বইপাঠ : বিশ্বসাহিত্যের ক্ষুদে জায়ান্ট



মোজাফফর হোসেন

“Size don't matter, chopping wood,”—কথাটি মারজরি কিনান রলিংসয়ের ছোটগল্প ‘মাদার ইন ম্যানভিল’র কিশোর জেরি লেখককে বলে। ‘আকার বা আকৃতি বিষয় না’—কথাটি ভীষণভাবে খাটে কিছু কিছু বইয়ের ক্ষেত্রেও। পৃথিবীতে অনেকগুলো ক্ষুদে বই আছে যা আজ দস্তয়েভস্কির ‘ব্রাদার কারামাজভ’, তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, টমাস মানের ‘ম্যাজিক মাউন্টেইন’, সার্ভেন্তেসের ‘দন কিহোতে’র মতো মহান উপন্যাসের পাশে বিশ্ব-ক্লাসিকের তকমা নিয়ে গৌরবের সঙ্গে ঠাই পেয়েছে।
সফোক্লিসের অতি ক্ষীণকায় নাটক ‘ইদিপাস’ পুরো বিশ্বে ঝড়তোলা সাহিত্যসৃষ্টির ভেতর একটি। এই নাটক থেকে তত্ত্ব হিসেবে পরবর্তীকালে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড ‘ইদিপাস কমপ্লেক্স’কে দাঁড় করান। সমগ্র শিল্প-সাহিত্যে এর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

ইবসেন রচিত ‘ডলস হাউস’ নাটকটি বিশ্বে নারীবাদী চেতনাকে একেবারে মূল থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার খোঁজে ঘর ছেড়ে যাওয়া নোরার বাইরে থেকে দরজা ভেড়ানোর শব্দ সম্পর্কে আরেক নাট্যকার বার্নাড শ’ বলেছেন, ওই ধ্বনি ওয়াটারলুর কামানের আওয়াজের চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। নোরা কেবল নারীমুক্তির প্রশ্নকেই ঊর্ধ্বে তোলেননি, তিনি সমাজের অর্থব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। নারীবাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান টেক্সট হিসেবে এই নাটকটি আজ পঠিত।
সামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ আবসার্ডিজম ধারণার প্রতিনিধিত্বশীল কাজ হিসেবে গণ্য। কামুর দার্শনিক রচনা ‘মিথ অব সিসিফাস’রই যেন নাট্যরূপ এটি। মানব জীবনের এই অর্থহীনতা বা নিরর্থকতার কথা কামু আরো সহজ করে বলেছেন তাঁর অমর সৃষ্টি ‘দ্য আউটসাইডার’-এ। মানুষের জীবনের অর্থহীনতার কথা এরচেয়ে ভালো করে আর কোনো উপন্যাসে উঠে আসেনি।
কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ মানুষকে পুঁজিবাদী সমাজে অস্তিত্বের প্রশ্নে দাড় করিয়ে দিয়েছে। আকারে সামান্যই, ইমপ্যাক্ট পাহাড়-সমান। তলস্তয়ের ‘দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচ’ ঠিক উপন্যাসিকা নয়, বড়গল্প। এটিকেও আমি এই তালিকায় রাখতে চাই। বলা যায়, ‘মেটামরফোসিস’ যেখানে শেষ ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ সেখান থেকে শুরু। দুটিরই গল্প শুরু হয় এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ শুরু হয় ইভান ইলিচের মৃত্যু আর ‘মেটামরফোসিস’ শুরু হয় সামসার দৈহিক পরিবর্তন অর্থাৎ মানুষ থেকে পোকায় রূপান্তর ঘটার মধ্য দিয়ে। বলা হয়, আধুনিক সাহিত্যের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাক্য হল: As Gregor Samsa awoke one morning from uneasy dreams he found himself transformed in his bed into a gigantic insect। দুটি গল্পেই একটি সরল আখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা ঢুকে পড়ি মানব জীবনের গাড় ও গূঢ় রহস্যের মধ্যে।

জর্জ অরওয়েলের ‘দ্য এনিমেল ফার্ম’ নতুন আঙ্গিকের পাশাপাশি নিয়ে এলো ব্যর্থ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দুর্দান্ত অ্যালিগরি। পরম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন এঁটে পরিচালিত হল আন্দোলন। বলা হল, “All men are enemies. All animals are comrades”। এরপর সমবেত প্রচেষ্টায় আন্দোলন সফল হওয়ার পর শ্লোগান গিয়ে দাঁড়াল: “All animals are equal, but some animals are more equal than others.”
ইংল্যান্ডের শুধু ভিক্টোরিয়ান সমাজবাস্তবতা নয়, মানুষের সামগ্রিক মনোজগতের নগ্নরূপ উঠে এসেছে রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘ড. জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড’ নামক ৬৪ পৃষ্ঠার ক্ষুদে উপন্যাসে। উপন্যাসটি একইসঙ্গে সায়েন্স ফিকশন, কিশোর থ্রিলার ও সাইকো উপন্যাস হিসেবে পঠিত। আর এর চেয়ে শক্তিশালী সোশ্যাল এলিগরি তো বিশ্বসাহিত্যেই দুর্লভ। স্টিভেনসন লিখে প্রথমে তাঁর স্ত্রীকে পড়তে দেন। স্ত্রী আঁৎকে ওঠেন পড়ে। বলেন, লেখাটি নষ্ট করে ফেলতে, কারণ এটি মানুষ সহ্য করতে পারবে না। স্টিভেনসন বউয়ের কথা শুনে ছিঁড়ে ফেলেন পাণ্ডুলিপি। কয়েকবছর পর দ্বিতীয়বার লিখে প্রকাশ করেন। উপন্যাসটির প্রধানতম বিষয় হল মানুষের দ্বৈতস্বভাব বা ‘split personality’।
লাতিন আমেরিকার শক্তিশালী কথাশিল্পী হুয়ান রুলফোর একবসাতেই পড়ে ফেলার মতো উপন্যাস ‘পেদ্রো পারামো’; কিন্তু এর ইমপ্যাক্ট কয়েক হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাসের সমান। ম্যাজিক রিয়েলিজম দীক্ষার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত কাজ আর হয় না। যে কারণে মার্কেস বলেছেন, ‘পেদ্রো পারামো’ পড়ার কারণেই তিনি ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’ লিখতে পেরেছেন। এই শতকের শুরুর দিকে উরুগুয়ের নামকরা দৈনিক El País ভোটিং পল খুলে দেশটির লেখক ও সমালোচকদের কাছে জানতে চায়, লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস কোনটি? দৃশ্যত ব্যবধানে প্রধান উপন্যাস হিসেবে উঠে আসে মেক্সিকোর হুয়ান রুলফো(১৯-১৭-১৯৮৬)-এর ‘পেদ্রো পারামো’র নাম। এই ক্ষীণকায় উপন্যাসটিকে হোর্হে লুই বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬) বলেছিলেন এটি লাতিন আমেরিকা তো বটেই গোটা বিশ্বেরই উল্লেখযোগ্য গুটিকতক ভালো কাজের একটি। এই উপন্যাসে অলীক এবং বাস্তবতা এমনভাবে মিশে গেল যে তা আর আলাদা করে চিহ্নিত করার অবস্থায় রইল না। রুলফো কমলা নামের যে গ্রামের কথা বললেন সেটি মৃতদের গ্রাম। মৃতমানুষের কণ্ঠস্বর বাসাতে ভেসে বেড়াচ্ছে। হুয়ান প্রিসিয়াদো মা মারা যাওয়ার পর মায়ের কথাগুলো বাবার সন্ধানে কমলা গ্রামে এসেছে। লোকজন সেখানে আছে বটে কিন্তু তারা কেউ স্বাভাবিক মানুষ না। সবকিছু এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন সেটা ভিন্ন একটা জগত—স্মৃতির অন্য একটা স্তর। গ্রামটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘sits on the coals of the earth, at the very mouth of hell।’ হুয়ান গ্রামে এসে জানতে পারে তার বাবা পেদ্রো পারামো অনেক আগেই মারা গেছে। হুয়ান মানুষের কণ্ঠস্বর ও বাতাসে শব্দ শুনতে পেয়ে গ্রামটি এখনো জীবিত আছে বলে মনে করে। সে মনে করে তার মা তাকে কথা দিয়েছিল, এই গ্রামে আসলে সে তার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে। রুলফো এক বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেই। বৃদ্ধা দেখা মাত্রই হুয়ানকে চিনতে পারে। তারা ভ্রমণের উপলক্ষ সম্পর্কেও সে পূর্বাগত। বৃদ্ধা জানায় মারা যাওয়ায় সময় হুয়ানের মা সব বলে গেছে। অথচ তার মা মারা গেছে দূরবর্তী কোনো স্থানে। এভাবে উপন্যাসের গল্প যতই এগোই তত রহস্য তৈরি হয়।
উপন্যাসটি ১৯৫৫ সালে লেখা হলেও উত্তরাধুনিক উপন্যাসের নানা উপকরণ বা রচনাকৌশল বিদ্যমান। উপন্যাসের প্রথম দিকে ন্যারেটর থাকে হুয়ান প্রিসিয়াদো নিজেই। দ্রুতই গল্পকথকের ভূমিকায় অন্য একজন চলে আসে। মাঝে মাঝেই হুয়ানের মৃত-মা বর্ণনাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ন্যারেশনে এই গ-গল থাকার কারণে উপন্যাসের সময়টা ঠিকমতো ধরা যায় না। এটি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের নানা মুহূর্ত চষে বেড়ায়। কোনো কোনো সমালোচক কমলা গ্রামকে নরকের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ক্লাসিক মহাকাব্যে যেমন একজন গাইড এসে মূলচরিত্রকে নরকের পথ চিনিয়ে দেয়, এখানেও তেমন আবানদিও চরিত্রটি হুয়ানকে কমলা গ্রামে পৌঁছে দেয়। আরো অনেক ইন্টারপ্রেটেশন এই উপন্যাসের আছে।
প্রভাবশালী বই হিসেবে এইচ জি ওয়েলসের সায়েন্স ফিকশন ‘দ্য টাইম মেশিন’ এই তালিকায় আসবে। ১৮৯৫ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে টাইম ট্রাভেলের কনসেপ্টে আরো অনেক বই লেখা হয়েছে, মুভিও হয়েছে প্রচুর। বলা হয় জোনাথন সুইফট এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তাঁর মাস্টারপিস ‘গ্যালিভার ট্রাভেলস’ রচনা করেন।
হেমিংওয়ের নোবেল জয়ের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তার সবচেয়ে ছোট উপন্যাস ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী। এর আগেই হেমিংওয়ে অপেক্ষাকৃত বড় পরিসরের উপন্যাস ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’, ‘ফর হুম দ্য বেল টলস’, ‘ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ লিখে ফেলেন। তবে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত ও পঠিত হয় তার এই ১২৮ পৃষ্ঠার ক্ষুদে মাস্টারপিসটি। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হল, এর দুবছর পর ১৯৫৪ সালে নোবেল পেলেন হেমিংওয়ে।
‘দ্য ইডিয়ট’, ‘ব্রাদার কারামাজব’, ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর মতো ঢাউস সাইজের উপন্যাস লিখে পৃথিবীসেরা কথাসাহিত্যিকদের একজন হয়ে ওঠা দস্তইয়েভস্কি লেখেন ক্ষুদে উপন্যাস ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’। তখন তিনি নির্বাসনে। এই সামান্য উপন্যাসে আধুনিক হয়ে ওঠা রাশিয়াকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
মাদাম বোভারির মতো ঢাউস উপন্যাস লিখে বিশ্বখ্যাত হওয়া আরেক কথাসাহিত্যিক গুস্তাভ ফ্লবেয়ার ক্ষুদে উপন্যাস ‘নভেম্বর’ দিয়ে লেখকজীবন শুরু করেন। পেপারব্যাকে ১১২ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির সাম্প্রতিক এডিশনের মুখবন্ধে কথাসাহিত্যিক নাদিন গর্ডিমার লিখেছেন, An intense, passionate, and profoundly moving work, Flaubert's November explores the notions of desire and longing to most remarkable effect.
এই তালিকায় আমি আমার পাঠ থেকে আরো রাখতে চাই, জোসেফ কনরাডের ‘দ্য হার্ট অব ডার্কনেস’, আন্দ্রে জিদের ‘স্ট্রেইট ইজ দ্য গেইট’, অস্কার ওয়াইল্ডের ‘দ্য পিকচার অব ডরিয়ান গ্রে’, টমাস মানের ‘ডেথ ইন ভেনিস’, সিদ্ধার্থ

Recommended names of the category:
Of Mice and Men by John Steinbeck
Mrs Dalloway by Virginia Woolf
Frankenstein Mary Shelley
We Have Always Lived in the Castle by Shirley Jackson
Chronicle of a Death Foretold by Gabriel García Márquez
The Fifth Child by Doris Lessing

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ