সেদিন বিকেল বেলায় যখন জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিলুম আমি, আর আঙুলের ডগায়, নখের কোণে শিকের জং ধরা রঙ ঢুকে গেছিল – আব্বা পেছন থেকে আমাকে একটা নরম পশমঅলা খেলনার বেড়াল দিয়ে বলেছিল, কী নাম দিবি তার, অ্যাঁ? এর পাঁচদিন পর তলপেটে তেঁতুল বিছের মত সেলাইয়ের দাগ নিয়ে সাইকেল ভ্যানে শুয়ে ঘরে ফিরেছিল মা। মা হাসপাতালে যাবার ক’দিন আগে থেকে খালা এ-বাড়িতে এসে সংসার সামলাচ্ছিল। সেই খালা এখন মাকে ধরে ধরে খাটে বসিয়ে মায়ের কোল থেকে কাঁথায় মোড়া পুঁটলিটাকে বিছানায় পাতা অয়েলক্লথের উপর শুইয়ে কাঁথাটাকে সরিয়েই বেফাঁস বলে ফেলে, ইস রাক্ষসী। আর কাঁথাটা সরাবার সাথে সাথে আমি সেই রাক্ষসীর নাভিতে লাল ওষুধের বৃত্ত দেখেছিলাম। আমি জানতাম, ঠিক সেইদিন থেকেই জেনে ফেলেছিলাম, এই খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মায়ের পাশে কাঁথায় মোড়া যে পুঁটলিটা নিস্তেজ অবস্থায় নেতিয়ে রয়েছে – আসলে সে মৃত্যু নয়; সে রাক্ষসী। কেননা ব্লাউজের হুক খুলে মা যখন দুধের বোঁটা ঢুকিয়ে দিত তার মুখে, কর্কের ছিপি খুলে লাল ওষুধ তুলোয় ভিজিয়ে তার নাভি ভিজিয়ে দিত – সে তখন দাঁতহীন মাড়ি বের করে মায়ের বুকের দুধ নয়, রক্ত চুষে খেত। একদিন গা ধোবার আগে মা সবে ব্লাউজ খুলে রেখেছে – আমি সেই ব্লাউজে পানির মত পাতলা দুধের ঘ্রান পেয়েছিলাম। মানুষের দুধ এত পাতলা হতে পারে কখনো? তবে মায়ের বুকে আর গরম রক্ত নেই? পানির মত পাতলা দুধ ঘুরপাক খাচ্ছে? তবে কি রাক্ষসী রক্ত সমেত মায়ের শরীর থেকে উদ্ভিদের মত সব রস টেনে নিচ্ছে? তাই হয়ত সেই ভেজা ব্লাউজ যখন আঙ্গুলে ঘষে ছিলাম, কই আঙুলটাতো চটচট করেনি। শুধু পানি লাগার মত বুড়ো আঙুলটা খানিক ভিজে থেকে আবার শুকিয়ে গেছিল!
অথচ রাক্ষসী নিজে থেকে কখনো আঘাত করেনি আমাদের। তবু আমি ঠিক টের পাচ্ছিলাম সবার নজরের বাইরে সে আমাদের জন্য একটা বলয় সৃষ্টি করেছে। সেই বলয়কে অতিক্রম করার সাধ্য এ সংসারের কারোর ছিল না।
দাদী মরে যাবার পর দাদাজী দখিন দিকের ঘরটায় একলাই থাকতেন। শুধু খাবার সময় হলে মা থালা বাটিতে তার জন্য আলাদা করে খাবার দিয়ে আসত। এতদিন খালাই এসব কাজ করছিল। এখন সে আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেছে। তাই মাকেই এসবের ভার নিতে হয়েছে।
সকালে চা দিতে গিয়েই মা টের পেয়েছিল দাদাজীর বুক থেকে কেরম ঘরঘর শব্দ বেরুচ্ছে। দাদাজী খাটের উপর দুটো মাথার বালিশ কোলে চেপে ঘাড় নীচু করে বসে আছেন। মা ঘরে ঢুকতেই তিনি একবার মায়ের দিকে তাকান। তারপর আবার সেই ভাবেই ঘাড় নিচু করে বলেন, মুই কী এত গোনা করিচি মা যে আল্লা এত কষ্ট দিচ্ছে?
মা দাদাজীর পাশে গিয়ে বসলে দাদাজীর বুক থেকে আবার ঘরঘর শব্দ পায়। তবে দাদাজীর জাকামদানি শুরু হয়েছে? মা দাদাজীর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। যেন জাকামদানির সময় এতটুকু আদর সকলের পাওনা – দাদাজী তাই আর বিচলিত হন না। মা আব্বাকে ডাকতে উঠলে তিনি আবার বলেন, মগরেব বাদ সময় হইছে মা। তোমরা জোহর বাদ মোকে উঠোনে নিয়ে যেও।
জোহর বাদ, তখন গনগনে রোদ, দাদাজীকে উঠোনে শোয়ানো হল। খাটিয়ার উপর শুয়ে শুয়ে তিনি কীসব বলেন। কখনো বলতে বলতে আচমকা থেমে যান। থেমে গেলে মুরুব্বিরা তার নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখেন নিঃশ্বাস বইছে কি না। কিছু বুঝবার আগে তিনি আবার বিড়বিড় করে বলেন, কী হাট বসত এখেনে। আর মাঠে ঘাটে পানি তমতম করত। কে গা তোমার গয়নাটা আলমারিতে থুয়ে দিলে? তোমায় রামচন্দ্র বসাক্বের নৌবহর দেখাব আর তুমি ...
- আর কী আব্বাজী? মা পাশ থেকে জানতে চায়।
- আর...কিছু বলবে বলে দাদাজী মায়ের দিকে তাকান। কিন্তু মাকে কিছু বলেন না।
- নিজের মনেই যেন গোপনে বলতে থাকেন, তিনদিন তিনরাত উনি গয়না থুয়ে দিলে আলমারিতে। হ্যাগা, রামচন্দ্র বসাকের নৌবহর দ্যাকবা না? শরীলখানা এমন খা খা করলি কী আর তানার নৌবহর দেখা যায়! শরীলের দিকে যে আর তাকাতি পারিনে গো। মাঠঘাট কেমন তমতম করতেছে পানিতে। কদিন টানা পানি হল গা?
দাদাজী সকলের সামনে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন। আব্বার উত্তর করতে গেলে মুরুব্বিরা তাকে থামিয়ে দেয়। যেন মরবার আগে এরম বিড়বিড় করা খুবই স্বাভাবিক। কেউ কোন উত্তর করলো না দেখে দাদাজী আবার শুরু করেন, দুদিন ধরি টানা পানি হচ্ছে। যেন আল্লার আসমান কেউ ছেনি হাতুড়ি দে ফুটো করে দেছে। খালি পানি আর পানি। হ্যাগা, তাবলে কী আর হাটবারে হাট বসবে না? তখন কী যে হাট বসত ইলাকায়। মহাজন ব্যাপারীদের ভিড় লেগে যেত বটে। মোর মালিক ছ্যালো গোবিন্দপুরের এলেমঅলা মহাজন রামচন্দ্র বসাক। খাটো ধুতি পিদে, গায়ে একখানা ফতুয়া আর মাথায় গোলপাতার একখানি ছাতি নিয়েই ঘুরত। কিন্তু মানুষ ছিল বড় ধনবান। সেদিন হল কী... এই পর্যন্ত বলে দাদাজী চুপ মেরে থাকেন। দম নেন। মুরুব্বিরা চামচে করে তার গালে জমজমের পানি দিতে যান। তিনি জিভ দিয়ে সেটুকু চুকচুক করে খেয়ে নিয়ে আবার শুরু করেন, কিন্তু জোহর বাদ মুই নামাজ পড়ে সবে এসিচি হাটে, ও বাবা, দেখি সে কী হুলস্থুল কান্ড। শোনা গেল ঘাটের দিকে পরদেশী এক নৌবহর এগিয়ে আসতেছে। সওদাগররা নোঙর তুলে নৌকা নে পালাবার লেগি ব্যাস্ত হয়ে উঠেচে...সকলেই ভীত। ভয় বুঝিবা বোম্বেটের দল এগিয়ে আসতেছে। নিশ্চয় হাট লুট হবে। এই ইলাকায় আগে পর্তুগীজ হার্মাদরা আসত। সি অবশ্য অনেকদিন আগেকার কথা। কাফেরের জাত ছিল তারা। মেয়েমাগিদের জোর করে ধরে নিয়ে দূরদূরান্তের হাটে বিক্রি করে দিত। মোর মহাজন গুজবে পালাবার লোক নয় বটে। এলেমঅলা মানুষতো। এর আগে সপ্তগ্রামে, তারপর ত্রিবেণীতে তারপর হুগলিতে মহাজনি করেছে। তিনি একা একাই মোকে সঙ্গে নিয়ে ঘাটে রওনা দিলেন। এক নজর তাকিয়েই বুঝলেন, এই নৌবহর পর্তুগীজ হার্মাদদের নয়। এগুলিন ইংরাজদের সওদাগরি জাহাজ। মোর দিকে তাকিয়ে বললেন, দ্যাখ মাস্তুলের সেই সাদার উপর লাল আর নীলের ডোরা।
এইটুকু বলে দাদাজী থেমে যান। দুদিকে চেয়ে দেখেন মুরুব্বিরা কেউ নেই। তাঁর চোখমুখ যেন চকমক করে ওঠে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করেন, এরা গেল কই?
- ওনারা মগরেবের নামাজ পড়তে গেছে আব্বাজী।
- আজান হল কখন গো?
- জী, তা বেশ খানিক আগে।
তা শুনে দাদাজী মুচকি হেসে ওঠেন। বলেন, মোকে ফাঁকি দে’ চলে গেল? এবার মোকে ঘরে নে’ চল। আজকে আর তার ফিরে আসবার সময় নাই।
সন্ধ্যার পর দাদাজীকে আবার খাটিয়ায় করে ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। এখন আর তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। পিঠের নীচে দুটো বালিশ গুঁজে দিলে তবে আড় হয়ে বসে থাকেন খানিক। আবার খনিক পর চিৎ করে শুইয়ে দিতে হয়। তবু ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মুচকি হাসিটা থামান না। যেন মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছেন তিনি, তাই এই মুহুর্তে আবার তাঁর জন্মলাভ হয়েছে!
আচমকা লোডশেডিং হল।
আমাদের বাড়ির পাশে হাফিজ চাচার এমব্রডারির কারখানা। সেখানে লক্ষ্মীকান্তপুর, ক্যানিং, বাসন্তী এইসব অঞ্চল থেকে ছেলেপুলে এসে কাজকর্ম করে। এখন নিঝুম অন্ধকার। তারা বিড়ি ফুকতে ফুকতে দাদাজীর ঘরের পেছনের মাঠটায় গোল করে বসেছে। তাদের মধ্যে কেউ একটাকা দামের বাংলাদেশী সিগারেটের মশলায় গাঁজা ডলে মেশাচ্ছে। চাঁদনী রাতে দাদাজীর ঘর থেকে তাদের কেমন রূপোর মত চকমকি মনে হয়। তারা পরস্পরকে খিস্তি দেয়, হাসে। কেউ একজন নতুন মোবাইল কিনেছে বলে মনে হল। সে সেই অন্ধকারে কোন মেয়েকে বুঝি ফোন করছে। দু-তিনজন তাকে ঘিরে সেইসব কথাবার্তা শুনছে। মনিরুল বছর পাঁচেক হল হাফিজ চাচার বোনকে বিয়ে করে এখানে পাকাপাকি ভাবে থেকে গেছে। এখন সে হাফিজ চাচার কারবারে ম্যানেজারি করে। এই পাড়ার সে জামাই। খালি গায়ে লুঙ্গিটা হাঁটুর উপর তুলে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সে এদের থেকে তফাতে এসে বসে। তারপর হাতের রেডিওটা এধার ওধার করে এফ এমে হিন্দি গান চালায়। লোডশেডিং হবার সাথে সাথে মা একটা হ্যারিকেন জ্বেলে সলতেটা নাবিয়ে দাদাজীর ঘরে দিয়ে গেছিল। কথা থেকে আব্বা ঘরে ফিরে উঠোন থেকেই মাকে চেঁচিয়ে শোনায়, শুনলুম ইস্টিশানের দিকে ট্রান্সফর্মার বাস্ট করেছে। আজ আর বুঝি কারেন্ট আসবে না।
আব্বার গলায় আমার সম্বিত ফিরল। মনে হল কতক্ষণ আমি দাদাজীর ঘরে অন্ধকারে বসে আছি। দাদাজী কোন শব্দ করেন না। চুপচাপ চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। হ্যারিকেনের কমলা আলোয় তাঁকে কেমন আদিম যুগের লোক বলে মনে হয়।
আমি যেই পায়ে পায়ে আলোটা নিয়ে দোরের কাছে গেছি, অমনি তিনি ডেকে উঠলেন। ফিরে দেখি উনি হাতের ইশারায় পাশে বসতে বলছেন। আমি তাঁর পায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। কী বলতে গেলে তাঁর গলা থেকে খালি শো শো শব্দ বেরুল। তারপর আচমকা পরিষ্কার গলায় কথা বলতে শুরু করলেন, ক’দিনের মধ্যেই লোকজনের মুখে ছড়িয়ে গেল ইলাকায় ফিরিঙ্গি নেবেছে। তা এই ফিরিঙ্গি খারাপ মানুষ নয় গো। ইনি হলেন গিয়ে বণিক। এখেনে তারা ব্যবসা করতি এইচেন। তিনি নাকি আবার পাকাপাকি ভাবে সুতানটিতে কুঠি গড়তি চান। কী জানি কী হয় – এই সকলের সংশয়। তবে মোর মালিক দেখি এতে বেজায় খুশি। কী জন্যি যে তিনি এত খুশি তা মুই বুঝিনি। এরই মধ্যে তিনি আবার রাধারমণ শেঠের সহিত মোলাকাত করলেন। যেন দুজনের মধ্যি কীসব চুক্তি হল। পরে শুনি দুজনের সেই এক কথা – যেখেনে ফিরিঙ্গি বণিকের কুঠি বসে সেখেনে নাকি কারবারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। এই ইলাকার ভাগ্যি বটে যে চার্নক সাহেব কাশিমবাজার না গিয়ে সুতানুটিতে ভিড়েছেন। তবে চিন্তার কথা এই যে, এই লালমুখো ফিরিঙ্গিও খাজনা থেকে রেহাই পাবে না গো। ইব্রাহিম খাঁ ইদিক থেকে নাছোড়বান্দা। খাজনা না দিলি সে যেই হোক, তাঁর কাছে সব সমান। তা মোর মালিকের বুদ্ধি বটে দেখ, তিনি বলেন, কে জানে ইব্রাহিম খাঁই হয়ত এই সাহেবকে বাংলায় ডেকেছে বানিজ্য করবার লেগে। কার ঘটে পানি কখন যে ছলাৎ করে ছলকে পড়ে তা কি কেউ বলতি পারে? এই দেখ তিনি সব গয়নাগাটি আলমারিতে থুয়ে রাখলে। এখন তার সেই খা খা বদনের দিকে তাকাতি পারিনি গো। এই চাঁদনী রাতে শড়ি পিঁদে, গয়নাগাটি গায়ে দিয়ে যদি দাঁড়াতে ঐ আমগাছটার তলে, নাকি ঘাটের ঐদিকটায় যেখেনে নরম মাছেরা ঘাই মারে খালি রাতে বিরেতে...আর খিলখিল করে হেঁসে উঠতে আদি, বলি, আহা, মুই আঁদার বেলায় ঘাড়ে গামছা মেলে ঐ ধরো সবে ঘরে ফিরতিছি...আর আচমকা সেইদিকে তাকিয়ে কে না বলে ফেলবে, আরে রাক্ষসী!
এই পর্যন্ত বলে দাদাজী আর সাড়াশব্দ করেন না। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি, না নিঃশ্বাস তখনও বইছে।
সন্তর্পণে হ্যারিকেনটা নিয়ে আমি পাশের ঘরে চলে গেলাম। ঘরে মা নেই। আব্বা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে জানলায় বসে বিড়ি ফুকছে। আমাকে দেখে হ্যারিকেনটা নাবিয়ে রাখতে বলল। রাক্ষসীর জন্য নানীরা স্টীলের দোলনা দিয়েছে। এখন সারাদিন সে দোলনাতেই শুয়ে থাকে। চেঁচালে মা কাঁথাটা পালটিয়ে দোলনাটা নাড়িয়ে দিয়ে যায়। সে দুলতে দুলতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে।
জানলার ধারে আব্বার গা ঘেঁষে দাড়াতেই রাক্ষসী আবার কেঁদে উঠল। হ্যারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে আব্বা যেই দোলনার কাছে গেছে, দেখি – দোলনার রডে পশমঅলা বেড়ালটা সুতো দিয়ে ঝোলানো। দোলনাটায় দোল দিয়ে আব্বা আবার আমার পাশে এসে বসল।
সংসারে মুরুব্বি মরে গেলে নাকি মেয়েদের চল্লিশদিন অব্দি বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে নেই। এতে সংসারের অকল্যান হয়। দাদাজীর ইন্তেকালের একচল্লিশ দিনের মাথায় আব্বা পাশের মাদ্রাসার এতিমখানায় খবর দিয়ে এসেছিল। সেই এতিমখানা থেকে পাঁচজন ছাত্র সকালবেলায় আমাদের বাসায় এসে কোরআন পাঠ শুরু করল। বিকেল বেলায় কোরআন পাঠ খতম হলে আমাদের মসজিদের মৌলানা এসে তা দাদাজীর নামে বোকসে দিলেন। পরের দিন আমি মা আর রাক্ষসী রিক্সায় চেপে নানীর বাড়ি রওনা দিলাম।
প্রধান সড়ক ছেড়ে ডানদিকের কাঁচা রাস্তা দিয়ে খানিকটা এগোলেই বিশাল ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠের দক্ষিণ দিকে কতদিনকার পুরনো একটা আমগাছ। এই গাছে চালতার মত গোল গোল আম ফলত বলে মার মুখে শুনেছি। সেই জন্য গাছটার নাম নাকি ‘চালতা আমগাছ’। এখন আর বয়েসের ভারে আগের মত আম ফলে না। তবু গাছটাকে কেন জানিনা, আমার খালি দারোয়ানের মত মনে হয়। মনে হয় কত বছর ধরে গাছটা একভাবে দাঁড়িয়ে রেয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানাদের বিশাল বাড়িটাকে পাহারা দিচ্ছে। যেন চেনা লোক দেখলেই এখুনি ডাল ঝাঁকিয়ে তাকে সেলাম জানাবে। কিম্বা এই গাছটা হয়ত রামচন্দ্র বসাকদের চিনত! এমনও হতে পারে, পঞ্চডিঙা করে সবে মাদ্রাজ থেকে ফিরেছেন চার্নক সাহেব। এখন তিনি ক্লান্ত। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স হল তাঁর। শুধু মনের জোরেই সুতানুটিতে ফিরতে পেরেছেন। দীর্ঘ জলযাত্রা তাঁকে কেমন অবশ করে দিয়েছে। তিনি ভাবেন, ক’দিন কোথাও বাগানবাড়িতে ঘুরে বেশ হয়। তারপর ফিরে এসে আবার সওদাগরি কাজকর্মে মন দেওয়া যাবে। শেষে রামচন্দ্র বসাকের পরামর্শেই তিনি পল্টন সমেত দক্ষিণবঙ্গের এক বাগান বাড়িতে রওনা দিলেন। যাবার প্তহে দেখলেন বিশাল মাঠের পাশে আমগাছটার তলায় এক সম্ভ্রান্ত বংশের কূলবধূ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে। তখন সবে গ্রীষ্ম শুরু হয়েছে। বাতাসে আম মুকুলের গন্ধ ভাসে। এই গন্ধে চার্নক সাহেবের কেমন মতিভ্রম হল। তিনি ভুলে গেল তাঁর পদমর্যাদা, ভুলে গেলেন জন্মের ইতিহাস। মুহুর্তে ঘোড়াগাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলেন। কারো বিধিনিষেধ তাঁর আর কানে ঢুকল না। তিনি গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে এলেন আমগাছটার তলায়।
আমরা আমগাছটা পেরিয়ে নানীর বাড়ি ঢুকেই দেখি মস্ত ছিপ হাতে নানা মাছ ধরতে বেরুচ্ছেন। মাকে দেখেই বললেন, আজ নাতিকে পুকুরের কাতলা খাওয়াব। বলেই তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে পুকুরে চললেন। মা ততক্ষণে রাক্ষসীকে নিয়ে অন্দরে চলেছে।
নানার পায়ে গোড়ালির ঠিক নীচে অনেকদিনের পুরন একটা ক্ষত আছে। বহু ঝাড়ফুক করেও সেই ক্ষত আর সারেনি। এখন সেই ক্ষত সারাবার আশা তিনি বুঝি নিজেই ছেড়ে দিয়েছেন। আর কোন চিকিৎসা করান না। খালি সকালবেলা উঠে গতদিনের পুরন ন্যাকড়াটা খুলে নতুন ন্যাকরা জড়িয়ে নেন। এই পা নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিনি সারা বাড়ি ঘোরেন। বাগানের কোন গাছে কী ফল ধরেছে তা তাঁর নখদর্পণে। স্কাল্বেলা রিক্সায় চেপে বাজারে যান। নিজে রিক্সা থেকে নাবেন না। রিকশাওয়ালাকে দিয়েই বাজার করিয়ে নেন।
তবে তিনি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যেতে পারেন না। দোতলায় নানাদের চারখানা ঘর। ঘরগুলো নানাদের অন্য দুই ভায়ের ভাগে পড়েছে। অবশ্য এখানে ওনারা কেউ থাকেন না। ইদের সময় এসে দু একদিন রয়ে যান মাত্র। সেই দোতলার পশ্চিমমুখো ঘরটার নাম ‘ইংরাজ ঘর’।
নানার মুখেই শুনেছি, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের মুখে। আকাশে আর আগের মত ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান উড়তে দেখা যায়না। এই অঞ্চলে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে অঞ্চলতা কেমন কালো চাদরে ঢেকে যায়। খানিক পর দূর থেকে একজনকে দেশলাই জ্বেলে এদিকে আসতে দেখলেই বোঝা যায় উনি আর কেউ নন, আলতাফ চাচা। নানার বাপেতা ছিলেন চার ভাই। আলতাফ চাচা তাদের মধ্যে বড়। আলতাফ চাচাই এই অঞ্চলে প্রথম সিগারেট ফোঁকা ধরেছিল। বিড়ি, হুকা অনেকেই নিত। কিন্তু সিগারেট? এ যে বিদেশীদের নেশা। সিগারেট বা অন্য কী কারণ – তা স্টহিক ভাবে কেউ বলতে পারে না, কিন্তু আলতাফ চাচাকে সন্মান করত সকলেই। তাঁর গলার স্বর ছিল মেঘের মত গুরুগম্ভীর। একবার হাঁক ছাড়লে গরু বাছুরেরও পিলে চমকে যেত। তিনি ‘হিন্দু’দের মত খাঁটি উচ্চারণে বাংলা বলতে পারতেন।
সেদিন রাতে নানারা সবে ভাত খেতে বসেছে। আচমকা মোটরগাড়ির শব্দে সকলেই চমকে উঠল। নানা ভাত খাওয়া রেখে উঠে এসে দেখন আমগাছটার তলায় একটা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারদিক অন্ধকার। তাঁর মধ্যে মোটরগাড়ির আলো ঘিরে পোকামাকড় বৃত্তাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। গাড়ি থেকে প্রথমে আলতাফ চাচা, তারপর আরও দুজন ইংরাজ নামল। তাদের দেখিয়ে আলতাফ চাচা বললেন, এনারা আজ এখানেই থাকবেন। শোবার বন্দবস্ত করো।
এত রাতে এসেছে, তাও আবার পরদেশী, এরা কেউ খায় তাও কেউ জানেনা। এদিকে গ্রামসুদ্ধু লোক মোটরগাড়ির আওয়াজ শুনে কেউ লম্ফ, কেউ হ্যাজাক জ্বেলে দেখতে এসেছে। দলিজে উঠে আলতাফ চাচা একবার হাঁক ছাড়লেন। তারপর ইংরাজ দুটোকে সঙ্গে নিয়ে অন্দরে ঢুকে গেলেন।
অত রাতেই কথা থেকে মুরগী এনে জবাই করা হল। সাহেবরা নাকি তরকারিতে মশলা পছন্দ করেন না। নানী আলতাফ চাচার কথামত মুরগী রাঁধলেন। আলমারি থেকে সুতোর নক্সা কাঁটা ওয়ার বার করে বালিশে লাগালেন। তা দেখে সাহেবরা তাজ্জব। পরের দিন ভোরবেলা নানা বাগান থেকে এক কাঁদি কলা আনিয়ে ছিলেন। সাহেবরা পুরো কাঁদিটা সাবার করে তবে উঠলেন। যাবার সময় আলতাফ চাচা তাদের বালিশের ওয়ার দুটো দিয়ে দিয়েছিলেন।
আলতাফ চাচা সারা জীবনে বিয়ে থা করেননি। ইন্তেকালের আগে ঘরটা নানার ছোট ভাইকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তারা সকলেই কলকাতায় থাকে। তাই ঘরের দরজায় তালাচাবি দেওয়া।
আমি একা একা দোতলায় উঠে দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভতেরটা দেখবার চেষ্টা করতাম। ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে কখনো একফালি রোদ এসে পড়লে ঘরের লাল মেঝেটাই খালি দৃষ্টিগোচর হয়। শুনেছি আলতাফ চাচার একটা দম দেওয়া গ্রামোফোনও ছিল। চিলেকোঠার ঘরটায় নাকি নাকি সেই সময়কার কতকগুলো ভাঙা রেকর্ড এখনও পড়ে আছে। কেন জানি না সেই রেকর্ডগুলোর দেখার খুব সখ হল আমার। কিন্তু ছাদে যাবার সিঁড়িতে মস্ত বড় একটা মৌমাছির চাক। দোতলার বারান্দা থেকে মৌমাছি ওড়ার গুনগুন আওয়াজ পাওয়া যায়। একবার উঁকি মেরে দেখেছি মৌচাকটাকে ঘিরে বিন্দু বিন্দু অন্ধকার প্রহরীর মত গুনগুন শব্দ তুলে জেগে রয়েছে। সারা গা শিউরে উঠেছিল।
এদিকে নানীর বাড়ি আসার পর থেকে রাক্ষসী একনাগারে কেঁদেই চলেছে। নানী বুড়ো মানুষ। মা বিরক্ত হয়ে উঠলে তিনি তবু কোলে তুলে গান গাইতে গাইতে ঘুম পারাবার চেষ্টা করেন। কখনো রাক্ষসী খানিক থামে। তারপর দম নিয়ে যেন আরও জোর চিৎকার শুরু করে।
কয়দিন পর রাক্ষসীর কান্নার আসল কারণটা জানতে পারলাম।
এখানে আসার পর, মা নানীর সাথে চুক্তি করে রাক্ষসীকে বুকের দুধ ছাড়াবার বিভিন্ন পন্থা নিয়েছিল। এদিকে রাক্ষসী তো মায়ের দুধ খেয়েই বড় হয়েছে। এখন মায়ের দুধ খাওয়া যেন তার নেশা। সে কিছুতেই বোতলের দুধ টানবে না। আবার খিদের জ্বালায় চুপ মেরে থাকতেও পারে না। মা প্রথমে দুধের বোঁটায় করোলার রস লাগিয়ে চোষাতে যেত। সেই তিতো স্বাদ রাক্ষসীর সহ্য হত না। তখন কাঁদলেই মা বোতলের নিপিলটা জোর করে তাঁর মুখে ঢুকিয়ে দিত। গাল ভর্তি দুধ নিয়ে সে বিষম যেত। তবু বোতলের দুধ আর টানতো না। এখন সে কেমন ঠোঁট বন্ধ করে কাঁদতে শিখেছে।
এতেও রাক্ষসীকে জব্দ করা গেল না বুঝে মা অন্য রাস্তায় গেল।
রোজার মাসে ইফতারে আমরা তোকমারির সরবত খেতাম। চিনি গোলা পানিতে খানিকটা তোকমারি আগে থেকে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পানিতে ভিজে গেলে তোকমারির কালো কালো দানাগুলো সিকনির মত থকথক করে। এখন সেই তোকমারির থকথকে কালো দানা মা বোঁটার চারধারে মাখিয়ে রেখেছে। রাক্ষসী দুধ চাইলেই সেই স্তন তার ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয়। রাক্ষসী হয়ত ভাবে দুধের চারধারে কালো কালো পোকা গিজগিজ করছে। সে ভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কঁকায়।
সবে সে বসতে শিখেছে। এখন আর ভয়ে সে মায়ের কাছে যেতে চায়না। মা বুঝি তাঁকে কাঁদাবার ছলেই জোর করে কোলে নিতে চায়। রাক্ষসী কেঁদে ওঠে। মা কখনও এমনি এমনি তাঁর চোখের সামনে তোকমারি মাখানো দুধ বার করে হাসে। এসবে মা যেন নতুন খেলা পেয়েছে। এখন মাকে বালিকার মত দেখায়। নানী রাক্ষসীকে কোলে তুলে গান গাইতে গাইতে বোতলের দুধ দেয়। রাক্ষসী আর রা করে না।
সে বোতলের দুধ খাওয়া শুরু করেছে। তবু তার হিংস্রতা এতটুকু কমেনি। সে কারণে অকারণে খালি জেদ ধরে। মায়ের থেকে নানীর কোলেই থাকে বেশীক্ষণ।
সেদিন সকালবেলা নানার সঙ্গে দলিজে বসে আছি। দেখি একজন বুড়ো মত লোক পা পর্যন্ত পিরান পরে মাঠ পেরিয়ে এদিকে আসছেন। তিনি এসে নানাকে সালাম জানালেন। সালাম জানিয়েই দলিজে বসে নানার সাথে টুকটাক কথা বলতে শুরু করলেন।
লোকটির নাম লিয়াকত আলি। ইনি পূর্বে এই গ্রামেরেই বাসিন্দা ছিলেন। ছোটবেলায় এতিম হয়ে গেলে সত্যপীরের মাজারে থেকে বড় হয়েছেন। পর পর তিন মেয়ে জন্ম দেবার পর নানী আবার যখন গর্ভবতী হলেন, সেবার ছেলে পাবার আশায় নানা সত্যপীরের মাজারে গিয়ে চাদর চড়িয়ে ছিলেন। সেই সূত্রেই লিয়াকত আলির সঙ্গে নানার ঘনিষ্টতা হয়। কিন্তু এখন নানাকে কেমন আড়ষ্ট দেখাচ্ছে। বুঝি বা তিনি লিয়াকত আলির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে আর আগ্রহী নন। তবে এত সবে লিয়াকত আলি কিছু এসে যায় না। তিনি আপন মনেই কখনো মাদার শাহ, কখনও আবার নিজের জীবনের গল্প শোনান। তাঁর কথাতেই জানতে পারি, এখন আর তিনি সত্যপীরের মাজারে থাকেন না। বড়পীরের মাজারই তাঁর আস্তানা। তিনি বলেন – লেকিন মাদার শাহের সহিত বড়পীরের একদিন বহুত হুজ্জত বাঁধল। মাদার শাহ কইলেন –
আচ্ছা ভাই এইখানে সিরনি রাখিয়া
আমরা তকরির করি একত্রে মিলিয়া
শত্ত একবার করো তুমি মোর সাথে
হারিলে গর্দ্দান জুদা নাহি হবে তাতে।
এইভাবে তিনি মাদার শাহের সহিত বড়পীরের লুকোচুরি খেলার বর্ণনা শুরু করলেন। এই খেলায় ঠিক হল, বড়পীর জয়ী হলে তবে মাদার শাহ তাঁকে গুরু রূপে স্বীকার করে নেবেন। প্রথমে বড়পীরের পালা। তিনি দরিয়াতে মাছের পেটের ডিমের ভেতর লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু মাদার শাহ ঠিক তাঁর সন্ধান পেয়ে গেলেন। এবার মাদার শাহের পালা। কী করবেন তিনি? দুনিয়ার সবদিকে, আমটি আসমান সবখানে যে বড়পীরের নজর ছড়ানো। যেখানেই লুকাও বড়পীর ঠিক হদিস পেয়ে যাবেন। না, মাদার শাহ অন্য কোথাও গেলেন না। তিনি অশরীরি রূপ ধরে বাতাসের মত বড়পীরের নিঃশ্বাসের সহিত মিশে গিয়ে বড়পীরের শরীরে ঢুকে গেলেন –
হাওয়া ভবে ছোপাইনু নিঃশ্বাস টানিতে
হাওয়ার সামিল আছি তোমার দমেতে।
এদিকে খেয়াল করিনি, রাক্ষসীকে কে নানার কোলে দিয়ে গেছিল। সে আচমকা কেঁদে উঠলে লিয়াকত আলি গল্পটা মাঝ পথেই থামিয়ে দিলেন। এখন দুপুর। লিয়াকত আলির তবু উঠবার কোন ইঙ্গিত নেই। নানা বুঝেছেন আজ দুপুরে লিয়াকত আলি এখানে ভার খেয়ে তবে যাবেন।
এত কথার মালিক এই লিয়াকত আলি, ভাত খাবার সময় কিন্তু কোন কথা বললেন না। যেন তিনি কতদিন পর গৃহস্থের বাড়িতে খেতে বসেছেন। ভাতের প্রতিটা দানা আয়েস করে চিবিয়ে যাচ্ছেন। মা, নানী কেউ লিয়াকত আলির সামনে আসেনি। লিয়াকত আলি এখানে খাবে শুনে নানী বলেছিলেন, লোকটা এখেনে এইচে কেন? এই বুড়ো বয়েসে উনি না আবার এনার খপ্পরে পড়ে।
আসলে ছেলে পাবার আশায় নানা যখন সত্যপীরের মাজারে প্রায়ই যেতেন, সেই সময় লিয়াকত আলির সঙ্গে তাঁর গোপনে বার্তা বিনিময় চলত। তিনি সময় পেলেই কারবারে লালবাতি জ্বেলে মাজারে গিয়ে লিয়াকত আলির সাথে মোলাকাত করতেন। তাদের মধ্যে কী যে কথা হয় তা কেউ জানে না। নানা খালি ফকিরের মত সারাদিন বসে বসে কীসব ভাবেন। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, ওসব কথা মেয়েমানুষের লেগে নয় গো।
নানী যতই বলেন, অত পীরের মাজারে যাও কেন? ওরা ঝাড়ফুঁক জানে। পীরের মাজারে গে মাথা ঠোকা মোছলমানদের লেগে হারাম।
মৌলবই ডেকে অনেক দোয়াদরুদ করার পর তবে নাকি নানার মতিগতি ফিরেছিল। নানী এখনও বিশ্বাস করেন, লিয়াকত আলির কুনজরে এসে পড়াতেই তিনি সেবার মৃত সন্তান প্রসব করেছিলেন। শুধু তাই নয়, নানার পায়ের ঘাটাও দারোগায় গিয়ে মাথা ঠোকার ফল।
লিয়াকত আলি এখন ভাত খেয়ে কুলকুচি করছেন। মুখে পানি দিতে দিতেই তিনি চারধারে তাকিয়ে কী যেন ভাবেন। এই প্রথম লিয়াকত আলির সুরমাটানা চোখ দুটোকে খুব কাছ থেকে দেখে ছিলাম। রসুনের তেল চোখে পড়লে চোখ দুটো যেমন লাল হয়ে যায়, তেমনি লাল টকটকে দুই চোখের রঙ। দেখলেই বোঝা যায় লোকটা ঝাড়ফুঁক জানে। কিম্বা লোকটার পোষা জ্বিন আছে। তাদের বশে এনেই তিনি তাঁর কাজ হাসিল করিয়ে নিতে পারেন।
লিয়াকত আলি চলে যাবার পর নানার যেন অশান্তি কাটল। কিন্তু মায়ের আর থির নেই। আমি আর রাক্ষসী দুজনাই লিয়াকত আলির নজরে এসে গেছি। এবার বুঝি আমার না হয় তো রাক্ষসীর পালা। নানীরও সেই একই ভয়। তিনি নানাকে সব দোষ দিয়ে বললেন, সাঁঝের দিকে মলিসাবকে আসতে বলে এস। কচি কচি বাচ্চাদের যদি কিছু হয় মেয়ের বাড়ি মুখ দেখাব কী করে? বলি মলিসাবকে ভালো তাবিজমাদলি দিতে বল গে।
বিকেলে দেখি হুলস্থুল কান্ড। জনা কুড়ি লোক দলিজে জড়ো হয়েছে। শুনলাম লিয়াকত আলি নাকি সারা গ্রামে বলে বেরিয়েছেন তিনি মৌমাছির ভাষা বুঝতে পারেন। এখন তিনি আবার এখানে আসবেন। এখানে এসে ছাদের সিঁড়িতে হওয়া মৌচাকের সামনে দাঁড়িয়ে মৌমাছিদের সাথে কথা কইবেন। এই মৌমাছিরা নাকি লিয়াকত আলিকে কোন গূঢ় কথা জানাতে চায়। সাহস থাকলে যে কেউ দাঁড়িয়ে থেকে সেইসব কথা শুনতে পারে। তবে এতে ভ্যের কিছু নেই। লিয়াকত আলি বারণ করলে মৌমাছিরা কাউকে কামড়াবে না। এমনকি তিনি ইচ্ছা করলে এক ঝাঁক মৌমাছি গায়ে নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরতে পারেন।
ক্ষণে ক্ষণে আরও মানুষ জড়ো হচ্ছে। কিন্তু আমাকে মা কিছুতেই বাইরে যেতে দেবে না। ঘর থেকেই বুঝতে পারছি বাইরে অনেক লোক। এদিকে এসব শুনে নানা সেই যে বাইরে বেরিয়েছিলেন এখনও তিনি ফেরেন নি। মা রাক্ষসীকে এই ঘরে রেখে নানীর সাথে শলা পরামর্শ করতে বেরিয়ে গেল। বাইরে থেকে দরজাটা ভেজানো। আমি আর রাক্ষসী আখন একই ঘরে।
চেয়ে দেখি রাক্ষসী খাটের উপর বসে আছে। চাদরের এক কোণে মিষ্টির রস লেগে লাল পিঁপড়ে গিজগিজ করছে। সে একবার আমার দিকে তাকায়। একবার চাদরের খুট ধরে টানে। চাদরে টান পড়ায় পিঁপড়ে গুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কয়েকটা পিঁপড়ে রাক্ষসীর পা বেয়ে উপরে উঠছে।
মনে হল ওকে এখানে রেখেই পালিয়ে যাই। তাঁর কাছে যেতেই দেখি, সে বিছানায় হিসু করে ফেলেছে। তাঁকে কোলে তুলে প্যান্টটা খুলে দিলাম। তারপর মেঝেয় বসিয়ে নতুন প্যান্ট নেব বলে যেই এগিয়েছি দেখি সে উবু হয়ে বসে হামা দিতে চাইছে।
দলিজে বেশ কিছু লোকের গমগম আওয়াজ পাচ্ছি। বুঝতে পারলুম নানার কথা শুনে মুরুব্বিরা এসে লিয়াকত আলিকে এখানে ঢুকতে বাঁধা দিয়েছে। যারা মৌমাছির সঙ্গে লিয়াকত আলির কথোকথন শুনতে ভিড় জমিয়েছিল তারা তাই কোলাহল করে ফিরে যাচ্ছে।
সেই সন্ধ্যায় একজন মলিসাব এসে দোয়াদরুদ পড়ে তাবিজ দিয়ে গেল। আমি সেই তাবিজখানি গলায় ঝুলিয়েছি। রাক্ষসী ছোট, গলায় তাবিজ পরালে সে তাবিজটা চুষবে, তাই কালো কাড় দিয়ে তাবিজখানি তার কোমরে ঝোলানো হয়েছে। রাতের দিকে একজন লোক মৌচাকটা ভাংতে এল।
শোনা যাচ্ছে লিয়াকত আলি গ্রাম ছেড়ে আবার বড়পীরের মাজারে রওনা দিয়েছেন। আমি তবু লিয়াকত আলির সেই লাল টুকটুকে চোখ দুটোর কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। দাদাজী বলতেন কোকিলের চোখও নাকি লাল। তবে কি লিয়াকত আলির চোখ দুটো আসলে কোকিলের চোখ?
নানীর অনুমান লিয়াকত আলির জন্যই তিনি সেবার মৃত সন্তান প্রসব করেছিলেন। কথাটা হয়ত সঠিক! তা না হলে প্রসবের আগের দিন তিনি কেন ভ্রূণটির নড়াচড়া টের পেতেন? এখন জানতে ইচ্ছা করে সেই না-জন্মানো ভ্রূণটি পুরুষ ছিল, না কি মেয়ে? কে জানে লিয়াকত আলিও বুঝি মাদার শাহের মত অশরীরি রূপ ধারণ করতে পারে। তিনি হয়ত হাওয়ার মত নানীর নিঃশ্বাসের সাথে মিশে ফুসফুসে আঁটকে আছেন এখন। যেন তিনি সকলের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। খেলায় জয়ী হলে পর আবার শরীরী রূপ ধরে বলবেন –
লাড়কারা আজ তক খেলে লুকোচুরি
লাড়কার মজলেছে ভাই আছেত মাসুরি।
দাদাজীর মৃত্যুর পর ইউনুস মৌলানা বলেছিলেন, সত্যিকার পরেজগার এলেমঅলা মানুষেরা ইন্তেকালের ঠিক পূর্বে দুনিয়ার শুরু থেকে আখরি অব্দি এক লহমায় সব কিছু দেখতে পান। দাদাজী সামান্য মানুষ, তাই বুঝি তিনি মাত্র কয়েকশ বছর পিছিয়ে যেতে পেরেছিলেন। হয়ত মরবার আগে, যে ইংরাজ দুটো নানাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তাদের সঙ্গেও ওনার মোলাকাত হয়েছিল!
পেছন ফিরে দেখি মা হাততালি দিয়ে রাক্ষসীর হামাগুড়ি দেওয়া দেখছে।বুকের ভেতরটা ছ্যাক করে উঠল। এসব কী ছাইপাশ ভাবছি আমি? কেন খালি দাদাজীর কথা, সেই ইংরাজ দুটোর কথা এইসবই মনে আসছে? মৌচাকটা এতক্ষণে ভাঙা হয়ে গেছে। কই সেই কথাটা তো একবারও ভাবিনি। তবে কি আমাদের উপর বিছানো রাক্ষসীর অদৃশ্য বলয়ের মধ্যে একা আমিই আঁটকে গেছি!
নাকি এইসব কিছুই আসলে একটি অখন্ড বিস্তার। আর সেরকম হলে হয়ত লিয়াকত আলিও কখনো সকলের সামনে সুবিশাল মৌচাকের নিকটে দাঁড়িয়ে মানুষের ভাষায় পতঙ্গদের সহিত কথা কইবেন। তারপর এক ঝাঁক মৌমাছি গায়ে নিয়ে, ইংরাজ ঘর পেরিয়ে উঠোনে নেমে, উঠোন পেরিয়ে আমগাটার তলায় দাঁড়িয়ে আচমকা নিরাকার হয়ে যাবেন।
অথচ রাক্ষসী নিজে থেকে কখনো আঘাত করেনি আমাদের। তবু আমি ঠিক টের পাচ্ছিলাম সবার নজরের বাইরে সে আমাদের জন্য একটা বলয় সৃষ্টি করেছে। সেই বলয়কে অতিক্রম করার সাধ্য এ সংসারের কারোর ছিল না।
দাদী মরে যাবার পর দাদাজী দখিন দিকের ঘরটায় একলাই থাকতেন। শুধু খাবার সময় হলে মা থালা বাটিতে তার জন্য আলাদা করে খাবার দিয়ে আসত। এতদিন খালাই এসব কাজ করছিল। এখন সে আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেছে। তাই মাকেই এসবের ভার নিতে হয়েছে।
সকালে চা দিতে গিয়েই মা টের পেয়েছিল দাদাজীর বুক থেকে কেরম ঘরঘর শব্দ বেরুচ্ছে। দাদাজী খাটের উপর দুটো মাথার বালিশ কোলে চেপে ঘাড় নীচু করে বসে আছেন। মা ঘরে ঢুকতেই তিনি একবার মায়ের দিকে তাকান। তারপর আবার সেই ভাবেই ঘাড় নিচু করে বলেন, মুই কী এত গোনা করিচি মা যে আল্লা এত কষ্ট দিচ্ছে?
মা দাদাজীর পাশে গিয়ে বসলে দাদাজীর বুক থেকে আবার ঘরঘর শব্দ পায়। তবে দাদাজীর জাকামদানি শুরু হয়েছে? মা দাদাজীর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। যেন জাকামদানির সময় এতটুকু আদর সকলের পাওনা – দাদাজী তাই আর বিচলিত হন না। মা আব্বাকে ডাকতে উঠলে তিনি আবার বলেন, মগরেব বাদ সময় হইছে মা। তোমরা জোহর বাদ মোকে উঠোনে নিয়ে যেও।
জোহর বাদ, তখন গনগনে রোদ, দাদাজীকে উঠোনে শোয়ানো হল। খাটিয়ার উপর শুয়ে শুয়ে তিনি কীসব বলেন। কখনো বলতে বলতে আচমকা থেমে যান। থেমে গেলে মুরুব্বিরা তার নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখেন নিঃশ্বাস বইছে কি না। কিছু বুঝবার আগে তিনি আবার বিড়বিড় করে বলেন, কী হাট বসত এখেনে। আর মাঠে ঘাটে পানি তমতম করত। কে গা তোমার গয়নাটা আলমারিতে থুয়ে দিলে? তোমায় রামচন্দ্র বসাক্বের নৌবহর দেখাব আর তুমি ...
- আর কী আব্বাজী? মা পাশ থেকে জানতে চায়।
- আর...কিছু বলবে বলে দাদাজী মায়ের দিকে তাকান। কিন্তু মাকে কিছু বলেন না।
- নিজের মনেই যেন গোপনে বলতে থাকেন, তিনদিন তিনরাত উনি গয়না থুয়ে দিলে আলমারিতে। হ্যাগা, রামচন্দ্র বসাকের নৌবহর দ্যাকবা না? শরীলখানা এমন খা খা করলি কী আর তানার নৌবহর দেখা যায়! শরীলের দিকে যে আর তাকাতি পারিনে গো। মাঠঘাট কেমন তমতম করতেছে পানিতে। কদিন টানা পানি হল গা?
দাদাজী সকলের সামনে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন। আব্বার উত্তর করতে গেলে মুরুব্বিরা তাকে থামিয়ে দেয়। যেন মরবার আগে এরম বিড়বিড় করা খুবই স্বাভাবিক। কেউ কোন উত্তর করলো না দেখে দাদাজী আবার শুরু করেন, দুদিন ধরি টানা পানি হচ্ছে। যেন আল্লার আসমান কেউ ছেনি হাতুড়ি দে ফুটো করে দেছে। খালি পানি আর পানি। হ্যাগা, তাবলে কী আর হাটবারে হাট বসবে না? তখন কী যে হাট বসত ইলাকায়। মহাজন ব্যাপারীদের ভিড় লেগে যেত বটে। মোর মালিক ছ্যালো গোবিন্দপুরের এলেমঅলা মহাজন রামচন্দ্র বসাক। খাটো ধুতি পিদে, গায়ে একখানা ফতুয়া আর মাথায় গোলপাতার একখানি ছাতি নিয়েই ঘুরত। কিন্তু মানুষ ছিল বড় ধনবান। সেদিন হল কী... এই পর্যন্ত বলে দাদাজী চুপ মেরে থাকেন। দম নেন। মুরুব্বিরা চামচে করে তার গালে জমজমের পানি দিতে যান। তিনি জিভ দিয়ে সেটুকু চুকচুক করে খেয়ে নিয়ে আবার শুরু করেন, কিন্তু জোহর বাদ মুই নামাজ পড়ে সবে এসিচি হাটে, ও বাবা, দেখি সে কী হুলস্থুল কান্ড। শোনা গেল ঘাটের দিকে পরদেশী এক নৌবহর এগিয়ে আসতেছে। সওদাগররা নোঙর তুলে নৌকা নে পালাবার লেগি ব্যাস্ত হয়ে উঠেচে...সকলেই ভীত। ভয় বুঝিবা বোম্বেটের দল এগিয়ে আসতেছে। নিশ্চয় হাট লুট হবে। এই ইলাকায় আগে পর্তুগীজ হার্মাদরা আসত। সি অবশ্য অনেকদিন আগেকার কথা। কাফেরের জাত ছিল তারা। মেয়েমাগিদের জোর করে ধরে নিয়ে দূরদূরান্তের হাটে বিক্রি করে দিত। মোর মহাজন গুজবে পালাবার লোক নয় বটে। এলেমঅলা মানুষতো। এর আগে সপ্তগ্রামে, তারপর ত্রিবেণীতে তারপর হুগলিতে মহাজনি করেছে। তিনি একা একাই মোকে সঙ্গে নিয়ে ঘাটে রওনা দিলেন। এক নজর তাকিয়েই বুঝলেন, এই নৌবহর পর্তুগীজ হার্মাদদের নয়। এগুলিন ইংরাজদের সওদাগরি জাহাজ। মোর দিকে তাকিয়ে বললেন, দ্যাখ মাস্তুলের সেই সাদার উপর লাল আর নীলের ডোরা।
এইটুকু বলে দাদাজী থেমে যান। দুদিকে চেয়ে দেখেন মুরুব্বিরা কেউ নেই। তাঁর চোখমুখ যেন চকমক করে ওঠে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করেন, এরা গেল কই?
- ওনারা মগরেবের নামাজ পড়তে গেছে আব্বাজী।
- আজান হল কখন গো?
- জী, তা বেশ খানিক আগে।
তা শুনে দাদাজী মুচকি হেসে ওঠেন। বলেন, মোকে ফাঁকি দে’ চলে গেল? এবার মোকে ঘরে নে’ চল। আজকে আর তার ফিরে আসবার সময় নাই।
সন্ধ্যার পর দাদাজীকে আবার খাটিয়ায় করে ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। এখন আর তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। পিঠের নীচে দুটো বালিশ গুঁজে দিলে তবে আড় হয়ে বসে থাকেন খানিক। আবার খনিক পর চিৎ করে শুইয়ে দিতে হয়। তবু ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মুচকি হাসিটা থামান না। যেন মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছেন তিনি, তাই এই মুহুর্তে আবার তাঁর জন্মলাভ হয়েছে!
আচমকা লোডশেডিং হল।
আমাদের বাড়ির পাশে হাফিজ চাচার এমব্রডারির কারখানা। সেখানে লক্ষ্মীকান্তপুর, ক্যানিং, বাসন্তী এইসব অঞ্চল থেকে ছেলেপুলে এসে কাজকর্ম করে। এখন নিঝুম অন্ধকার। তারা বিড়ি ফুকতে ফুকতে দাদাজীর ঘরের পেছনের মাঠটায় গোল করে বসেছে। তাদের মধ্যে কেউ একটাকা দামের বাংলাদেশী সিগারেটের মশলায় গাঁজা ডলে মেশাচ্ছে। চাঁদনী রাতে দাদাজীর ঘর থেকে তাদের কেমন রূপোর মত চকমকি মনে হয়। তারা পরস্পরকে খিস্তি দেয়, হাসে। কেউ একজন নতুন মোবাইল কিনেছে বলে মনে হল। সে সেই অন্ধকারে কোন মেয়েকে বুঝি ফোন করছে। দু-তিনজন তাকে ঘিরে সেইসব কথাবার্তা শুনছে। মনিরুল বছর পাঁচেক হল হাফিজ চাচার বোনকে বিয়ে করে এখানে পাকাপাকি ভাবে থেকে গেছে। এখন সে হাফিজ চাচার কারবারে ম্যানেজারি করে। এই পাড়ার সে জামাই। খালি গায়ে লুঙ্গিটা হাঁটুর উপর তুলে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সে এদের থেকে তফাতে এসে বসে। তারপর হাতের রেডিওটা এধার ওধার করে এফ এমে হিন্দি গান চালায়। লোডশেডিং হবার সাথে সাথে মা একটা হ্যারিকেন জ্বেলে সলতেটা নাবিয়ে দাদাজীর ঘরে দিয়ে গেছিল। কথা থেকে আব্বা ঘরে ফিরে উঠোন থেকেই মাকে চেঁচিয়ে শোনায়, শুনলুম ইস্টিশানের দিকে ট্রান্সফর্মার বাস্ট করেছে। আজ আর বুঝি কারেন্ট আসবে না।
আব্বার গলায় আমার সম্বিত ফিরল। মনে হল কতক্ষণ আমি দাদাজীর ঘরে অন্ধকারে বসে আছি। দাদাজী কোন শব্দ করেন না। চুপচাপ চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। হ্যারিকেনের কমলা আলোয় তাঁকে কেমন আদিম যুগের লোক বলে মনে হয়।
আমি যেই পায়ে পায়ে আলোটা নিয়ে দোরের কাছে গেছি, অমনি তিনি ডেকে উঠলেন। ফিরে দেখি উনি হাতের ইশারায় পাশে বসতে বলছেন। আমি তাঁর পায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। কী বলতে গেলে তাঁর গলা থেকে খালি শো শো শব্দ বেরুল। তারপর আচমকা পরিষ্কার গলায় কথা বলতে শুরু করলেন, ক’দিনের মধ্যেই লোকজনের মুখে ছড়িয়ে গেল ইলাকায় ফিরিঙ্গি নেবেছে। তা এই ফিরিঙ্গি খারাপ মানুষ নয় গো। ইনি হলেন গিয়ে বণিক। এখেনে তারা ব্যবসা করতি এইচেন। তিনি নাকি আবার পাকাপাকি ভাবে সুতানটিতে কুঠি গড়তি চান। কী জানি কী হয় – এই সকলের সংশয়। তবে মোর মালিক দেখি এতে বেজায় খুশি। কী জন্যি যে তিনি এত খুশি তা মুই বুঝিনি। এরই মধ্যে তিনি আবার রাধারমণ শেঠের সহিত মোলাকাত করলেন। যেন দুজনের মধ্যি কীসব চুক্তি হল। পরে শুনি দুজনের সেই এক কথা – যেখেনে ফিরিঙ্গি বণিকের কুঠি বসে সেখেনে নাকি কারবারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। এই ইলাকার ভাগ্যি বটে যে চার্নক সাহেব কাশিমবাজার না গিয়ে সুতানুটিতে ভিড়েছেন। তবে চিন্তার কথা এই যে, এই লালমুখো ফিরিঙ্গিও খাজনা থেকে রেহাই পাবে না গো। ইব্রাহিম খাঁ ইদিক থেকে নাছোড়বান্দা। খাজনা না দিলি সে যেই হোক, তাঁর কাছে সব সমান। তা মোর মালিকের বুদ্ধি বটে দেখ, তিনি বলেন, কে জানে ইব্রাহিম খাঁই হয়ত এই সাহেবকে বাংলায় ডেকেছে বানিজ্য করবার লেগে। কার ঘটে পানি কখন যে ছলাৎ করে ছলকে পড়ে তা কি কেউ বলতি পারে? এই দেখ তিনি সব গয়নাগাটি আলমারিতে থুয়ে রাখলে। এখন তার সেই খা খা বদনের দিকে তাকাতি পারিনি গো। এই চাঁদনী রাতে শড়ি পিঁদে, গয়নাগাটি গায়ে দিয়ে যদি দাঁড়াতে ঐ আমগাছটার তলে, নাকি ঘাটের ঐদিকটায় যেখেনে নরম মাছেরা ঘাই মারে খালি রাতে বিরেতে...আর খিলখিল করে হেঁসে উঠতে আদি, বলি, আহা, মুই আঁদার বেলায় ঘাড়ে গামছা মেলে ঐ ধরো সবে ঘরে ফিরতিছি...আর আচমকা সেইদিকে তাকিয়ে কে না বলে ফেলবে, আরে রাক্ষসী!
এই পর্যন্ত বলে দাদাজী আর সাড়াশব্দ করেন না। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি, না নিঃশ্বাস তখনও বইছে।
সন্তর্পণে হ্যারিকেনটা নিয়ে আমি পাশের ঘরে চলে গেলাম। ঘরে মা নেই। আব্বা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে জানলায় বসে বিড়ি ফুকছে। আমাকে দেখে হ্যারিকেনটা নাবিয়ে রাখতে বলল। রাক্ষসীর জন্য নানীরা স্টীলের দোলনা দিয়েছে। এখন সারাদিন সে দোলনাতেই শুয়ে থাকে। চেঁচালে মা কাঁথাটা পালটিয়ে দোলনাটা নাড়িয়ে দিয়ে যায়। সে দুলতে দুলতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে।
জানলার ধারে আব্বার গা ঘেঁষে দাড়াতেই রাক্ষসী আবার কেঁদে উঠল। হ্যারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে আব্বা যেই দোলনার কাছে গেছে, দেখি – দোলনার রডে পশমঅলা বেড়ালটা সুতো দিয়ে ঝোলানো। দোলনাটায় দোল দিয়ে আব্বা আবার আমার পাশে এসে বসল।
সংসারে মুরুব্বি মরে গেলে নাকি মেয়েদের চল্লিশদিন অব্দি বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে নেই। এতে সংসারের অকল্যান হয়। দাদাজীর ইন্তেকালের একচল্লিশ দিনের মাথায় আব্বা পাশের মাদ্রাসার এতিমখানায় খবর দিয়ে এসেছিল। সেই এতিমখানা থেকে পাঁচজন ছাত্র সকালবেলায় আমাদের বাসায় এসে কোরআন পাঠ শুরু করল। বিকেল বেলায় কোরআন পাঠ খতম হলে আমাদের মসজিদের মৌলানা এসে তা দাদাজীর নামে বোকসে দিলেন। পরের দিন আমি মা আর রাক্ষসী রিক্সায় চেপে নানীর বাড়ি রওনা দিলাম।
প্রধান সড়ক ছেড়ে ডানদিকের কাঁচা রাস্তা দিয়ে খানিকটা এগোলেই বিশাল ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠের দক্ষিণ দিকে কতদিনকার পুরনো একটা আমগাছ। এই গাছে চালতার মত গোল গোল আম ফলত বলে মার মুখে শুনেছি। সেই জন্য গাছটার নাম নাকি ‘চালতা আমগাছ’। এখন আর বয়েসের ভারে আগের মত আম ফলে না। তবু গাছটাকে কেন জানিনা, আমার খালি দারোয়ানের মত মনে হয়। মনে হয় কত বছর ধরে গাছটা একভাবে দাঁড়িয়ে রেয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানাদের বিশাল বাড়িটাকে পাহারা দিচ্ছে। যেন চেনা লোক দেখলেই এখুনি ডাল ঝাঁকিয়ে তাকে সেলাম জানাবে। কিম্বা এই গাছটা হয়ত রামচন্দ্র বসাকদের চিনত! এমনও হতে পারে, পঞ্চডিঙা করে সবে মাদ্রাজ থেকে ফিরেছেন চার্নক সাহেব। এখন তিনি ক্লান্ত। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স হল তাঁর। শুধু মনের জোরেই সুতানুটিতে ফিরতে পেরেছেন। দীর্ঘ জলযাত্রা তাঁকে কেমন অবশ করে দিয়েছে। তিনি ভাবেন, ক’দিন কোথাও বাগানবাড়িতে ঘুরে বেশ হয়। তারপর ফিরে এসে আবার সওদাগরি কাজকর্মে মন দেওয়া যাবে। শেষে রামচন্দ্র বসাকের পরামর্শেই তিনি পল্টন সমেত দক্ষিণবঙ্গের এক বাগান বাড়িতে রওনা দিলেন। যাবার প্তহে দেখলেন বিশাল মাঠের পাশে আমগাছটার তলায় এক সম্ভ্রান্ত বংশের কূলবধূ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে। তখন সবে গ্রীষ্ম শুরু হয়েছে। বাতাসে আম মুকুলের গন্ধ ভাসে। এই গন্ধে চার্নক সাহেবের কেমন মতিভ্রম হল। তিনি ভুলে গেল তাঁর পদমর্যাদা, ভুলে গেলেন জন্মের ইতিহাস। মুহুর্তে ঘোড়াগাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলেন। কারো বিধিনিষেধ তাঁর আর কানে ঢুকল না। তিনি গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে এলেন আমগাছটার তলায়।
আমরা আমগাছটা পেরিয়ে নানীর বাড়ি ঢুকেই দেখি মস্ত ছিপ হাতে নানা মাছ ধরতে বেরুচ্ছেন। মাকে দেখেই বললেন, আজ নাতিকে পুকুরের কাতলা খাওয়াব। বলেই তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে পুকুরে চললেন। মা ততক্ষণে রাক্ষসীকে নিয়ে অন্দরে চলেছে।
নানার পায়ে গোড়ালির ঠিক নীচে অনেকদিনের পুরন একটা ক্ষত আছে। বহু ঝাড়ফুক করেও সেই ক্ষত আর সারেনি। এখন সেই ক্ষত সারাবার আশা তিনি বুঝি নিজেই ছেড়ে দিয়েছেন। আর কোন চিকিৎসা করান না। খালি সকালবেলা উঠে গতদিনের পুরন ন্যাকড়াটা খুলে নতুন ন্যাকরা জড়িয়ে নেন। এই পা নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিনি সারা বাড়ি ঘোরেন। বাগানের কোন গাছে কী ফল ধরেছে তা তাঁর নখদর্পণে। স্কাল্বেলা রিক্সায় চেপে বাজারে যান। নিজে রিক্সা থেকে নাবেন না। রিকশাওয়ালাকে দিয়েই বাজার করিয়ে নেন।
তবে তিনি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যেতে পারেন না। দোতলায় নানাদের চারখানা ঘর। ঘরগুলো নানাদের অন্য দুই ভায়ের ভাগে পড়েছে। অবশ্য এখানে ওনারা কেউ থাকেন না। ইদের সময় এসে দু একদিন রয়ে যান মাত্র। সেই দোতলার পশ্চিমমুখো ঘরটার নাম ‘ইংরাজ ঘর’।
নানার মুখেই শুনেছি, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের মুখে। আকাশে আর আগের মত ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান উড়তে দেখা যায়না। এই অঞ্চলে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে অঞ্চলতা কেমন কালো চাদরে ঢেকে যায়। খানিক পর দূর থেকে একজনকে দেশলাই জ্বেলে এদিকে আসতে দেখলেই বোঝা যায় উনি আর কেউ নন, আলতাফ চাচা। নানার বাপেতা ছিলেন চার ভাই। আলতাফ চাচা তাদের মধ্যে বড়। আলতাফ চাচাই এই অঞ্চলে প্রথম সিগারেট ফোঁকা ধরেছিল। বিড়ি, হুকা অনেকেই নিত। কিন্তু সিগারেট? এ যে বিদেশীদের নেশা। সিগারেট বা অন্য কী কারণ – তা স্টহিক ভাবে কেউ বলতে পারে না, কিন্তু আলতাফ চাচাকে সন্মান করত সকলেই। তাঁর গলার স্বর ছিল মেঘের মত গুরুগম্ভীর। একবার হাঁক ছাড়লে গরু বাছুরেরও পিলে চমকে যেত। তিনি ‘হিন্দু’দের মত খাঁটি উচ্চারণে বাংলা বলতে পারতেন।
সেদিন রাতে নানারা সবে ভাত খেতে বসেছে। আচমকা মোটরগাড়ির শব্দে সকলেই চমকে উঠল। নানা ভাত খাওয়া রেখে উঠে এসে দেখন আমগাছটার তলায় একটা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারদিক অন্ধকার। তাঁর মধ্যে মোটরগাড়ির আলো ঘিরে পোকামাকড় বৃত্তাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। গাড়ি থেকে প্রথমে আলতাফ চাচা, তারপর আরও দুজন ইংরাজ নামল। তাদের দেখিয়ে আলতাফ চাচা বললেন, এনারা আজ এখানেই থাকবেন। শোবার বন্দবস্ত করো।
এত রাতে এসেছে, তাও আবার পরদেশী, এরা কেউ খায় তাও কেউ জানেনা। এদিকে গ্রামসুদ্ধু লোক মোটরগাড়ির আওয়াজ শুনে কেউ লম্ফ, কেউ হ্যাজাক জ্বেলে দেখতে এসেছে। দলিজে উঠে আলতাফ চাচা একবার হাঁক ছাড়লেন। তারপর ইংরাজ দুটোকে সঙ্গে নিয়ে অন্দরে ঢুকে গেলেন।
অত রাতেই কথা থেকে মুরগী এনে জবাই করা হল। সাহেবরা নাকি তরকারিতে মশলা পছন্দ করেন না। নানী আলতাফ চাচার কথামত মুরগী রাঁধলেন। আলমারি থেকে সুতোর নক্সা কাঁটা ওয়ার বার করে বালিশে লাগালেন। তা দেখে সাহেবরা তাজ্জব। পরের দিন ভোরবেলা নানা বাগান থেকে এক কাঁদি কলা আনিয়ে ছিলেন। সাহেবরা পুরো কাঁদিটা সাবার করে তবে উঠলেন। যাবার সময় আলতাফ চাচা তাদের বালিশের ওয়ার দুটো দিয়ে দিয়েছিলেন।
আলতাফ চাচা সারা জীবনে বিয়ে থা করেননি। ইন্তেকালের আগে ঘরটা নানার ছোট ভাইকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তারা সকলেই কলকাতায় থাকে। তাই ঘরের দরজায় তালাচাবি দেওয়া।
আমি একা একা দোতলায় উঠে দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভতেরটা দেখবার চেষ্টা করতাম। ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে কখনো একফালি রোদ এসে পড়লে ঘরের লাল মেঝেটাই খালি দৃষ্টিগোচর হয়। শুনেছি আলতাফ চাচার একটা দম দেওয়া গ্রামোফোনও ছিল। চিলেকোঠার ঘরটায় নাকি নাকি সেই সময়কার কতকগুলো ভাঙা রেকর্ড এখনও পড়ে আছে। কেন জানি না সেই রেকর্ডগুলোর দেখার খুব সখ হল আমার। কিন্তু ছাদে যাবার সিঁড়িতে মস্ত বড় একটা মৌমাছির চাক। দোতলার বারান্দা থেকে মৌমাছি ওড়ার গুনগুন আওয়াজ পাওয়া যায়। একবার উঁকি মেরে দেখেছি মৌচাকটাকে ঘিরে বিন্দু বিন্দু অন্ধকার প্রহরীর মত গুনগুন শব্দ তুলে জেগে রয়েছে। সারা গা শিউরে উঠেছিল।
এদিকে নানীর বাড়ি আসার পর থেকে রাক্ষসী একনাগারে কেঁদেই চলেছে। নানী বুড়ো মানুষ। মা বিরক্ত হয়ে উঠলে তিনি তবু কোলে তুলে গান গাইতে গাইতে ঘুম পারাবার চেষ্টা করেন। কখনো রাক্ষসী খানিক থামে। তারপর দম নিয়ে যেন আরও জোর চিৎকার শুরু করে।
কয়দিন পর রাক্ষসীর কান্নার আসল কারণটা জানতে পারলাম।
এখানে আসার পর, মা নানীর সাথে চুক্তি করে রাক্ষসীকে বুকের দুধ ছাড়াবার বিভিন্ন পন্থা নিয়েছিল। এদিকে রাক্ষসী তো মায়ের দুধ খেয়েই বড় হয়েছে। এখন মায়ের দুধ খাওয়া যেন তার নেশা। সে কিছুতেই বোতলের দুধ টানবে না। আবার খিদের জ্বালায় চুপ মেরে থাকতেও পারে না। মা প্রথমে দুধের বোঁটায় করোলার রস লাগিয়ে চোষাতে যেত। সেই তিতো স্বাদ রাক্ষসীর সহ্য হত না। তখন কাঁদলেই মা বোতলের নিপিলটা জোর করে তাঁর মুখে ঢুকিয়ে দিত। গাল ভর্তি দুধ নিয়ে সে বিষম যেত। তবু বোতলের দুধ আর টানতো না। এখন সে কেমন ঠোঁট বন্ধ করে কাঁদতে শিখেছে।
এতেও রাক্ষসীকে জব্দ করা গেল না বুঝে মা অন্য রাস্তায় গেল।
রোজার মাসে ইফতারে আমরা তোকমারির সরবত খেতাম। চিনি গোলা পানিতে খানিকটা তোকমারি আগে থেকে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পানিতে ভিজে গেলে তোকমারির কালো কালো দানাগুলো সিকনির মত থকথক করে। এখন সেই তোকমারির থকথকে কালো দানা মা বোঁটার চারধারে মাখিয়ে রেখেছে। রাক্ষসী দুধ চাইলেই সেই স্তন তার ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয়। রাক্ষসী হয়ত ভাবে দুধের চারধারে কালো কালো পোকা গিজগিজ করছে। সে ভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কঁকায়।
সবে সে বসতে শিখেছে। এখন আর ভয়ে সে মায়ের কাছে যেতে চায়না। মা বুঝি তাঁকে কাঁদাবার ছলেই জোর করে কোলে নিতে চায়। রাক্ষসী কেঁদে ওঠে। মা কখনও এমনি এমনি তাঁর চোখের সামনে তোকমারি মাখানো দুধ বার করে হাসে। এসবে মা যেন নতুন খেলা পেয়েছে। এখন মাকে বালিকার মত দেখায়। নানী রাক্ষসীকে কোলে তুলে গান গাইতে গাইতে বোতলের দুধ দেয়। রাক্ষসী আর রা করে না।
সে বোতলের দুধ খাওয়া শুরু করেছে। তবু তার হিংস্রতা এতটুকু কমেনি। সে কারণে অকারণে খালি জেদ ধরে। মায়ের থেকে নানীর কোলেই থাকে বেশীক্ষণ।
সেদিন সকালবেলা নানার সঙ্গে দলিজে বসে আছি। দেখি একজন বুড়ো মত লোক পা পর্যন্ত পিরান পরে মাঠ পেরিয়ে এদিকে আসছেন। তিনি এসে নানাকে সালাম জানালেন। সালাম জানিয়েই দলিজে বসে নানার সাথে টুকটাক কথা বলতে শুরু করলেন।
লোকটির নাম লিয়াকত আলি। ইনি পূর্বে এই গ্রামেরেই বাসিন্দা ছিলেন। ছোটবেলায় এতিম হয়ে গেলে সত্যপীরের মাজারে থেকে বড় হয়েছেন। পর পর তিন মেয়ে জন্ম দেবার পর নানী আবার যখন গর্ভবতী হলেন, সেবার ছেলে পাবার আশায় নানা সত্যপীরের মাজারে গিয়ে চাদর চড়িয়ে ছিলেন। সেই সূত্রেই লিয়াকত আলির সঙ্গে নানার ঘনিষ্টতা হয়। কিন্তু এখন নানাকে কেমন আড়ষ্ট দেখাচ্ছে। বুঝি বা তিনি লিয়াকত আলির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে আর আগ্রহী নন। তবে এত সবে লিয়াকত আলি কিছু এসে যায় না। তিনি আপন মনেই কখনো মাদার শাহ, কখনও আবার নিজের জীবনের গল্প শোনান। তাঁর কথাতেই জানতে পারি, এখন আর তিনি সত্যপীরের মাজারে থাকেন না। বড়পীরের মাজারই তাঁর আস্তানা। তিনি বলেন – লেকিন মাদার শাহের সহিত বড়পীরের একদিন বহুত হুজ্জত বাঁধল। মাদার শাহ কইলেন –
আচ্ছা ভাই এইখানে সিরনি রাখিয়া
আমরা তকরির করি একত্রে মিলিয়া
শত্ত একবার করো তুমি মোর সাথে
হারিলে গর্দ্দান জুদা নাহি হবে তাতে।
এইভাবে তিনি মাদার শাহের সহিত বড়পীরের লুকোচুরি খেলার বর্ণনা শুরু করলেন। এই খেলায় ঠিক হল, বড়পীর জয়ী হলে তবে মাদার শাহ তাঁকে গুরু রূপে স্বীকার করে নেবেন। প্রথমে বড়পীরের পালা। তিনি দরিয়াতে মাছের পেটের ডিমের ভেতর লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু মাদার শাহ ঠিক তাঁর সন্ধান পেয়ে গেলেন। এবার মাদার শাহের পালা। কী করবেন তিনি? দুনিয়ার সবদিকে, আমটি আসমান সবখানে যে বড়পীরের নজর ছড়ানো। যেখানেই লুকাও বড়পীর ঠিক হদিস পেয়ে যাবেন। না, মাদার শাহ অন্য কোথাও গেলেন না। তিনি অশরীরি রূপ ধরে বাতাসের মত বড়পীরের নিঃশ্বাসের সহিত মিশে গিয়ে বড়পীরের শরীরে ঢুকে গেলেন –
হাওয়া ভবে ছোপাইনু নিঃশ্বাস টানিতে
হাওয়ার সামিল আছি তোমার দমেতে।
এদিকে খেয়াল করিনি, রাক্ষসীকে কে নানার কোলে দিয়ে গেছিল। সে আচমকা কেঁদে উঠলে লিয়াকত আলি গল্পটা মাঝ পথেই থামিয়ে দিলেন। এখন দুপুর। লিয়াকত আলির তবু উঠবার কোন ইঙ্গিত নেই। নানা বুঝেছেন আজ দুপুরে লিয়াকত আলি এখানে ভার খেয়ে তবে যাবেন।
এত কথার মালিক এই লিয়াকত আলি, ভাত খাবার সময় কিন্তু কোন কথা বললেন না। যেন তিনি কতদিন পর গৃহস্থের বাড়িতে খেতে বসেছেন। ভাতের প্রতিটা দানা আয়েস করে চিবিয়ে যাচ্ছেন। মা, নানী কেউ লিয়াকত আলির সামনে আসেনি। লিয়াকত আলি এখানে খাবে শুনে নানী বলেছিলেন, লোকটা এখেনে এইচে কেন? এই বুড়ো বয়েসে উনি না আবার এনার খপ্পরে পড়ে।
আসলে ছেলে পাবার আশায় নানা যখন সত্যপীরের মাজারে প্রায়ই যেতেন, সেই সময় লিয়াকত আলির সঙ্গে তাঁর গোপনে বার্তা বিনিময় চলত। তিনি সময় পেলেই কারবারে লালবাতি জ্বেলে মাজারে গিয়ে লিয়াকত আলির সাথে মোলাকাত করতেন। তাদের মধ্যে কী যে কথা হয় তা কেউ জানে না। নানা খালি ফকিরের মত সারাদিন বসে বসে কীসব ভাবেন। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, ওসব কথা মেয়েমানুষের লেগে নয় গো।
নানী যতই বলেন, অত পীরের মাজারে যাও কেন? ওরা ঝাড়ফুঁক জানে। পীরের মাজারে গে মাথা ঠোকা মোছলমানদের লেগে হারাম।
মৌলবই ডেকে অনেক দোয়াদরুদ করার পর তবে নাকি নানার মতিগতি ফিরেছিল। নানী এখনও বিশ্বাস করেন, লিয়াকত আলির কুনজরে এসে পড়াতেই তিনি সেবার মৃত সন্তান প্রসব করেছিলেন। শুধু তাই নয়, নানার পায়ের ঘাটাও দারোগায় গিয়ে মাথা ঠোকার ফল।
লিয়াকত আলি এখন ভাত খেয়ে কুলকুচি করছেন। মুখে পানি দিতে দিতেই তিনি চারধারে তাকিয়ে কী যেন ভাবেন। এই প্রথম লিয়াকত আলির সুরমাটানা চোখ দুটোকে খুব কাছ থেকে দেখে ছিলাম। রসুনের তেল চোখে পড়লে চোখ দুটো যেমন লাল হয়ে যায়, তেমনি লাল টকটকে দুই চোখের রঙ। দেখলেই বোঝা যায় লোকটা ঝাড়ফুঁক জানে। কিম্বা লোকটার পোষা জ্বিন আছে। তাদের বশে এনেই তিনি তাঁর কাজ হাসিল করিয়ে নিতে পারেন।
লিয়াকত আলি চলে যাবার পর নানার যেন অশান্তি কাটল। কিন্তু মায়ের আর থির নেই। আমি আর রাক্ষসী দুজনাই লিয়াকত আলির নজরে এসে গেছি। এবার বুঝি আমার না হয় তো রাক্ষসীর পালা। নানীরও সেই একই ভয়। তিনি নানাকে সব দোষ দিয়ে বললেন, সাঁঝের দিকে মলিসাবকে আসতে বলে এস। কচি কচি বাচ্চাদের যদি কিছু হয় মেয়ের বাড়ি মুখ দেখাব কী করে? বলি মলিসাবকে ভালো তাবিজমাদলি দিতে বল গে।
বিকেলে দেখি হুলস্থুল কান্ড। জনা কুড়ি লোক দলিজে জড়ো হয়েছে। শুনলাম লিয়াকত আলি নাকি সারা গ্রামে বলে বেরিয়েছেন তিনি মৌমাছির ভাষা বুঝতে পারেন। এখন তিনি আবার এখানে আসবেন। এখানে এসে ছাদের সিঁড়িতে হওয়া মৌচাকের সামনে দাঁড়িয়ে মৌমাছিদের সাথে কথা কইবেন। এই মৌমাছিরা নাকি লিয়াকত আলিকে কোন গূঢ় কথা জানাতে চায়। সাহস থাকলে যে কেউ দাঁড়িয়ে থেকে সেইসব কথা শুনতে পারে। তবে এতে ভ্যের কিছু নেই। লিয়াকত আলি বারণ করলে মৌমাছিরা কাউকে কামড়াবে না। এমনকি তিনি ইচ্ছা করলে এক ঝাঁক মৌমাছি গায়ে নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরতে পারেন।
ক্ষণে ক্ষণে আরও মানুষ জড়ো হচ্ছে। কিন্তু আমাকে মা কিছুতেই বাইরে যেতে দেবে না। ঘর থেকেই বুঝতে পারছি বাইরে অনেক লোক। এদিকে এসব শুনে নানা সেই যে বাইরে বেরিয়েছিলেন এখনও তিনি ফেরেন নি। মা রাক্ষসীকে এই ঘরে রেখে নানীর সাথে শলা পরামর্শ করতে বেরিয়ে গেল। বাইরে থেকে দরজাটা ভেজানো। আমি আর রাক্ষসী আখন একই ঘরে।
চেয়ে দেখি রাক্ষসী খাটের উপর বসে আছে। চাদরের এক কোণে মিষ্টির রস লেগে লাল পিঁপড়ে গিজগিজ করছে। সে একবার আমার দিকে তাকায়। একবার চাদরের খুট ধরে টানে। চাদরে টান পড়ায় পিঁপড়ে গুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কয়েকটা পিঁপড়ে রাক্ষসীর পা বেয়ে উপরে উঠছে।
মনে হল ওকে এখানে রেখেই পালিয়ে যাই। তাঁর কাছে যেতেই দেখি, সে বিছানায় হিসু করে ফেলেছে। তাঁকে কোলে তুলে প্যান্টটা খুলে দিলাম। তারপর মেঝেয় বসিয়ে নতুন প্যান্ট নেব বলে যেই এগিয়েছি দেখি সে উবু হয়ে বসে হামা দিতে চাইছে।
দলিজে বেশ কিছু লোকের গমগম আওয়াজ পাচ্ছি। বুঝতে পারলুম নানার কথা শুনে মুরুব্বিরা এসে লিয়াকত আলিকে এখানে ঢুকতে বাঁধা দিয়েছে। যারা মৌমাছির সঙ্গে লিয়াকত আলির কথোকথন শুনতে ভিড় জমিয়েছিল তারা তাই কোলাহল করে ফিরে যাচ্ছে।
সেই সন্ধ্যায় একজন মলিসাব এসে দোয়াদরুদ পড়ে তাবিজ দিয়ে গেল। আমি সেই তাবিজখানি গলায় ঝুলিয়েছি। রাক্ষসী ছোট, গলায় তাবিজ পরালে সে তাবিজটা চুষবে, তাই কালো কাড় দিয়ে তাবিজখানি তার কোমরে ঝোলানো হয়েছে। রাতের দিকে একজন লোক মৌচাকটা ভাংতে এল।
শোনা যাচ্ছে লিয়াকত আলি গ্রাম ছেড়ে আবার বড়পীরের মাজারে রওনা দিয়েছেন। আমি তবু লিয়াকত আলির সেই লাল টুকটুকে চোখ দুটোর কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। দাদাজী বলতেন কোকিলের চোখও নাকি লাল। তবে কি লিয়াকত আলির চোখ দুটো আসলে কোকিলের চোখ?
নানীর অনুমান লিয়াকত আলির জন্যই তিনি সেবার মৃত সন্তান প্রসব করেছিলেন। কথাটা হয়ত সঠিক! তা না হলে প্রসবের আগের দিন তিনি কেন ভ্রূণটির নড়াচড়া টের পেতেন? এখন জানতে ইচ্ছা করে সেই না-জন্মানো ভ্রূণটি পুরুষ ছিল, না কি মেয়ে? কে জানে লিয়াকত আলিও বুঝি মাদার শাহের মত অশরীরি রূপ ধারণ করতে পারে। তিনি হয়ত হাওয়ার মত নানীর নিঃশ্বাসের সাথে মিশে ফুসফুসে আঁটকে আছেন এখন। যেন তিনি সকলের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। খেলায় জয়ী হলে পর আবার শরীরী রূপ ধরে বলবেন –
লাড়কারা আজ তক খেলে লুকোচুরি
লাড়কার মজলেছে ভাই আছেত মাসুরি।
দাদাজীর মৃত্যুর পর ইউনুস মৌলানা বলেছিলেন, সত্যিকার পরেজগার এলেমঅলা মানুষেরা ইন্তেকালের ঠিক পূর্বে দুনিয়ার শুরু থেকে আখরি অব্দি এক লহমায় সব কিছু দেখতে পান। দাদাজী সামান্য মানুষ, তাই বুঝি তিনি মাত্র কয়েকশ বছর পিছিয়ে যেতে পেরেছিলেন। হয়ত মরবার আগে, যে ইংরাজ দুটো নানাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তাদের সঙ্গেও ওনার মোলাকাত হয়েছিল!
পেছন ফিরে দেখি মা হাততালি দিয়ে রাক্ষসীর হামাগুড়ি দেওয়া দেখছে।বুকের ভেতরটা ছ্যাক করে উঠল। এসব কী ছাইপাশ ভাবছি আমি? কেন খালি দাদাজীর কথা, সেই ইংরাজ দুটোর কথা এইসবই মনে আসছে? মৌচাকটা এতক্ষণে ভাঙা হয়ে গেছে। কই সেই কথাটা তো একবারও ভাবিনি। তবে কি আমাদের উপর বিছানো রাক্ষসীর অদৃশ্য বলয়ের মধ্যে একা আমিই আঁটকে গেছি!
নাকি এইসব কিছুই আসলে একটি অখন্ড বিস্তার। আর সেরকম হলে হয়ত লিয়াকত আলিও কখনো সকলের সামনে সুবিশাল মৌচাকের নিকটে দাঁড়িয়ে মানুষের ভাষায় পতঙ্গদের সহিত কথা কইবেন। তারপর এক ঝাঁক মৌমাছি গায়ে নিয়ে, ইংরাজ ঘর পেরিয়ে উঠোনে নেমে, উঠোন পেরিয়ে আমগাটার তলায় দাঁড়িয়ে আচমকা নিরাকার হয়ে যাবেন।
1 মন্তব্যসমূহ
এ মাসের সেরা গল্পের স্বীকৃতির বিজ্ঞাপন দেখেই গল্পটি পড়লাম। এটি কি ছোটগল্প? গল্পের পরিসরে তো তা মনে হয় না।
উত্তরমুছুন