ইফতারে বসা। আজান কানে আসা মাত্রই আমি পানি মুখে দিই; নিলু লেবুর শরবতটা ঠোঁটে একবার ঠেকিয়ে নামিয়ে রাখে। সুগার কম হয়েছে, তিতা লাগছে-- বলতে বলতে একটা খেজুর হাতে তোলে । বাবা অপেক্ষা করেন। বাবা আজান হচ্ছে তো-- আমি মৃদুস্বরে বলি।
এ তো ঢাকার আজান! ৬মিনিটি যোগ করতে হবে যে। বাবা বলেন।
বাবা ভুলে যান তিনি এখন ঢাকাতেই আছেন। গত পাঁচবছর হল তিনি মেহেরপুর ছেড়ে ঢাকায় আমাদের মোহাম্মদপুরের বাসায় উঠেছেন। পাঁচবছর থেকে একই ভুল করছেন।
খ
হঠাৎ করেই চলে গেল মা। গ্রামের বাড়িটা মেজভাই জালসই করে নিজের নামে লিখে নিয়েছিল আগেই। মা মারা যাওয়ার পর দলিল দেখিয়ে দখল নিলো। বাবা জেলা শহরে বড়ভাইয়ের বাড়িতে উঠলেন; মানে আশ্রয় নিলেন। শর্ত হল বাবার নামে মাঠে যে চল্লিশ শতক জমি আছে ওটা আশ্রয়দাতা হিসেবে বড়ভাই পাবেন। আমি খোঁজখবর নিতাম ফোনে, শর্তহীন-- দায়িত্ববোধ থেকেই হয়ত। ভালোবাসা তার সঙ্গে কিছুটা থাকলেও থাকতে পারে। বাবা ফোনে কথা বলতেন না বলে বহুদিন কোনো কথা হত না। বলতেন, ওটা ধরতে তার নাকি ভয় করে!
আমি সেবার বাড়ি গিয়ে দেখি বাবা জড়সড় হয়ে ছাদের এক কোণায় বসে আছেন। রোদে পুড়ে যাচ্ছে তার শরীর। আমাকে দেখে প্রথমটাই চিনতে পারেননি বলে মনে হল। খানিকক্ষণ আমার কথা শোনার পর বললেন, ওহ তুই? ফেরত যাচ্ছিস বুঝি?
সবে এলাম বাবা। বলি আমি।
তবে যে তোকে কদিন থেকে দেখছি! বাবা নিচু স্বরে বললেন।
ভুল দেখেছ। কিংবা বড়ভাইকে কখনো কখনো আমি বলে মনে করেছ। আমার কথা শুনে বাবা সম্মতিসূচক মাথা দুলিয়ে বললেন, চোখের কি যেন হয়েছে-- সব মানুষ আর গাছকে এক বলে মনে হয়।
এই রোদে কেউ এভাবে পিঠ-বুক পেতে বসে থাকে? চলো, ঘরে চলো। বললাম আমি।
রোজই তো থাকি। শিশুর মতো সরলভাবে উত্তর করেন বাবা।
নিশ্চয় ভালো করো না। এজন্যেই তুমি এমন পুড়ে কালো হয়ে গেছ। মা থাকতে তোমার শরীরটা বেশ চকচক করত। এখন এই পোড়া শরীর নিয়ে মা’র কাছে গেলে মা তোমাকে চিনবে তো! আর আমাদের বকে রাখবে মনে করছো?
বাবা আর কথা না বলে আমার আগে আগে ঘরে চলে আসে। বাবাকে দেখা মাত্রই বড়ভাই বকে ওঠেন, এখন আবার নামলেন কেন? শিপুর টিচার পড়াচ্ছে। আপনি ঘরে গেলে ও পড়বে কেমন করে? শিপু বড়ভাইয়ের ছোটছেলে। বাবা আর শিপু একঘরে থাকে। শিপু বিছানায়, বাবা মেঝেতে। বড়ভাইয়ের কথায় লজ্জা পেয়ে বাবা আবার ছাদে ফিরে গেলেন। এই বাবাকে আমরা ছোট থাকতে ভীষণ ভয় পেতাম। সবচেয়ে বেশি ভয় পেত বড়ভাই। আমি ছোট হওয়াতে যে কোনো বিষয়ে তারা বাবার মুখোমুখি আমাকে ঢাল হিসেবে দাঁড় করাত। বাবা আমাকেও ছাড় দিবেন না জেনেও একটাকায় চারটি লজেন্সের লোভে দাঁড়িয়ে থাকতাম। নিতান্তই শিশু হিসেবে কিছুটা ছাড় তো পেতামই।
বড়ভাই লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার চশমাটা চোখে দিয়ে মাস্টারির অভিনয় করত। আমরা ছোটরা ছাত্র হতাম। একদিন তিনি চশমাটা ভেঙে ফেললেন। দায় নিতে হল আমাকে। বাবা আমার কানটা এমন করে ধরলেন যেন ব্যথা না পাই, কিন্তু ভয়টা পাই। পরদিন দেখলাম বাবা একটা রঙিন চশমা কিনে এনেছেন। প্লাস্টিকের। আমার হাতে দিয়ে বললেন, ওই বাদরটাকে দি-গা। প্লাস্টিকের গ্লাস, বেশি চোখে দিলে চোখের ক্ষতি হবে। বড়ভাই যেদিন শহরে স্কুলে ভর্তি হয়ে বাবার কাছে বিদায় নিলেন, বাবা একটিও কথা বললেন না। সেদিন রাতে আর কিছু খেলেন না; মা বললেন গা গরম হয়েছে বাবার। তিনদিন পর দেখি বাবা সেই চশমাটার ভাঙা অংশটা হাতে নিয়ে মাকে বলছেন, ওকে একটা ভালো চশমা কিনে দেয়া দরকার। বাবার ওভাবে নীরবে ছাদে চলে যাওয়া দেখে সেই দিনের কথাগুলো মনে পড়ল।
বাড়িতে এত মানুষ, মাত্র তিনটা ঘর। এরওপর আবার বাবা! কি করে সব সামলাই বলো? বড়ভাবি আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললেন। ঠিকই তো-- একথা বলে আমি আর তাকে কথা বাড়াতে দিলাম না।
দুপুরে বাবা গোসল করতে যাওয়ার সময় দেখলাম পিঠের ওপরের অংশে ডানদিকে আঘাতের চিহ্ন। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই, বাবা তাড়াতাড়ি আড়াল করে বাথরুমের দরজা আটকে দিলেন। প্রায় আধাঘণ্টা পর গোসল সেরে বের হয়ে এলেন। চোখ লাল হয়ে উঠেছে। বোধহয় অতিরিক্ত পানি ঢেলেছেন। আমি আর কিছু জানতে চাইনি। পরদিন ঢাকায় ফিরে আসার সময় ভাবিকে বললাম, বাবাকে নিয়ে গেলাম। ভাবি বেশ উৎসাহ নিয়ে বাবার কাপড়চোপড় গুছিয়ে দিলো, বড়ভাই দুটো এসি বাসের টিকিট কিনে এনে আমার আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এসি বাবার সহ্য হয় না। সাবধানে নিস।
গ
বাবা ঠিক ঘড়ি ধরে ঢাকার আজানের ৬মিনিট পর ইফতার শুরু করলেন। নিলু উঠে গেল। আমিও উঠে পড়লাম। বাবা নিজের মতো খেয়ে নামাজে বের হলেন। নামাজ শেষ করে তিনি মুখটা এমন ভার করে বাড়ি ফেরেন, মনে হয় যেন জানাজা থেকে ফিরলেন। এইমাত্র খুব কাছের কেউ চলে গেল।
বাবা, মন খারাপ? মায়ের কথা মনে পড়ছে? জিজ্ঞেস করি আমি।
পাকুড়গাছটা কোথাও পেলাম না। বলে বাবা নিজের ঘরে চলে যান। শুনেছি বাবা আর দাদা একসঙ্গে বাড়ির পেছনের পাকুড় গাছটি লাগিয়েছিলেন। সেবার খুব বর্ষা ছিল। দাদা নাকি বাবাকে বলেছিল, আমি যখন থাকবো না, তখন গাছটির তলায় দাঁড়ালে আমাকে পাবি। বছর দুয়েক আগে গাছটি কেটে বড়ভাই ফার্নিচার বানিয়েছে। আমার ভাগের অংশটা নিজে নিয়ে টাকা পাঠিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে আমি বাবাকে বারান্দায় বসার আরাম চেয়ারটা কিনে দিয়েছি-- বাবাকে আর বলি না সেকথা। বাবা আলো না জ্বালিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসেন। পাশে কয়েকটি বনসাইয়ের টব আছে। বনসাইগুলো হালকা বাতাসে একটু নড়ে আবার স্থির হয়ে যায়। নিলুর এক অধ্যাপক দুলাভাই আছেন, গাছ ধরে ধরে বনসাই বানান। এটাও নাকি আর্ট। আর্ট অব শেপিং। আমি বলি আর্ট অব সাপ্রেশন!
খুব অন্ধকার, মশা আসছে। আলোটা জ্বেলে দিই বাবা? আমি জিজ্ঞেস করি।
বাবা উত্তর দেন না। আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে এটাসেটা বলি; একতরফা। বাবাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। একমাত্র ছেলেটা কানাডায় থাকে। একমাত্র মেয়েটা আমেরিকায়। ওদের ঘরদুটো ওদের শৈশবের স্মৃতি আটকে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে আমি ঘরদুটো খুলে ওদের স্মৃতি মেখে বসে থাকি। নির্বাক। আমার নিজেরও কথা বলার মানুষ দরকার। বাবা কোনো উত্তর করছে না দেখে হতাশ হয়ে ফিরে আসি। আবার ঘণ্টাখানেক পর একটা ছুঁতো নিয়ে যাই।
বাবা, ভালো কাঁঠাল আছে; আনি? বাবা কিছু না বললেও একপ্লেট কাঁঠালের রোয়া তুলে এনে বাবার হাতে ধরিয়ে দিই।
পান্তা ভাত হবে? কতকাল পান্তা-কাঁঠাল খাইনি! বাবা প্লেটটা ধরে নিয়ে ছায়ার মতো বসে থেকে কথাগুলো বলেন। অথচ তার মুখ নড়ে না-- অনেক দূর থেকে ভেসে আসে তার কণ্ঠস্বর।
আমি নিলুকে কিছু না বুঝতে দিয়ে রান্নাঘর থেকে গরম ভাতে ফ্রিজের শীতল পানি ঢেলে বাবার হাতে দিই। বাবা ধরে বসে থাকেন।
বাবা, মা থাকলে তুমি নিশ্চয় এখানে আসতে না? আবার আমি মায়ের প্রসঙ্গ তুলি। কতদিন মাকে নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো কথা বলা হয়নি!
বাবা কোনো কথা বলেন না।
একবার মা তোমার পেছনে আমাকে স্পাই হিসেবে নিয়োগ করেছিল। তুমি মাঝে মধ্যে দুপুরে উধাও হয়ে যেতে, মায়ের ধারণা তুমি ফজু চাচার বাড়িতে তাসের আসরে বসতে। তোমাকে দাদা-দাদির কবরের দিকে যেতে দেখে এসে মাকে বলেছিলাম, তুমি ফজু চাচার বাড়িতে! মা তার ধারণা ঠিক হয়েছে এই খুশিতে বোনাসসহ ১০টাকা দিয়েছিল। তারপর রাতে তোমাদের ভেতর যখন তুমুল ঝগড়া হল, তুমি বলছিলে তাসের আসরে যাও নি, আর মা কিছুতেই মানছে না, বলছে তার হাতে প্রমাণ আছে; তখন ঐ টাকা দিয়ে আমি একটা লাটাই কিনে এনে সুতো আঁটছিলাম। একটুও যে খারাপ লাগছিল না, তা নয়। কিন্তু ঘুড়ি ওড়ানোর জন্যে লাটাইটার খুব দরকার ছিল, বাবা। নিজে একটা লাটাইসহ ঘুড়ির মালিক হওয়ার জন্যে তখন যে কোনো কাজ করতে রাজি ছিলাম। আচ্ছা, তুমি তো জানতে কাণ্ডটা আমার, বকলে না যে? আমি ভয়ে ভয়ে কতদিন যে তোমার আড়াল হয়েছি; জানো?
আমার কথা শুনে বাবা হাসলেন। বহুদিন পর তার হাসি শুনতে পেলাম। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিল সেই হাসির শব্দ।
ঘ
বাবা ছায়ার মতো নিশব্দে উঠে পড়েন। ওজু করে এশার নামাজে বের হন। একা একা নিঃশব্দে যান, নিঃশব্দে আসেন। আমি কেবল নিয়ম করে দরজাটা খুলে দিই। বাবা মসজিদের প্রবেশপথের পাশঘেঁষে বসেন। নামাজ পড়তে আসা প্রতিটা মুসল্লিদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। পরিচিত কাউকে খোঁজেন বোধহয়। ঢাকার এই মসজিদে যে আমাদের গ্রামের কাউকে পাবেন না, আমি ভালো করেই জানি, বাবাকে বলতে পারি না। একটা মানুষ প্রতিদিন নিয়ম করে মসজিদে যান, কারো অপেক্ষা করেন, এই আগ্রহটা আমি নষ্ট করে দিতে চাই না।
নামাজ শেষ করে বাবা ফের বারান্দায় এসে বসেন। অন্ধকারে।
বাবা, ঘুমাবে না? বলি আমি।
বাবা, একগ্লাস পানি দিই? আমি জিজ্ঞেস করি।
বাবা, আলোটা দেবো? জানতে চাই আমি।
বাবা আর কথা বলেন না। বসে থাকেন টবের বনসাই বটের দিকে তাকিয়ে।
আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিলুর ডাকে ফিরে যাই শোবার ঘরে। একটু পরেই আবার সেহরি খেতে উঠতে হবে। সকালে অফিস। রাতজাগা আমার উচিত না। কদিন থেকে অফিসে যেতে দেরি হচ্ছে বলে বস বলে দিয়েছেন-- হালিম সাহেব, রোজাটা বোধহয় আপনার সঙ্গে স্যুট করছে না! ইঙ্গিতটা ভালো না।। ঘরে ফেরা মাত্রই নিলু কতক্ষণ আমাকে ভর্ৎসণা করে। আমি ওর কথায় কান না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। চেষ্টা করতে করতেই টের পাই নিলু ঘুমচ্ছে অঘোরে। আমি আবার উঠি। টের পাই বাবা তখনও ঘুমাননি। বারান্দায় তেমনি করে বসে আছেন। ঠাই। অন্ধকারে।
বাবা, ঘুম আসছে না? জানতে চাই আমি।
বাবা কোনো উত্তর করেন না।
বাবা, তোমার শরীর খারাপ? কাল একবার ডাক্তারের কাছে নিই?
বাবা কোনো উত্তর করেন না।
বাবা, তোমার কি কথা বলতে কষ্ট হয়? জিজ্ঞেস করি।
বাবা কোনো উত্তর করেন না।
আমার বাবা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার ছিলেন। স্কুলে-বাড়িতে-বাইরে সবখানেই বাবার কণ্ঠস্বর শোনা যেত। উচ্চস্বরে কথা বলতেন তিনি। বাবা কোথাও থাকলে সেখানে অন্যরা কথা বলার সুযোগ খুব বেশি পেতেন না। সেই বাবা এখন শব্দহীন এভাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমি মানতে না পেরে উত্তেজিত কণ্ঠে শেষবারের মতোন জিজ্ঞেস করি-- বাবা, তোমার সমস্যাটা কি?
বাবা এবার মাথাটা একটু তোলেন। কিছু বলতে চান। আমি অপেক্ষা করি আগ্রহ নিয়ে।
কই গেলে তুমি? নিলু ও ঘর থেকে ডেকে ওঠে।
ঋণস্বীকার: মার্কিন গল্পকার জেরোম ওয়াইডম্যান
এ তো ঢাকার আজান! ৬মিনিটি যোগ করতে হবে যে। বাবা বলেন।
বাবা ভুলে যান তিনি এখন ঢাকাতেই আছেন। গত পাঁচবছর হল তিনি মেহেরপুর ছেড়ে ঢাকায় আমাদের মোহাম্মদপুরের বাসায় উঠেছেন। পাঁচবছর থেকে একই ভুল করছেন।
খ
হঠাৎ করেই চলে গেল মা। গ্রামের বাড়িটা মেজভাই জালসই করে নিজের নামে লিখে নিয়েছিল আগেই। মা মারা যাওয়ার পর দলিল দেখিয়ে দখল নিলো। বাবা জেলা শহরে বড়ভাইয়ের বাড়িতে উঠলেন; মানে আশ্রয় নিলেন। শর্ত হল বাবার নামে মাঠে যে চল্লিশ শতক জমি আছে ওটা আশ্রয়দাতা হিসেবে বড়ভাই পাবেন। আমি খোঁজখবর নিতাম ফোনে, শর্তহীন-- দায়িত্ববোধ থেকেই হয়ত। ভালোবাসা তার সঙ্গে কিছুটা থাকলেও থাকতে পারে। বাবা ফোনে কথা বলতেন না বলে বহুদিন কোনো কথা হত না। বলতেন, ওটা ধরতে তার নাকি ভয় করে!
আমি সেবার বাড়ি গিয়ে দেখি বাবা জড়সড় হয়ে ছাদের এক কোণায় বসে আছেন। রোদে পুড়ে যাচ্ছে তার শরীর। আমাকে দেখে প্রথমটাই চিনতে পারেননি বলে মনে হল। খানিকক্ষণ আমার কথা শোনার পর বললেন, ওহ তুই? ফেরত যাচ্ছিস বুঝি?
সবে এলাম বাবা। বলি আমি।
তবে যে তোকে কদিন থেকে দেখছি! বাবা নিচু স্বরে বললেন।
ভুল দেখেছ। কিংবা বড়ভাইকে কখনো কখনো আমি বলে মনে করেছ। আমার কথা শুনে বাবা সম্মতিসূচক মাথা দুলিয়ে বললেন, চোখের কি যেন হয়েছে-- সব মানুষ আর গাছকে এক বলে মনে হয়।
এই রোদে কেউ এভাবে পিঠ-বুক পেতে বসে থাকে? চলো, ঘরে চলো। বললাম আমি।
রোজই তো থাকি। শিশুর মতো সরলভাবে উত্তর করেন বাবা।
নিশ্চয় ভালো করো না। এজন্যেই তুমি এমন পুড়ে কালো হয়ে গেছ। মা থাকতে তোমার শরীরটা বেশ চকচক করত। এখন এই পোড়া শরীর নিয়ে মা’র কাছে গেলে মা তোমাকে চিনবে তো! আর আমাদের বকে রাখবে মনে করছো?
বাবা আর কথা না বলে আমার আগে আগে ঘরে চলে আসে। বাবাকে দেখা মাত্রই বড়ভাই বকে ওঠেন, এখন আবার নামলেন কেন? শিপুর টিচার পড়াচ্ছে। আপনি ঘরে গেলে ও পড়বে কেমন করে? শিপু বড়ভাইয়ের ছোটছেলে। বাবা আর শিপু একঘরে থাকে। শিপু বিছানায়, বাবা মেঝেতে। বড়ভাইয়ের কথায় লজ্জা পেয়ে বাবা আবার ছাদে ফিরে গেলেন। এই বাবাকে আমরা ছোট থাকতে ভীষণ ভয় পেতাম। সবচেয়ে বেশি ভয় পেত বড়ভাই। আমি ছোট হওয়াতে যে কোনো বিষয়ে তারা বাবার মুখোমুখি আমাকে ঢাল হিসেবে দাঁড় করাত। বাবা আমাকেও ছাড় দিবেন না জেনেও একটাকায় চারটি লজেন্সের লোভে দাঁড়িয়ে থাকতাম। নিতান্তই শিশু হিসেবে কিছুটা ছাড় তো পেতামই।
বড়ভাই লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার চশমাটা চোখে দিয়ে মাস্টারির অভিনয় করত। আমরা ছোটরা ছাত্র হতাম। একদিন তিনি চশমাটা ভেঙে ফেললেন। দায় নিতে হল আমাকে। বাবা আমার কানটা এমন করে ধরলেন যেন ব্যথা না পাই, কিন্তু ভয়টা পাই। পরদিন দেখলাম বাবা একটা রঙিন চশমা কিনে এনেছেন। প্লাস্টিকের। আমার হাতে দিয়ে বললেন, ওই বাদরটাকে দি-গা। প্লাস্টিকের গ্লাস, বেশি চোখে দিলে চোখের ক্ষতি হবে। বড়ভাই যেদিন শহরে স্কুলে ভর্তি হয়ে বাবার কাছে বিদায় নিলেন, বাবা একটিও কথা বললেন না। সেদিন রাতে আর কিছু খেলেন না; মা বললেন গা গরম হয়েছে বাবার। তিনদিন পর দেখি বাবা সেই চশমাটার ভাঙা অংশটা হাতে নিয়ে মাকে বলছেন, ওকে একটা ভালো চশমা কিনে দেয়া দরকার। বাবার ওভাবে নীরবে ছাদে চলে যাওয়া দেখে সেই দিনের কথাগুলো মনে পড়ল।
বাড়িতে এত মানুষ, মাত্র তিনটা ঘর। এরওপর আবার বাবা! কি করে সব সামলাই বলো? বড়ভাবি আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললেন। ঠিকই তো-- একথা বলে আমি আর তাকে কথা বাড়াতে দিলাম না।
দুপুরে বাবা গোসল করতে যাওয়ার সময় দেখলাম পিঠের ওপরের অংশে ডানদিকে আঘাতের চিহ্ন। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই, বাবা তাড়াতাড়ি আড়াল করে বাথরুমের দরজা আটকে দিলেন। প্রায় আধাঘণ্টা পর গোসল সেরে বের হয়ে এলেন। চোখ লাল হয়ে উঠেছে। বোধহয় অতিরিক্ত পানি ঢেলেছেন। আমি আর কিছু জানতে চাইনি। পরদিন ঢাকায় ফিরে আসার সময় ভাবিকে বললাম, বাবাকে নিয়ে গেলাম। ভাবি বেশ উৎসাহ নিয়ে বাবার কাপড়চোপড় গুছিয়ে দিলো, বড়ভাই দুটো এসি বাসের টিকিট কিনে এনে আমার আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এসি বাবার সহ্য হয় না। সাবধানে নিস।
গ
বাবা ঠিক ঘড়ি ধরে ঢাকার আজানের ৬মিনিট পর ইফতার শুরু করলেন। নিলু উঠে গেল। আমিও উঠে পড়লাম। বাবা নিজের মতো খেয়ে নামাজে বের হলেন। নামাজ শেষ করে তিনি মুখটা এমন ভার করে বাড়ি ফেরেন, মনে হয় যেন জানাজা থেকে ফিরলেন। এইমাত্র খুব কাছের কেউ চলে গেল।
বাবা, মন খারাপ? মায়ের কথা মনে পড়ছে? জিজ্ঞেস করি আমি।
পাকুড়গাছটা কোথাও পেলাম না। বলে বাবা নিজের ঘরে চলে যান। শুনেছি বাবা আর দাদা একসঙ্গে বাড়ির পেছনের পাকুড় গাছটি লাগিয়েছিলেন। সেবার খুব বর্ষা ছিল। দাদা নাকি বাবাকে বলেছিল, আমি যখন থাকবো না, তখন গাছটির তলায় দাঁড়ালে আমাকে পাবি। বছর দুয়েক আগে গাছটি কেটে বড়ভাই ফার্নিচার বানিয়েছে। আমার ভাগের অংশটা নিজে নিয়ে টাকা পাঠিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে আমি বাবাকে বারান্দায় বসার আরাম চেয়ারটা কিনে দিয়েছি-- বাবাকে আর বলি না সেকথা। বাবা আলো না জ্বালিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসেন। পাশে কয়েকটি বনসাইয়ের টব আছে। বনসাইগুলো হালকা বাতাসে একটু নড়ে আবার স্থির হয়ে যায়। নিলুর এক অধ্যাপক দুলাভাই আছেন, গাছ ধরে ধরে বনসাই বানান। এটাও নাকি আর্ট। আর্ট অব শেপিং। আমি বলি আর্ট অব সাপ্রেশন!
খুব অন্ধকার, মশা আসছে। আলোটা জ্বেলে দিই বাবা? আমি জিজ্ঞেস করি।
বাবা উত্তর দেন না। আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে এটাসেটা বলি; একতরফা। বাবাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। একমাত্র ছেলেটা কানাডায় থাকে। একমাত্র মেয়েটা আমেরিকায়। ওদের ঘরদুটো ওদের শৈশবের স্মৃতি আটকে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে আমি ঘরদুটো খুলে ওদের স্মৃতি মেখে বসে থাকি। নির্বাক। আমার নিজেরও কথা বলার মানুষ দরকার। বাবা কোনো উত্তর করছে না দেখে হতাশ হয়ে ফিরে আসি। আবার ঘণ্টাখানেক পর একটা ছুঁতো নিয়ে যাই।
বাবা, ভালো কাঁঠাল আছে; আনি? বাবা কিছু না বললেও একপ্লেট কাঁঠালের রোয়া তুলে এনে বাবার হাতে ধরিয়ে দিই।
পান্তা ভাত হবে? কতকাল পান্তা-কাঁঠাল খাইনি! বাবা প্লেটটা ধরে নিয়ে ছায়ার মতো বসে থেকে কথাগুলো বলেন। অথচ তার মুখ নড়ে না-- অনেক দূর থেকে ভেসে আসে তার কণ্ঠস্বর।
আমি নিলুকে কিছু না বুঝতে দিয়ে রান্নাঘর থেকে গরম ভাতে ফ্রিজের শীতল পানি ঢেলে বাবার হাতে দিই। বাবা ধরে বসে থাকেন।
বাবা, মা থাকলে তুমি নিশ্চয় এখানে আসতে না? আবার আমি মায়ের প্রসঙ্গ তুলি। কতদিন মাকে নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো কথা বলা হয়নি!
বাবা কোনো কথা বলেন না।
একবার মা তোমার পেছনে আমাকে স্পাই হিসেবে নিয়োগ করেছিল। তুমি মাঝে মধ্যে দুপুরে উধাও হয়ে যেতে, মায়ের ধারণা তুমি ফজু চাচার বাড়িতে তাসের আসরে বসতে। তোমাকে দাদা-দাদির কবরের দিকে যেতে দেখে এসে মাকে বলেছিলাম, তুমি ফজু চাচার বাড়িতে! মা তার ধারণা ঠিক হয়েছে এই খুশিতে বোনাসসহ ১০টাকা দিয়েছিল। তারপর রাতে তোমাদের ভেতর যখন তুমুল ঝগড়া হল, তুমি বলছিলে তাসের আসরে যাও নি, আর মা কিছুতেই মানছে না, বলছে তার হাতে প্রমাণ আছে; তখন ঐ টাকা দিয়ে আমি একটা লাটাই কিনে এনে সুতো আঁটছিলাম। একটুও যে খারাপ লাগছিল না, তা নয়। কিন্তু ঘুড়ি ওড়ানোর জন্যে লাটাইটার খুব দরকার ছিল, বাবা। নিজে একটা লাটাইসহ ঘুড়ির মালিক হওয়ার জন্যে তখন যে কোনো কাজ করতে রাজি ছিলাম। আচ্ছা, তুমি তো জানতে কাণ্ডটা আমার, বকলে না যে? আমি ভয়ে ভয়ে কতদিন যে তোমার আড়াল হয়েছি; জানো?
আমার কথা শুনে বাবা হাসলেন। বহুদিন পর তার হাসি শুনতে পেলাম। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিল সেই হাসির শব্দ।
ঘ
বাবা ছায়ার মতো নিশব্দে উঠে পড়েন। ওজু করে এশার নামাজে বের হন। একা একা নিঃশব্দে যান, নিঃশব্দে আসেন। আমি কেবল নিয়ম করে দরজাটা খুলে দিই। বাবা মসজিদের প্রবেশপথের পাশঘেঁষে বসেন। নামাজ পড়তে আসা প্রতিটা মুসল্লিদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। পরিচিত কাউকে খোঁজেন বোধহয়। ঢাকার এই মসজিদে যে আমাদের গ্রামের কাউকে পাবেন না, আমি ভালো করেই জানি, বাবাকে বলতে পারি না। একটা মানুষ প্রতিদিন নিয়ম করে মসজিদে যান, কারো অপেক্ষা করেন, এই আগ্রহটা আমি নষ্ট করে দিতে চাই না।
নামাজ শেষ করে বাবা ফের বারান্দায় এসে বসেন। অন্ধকারে।
বাবা, ঘুমাবে না? বলি আমি।
বাবা, একগ্লাস পানি দিই? আমি জিজ্ঞেস করি।
বাবা, আলোটা দেবো? জানতে চাই আমি।
বাবা আর কথা বলেন না। বসে থাকেন টবের বনসাই বটের দিকে তাকিয়ে।
আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিলুর ডাকে ফিরে যাই শোবার ঘরে। একটু পরেই আবার সেহরি খেতে উঠতে হবে। সকালে অফিস। রাতজাগা আমার উচিত না। কদিন থেকে অফিসে যেতে দেরি হচ্ছে বলে বস বলে দিয়েছেন-- হালিম সাহেব, রোজাটা বোধহয় আপনার সঙ্গে স্যুট করছে না! ইঙ্গিতটা ভালো না।। ঘরে ফেরা মাত্রই নিলু কতক্ষণ আমাকে ভর্ৎসণা করে। আমি ওর কথায় কান না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। চেষ্টা করতে করতেই টের পাই নিলু ঘুমচ্ছে অঘোরে। আমি আবার উঠি। টের পাই বাবা তখনও ঘুমাননি। বারান্দায় তেমনি করে বসে আছেন। ঠাই। অন্ধকারে।
বাবা, ঘুম আসছে না? জানতে চাই আমি।
বাবা কোনো উত্তর করেন না।
বাবা, তোমার শরীর খারাপ? কাল একবার ডাক্তারের কাছে নিই?
বাবা কোনো উত্তর করেন না।
বাবা, তোমার কি কথা বলতে কষ্ট হয়? জিজ্ঞেস করি।
বাবা কোনো উত্তর করেন না।
আমার বাবা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার ছিলেন। স্কুলে-বাড়িতে-বাইরে সবখানেই বাবার কণ্ঠস্বর শোনা যেত। উচ্চস্বরে কথা বলতেন তিনি। বাবা কোথাও থাকলে সেখানে অন্যরা কথা বলার সুযোগ খুব বেশি পেতেন না। সেই বাবা এখন শব্দহীন এভাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমি মানতে না পেরে উত্তেজিত কণ্ঠে শেষবারের মতোন জিজ্ঞেস করি-- বাবা, তোমার সমস্যাটা কি?
বাবা এবার মাথাটা একটু তোলেন। কিছু বলতে চান। আমি অপেক্ষা করি আগ্রহ নিয়ে।
কই গেলে তুমি? নিলু ও ঘর থেকে ডেকে ওঠে।
ঋণস্বীকার: মার্কিন গল্পকার জেরোম ওয়াইডম্যান
3 মন্তব্যসমূহ
বুক টনটন করা গল্প।বুকটা ভারি হয়ে গেলো।
উত্তরমুছুননগর সভ্যতা বাবা-মাকে ঘরে আপদ বানিয়েছে, অবশ্য কখনও কখনও বনসাই করে রাখি তাদের। আমরা নিজেরাও অবচেতনভাবে বনসাই হয়ে আছি সবাই। জড় পদার্থের মতো অযথাই বেঁচে থাকি। মনকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়ে গেল।
উত্তরমুছুনযে সব সন্তানরা বাবাদেরকে এভাবে বনসাই বাবাতে রূপান্তর করে ফেলেন, বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন, তাদেরকে ক্ষেপে গিয়ে অনেকেই কুলাংগার বলি আমরা । কিন্তু তাদেরকে কুলাংগার বলে লাভ নেই । আমরা সন্তানদের যেমন করে মানুষ করি, এ হচ্ছে তেমন কাজের ফলাফল । আসলে মায়ের কোল নামক সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে নৈতিক শিক্ষা নামক পি এইচ ডি ডিগ্রী মা-বাবাকে সেই শশিুকালেই প্রদান করে তবে বড় করে তুলতে হয়, তা না হলে সেই সন্তানকে আপনি আমি যতই দামী সন্তান তৈরী করি না কেন, তার দ্বারা মানবতার কল্যাণ হতে পারে না । অতএব বাবা মায়েরা সাবধান !!
উত্তরমুছুন