১.
কালো ঘুড়িটা হঠাৎ করেই কাৎ হয়ে পাক খেল, যেন চাঁদা মাছ হাঙর দেখে দিশেহারা হয়ে কোথায় পালাবে বুঝতে পারছে না। পালানোরই কথা কারণ অমলের লাল কয়রা ঘুড়ির সুতো কালো ঘুড়ির সুতোকে পেঁচিয়ে ফেলেছে। অমল তার সুতোর ওপর বিশ্বাস রাখে, ঐ কালো ঘুড়িটা তারই এটা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। নাটাইয়ে টান দেয় অমল, কিন্তু আকাশের খেলার মাঠে পৃথিবীর বিশ্বাস সব সময় চলে না। কালো ঘুড়ি আর একটা ঘূর্ণি দিয়ে উঠে গেল অনেক ওপরে, সাথে নিয়ে গেল অমলের লাল ঘুড়িটাকে।
কালো ঘুড়ি অমলের লাল ঘুড়ির সুতো কেটে দিয়েছে। লাল ঘুড়িটা উড়ে যেতে থাকল। ঘুড়িটা অমল মাসখানেক আগে চার আনা দিয়ে বাংলাবাজার থেকে কিনেছিল। তার বন্ধু দুলাল তাকে ঘৃতকমলে মাঞ্জা দেওয়া, কাচের গুড়ো লাগানো সুতো দিয়েছিল, সেই সুতো কোনো কাজেই লাগল না। কিন্তু সুতোর চেয়ে বড় কথা ঐ ঘুড়িটা অমলের হৃদয়ের অংশ ছিল। ঘরে জায়গা নেই, তবু রাত্রিবেলা মাথার পেছনে ঘুড়িটা না রেখে ঘুমালে তার চলে না। মা খুব বকাবকি করেন, কিন্তু অমলের রাতে ঘুম হয় না ঘুড়ি দূরে রাখলে। ঘুড়ি মাথার কাছে রাখলে স্বপ্ন দেখে অমল সে যেন এক পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছে, আর অন্য যেসব ঘুড়ি তার ঘুড়ির সমান উচ্চতায় উঠতে চাইছে তাদের সে অনায়াসে কেটে দিচ্ছে, সেইসব কাটা ঘুড়ি ভেসে যাচ্ছে দিগন্তে লাল মেঘের পেছনে যেখানে সূর্য ডুবছে।
কিন্তু আজ তারই কাটা ঘুড়ি উড়ে যায় রাজার দেউড়ি পেরিয়ে, কারকুন বাড়ি লেন পেরিয়ে, পানি টোলা রোড পেরিয়ে, কোতোয়ালি পেরিয়ে, নবরায় লেন পেরিয়ে নদীর দিকে। তার স্বপ্নের আধার ভেসে যায়, কপালের ওপর ডান হাতটা তুলে চোখকে সূর্যের আলো থেকে বাঁচিয়ে অমল দেখতে চায় ঘুড়িটা কোনদিকে যাচ্ছে। দক্ষিণে, পুরনো শহরের কালো শ্যাওলা জমা ছাদগুলোর ওপর, জং-ধরা জলের ট্যাংকগুলোর ওপর দিয়ে সোজা দক্ষিণে, চৈত্রের নিদাঘ আকাশে এক নির্মোহ উদাসীনতায় গা এলিয়ে অমলের লাল ঘুড়ি চলে যেতে থাকে। তার ঘুড়ির নির্বিকার বিশ্বাসঘাতকতায় অমলের চোখে জল আসে, দু-গাল বেয়ে টসটস করে জল পরে। কিন্তু ক্ষণিকের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠে তেতলার ছাদ থেকে এক অন্ধকার সরু সিঁড়ি বেয়ে হুড়মুড় করে অমল নিচে নেমে আসে। নামতে নামতে একটা ভাঙা সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। বাড়ি থেকে বের হতে হতে মা'র গলা শোনে সে, "এই দুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?" কিন্তু অমলের তখন থেমে উত্তর দেবার সময় নেই।
রাস্তায় নেমে ওপরে তাকিয়ে ঘুড়িটা দেখতে পায় না অমল। ছোট গলিটার ওপরে এক চিলতে মেঘহীন আকাশ পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে। দুপুর তিনটে, রাস্তায় লোক কম, দোকানের ঝাঁপি বন্ধ। গলি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে অমল একটা খোলা জায়গায়। জগন্নাথ কলেজ, উল্টোদিকে বাহাদুর শাহ পার্ক যার নাম পুরনো সময়ে ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক। এখানেও রাস্তা বেশ ফাঁকা, একটু হেঁটেই ঘুড়িটার দেখা পায় অমল, পাটুয়াটুলির আকাশে তার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল সেই লাল চতুষ্কোণ, তাকে দেখে পশ্চিমদিকে মোড় নেয় ঘুড়ি। ইসলামপুর রোডের ওপর দিয়ে ওড়ে, কিন্তু দুদিকে দুলতে দুলতে নিচেও নামে। অমল রাস্তার ডানদিকে ঘেঁষে দৌড়িয়ে ইসলামপুর রোডে ঢোকে। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, কিন্তু সেই কাজের দিনেও ইসলামপুর রোড ফাঁকা ছিল। ঘুড়িটা প্রায় হঠাৎ করেই রাস্তার ডানদিকে কয়েকটা বাড়ির পেছনে অদৃশ্য হয়ে যায়।
অমল প্রথমে বুঝে পায় না কিভাবে সে ঐ বাড়িগুলির পেছনে যাবে। একটু এগিয়ে দেখল রাস্তার ডানদিকে কবিরাজ লেন বেরিয়ে গেছে। কিছু পরেই হাতের ডানদিকে আর একটা ছোট গলি পড়ল, অমলের মনে হল এই গলিটার আশেপাশেই ঘুড়িটা নেমে আসতে পারে।
কালো ঘুড়িটা হঠাৎ করেই কাৎ হয়ে পাক খেল, যেন চাঁদা মাছ হাঙর দেখে দিশেহারা হয়ে কোথায় পালাবে বুঝতে পারছে না। পালানোরই কথা কারণ অমলের লাল কয়রা ঘুড়ির সুতো কালো ঘুড়ির সুতোকে পেঁচিয়ে ফেলেছে। অমল তার সুতোর ওপর বিশ্বাস রাখে, ঐ কালো ঘুড়িটা তারই এটা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। নাটাইয়ে টান দেয় অমল, কিন্তু আকাশের খেলার মাঠে পৃথিবীর বিশ্বাস সব সময় চলে না। কালো ঘুড়ি আর একটা ঘূর্ণি দিয়ে উঠে গেল অনেক ওপরে, সাথে নিয়ে গেল অমলের লাল ঘুড়িটাকে।
কালো ঘুড়ি অমলের লাল ঘুড়ির সুতো কেটে দিয়েছে। লাল ঘুড়িটা উড়ে যেতে থাকল। ঘুড়িটা অমল মাসখানেক আগে চার আনা দিয়ে বাংলাবাজার থেকে কিনেছিল। তার বন্ধু দুলাল তাকে ঘৃতকমলে মাঞ্জা দেওয়া, কাচের গুড়ো লাগানো সুতো দিয়েছিল, সেই সুতো কোনো কাজেই লাগল না। কিন্তু সুতোর চেয়ে বড় কথা ঐ ঘুড়িটা অমলের হৃদয়ের অংশ ছিল। ঘরে জায়গা নেই, তবু রাত্রিবেলা মাথার পেছনে ঘুড়িটা না রেখে ঘুমালে তার চলে না। মা খুব বকাবকি করেন, কিন্তু অমলের রাতে ঘুম হয় না ঘুড়ি দূরে রাখলে। ঘুড়ি মাথার কাছে রাখলে স্বপ্ন দেখে অমল সে যেন এক পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছে, আর অন্য যেসব ঘুড়ি তার ঘুড়ির সমান উচ্চতায় উঠতে চাইছে তাদের সে অনায়াসে কেটে দিচ্ছে, সেইসব কাটা ঘুড়ি ভেসে যাচ্ছে দিগন্তে লাল মেঘের পেছনে যেখানে সূর্য ডুবছে।
কিন্তু আজ তারই কাটা ঘুড়ি উড়ে যায় রাজার দেউড়ি পেরিয়ে, কারকুন বাড়ি লেন পেরিয়ে, পানি টোলা রোড পেরিয়ে, কোতোয়ালি পেরিয়ে, নবরায় লেন পেরিয়ে নদীর দিকে। তার স্বপ্নের আধার ভেসে যায়, কপালের ওপর ডান হাতটা তুলে চোখকে সূর্যের আলো থেকে বাঁচিয়ে অমল দেখতে চায় ঘুড়িটা কোনদিকে যাচ্ছে। দক্ষিণে, পুরনো শহরের কালো শ্যাওলা জমা ছাদগুলোর ওপর, জং-ধরা জলের ট্যাংকগুলোর ওপর দিয়ে সোজা দক্ষিণে, চৈত্রের নিদাঘ আকাশে এক নির্মোহ উদাসীনতায় গা এলিয়ে অমলের লাল ঘুড়ি চলে যেতে থাকে। তার ঘুড়ির নির্বিকার বিশ্বাসঘাতকতায় অমলের চোখে জল আসে, দু-গাল বেয়ে টসটস করে জল পরে। কিন্তু ক্ষণিকের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠে তেতলার ছাদ থেকে এক অন্ধকার সরু সিঁড়ি বেয়ে হুড়মুড় করে অমল নিচে নেমে আসে। নামতে নামতে একটা ভাঙা সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। বাড়ি থেকে বের হতে হতে মা'র গলা শোনে সে, "এই দুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?" কিন্তু অমলের তখন থেমে উত্তর দেবার সময় নেই।
রাস্তায় নেমে ওপরে তাকিয়ে ঘুড়িটা দেখতে পায় না অমল। ছোট গলিটার ওপরে এক চিলতে মেঘহীন আকাশ পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে। দুপুর তিনটে, রাস্তায় লোক কম, দোকানের ঝাঁপি বন্ধ। গলি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে অমল একটা খোলা জায়গায়। জগন্নাথ কলেজ, উল্টোদিকে বাহাদুর শাহ পার্ক যার নাম পুরনো সময়ে ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক। এখানেও রাস্তা বেশ ফাঁকা, একটু হেঁটেই ঘুড়িটার দেখা পায় অমল, পাটুয়াটুলির আকাশে তার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল সেই লাল চতুষ্কোণ, তাকে দেখে পশ্চিমদিকে মোড় নেয় ঘুড়ি। ইসলামপুর রোডের ওপর দিয়ে ওড়ে, কিন্তু দুদিকে দুলতে দুলতে নিচেও নামে। অমল রাস্তার ডানদিকে ঘেঁষে দৌড়িয়ে ইসলামপুর রোডে ঢোকে। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, কিন্তু সেই কাজের দিনেও ইসলামপুর রোড ফাঁকা ছিল। ঘুড়িটা প্রায় হঠাৎ করেই রাস্তার ডানদিকে কয়েকটা বাড়ির পেছনে অদৃশ্য হয়ে যায়।
অমল প্রথমে বুঝে পায় না কিভাবে সে ঐ বাড়িগুলির পেছনে যাবে। একটু এগিয়ে দেখল রাস্তার ডানদিকে কবিরাজ লেন বেরিয়ে গেছে। কিছু পরেই হাতের ডানদিকে আর একটা ছোট গলি পড়ল, অমলের মনে হল এই গলিটার আশেপাশেই ঘুড়িটা নেমে আসতে পারে।
গলিটার মধ্যে সূর্যের আলো ঢোকার ব্যবস্থা ছিল না। কয়েক ফুট চওড়া, দুজন মাত্র মানুষ পাশাপাশি যেতে পারে। গলিটার শেষে, প্রায় শ'দুয়েক ফুট দূরে সূর্যালোক চোখে পড়ে, সুরঙ্গর শেষে যেমন আলো দেখা যায়। দুদিকে কিছু জায়গায় উঁচু পাঁচিল, কিছু জায়গায় কোনো কোনো বাড়ির দরজা, কোনো জায়গায় আবর্জনা ফেলা, একপাশে খোলা ড্রেন। সেই নির্জন গলিতে কিছুটা ভয়ে ভয়ে অমল পা ফেলে হাঁটে, কিন্তু একটু পরেই দেখে তার লাল ঘুড়িটা ঠিক গলির মাঝখানে পড়ে আছে। বিশ্বাস করতে পারে না সে নিজের ভাগ্যকে। তার বন্ধু শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে নি। দৌড়ে যেয়ে মাটি থেকে দু'হাতে যত্ন করে ঘুড়িটা তোলে অমল। দাঁড়ায়, খুঁটিয়ে দেখে কোনো জায়গায় কাগজ ছিঁড়েছে কিনা।
দূরে, গলির অপর প্রান্তে গোলযোগ শোনে অমল। ভাল করে সেই দিকটা দেখতে পায় না, মনে হয় একটা ছায়া দৌড়ে আসছে। তারপর বোঝে একজন মানুষ তার দিকে দৌড়াচ্ছে, সূর্যের আলোটা পেছনে থাকায় তাকে একটা কালো ছায়া মনে হচ্ছিল। কিন্তু সেই লোকটির পেছনে আরো কয়েকজন ছিল, কয়েক সেকেন্ড লাগল, অমল বুঝল সামনের লোকটিকে ধরার জন্য পেছনের মানুষ ক'টি তাড়া করছে। অমল খুব ভয় পেল, কিন্তু ওরা যে বেগে দৌড়াচ্ছে তাতে, সে তাদের আগে, গলির এই প্রান্তে, যে প্রান্ত দিয়ে সে ঢুকেছিল, সেখানে পৌঁছুতে পারবে না। দেয়ালে ঠেস দিয়ে প্রায় দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে অমল।
সামনের মানুষটা অমলের থেকে দশ ফুট মত দূরে এলে অমলের উপস্থিতি বুঝতে পারে। তার হাতে ধরা একটা জিনিস থেকে রঙিন আলো এসে পড়ে অমলের মুখে। বেশ বয়স্ক মানুষ, অমল ভাবে, চল্লিশ বছর তো হবেই, পঞ্চাশও হতে পারে, ষাট হলেও আশ্চর্য হত না সে। অমলের মত বয়সের কিশোরদের বড় মানুষের বয়স সম্পর্কে ধারণা নেই। অমল দু'হাত দিয়ে ঘুড়িটাকে যেভাবে আগলে রেখেছিল সেটা দেখে সেই বয়স্ক মানুষটা যেন তার দৌড়ের খেই হারিয়ে ফেলল। অমলের মনে হল সে যেন মুহূর্তের জন্য থেমে গেল, তারপর একটা অদ্ভুত কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠল, "রান, বয়, রান।" তার কপালের একটা প্রান্ত রক্তাক্ত। তার উদভ্রান্ত চোখ দেখে মনে হল সে যেন আরো কী বলতে চেয়েছিল, কিন্তু পেছনের লোকগুলো ততক্ষণে খুব কাছে চলে এসেছে। শুধুমাত্র তখনই অমল বুঝল তাড়া করছে যে মানুষগুলো তার বয়স্ক নয়, চার-পাঁচটা পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে। কিন্তু ওরা যেন অমলকে দেখতেই পেল না। তাড়া-খাওয়া মানুষটা আর ঐ ছেলেগুলো গলির এই প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে গেল।
সেই রাতে মেঝেতে পিঁড়ির ওপর বসে ভাতের সাথে কই মাছ খেতে খেতে অমল বলল, "মা, আমাকে আজ একটা লোক বলল, 'রান, বয়, রান।' ইংরাজিতে আমাকে দৌড়াতে বলল। কিন্তু আমাকে দেখে ইংরাজি বলল কেন, মা?"
২.
সেই বৃহস্পতিবারের পর আরো ২৩১৩টি বৃহস্পতি এলো, গেল। ১৬১৯১টি দিন পার হল, ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা প্রায় ১৪০ কোটি সেকেন্ড গুনল। বর্ষা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে, গ্রীষ্মের দাবাদহ কমেছে অল্প। দুপুর দুটোর সময় প্রৌঢ় অমল জগন্নাথ কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বহু বছর পরে দেশে ফিরেছে অমল। জগন্নাথ কলেজ এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, নতুন দালান উঠেছে, পুরনো জায়গা অচেনা হয়ে গেছে। রাস্তা পেড়িয়ে তার চোখে পড়ল বাহাদুর শাহ পার্কের পাশে ফুটপাথের ওপর একটা জটলা। প্রবাসী অমলের সব ব্যাপারেই কৌতূহল, রিক্সার স্রোত বাঁচিয়ে সে রাস্তা পার হয়, মানুষজনের ভিড় ঠেলে যায় জটলার ভেতর। মাটিতে কাৎ হয়ে পড়ে আছে একটা পাখী, চারজন পনেরো-ষোল বছরের কিশোর সেই পাখিকে ঘিরে রেখেছে। পাখীটার রক্তোৎপল ডানা, সাদা ঘাড় ও মাথা এবং বাঁকা ঠোঁট দেখে মুহূর্তেই চিনে নিল তাকে অমল - শঙ্খচিল। ঢাকার আকাশে শঙ্খচিলের দেখা সহজে পাওয়া যায় না। পাখীটার দুটো পা কালো সুতোয় বাঁধা। একটু সময় লাগল বুঝতে অমলের, তারপর বুঝল ঘুড়ির সুতো আকাশের বুক থেকে ছিনিয়ে এনেছে মুক্ত পাখীকে পঙ্কিল পৃথিবীতে। ক্লান্ত হয়েছিল পাখীটা, তবু মাঝেমাঝে ডানা ঝাপটাচ্ছিল। অমল ভাবল ছেলেগুলো পাখীটাকে মুক্ত করতে চাইছে, খুলতে চাইছে পায়ের সুতোর বেড়ি। কিন্তু তার ভুল ভাঙতে দেরী হল না, একটা ছেলে ছোট একটা ঢিল তুলে পাখীটার দিকে ছুঁড়ল। ঢিলটা পাখীটার পাখায় লাগল, পাখীটা শিশুর মত ডেকে উঠল। শঙ্খচিলের ডাক শিশুর কান্নার মত, অমলের হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে গেল সেই শব্দে। চিৎকার করে ওঠে অমল, "কী করছ তোমরা, পাখীটাকে মেরে ফেলবে তো?"
অমল ভাবে তার সাথে সায় দেবে উপস্থিত জনতা। কিন্তু নিশ্চুপ থাকে জনতা। চারটা ছেলে তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। তাদের পেছন থেকে হঠাৎ করে পঞ্চম একটি ছেলের আবির্ভাব হল। এতক্ষণ কোথায় ছিল এই ছেলেটি, ভাবে সে। পঞ্চমের পরিধানে জিনসের প্যান্ট, ইংরেজি লেখা গেঞ্জি। তার দৃষ্টির ক্রূরতা গ্রীষ্মের উষ্ণতাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। "কেরে, এইডা কই থিকা আইল?" ছেলেটি চেঁচিয়ে ওঠে, এই অনুষ্ঠানের সেই সর্দার। অমল পিছু হটে। পাঁচটি ছেলে তার দিকে এগিয়ে আসে। হঠাৎ একটা ঢিল এসে অমলের কপালে লাগে। ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে অমল, কপালে হাত দিয়ে দেখে রক্ত পড়ছে। কপালে হাত ওঠাতে ওঠাতেই তার চোখে পড়ে সর্দার ছেলেটি পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বার করছে। পালাতে হবে, পালাতে হবে, ক্ষণিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠে অমল।
সামনের মানুষটা অমলের থেকে দশ ফুট মত দূরে এলে অমলের উপস্থিতি বুঝতে পারে। তার হাতে ধরা একটা জিনিস থেকে রঙিন আলো এসে পড়ে অমলের মুখে। বেশ বয়স্ক মানুষ, অমল ভাবে, চল্লিশ বছর তো হবেই, পঞ্চাশও হতে পারে, ষাট হলেও আশ্চর্য হত না সে। অমলের মত বয়সের কিশোরদের বড় মানুষের বয়স সম্পর্কে ধারণা নেই। অমল দু'হাত দিয়ে ঘুড়িটাকে যেভাবে আগলে রেখেছিল সেটা দেখে সেই বয়স্ক মানুষটা যেন তার দৌড়ের খেই হারিয়ে ফেলল। অমলের মনে হল সে যেন মুহূর্তের জন্য থেমে গেল, তারপর একটা অদ্ভুত কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠল, "রান, বয়, রান।" তার কপালের একটা প্রান্ত রক্তাক্ত। তার উদভ্রান্ত চোখ দেখে মনে হল সে যেন আরো কী বলতে চেয়েছিল, কিন্তু পেছনের লোকগুলো ততক্ষণে খুব কাছে চলে এসেছে। শুধুমাত্র তখনই অমল বুঝল তাড়া করছে যে মানুষগুলো তার বয়স্ক নয়, চার-পাঁচটা পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে। কিন্তু ওরা যেন অমলকে দেখতেই পেল না। তাড়া-খাওয়া মানুষটা আর ঐ ছেলেগুলো গলির এই প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে গেল।
সেই রাতে মেঝেতে পিঁড়ির ওপর বসে ভাতের সাথে কই মাছ খেতে খেতে অমল বলল, "মা, আমাকে আজ একটা লোক বলল, 'রান, বয়, রান।' ইংরাজিতে আমাকে দৌড়াতে বলল। কিন্তু আমাকে দেখে ইংরাজি বলল কেন, মা?"
২.
সেই বৃহস্পতিবারের পর আরো ২৩১৩টি বৃহস্পতি এলো, গেল। ১৬১৯১টি দিন পার হল, ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা প্রায় ১৪০ কোটি সেকেন্ড গুনল। বর্ষা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে, গ্রীষ্মের দাবাদহ কমেছে অল্প। দুপুর দুটোর সময় প্রৌঢ় অমল জগন্নাথ কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বহু বছর পরে দেশে ফিরেছে অমল। জগন্নাথ কলেজ এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, নতুন দালান উঠেছে, পুরনো জায়গা অচেনা হয়ে গেছে। রাস্তা পেড়িয়ে তার চোখে পড়ল বাহাদুর শাহ পার্কের পাশে ফুটপাথের ওপর একটা জটলা। প্রবাসী অমলের সব ব্যাপারেই কৌতূহল, রিক্সার স্রোত বাঁচিয়ে সে রাস্তা পার হয়, মানুষজনের ভিড় ঠেলে যায় জটলার ভেতর। মাটিতে কাৎ হয়ে পড়ে আছে একটা পাখী, চারজন পনেরো-ষোল বছরের কিশোর সেই পাখিকে ঘিরে রেখেছে। পাখীটার রক্তোৎপল ডানা, সাদা ঘাড় ও মাথা এবং বাঁকা ঠোঁট দেখে মুহূর্তেই চিনে নিল তাকে অমল - শঙ্খচিল। ঢাকার আকাশে শঙ্খচিলের দেখা সহজে পাওয়া যায় না। পাখীটার দুটো পা কালো সুতোয় বাঁধা। একটু সময় লাগল বুঝতে অমলের, তারপর বুঝল ঘুড়ির সুতো আকাশের বুক থেকে ছিনিয়ে এনেছে মুক্ত পাখীকে পঙ্কিল পৃথিবীতে। ক্লান্ত হয়েছিল পাখীটা, তবু মাঝেমাঝে ডানা ঝাপটাচ্ছিল। অমল ভাবল ছেলেগুলো পাখীটাকে মুক্ত করতে চাইছে, খুলতে চাইছে পায়ের সুতোর বেড়ি। কিন্তু তার ভুল ভাঙতে দেরী হল না, একটা ছেলে ছোট একটা ঢিল তুলে পাখীটার দিকে ছুঁড়ল। ঢিলটা পাখীটার পাখায় লাগল, পাখীটা শিশুর মত ডেকে উঠল। শঙ্খচিলের ডাক শিশুর কান্নার মত, অমলের হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে গেল সেই শব্দে। চিৎকার করে ওঠে অমল, "কী করছ তোমরা, পাখীটাকে মেরে ফেলবে তো?"
অমল ভাবে তার সাথে সায় দেবে উপস্থিত জনতা। কিন্তু নিশ্চুপ থাকে জনতা। চারটা ছেলে তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। তাদের পেছন থেকে হঠাৎ করে পঞ্চম একটি ছেলের আবির্ভাব হল। এতক্ষণ কোথায় ছিল এই ছেলেটি, ভাবে সে। পঞ্চমের পরিধানে জিনসের প্যান্ট, ইংরেজি লেখা গেঞ্জি। তার দৃষ্টির ক্রূরতা গ্রীষ্মের উষ্ণতাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। "কেরে, এইডা কই থিকা আইল?" ছেলেটি চেঁচিয়ে ওঠে, এই অনুষ্ঠানের সেই সর্দার। অমল পিছু হটে। পাঁচটি ছেলে তার দিকে এগিয়ে আসে। হঠাৎ একটা ঢিল এসে অমলের কপালে লাগে। ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে অমল, কপালে হাত দিয়ে দেখে রক্ত পড়ছে। কপালে হাত ওঠাতে ওঠাতেই তার চোখে পড়ে সর্দার ছেলেটি পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বার করছে। পালাতে হবে, পালাতে হবে, ক্ষণিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠে অমল।
ভিড় ঠেলে ফুটপাথ থেকে রাস্তার ওপর নামে অমল। মাথার পেছনে ছোট একটা ঢিল আঘাত করে। এবার ক্ষণিকের জন্য চোখে অন্ধকার নামে, কিন্তু বাঁচতে হলে তাকে দৌড়াতে হবে। রাস্তার চলমান রিক্সাগুলির ফাঁক দিয়ে কোনক্রমে দেহ গলিয়ে অন্যপাড়ে পৌঁছায় সে, তারপর দৌড়ায় পাটুয়াটুলির দিকে। কিন্তু ছেলে ক'টি তার পেছন ছাড়ে না। এই বয়সেও অমল দৌড়াতে পারে ভালই, যে দেশে থাকে সেখানে সপ্তাহান্তে দূর পাল্লার দৌড়ে সে অংশগ্রহণ করে। ডান হাতে মোবাইল ফোনটাকে আঁকড়ে ধরে দৌড়ায় অমল।
দৌড়ায় অমল ইসলামপুর রোড দিয়ে। রিক্সার পাশ কাটিয়ে। রাস্তার লোক হাঁ করে দেখে। গহনার দোকান, কল-কবজা ফিটিংসের দোকান, কাপড়ের দোকান সবই খোলা, কিন্তু সেখানে থেমে সাহায্য চাওয়া যাবে না, বরং তাকে ছিনতাইকারী ভেবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, পেছনে ছেলেগুলো "ধর ধর" বলে চিৎকার করছে। এই শহরে কে কাকে সাহায্য করে? অমল ভাবে সে দৌড়াচ্ছে উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা এক নীল হ্রদের প্রান্তে। হ্রদের স্বচ্ছ জলে নিচে পাথর দেখা যায়, তার পাশ দিয়ে মাছ চলে যায়। অমল অনুভব করে পাহাড়ে ঝাউয়ের আন্দোলন। তার গতি বাড়ে, রিকসা, ঠেলা আর মানুষের ভিড় কাটিয়ে সে উড়ে যায় শঙ্খচিল পাখীর মত। পিছনের ছেলেগুলি পিছ ছাড়ে না, কিন্তু তারা অমলের দৌড়ের গতিবেগ দেখে আশ্চর্য হয়, বুড়ো লোকটাকে তারা ধরতে পারছে না দেখে ক্ষিপ্ত হতে থাকে, তাদের ক্রুধ গালাগালি অমলের কানে পৌঁছায়।
দৌড়ায় অমল ইসলামপুর রোড দিয়ে। রিক্সার পাশ কাটিয়ে। রাস্তার লোক হাঁ করে দেখে। গহনার দোকান, কল-কবজা ফিটিংসের দোকান, কাপড়ের দোকান সবই খোলা, কিন্তু সেখানে থেমে সাহায্য চাওয়া যাবে না, বরং তাকে ছিনতাইকারী ভেবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, পেছনে ছেলেগুলো "ধর ধর" বলে চিৎকার করছে। এই শহরে কে কাকে সাহায্য করে? অমল ভাবে সে দৌড়াচ্ছে উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা এক নীল হ্রদের প্রান্তে। হ্রদের স্বচ্ছ জলে নিচে পাথর দেখা যায়, তার পাশ দিয়ে মাছ চলে যায়। অমল অনুভব করে পাহাড়ে ঝাউয়ের আন্দোলন। তার গতি বাড়ে, রিকসা, ঠেলা আর মানুষের ভিড় কাটিয়ে সে উড়ে যায় শঙ্খচিল পাখীর মত। পিছনের ছেলেগুলি পিছ ছাড়ে না, কিন্তু তারা অমলের দৌড়ের গতিবেগ দেখে আশ্চর্য হয়, বুড়ো লোকটাকে তারা ধরতে পারছে না দেখে ক্ষিপ্ত হতে থাকে, তাদের ক্রুধ গালাগালি অমলের কানে পৌঁছায়।
একটা ছোট রাস্তা পড়ে হাতের ডানে। এইসব গলি এককালে কত পরিচিত ছিল, আজ স্মৃতি হাতড়ে তাদের নাম মনে করতে হয়। অমল সেটাতে ঢোকে, তারপর আর একটা গলি ধরে, খুব সরু ছিল সেই গলিটা। অন্ধকার নির্জন গলি, খুব দূরে সুরঙ্গের শেষে সূর্যের আলো দেখা যায়। গলিটার মাঝামাঝি এলে তার চোখে পড়ে একটা ছোট ছেলে একটা লাল ঘুড়ি নিয়ে দেয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে। অমলের ডান হাতে ধরা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের রঙিন আলো যেয়ে পড়ে ছেলেটার মুখটার ওপর। ছেলেটিকে চিনল সে। অমল এক মুহূর্ত সময় নেয়, সেই মুহূর্তটা তার মনে অসীম সময় ধরে বিস্তৃত হতে থাকে। ঐ ছেলেটিকে অমলের অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু সে অনুভব করে ছুরি হাতে পেছনে সর্দার ছেলেটি খুব কাছে এসে পড়েছে। ১৬১৯১টি দিন এক সেকেন্ডের মাঝে প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু অতগুলো দিনও নয়, অমলের দরকার ছিল শুধু একটি দিনের কথা সংক্ষেপে প্রকাশ করা, শুধু একটি সতর্কবাণী। কিন্তু তার মুখ দিয়ে মাত্র তিনটি কথা বের হয়, "রান, বয়, রান"।
পেছনের পদশব্দগুলো যেন অমলের কানে বিস্ফোরিত হতে থাকে। এখানে দাঁড়ানো চলবে না একেবারেই, নইলে এই গলিতে তার মৃত্যু অনিবার্য। ঘুড়ি-ধরে থাকা ছেলেটিকে সেখানে রেখেই গলির অপর প্রান্তে বের হয়ে আসে অমল। যতক্ষণ সে আবার ইসলামপুর রোডে পৌঁছায় ততক্ষণে সেই ছেলেগুলো ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে। তবু দৌড় থামায় না অমল, ফিরে আসে বাহাদুর শাহ পার্কে। কপাল দিয়ে ঘাম চোখে পড়ায় চোখ জ্বলছে, ঘামে জবজব করছে জামা। পথচারীরা তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়।
কিন্তু পার্কের পাশের ফুটপাথে সেই জটলা আর ছিল না, ছিল না সেই শঙ্খচিল পাখীটাও। পাখীটাকে কি কেউ সাহায্য করেছে? উড়ে গেছে কি পাখী নীল আকাশে? খোঁজ করে অমল, চারদিকে তাকায়, ওপরে তাকায়। দেখে পার্কের বেড়ার ওপর বসে আছে একটা কাক, সেই কাকটার দুটো পায়েই ঘুড়ির কালো সুতো জড়ানো, যেমন জড়ানো ছিল সেই শঙ্খচিল পাখীর। কাকটা অমলকে দেখে মাথা কাৎ করে একদিকে, যেন চিনতে পেরেছে, তারপর দু-বার কা-কা করে উড়ে যায় পার্কের ভেতরের বড় ছাউনিটার ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে, তার দুটো পা থেকে ঝুলতে থাকে কালো সুতো।
পেছনের পদশব্দগুলো যেন অমলের কানে বিস্ফোরিত হতে থাকে। এখানে দাঁড়ানো চলবে না একেবারেই, নইলে এই গলিতে তার মৃত্যু অনিবার্য। ঘুড়ি-ধরে থাকা ছেলেটিকে সেখানে রেখেই গলির অপর প্রান্তে বের হয়ে আসে অমল। যতক্ষণ সে আবার ইসলামপুর রোডে পৌঁছায় ততক্ষণে সেই ছেলেগুলো ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে। তবু দৌড় থামায় না অমল, ফিরে আসে বাহাদুর শাহ পার্কে। কপাল দিয়ে ঘাম চোখে পড়ায় চোখ জ্বলছে, ঘামে জবজব করছে জামা। পথচারীরা তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়।
কিন্তু পার্কের পাশের ফুটপাথে সেই জটলা আর ছিল না, ছিল না সেই শঙ্খচিল পাখীটাও। পাখীটাকে কি কেউ সাহায্য করেছে? উড়ে গেছে কি পাখী নীল আকাশে? খোঁজ করে অমল, চারদিকে তাকায়, ওপরে তাকায়। দেখে পার্কের বেড়ার ওপর বসে আছে একটা কাক, সেই কাকটার দুটো পায়েই ঘুড়ির কালো সুতো জড়ানো, যেমন জড়ানো ছিল সেই শঙ্খচিল পাখীর। কাকটা অমলকে দেখে মাথা কাৎ করে একদিকে, যেন চিনতে পেরেছে, তারপর দু-বার কা-কা করে উড়ে যায় পার্কের ভেতরের বড় ছাউনিটার ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে, তার দুটো পা থেকে ঝুলতে থাকে কালো সুতো।
দু-দিন পরে ঢাকা থেকে বিমানে চড়ে উড়ে যায় অমল পশ্চিমে। বিমানের জানালার কাচে মাথা ঠেকিয়ে শহরটাকে দেখতে চায় শেষ বারের মতন, জানালায় তার নিঃশ্বাস ঘনীভূত হয়। বিমান কাৎ হয়ে ঘুড়ির মতন, শহরও কাৎ হয়ে যায়। আপেক্ষিকতা সূত্র বলে বেশী গতিতে ভ্রমণ করলে সময়ের মন্দন হয়, ভবিষ্যতে ভ্রমণ করা যায়, কিন্তু অতীতে ফেরা যায় না। বালক অমল ভবিষ্যতে ভ্রমণ করেছিল, শুনেছিল সাবধানবাণী "রান, বয়, রান"। কিন্তু সেই বাণীর পুরো অর্থ সে তখন বোঝে নি। শুধুমাত্র আজ, ১৬১৯১ দিন পরে, প্রৌঢ় অমল বুঝতে পারল সে কী বলতে চেয়েছিল নিজেকে, কিন্তু সেই অতীতে ফিরে যাবার তার কোন ক্ষমতা নেই। অসংখ্য সম্ভাব্যতার বিচারে সময়ের দরজা খোলার সামান্য সম্ভাবনা হয়তো থেকে যায়, কিন্তু একবারের বেশী দু'বার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবার সম্ভাবনা কম।
১৬১৯০ দিন আগে, শুক্রবারের খুব ভোরে, সূর্য তখনো ওঠেনি, তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ভিনদেশী সৈন্যরা। ১৯৭১র মার্চের এক ভয়াল রাত ছিল সেটা। অমলকে তার বাবা মা বাড়ির পাঁচিল দিয়ে উঠিয়ে পেছনের গলিতে নামিয়ে দিতে পেরেছিলেন। মা আর বাবাকে সেই শেষবারের মত দেখে অমল। অনেক বছর পরে শুনেছিল জগন্নাথ কলেজের মাঠে পুরনো বহু হাড় আর করোটি পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র আজ, এত বছর পরে, অমল বুঝল "রান, বয়, রান" কথাটা তাদের বাড়ির সবার জন্যই প্রযোজ্য ছিল। অমল ভাবে কী বললে সেই সতর্কবাণীটাকে তার মা বাবার কাছে পৌঁছে দেয়া যত। অমল ভাবে, কিন্তু অথৈ আকাশে কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। বহু নীচে সবুজ আয়তাকার ক্ষেতগুলো দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে থাকে, মেঘের ওপরে বিমান উঠে যাবার আগে শেষবারের মত শঙ্খচিল পাখীটাকে খোঁজে অমল। শঙ্খচিলটা কিভাবে কাক হল ভাবে সে, ভাবে তার দৌড়ানো এখন শেষ হয় নি। ভাবে সেই লাল ঘুড়িটার কথা যেটা সেই কবে বাড়িটার সাথে পুড়ে গিয়েছিল।
১৬১৯০ দিন আগে, শুক্রবারের খুব ভোরে, সূর্য তখনো ওঠেনি, তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ভিনদেশী সৈন্যরা। ১৯৭১র মার্চের এক ভয়াল রাত ছিল সেটা। অমলকে তার বাবা মা বাড়ির পাঁচিল দিয়ে উঠিয়ে পেছনের গলিতে নামিয়ে দিতে পেরেছিলেন। মা আর বাবাকে সেই শেষবারের মত দেখে অমল। অনেক বছর পরে শুনেছিল জগন্নাথ কলেজের মাঠে পুরনো বহু হাড় আর করোটি পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র আজ, এত বছর পরে, অমল বুঝল "রান, বয়, রান" কথাটা তাদের বাড়ির সবার জন্যই প্রযোজ্য ছিল। অমল ভাবে কী বললে সেই সতর্কবাণীটাকে তার মা বাবার কাছে পৌঁছে দেয়া যত। অমল ভাবে, কিন্তু অথৈ আকাশে কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। বহু নীচে সবুজ আয়তাকার ক্ষেতগুলো দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে থাকে, মেঘের ওপরে বিমান উঠে যাবার আগে শেষবারের মত শঙ্খচিল পাখীটাকে খোঁজে অমল। শঙ্খচিলটা কিভাবে কাক হল ভাবে সে, ভাবে তার দৌড়ানো এখন শেষ হয় নি। ভাবে সেই লাল ঘুড়িটার কথা যেটা সেই কবে বাড়িটার সাথে পুড়ে গিয়েছিল।
2 মন্তব্যসমূহ
অসাধারন!
উত্তরমুছুনঅসাধারণ একটি গল্প । বুকের ভেতরে মাচোড় দিয়ে ওঠে।
উত্তরমুছুন