আনোয়ার শাহাদাত'এর গল্প : উদ্ভট তর্ক শোরগোল

আমি তখন নবম-দশম শ্রেণীতে হবো, কেবল বিকাল বেলা শহরের মধ্যে আড্ডা দিতে শুরু করেছি। সে ছিল ‘বড় হয়ে যাচ্ছি’র উপসর্গ। সেই বয়সে বন্ধুদেরর সঙ্গে শহরের কেন্দ্রস্থল, বরিশাল অশ্বিনীকুমার টাউন হলের সামনে বাদাম খেয়ে আড্ডা দেওয়ার অধিকার ছিল না। যখন সেই সুযোগ এল তখন বুঝলাম নির্ধারিত সময়ের আগে এই অধিকার থাকে না। অবশ্য আমি ছিলাম এ সব নিয়মের বাইরে।

আমাদের সেই দল সদর রোড টাউন হল সামনের সিমেন্টের রেলিংএ কেউ বসে, দাঁড়িয়ে, চক্র করে, উচু গলায় কথা বলতে থাকি। সেই কথা বলার বিষয়েরও কোনও তাল ঠিক থাকে না। যেমন, আমাদের শাখা-প্রশাখাহীন আমলকী গাছে ‘মরন-সুন্দর’ রঙের দুটি পাখী বাসা বেঁধে ঘর সংসার করা শুরু করে।
সেই পাখী ঠোটে করে বাসা নির্মাণের খড় বয়ে আনার দীর্ঘ বর্ণনা আমি অভিনয় করে দেখাই। গোটা মহল্লা পাখী-সংসার নিয়ে মগ্ন। আমার দাদু বলেছে, পাখীদের ওই জাতের অস্তিত্ব মেলে শুধু দক্ষিণ আমেরিকায়। আমি বিশ্ব মানচিত্র খুলে দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনার উপর কনু-আঙ্গুল এবং ভেনেযুয়েলার উপরে আংটি-আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে বুড়ো-আঙ্গুল বিঘস্থ করে এশিয়া অংশে রাখি। দাদুকে পাখীদের এই দীর্ঘ পথ উড়ে আসা সম্ভব কিনা সেই ইংগিত করি। দাদু বলে, হ্যাঁ পাখীদের পক্ষে ওই পরিমাণ দুরত্ব উড়ে আসা সম্ভব। সে কারণে পরজন্মে অনেক বিশ্বাসীরা পাখী হতে চায়, পাখীরা সবই পারে। আমি জানি তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ১৬ হাজার মাইল উড়ে ওই পাখী বরিশাল শহরে দাদুর বাড়ীতে এসেছে, প্রাচীন আমলকী ডালের সন্ধিক্ষণে বাসা করতে! দাদুকে আমার সন্দেহ গোপন করিনা।

আমার এই গল্পের উত্তেজনা ছাপিয়ে ছাইদুলের গল্প অনেক বেশী গরম করে। সে তার দূর সম্পর্কের খালাতো বোনের বুকে হাত চালাবার গল্প ফাঁদে। পাখী গল্প অর্ধ-ধর্ষণের রগুড়ের কাছে পরাজিত হয়। যদিও গল্পকারের হাত যখন অনিচ্ছুক নারী দেহের উপর থেকে নিচে যেতে থাকে তখন আমার গল্প সামনে আনতে আমি কৌশল করি, বলি -”নিঃশব্দ”।

আমাদের স্কুলে একজন শিক্ষক ছিলেন, আমেরিকান, পিস কোরের হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন, এই আমাদের বরিশালে। তিনি বাংলাও বলতেন। ক্লাসে যখন ছাত্রদের থামাতে চাইতেন, বলতেন, “নিঃশব্দ”। ছাত্ররা হাসত তার বলা “নিঃশব্দের” উদ্দেশ্য না বুঝে। আসলে সে ‘চুপ’ করতে বলত, ইংরেজি ‘সাইলেন্ট’এর বাংলা। সহ শিক্ষক হেদায়েতুল্লা তাকে বুঝালো- তুমি বলতে চাচ্ছ “চুপ কর”, ‘সাইলেন্ট’ নয়। তার নাম ক্লিন্টন সিলি, যিনি কবি জীবনানন্দ বিশেষজ্ঞ। ছাইদুরের মন খারাপ হয়। সেটাই স্বাভাবিক, যৌন নিপীড়করা তাদের গল্প, গ্রাফিক বর্ণনায় বলতে পছন্দ করে, এক বলে বিকৃতি। আমার নিন্দা হয়- যৌন রগড় গল্প নিধনকারী হিসাবে “হালায় সুড়সুড়ি গল্প নিধনের রাজা!”।

এই দিনের আড্ডার এক ফাঁকে ফয়সাল টাউন হলের ভেতরে গিয়ে খবর নিয়ে আসে, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির এক বুড়ো নেতার সম্বর্ধনা হচ্ছে। বুড়ো তার গলায় রাজ্যের পরিমাণ কাগজের ফুলের মালা লয়ে বসে আছেন। মালা সমুহের ভারে শ্বাস নিতে পারছেন না, অবস্থা শঙ্কুল। ফয়সল বাড়িয়ে বলছে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার আগ্রহ হয় এমন মরণদশার বুড়োকে দেখতে।

আমি রেইলিং থেকে নেমে টাউন হলের ভেতরের দিকে যেতে উদ্যত হলে সবাই আমার সঙ্গে যোগ দেয়। ফয়সল ঠিকই বলেছিল। মঞ্চে কাগজের মালায় ডুবন্ত বুড়ো। আমরা ঢোকার সঙ্গেই শুরু হলো তাঁর বক্তব্য রাখার ঘোষণা। তিনি ওইসব মালা নিয়েই বক্তৃতায় দাঁড়াতে গেলেন। রোহিত তখন ফিসফিসায়- ‘আরে বুড়া, মালা গুলা চেয়ারে থুইয়া আস’। হল থেকে বেরুবার প্রস্তাব এলেও আমার মালা-বুড়ো’র কথা শুনতে ইচ্ছে হলো।

দর্শক-শ্রোতাদের আহ্লাদিত মনে হয় তাঁর বক্তব্যের পালা এলে। লোক জন খুব আগ্রহ নিয়ে শোনে তাঁর কথা। কী প্রসঙ্গে তিনি বক্তৃতায় তার নাতির কথা বলা শুরু করলেন, রসিকতার সুরে। যা বলছেন তা এই রকমঃ তিনি, হ্যাঁ জীবন কাটিয়েছেন একজন কমরেড হিসাবে, সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে, সাম্যবাদের লড়াইয়ে। অথচ…।

তিনি ‘অথচ’ বলে থামেন। লোক জন অপেক্ষা করে তিনি কী বলেন তারপর। তিনি বলেন, অথচ তার এক নাতী আছে যে কিনা ধনতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন। মনে হলো তিনি মনে করছেন শ্রোতা-দর্শকরা হয়তো তার এই কথার মর্মার্থ ধরতে পারেনি।

তিনি বললেনঃ ‘নাতিটি সমাজতন্ত্র বিরোধী’। তখন শ্রোতাদের ভেতর থেকে একজন বলে উঠল ‘শেইম’।

এর পর তিনি আরো পরিষ্কার করলেন “সাম্রাজ্যবাদের দালাল”! বলে তিনি একটু হাসলেন। দর্শকরা ‘সাম্রাজ্যবাদের দালাল’ শুনে হল্লা করে উঠল। এবারে “শেইম”এর সঙ্গে আরো লোকজন তুমুল তর্জনে যোগ হলো। সমম্বরে বলে উঠল “শেইম”।

আমাদের ফয়সল বললঃ ‘আহরে বুড়ো, নাতির দুন্মাম!’

আমি বলিঃ “তোর কী, যার নাতি, সে দুন্নাম কয়। তোর কী”?

ফয়সল তখন আমাকে কনুই দিয়ে গোতা মেরে বলেঃ “কীরে তোর দাদুজান হয় নাকিরে, টান লাগছে”?

আমি কোনও উত্তর দেইনা।

সেই “শেইম” শোরগোল চলতে থাকল। নাতি বিষয়ক বক্তা দাদা দর্শকদের বললেনঃ “চুপ”। মনে হলো শ্রোতাদের সেই অজ্ঞাত সাম্রাজ্যবাদের দালালের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানানো শেষ হয়নি। হয়তো বুড়ার রাগ হলো তাদের মাত্রাতিরিক্ত ‘শেইম’ শোরগোলে। তিনি এবারে ইংরেজিতে বললেন “শাট আপ”। শোরগোল থামল।

কিন্তু বুড়োকে মনে হলো একটু বিচলিত। তাঁর বাম হাত প্যান্টের পকেটে ছিল, ডান হাত পোডিয়ামে। তিনি বাম হাত পকেট থেকে বের করলেন, ডান হাত পকেটে দিলেন, অন্য হাত পোডিয়ামে। এমন করে চারবার তিনি হাত পরিবর্তন করলেন। এর পর বাম হাত বুকের দিকে রেখে ঝুঁকে পড়লেন। যেন আর দাঁড়াতে পারছেন না। পড়ে যাবেন। মঞ্চের অপর একজন তার চেয়ার থেক উঠে এসে কমরেডকে তাঁর চেয়ারে বসালেন। তিনি মঞ্চ-মেঝেতে পড়ে গেলেন।

আমি টাউন হলের পেছন থেকে চেয়ার সারির ফাঁকা ধরে দৌঁড়ালাম মঞ্চের দিকে। ফয়সল পেছন থেকে বলেঃ “কিরে তোর সত্যই দাদু নাকিরে”? যখন আমি দর্শকদের ভীড়ের ভেতর দিয়ে মঞ্চে কমরেডের দিকে দৌঁড়াচ্ছিলাম তখন ভেতরের মাইক বন্ধ বলে বাইরের শব্দ আসছিল। কালীবাড়ি রোডের পূজা মণ্ডপ থেকে তখন সেই গানটি বাজে “হায়রে হায় চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি”। কী অদ্ভুত ওই গানটি তখন বাজতে হবে কেন!

আমি তার আগের সন্ধ্যায় পূজা মণ্ডপের বাহারি বাতির বিভ্রমে ওই গানের সঙ্গে যে মেয়েটিকে দেখে বুকের অজ্ঞাত কোথাও প্রলয় বোধ করেছিলাম সেই মেয়েটির নাম তানজিম। দৌঁড়াচ্ছি, তার কথা মনে হলো। কমরেড মঞ্চে শুয়ে পড়ে আছেন। ফয়সল পেছন থেকে ডাকছে, “আস্তে যা, আস্তে দৌঁড়া”। সর্বশক্তি নিয়ে লাফিয়ে মঞ্চে উঠি। প্রায় নিথর হয়ে থাকা কমরেডকে স্পর্শ করি। হাতের তালুতে চাপ দিয়ে পিঠে ঘষা দিয়ে ডাকি “কমরেড”।

মঞ্চের অন্যান্যরাও তাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তিনি ছিলেন নিরুত্তর। কিন্তু আমি যখন ডাকলাম “কমরেড”।

তিনি উত্তর করলেনঃ “ইয়েস কমরেড, ইয়েস”!

কে কী বুঝলো আমি জানি না। তার পাশের চেয়ারে বসা লোকটি মনে হলো আমাকে চিনলেন। হ্যাঁ, ফয়সালের কথা ঠিক। আমি বুড়োর নাতি। যার সম্পর্কে তিনি একটু বলছিলেন, শ্রোতারা তখন ‘শেইম’ বলেছিল, আমিই কমরেডের সেই নাতি।

ওইদিন রাতে খাওয়ার সময় বুড়ো বললেন “দাদু মাফ করে দিও, বয়স হয়ে গেছে, কী বলি, কেন বলি কিছুতো ঠিক নাই”।

আমি যে কিছু মনে করি নাই সেটা বোঝাবার জন্য তার পাত থেকে শৌল মাছের টুকরোটা তুলে নেই। তিনি তার থালা থেকে একটু ঝোল তুলে দিয়ে বলেন “তোমার বাবাকে ক্ষমা করি নাই,সেইটা এখন তোমার উপর দিয়া যায়”।

আমি হাসি, শৌল মাছের ঝোল লাগা হাতের আঙ্গুল থেকে চাটি।

“হাইস্য না, হাইস্য না, তোমার বাপ থাকলে, মা থাকলে, আরো কতগুলা নাতি হইত”।

একটু থেমে এর পর তিনি শিশুর মতন কেঁদে ওঠেন, মাথাটা প্রায় ভাতের থালার উপর ঠুকে ডুকরে যায় “আজ যদি আমি মরে যেতাম তাহলে আমার নাতির জীবনে বায়োলজিক্যাল আর কেউ থাকে না এই দুনিয়ায়” এই বলে সামনের থালাটা ঠেলে সরিয়ে দিলেন, মাথাটা টেবিলে গুঁজলেন।

বাম হাত দিয়ে আমি তাঁর পিঠ খামছে ধরলাম, যেন- বেশ, তাহলে একা ফেলে রেখে যেও না দাদু।



বিঃদ্রঃ কমরেড যে তাঁর ছেলে অর্থাৎ আমার বাবাকে ক্ষমা করতে পারেননি তার কারণ তিনি মনে করেন, আমাকে অত ছোট রেখে সে মুক্তিযুদ্ধে না গেলেও পারত। আর গেলেই মরতে হবে কেন? আমি তখন বলবার চেষ্টা করেছি, “তাঁর অর্থ বাবাকে নয়, যুদ্ধে বাবার মরে যাওয়াকে তুমি ক্ষমা করোনি”।

তিনি বলেন “তোমার বাবার মতন উদ্ভট তর্ক করবে না”।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ