দীপেন ভট্টাচার্য
একটি গল্প পাঠের মধ্যে দিয়ে লেখক ও পাঠকের এক ধরণের নির্বাক যোগাযোগ স্থাপন হয়। এই সেতুবন্ধনে পাঠকের ভূমিকা স্থবির নয়, বরং ডাইনামিক - লেখকের চিন্তা, বোধ, উদ্দেশ্যকে আত্মস্থ করতে পাঠক নিজস্ব এক সৃষ্টিশীলতার আশ্রয় নেন। পাঠকের এই সৃজন শক্তির প্রতি আস্থা লেখককে করে তোলে প্রাজ্ঞ, তাঁর লেখাকে করে তোলে মূল্যবান। রুমা মোদক এমনই এক লেখক যিনি পাঠকের এই অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করেন। তাই তাঁর প্রতিটি গল্পের পুনঃপাঠের প্রয়োজন, কারণ প্রথম পাঠে বেশ কিছু কার্যকারণ হয়তো পাঠকের গোচরের বাইরে থাকে। সাত বোন চম্পা এরকমই একটি গল্প যেটির গঠন-শৈলী ও নকশাকে এমন একটি ভাষা (ডায়ালোগ অর্থে নয়) দিয়ে উপস্থাপনা করা হয়েছে যে সেটি পাঠককে চিন্তায় ভাসাবে।
গল্পটির পাটাতন হল অসহায় এক নারী হাজেরার কাহিনী যে কিনা শত অসহায়ত্বের মধ্যেও তাঁর ছটি মেয়েকে আগলে রাখতে চাইছে। স্বামী মিয়াধন তাকে ঘরে তোলে নি, রেখে দিয়েছে বাজারে এক বেতের বেড়ার ঘরে, হয়তো কোনোদিন ছেলে হলে বাড়িতে নিয়ে যাবে। মিয়াধনের এককালের লাঠিয়াল বা খুনী অতীত হাজেরাকে কিছুটা নিরাপত্তা দেয় এই বাজারের মধ্যে, কিন্তু বাজারি লোকজনের লালসা-চক্ষু থেকে তার মেয়েদের বাঁচাতে তার প্রাণান্ত। তবু বাজার কমিটির মনাই মিয়াকে সে এড়াতে পারে না, সে ছুতো-নাতায় ঘরে ঢুকে পড়ে । সেখানে তার চোখ খোঁজে হাজেরার বাড়ন্ত পনেরো/ষোলো বছরের বড় মেয়ে দুটোকে - তারা যেন ‘ঈগলের চোখের সামনে ইঁদুর ছানা’ । তাদেরকে রক্ষা করতেই হাজেরা নিজেকে সমর্পণ করে মনাই মিয়ার কাছে। হাজেরার বয়স বেশী নয়, এই প্রতিকল্পিত যৌনতায় মনাই মিয়ার আপত্তি নেই। এর বহুমাত্রিক পরিণামের একটি মাত্রা পাঠক হয়তো অনুমান করতে পারেন, কিন্তু লেখক সেই পরিণামের অন্যান্য মাত্রা এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যা কিনা আমাদেরকে এক ধরণের বিভীষিকায় হিমশীতল করে দিতে পারে। আর সেটাই এই গল্পের সার্থকতা।
হাজেরার প্রথম মেয়েটি বিবাহের পূর্বেই গর্ভে এসেছিল বলে শাশুড়ী তাঁকে ঘরে উঠতে দেয় নি। এর পর আরো পাঁচটি মেয়ে হয়েছে। সপ্তম জন ছেলে হলে মিয়াধন তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাবে কিনা, শাশুড়ী ঘরে উঠতে দেবে কিনা ভাবে হাজেরা। এর মাঝেই এই গল্পের মধ্যে একটি মেয়ে চরিত্রের আবির্ভাব হয়। মেয়েটিকে লক্ষ্মীমন্ত চেহারার বলছেন লেখক, কিন্তু অন্য কোনো পরিচয় দিচ্ছেন না, তার বয়স বলছেন না। অথচ সেই লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে এই সংসারের সব জানে, আমরা তাই দেখে বিস্মিত হই। হাজেরার প্রতি তার দরদ অফুরন্ত, কিন্তু হাজেরা সেটা নিতে পারে না (কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?)।
এর মধ্যে হাজেরা আবার গর্ভবতী হয়েছে। সেই গর্ভের পিতা তার স্বামী মিয়াধন হতে পারে কারণ মিয়াধন বাজার বাড়িতে না থাকলেও হাজেরার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল এমন একটি ইঙ্গিত লেখক দিয়ে রেখেছিলেন। লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে হাজেরার গর্ভবান স্ফীত বাড়ন্ত পেট দেখে বলে, “আবার পেড বান্ধাইছ?” …. “হাজেরা বিবি ঠোঁট উল্টায় বিব্রত বিরক্তে- ‘দেহস না? এই নিয়া সাতবার...।’ মেয়েটা মুখের কথা কেড়ে নেয়— ‘সাতবার না গ, সাতবার না, আটবার।’…” এই আটবার কথাটির মধ্যে যে রহস্য তা কাহিনীর একদম শেষে গিয়ে উন্মোচিত হয়। কিন্তু রুমা মোদক পরিণত লেখক, তিনি জট আলগা করে দিয়েছেন, কিন্তু পুরো জটটি ছাড়াতে পাঠককে আর এক ধাপ এগুতে হবে। একদম শেষে যেয়েও নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে। কে এই লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে? সে কেন আটবার গর্ভ ধারণের কথা বলছে?
অবশেষে হাজেরার সপ্তম সন্তানটি হল একটি ছেলে। প্রতিবেশী জয়তুন বিবি সাত ভাই চম্পার কাহিনী শোনান। কিন্তু দক্ষিণারঞ্জন রায়ের ঠাকুরমার ঝুলিতে সাতটি ভাই হয়েছিল চাঁপা (বা চম্পা) ও একটি বোন হয়েছিল পারুল ফুল। এই কাহিনীতে হল ছটি পারুল ও তারপর একটি চাঁপা। কিন্তু শেষে যে চম্পা শিশুটি হল সে যেন কাউকে স্বস্তি দিল না। মনাই মিয়া হাজেরার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, ‘ছেলের চোখগুলো যে তার মতো বিড়াল-কটা এটা সে আপাতত কাউকেই বলবে না।’ মনাই মিয়া আমাদের সমাজের প্রতিভূ, তার মাঝে কোনো বিবেক নেই, অন্যায় বোধ নেই। সে চায় হাজেরার কিশোরী মেয়েদের দেহ-সঙ্গ, কিন্তু হাজেরার সঙ্গে যৌন আচরণে তার আপত্তি নেই। তার নিজের ঔরসজাত পুত্রের প্রতি তার কোনো পিতৃত্বের মমতা নেই, বরং সেই পুত্রকে বন্ধক রেখে হাজেরাকে ব্ল্যাকমেল করে। যে পুত্র হাজেরার জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারত, সেই পুত্র হাজেরাকে কোনো শান্তিই দিল না। ভাগ্যের এই পরিহাস পাঠককে বিচলিত করে। এই সময়ে আবির্ভাব হয় আবার আমাদের লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের। সে এক পোটলা লবণ হাতে গুঁজে দেয় হাজেরার হাতে, বলে, “একবার আমার মুখঅ দিয়ো নিজেরে বাঁচাইছিলা, ইবার পোলার মুখঅ দিয়া বাকী মাইয়াগুলারে বাঁচাও।” শুধুমাত্র তখনই, এই গল্পের শেষে, আমরা লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের অশরীরী উপস্থিতিতে শিউরে উঠি, তার রহস্য উন্মোচিত হয় আমাদের কাছে। আমরা বলি এতক্ষণ কেন এটা বুঝি নি।
এই যে বিড়াল-কটা চোখের পুত্র সন্তানের irony, এই যে লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের mystery - - সেটি সৃষ্টি করতে লেখককে ভাবতে হয়েছে, কিন্তু এই সৃষ্টির নকশাটি তিনি শূন্য বুনন করেন নি, করেছেন সমাজে একটি নারীর অসহায়ত্বের কাঠামোতে। যে সমাজে সেই নারীকে তার স্বামী পরিত্যাগ করেও আবার বছর বছর সন্তান সৃষ্টি করতে পারে। এই সমাজে তার স্ত্রী ও ছটি কন্যাকে বাজারে শত পুরুষের লালায়িত কামনার চোখ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সেই স্বামীর কোনই দায়িত্ব নেই। অন্যদিকে তার স্ত্রীর যদি অন্যের ঔরসে সন্তান হয় সেখানে স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ নেয়া যেন তার ন্যায্য অধিকার। ঘুনে-ধরা বস্তাপচা সমাজ থেকে এটাই আশা করা যায়। তাই আমাদের প্রটাগনিস্ট হাজেরা, যে কিনা শত লড়াই করে তার সন্তানদের রক্ষা করছে, এমন কি নিজের দেহ বিসর্জন দিয়েও, তার আত্মত্যাগ কারুর কাছে কিছু না, এমন কি নারীদের কাছেও নয়। তাই হাজেরা যখন ‘সাঁতরে মাঝনদীতে গিয়ে আর ফিরে আসবার দম পায় না’ তখন আমাদেরও, পাঠকদেরও, দম যেন ফুরিয়ে যায়। আমরা ভাবি এই আমাদের নিয়তি, যে নিয়তি আমাদের এই সমাজ সৃষ্টি করেছে, যে নিয়তিতে হাজেরার কোনো মুক্তি নেই, মাঝনদীতে যার সলিল সমাধি নিশ্চিত।
একটি ভাল গল্পের নানাবিধ প্রভাব থাকে। রুমা মোদকের গল্পটি পড়ে আমি সাত ভাই চম্পার মূল গল্পটি স্মরণ করার চেষ্টা করি, একই সাথে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া (কার লেখা? সলিল চৌধুরির?) গানটির কথা মনে করি। সেই গানটির শেষ প্যারা হল --
আর রাজবাড়ি সাত রানী মায়ের ঘরে
ফিরে যাব না যাব না যাব না রে।
ঘরে ক্ষুধার জ্বালা, পথে যৌবন জ্বালা
রাজার কুমার আর আসে না ঘোড়ায় চড়ে।।
হাজেরার বয়স বেশী হয় নি, ত্রিশের কোঠায়। কিন্তু তার জন্য কোনো রাজার কুমার ঘোড়ায় চড়ে আসবে না। তার ঘরে ক্ষুধার জ্বালা যেমন আছে, যৌবন জ্বালাও তেমনভাবে বর্তমান। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রথমটিতে দয়া করে দুটো অন্ন দান করলেও (যেমন হাজেরার স্বামী মিয়াধন করত), দ্বিতীয়টির জন্য তার কোনো ক্ষমা নেই।
রুমা মোদকের কলম এবং কম্পুটার বাংলার সমাজের সমস্ত শ্রেণীর সূক্ষ্ণ টানা-পোড়েন এবং তাদের মাঝে বিদ্যমান অন্যায় ও আশা বর্ণনা করে ডকুমেনটারি ফিল্মের মত করে নয় (যেটা অনেক গল্পকার নিজের অজান্তেই করে থাকেন); তাঁর গল্প মোড়া থাকে এক রহস্যের আবরণে যার denouement (ডেনুমাঁ) বা জট-ছাড়ানোর জন্য পাঠককে শেষ লাইন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আর সেই লাইনটি গল্পটিকে আবার নতুন করে দেখায়। পাঠক তাঁর গল্পের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ইন্টারেস্টিং মাত্রাও উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্ত তাঁর শক্তিশালী যবনিকা পাঠককে ভাবাবে, মূহ্যমান করবে। আমার কাছে রুমা মোদকের গল্পের বলিষ্ঠতা সেখানেই।
----------
মূল গল্পটি
রুমা মোদকের সাত ভাই চম্পা
একটি গল্প পাঠের মধ্যে দিয়ে লেখক ও পাঠকের এক ধরণের নির্বাক যোগাযোগ স্থাপন হয়। এই সেতুবন্ধনে পাঠকের ভূমিকা স্থবির নয়, বরং ডাইনামিক - লেখকের চিন্তা, বোধ, উদ্দেশ্যকে আত্মস্থ করতে পাঠক নিজস্ব এক সৃষ্টিশীলতার আশ্রয় নেন। পাঠকের এই সৃজন শক্তির প্রতি আস্থা লেখককে করে তোলে প্রাজ্ঞ, তাঁর লেখাকে করে তোলে মূল্যবান। রুমা মোদক এমনই এক লেখক যিনি পাঠকের এই অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করেন। তাই তাঁর প্রতিটি গল্পের পুনঃপাঠের প্রয়োজন, কারণ প্রথম পাঠে বেশ কিছু কার্যকারণ হয়তো পাঠকের গোচরের বাইরে থাকে। সাত বোন চম্পা এরকমই একটি গল্প যেটির গঠন-শৈলী ও নকশাকে এমন একটি ভাষা (ডায়ালোগ অর্থে নয়) দিয়ে উপস্থাপনা করা হয়েছে যে সেটি পাঠককে চিন্তায় ভাসাবে।
গল্পটির পাটাতন হল অসহায় এক নারী হাজেরার কাহিনী যে কিনা শত অসহায়ত্বের মধ্যেও তাঁর ছটি মেয়েকে আগলে রাখতে চাইছে। স্বামী মিয়াধন তাকে ঘরে তোলে নি, রেখে দিয়েছে বাজারে এক বেতের বেড়ার ঘরে, হয়তো কোনোদিন ছেলে হলে বাড়িতে নিয়ে যাবে। মিয়াধনের এককালের লাঠিয়াল বা খুনী অতীত হাজেরাকে কিছুটা নিরাপত্তা দেয় এই বাজারের মধ্যে, কিন্তু বাজারি লোকজনের লালসা-চক্ষু থেকে তার মেয়েদের বাঁচাতে তার প্রাণান্ত। তবু বাজার কমিটির মনাই মিয়াকে সে এড়াতে পারে না, সে ছুতো-নাতায় ঘরে ঢুকে পড়ে । সেখানে তার চোখ খোঁজে হাজেরার বাড়ন্ত পনেরো/ষোলো বছরের বড় মেয়ে দুটোকে - তারা যেন ‘ঈগলের চোখের সামনে ইঁদুর ছানা’ । তাদেরকে রক্ষা করতেই হাজেরা নিজেকে সমর্পণ করে মনাই মিয়ার কাছে। হাজেরার বয়স বেশী নয়, এই প্রতিকল্পিত যৌনতায় মনাই মিয়ার আপত্তি নেই। এর বহুমাত্রিক পরিণামের একটি মাত্রা পাঠক হয়তো অনুমান করতে পারেন, কিন্তু লেখক সেই পরিণামের অন্যান্য মাত্রা এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যা কিনা আমাদেরকে এক ধরণের বিভীষিকায় হিমশীতল করে দিতে পারে। আর সেটাই এই গল্পের সার্থকতা।
হাজেরার প্রথম মেয়েটি বিবাহের পূর্বেই গর্ভে এসেছিল বলে শাশুড়ী তাঁকে ঘরে উঠতে দেয় নি। এর পর আরো পাঁচটি মেয়ে হয়েছে। সপ্তম জন ছেলে হলে মিয়াধন তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাবে কিনা, শাশুড়ী ঘরে উঠতে দেবে কিনা ভাবে হাজেরা। এর মাঝেই এই গল্পের মধ্যে একটি মেয়ে চরিত্রের আবির্ভাব হয়। মেয়েটিকে লক্ষ্মীমন্ত চেহারার বলছেন লেখক, কিন্তু অন্য কোনো পরিচয় দিচ্ছেন না, তার বয়স বলছেন না। অথচ সেই লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে এই সংসারের সব জানে, আমরা তাই দেখে বিস্মিত হই। হাজেরার প্রতি তার দরদ অফুরন্ত, কিন্তু হাজেরা সেটা নিতে পারে না (কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?)।
এর মধ্যে হাজেরা আবার গর্ভবতী হয়েছে। সেই গর্ভের পিতা তার স্বামী মিয়াধন হতে পারে কারণ মিয়াধন বাজার বাড়িতে না থাকলেও হাজেরার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল এমন একটি ইঙ্গিত লেখক দিয়ে রেখেছিলেন। লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে হাজেরার গর্ভবান স্ফীত বাড়ন্ত পেট দেখে বলে, “আবার পেড বান্ধাইছ?” …. “হাজেরা বিবি ঠোঁট উল্টায় বিব্রত বিরক্তে- ‘দেহস না? এই নিয়া সাতবার...।’ মেয়েটা মুখের কথা কেড়ে নেয়— ‘সাতবার না গ, সাতবার না, আটবার।’…” এই আটবার কথাটির মধ্যে যে রহস্য তা কাহিনীর একদম শেষে গিয়ে উন্মোচিত হয়। কিন্তু রুমা মোদক পরিণত লেখক, তিনি জট আলগা করে দিয়েছেন, কিন্তু পুরো জটটি ছাড়াতে পাঠককে আর এক ধাপ এগুতে হবে। একদম শেষে যেয়েও নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে। কে এই লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে? সে কেন আটবার গর্ভ ধারণের কথা বলছে?
অবশেষে হাজেরার সপ্তম সন্তানটি হল একটি ছেলে। প্রতিবেশী জয়তুন বিবি সাত ভাই চম্পার কাহিনী শোনান। কিন্তু দক্ষিণারঞ্জন রায়ের ঠাকুরমার ঝুলিতে সাতটি ভাই হয়েছিল চাঁপা (বা চম্পা) ও একটি বোন হয়েছিল পারুল ফুল। এই কাহিনীতে হল ছটি পারুল ও তারপর একটি চাঁপা। কিন্তু শেষে যে চম্পা শিশুটি হল সে যেন কাউকে স্বস্তি দিল না। মনাই মিয়া হাজেরার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, ‘ছেলের চোখগুলো যে তার মতো বিড়াল-কটা এটা সে আপাতত কাউকেই বলবে না।’ মনাই মিয়া আমাদের সমাজের প্রতিভূ, তার মাঝে কোনো বিবেক নেই, অন্যায় বোধ নেই। সে চায় হাজেরার কিশোরী মেয়েদের দেহ-সঙ্গ, কিন্তু হাজেরার সঙ্গে যৌন আচরণে তার আপত্তি নেই। তার নিজের ঔরসজাত পুত্রের প্রতি তার কোনো পিতৃত্বের মমতা নেই, বরং সেই পুত্রকে বন্ধক রেখে হাজেরাকে ব্ল্যাকমেল করে। যে পুত্র হাজেরার জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারত, সেই পুত্র হাজেরাকে কোনো শান্তিই দিল না। ভাগ্যের এই পরিহাস পাঠককে বিচলিত করে। এই সময়ে আবির্ভাব হয় আবার আমাদের লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের। সে এক পোটলা লবণ হাতে গুঁজে দেয় হাজেরার হাতে, বলে, “একবার আমার মুখঅ দিয়ো নিজেরে বাঁচাইছিলা, ইবার পোলার মুখঅ দিয়া বাকী মাইয়াগুলারে বাঁচাও।” শুধুমাত্র তখনই, এই গল্পের শেষে, আমরা লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের অশরীরী উপস্থিতিতে শিউরে উঠি, তার রহস্য উন্মোচিত হয় আমাদের কাছে। আমরা বলি এতক্ষণ কেন এটা বুঝি নি।
এই যে বিড়াল-কটা চোখের পুত্র সন্তানের irony, এই যে লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের mystery - - সেটি সৃষ্টি করতে লেখককে ভাবতে হয়েছে, কিন্তু এই সৃষ্টির নকশাটি তিনি শূন্য বুনন করেন নি, করেছেন সমাজে একটি নারীর অসহায়ত্বের কাঠামোতে। যে সমাজে সেই নারীকে তার স্বামী পরিত্যাগ করেও আবার বছর বছর সন্তান সৃষ্টি করতে পারে। এই সমাজে তার স্ত্রী ও ছটি কন্যাকে বাজারে শত পুরুষের লালায়িত কামনার চোখ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সেই স্বামীর কোনই দায়িত্ব নেই। অন্যদিকে তার স্ত্রীর যদি অন্যের ঔরসে সন্তান হয় সেখানে স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ নেয়া যেন তার ন্যায্য অধিকার। ঘুনে-ধরা বস্তাপচা সমাজ থেকে এটাই আশা করা যায়। তাই আমাদের প্রটাগনিস্ট হাজেরা, যে কিনা শত লড়াই করে তার সন্তানদের রক্ষা করছে, এমন কি নিজের দেহ বিসর্জন দিয়েও, তার আত্মত্যাগ কারুর কাছে কিছু না, এমন কি নারীদের কাছেও নয়। তাই হাজেরা যখন ‘সাঁতরে মাঝনদীতে গিয়ে আর ফিরে আসবার দম পায় না’ তখন আমাদেরও, পাঠকদেরও, দম যেন ফুরিয়ে যায়। আমরা ভাবি এই আমাদের নিয়তি, যে নিয়তি আমাদের এই সমাজ সৃষ্টি করেছে, যে নিয়তিতে হাজেরার কোনো মুক্তি নেই, মাঝনদীতে যার সলিল সমাধি নিশ্চিত।
একটি ভাল গল্পের নানাবিধ প্রভাব থাকে। রুমা মোদকের গল্পটি পড়ে আমি সাত ভাই চম্পার মূল গল্পটি স্মরণ করার চেষ্টা করি, একই সাথে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া (কার লেখা? সলিল চৌধুরির?) গানটির কথা মনে করি। সেই গানটির শেষ প্যারা হল --
আর রাজবাড়ি সাত রানী মায়ের ঘরে
ফিরে যাব না যাব না যাব না রে।
ঘরে ক্ষুধার জ্বালা, পথে যৌবন জ্বালা
রাজার কুমার আর আসে না ঘোড়ায় চড়ে।।
হাজেরার বয়স বেশী হয় নি, ত্রিশের কোঠায়। কিন্তু তার জন্য কোনো রাজার কুমার ঘোড়ায় চড়ে আসবে না। তার ঘরে ক্ষুধার জ্বালা যেমন আছে, যৌবন জ্বালাও তেমনভাবে বর্তমান। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রথমটিতে দয়া করে দুটো অন্ন দান করলেও (যেমন হাজেরার স্বামী মিয়াধন করত), দ্বিতীয়টির জন্য তার কোনো ক্ষমা নেই।
রুমা মোদকের কলম এবং কম্পুটার বাংলার সমাজের সমস্ত শ্রেণীর সূক্ষ্ণ টানা-পোড়েন এবং তাদের মাঝে বিদ্যমান অন্যায় ও আশা বর্ণনা করে ডকুমেনটারি ফিল্মের মত করে নয় (যেটা অনেক গল্পকার নিজের অজান্তেই করে থাকেন); তাঁর গল্প মোড়া থাকে এক রহস্যের আবরণে যার denouement (ডেনুমাঁ) বা জট-ছাড়ানোর জন্য পাঠককে শেষ লাইন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আর সেই লাইনটি গল্পটিকে আবার নতুন করে দেখায়। পাঠক তাঁর গল্পের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ইন্টারেস্টিং মাত্রাও উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্ত তাঁর শক্তিশালী যবনিকা পাঠককে ভাবাবে, মূহ্যমান করবে। আমার কাছে রুমা মোদকের গল্পের বলিষ্ঠতা সেখানেই।
----------
মূল গল্পটি
রুমা মোদকের সাত ভাই চম্পা
1 মন্তব্যসমূহ
ei site oonek rich ...wishing its prosperity / immortality ...
উত্তরমুছুন