শহরটিতে যাবার কোনও এসি বাস নেই, খবরটা শুনে তিনি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। কোন অজপাড়া গাঁরে বাবা। পরিচিত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অফিসারদের কাছে ফোন করে খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন জায়গাটা কেমন, কেউ তেমন মন্দ বলেননি, এসি ল্যান্ড সাহেব বিসিএস কমপ্লিট করে প্রথম সহাকারি কমিশনার হিসাবে জয়েন করেছিলেন শহরটিতে। তিনি মোটামুটি ভালো একটা ধারণা দিয়েছিলেন। ছোট্ট শহর, জেলা শহর তবে জেলার জৌলুস নেই, মানুষ জন তেমন জটিল নয়, তবে একটু বেয়াড়া গেঁয়ো টাইপ, কিন্তু খুশি করে চলতে পারলে তারাও স্যার স্যার করে। এডিসি ভাবি মিসেসকে ফোন করে বলেছিলেন ভালো জায়গা ভাবি। চারদিকে হাওড়, মাছ খেতে পারবেন ইচ্ছামতো।
গাঁয়ে শৈশব কাটানো কালিবোস, রুই, কাতলা, পাবদা, জিয়ল মাছ খেয়ে বড় হয়েছেন। মাছের প্রতি দুর্বলতা আছে বটে, তাই বলে শুধু মাছ খাওয়ার জন্য এলাকাটিতে যাবেন, নাকি মন্ত্রণালয়ে তদবির করে আদেশটি রদ করাবেন এটি ভাবতে ভাবতে মিসেস হম্বি তম্বি শুরু করে দিলেন। কাছাকাছি চা বাগানের সৌন্দর্য, জলপ্রপাতের ঝরনাধারা ইত্যাদির সাথে চুপি চুপি জেনে নেয়া ‘পয়সার জায়গা’ বিষয়গুলো মিসেসকে পটিয়ে দিয়েছে। তিনি গোঁ ধরে বললেন শহরটিতে যাবেনই। বাধ্য হয়ে এডিসি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হাকিম সাহেবের বদলি আদেশ রদের তদবির করা হলো না। জেলা শহরটিতে তিনি চলেই এলেন। প্রথম প্রথম একদমই মন না বসলেও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। প্রথম প্রথম মন না বসার যেমন যৌক্তিক কারণ ছিল তেমনি ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ারও যৌক্তিক কারণ তৈরি হয়েছিল।
এখানে ক্লাবে আড্ডা জমে না। সন্ধ্যা ৭টায় ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। বিনোদনের জন্য পার্ক, থিয়েটার দূরে থাকুক একটা খেলার মাঠ পর্যন্ত নেই। আসলে তার মন বসবে কেন? পরবর্তীতে হাতে যখন কাঁচা টাকা আসতে থাকে, গোঁয়ার লোকগুলোর ঘাড়ের বেয়াড়া রগগুলো চেনা হয়ে যায়, ঢাকা যাবার এসি বাস রাস্তায় নেমে যায়, সেতু তৈরি হয়ে ফেরি পারাপারের ঝক্কি উঠে যায় দেখতে দেখতে। তখন তার মন বসতে থাকে, শান্ত-নির্ভেজাল, কোলাহলহীন শহরটা তার ভালো লাগতে থাকে।
এই ভালোলাগা হঠাৎ কিছুটা হোঁচট খায় পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা প্রলয়ংকরী বন্যায়। হিমশিম অবস্থা তখন, আজ এ মন্ত্রী আসেন তো কাল ও মন্ত্রী, আজ এ ভিআইপি তো কাল অন্য ভিআইপি। মহামান্য ত্রাণদাতারা মূল্যবান ত্রাণ দিবেন তো সবচেয়ে ভালো নৌকাটা নেয়া চাই। ভিতরে পাঁচতারা হোটেলের সুবিধা তৈরি করা চাই, প্রয়োজনীয় প্রটোকল তো আবশ্যক। কোথাও তিল পরিমাণ ক্রটি ঘটবার সুযোগ নেই, শা-লা, ঘুম হারাম। উদয়াস্ত বন্যা সামলাতে সামলাতে মড়ার ওপর খাড়ার ঘা-এর মতো মন্ত্রী সামলাতে তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন, উপরন্তু সব সময় ঘাড়ের ওপর খড়গ হয়ে ঝুলে থাকে ক্রটি ঘটবার ভয়। স্যার বিরক্ত হলে এসিআর এ লাল দাগ পড়ার ভয়। পরিণামে পুরো ভবিষ্যত অন্ধাকারাচ্ছন্ন হবার ভয়। তখন ভাবতে লাগলেন, ধুত্তরি কেন যে তখন গিন্নির কথা শুনে এই হাওড় এলাকায় আসতে রাজি হলেন।
২
সিরাজ আলীর ছেলেটি ক’দিন ধরেই বায়না ধরেছে মোরগের সালুন দিয়ে ভাত খাবে। ছেলেটা সবে দুই মাস জন্ডিস থেকে সেরে উঠেছে। খাবার দাবারের কড়া নিয়ন্ত্রণের সাথে ঘরবন্দি থেকেছে। এই দু’মাস সিরাজ আলী দীর্ঘ সময় অফিস করে যতটা সময় হাতে থেকেছে মসজিদে মসজিদে কাটিয়েছে। একটি মাত্র সন্তান তার। স্ত্রীর হাইপ্রেসারের কারণে প্রথম সন্তানের জন্মের পর আর সন্তান গ্রহণ করেননি। বলা ভালো করতে পারেননি। ঘর ভর্তি নাতি-নাতনির যে ভীষণ শখ তার আম্মার ছিল। তার পূরণ হয়নি-যে কারণে আরেকটি বিয়ের জন্য অনেক পীড়াপীড়ি সহ্য করতে হয়েছে দীর্ঘদিন, আম্মাকে না খেপিয়ে, স্ত্রীকে পীড়া না দিয়ে দুর্বিষহ সেই পরিস্থিতি সামলেছেন একা। অন্ধের যষ্ঠী সেই ছেলেটির যখন অসুখ ধরা পড়ে তখন বাড়াবাড়িও ছিল বেশি রকম। পরিচর্যার অত্যাচারে ছেলেটির খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কাহিল ছেলেটি তাই ভালো হয়েই ভালো-মন্দ খেতে চায়। মোরগের সালুন আর পোলাও ভাত। দু’পয়সার চাকরি করে তো আর ছেলের বায়না মিটাতে যখন তখন মোরগ কেনা যায় না। ঠিক করে রেখেছিলেন তাই বেতনটা পেয়েই বাজারে যাবেন।
বাজারে যাবার সময় ছেলেটাও বায়না ধরলে প্রথমটায় তিনি রাজী হননি। স্ত্রী এগিয়ে দিল-- যাক না, শখ করেছে। তাড়া দিয়েছিলেন তিনি, গেলে তাড়াতাড়ি, অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে। দেড়শ টাকায় একটা দেশি মোরগ, নতুন আলু আর কেজি দুয়েক পোলাও-চাল কিনে মনটা তার সাড়ে বাইশ হাত হয়ে যায়। কখনো চোখে আনন্দে জল এসে যায়। সেই জল আড়াল করে ছেলেকে নিয়ে রিক্সায় চাপেন তিনি। দাড়িতে হাত বুলিয়ে ছেলেকে বলেন, আম্মাকে বলবি ঝাল কম দিয়ে রানতে। ছেলেটা যখন মাথা কাত করে সম্মতিতে তখন সিরাজ মিয়ার সাধ হয় ছেলের কপালে আদুরে চুমু খান। কোলাহল মুখর রাস্তায় নিজেকে সংযত করেন আর ভাবেন দুপুরে ঠিক সময়ে বাসায় ফিরবেন আজ, মোরগের সালুন দিয়ে ভাত খেয়ে তৃপ্ত ছেলেকে আদর করবেন।
অতঃপর সবাই যখন তাড়া দিচ্ছে তাকে ছেলেকে আদর করার জন্য তখন সিরাজ মিয়া স্তব্ধ। তার মাথা কাজ করছে না। সে উপলব্ধি করতে পারছে না আসলে ঘটনাটা কী ঘটেছে। একি স্বপ্নে-না বাস্তবে? মাত্র না ঘণ্টাখানেক আগে, ছেলেটিকে রিক্সা থেকে নামিয়ে দিয়ে গেছেন হাতে মোরগ আর বাজারের ব্যাগটা দিয়ে। মোরগটা তখনো উঠোনের এককোণে কক-ক-ক শব্দে নিজের জীবন্ত অস্তিত্ব ঘোষণা করছিল। রাস্তাটা পার হয়েই বাসায় পৌঁছাবে ছেলেটা, নিশ্চিন্ত মনে অফিস গিয়েছে সে, এর মধ্যে কী ঘটল? সিরাজ মিয়ার চোখে জল আসে না। সে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকে সবার সামনে। সবাই যখন তাড়া দেয়-- ছেলেটাকে শেষবারের মতো আদর কইরা দাও বাবা। তখন সিরাজ মিয়া ভাবে, এখন কেন? ছেলেকে তো সে আদর করবে মোরগের সালুন দিয়ে ভাত খেতে খেতে।
পত্রিকায় ছবি ছাপা হয় তার ছেলের হাস্যোজ্জ্বল, ঘাতক ট্রাকটিকে ধরা যায়নি, পুলিশ তৎপর। মুরব্বিরা পরামর্শ দেয়, মরা ছেলের ছবি না ছাপানোই ভাল বাবা। ছেলের মা ঝাঁপিয়ে পড়ে ছবির ওপর--আমার বাপ রে বাপ, মোরগের সালুন দিয়ে ভাত খাবেরে বাপ। পাড়ায় মসজিদে মিলাদ মাহফিলে হুজুর কোরানের আয়াত ব্যাখ্যা করেন- আল্লা বান্দার জন্ম দিয়াছেন, তিনি নেবার মালিক। এই নিষ্পাপ বালকটিকে দীর্ঘ দশ বছর প্রতিপালন করেছে সিরাজ মিয়া, আল্লার মাল আল্লাহ নিয়া গেছে, হয়তো বা এই নিষ্পাপ বালকটিকে প্রতিপালনের উছিলায় আল্লাহ সিরাজ মিয়ার সব গুণাহ মাফ করে দিবেন। সিরাজ মিয়া গত দু’মাস কাটিয়েছেন মসজিদে। তার পরের দু’মাস তার কাটতে থাকে গোরস্থানে। মুরব্বিরা গভীর রাতে তাকে বাড়ি ধরে আনেন। বলেন- আল্লাহর নাম নাও বাবা, তিনি মনে শান্তি দিবেন।
৩
জাহাঙ্গীর আলমের ঘরে এক ফুট পানি। উঠোনে দুই ফুট। নড়বড়ে চৌকিটার ওপর বিছানা বালিশ, হাঁড়ি-পাতিল একসাথে। কোথায় রান্না হয়, কোথায় খানা, বউটা বাড়ি ফিরলেই প্যান প্যান করে--সারাদিন বাইরে বাইরে থাকেন। আমি পোলা মাইয়া লইয়া কি করি একলা পানির মাইঝে। মূর্খ, ছোটলোক বলে বউকে গালি দিলেও মনে মনে তারও ভীষণ বিরক্ত লাগে। কী ব্যাঙের চাকরি। ঘরে বউ পোলাপান বন্যার থৈহীন পানিতে ভাসিয়ে তাকে সারাদিন ঘুরতে হয় বাজারে বাজারে পাবদা আর কৈয়ের খোঁজে। ত্রাণ দেয়ার জন্য যারা ঘাঁটি গেড়েছেন সার্কিট হাউজের ভিআইপি কক্ষে, তাদের জন্য প্রতিদিন খাবার মেনু তৈরি করার দায়িত্ব তার। এল আর ফান্ড থেকে টাকা দিয়েই খালাস ডিসি স্যার। এই আকালের বাজারে কোত্থেকে যোগাড় হয় দুর্লভ সে সব মেনু। যা কিনা ভিআইপিরা মুখ ফুটে খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অফিসে কোনও ডিউটি নেই তার এখন, সকাল থেকে ব্যস্ত থাকতে হয় ভিআইপিদের প্রয়োজন মেটানোর তাগাদায়, তাদের সেবায় নিবেদিত হয়ে। গভীর রাতে ডিনার শেষে এসি রুমে বরফ ঠাণ্ডা পানি দিয়ে তবে তার ছুটি মিলে পরদিনের তাড়া নিয়ে। ঘরে ফিরে বউয়ের প্যান প্যানানি যতোই যৌক্তিক হোক, মুখে তো আর স্বীকার করা যায় না। বৌয়ের কাছে বড় গলায় চিৎকার না করলে ঠিক পুরুষত্ব থাকে না। কিন্তু নিজের কষ্টটা বলার কিংবা বোঝার যে কেউ নেই- এই কষ্ট আর বিরক্তি তার রাগে পরিণত হচ্ছে। এতো ছোট চাকরি করে সে, যে-চাকরির নিচে রাগ দেখানোর মতো আর কেউ বাকি থাকে না। শেষ ভরসা বউ, তার কাছে এসব বয়ান করাই বৃথা, কষ্টতো সে বুঝবে না। উলটো স্বামীর গরবে গরবিনী হয়ে ভাববে স্বামী তার কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। পথে অবসরপ্রাপ্ত হেডক্লার্ক বড় বাবুকে পেয়ে তাই ক্ষোভে ফেটে পড়ে, গলদা চিংড়ি খোঁজার প্রচেষ্টা তার বিলম্বিত হয়। মন খুলে সে বলতে থাকে চলতি হাল-হকিকতের কথা। চাকরি আর করা যাবে না স্যার, চাকরির দিন শেষ। আপনাদের আমলের সাথে এ আমলের ফারাক আকাশ-পাতাল। তেনারা ত্রাণ দিবেন আর আমাদের খাওয়া ঘুম হারাম হবে মাছ খুঁজতে খুঁজতে। বুইজলেন না স্যার, ভাল লাগে না স্যার এই ব্যাঙের চাকরি।
৪
ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা এলাকার মুরুব্বিও বটে। বাস ট্রাক মালিকের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে সব শ্রেণি/পেশার সমন্বয়ে যে-সভা ডাকেন, সেখানে সবার বক্তৃতাই দুঃখ-শোককে ফেনিল করে সান্ত্বনার মোড়কে ঢেকে পুত্র শোকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে চায়। সভায় জোরেসোরে উচ্চারিত হয় এলাকায় একটি স্পিডব্রেকার তৈরির দাবি। সেই সাথে পুত্র বিয়োগের শোক ভুলিয়ে দিতে উত্থাপিত হয় ক্ষতিপূরণ দানের দাবি। দাতারা বিনা বাক্যব্যয়ে রাজিও হয়। কেবল টাকার অংকটাই যা বাকি থাকল সিরাজ আলীর জন্য। নিজের মুখে অংকটা যদি বলে সিরাজ আলী তবে তা যতো বড়ই হোক, দেবার সর্বাত্বক চেষ্টা করবে মালিক সমিতি।
প্রথমে কিছুই বলতে রাজি না হলেও সবার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত সিরাজ আলী যখন নতমুখে বিধ্বস্ত অবয়বে উঠে দাঁড়ায় তখন তার দু’চোখের অঝোর ধারায় ভিজতে থাকে পুরো সভা। পিনপতন স্তব্ধতায় মিনিট পাঁচেক সময় যায় কেবল ধাতস্থ হতে, পরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সিরাজ আলী বলে--টাকা পয়সার দরকার আমার নাই, আমার ছেলের মতো আর কোন ছেলে যেন অকালে না মরে তার ব্যবস্থায় রাস্তাটার ওপর একটা স্পিডব্রেকার তৈরি করার জইন্য যদি আমার কিছু করতে হয়, তাইলে আমারে বলবেন, আমি তা করব, যেখানে যেতে হয় যাব। ছেলের জন্য শুধু দোয়া কামনা করে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ে সিরাজ আলী।
এলাকায় নিজ ক্ষমতার দৌঁড় দেখানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়ে পুরো দায়িত্বটাই কাঁদে তুলে নিলেন নেতা মহোদয়, সিরাজ আলীকে নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করলেন এলজিডি থেকে সিএন্ডবি, পৌরসভা থেকে জেলা প্রশাসক ও এমপি'র দপ্তর। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের বদনাম মিথ্যে করে, মোটামুটি রাতারাতি ফাইল ওয়ার্ক হয়ে অল্প ক'দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গেল একটি স্পিডব্রেকার নির্মাণের। নেতার ভ্রাতা ছোটোখাটো কন্ট্রাক্ট করে যে হাত পাকাচ্ছে কেবল, তার বিশেষ তদারকিতে দ্রুত তৈরি হয়ে গেল স্পিডব্রেকার। তারও পরদিন অফিসগামী জনগণ, সাধারণ রিক্সাওয়ালা, নিত্য পথচারীসহ সবাই অবাক চোখে দেখল সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে সরকারের প্রতিটি সেক্টর কতটা আন্তরিক।
এডিসি জেনারেল সাহেবের গত কয়েক রাত ঘুম নেই। ঘুমোনোর সময় ফুসরত মিলেছিল যে ঘণ্টা কয়েক, তাও গ্রাস করেছিল উদ্বিগ্নতা আর দুশ্চিন্তা। ফলে নির্ঘুমও থাকতে হয়েছে গত কয়েকদিন। আজ নেতা আসছেন শহরে। সব ব্যবস্থা নিশ্চিদ্র, ক্রটিহীন করতে কয়েক রাত নির্ঘুম থাকলেও, তিনি জানেন না শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হবে কি না। জেলা স্কুলের যে-মাঠটিতে মহামান্য নেতা ভাষণ দিবেন, বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণ করবেন, সে স্কুলের পুরোটা রং করা হয়েছে, গাছগুলো সাজানো হয়েছে আধাআধি সাদা রঙে। ডালপালা ছেটে ঝকঝকে করা হয়েছে পুরো প্রাঙ্গন। সাজাতে হয়েছে পুরো শহরকেও। রাস্তায় দু’পাশে স্তুপিকৃত ইট বালু সরানো হয়েছে। যত্রতত্র পার্কিং করা বাস, ট্রাক ইত্যাদি যানগুলোকে নেয়া হয়েছে নির্দিষ্ট স্থানে। সমস্ত অফিস আদালতে সবাইকে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকার কঠোর নির্দেশ জারি করা হয়েছে। রাস্তাঘাট ঝাড় দিয়ে পরিস্কার রাখা হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। ড্রেন আর ডাস্টবিনগুলো নোংরা আবর্জনাহীন। জেলা স্কুল কর্তৃপক্ষসহ সরকারি বেসরকারি দপ্তরগুলোতে কারও স্বস্তি নেই।
মহামান্য নেতা যেদিন শহরে পদার্পন করবেন, সেদিন মূল্যবান ত্রাণের লোভে সকাল থেকেই স্কুল প্রাঙ্গনের আশেপাশে ভিড় জমাতে থাকে অভুক্ত, ভাসমান, ডুবে থাকা শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। মাত্র শ’খানেক সৌভাগ্যবান বন্যার্তদের সৌভাগ্য হয় ভিতরে প্রবেশের। বাইরে অন্যদের অপেক্ষা চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মাথার ওপর চড়তে থাকে রোদ, যদিও বন্যার পানি স্থির হয়ে থাকে।
অবশেষে মহামান্য নেতা আসেন, কিন্তু তখন তার হাতে সময় খুব কম। মূল্যবান বক্তব্য শেষে তিনি কেবলমাত্র জনাপাঁচেক বন্যার্ত, ক্ষুধার্ত, অভাবী মানুষকে ত্রাণ বিতরণ করতে পারেন। বাকিরা পুলিশের লাঠির বাড়ি, নেতাদের ধাক্কা, বন্যার্তদের ঠেলা খেয়ে কেউবা ত্রাণের বস্তা হাতে, কেউবা খালি হাতে সন্ধ্যা নামবার আগে বন্যার পানিতে থৈ থৈ ভাসতে থাকা অভুক্ত, অর্ধভুক্ত পরিবারগুলোর কাছে ফিরে যায়। মহামান্য নেতাও বহু মূল্যবান গাড়ির এসি ঠাণ্ডায় নির্বিঘ্নে রাজধানীতে ফিরে যান। এডিসি জেনারেল সাহেব ডিসি সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ভাসুক মানুষ, থাকুক বন্যার থৈ থৈ পানি আরও কিছুদিন। সবেচেয়ে বড় বিপদটাতো পার পাওয়া গেল! আজ রাতটা শান্তিতে ঘুমানো যাবে।
৫
প্রাইমারি স্কুলের সহকারি শিক্ষক জাহানারা বেগম, এতক্ষণ যাবৎ বর্ণিত এডিসি সাহেব, সিরাজ মিয়া, জাহাঙ্গীর আলমদের কারো সাথে তার যদিও প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই, তবে প্রলয়ংকরী বন্যা তাকেও ছেড়ে যায়নি। বন্যার থৈহীন পানিতে ভেসেছে তার বাড়িঘর। ঘর ছেড়ে তাকে থাকতে হয়েছে আত্মীয় বাড়িতে। স্কুলটিও ডুবে গিয়েছিল দুই ফুট পানির নিচে। বন্যার পানি বাড়তে বাড়তে, কমতে কমতে জাহানারা বেগমের ছ’মাসের জন্ম না নেয়া সন্তানটি আট মাসে পা রাখে। তারপর পানি একেবারে কমে গেলে, স্কুলের বিল্ডিংটি ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে ফেললে, সুদীর্ঘ ক’দিনের বিরতি শেষে স্কুলে যাবার পথে তিনি দেখলেন রাস্তার স্পিডব্রেকারগুলি নেই। তিনি হাঁফ ছাড়লেন। ক’টা মাস খুব কষ্ট করে রিক্সা পারাপার করতে হয়েছে তাকে। দ্রুত স্পিডে স্পিডব্রেকার ডিঙানোতে প্রচণ্ড উৎসাহী ড্রাইভারকে গর্ভস্থ সন্তানের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় হাত পাঁচেক দূর থেকেই বার বার সাবধান করতে হতো জাহানারার। আজ স্পিডব্রেকারহীন সমতল রাস্তাটি তাকে নিশ্চিন্ত করে।
পরক্ষণেই তার হাঁফ ছাড়া নিশ্চিন্ততা গ্রাস করে বিষণ্নতা। আহারে এ স্পিডব্রেকারটি থাকলে উদ্দাম ঘাতক ট্রাকটি সে দিন সিরাজ মিয়ার বাচ্চাটিকে চাপা দিতে পারতো না। নিজের অনাগত সন্তানটির অস্পষ্ট চেহারার সাথে ক্লাশ ফোরের বেঞ্চে বসে থাকা নিষ্পাপ ছেলেটির চেহারাটার কোথায় যেন মিল দেখে সে। একই সাথে ভাবনাটাও জাগে প্রাসঙ্গিকভাবে। স্পিডব্রেকারটি ভাঙল কারা, কেন ভাঙল?
রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাওয়া গেল না। উত্তর পাওয়া গেল না হ্যাডমিসট্রেসকে জিজ্ঞেস করেও। উত্তর না মেলা কৌতুহলটি ক্রমে ক্রমে বিলীন হয়ে যায় মনের ভিতরেই। ইতিমধ্যে তার অনাগত সন্তানটি পৃথিবীর আলো দেখে। মেটারনিটি লিভের সময়ও ফুরিয়ে যায়। মাস ছয়েকের তুলতুলে বাচ্চাটিকে ফেলে স্কুলে যেতে মন তার নিয়ন্ত্রণহীন হয়। তবুও সংহত করে স্কুলের উদ্দেশ্যে রিক্সায় যেতে যেতে দেখেন রাস্তাটি তখনও সমতলই আছে। বন্যায় ত্রাণ দিতে আসা মহামান্য নেতার আসতে অসুবিধা হবে, মূল্যবান গাড়ির এসি রুমে মহামান্য নেতা ঝাঁকুনি খাবেন বলে এলাকাবাসীর বাধার মুখে পুনরায় শীঘ্রই তৈরি করে দেয়া হবে এই প্রতিশ্রুতিতে স্পিডব্রেকারটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। জাহানারা বেগমের বাচ্চাটিও একসময় মায়ের হাত ধরে স্কুলে আসতে থাকে। স্পিডব্রেকারটি আর তৈরি হয় না, আর ভেঙে ফেলার ইতিহাসটিও জানা হয় না সহকারি শিক্ষক জাহানারা বেগমের।
গাঁয়ে শৈশব কাটানো কালিবোস, রুই, কাতলা, পাবদা, জিয়ল মাছ খেয়ে বড় হয়েছেন। মাছের প্রতি দুর্বলতা আছে বটে, তাই বলে শুধু মাছ খাওয়ার জন্য এলাকাটিতে যাবেন, নাকি মন্ত্রণালয়ে তদবির করে আদেশটি রদ করাবেন এটি ভাবতে ভাবতে মিসেস হম্বি তম্বি শুরু করে দিলেন। কাছাকাছি চা বাগানের সৌন্দর্য, জলপ্রপাতের ঝরনাধারা ইত্যাদির সাথে চুপি চুপি জেনে নেয়া ‘পয়সার জায়গা’ বিষয়গুলো মিসেসকে পটিয়ে দিয়েছে। তিনি গোঁ ধরে বললেন শহরটিতে যাবেনই। বাধ্য হয়ে এডিসি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হাকিম সাহেবের বদলি আদেশ রদের তদবির করা হলো না। জেলা শহরটিতে তিনি চলেই এলেন। প্রথম প্রথম একদমই মন না বসলেও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। প্রথম প্রথম মন না বসার যেমন যৌক্তিক কারণ ছিল তেমনি ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ারও যৌক্তিক কারণ তৈরি হয়েছিল।
এখানে ক্লাবে আড্ডা জমে না। সন্ধ্যা ৭টায় ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। বিনোদনের জন্য পার্ক, থিয়েটার দূরে থাকুক একটা খেলার মাঠ পর্যন্ত নেই। আসলে তার মন বসবে কেন? পরবর্তীতে হাতে যখন কাঁচা টাকা আসতে থাকে, গোঁয়ার লোকগুলোর ঘাড়ের বেয়াড়া রগগুলো চেনা হয়ে যায়, ঢাকা যাবার এসি বাস রাস্তায় নেমে যায়, সেতু তৈরি হয়ে ফেরি পারাপারের ঝক্কি উঠে যায় দেখতে দেখতে। তখন তার মন বসতে থাকে, শান্ত-নির্ভেজাল, কোলাহলহীন শহরটা তার ভালো লাগতে থাকে।
এই ভালোলাগা হঠাৎ কিছুটা হোঁচট খায় পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা প্রলয়ংকরী বন্যায়। হিমশিম অবস্থা তখন, আজ এ মন্ত্রী আসেন তো কাল ও মন্ত্রী, আজ এ ভিআইপি তো কাল অন্য ভিআইপি। মহামান্য ত্রাণদাতারা মূল্যবান ত্রাণ দিবেন তো সবচেয়ে ভালো নৌকাটা নেয়া চাই। ভিতরে পাঁচতারা হোটেলের সুবিধা তৈরি করা চাই, প্রয়োজনীয় প্রটোকল তো আবশ্যক। কোথাও তিল পরিমাণ ক্রটি ঘটবার সুযোগ নেই, শা-লা, ঘুম হারাম। উদয়াস্ত বন্যা সামলাতে সামলাতে মড়ার ওপর খাড়ার ঘা-এর মতো মন্ত্রী সামলাতে তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন, উপরন্তু সব সময় ঘাড়ের ওপর খড়গ হয়ে ঝুলে থাকে ক্রটি ঘটবার ভয়। স্যার বিরক্ত হলে এসিআর এ লাল দাগ পড়ার ভয়। পরিণামে পুরো ভবিষ্যত অন্ধাকারাচ্ছন্ন হবার ভয়। তখন ভাবতে লাগলেন, ধুত্তরি কেন যে তখন গিন্নির কথা শুনে এই হাওড় এলাকায় আসতে রাজি হলেন।
২
সিরাজ আলীর ছেলেটি ক’দিন ধরেই বায়না ধরেছে মোরগের সালুন দিয়ে ভাত খাবে। ছেলেটা সবে দুই মাস জন্ডিস থেকে সেরে উঠেছে। খাবার দাবারের কড়া নিয়ন্ত্রণের সাথে ঘরবন্দি থেকেছে। এই দু’মাস সিরাজ আলী দীর্ঘ সময় অফিস করে যতটা সময় হাতে থেকেছে মসজিদে মসজিদে কাটিয়েছে। একটি মাত্র সন্তান তার। স্ত্রীর হাইপ্রেসারের কারণে প্রথম সন্তানের জন্মের পর আর সন্তান গ্রহণ করেননি। বলা ভালো করতে পারেননি। ঘর ভর্তি নাতি-নাতনির যে ভীষণ শখ তার আম্মার ছিল। তার পূরণ হয়নি-যে কারণে আরেকটি বিয়ের জন্য অনেক পীড়াপীড়ি সহ্য করতে হয়েছে দীর্ঘদিন, আম্মাকে না খেপিয়ে, স্ত্রীকে পীড়া না দিয়ে দুর্বিষহ সেই পরিস্থিতি সামলেছেন একা। অন্ধের যষ্ঠী সেই ছেলেটির যখন অসুখ ধরা পড়ে তখন বাড়াবাড়িও ছিল বেশি রকম। পরিচর্যার অত্যাচারে ছেলেটির খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কাহিল ছেলেটি তাই ভালো হয়েই ভালো-মন্দ খেতে চায়। মোরগের সালুন আর পোলাও ভাত। দু’পয়সার চাকরি করে তো আর ছেলের বায়না মিটাতে যখন তখন মোরগ কেনা যায় না। ঠিক করে রেখেছিলেন তাই বেতনটা পেয়েই বাজারে যাবেন।
বাজারে যাবার সময় ছেলেটাও বায়না ধরলে প্রথমটায় তিনি রাজী হননি। স্ত্রী এগিয়ে দিল-- যাক না, শখ করেছে। তাড়া দিয়েছিলেন তিনি, গেলে তাড়াতাড়ি, অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে। দেড়শ টাকায় একটা দেশি মোরগ, নতুন আলু আর কেজি দুয়েক পোলাও-চাল কিনে মনটা তার সাড়ে বাইশ হাত হয়ে যায়। কখনো চোখে আনন্দে জল এসে যায়। সেই জল আড়াল করে ছেলেকে নিয়ে রিক্সায় চাপেন তিনি। দাড়িতে হাত বুলিয়ে ছেলেকে বলেন, আম্মাকে বলবি ঝাল কম দিয়ে রানতে। ছেলেটা যখন মাথা কাত করে সম্মতিতে তখন সিরাজ মিয়ার সাধ হয় ছেলের কপালে আদুরে চুমু খান। কোলাহল মুখর রাস্তায় নিজেকে সংযত করেন আর ভাবেন দুপুরে ঠিক সময়ে বাসায় ফিরবেন আজ, মোরগের সালুন দিয়ে ভাত খেয়ে তৃপ্ত ছেলেকে আদর করবেন।
অতঃপর সবাই যখন তাড়া দিচ্ছে তাকে ছেলেকে আদর করার জন্য তখন সিরাজ মিয়া স্তব্ধ। তার মাথা কাজ করছে না। সে উপলব্ধি করতে পারছে না আসলে ঘটনাটা কী ঘটেছে। একি স্বপ্নে-না বাস্তবে? মাত্র না ঘণ্টাখানেক আগে, ছেলেটিকে রিক্সা থেকে নামিয়ে দিয়ে গেছেন হাতে মোরগ আর বাজারের ব্যাগটা দিয়ে। মোরগটা তখনো উঠোনের এককোণে কক-ক-ক শব্দে নিজের জীবন্ত অস্তিত্ব ঘোষণা করছিল। রাস্তাটা পার হয়েই বাসায় পৌঁছাবে ছেলেটা, নিশ্চিন্ত মনে অফিস গিয়েছে সে, এর মধ্যে কী ঘটল? সিরাজ মিয়ার চোখে জল আসে না। সে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকে সবার সামনে। সবাই যখন তাড়া দেয়-- ছেলেটাকে শেষবারের মতো আদর কইরা দাও বাবা। তখন সিরাজ মিয়া ভাবে, এখন কেন? ছেলেকে তো সে আদর করবে মোরগের সালুন দিয়ে ভাত খেতে খেতে।
পত্রিকায় ছবি ছাপা হয় তার ছেলের হাস্যোজ্জ্বল, ঘাতক ট্রাকটিকে ধরা যায়নি, পুলিশ তৎপর। মুরব্বিরা পরামর্শ দেয়, মরা ছেলের ছবি না ছাপানোই ভাল বাবা। ছেলের মা ঝাঁপিয়ে পড়ে ছবির ওপর--আমার বাপ রে বাপ, মোরগের সালুন দিয়ে ভাত খাবেরে বাপ। পাড়ায় মসজিদে মিলাদ মাহফিলে হুজুর কোরানের আয়াত ব্যাখ্যা করেন- আল্লা বান্দার জন্ম দিয়াছেন, তিনি নেবার মালিক। এই নিষ্পাপ বালকটিকে দীর্ঘ দশ বছর প্রতিপালন করেছে সিরাজ মিয়া, আল্লার মাল আল্লাহ নিয়া গেছে, হয়তো বা এই নিষ্পাপ বালকটিকে প্রতিপালনের উছিলায় আল্লাহ সিরাজ মিয়ার সব গুণাহ মাফ করে দিবেন। সিরাজ মিয়া গত দু’মাস কাটিয়েছেন মসজিদে। তার পরের দু’মাস তার কাটতে থাকে গোরস্থানে। মুরব্বিরা গভীর রাতে তাকে বাড়ি ধরে আনেন। বলেন- আল্লাহর নাম নাও বাবা, তিনি মনে শান্তি দিবেন।
৩
জাহাঙ্গীর আলমের ঘরে এক ফুট পানি। উঠোনে দুই ফুট। নড়বড়ে চৌকিটার ওপর বিছানা বালিশ, হাঁড়ি-পাতিল একসাথে। কোথায় রান্না হয়, কোথায় খানা, বউটা বাড়ি ফিরলেই প্যান প্যান করে--সারাদিন বাইরে বাইরে থাকেন। আমি পোলা মাইয়া লইয়া কি করি একলা পানির মাইঝে। মূর্খ, ছোটলোক বলে বউকে গালি দিলেও মনে মনে তারও ভীষণ বিরক্ত লাগে। কী ব্যাঙের চাকরি। ঘরে বউ পোলাপান বন্যার থৈহীন পানিতে ভাসিয়ে তাকে সারাদিন ঘুরতে হয় বাজারে বাজারে পাবদা আর কৈয়ের খোঁজে। ত্রাণ দেয়ার জন্য যারা ঘাঁটি গেড়েছেন সার্কিট হাউজের ভিআইপি কক্ষে, তাদের জন্য প্রতিদিন খাবার মেনু তৈরি করার দায়িত্ব তার। এল আর ফান্ড থেকে টাকা দিয়েই খালাস ডিসি স্যার। এই আকালের বাজারে কোত্থেকে যোগাড় হয় দুর্লভ সে সব মেনু। যা কিনা ভিআইপিরা মুখ ফুটে খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অফিসে কোনও ডিউটি নেই তার এখন, সকাল থেকে ব্যস্ত থাকতে হয় ভিআইপিদের প্রয়োজন মেটানোর তাগাদায়, তাদের সেবায় নিবেদিত হয়ে। গভীর রাতে ডিনার শেষে এসি রুমে বরফ ঠাণ্ডা পানি দিয়ে তবে তার ছুটি মিলে পরদিনের তাড়া নিয়ে। ঘরে ফিরে বউয়ের প্যান প্যানানি যতোই যৌক্তিক হোক, মুখে তো আর স্বীকার করা যায় না। বৌয়ের কাছে বড় গলায় চিৎকার না করলে ঠিক পুরুষত্ব থাকে না। কিন্তু নিজের কষ্টটা বলার কিংবা বোঝার যে কেউ নেই- এই কষ্ট আর বিরক্তি তার রাগে পরিণত হচ্ছে। এতো ছোট চাকরি করে সে, যে-চাকরির নিচে রাগ দেখানোর মতো আর কেউ বাকি থাকে না। শেষ ভরসা বউ, তার কাছে এসব বয়ান করাই বৃথা, কষ্টতো সে বুঝবে না। উলটো স্বামীর গরবে গরবিনী হয়ে ভাববে স্বামী তার কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। পথে অবসরপ্রাপ্ত হেডক্লার্ক বড় বাবুকে পেয়ে তাই ক্ষোভে ফেটে পড়ে, গলদা চিংড়ি খোঁজার প্রচেষ্টা তার বিলম্বিত হয়। মন খুলে সে বলতে থাকে চলতি হাল-হকিকতের কথা। চাকরি আর করা যাবে না স্যার, চাকরির দিন শেষ। আপনাদের আমলের সাথে এ আমলের ফারাক আকাশ-পাতাল। তেনারা ত্রাণ দিবেন আর আমাদের খাওয়া ঘুম হারাম হবে মাছ খুঁজতে খুঁজতে। বুইজলেন না স্যার, ভাল লাগে না স্যার এই ব্যাঙের চাকরি।
৪
ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা এলাকার মুরুব্বিও বটে। বাস ট্রাক মালিকের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে সব শ্রেণি/পেশার সমন্বয়ে যে-সভা ডাকেন, সেখানে সবার বক্তৃতাই দুঃখ-শোককে ফেনিল করে সান্ত্বনার মোড়কে ঢেকে পুত্র শোকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে চায়। সভায় জোরেসোরে উচ্চারিত হয় এলাকায় একটি স্পিডব্রেকার তৈরির দাবি। সেই সাথে পুত্র বিয়োগের শোক ভুলিয়ে দিতে উত্থাপিত হয় ক্ষতিপূরণ দানের দাবি। দাতারা বিনা বাক্যব্যয়ে রাজিও হয়। কেবল টাকার অংকটাই যা বাকি থাকল সিরাজ আলীর জন্য। নিজের মুখে অংকটা যদি বলে সিরাজ আলী তবে তা যতো বড়ই হোক, দেবার সর্বাত্বক চেষ্টা করবে মালিক সমিতি।
প্রথমে কিছুই বলতে রাজি না হলেও সবার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত সিরাজ আলী যখন নতমুখে বিধ্বস্ত অবয়বে উঠে দাঁড়ায় তখন তার দু’চোখের অঝোর ধারায় ভিজতে থাকে পুরো সভা। পিনপতন স্তব্ধতায় মিনিট পাঁচেক সময় যায় কেবল ধাতস্থ হতে, পরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সিরাজ আলী বলে--টাকা পয়সার দরকার আমার নাই, আমার ছেলের মতো আর কোন ছেলে যেন অকালে না মরে তার ব্যবস্থায় রাস্তাটার ওপর একটা স্পিডব্রেকার তৈরি করার জইন্য যদি আমার কিছু করতে হয়, তাইলে আমারে বলবেন, আমি তা করব, যেখানে যেতে হয় যাব। ছেলের জন্য শুধু দোয়া কামনা করে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ে সিরাজ আলী।
এলাকায় নিজ ক্ষমতার দৌঁড় দেখানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়ে পুরো দায়িত্বটাই কাঁদে তুলে নিলেন নেতা মহোদয়, সিরাজ আলীকে নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করলেন এলজিডি থেকে সিএন্ডবি, পৌরসভা থেকে জেলা প্রশাসক ও এমপি'র দপ্তর। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের বদনাম মিথ্যে করে, মোটামুটি রাতারাতি ফাইল ওয়ার্ক হয়ে অল্প ক'দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গেল একটি স্পিডব্রেকার নির্মাণের। নেতার ভ্রাতা ছোটোখাটো কন্ট্রাক্ট করে যে হাত পাকাচ্ছে কেবল, তার বিশেষ তদারকিতে দ্রুত তৈরি হয়ে গেল স্পিডব্রেকার। তারও পরদিন অফিসগামী জনগণ, সাধারণ রিক্সাওয়ালা, নিত্য পথচারীসহ সবাই অবাক চোখে দেখল সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে সরকারের প্রতিটি সেক্টর কতটা আন্তরিক।
এডিসি জেনারেল সাহেবের গত কয়েক রাত ঘুম নেই। ঘুমোনোর সময় ফুসরত মিলেছিল যে ঘণ্টা কয়েক, তাও গ্রাস করেছিল উদ্বিগ্নতা আর দুশ্চিন্তা। ফলে নির্ঘুমও থাকতে হয়েছে গত কয়েকদিন। আজ নেতা আসছেন শহরে। সব ব্যবস্থা নিশ্চিদ্র, ক্রটিহীন করতে কয়েক রাত নির্ঘুম থাকলেও, তিনি জানেন না শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হবে কি না। জেলা স্কুলের যে-মাঠটিতে মহামান্য নেতা ভাষণ দিবেন, বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণ করবেন, সে স্কুলের পুরোটা রং করা হয়েছে, গাছগুলো সাজানো হয়েছে আধাআধি সাদা রঙে। ডালপালা ছেটে ঝকঝকে করা হয়েছে পুরো প্রাঙ্গন। সাজাতে হয়েছে পুরো শহরকেও। রাস্তায় দু’পাশে স্তুপিকৃত ইট বালু সরানো হয়েছে। যত্রতত্র পার্কিং করা বাস, ট্রাক ইত্যাদি যানগুলোকে নেয়া হয়েছে নির্দিষ্ট স্থানে। সমস্ত অফিস আদালতে সবাইকে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকার কঠোর নির্দেশ জারি করা হয়েছে। রাস্তাঘাট ঝাড় দিয়ে পরিস্কার রাখা হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। ড্রেন আর ডাস্টবিনগুলো নোংরা আবর্জনাহীন। জেলা স্কুল কর্তৃপক্ষসহ সরকারি বেসরকারি দপ্তরগুলোতে কারও স্বস্তি নেই।
মহামান্য নেতা যেদিন শহরে পদার্পন করবেন, সেদিন মূল্যবান ত্রাণের লোভে সকাল থেকেই স্কুল প্রাঙ্গনের আশেপাশে ভিড় জমাতে থাকে অভুক্ত, ভাসমান, ডুবে থাকা শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। মাত্র শ’খানেক সৌভাগ্যবান বন্যার্তদের সৌভাগ্য হয় ভিতরে প্রবেশের। বাইরে অন্যদের অপেক্ষা চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মাথার ওপর চড়তে থাকে রোদ, যদিও বন্যার পানি স্থির হয়ে থাকে।
অবশেষে মহামান্য নেতা আসেন, কিন্তু তখন তার হাতে সময় খুব কম। মূল্যবান বক্তব্য শেষে তিনি কেবলমাত্র জনাপাঁচেক বন্যার্ত, ক্ষুধার্ত, অভাবী মানুষকে ত্রাণ বিতরণ করতে পারেন। বাকিরা পুলিশের লাঠির বাড়ি, নেতাদের ধাক্কা, বন্যার্তদের ঠেলা খেয়ে কেউবা ত্রাণের বস্তা হাতে, কেউবা খালি হাতে সন্ধ্যা নামবার আগে বন্যার পানিতে থৈ থৈ ভাসতে থাকা অভুক্ত, অর্ধভুক্ত পরিবারগুলোর কাছে ফিরে যায়। মহামান্য নেতাও বহু মূল্যবান গাড়ির এসি ঠাণ্ডায় নির্বিঘ্নে রাজধানীতে ফিরে যান। এডিসি জেনারেল সাহেব ডিসি সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ভাসুক মানুষ, থাকুক বন্যার থৈ থৈ পানি আরও কিছুদিন। সবেচেয়ে বড় বিপদটাতো পার পাওয়া গেল! আজ রাতটা শান্তিতে ঘুমানো যাবে।
৫
প্রাইমারি স্কুলের সহকারি শিক্ষক জাহানারা বেগম, এতক্ষণ যাবৎ বর্ণিত এডিসি সাহেব, সিরাজ মিয়া, জাহাঙ্গীর আলমদের কারো সাথে তার যদিও প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই, তবে প্রলয়ংকরী বন্যা তাকেও ছেড়ে যায়নি। বন্যার থৈহীন পানিতে ভেসেছে তার বাড়িঘর। ঘর ছেড়ে তাকে থাকতে হয়েছে আত্মীয় বাড়িতে। স্কুলটিও ডুবে গিয়েছিল দুই ফুট পানির নিচে। বন্যার পানি বাড়তে বাড়তে, কমতে কমতে জাহানারা বেগমের ছ’মাসের জন্ম না নেয়া সন্তানটি আট মাসে পা রাখে। তারপর পানি একেবারে কমে গেলে, স্কুলের বিল্ডিংটি ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে ফেললে, সুদীর্ঘ ক’দিনের বিরতি শেষে স্কুলে যাবার পথে তিনি দেখলেন রাস্তার স্পিডব্রেকারগুলি নেই। তিনি হাঁফ ছাড়লেন। ক’টা মাস খুব কষ্ট করে রিক্সা পারাপার করতে হয়েছে তাকে। দ্রুত স্পিডে স্পিডব্রেকার ডিঙানোতে প্রচণ্ড উৎসাহী ড্রাইভারকে গর্ভস্থ সন্তানের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় হাত পাঁচেক দূর থেকেই বার বার সাবধান করতে হতো জাহানারার। আজ স্পিডব্রেকারহীন সমতল রাস্তাটি তাকে নিশ্চিন্ত করে।
পরক্ষণেই তার হাঁফ ছাড়া নিশ্চিন্ততা গ্রাস করে বিষণ্নতা। আহারে এ স্পিডব্রেকারটি থাকলে উদ্দাম ঘাতক ট্রাকটি সে দিন সিরাজ মিয়ার বাচ্চাটিকে চাপা দিতে পারতো না। নিজের অনাগত সন্তানটির অস্পষ্ট চেহারার সাথে ক্লাশ ফোরের বেঞ্চে বসে থাকা নিষ্পাপ ছেলেটির চেহারাটার কোথায় যেন মিল দেখে সে। একই সাথে ভাবনাটাও জাগে প্রাসঙ্গিকভাবে। স্পিডব্রেকারটি ভাঙল কারা, কেন ভাঙল?
রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাওয়া গেল না। উত্তর পাওয়া গেল না হ্যাডমিসট্রেসকে জিজ্ঞেস করেও। উত্তর না মেলা কৌতুহলটি ক্রমে ক্রমে বিলীন হয়ে যায় মনের ভিতরেই। ইতিমধ্যে তার অনাগত সন্তানটি পৃথিবীর আলো দেখে। মেটারনিটি লিভের সময়ও ফুরিয়ে যায়। মাস ছয়েকের তুলতুলে বাচ্চাটিকে ফেলে স্কুলে যেতে মন তার নিয়ন্ত্রণহীন হয়। তবুও সংহত করে স্কুলের উদ্দেশ্যে রিক্সায় যেতে যেতে দেখেন রাস্তাটি তখনও সমতলই আছে। বন্যায় ত্রাণ দিতে আসা মহামান্য নেতার আসতে অসুবিধা হবে, মূল্যবান গাড়ির এসি রুমে মহামান্য নেতা ঝাঁকুনি খাবেন বলে এলাকাবাসীর বাধার মুখে পুনরায় শীঘ্রই তৈরি করে দেয়া হবে এই প্রতিশ্রুতিতে স্পিডব্রেকারটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। জাহানারা বেগমের বাচ্চাটিও একসময় মায়ের হাত ধরে স্কুলে আসতে থাকে। স্পিডব্রেকারটি আর তৈরি হয় না, আর ভেঙে ফেলার ইতিহাসটিও জানা হয় না সহকারি শিক্ষক জাহানারা বেগমের।
0 মন্তব্যসমূহ