মা-মেয়ের সংসারঃ জীবন মৃত্যুর যুগল ধ্রুপদী নৃত্য

পাঠপ্রতিক্রিয়া
ইশারাত তানিয়া


সগল্প যদি হয় আকাশ সদৃশ ক্যানভাস তবে সৃজন ও মননচিন্তায় তাঁকে বলি প্রবাদপ্রতিম চিত্রী। নির্মোহ তুলি বুলিয়ে তিনি এঁকে যান ঘটনা প্রবাহ। শোষিত, অধিকারবঞ্চিত মানুষ, ক্রোধ, হতাশা, ভালোবাসা, দেশভাগ, সামাজিক ক্ষত, ঐক্য-বিভেদ, শ্রেণি সংগ্রামে জীবনের সবটুকু তিনি রঙের পর রঙ বুলিয়ে স্পর্শ করতে চান। কোথাও ফিকে, কোথাও গাঢ়।


নির্দ্বিধায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যাঁর সম্পর্কে বলেছেন- “হাসান আজিজুল হক বাঙালির সাহিত্যসেবায় নিজেই একটি বনের পত্তন করলেন- যে বনের বৃক্ষগুলো তাঁর নিজের হাতেই বসানো। তিনি স্বয়ং একটি ধারার প্রবর্তক হিসেবে বাঙ্গালি পাঠকের কাছে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।” সামান্য যা কিছু পারিপার্শ্বিকতার তাঁর দৃষ্টিতে অসামান্য মাত্রায় অধিষ্ঠিত হয়। বাংলা সাহিত্যের অনন্য সাধারণ কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক এর ‘মা-মেয়ের সংসার’ গল্পটিতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি ধর্ষণ, অসহায়ত্ব, ভয়, নির্ভরতা এবং সমাজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন মা ও মেয়েকে। সৃষ্ট দুটো চরিত্র এক নিষ্ঠুর ব্যাঙ্গ ছুঁড়ে দেয়। পাঠকেরও দৃষ্টি সম্প্রসারিত হয়। মনে জাগায় বেদনা এবং অপরাধবোধ।

মা আর মেয়ে জলের কাছে থাকে। খাল পাড়ে। বাঘ, সাপ, শেয়াল আর বাঁদর তাদের পড়শী। গরান, সুন্দরী, পশর, ক্যাওড়া তাদের আত্মীয়। মা-মেয়ে ভাত খায়, জল পান করে। তাদের পেটে জল কলকল ছলছল শব্দ করে। কালো-নোনা কাদার ওপর মানুষরূপী শিয়াল খুবলে খায় প্রথমে মেয়েকে। তারপর ঘরের ভেতর মাকে। মেয়ে তেঁতুল আর টকটক তেঁতুল পাতা খায়। বাঁদরের দল এগুলো ছিঁড়ে নিচে ফেলে। মেয়ে উনুনের প্রায় সটুকু মাটি খেয়ে শেষ করে। মেয়ে কিছু বোঝে না। বলে- “অমা, পেটের মধ্যে কি জানি নড়তেছে।” মায়ের বিশাল পর্বতউঁচু গর্ভ। দেখে বোঝা যায় মায়ের পেটেও খোকা এসেছে। জীবনের অনুবাদ এভাবেই করে যান হাসান আজিজুল হক। গল্প এগিয়ে যায় প্রান্তিক মা-মেয়ের কেউ নেই। তাদের দুজনের আছে শুধু দুজন। আল্লাহ নেই, আজরাইল নেই, বেহেশত-দোজখ নেই। দুজনের পেটের ভেতর দানো বাড়তে থাকে। উপোসী মা-মেয়ে দুজনে দুজনের তলপেটে হাত দিয়ে শুয়ে থাকে। দুটি দানো তাদের হাতের মধ্যে খেলা করে, খুদে পায়ে লাথি মারে, কখনো মাথা দিয়ে গোঁত্তা দেয়, চিমটি কাটে, খামচা মারে। এক সকালে গাঁয়ের কিছু লোক এসে জেনা করার দায়ে মা-মেয়েকে অভিযুক্ত করে। সমাজচ্যুত করার হুমকি দেয়। স্ফীতোদর ইঙ্গিত করে অশ্রাব্য বললে মা প্রতিবাদ করে। মা-মেয়ের অত গরজ কই সমাজে থাকার? তাদের আছে খাল পাড়ের জঙ্গল। মা জং ধরা দা হাতে তুলে নেয়।

মেয়ে ধামা পেট নিয়ে খাল পার হয়ে জঙ্গলে যায়- হাঁটু পর্যন্ত শাড়ী বাগিয়ে ধরে- শুলোর ফাঁকে ফাঁকে কাদায় পায়ের পাতা ডুবিয়ে ঘুরে বেড়ায়- বাঘ বাঘিনীর খোঁজে। যদি তাকে বাঘ গিলে খায় সে মরে বাঁচে। একদিন মেয়ে দেখতে পায় মায়ের পাশে রক্ত আর জলের মধ্যে একটা খোকা শুয়ে আছে। মৃত। জ্যোৎস্নার মধ্যে মেয়ে উঠে দাঁড়ায়, চাঁদে পাওয়া নিশির ঘোরে সে খোকাটাকে দুহাতের ওপর শুইয়ে একটু একটু দোলায়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে জ্যোৎস্নার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে আকাশপ্রমাণ মেয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। যতবার মেয়ে মাটি চাপা দেয়, খোকাটা হি-হি করে হাসতে হাসতে একবার হাত বের করে মাটির ওপরে, একবার পা বার করে- এক একবার ঢুঁ মেরে মাটি সরিয়ে মাথা বার করে চাঁদের দিকে চেয়ে ফিকফিকে হাসি হাসে। মেয়ে চোপ চোপ বলে তার হাত বা পা বা মাথা থাবড়ে-থুবড়ে মাটিতে ঢেকে দেয় আর এইসব নখরা চলতে চলতে সকাল হয়ে আসে। হাসানের গল্প এখানে পূর্ব নির্ধারিত নির্মাণ রীতির চৌহদ্দি পেরিয়ে যায়। শুধুমাত্র কাহিনী নির্ভর, বর্ণনাধর্মী নির্মাণ নয়। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকটকে সাহিত্যের প্রতিপাদ্য করে তাঁর সৃষ্টির বিষয় ও আঙ্গিক গল্পভাষা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ধারণ করে।

হাসান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রেখায় গল্পে জীবন এঁকে যান নৈসর্গিক পটে। ক্যানভাসে ছড়িয়ে দেন নিসর্গসম্ভার আর জীবনের অনুকণা। “দূরে বাঘ ডাকে, বাঘিনীকে খুঁজে পায়নি বোঝা যায়, চারপাশে কট কট করে ব্যাঙ ডাকে, পোকামাকড় শব্দ করে, ঝিঁঝিঁরা ডানা ঘষে। প্যাঁচা ডাকে, ফেউ ডাকে। চারিদিক থেকে এত শব্দ আসে, মা-মেয়ে অত শব্দের মধ্যে কালা হয়ে বসে থাকে।” জলঝড় বাঙময় হয়ে ওঠে। পাঠক বিশ্বাস করে- “এই বাতাসের কি শেষ নেই- মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মা ভাবে, এত বাতাস কোথা জমা আছে, শ্যাষ হয় না কেন! খালের জল আকূল হয়ে বাতাস ধরার জন্য ফুলে ওঠে; বাতাস আকাশ ঝেঁটিয়ে বেড়ায়, উল্টো ডিগবাজি খেয়ে জলকে জড়িয়ে ধরে। বলেশ্বরের লক্ষ লক্ষ ছোট ছোট ঢেউয়ের প্রত্যেকটিতে একটি করে চোখের মতো শাদা আলো জ্বলে। তারপর হঠাৎ বাতাস থেমে যায়।”

মেয়ে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে- আমাদের আল্লা নেই? মা দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দেয়- না, ওদের আছে, মওলানা মৌলবীগো, বড়লোক, ধনীগো আছে; মাতাল, বজ্জাত, জাউরা, পুরুষগো আছে, অগো সব আছে, তারপরে আবার আল্লাও আছে। বিকেল বেলায় ঘন কালো মেঘ করে আসে আকাশে। কি আশ্চর্য। এমন করে বাতাস থেমে যায় কেন? তার এত রোষের শোঁসানি আর শোনা যায় না। জলের শব্দ থামে, ঢেউয়ের শব্দ থামে। শুধু পাওয়া যায় বিপুল জলের সমুদ্রে নেমে যাওয়ার আওয়াজ। কালো মেঘ নিচে নেমে আসে। সন্ধের খানিকটা আগে কালো মেঘ, কালো জল আর কালো অরন্য একসঙ্গে মিশে যায়, তবু বাতাস থেমে থাকে। দূরে বাঘ ডাকে। সেই ডাক শুনে মা মেয়ে চমকে ওঠে। তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।” আকাশ থেকে বিক্ষুব্ধ জলসম্ভের মহা বিস্ফোরণ নুহের প্লাবন হয়ে ভাসিয়ে নিল বিশ্ব চরাচর। যেন এক গভীর প্রতিশোধ নিতে উন্মত্ত প্রকৃতি। সমস্ত পাপ, দুরাচার, অন্যায়, অন্যায়কারী ভাসিয়ে নিয়ে ক্লেদমুক্ত করে অবক্ষয়িত পৃথিবীকে। চার শিয়াল সদৃশ ধর্ষক ভেসে যায়। ভেসে যায় ডোরাকাটা বাঘও। মা-মেয়ে শান্তিতে ঘুমায়। মেয়ের খোকাটি অস্তিত্ব প্রকাশ করে কান্নার চিৎকারে। গল্প পূর্ণতায় পৌঁছে যায়।

হায়াৎ মামুদ নিবিড়ভাবে হাসানের গল্পবীক্ষা বিশ্লেষণ করে বলেছেন- “হাসান আজিজুল হক প্রায় এক ক্ষমাহীন বিশ্বকে উপস্থিত করেছেন।... গল্পের গঠনশৈলী সম্পর্কে উৎকেন্দ্রিক নন, কিন্তু অকল্পনীয় ক্ষুরধার। সরাসরি চলে যান কাহিনীর গভীরে। কোনো নান্দীপাঠ নেই, কোনো কবিতার বা বৈদগ্ধ্যের অনুষঙ্গ টেনে আনেন না; ভাবখানা এ-রকম যে, তাঁর ঐ গল্প ছাড়া পৃথিবীর সকল কিছুই আপাতত অপ্রয়োজনীয়। অতএব তিনি গল্পের চরিত্রাবলি নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, তাদের সংলাপ ও ক্রিয়াকাণ্ড গভীর বিশ্বাসে দক্ষ স্থপতির ন্যায় একে একে গ্রথিত করেন। কিন্তু আশ্চর্য! গল্প পাঠের পরেই স্পষ্ট হয়, কী ভয়ানক নিষ্ঠুর তিনি, মহান নাস্তিক। কোনো মূঢ় তাই, আমাদের কোনো অপরাধ, জীবনধারণের হাস্যকরতা দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না; পরম আদরে ও সম্মানে এদের সাজানো ঘরের সোফায় বসিয়ে তিনি নিষ্ঠুর বিদ্রুপ করে যাবেন।”

অতিকথন নয়। দলিত মানুষের হাহাকার-প্রতিবাদ, সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি, সামাজিক ক্ষত, শোষণ-অনাচার নিয়ে গড়ে ওঠে হাসানের গল্পজগৎ। ‘মা-মেয়ের সংসার’ গল্পে ভাষা, সংলাপ, লোকাচার, সৃষ্ট চরিত্র, পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে জীবনের ভেতর ঢুকে গেছেন তিনি। তাঁর গল্প চিরন্তনতা পায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে। পাঠক গভীরভাবে সেই দর্শনের তাৎপর্য অনুধাবন করে অথচ সাহিত্যের রস আস্বাদনে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না।

------------------------------------------------------------------------

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ