দীপেন ভট্টাচার্য
আগের পর্বগুলির লিঙ্ক
আগের পর্বগুলির লিঙ্ক
অদিতা চোখ খোলে, সামনেই বড় কাচের জানালা। তার বাইরে সবুজ গাছের মাথা দেখা যায়, ওপরে সুনীল আকাশ। একদল পাখী সেই আকাশে ঘুরছে, ঘুরছে পাক খাচ্ছে। বাইরের বাতাস এই ঘরে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু গাছের মাথা আন্দোলিত হচ্ছে, নতুন দিন এসেছে। অদিতা প্রথমে বুঝতে পারে না সে কোথায় আছে, তারপর অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে গতকাল রাতে সে এসেছিল তার মস্তিষ্ককে কপি করাতে নিলয়ে। কপি করার আগে তাকে অচেতন করে দেয়া হয়েছিল, ডকটর তারকার বলেছিল, ‘আপনি এখন দশ ঘন্টা ঘুমাবেন। এর প্রথম পাঁচ ঘন্টায় আপনার মস্তিষ্ক পুরো অচেতন থাকবে, পরের পাঁচ ঘন্টায় স্বপ্ন দেখবেন। সকালে যখন উঠবেন সামনের দেয়ালে দিন-তারিখ ফুটে উঠবে। আপনি দেখবেন সন ৪৩৫৬, নভেম্বর ২৩, শুক্রবার। তবে ভবিষ্যতে আপনার যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে ঐ সনটা ৪৩৫৬ হবে না সেটা বুঝতেই পারছেন। আপনার এই মস্তিষ্কই জেগে উঠবে ভবিষ্যতের ঐ তারিখে।’
স্বপ্ন সত্যিই দেখেছে অনেক অদিতা, মনে হয় অনন্তকাল ধরে। পাখীগুলোর থেকে সে দৃষ্টি সরিয়ে আনে ঘরের মধ্যে। ঘরটার দেয়াল হালকা গোলাপী রঙের, দেয়ালে চোখ পড়তেই তাতে বেগুনী রঙে ফুটে ওঠে আজকের তারিখ - সন ৪৩৫৯, অক্টোবর ২১, বুধবার। মুহূর্তে আড়ষ্ট হয়ে যায় অদিতার শরীর। তিনটি বছর!! তিনটি বছর তার জীবন থেকে চলে গিয়েছে! তিনটি বছর সে ঘুমিয়ে ছিল নিলয়ের নিচে এক অন্ধকার সংরক্ষণাগারে, আরো লক্ষ লক্ষ মস্তিষ্কের সঙ্গে। কিন্তু তার থেকে বড় কথা সে মৃত্যুবরণ করেছে। কি হয়েছিল তার, কিভাবে সে মারা গেল? নিজের মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কঠিন।
কি করেছে সে এই কটা বছর? সে নয় - আর এক অদিতা, এক ভিন্ন অদিতা। আর সে নিজে আসল অদিতা নয়, এক কপি-করা অদিতা। কপি-করা জিনিসের কি বাঁচার অধিকার আছে? ঘাম ঝরে, শুয়ে থেকেও মাথা ঘুরাতে থাকে অদিতার।
ছুটে আসে স-কুরা পাশের ঘর থেকে। ‘আপনি জেগে উঠেছেন,’ উল্লসিত কন্ঠে বলে স-কুরা। জৈবিক রোবট স-কুরা মানুষের প্রতিটি অনুভূতির অধিকারী। স-কুরা দাবী করে তার মানবিক ব্যাপারগুলো মানুষের চাইতে অনেক বেশী সূক্ষ্ণ। তার সঙ্গে মাত্র গতকালই পরিচয় হয়েছে অদিতার, ভাল লেগেছে এই মানুষটিকে অদিতার - যদিও তাকে মানুষ বলা কতটুকু সঙ্গত সে ভেবেছে। ‘যাক বাঁচা গেল, সবকিছু একদম ঠিকঠাক, আপনি একটু বিভ্রান্ত আছেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক। নতুন করে বেঁচে ওঠা কি চাট্টিখানি কথা।’ স-কুরার ভাষাটা ঠিক আধুনিক নয়, একটু সেকেলে, কিন্তু তার মধ্যে একটা আভিজাত্য আছে। এই জিনিসটা গতকালই খেয়াল করেছে অদিতা।
কিন্তু গতকাল তো গতকাল নয়, গতকাল পার হয়ে গেছে কতকাল। দেয়ালের তারিখটার দিকে তাকায় আবার অদিতা। সে নিলয়ে ঢুকেছিল গতকাল ৪৩৫৬ সনের নভেম্বর মাসে, এখন ৪৩৫৯ সনের অক্টোবর। তিনটি বছর পার হয়ে গেছে। এই তিনটি বছর সে অচেতন হয়েছিল নিলয়ের ভূ-গর্ভস্থ্য সংরক্ষাণাগারে। না, অচেতন হয়ে ছিল না, ধীরে ধীরে তার দুঃস্বপ্নগুলো মনে পড়তে থাকে। এই তিন বছর ধরে সে স্বপ্ন দেখেছে, সেই স্বপ্নে ধীরে ধীরে আর একটি জগৎ তৈরি হয়েছে। বিশাল সেই জগৎ, দুঃস্বপ্নের জগৎ। স-কুরা যেন অদিতার মনের কথাগুলো ধরতে পারে, সে অনেক মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন করেছে, সে জানে সংরক্ষাণাগারে মস্তিষ্করা স্বপ্ন দেখে। প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াটা বোঝে নি, তারা সংরক্ষিত মস্তিষ্কর স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পরে তারা বুঝতে পারে মস্তিষ্কর নিজের বাঁচার জন্য স্বপ্ন দেখার প্রয়োজন আছে। কিন্তু স-কুরা জানে সেই স্বপ্ন সাধারণতঃ দুঃস্বপ্ন হয়।
স-কুরা বলে, ‘আজ কেমন সুন্দর দিন দেখছেন, বাইরে পাখী উড়ছে। আপনার জন্য যেন উড়ছে।’ স-কুরার কন্ঠ উজ্জ্বল দিনের মত, শুনলেই মন ভাল হয়ে যায়। বাইরে পাখীগুলো তখনো চক্রাকারে উড়ছিল। অদিতা জিজ্ঞেস করে, ‘ওরা কি বক?’ নতুন জীবনে অদিতার প্রথম কথাগুলো হল এই তিনটি শব্দ। স-কুরা বাইরে তাকায়, ওর গাঢ় ধূসর চোখের মণিতে নীল আকাশ প্রতিবিম্বিত হয়। সে বলে, ‘তা বলতে পারেন। ওদের বলা হয় ধবল মাণিকজোড়।’
স-কুরা জানে অদিতা সবধরণের পাখিই চেনে। বনবিজ্ঞানী অদিতার অজানা কিছুই নেই। তবে স-কুরা এটাও জানে যে মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের পরে প্রথম দিনটিতে কপি-করা মস্তিষ্ককে দেহের সঙ্গে স্নায়বিক যোগাযোগ স্থাপনে সময় দিতে হবে। স-কুরা বলে, ‘ওরা হিমালয় পার হয়ে এসেছে।’ অদিতা বালিশের ওপর মাথাটা নাড়িয়ে সায় দেয়, তার এখ্ন সব মনে পড়ছে।
অদিতা বলে, ‘আমার হৃদপিণ্ডটা কি নতুন?’ স-কুরা এই প্রশ্নটি আশা করে নি, সে ভেবেছিল অদিতা জিজ্ঞেস করবে, ‘আমি কেমন করে মারা গেলাম?’ কিন্তু বিচক্ষণ অদিতা তার বুকের ক্ষত অনুভব করেছিল, ধরে নিয়েছিল তার পুরনো হৃদপিণ্ডটা একেবারেই অচল হয়ে গিয়েছিল। সেই জন্য শরীরের ন্যানোযানরা কিছুই করতে পারে নি। তবে ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারে অদিতার জন্য নতুন হৃদযন্ত্র সৃষ্টি করতে বেশী সময়ের প্রয়োজন হয় নি। স-কুরা আর ডকটর তারকার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের আগে নতুন হৃদযন্ত্রটি অদিতার বুকে বসিয়েছিল। স-কুরা অদিতার প্রশ্নের উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ।’
‘পুরনো অদিতার রইল কী?’, ভাবে অদিতা। নতুন মাথা, নতুন হৃদয়। সেই অদিতা কী করেছে গত তিন বছর? নতুন কিছু আবিষ্কার করেছে, নতুন কারো প্রেমে পড়েছে, ছেলে সেনভার সঙ্গে কি যোগাযোগ আছে? ঈর্ষা হয় অদিতার, নতুন কি না জানি সেই অন্য অদিতা দেখেছে। কিন্তু এসব ছাপিয়ে একটা বেদনা ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে মনের ভেতরে ঢোকে, বেদনাটা কিসের জন্য বোঝে না। বাইরের নীল আকাশটা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যেতে থাকে। নতুন হৃদপিণ্ডে সেই ব্যথা সঞ্চারিত হয়। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে যেমন হারিয়ে যাওয়া সময়ের জন্য মন কাঁদে তেমনই যেন হল। তার মা’র জন্য, সেনভার জন্য, পুরনো সব প্রেমিকদের জন্য একটা বিষন্ন বোধ তাকে আচ্ছন্ন করে। ‘আমি কি আত্মহত্যা করেছিলাম, স-কুরা?’ কথাগুলো নিজের অজান্তেই যেন অদিতার মুখ দিয়ে বের হয়।
স-কুরা এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল। সে বলল, ‘আপনার হৃদপিণ্ড ভেদ করেছিল এক প্রাচীন তীর। আমাদের মনে হয় না আপনার একার পক্ষে ঐ তীর বুকের মধ্যে গাঁথা সম্ভব। তবে আত্মহত্যা করবার জন্য আপনি যদি কাউকে নিয়োজিত করে থাকেন সেটা অন্য ব্যাপার।’ একটু চুপ থেকে স-কুরা বলে, ‘তবে আমি শুনেছি আপনি জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য চেষ্টা করছেন। পরিচালনা কমিটির কাছে আবেদন করেছেন। ডকটর বিনতা - যিনি আপনাকে গতকাল নিলয়ে নিয়ে এসেছিলেন - উনি বললেন - আপনি চির-মৃত্যুর জন্য ওনার সুপারিশ চেয়েছেন।’
ডকটর বিনতা? খুব আবছাভাবে বিনতার মুখটা ভেসে ওঠে আদিতার মনে। ডামুরির নতুন চিকিৎসক, দু-একবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অন্য অদিতা তাহলে চেষ্টা করেছে তাকে যাতে আর পুনরুজ্জীবিত না করা হয়। কিন্তু তার প্রচেষ্টা সফল হয় নি। এই যে সে আবার ফিরে এসেছে। দুঃখবোধ, বিষন্নতা অদিতাকে অবশ করে দেয়, সেই অবশতায় তার মনে হয় বাঁদিকে ঘরের এক কোনায় দেয়ালের গোলাপী রঙের সামনে এক কালো কুয়াশা ঘনীভূত হচ্ছে। তার চোখের কোনায় সেটা যেন ধরা পড়ে। অদিতা আশ্চর্য হল যে স-কুরা কেন সেই কুয়াশাটা দেখতে পাচ্ছে না। কুয়াশা নয়, ঘন অন্ধকার মেঘ। ঘরে কি কখনো মেঘ জমে? অদিতা স-কুরাকে ডাকতে যাবে এমন সময় ডকটর তারকার ডানদিকের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। তারকারের দিকে মুহূর্তখানেক চোখ রেখে আবার বাঁদিকে তাকিয়ে অদিতা দেখে সেই মেঘ অন্তর্হিত হয়েছে। অন্ধকার মন মেঘ তৈরি করেছে।
অদিতা তারকারের বয়স অনুমান করতে চাইল, তার থেকে হয়তো বছর বিশেক বড়ই হবে তারকার। গোলগাল সহৃদয় মুখ, সেই সহৃদয়তার প্রমাণস্বরূপ এক গাল হাসি। তারকার উচ্চস্বরে বলল, ‘অদিতা সান, আপনাকে ৪৩৫৯ সনে সুস্বাগতম। আমি জানি আপনার জন্য এটা একটা কষ্টকর সময়, বিশেষতঃ যখন আপনার জীবন থেকে তিনটি বছর হারিয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের জীবনের সামনে অনেক পথ পড়ে আছে, ঐ তিনটি বছর সহজেই পুষিয়ে নেয়া যাবে।’
বুকের ভেতর বেদনাটা আবার ফিরে আসতে শুরু করে। তাকে আবার জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। অদিতা নিশ্চিত যে আর এক অদিতা - যে অদিতা মারা গেছে - সে এইভাবে ফিরে আসতে চায় নি। হৃদপিণ্ড আর মস্তিষ্ক বাদে বাকি শরীরে সেই অদিতা যেন ঐরকম ‘না ফেরার’ একটা ইচ্ছা রেখে গেছে।
ডকটর তারকার বলে, ‘আপনাকে একটা কথা আমার বলার আছে, কথাটা বলা হবে কিনা সেটা নিয়ে আজ সকালে অধ্যাপক বিষাণের সঙ্গে আমার একটা মিটিং হয়েছে।’
বিষাণ? বিষাণ এখানে? তারপর অদিতার মনে হয় বিষাণের গবেষণাগার নিলয়ের পাশেই। বিষাণ এই পৃথিবীর একজন অগ্রগণ্য মস্তিষ্ক বিশারদ।
‘প্রফেসর বিষাণ নিজেই আপনাকে বলতেন, কিন্তু এই মুহূর্তে উনি আর একটি মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন কাজে আমাদের সাহায্য করছেন। আমরা আর একটু অপেক্ষা করতে পারতাম, কিন্তু আমাদের হাতে মনে হয় বেশী সময় নেই।’
অনেক কিছু ঘটে গেছে এই তিন বছরে, ভাবে অদিতা, কিন্তু সে জানে না কি ঘটেছে।
‘আপনাকে গতকাল ডামুরির বন থেকে উদ্ধার করা হয়। সেই উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেন ডকটর বিনতা। আপনার দেহ তীরবিদ্ধ অব্স্থায় ডামুরি অরণ্যের একটা হ্রদের ধারে পাওয়া যায়। ডকটর বিনতাই আপনাকে নিলয়ে নিয়ে আসেন। আমরা প্রফেসর বিষাণকে ডাকি পরমার্শের জন্য কারণ আপনি গত পাঁচ বছর হল চিরমৃত্যুর আবেদন করে যাচ্ছেন। আপনার এই মস্তিষ্কও সেই মৃত্যু কামনায় আচ্ছন্ন, আমাদের ভয় ছিল প্রতিস্থাপনের পর এই মস্তিষ্ক আপনার দেহকে প্রত্যাখান করতে পারে।’
না, কপি-করা মস্তিষ্ক তার দেহকে প্রত্যাখ্যান করে নি। হতাশায় মূহ্যমান হয়ে পড়ে অদিতা। কিন্তু কে তাকে হত্যা করতে পারে সেটাও ভাবে।
তারপর তারকার বলে, ‘গতরাতে যখন সু-করা এবং আমি আপনার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন করছিলাম তখন ডকটর বিনতাকে এই নিলয়ের খুব কাছেই হত্যা করা হয়েছে।’
অদিতার চোখ বিস্ফারিত হয়, হৃদপিণ্ড প্রায় থেমে যায়। তারকার বলতে থাকে, ‘একটা ধারাল ছোরা দিয়ে তাঁর হৃদপিণ্ডকে ভেদ করা হয়েছে। আততায়ীরা জানে কিভাবে ন্যানোরোবটদের পরাস্ত করতে হয়, হৃদপিণ্ডকে অত দ্রুত মেরামত করার ক্ষমতা তাদের নেই। ঐ সময়ে খুনীরা স্থানীয় সমস্ত বেতার তরঙ্গ জ্যাম করে দেয় যার ফলে এই হত্যাকাণ্ডের কোনো দৃশ্যই আমাদের সংগ্রহে নেই। আপনার মৃত্যুর সঙ্গে এই হত্যার অনেক মিল আছে, আমরা নিশ্চিত এই দুটি হত্যাকাণ্ড জড়িত। আমাদের মনে হয় আততায়ীরা চায় নি বিনতার কাছ থেকে তারা কি চেয়েছিল সেটা আর কেউ জানুক। তবে হত্যার পরপরই তারা বেতার জ্যাম তুলে নেয়, তারা চেয়েছিল আমরা যাতে বিনতার দেহ খুব তাড়াতাড়িই খুঁজে পাই। ডকটর বিনতার মস্তিষ্ক দুবছর আগে কপি করা হয়েছিল। নিলয়েরই আর একটি ঘরে এই মুহূর্তে তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন হচ্ছে।’
তারকার কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকে, তারপর আবার বলতে থাকে, ‘আপনাকে হত্যার দিনেই বিনতাকে হত্যা করা হল। হত্যাকারীরা ঠিকই জানত উনি আপনাকে নিয়ে বিশালগড়ে এসেছেন। এর পরে তারা অপেক্ষা করে কখন বিনতাকে একা পাওয়া যাবে। তারা বিনতার কাছ থেকে কোনো তথ্য চেয়েছিল। ঠিক কী তথ্য চেয়েছিল সেটা আমরা জানি না। তবে প্রফেসর বিষাণ একটা কম্পুটার সিমুলেশন করছেন সেটা সম্ভাব্যতা তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তারা বিনতার কাছে কি চেয়েছিল সেটা বার করার চেষ্টা করবে।’
বিষাণ! কতদিন বিষাণের সঙ্গে দেখা হয় নি ভাবে অদিতা। দশ বছর? বিশালগড় ডামুরি থেকে খুব একটা দূরে নয়। সবাই চলে গেছে - মা, সেনভা, বিষাণ। সে তার অরণ্য নিয়ে ছিল, কিন্তু আর কতদিন? মাদ্রে দে দিয়স নদীর বৃষ্টিভেজা আমাজন অরণ্যে তার কান্নার কথাটা এবার মনে পড়ল। চাঁদে হারিয়ে যাওয়া সেনভা কি এখনো বেঁচে আছে?
‘ডকটর তারকার, আমি যদি আবার মারা যাই তাহলে কী হবে? আমার ছ’বছর আগের মস্তিষ্কটা ব্যবহার করা হবে?’
‘হ্যাঁ,’ উত্তর দেয় তারকার। আমরা দুটো মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করি। প্রতি তিন বছর অন্তর মস্তিষ্ক কপি করা হয়, কিন্তু দুটোর বেশী মস্তিষ্ক আমরা সংরক্ষণাগারে রাখি না।’
‘তাহলে আমি যদি ঐ ছ’বছর আগের মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের পর পরই মারা যাই তাহলে আমাকে আর পুনর্জীবিত করা যাবে না।’
‘না, তা যাবে না, তবে তার আগেই আমরা আপনার মস্তিষ্কের একটা কপি করে নেব।’
‘কবে করবেন?’ প্রশ্ন করে অদিতা।
‘নতুন মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের পরে অন্ততঃ ছ’মাস সময় দিতে হবে।’
তারকার বোঝে অদিতার মাথায় অনেক চিন্তা ঘোরা ফেরা করছে, তার মধ্যে মৃত্যুচিন্তাই মুখ্য।
‘আমি কি উঠতে পারি?’ জিজ্ঞেস করে অদিতা। ‘নিশ্চয়’, বলে তারকার।
অদিতা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে, সমতা রাখতে পারে না, পড়ে যাবার আগেই স-কুরা ঘরের আর এক কোনা থেকে একটা বড় লাফ দিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলে। অদিতা একটু অপ্রস্তুত হাসি হাসে। তারকার বলে, ‘আমারই দোষ, স-কুরাকে আগেই আপনার পাশে দাঁড়াতে বলা উচিত ছিল। আপনার মস্তিষ্কের সেরিবেলাম এত বছর পরে শরীরের সাথে সংযোগ স্থাপন করছে, সেরিবেলাম আমাদের ব্যালান্সের ব্যাপারটা দেখে।’
অদিতা এসব জানে। স-কুরার হাত ছেড়ে জানালার দিকে এগিয়ে যায়। জানালা দিয়ে দেখা যায় সামনে একটা ছোট বন। আকাশের বকরা কখন হারিয়ে গেছে।
পাশের দরজাটা খুলে যায়, ঘরে ঢোকে বিষাণ - তার মুখে উদ্বেগ। সে ভাবে নি অদিতা ইতোমধ্যে জেগে উঠেছে। কত বছর পরে অদিতাকে সে দেখছে? গুণতে চাইল, কিন্তু তার আগে কিছু বলা দরকার, কী অনুভূতি হচ্ছে সেটা পরে ভাবলেও চলবে। বিষাণ তারকার আর স-কুরাকে কম্পিত কন্ঠে বলে, ‘অদিতা সানকে এখুনি এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। ওনাকে কোনো বেতার-তরঙ্গ-নিরোধী ঘরে রাখা দরকার।’
অদিতার পাশে এসে দাঁড়ায় বিষাণ। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে ভাবে তাদের বয়স বেড়েছে। তাদের অতীতের ভালবাসা এখনো কতখানি বর্তমান? সারা রাত ঘুমায় নি বিষাণ। সেনভাকে তার মা’র মৃত্যু ও মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের খবরটা জানিয়ে ফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার এক মিনিটের মধ্যে তার ফোনে বিপদ সঙ্কেত বেজে ওঠে, ক্যাফেতেও একটা এলার্ম বাজে। বিনতার বিপদ হয়েছে। বিষাণের বাঁ হাতের কবজিতে ফুটে ওঠা মানচিত্রে বিনতার অবস্থানটা দেখা যায়। কাফে থেকে বের হয়ে দৌড়ে খুব সহজেই সে ফোয়ারার কাছে একটা গলিতে বিনতার দেহকে খুঁজে পায়। ততক্ষণে বিনতার হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে।
বিনতাকে খুন করার এক মিনিটের মধ্যে হত্যাকারীরা তারা যে বেতার সংকেত জ্যাম করেছিল সেটা তুলে নেয়। বিনতার দেহ যাতে কর্তৃপক্ষ খুঁজে পায় তারা সেটাই চেয়েছিল। অন্ততঃ তাই বিষাণের ধারনা। বিনতার দেহকে কয়েক মিনিটের মধ্যে নিলয়ে নিয়ে আসা হয়। কেন বিনতাকে হত্যা করা হয়েছে, বিনতার কাছে কি তথ্য হত্যাকারীরা চাইতে পারে এইসব প্রশ্ন করে একটা গণনার সিমুলেশন কম্পুটারে বিষাণ দিয়েছিল। তার ফলাফল সে সবে পেয়েছে।
বিষাণ অদিতার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হত্যাকারীরা ডকটর বিনতার কাছে তোমার নিরাময়-নম্বর ও পাসওয়ার্ড চেয়েছে এবং মনে হয় সেটা তারা পেয়েছে। নিরাময়-নম্বরে তোমার মস্তিষ্কের নিউরোকম্পাঙ্ক লেখা আছে, সেই কম্পাঙ্কের তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ দিয়ে তোমার মস্তিষ্ককে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব।’
বিষাণের কথা শেষ হতে না হতেই অদিতা মাটিতে পড়ে যেতে থাকে। স-কুরা ঘরের একদিক থেকে লাফ দিয়ে আবার অদিতাকে ধরে ফেলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ডকটর তারকার বিছানার পাশেই লাগানো একটা প্যানেলের বোতামে চাপ দেয়, মেঝে ফাঁক হয়ে যায়, অদিতার বিছানাটা নিচে নেমে যায়। বিষাণ হতবিহ্বল হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে, দেরী হয়ে গেল, কম্পুটারের গণনাটা আগেই করা উচিত ছিল। বিনতার হত্যাকারীরা বোধহয় অদিতার মস্তিষ্ককে অচল করে দিয়েছে। জানালার বাইরে তাকায় বিষাণ, বিশালগড়ের যেকোনো জায়গায় থাকতে পারে এই আততায়ীরা। তাদের নাম এখন জানে বিষাণ। কম্পুটার সিমুলেশন বলেছে বিনতাকে হত্যার পেছনে ‘লোহিতক’ নামে একটি দলের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা শতকরা ৮২%। ‘লোহিতক’ পুনর্জন্মের অবসান চায়, মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনকে বন্ধ করতে চায়, সমস্ত সংরক্ষিত মস্তিষ্কের ধ্বংস চায়। কিন্তু তারা কেন অদিতার ব্যাপারে এত আগ্রহী হবে? অদিতার সঙ্গে কি তাদের যোগাযোগ আছে? তারাই কি অদিতার চিরমৃত্যুর ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে চাইছে? জানালার বাইরে বনের ওপরে বিশালগড়ের নিশ্চিন্ত সুনীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বিষাণ। সেই আকাশের নিচে কোথাও লুকিয়ে আছে ‘লোহিতকের’ মানুষ, ষড়যন্ত্র করে তারা, বেতার তরঙ্গ দিয়ে অচল করে দিতে চায় হাজার বছরের অগ্রগতি। হঠাৎ অসহায় বোধ করে প্রফেসর বিষাণ, এরকম অসহায়ত্ব সে বোধ করেছিল চাঁদে সেনভা যখন হারিয়ে গিয়েছিল। আর এখন মনে হয় সবাই এরকমভাবে হারিয়ে যাবে।
0 মন্তব্যসমূহ