সাংস্কৃতিক-গ্রহ ও হ্যালোউইন-দীপাবলী সমূহ
অনামিকাস জার্নাল : চাই-ল্যাটেঅনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
‘When I hear the word “culture”, I reach for my gun,’ Goebbels এর এই উক্তির উত্তরে বলা জরুরী ছিল- 'When I hear the word “gun”, I reach for culture,’। বলেও ছিলেন কেউ। । Le Mépris তে চির-সিনিক্যাল গোদারের আরও-সিনিক্যাল প্রোডিউসার বলে উঠেছিলেন - 'When I hear the word “culture”, I reach for my cheque-book !'
আর সাইদ তো বলতেই পারতেন-- Orientalism at its very worst.
এরপর চটপট কয়েকটি দৃশ্যকল্প-- ASOS, এক ট্রেন্ডি পোশাকের দোকান সম্প্রতি ভারতীয় বিন্দিকে তাদের হ্যালোউইন বাজারে তালিকাভুক্ত করেছেন। কিছু সস্তা কাপড়ের তৈরি কিম্ভুত কিমোনোও রেখেছেন। এও, হ্যালোউইনের চাহিদায়।
এদিকে একিভাবে, ভিক্টোরিয়া সিক্রেট তাদের দোকানের মডেল-শো'তে নেটিভ আমেরিকান হেড্ড্রেস কে ব্যবহার করেছেন অবলীলায় । নেটিভ ইন্ডিয়ানদের অভিজাত পালকে সজ্জিত এক শাদা মেয়ের মাথা, যার নাকি মাথাতেই ঢোকেনি মোটে কি সে পরিধান করে আছে। ভিক্টোরিয়া সিক্রেট অবশ্য খুবি সক্রিয়। এ ব্যাপারে ঝামেলা এড়াতে তড়িঘড়ি ক্ষমা চেয়ে ফেলেছেন।
এরই মধ্যে আবার মার্কিন দেশে সামার ফুরিয়েছে। ছাত্রেরা ইশকুলে ফেরত চলে গেছে। গাছের পাতা এখন থেকেই অল্প অল্প হলুদ। কারুর কাঁচা-লালের ছিটের সম্ভাবনা- গাঢ় না হলেও প্রকট।
এবং ইতিমধ্যে আবারো - গোল পেকেছে। এক এলিট ইউনিভারসিটিতে ছেলে-মেয়েরা থিম পার্টী করলেন। যেমন তারা করেই থাকেন। প্রায়শই । হরহামেশা।
কিন্তু কথা হোল- সমস্যা ঘুরেফিরে সেই একই শব্দবন্ধের আশেপাশে এবং তাদের পরপর সাজালে পাওয়া যাবে --
আরব-কস্টিউম ইন্ডিয়ান-প্রিন্সেস জিপসি-বেলিবেল্ট নাভাখো-হেড্ড্রেস
এই কোলাজ সমূহ।
আর ইউএসে টুডে লিখছেন -- 'The outrage began when a photo from the party surfaced on social media. Some students attending the party wore culturally themed apparel, including traditional Arab keffiyehs, a Mexican sombrero and a Native American headdress.'
অর্থাৎ কিনা প্রশ্ন উঠছে Cultural appropriation বা সাংস্কৃতিক গ্রহ নিয়ে। অন্য সংস্কৃতির প্রতি আপাত মুগ্ধতায় সেই সংস্কৃতির থেকে ইতিহাস, মানবিক সংবেদনশীলতা ব্যতিরেকে ধার করার প্রবণতা। যার লিস্টিতে রয়েছে দেশি বিন্দি থেকে শুরু করে আরব ও নাভাখো হেডড্রেস ও জিপসি-বেলিবেল্ট সমূহ। যাকে গুলিয়ে দেওয়ার জন্যে রয়েছে কাছাকাছি এক আপাত নির্দোষ শব্দও - অ্যাপ্রিশিয়েশন।
অ্যাপ্রিশিয়েশন যদি এখানে হয় সাংস্কৃতিক বিনিময় তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই আসলে এর সহজ গ্রহণীয়তার তলায় থাকা এক আপাত নিরীহ ভাইরাস- যা আপনাকে মনে করায় না যে অন্যের সাংস্কৃতিক বোধে অংশ নেওয়ার প্রাথমিক স্তরে থাকে এক শব্দ - 'কন্সেন্ট' - আদানপ্রদানের এক সহনীয় ভিত্তি। পারস্পরিক এক অনুমতি।
অন্যদিকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন - এক কথায় এই অনুমতির ধার ধারছে না এবং যে সংস্কৃতির থেকে সে ধার করছে, সে হয়ে থাকছে তার ত্বকের ওপর বসে থাকা - 'খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না' সিন্ড্রোমের দূষণকারী পরজীবী বিশেষ।
তাই এই আগ্রাসনের বিপক্ষে যুক্তি দাঁড়াচ্ছে -- অন্য সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধতা আপনাকে সেই বিশেষ গোষ্ঠীর কৃষ্টি সম্পর্কে আগ্রহী করে ছাড়বে, সেই কৃষ্টির ইতিহাসের সচেতনতা আপনার মস্তিষ্কে দ্বিধাহীন প্রবেশ করাবে। কিন্তু যদি হয় এমন যে এই মুগ্ধতা আপনাকে শুধুমাত্র হ্যালোউইনের একটি কস্টিউম বানাতেই উৎসাহিত করছে কেবল, তাহলে সন্দেহ নেই আপনি এক ক্ষতিকর স্টিরিওটাইপ কে জনপ্রিয় করার কাজে হাত লাগিয়ে ফেলেছেন।
বলছিলাম আমি নাভাখো-নারী আনাবা'কে, অ্যারিজোনার মেয়ে তিনি। বলছিলাম ...
বিন্দি, যোগাসন ও বেলিবেল্টএর মত এভাবেই, সারা উত্তর আমেরিকায় 'নাভাখো' একটি বাজ-ওয়ার্ড হয়ে উঠেছে। নাভাখো ক্লোথজ-লাইন , নাভাখো অলঙ্কারসমূহ মল-আহ্লাদিত কাচের বাক্সে কয়েক-কয়েক শো ডলারে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আর প্রতারিত জাতিগোষ্ঠীটি সেখানে হাই-এন্ড ঝাঁ-সুন্দর মল-নির্ধারিত প্রপ মাত্র হয়ে পরিচিত হচ্ছেন।
অথচ এদের কখনো আমাদের কোন প্রকল্পে যুক্ত হতে দেখা যাবেনা, এরা জানবেন না ও প্রজন্মকে জানাবেন না এই দেশ তারা দখল করতে পেরেছিলেন জিনোসাইড ঘটিয়ে । সমস্ত অধিবাসীদের ধুয়ে-মুছে দিয়ে । এদের মনেই থাকেনা যে এই দেশের কলোনিস্টদের উত্তররসুরী এরা, আসল বাসিন্দা নয়। ভাবতে পারো ?
প্রশ্ন তোলেন আনাবা । তার বেগুনে রঙের টি-শার্টের বক্ষ-স্থলে ছাপা--
Our Cultures Are Not Costumes.
তার কালো ভুরুর নিচে অসহিষ্ণুতার গুঁড়ো দেখতে পাই। খুব মেধাবী মানুষ আনাবা। সোশিওলজিতে গবেষণা করছেন ইস্ট কোস্টের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার নাভাখো সংস্কৃতি নিয়ে দারুণ গর্বিত থাকেন। আর ততোধিক অসহিষ্ণু সরকারী গাফিলতি নিয়ে। রাগ বয়ে চলে তার ঠোঁটে।
আনাবা বলে চলেন --
নেটিভ আমেরিকানরা বেঁচে নেই, তারা শুধু টিকে আছেন, অ্যাকাডেমিয়ায় আর শপিং মলে। শাদা আমেরিকানের বাহুতে এক ট্যাটুর মতোই ক্ষুদ্র ও জন্মদাগের ইরেজার স্বরূপ। সাধারণ মানুষ হিসেবে শাদা আমেরিকানরা 'এক্সোটিক' দেখা মাত্রেই তা জবরদখলের মতই ঝাঁপিয়ে পড়বে কিন্তু গভীরে যাবেনা …আনাবা'র ক্রুদ্ধ যুক্তি আমাকে 'কুমারে-এক্সপেরিমেন্টে'র কথা মনে পড়াল। ২০১১ সালে নির্মিত 'কুমারে' ছিল একটি সোশ্যাল পরীক্ষামূলক তথ্যচিত্র। ভারতীয় 'এক্সোটিক' চাখার নেশায় কয়েক জন শাদা আমেরিকান রিমোট অ্যারিজোনায় এসে এক ভারতীয় 'সাধু' কুমারে'র সঙ্গ করেন ও তার আশ্রমে যোগদান করে। এই কুমারে হলেন আসলে বিক্রম গান্ধী, এই তথ্যচিত্রটির নির্মাতা, আর আখড়াটি হোল তার পরীক্ষাগার। যেখানে তিনি পরীক্ষা চালালেন - কিভাবে একজন মানুষ ও তার আশ্রমকে তারা প্রাচীন বহমান সংস্কৃতির সোর্স ভেবে নিলেন, কোন যোগ্যতা'র ও বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রমাণের সম্যক ধারনা ছাড়াই। প্রায় এক বছরের পরে কুমারে তার পরিচয় প্রকাশ করেন। ততদিনে তিনি এক দারুণ ইন্ডিয়ান গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তার পরীক্ষাগারের ছাত্রদলের কাছে। ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রতিদিনই এই দৃশ্যের জন্ম হয়। বাবা-অবতার, ধর্মের হঠাৎ গজিয়ে ওঠা পয়গম্বর, যাদের চরম ইচ্ছে শীঘ্রই এক রাজনৈতিক বা সামাজিক চাঁই হয়ে ওঠা। আর্থিক সমস্যার এক সহজ সমাধানও বটে।
ভারত নামের ভূখণ্ডেই, ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই গজিয়ে ওঠা চাঁইদের প্রতিষ্ঠা দেয়, সমগ্র জাতি ভাবতে থাকে তারা প্রাচীন এক ভারতীয় জ্ঞান-ধারা থেকে বিচ্যুত। কোন এক জটিল জটাধারী, বা যোগা'র এক্সোটিক খেল-কুঁদ করা কোন ব্যক্তিই তখন হয়ে ওঠেন প্রাচীনতার মিসিং লিঙ্ক। আর তা ক্রমে চুঁয়ে পড়তে থাকে জাতির কোমর বেয়ে। যাকে অনেক সময় 'ডিফিউশন' আখ্যা দেবেন অনেক সমাজতাত্ত্বিক, ঠিক যেভাবে অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন কেও কখনো কখনো ডিফিউশন বলা হবে চৌর্যের ধারনাটির থেকে অল্প সরে গিয়ে।
কিন্তু, যেভাবে ডিফিউশন অবশ্যম্ভাবী, গ্রহ কিছুতেই নয়। মুদ্রার অপর পিঠের যাওয়ার চেয়েও সূক্ষ্ম এক অযাচক অনুপ্রবেশ তা । আসলে যে মুহূর্তে তার সাথে জোট বাঁধছে উপনিবেশিক সত্তা, সেই মুহূর্ত থেকে এই অনুপ্রবেশ অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনে বদলে জেতে শুরু করছে, চান বা না চান। তাই যেভাবে এক শাদা শহুরে তরুণী যখন তার নবতম মেকওভার হিসেবে ড্রেডলক বেঁধে পার্কে বেড়াচ্ছেন তখন তা আর নিছক অ্যাপ্রিসিয়েশন না থেকে গ্রহে অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। যদি ব্ল্যাক কালচারের বদলে আমেরিকা ব্ল্যাকদের ভালবাসতে শিখত ...
আমি আর আনাবা বলাবলি করি।
আরও সমস্যা হোল এই অনুবাদ হওয়াকে প্রশ্রয় দিলে তা ক্রমে বেড়ে এক স্ট্যাটাস-কুয়োতে এসে দাঁড়ায়, যতক্ষণ না পর্যন্ত তা পুরোপুরি বিকৃত হচ্ছে, আর শেষ হয়, যখন প্রায় কেউই আর মনে করতে পারেননা এর অরিজিনাল উৎপত্তি ও ইতিহাসের জায়গাটি। বিশ্বের অন্য নাগরিকদের চোখে আমাদের সমস্ত সাম্প্রতিক অর্জন কয়েক শতক পিছু হটে যায়। এক প্রাচীন ফসিল যেন আমরা, আর এর সবটাই ঘটে কিছু মানুষের অ-সংবেদনশীল আমোদ করার ইচ্ছেতে।
আনাবা'র চোখে উষ্মা প্রবল।
আমার আরেক কাছের বন্ধু পূর্ব-ইয়োরোপের মানুষ হেলেনা, একবার আমি কুস্তুরিকার ছবি ভালবাসি শুনে বলেছিলেন ঃ 'তোমরা কি সত্যই খেয়াল করনা, অনেক ভাল সিনেমার শিল্পীদের আলপাকার নীচে কিভাবে রেসিজম লুকোনো থাকে ?'
কুস্তুরিকা তার প্রবাদ ছবি আন্ডারগ্রাউণ্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্লোভেনিয়ানদের 'অস্ট্রিয়া'র ঝাড়ু' বলে ছারখার করেছিলেন। একিভাবে রাজনৈতিক লড়াইয়ে কসাকদের কাউন্ট ড্রাকুলার জাতিস্মর হিসেবে দেখানো হয়েছিল। যেভাবে 'জিপসি' শব্দও একিভাবে অবমাননাকর, রোমানি'দের বোঝাতে তার প্রয়োগ শুরু।
অর্থাৎ চৌর্য শুধু না, সাংস্কৃতিক-গ্রহের কথা বলতে গেলে উঠে আসবেই লীন তাপের মত মিশে থাকা মুনাফা ও উপনিবেশবাদ, রেসিজম ও সুপ্রিমেসির ফেনা সমূহ।
ছোটবেলার গল্প । আমরা তখন নেহাতি ইশকুলে'র ছোট ক্লাসে।
হাতিবাগান -গড়িয়াহাটে প্লাস্টিকের ফুলের পাশে রমরমা বিক্রি হত সাঁওতালি নারী -পুরুষের এক্সোটিক মাথা, অত্যধিক মোটা তুলির প্রয়োগে আঁকা ওভার-পাউটেড ঠোঁট, গায়ের রঙের থেকে মাথার কালো চুল আলাদা করার জন্যে পরচুলোর ছোঁয়া। একবার আমাদের বম্মা, চৈত্র সেলে মাটির দুই সাঁওতালিদের মাথা কিনে আনলেন দরদাম করে। সঙ্গে আরও সাঁওতালী পুতুল। সঙ্গে ছিলেন আমদের ইস্কুলতুতো এক বন্ধুর মা । সুরমা মাসি । মাসি বললেন - 'দারুণ হয়েছে, ওদের নাচ দেখতে এতো ইচ্ছে করে, দূরদর্শনে একদিন দিয়েছিল। কি দারুণ সারি বেঁধে নাচ'। বম্মা শুনে তৎক্ষণাৎ সুরমা মাসিকে পুজোর দাওয়াত দিলেন- আরে আমাদের দুর্গাপূজোয় এসো দেখতে পাবে, আমাদের বাড়ি এসে কেমন নাচে। বোলপুরে দেশের বাড়িতে দুর্গাপুজোয় নাচ দেখাতে আসত সাঁওতালি কিছু নারীপুরুষ, তারপর আখ-বলিও দিত। এদের বলা হত রাজার বলি। রাজার বলি কেন বলে, এ প্রশ্নের উত্তরে বড়দের আধা-আহ্লাদী-গর্ব মাখানো উত্তর মিলত - 'এরা সব আমাদের প্রজা ছিল তো এককালে … তখন ভেট আনত রাজাবাবুদের জন্যে... এই সাদামাটা ফসল-টসল , মুরগী টুরগী তো আনা চলত না …। ' মানে হল- তার একটা রিচুয়াল হয়ে থেকে গেছে এই আখ-বলি। রাজার বলি দূর থেকে আসছে দেখলেই 'আসছে আসছে ' রব উঠে যেত। পেছনে গ্রামের কাচ্চা-বাচ্চা নাঙ্গা পায়ে ধুলো উড়িয়ে ছুটত। দশ ফুট প্রায় লম্বা এক আখকে হাড়িকাঠে আড়াআড়ি রেখে বলি দেওয়া হত। নিরামিষ এই বলিতে আমাদের ছপ্পর আনন্দ হত। কোন রক্ত নেই। তারপর সেই আখ টুকরো করে সবাইকে বিলিয়ে দেওয়া হত। সে নিয়ে সামান্য কিছু মারামারিও চলত। সেসব মিটলে বলির পর কোমর জড়িয়ে শুরু হয়ে যেত সাঁওতালিদের নাচ। নাচ শেষে তারা বাড়ি ঢুকে হাসিমুখে বিদায়ী নিতে আসত। সামান্য কিছু টাকা, চাল, পুরনো জামাকাপড় এই ছিল বরাদ্দ। একবার নাচ শেষে তাদের এক বছর ছয়েকের ছেলের জন্যে তাদের এক ক্ষীণ -কায়া মা নতুন জামা চেয়ে বসলেন। অনেকদিন নাকি সে শিশু কোন নতুন জামা গায়ে দেয়নি। তাতে বম্মা- ছোম্মা ও গৃহকর্মের কর্ত্রীরা হাঁই -হাঁই করে কান্না জুড়ে দিলেন। যে কান্নার সারমর্ম ছিল- দেখছিস কিছুতেই খুশি নয়। শেষে দিদারা এসে বুঝিয়ে বললেন - 'এখন এই নাও, পরের বার দেব'। ছোট শিশুটি খড়ি-তোলা গায়ে পুরনো জামা বগলে মায়ের দিকে চেয়ে চেয়ে বেরিয়ে গেল। আমার মামাতো বোন সিমটু বলল- 'দেখলি, ওদের মুখের পুতুল কিনতে কত খরচ করলো বম্মা, আর বাচ্চাটাকে একটা জামা দিল না'। এর প্রতিশোধ নিতে আমরা লুকিয়ে দৌড় লাগিয়ে আমাদের মাসতুত দু'ভাইয়ের নতুন পুজোর জামা তাদের দিয়ে আসতে গেলাম। তাদের বাবাটি মহা খুশি। তাদের মা বললেন ঃ এ জামা কে দিয়েছে, তোমাদের মা ? আমরা সহাস্যে জোর মিথ্যে বলে পালিয়ে এলাম। পরে, জামা পাওয়া যায়না সুটকেস থেকে, এমন সময়ে বাজার করার ভারপ্রাপ্ত মদন খবর পৌঁছে দিলেন, সাঁওতালিদের ছেলের গায়ে তিনি এইরকম জামা দেখছেন। দেখেই বুঝেছিলেন- শহরের জামা। এরকম জামা পেল কোথায় এ ভেবে তখন চেপে ধরেনই বলে তার বহুত আফসোস। বাকি কথা বিস্তর না বললেও চলে যে তা চৌর্য কাজ স্বরূপ মুহূর্তে স্বীকৃত হোল এবং সব ছাপিয়ে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল - চুরিটা করল কখন ? ছোম্মা বললেন- 'এতো মিনিবাসের গাঁট-কাটা দের চেয়েও বিপজ্জনক'। এর একদিন বাদে, থাকতে না পেরে, আমরা সে দোষ কবুল করি। তার নেক্সট কার্যক্রম স্বরূপ দু'ঘা দেওয়াই ছিল দস্তুর। সিমটু একটু আহ্লাদী, তাই অনেকক্ষণ ভ্যা করে কেঁদেছিল। মনে আছে, আমি সে রাগ পুষে রাখি ও কোন এক রোববারে যখন বম্মার বাড়ি যাওয়া হয়েছে, সুযোগ মত বম্মা'র বাড়ির পুতুলগুলো তার তাক থেকে ফেলে ভাংচুর করে দিই। আর সিমটু সারা বাড়ি ঘুরে জানিয়ে আসে যে তা আসলে কেলু'র কীর্তি। বম্মার আদরের বেড়াল। কেলুকে ক্যাল দেওয়া হয়েছিল কিনা তা অবশ্যই মনে নেই আর।
এরও বহুবছর বাদ, আমি নক্টেদের বিষয়ে এক ফিচারের কাজ করছি, মূলত গোপাল কাকার উৎসাহে। গোপাল কাকা, গোপাল কৃষ্ণ রায়, এক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন আর দীর্ঘদিন সঙ্গ করেছেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের বাসিন্দা নক্টেদের সাথে। গবেষণাও করেছেন অনেক। আমাদের এক তুলনামূলক সার্ভে জাতীয় কাজ ছিল তা।
এই সূত্রেই আলাপ হয় তার সাথে। দেবুদা। দেবুদা বোলপুরের সরপুকুর-ডাঙ্গা গ্রামে থাকতেন। এখনো থাকেন। সেই থেকে দারুণ আলাপ ও বাড়ি যাওয়া-যাই। দেবুদার মামীর হাতে তাড়ি,পিঠে,খাটিয়া পেতে চাঁদের আলোয় ভরভরন্ত গান। নানা হেজগ্রস্ত, অলীক সন্ধ্যে সব। ছিল ছোট্ট মেয়ে মুমু- সে ছাপা ফ্রক পরে মাটির উঠোন-ময় ঘুরে ঘুরে নাচত। এই সব কথা কলকাতার বন্ধুদের কাছে গল্প করে থাকব।
একদিন দেবুদা ফোন করে জানতে চাইলেন - 'তুমি কোন বন্ধু পাঠিয়েছ ? একদল ছেলে মেয়ে বাসা-পরবের ছবি তুলবে বলে তোমার নাম নিলো, তারপর আমাদের দেখাদেখি ওইরকম ফুল ছুঁড়া-ছিরি করতে করতে মাঠ দিয়ে মদ খেতে খেতে খেতে চক্কর দিচ্ছে খালি। কিছু বাড়িতে গিয়ে লোভ দেখিয়ে বলেছে নাচতে পারলে টাকা দেবে। যত বলি- এ আমাদের পরব, নিজস্ব ব্যাপার। লোকের লগে, তারা বললেই আমরা নাচব কেনে। মানতে চায়না'।
অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে নাম জিজ্ঞেস করি- এবং বুঝতে পারি ক্ষীণ পরিচিত কিছু সহ-নাগরিক আমার নাম ব্যবহার করে এন্ট্রি নিয়েছেন।
এরও অনেক বছর বাদ। বছর দু'এক আগের কথা। ইন্ডিয়া গিয়ে, বোলপুর গেছি। কয়েক কলকাতা'র বন্ধু বাড়ি বানিয়ে উইকেন্ড যাপন করতে এসেছেন শান্তিনিকেতনে। তাদেরই জোরাজুরিতে এক এথনিক হোটেলে রাতের খাবার খাওয়া হবে। মোচা ঘণ্ট, পাতলা মুসুর, কুমড়ো ফুলের বড়া সহ নানা রকমের রেয়ার শাক-সবজি'র কমপ্লিট 'দেশী' প্যাকেজ। মানে দারুণ 'এক্সোটিক' যাকে বলে। হোটেলের ম্যানেজার আমার বিদেশ বাস কে এক বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে গণনা করছেন, ফলে যত্ন অনেকটাই ফাউ। এই ফাউ এর শেষে আরও ফাউ যাতে যোগ হয়, তার জন্যে তিনি রহস্য হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন ঠোঁটের কোণে। পরিবেশন কারী মানুষটির বয়েস অল্প, তিনি বললেন ঃ 'আপনার জন্যে দারুণ চমক আছে দিদি'। আমার বন্ধুদের কাছে ফরসা করতে চাইলে, তারা বললেন- 'আরে রোসো - আজ পূর্ণিমা তো '। রহস্য হাল্কা হয়, আবার হয় না । যাই হোক, চমক এলো। একদল সাঁওতালী ছেলেমেয়ে মাদল সহযোগে নাচতে এলেন। একজন বৃদ্ধও আছেন, বাঁশী বাজাতে। মাথায় তার নানা রকমের পালক গোঁজা। সবাই মুরগীর ঠ্যাং সহযোগে সে নাচ দেখলেন। বেশী সুরা-পাণে অতি উৎসাহও চোখে পড়ল।
পরদিন দেবুদা'র সাথে দেখা করলাম। জানলাম সে গ্রামের অনেকেই বোলপুরের নানা হোটেলে নাচ করে। বিশেষ করে দোলের সময়। আমি বিস্মিত হ'তে দেবুদা পরে বলেছিলেন- 'নানা সময় নানা লোক এসে আমাদের সাথে মাথায় পালক টালক দিয়ে ছবি তুলতে চাইত, তারা নাকি আমাদের নাচগান ভালবাসে, আর পরে সেই ছবি চড়া দামে দেশ-বিদেশের কাগজে বিক্রি করে দিত । আমরা এক টাকাও পাইনি কোনদিন। অনেকে আগে হোটেলে নাচতে রাজী হয় নাই- তো দেখতাম কেউ কেউ সব মেয়েদের শহর থেকে এনে, গায়ে কালো রং দিয়ে নাচ করাত । আমদেরই বিচে টাকা যদি তো আমরাই নাচি না কেনে'।
আরও শুনলাম- মুমুর নাম এখন জাসিন্টা । ইশকুলের চাকরীর পাশে ব্যবসা করে। ওর মা-বাবা মিশনারি স্কুলের সাফাইয়ের এর কাজ পেয়েছিলেন, পরে খ্রিস্টান হয়ে যান। শুনেছি ওর বাবাকে তখন দারোয়ানের কাজে মাস মাইনেতে রাখা হয়। জাসিন্টা প্রাইমারি ইশকুলে খোখো'র টিচার, বাকি সময় সে সাঁওতাল পুতুলের মাথা তৈরি করিয়ে সরকারী দোকানে সাপ্লাই করে। ধরাবাঁধা কাজ। ভালো আয়।
এবার ফলে দারুণ রং ধরেছে। নিউ ইংল্যান্ডের চেয়ে কম কিছু না। পাতায় পাতা ক্যাম্পাস। তার ওপর হাল্কা মরমর শব্দ তুলে লাল টুকটুকে বুট জোড়া চড়িয়ে আমার পাশে হেঁটেছিল আনাবা। হেমন্তের বিকেল প্রায়শই মোলায়েম, মনখারাপ-ময়।
তোমার নামের মানে কি আনাবা ?
আমি গরম কফি সামলাতে সামলাতে জিজ্ঞেস করি ।
রিটার্নস ফ্রম ওয়র ...
অন্যমনস্ক ভাবে ম্যাপল পাতা কুড়িয়ে নেয় আনাবা।
আবার বলে ঃ
রিটার্নস ফ্রম ওয়র … শী রিটার্নস ফ্রম ওয়র ।
******
এরপর হ্যালোউইন কেটে গেছে। কিছুদিন হোল। শেষ ফল-ব্রেকেরও।
এরই মধ্যে পরপর দুটি ঘটনায় আমাদের পাড়া সরগরম ঃ আমাদের প্রতিবেশী মিস্টার সবচাক এবছর হ্যালোউইনে স্পাইডারম্যান সেজেছিলেন। অদ্ভুতভাবে, তিনি নাকি পরদিনই কালো মাকড়শা'র কামড়ে হসপিটালে।
আমায় সবচাকদের পাশের বাড়ির অ্যান্ডারসন গিন্নি চোখ বড় বড় করে সে খবর জানালেন। বলার মধ্যে কি আর থাকে একথা ছাড়া, সেটাই বললাম ঃ আরে ভীষণ কাকতালীয় তো !
বাড়ি ফেরার পথে কেন কে জানে মনে পড়ল, দাদুর কাছে শোনা ঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঘোড়া-গাড়ী চড়তেন না। তার যুক্তি ছিল ঃ ঘোড়াকে তো আমার জিগানো হয়নি যে সে আমাকে পিঠে নিতে রাজী কিনা।
1 মন্তব্যসমূহ
চমৎকার। তবে লেখাটা আরো একটু অ্যানালিটিকাল হলে ভালো লাগত।
উত্তরমুছুন