ্ডা গণ্ডা বই প্রকাশ করেও নন, তেমনি শত শত বই পড়েও পাঠকই হয়ে উঠতে পারেন না অনেকে। কেবল একটা স্তরে রয়ে জান। সময় কাটাতে এরা কেবল পড়ে যান, বা বলা যায় নেশার মতো পড়ে যান, কিন্তু পাঠকের প্রকৃত সত্তাটি অর্জন করতে পারেন না। এই সত্তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়ে ওঠে, ম্যাচুরিটি অর্জন করে। সেই পাঠক শোপেনহাওয়ার-নিৎসে-রাসেল কি মিশেল ফুকো এবং বোর্হেস-মার্কেস-মিলান কুন্দেরার লেখা সমানভাবে সম্ভোগ করতে পারেন, পারেন ইতিহাসের গভীর বিশ্লেষণী কোনো লেখা। এছাড়া যারা কেবল নেশার মতো পড়ে যান তারা সেই ট্রেন যাত্রীর মতো-- জানালার পাশে বসার জায়গা পেয়ে সারা পথ বাইরের দৃশ্যাবলীতে দিকে তাকিয়ে থেকেছেন কিন্তু কিছুই আসলেই দেখেননি। তেমন করে দেখার জন্য দেখতে জানা শিখতে হয়।
আসলে স্বাভাবিক পরিণতি অতিরিক্ত কিছুর জন্য পরিশীলন বা চর্চা চাই-ই চাই। স্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে অনেকেই পড়তে লিখতে পারেন, যেভাবে একজন চিঠি লেখে বা চিঠি পড়ে। যেমন গলা ছেড়ে গান গাওয়ার ক্ষমতা অনেকেরই থাকে কিন্তু যিনি একই সঙ্গে গানটির ভেতরগত নির্মাণ বুঝতে পারেন, এর নোটেশনটি বুঝে নিতে পারেন তার জন্য মেধা ও চর্চা চাই। এটি স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় না।
তবে চর্চা করলেই যেকেউ শিল্পী হয়ে উঠেবেন সবাই তা নয়। তবে শিল্পী হয়ে উঠতে চর্চা চাই-ই চাই। অর্থাৎ যার ভেতর শিল্প হওয়ার ক্ষমতা আছে তাকে সত্যিকার শিল্পী হতে হলে পরিশ্রম করতেই হবে। ফলে যে ব্যক্তিটি বুঝতে পারেন তার মনটি সাধারণ পাঠকের মতো নয়, তিনি পড়ার জন্য আরো বিশেষ কিছু চান তাকে সেই বিশেষ কিছু পড়ে বোঝার জন্য পড়াটাকেই জারি রাখতে হবে। যিনি ছোটগল্প পড়েন তাকে ছোটগল্প পড়াটা চালিয়েই যেতে হবে। তাহলে তিনি আধুনিক ছোটগল্পের প্রকৃত পাঠক হয়ে উঠবেন।
আধুনিক ছোটগল্প আগে ছোটগল্পের আরেকটি পর্যায় আছে আমরা তাকে এর ক্ল্যাসিক পর্যায় বলতে পারি। ক্ল্যাসিক ছোটগল্পের ধারা পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই আছে। তবে এর প্রধান চার লেখক হলেন, এডগার অ্যালান পো, গী দ্য মোপাসাঁ এবং রবীন্দ্রনাথ। এর সঙ্গে আমরা তুর্গেনেভ, তলস্তয়, গোর্কির কথা মনে করতে পারি। পারি নাথালিয়ান হর্থন, হ্যারমান মেলভিলের কথা। ওস্কার ওয়াইল্ডের গল্পগুলো ফেবল আর বাস্তবতা মিশে ভিন্ন এক আবেদন তৈরি করে। সমারসেট মমও অনেকের প্রিয় ছোটগল্পকার। হারমেন হেস কি টমাস মানের গল্পগুলো যেকোনো পাঠকের চিরদিনের সম্পদ। পরবর্তীকালের কাফকা, হেমিংওয়ে, বোর্হেস, মার্কেসের মতো লেখকরা ছোটগল্পের এক একজন যুগন্ধর পুরুষ। জয়েস, সার্ত্রে কামু বা কুন্দেরা হাতে গোনা ছোটগল্প লিখলেও তা গুণগত বিচারে বিশ্বের সর্বকালের সেরাকয়েকটি গল্পের শিরোপা পাওয়ার যোগ্য। আইজাক বাশেভিস সিঙ্গার ইদ্দিসভাষায় ইহুদিজীবনের নানান দিককে সার্বজনীন করে তোলেন। তিনি ইহুদি লোকগাথা, পুরাণ আর কেচ্ছকাহিনীর মিশ্রণ ঘটিয়ে তাতে যোগ করেন ধ্র“পদী মাত্রা। অসাধারণ সব গল্প লিখেছেন গ্রাহাম গ্রিন। এর বাইরেও আরো অনেক লেখক আছেন যাদের ছোটগল্প পাঠ যেকোনো পাঠকের মহামূল্যবান অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারে। আমরা চীনা ল্যু স্যুন, ইংরেজ ডি এইচ লরেন্স, সাকী, আইরিস ফ্রাঙ্ক ও’ কোনোর, মার্কিন জন চিভার, ভারতীয় প্রেমচন্দ, কৃষণ চন্দর, ভৈকম মুহম্মদ বশির এবং আর কে নারায়ণ, পাকিস্তানি সাদাত হাসান মান্টো, জাপানি হারুকি মুরাকামি, এবং বাংলাভাষায় কমলকুমার-অমিয়ভূষণ মজুমদারদের মতো লেখকের লেখার কথা স্মরণ করি। এসব লেখকের লেখা ছোটগল্প পাঠকের তন্নিষ্ঠ (সিরিয়াস) মনোযোগ দাবি করে। সঙ্গে এও যোগ করে দেওয়া যায় বাংলাভাষায় যে পরিমাণ প্রকৃত ছোটগল্প লেখা হয়েছে তা নিয়ে কোনো পাঠক সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন।
২.
ছোটগল্পের লেখক বিশ্বজুড়েরই বিস্তর। কিন্তু দেখব বালজাকের ছোটগল্প বা হেনরি জেমসের ছোটগল্প বা তাদের তুলনায় অনেক পরের মার্কিন লেখক জন ও’হারার ছোটগল্প একসময় পাঠককে মাতালেও পরবর্তীকালে কোনো না কোনো দিকে তা সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। কারো আবেদন, কানো নির্মাণ, কারো বা চরিত্রচিত্রণ কারো বা দৃষ্টিভঙ্গি তার নিজের সময়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকলেও চিরন্তন পাঠকের চিরদিনের সম্বল হয়ে ওঠেনি। তারপরও এদের সবার গল্পই কমবেশি উপভোগ্য। তাদের সেই সময়কে চিনতে হলে, মানুষের মানমানসিকতার পরম্পরাকে বুঝে নিতে হলে তাদের গল্প আমাদের কাজে আসতে পারে।
কিন্তু সেটি কাজে লাগানোর আগে ছোটগল্প পড়ার মনটি গড়ে নিতে হয়। আর তা গড়ে নেওয়ার জন্য প্রথমত দরকার বিশ্বের সেরা গল্পকারদের গল্পর ধারাবাহিক পঠনপাঠন। একইসঙ্গে দরকার ছোটগল্পের আসল মেজাজটি শনাক্তকরণ। ইন্টারনেটে সহজেই ছোটগল্প ইতিহাস পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু উপন্যাস নিয়ে এতে যে বিপুল তথ্যের সমারোহ আছে ছোটগল্প নিয়ে তার সিকি পরিমাণও নেই। দুঃখ জনক হলেও সত্যি রবীন্দ্রনাথ নামে বিশ্বের সর্বকালের সেরা একজন ছোটগল্পকার আছেন তার নাম পর্যন্ত এতে ভুক্ত নয় অনেক মনস্বী লেখক কবিতা এবং উপন্যাস নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ও অত্যন্ত দরকারি প্রবন্ধ লিখেছেন কিন্তু ছোটগল্প নিয়ে তেমন প্রবন্ধ-নিবন্ধ আমরা পাইনি। বিশ্বছোটগল্পের ধারাবাহিত ইতিহাস জানার জন্য বাংলা ভাষায় মূলত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’ ছাড়া অনেকদিন আর তেমন কোনো বইয়ের দেখা বাংলাভাষায় মেলেনি। তবে শিশিরকুমার দাশের ‘বাংলা ছোটগল্প’ বইটিও পাঠকের কাজে আসবে। পরবর্তীকালে অনেক বই অবশ্য লেখা হয়েছে, কিন্তু তা মূলত বিভিন্ন লেখকের ছোটগল্পের আলোচনা। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও মানিকের ছোটগল্পই সবেচয়ে বেশি আলোচিত।
তবে বেশির ভাগ বইয়ের বিষয়সূচিতে আছে বিভিন্ন ছোটগল্পকারদের গল্পবৈশিষ্ট্য এবং তাদের অবদান নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ। ছোটগল্প কী, তার স্বরূপ এবং তার ভাষা, নির্মাণকৌশলের নানান দিক নিয়ে বোধ করি একটি পরিপূর্ণ বই এখনো বাংলাসাহিত্যের পাঠকরা পাননি। এই প্রসঙ্গগুলো উল্লিখিত বইগুলোতে যে আসেনি তা তো নয়, কিন্তু তা এর উৎস, অভিমুখ, বিষয়বৈচিত্র্যতে বিশেষ নজর দেওয়া। অর্থাৎ ছোটগল্পর আলোচনা মানে ছোটগল্পর ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে এর নিজস্ব বিধা ও গঠন প্রণালী নির্ধারণী নিদের্শক দিকগুলো কমই উপস্থাপিত হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের ‘ছোটগল্পের কথা’ বা সরোজমোহন মিত্রের ‘ছোটগল্পের বিচিত্রকথা’য় সেদিকে কিছুটা আলো ফেলা হয়েছে, যা থেকে পাঠক প্রকৃত ছোটগল্প শনাক্ত করতে পারেন। যদিও এসব বই কিছুটা একাডেমিক বা প্রতিষ্ঠানিক ধাঁচের, সেদিক থেকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছোটগল্পের সীমারেখা’-ই আমাদের সবেধন নীলমণি। কেননা বাংলাছোটগল্প কি বিশ্বছোটগল্প নিয়ে তাতে এর ইতিহাস ও সে-ই সে-ই ধারার গল্প ও তার বিষয়বস্তু নিয়ে নানান কথাবার্তা আছে। কিন্তু ছোটগল্প তা যেভাষায়ই লেখা হোক না কেন, সেই ছোটগল্প শিল্পমাধ্যম হিসেবে এর রকমসকম, তার রং ও ঢং নিয়ে লেখা বইই সবভাষায়ই বোধ করি হাতে গোনা। উপন্যাসের তত্ত্ব, শিল্পকৃতি, ভাষাপ্রয়োগ নিয়ে আমরা যত বই পাবো, ছোটগল্পে তত্ত্ব নিয়ে সেইরকম বই রচনার দিকে কেউই বোধ খুব একটা মনোযোগ দেননি। বিশেষ করে ছোটগল্প লেখকরা। বর্তমান বিশ্বের নামকরা লেখদের অনেক উপন্যাস থাকলেও ছোটগল্পের বই তেমন একটা তার লেখেননি। তারওপর ছোটগল্প নিয়ে, তার স্বরূপ নিয়ে লেখা তো দূরের কথা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শিল্পসাহিত্যের নানান বিষয়ের স্বরূপ ও ভূমিকা নিয়ে সিরিজ বই বের করার যে নজির আছে তাতেও ছোটগল্প নিয়ে আলাদা কোনো বই নেই। অক্সফোর্ড থেকে ‘অ্যা ভেরি সর্ট ইন্ট্রোডাকশন’ সিরিজেও এখন পর্যন্ত ছোটগল্প সম্পর্কিত কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। এসব মিলে মনে হয় সাহিত্যে ছোটগল্পের তত্ত্বীয় দিকটি নিয়ে কোনো আলোকপাত করার দাবি কি লেখকদের মধ্যেও জেগে ওঠে নি, তেমনি তা নিয়ে পাঠ করার দাবি পাঠকদের মধ্যেও কম। ফলে ছোটগল্প পাঠকের প্রস্তুতি আসলে তার নিজের ওপরই বর্তায় তিনি কতটা যত্নের সঙ্গে সেটি সম্পন্ন করবেন। এর ভালো দিক হলো এ পথে তিনি একেবারেই নিজের মতো এগিয়ে যেতে পারেন। ফলে ‘সর্টস্টোরি ফর বিগিনার্স’ নামের বইটি তার নিজের মনেই লিখে নিতে হবে।
৩.
তাহলে মোদ্দা কথা দাঁড়াচ্ছে ‘গল্পশাস্ত্র’ নামের কোনো বই যেহেতু সবভাষায়ই দুর্লভ ফলে সেটি ছোটগল্প পাঠককে নিজ থেকে স্ব স্ব মনোভূমিতে লিখে নিতে হবে। অনেকেই জানেন শাস্ত্র মেনে জীবনে কোনো কিছুই হুবহু করা যায় না, সেটি নীতিশাস্ত্র হোক কি অর্থশাস্ত্র হোক কি কামশাস্ত্রই হোক। বরং অনুপুঙ্খভাবে শাস্ত্র মেনে কিছু করতে গেলে বিড়ম্বনাই অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই ছোটগল্প কী-- চিনে নেওয়ার জন্য এবং ছোটগল্প পড়তে চাওয়া বা পড়তে থাকা পাঠককে নিজের বোধ বুদ্ধি বিবেচনার ওপর অনেকবেশি আস্থা রাখতে হবে। হ্যাঁ, আমরা যেসব বইয়ের কথা বললাম সেগুলো প্রাথমিকভাবে তাকে ছোটগল্পের পথরেখা ধরে এগুনোর দিকদর্শন দিতে পারে মাত্র, কিন্তু ছোটগল্পের দীর্ঘপথ শিল্পের যেকোনো শাখার মতোই দীর্ঘ এবং কেবলই তা ক্রমেই প্রসারিত হয়ে চলেছে। কারণ প্রতিনিয়ত ছোটগল্প লেখা হচ্ছে। বিষয়ে, আঙ্গিকে আর আবেদনে সেখানে নিত্য পালাবদল ঘটছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটানোও হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোটগল্পের নামে আয়তনে ছোট কাহিনীকে গল্প বলে চালানো বা স্রেফ কিছু পর্যবেক্ষণ ও বর্ণনাকে ছোটগল্প তকমা দেওয়া হচ্ছে। আগে নভেল ও সর্টস্টোরির আলাদা চিহ্নায়ন ছিল পরে তাকে ফিকশন নাম দেওয়া হয়। এবং বর্তমানে ফিকশন থেকে ফিকশিয়াস বিষয় উবে যাওয়ার কারণেও কিনা কে জানে এদের স্রেফ ন্যারেশন হিসেবে বুঝে নেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। কিন্তু যত যাই হোক শিল্পের মূল জায়গা আর কতটা পালটায়, তাহলে লোকে এখনো গ্রীক ট্যাজেডি পড়ত না বা মঞ্চে দেখতে যেত না। সাহিত্যের আধুনিকতা বিজ্ঞান প্রযুক্তির আধুনিকতার মতো নয় তা তো বলাই বাহুল্য। সেখানে কৃত্রিম রঙ ঢং আমদানি করে পাঠককে বেশিদিন প্রতারিত করা যায় না। ফলে নানান মতবাদের তকমা দেওয়া গল্প আদতে গল্প বলেই টিকে থাকে। পাঠক তকমার জন্য লোকে গল্প পড়ে না। প্রকৃত লেখকও ‘আমি একটি পরাবাস্তববাদী বা যাদুবাস্তবতাবাদী গল্প লিখিব’ পণ করে গল্প লিখতে শুরু করেন না। আর পাঠকও কোনো তকমায় বেশিদিন মজে থাকার লোক নন। তিনি সহজেই চিনে নিতে পারেন কোনো লেখাটি সূচনা লগ্ন থেকেই ছোটগল্প হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরো অনেকজনের মতো মার্কেসের কথানুযায়ী আমরা দেখি, ছোটগল্পের প্রথম বাক্যটাতেই গল্পের রক্তবীজ নিহিত থাকে। তা-ই প্রথম বাক্যটির জন্যই তিনি সর্বাধিক শ্রম দেন। ফ্লবেয়ার কোনো গল্পের প্রতম পৃষ্ঠাটি ১৮ বার পূর্ণলিখন করতেন। কারণ সেটি নির্মাণ করলেই বাকি গল্পটি বলতে গেলে নিজের মতো হয়ে ওঠার দিকে লেখকের কলমকে চালিত করে নিয়ে যায়। এবং পাঠকও শুরুতে টের পান যে তিনিও একটি সত্যিকারের গল্প পড়ার ভাগ্য নিয়ে লেখাটি পড়তে শুরু করেছেন। পড়তে গিয়ে তিনি নিজেকে নতুন করে অবিষ্কার করেন। নতুন করে তার পরিপার্শ্বকে চিনে নিতে পারেন এবং সর্বোপরি লেখক জীবনের কোনো একটি ক্ষেত্রে পাঠকের ভেতরে তীক্ষèতার সঞ্চার করেন। জন্ম, মৃত্যু, দাম্পত্য, নরনারীর সম্পর্ক, সমাজের নানান অসংগতি, প্রেম, ঘৃণা, শত্রুতা, বন্ধুত্ব, আত্মত্যাগ, আত্মপ্রতারণা, ক্রোধ, গ্লানি, তীব্রকামনাবাসনার বিমোক্ষণ, জীবনের জানাঅজানা প্রান্তরের এমন কোনো দিক নেই যা নিয়ে ছোটগল্প কারবার করে না। কিন্তু আমরা শুরুতেই বলেছি, লেখককে শনাক্ত করে নিতে হবে তার ভেতর থেকে কোনটি ছোটগল্পের বিষয় এবং কোনটি নয়। আমাদের মনে পড়ে তলস্তয় রাশিয়ার কৃষকজীবন,সহ নানাস্তরের মানুষের কথা ছোটগল্পে এনেছেন, কিন্তু উপন্যাসে লিখেছেন মূলত তার শ্রেণী মানে অভিজাত শ্রেণীকে নিয়েই। একই ব্যাপার ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। তাঁর ছোটগল্পে গ্রাম ও শহরের নিচু তলার মানুষ যতটা এসেছে উপন্যাসে ততটা আসেনি। চেখভ তো বিশ্বাস করতেন উপন্যাস হল অভিজাত লেখকের বিষয়। তাহলে দাঁড়াচ্ছে ছোটগল্পে সবধরণের মানুষের জীবনগাথাকে যতটা সহজে আনা যায় উপন্যাসে তা আনা একসময়ে ততটা সহজ ছিল না। পরবর্তীকালে সবশ্রেণীর মানুষের জীবন নিয়ে এতটা লেখা হয়েছে যে তা পড়ে লেখক তাদের অভিজ্ঞতায় অনেক কিছু পেয়ে যান। আইজাক বাশেভিস সিঙ্গার তার ক্রোখমালনা স্ট্রিটের ইহুদি ইদ্দিসভাষী মানুষের জীবনকে এতটাই জীবন্ত করে তোলেন যে সেইসব মানুষ যে এখন আর ওই জায়গায়ই নেই তা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। ফলে ছোটগল্প সমাকলের সীমায় মেনে চিরকালের সীমায় পৌঁছায়। আর সেই গল্প পড়ে এর পাঠক একজীবনে হাজার জীবনের স্বাদ পান।
সাহিত্যের এ-ই তো অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষের চিন্তায় স্থান-কাল-পাত্রের সকল ধরনের সীমবদ্ধতাকে ভেঙে দেওয়া। যারা অর্থবিত্ত-কৃত্রিমবিলাসব্যসন- ভোগবসানাচরিতার্থর পেছনে ছোটেন এবং যাদের তার উলটো দিকে দারিদ্র্য-ক্ষুধা-নিত্যদুর্ভোগ যাদের নিত্যদিরে পাওনা তাদের জীবন ধরা থাকে ছোটগল্পে। ধারা থাকে এই দুয়ের মধ্যখানে থাকা মধ্যবিত্তদের জীবনও। সাহিত্য আদতে তো ধরতে চায় মানুষকে। মানুষের জীবনকে। তা-ই সাহিত্যের কাছে পাঠকের দাবি। লেখক মুক্ত হন তার বোধ ও ভাবনাকে শিল্পরূপ দিয়ে, আর পাঠক মুক্তিপান সেই লেখা পড়ে, যে-লেখা অন্যর লেখা হলেও তাতে নিজের জীবন ও পরিপার্শ্বই কথা বলে ওঠে।
বাজাতে বাজাতে বায়েন, গাইতে গাইতে গায়েন আর লিখতে লিখতে লেখকের মতোই পড়তে পড়তে প্রকৃত পাঠকের জন্ম হয়। এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে থাকে এমন কিছু গূঢ় বিষয় ও রহস্য যা চর্চা ও অনুশীলনে ভেদ করতে হয়। কতটা ভেদ করা যায় তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু দিশা তো পাওয়া যায়। এই দিশার একদিশা পেয়ে যান ছোটগল্পের পাঠক। এবং তিনি যখন তা পেয়ে যান, তিনি জীবনবোধে সাধারণ স্তরের আর কেউ থাকেন না। এই অসাধারানত্ব অর্জন সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের মতো ছোটগল্প পাঠকেরও সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। কতটা তিনি অর্জন করতে চান তারও কোনো সীমা নেই। তবে একথা বলাই যায় ছোটগল্প পাঠের ভেতর দিয়েও তিনি হয়ে উঠতে পারেন অনন্তপথের যাত্রী। সবই নির্ভর করে তার সচেতন প্রস্তুতির সূচনালগ্ন থেকে। আর কে না জানে হাজার হাজার মাইল যাত্রার শুরুটা হয় মাত্র একটি পদক্ষেপ দিয়ে। ছোটগল্প পাঠক যত সমৃদ্ধ হবেন ছোটগল্প লেখক ততটাই সতর্ক হবেন। ইদানীং ছোটগল্পের বইয়ের পাঠক কমে যাওয়াতে ছোটগল্প লেখকরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা ঘটত না, যদি ছোটগল্প পাঠকের প্রস্তুতিটা ঠিক মতো সম্পন্ন হত। লেখকরাও পাতাভরানো জটিল-তরল-বায়বীয় বিষয়য়াদি লিখে ছোটগল্পের নামে তা চালানোর সাহস পেতেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ