গল্পপাঠে প্রেরিত কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা

জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলাো

সেদিন ঘরোয়া আড্ডায় এক বন্ধু বললেন, “‘ছোটগল্প’ পড়তেই বেশি ভাল লাগে”। ‘কেন’ জানতে চাওয়ার আগেই তিনি বলা শুরু করলেন, “এমনিতে, ভীষণ ব্যস্ত! এর মাঝেও অল্প কিছু সময় বের করে নিতে পারলে, ছোট একটি ভালো গল্প পড়া সম্ভব। আর ‘গল্প’ পড়ার বড় সুবিধাই হলো, সামান্য এগুতেই বুঝে নেওয়া যায়- গল্পটা ভালো কিনা! উপন্যাস, প্রবন্ধ বা নিবন্ধের ক্ষেত্রে যেটা সব সময় সম্ভব হয় না।”

 যদিও এটি মাত্র একজন পাঠকের মনোভাব, তবু কথাগুলো মাথায় রয়ে গেল। বিশেষ করে, গল্পের শুরুতেই পাঠক বুঝে নিতে চান গল্পটি কেমন, ভাল নাকি মন্দ- এ অংশটি বোধহয় আসলেই সত্য। এবং এও খুব মিথ্যা নয় যে, আজকের গল্পকারের কাছে তাঁর পাঠকের দাবী অনেক। ব্যস্ত এ সময়ে, পাঠক তাঁর সাহিত্যাকাঙ্ক্ষার পুরোটা মিটিয়ে নিতে চান সুঘ্রাণ চায়ে চুমুকের মতো করে। অর্থাৎ মুহূর্তের মাঝে তাঁর ভাবনা জগতে নিয়ে নিতে চান চমৎকার কোন ভাষার কারুকাজ কিংবা অভাবনীয় কিছু ঘটনা। কিংবা পেতে চান ছোট সে গল্পে, অসাধারণ কোন জীবনবোধের আভাস। তাই আধুনিক এবং নবীন গল্পকারকে স্বাচ্ছন্দে এগুতে হলে, গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে জরুরি কিছু গল্প-ভাবনা।

‘গল্পপাঠ’ মূলত গল্পের পত্রিকা। গল্প এবং গল্পের সংশ্লিষ্টতাই এর প্রাণ। এখানে গল্প প্রকাশের উদ্দেশ্যে নবীন এবং অভিজ্ঞ গল্পকাররা নিয়মিত গল্প পাঠিয়ে থাকেন। গল্পপাঠের জন্য গল্প-বাছাই করতে গিয়ে, চমৎকার সব গল্প-পাঠের অভিজ্ঞতা তাই যেমন বাড়ছে, তেমনি কখনো বা, অসংলগ্ন কথার দীর্ঘ-স্তুপও পাড়ি দিতে হচ্ছে! কিছু গল্প এখানে আসে যেগুলো থেকে শুরুতেই মন সরে যায়। ভাষার অপরিণত ব্যবহার এবং গল্পের মূল ফোকাস-এ, সঠিক সময়ে আলো ফেলতে না পারাই এর প্রধান কারণ। যেমন একটি গল্প এসেছিল ‘ভারত জিতলে বিপ্লব সফল হবে’ নামে। লেখক গল্পটি শুরু করেছেন জটিল ভাষায় এবং কিছুটা পত্রিকায় খবর প্রকাশের ধরণে। তবু নামটি আকর্ষণীয় হওয়ায় এবং অন্যরকম থিমের গল্প-আশায়, গল্পটিকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করা হয়। শেষে যদিও ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের টুকরো কিছু দৃশ্য আর লেখকের সংলাপহীন দীর্ঘ আলাপ ছাড়া তেমন কিছু সেখানে পাওয়া যায় না।

গল্পের নাম একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কখনো কখনো শুধু নাম দিয়েই বেশ কিছুক্ষণ পাঠককে গল্পে বেঁধে রাখা যায়। যেমন নাম যদি হয়, ‘একটি অমীমাংসিত গল্প’, তাহলে অবশ্যই জানতে ইচ্ছে করে সে গল্প সম্পর্কে। কিন্তু গল্পে একটু এগুতেই যদি দেখা যায়- মেস-রাঁধুনি আর মেস-পরিচালকের শারীরিক সম্পর্ক আর তার জেরে রাঁধুনিকে ছাটাই করাই হচ্ছে গল্পের মূল আলোচ্য বিষয়; তাহলে পাঠক সেখানে অন্য কিছু খুঁজবে। কেননা এই সাদামাটা গল্প পাঠকের জানা আছে। শুধু এ গল্পকে পাঠকের অমীমাংসিত কিছু মনে হয় না। খুব চেনা এবং সাধারণ বিষয় নিয়ে লিখতে চাইলে, গল্পে নতুন এক অনুভূতি কিংবা আনকোরা কোন বোধের সাথে পাঠকের পরিচয় করালে ভালো হবে। তাহলে সেই অতি সাধারণ গল্পটিও তখন নতুন রূপে স্থান পাবে পাঠক-হৃদয়ে।

ইদানিং বেশ কিছু গল্প আসছে যেগুলো লেখাই হচ্ছে যৌনতাকে উপজীব্য করে। যৌনতা গল্পে আসতে পারবে না তা কিন্তু নয়। আসবে, জীবন সংশ্লিষ্ট সব কিছুই আসবে জীবনের গল্পে। তবে আসতে হবে, গল্পের প্রয়োজন অনুসারে। যেমন ‘অল্প অল্প রোদ-বৃষ্টি’ নামের একটি গল্পে লেখক দেখাচ্ছেন পুরনো প্রেমিকার সাথে দেখা হওয়ার অনুভূতিকে। কিন্তু একাকী সে স্মৃতিচারণ পুরোটাই যদি হয় প্রেমিকার শরীর এবং শারীরিক সম্পর্কের বর্ণনা; তাহলে গল্পের পাঠক শুধু নয়, লেখকের ফোকাসও দূরে সরে যায় গল্প থেকে। ‘গল্প’ তখন তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যটুকু হারিয়ে ফেলে। গল্পটি হয়ে যায় বিরক্তিকর।

চিরন্তন কিছু সত্য বা নিয়তি নিয়েও গল্প লেখেন অনেকে। তেমন একটি গল্প ‘ডাক’। এখানে অশীতিপর এক বৃদ্ধা রয়েছেন প্রায় মৃত্যু-শয্যায়। মৃত্যু শয্যায় থেকেও যিনি কথাবার্তা, খাওয়াদাওয়া সব ঠিকঠাক করতে পারেন। কিন্তু এক সকালে গ্রামের সবাই একটি মৃত্যু-সংবাদ পেল। তবে বৃদ্ধা নয়, তার ছেলেটি মারা গিয়েছিল। এই মৃত্যু নিয়ে আত্মীয় স্বজনের ইমোশন বা চিরাচরিত এক হাহাকারকে খুব স্বাভাবিকভাবেই লেখক আনতে পারতেন গল্পে। কিংবা মৃত্যু কে কেন্দ্র করে যে ‘আতঙ্ক মেশানো এক অপেক্ষা’ থাকে তাও সুন্দর করে দেখাতে পারতেন। কিন্তু লেখক শুধুই ধর্মীয় আবহে গল্পটি শেষ করলেন। ধর্ম ভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকার জন্য হয়তো এ ধরণের গল্প ঠিক আছে। তবে সাধারণভাবে, গল্প-সাহিত্যে পাঠকের আকাঙ্ক্ষায় থাকে আরও অনেক কিছু। চিরন্তন এ গুরুত্বপূর্ণ কথাকে অন্য কোন তাৎপর্যে বা ঘটনার চমকে দেখাতে না পারলে, গল্প তার গুরুত্ব হারায় সবটুকু!

অভিজ্ঞ হাতে, সহজ লেখনী দিয়ে লেখা বেশ কিছু গল্পও আসে গল্পপাঠে। এই মুহূর্তে গল্প ‘গোসাপ’ এর কথা মনে পড়ছে। লেখক এখানে ধীরে ধীরে মূল গল্পে নিয়েছেন তাঁর পাঠককে। ঘটনায় তেমন নতুনত্ব না থাকলেও, গল্প হিসেবে মন্দ নয়। পুরো গল্পই পাঠকের কাছে হয়েছে দৃশ্যমান। গল্পের শেষে সূক্ষ্ম একটি মেসেজ রেখেছেন গল্পকার। সমস্যাটা এখানেই। গল্পে লেখককে মেসেজ দিতেই হবে, এমন কোন কথা নেই! তবে মেসেজ দিলে, সে বক্তব্যটিকে হতে হবে ন্যায়নিষ্ঠ। কয়েকটি অনৈতিক চরিত্রের কার্যকলাপের মাঝে অপেক্ষাকৃত কম অনৈতিক কাজটিকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখানোটাও পাঠকের চোখে দৃষ্টিকটু। সমাজ সংস্কারের সব দায় মাথায় নিয়ে লেখককে লিখতে শুরু করতে হবে তা কিন্তু নয়! তবে একজন লেখক লেখার মধ্য দিয়ে কোন ভুল বা অস্বচ্ছ মতামত পাঠককে দেবেন না- এটুকু দায় তাঁর নিশ্চয়ই!

‘অপঘাত’ নামের একটি গল্পে শুরর দিকটা বেশ চমৎকার। পাঠকের এখানে আগ্রহ থাকবে শেষে কি হয় তা দেখার। অর্থাৎ এই গল্পকারের গল্প বলার ধরণটি আকর্ষণীয়। একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় এমনিতেই মানুষের আগ্রহ থাকে, তার উপরে গল্পটি রহস্যে মুড়িয়ে এগুচ্ছিল। কিন্তু শেষে গিয়ে খুব সাদামাটা ভাবে গল্পটি শেষ হয়। শেষপ্রান্তে এসে আগ্রহী পাঠককে হতাশই হতে হয়। আসলে, যেভাবে গল্পটি শুরু হয়েছে, তার সাথে তাল মিলিয়েই গল্পটি শেষ হওয়া ভালো। তাই গল্পের শেষাংশও অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভালো গল্পও অসফল পরিণতি লাভ করতে পারে, সঙ্গতিপূর্ণ উপসংহারের অভাবে।

সমসাময়িককালে প্রাপ্ত গল্প সমূহে সাধারণভাবে এ ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোই দেখা যাচ্ছে। তবে এ আলোচনার অর্থ এই নয় যে, নতুন গল্পকাররা সুন্দর গল্প লিখছেন না! প্রচুর ভালো এবং নতুন ধরণের গল্পও লিখছেন নবীন গল্পকাররা। নতুন লেখকদের ভালো গল্পের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, তাঁরা তাঁদের নিজেদের জীবনের গল্পই লিখছেন গল্পে। কিংবা খুব কাছ থেকে দেখা কোন ঘটনাকেই তাঁদের গল্পের আখ্যান বানিয়ে নিচ্ছেন। এটা তো সত্যি, অচেনা গল্পের চাইতে চেনাজানা গল্পের জোর বা শক্তি অনেক বেশি। লেখক তখন শক্ত হাতে শুধু পরিবেশটুকু বোনেন, গল্প এগোয় তার নিজস্ব গতিতে। লেখকের আঁকা চরিত্ররা তখন নিপুন ক্যনভাসে ভেসে ওঠে পাঠকের চোখে। ‘ভালো লেখক’ হবার প্রথম ধাপে তাই নিজের জানাশোনার ব্যাপ্তিকে কাজে লাগাতে পারলে, মন্দ নয়।

‘লেখা’ নিয়ে বলা যায় বহু কথা। কিন্তু সব কথার আসল কথাই হলো লেখক লিখবেন নিজের মতো করে। লেখক তাঁর লেখায় প্রকাশ করবেন একান্ত নিজস্ব কিছু ভাবনা। একজন লেখক লিখবেন সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয়। তিনি লিখবেন মানুষের গল্প, তুলিতে শুধু কল্পনার কিছু রঙ মাখিয়ে। এখানে নিতান্তই একজন পাঠক হিসেবে জানানো হলো, কোন ধরনের লেখা কেমন লাগে পড়তে; কিংবা কেন এমন লাগে! নিশ্চয়ই নতুন লেখকগণ গল্পপাঠের সদিচ্ছা বুঝতে পারবেন। এবং গল্পপাঠের সাথেই থাকবেন!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব কাজের একটি লেখা। নিজের সমস্যা নিজে থেকে ধরা যায় না। লেখককে ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার গল্প পড়ার খুব ইচ্ছে করছে। জানতে ইচ্ছে করছে, সেসব গল্প কেমন আর কতটুকু পরিপক্ক

    উত্তরমুছুন