দীপেন ভট্টাচার্য
১. কয়লা ও কাহিনী
আজ থেকে পনেরো কোটি বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশ দক্ষিণ গোলার্ধে আফ্রিকার সাথে মিশে ছিল। তারও কোটি কোটি বছর পূর্বে তার জমিতে শায়িত হয়েছিল জলাভূমির উদ্ভিদ, ধীরে ধীরে সেই উদ্ভিদ স্তরের ওপর পড়েছিল নতুন মাটির স্তর। অবশেষে সেই উদ্ভিদস্তর পরিণত হয়েছিল কালো কয়লায়। ভারতীয় টেকটনিক প্লেট এরপরে যাত্রা করেছে উত্তরে, পৌঁছেছে উত্তর গোলার্ধে, সংঘাত হয়েছে তার এশিয়ার সাথে। মানুষের আবির্ভাব এসবের অনেক পরে, কিন্তু পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার নিরন্তর তাগিদে মানুষ শিখেছে সেই কয়লার ব্যবহার। একই সাথে, অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার বজায় রাখার দ্বন্দ্বে, সেই ব্যবহার নিয়ে এসেছে সংঘাত।
পশ্চিম বাংলা ও বিহারের সীমান্তে এক আশ্চর্য জায়গা ন’পাহাড়ি, ন’টি টিলা থেকে যার নাম। দামোদর নদের পাশে শাল পিয়াল হরতকীর বন, আরো আছে ময়ূর, গুলবাঘা আর হাতি। এছাড়াও আর একটি জিনিস আছে, মাটির অল্প গভীরেই, উষ্ণতার আকরিক কৃষ্ণ কার্বন কয়লা। আঙুলের মত সেই কয়লার স্তর ছড়িয়ে পড়েছে দামোদরের পাশে গ্রামগুলোর নিচ দিয়ে, পুকুর কাটতে, কুয়ো খুঁড়তে তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় অনায়াসে। কিন্তু ভূমিস্থ শায়িত সব খনিজের মালিকানা রাষ্ট্রের। তাই জমির মালিক লোক লাগিয়ে গোপনে খোঁড়ে তার জমি, বেআইনী পথে চালান দেয় কয়লা চোরাপথে সারা ভারতবর্ষে। তার লাভের বখড়ায় সামিল হয় স্থানীয় নেতা, পুলিশ, পরোক্ষভাবে সম্মানিত সিভিল সার্ভিসের লোকজন। অন্ধকার পাতালপুরী থেকে কোটি কোটি বছর পরে প্রাচীন জৈবের পুনরুত্থান হয়, কিন্তু সেই উথ্বান শুভ হয় না - কৃষ্ণ কয়লায় লাগে রক্তের ছোপ।
এই সূচনায় রচিত হল অমর মিত্রের উপাখ্যান পুনরুত্থান। হৃদয়কে বরফ করে দেবার গল্প। কাহিনীর প্রটাগনিস্ট থানার চল্লিশ বছরের নিরীহ কিন্তু নির্বীজ ওসি গোলকবিহারী কুণ্ডু। এই গল্পে তার ভূমিকা নায়কের নয়, আবার প্রতিনায়কের বা খলনায়কেরও নয়। গোলক এখানে এক বিচলিত কিন্তু জড় দর্শক, সে ঘুষ খায় না, কিন্তু ঘুষ বন্ধ করতে সচেষ্ট হয় না। তার নীতিজ্ঞান প্রচুর, কিন্তু উপরওয়ালার অন্যায় হুকুম অমান্য করতে তার সাহস হয় না।
ন’পাহাড়ির বেআইনী খাদানে কয়লা তুলতে গিয়ে নানা দুর্ঘটনায় পড়ে শ্রমিকেরা। তাতে তারা আহত হয়, মাঝে-মধ্যেই মারা যায়। তাদের মৃত্যুর খবর ধামাচাপা দেয়া হয়, এই অমানবিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে জমির মালিক, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, পুলিশ। সেই অন্যায়ের মাঝে আবির্ভূত হয় ভরত কুইলা; সে এই নিষ্ঠুর সাম্যাবস্থাকে মানতে পারে নি। তিনজন শ্রমিক অবিনাশ সরকারের কয়লা খাদানে কাজ করতে গিয়ে মারা যায়, অবিনাশ তাদের মৃতদেহগুলিকে গোপন করে। ভরত চিঠি লিখেছিল স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে তদন্তের আশায়। সেই চিঠি এল স্থানীয় পুলিশের কাছে। দুঃস্বপ্নের শুরু তখন থেকেই।
তরুণ ডেপুটি সুপার অফ পোলিস অনিন্দ্য তালুকদার। সেই এই কাহিনীর খলনায়ক। লেখক তাকে সম্বোধন করেছেন নীল রক্তের মানুষ বলে। জমিদারি রক্ত তার দেহে, তার বাবা, কাকা, পিসী সরকারী বিভিন্ন সার্ভিসে নিযুক্ত ছিল বা আছে - প্রশাসনিক, সিভিল, বিদেশ কোনোটাই বাদ নেই। ক্ষমতার অধিকারী আর ক্ষমতার কাছাকাছি যে সেই দেশের মালিক, যেমন বেআইনী লাভের বখড়া নেয় তেমনই নিজেকে সাধারনের দণ্ড-মুণ্ডের বিধাতা ভাবে। অনিন্দ্য ওসি গোলোককে দিয়ে ভরত কুইলাকে তুলে নিয়ে আসে থানায়। পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করা অনিন্দ্য ভরতকে পেটায় তার গাড়ির ড্রাইভার দিয়ে। অলিভার টুইস্ট-কপচানো অনিন্দ্য তালুকদার দ্বিধা করে না নাগরিক ভরত কুইলাকে মাছি-সম জ্ঞান করে মেরে ফেলতে। অনিন্দ্যকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো প্রশাসন।
ভরত কুইলার হত্যার দোষ বর্তায় ওসি গোলকবিহারী কুণ্ডুর ওপর। গোলক পালায় প্রথমে কলকাতায় তার বাড়িতে (যেখানে তার স্ত্রী ও কন্যা ছিল), তারপর সাব-ইনসপেকটর ভগবান বর্মনের বাড়ি কোচবিহার জেলার দিনহাটায়। সেখান থেকে ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহল হরিশের তালুকে। শুধুমাত্র সেখানেই, মানুষের যোগাযোগ থেকে বহু দূরে গোলকের বোধোদয় হতে শুরু করে যে সে এভাবে সারা জীবন পালিয়ে বাঁচবে না। সে ফিরে যায় বসিরহাটের কাছে তার গ্রামে, কিন্তু তার পৈত্রিকবাড়িতে ঢুকতে পারে না, তারই থাকতে-দেয়া লোক তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, পুলিশের ভয় দেখায়। অবশেষে দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকেছে তখন গোলকের পরিবর্তন হয়, সে হয়ে ওঠে ভরত কুইলা। ভরত কুইলা হয়ে ফোন করে সে ডিএসপি অনিন্দ্যকে, অনিন্দ্যর পেটোয়া লোক সাব-ইনসপেকটর সুধন্য মাইতিকে, জেলা শাসক সন্দীপ ঘোষকে। ভরত কুইলা যেন মাটি থেকে উঠে আসে সমস্ত অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে। এই পুনরুত্থান গোলক কুণ্ডুর পুনরুত্থান নয়, বরং ভরত কুইলার।
২. জাগরণ
বড় লেখক বড় মাপের চিন্তা করেন। তার বিষয়বস্তু নিজের অজান্তেই হয়ে ওঠে প্রাসঙ্গিক। স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশ বিরচিত পুলিশ ও সিভিল সার্ভিস বিদ্যমান তার উপনিবেশী চরিত্রে, তার ভূমিকা নিতান্তই নিষ্পেষণের, তাতে জনগনের কোনো অধিকার নেই। অমর মিত্র পুলিশ ও প্রশাসনের সেই জটিল কলকব্জার সন্ধান রাখেন, তার হাতে সরকারের এই শাখাগুলির কর্মকর্তাদের স্বত্ববান আত্মম্ভরী আচরণ মূর্ত হয়ে ওঠে। পাঠকের পক্ষে তাদের অমানবিকতা অসহ্য হয়ে ওঠে, রাগে ক্রোধে ফেটে পড়তে চায় পাঠক, অঙ্গারের বর্শা দিয়ে মাটি ভেদ করে চিৎকার করে পাঠক বলতে চায় নিকুচি করি এই পুলিশের, নিকুচি করি এই সিভিল সার্ভিসের। যে লেখা পাঠকের মনে এত ক্রোধ জন্মাতে পারে সেই লেখা সার্থক।
প্রতিটি মহৎ গল্পই এক ধরণের পুনর্জাগরণ। লে মিজেরাব্লের প্রায় তিন হাজার পাতা জুড়ে চলেছে জ্যাঁ ভালজ্যাঁর ফিরে আসার লড়াই। রক্তকরবীতে যক্ষপুরীর শিকল ভাঙার মাঝে পাতালের শ্রম থেকে মুক্তি, সেটাও পুনরুত্থান। অমর মিত্র সেই মহৎ রীতিকেই অনুসরণ করেছেন, কাহিনীর প্রথমেই তলস্তয়ের রেজারেকশন উপন্যাসের নামটি এনেছেন। উপন্যাসের শিরোনামটিও তলস্তয়ের রেজারেকশনের নামে। তলস্তয়ের পুনরুথ্বানে জমিদার-বংশীয় নাখলুদভ নিম্নবংশীয় কাতিয়ুশা মাসলোভার প্রতি চরম অন্যায় করেছিল, সেই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত নিয়েই রেজারেকশনের কাহিনী। অমর মিত্রের কাহিনীর শুরুতে অনিন্দ্য রেজারেকশনের এক্দম প্রথমে বর্ণিত রুশ দেশে বসন্তের আগমনের কথা চিন্তা করে। একই সাথে সে ব্যস্ত টেলিভিশনে মেয়েদের হ্যান্ডবল খেলা দেখতে। কয়েকটি বাক্যের পরই পাঠক এক বিবমিষায় আবিষ্কার করে যে একই সময়ে তারই আদেশে একটি মানুষকে অমানুষিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। টেলিভিশন থেকে মন উঠাতে পারে না অনিন্দ্য, সেই অমনোযোগিতায় ভরত কুইলা মরে যায়। অলিভার টুইস্ট আর রেজারেকশন-পড়া অনিন্দ্য বর্তমান ভারতের জন্য এক বিশাল প্যারাডক্স। এই প্যারাডক্স-সম্পন্ন চরিত্ররা আমাদের মাঝেই ঘোরাফেরা করে, অমর মিত্রের হাতে তারা হয়েছে মূর্তমান।
তলস্তয় নাখলুদভের হাত ধরে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন ১৯শ শতকের রুশ দেশের আইন ব্যবস্থার গভীর অবিচারে, ভিকটর উগো জ্যাঁ ভ্যালজাঁর নিরন্তর সংগ্রামে দেখিয়েছিলেন শাসক সমাজ বিত্তহীন শ্রেণীর প্রতি কিরকম উদাসীন। একটি রুটি চুরির অপরাধে ১৯ বছর জেল খাটতে হয়েছিল ভ্যালজাঁকে। গোকুল কুণ্ডু জ্যাঁ ভ্যালজাঁ বা নাখ্লুদভ নয়। তার কাপুরুষতায় আমরা বিমর্ষ হই, কিন্তু যে সমাজ নায়ক তৈরি করে না, সেই সমাজ থেকে কাপুরুষতাই আশা করা যায়। তাই গোলকের স্ত্রী রণিতা যখন তাকে বলে, “….তুমি লাঠিটা কেড়ে নেবার সাহস দেখাতে পার নি, অপরাধ না করেও অপরাধী, যাও কোথাও একটা….,” আমরা রণিতার কথায় সায় না দিয়ে পারি না।
তবু এর মধ্যে একজনের বিচক্ষণতা ও সাহস আমাদের আশ্চর্য করে। সুবিধাবাদী জেলা শাসক সন্দীপ ঘোষের মেয়ে সম্বিতা। এই জেলা শাসক অনিন্দ্য তালুকদারকে বাঁচাতে চেয়েছিল, কিন্তু তার মেয়ে কুইলার মৃত্যুতে বিচলিত হয়ে পিতার অমতে নপাহাড়িতে গিয়েছিল ঘটনাটা জানতে। আধুনিক মেয়ে সম্বিতা বড় হয়েছে সম্পদে তবু ন্যায়বোধ তার পিতা এবং পিতার সহকর্মীদের থেকে অনেক বেশী। সেই তার বাবাকে বাধ্য করেছিল এই ঘটনায় শেষাবধি হস্তক্ষেপ না করতে। অমর মিত্র তরুণ সমাজের এই কর্তব্যবোধ ন্যায়বোধকে চিহ্নিত করেছেন, মূল্য দিয়েছেন, সেটাও এই কাহিনীর একটা বড় অংশ। তাই এই কাহিনীর একজন নায়িকা আছে, যত ছোট সময়ের জন্যই সে আসুক নাটমঞ্চে। এছাড়াও রয়েছে সাব-ইন্সপেকটর ভগবান বর্মন যে কিনা নিজের চাকরি খোওয়া যাবার ভয় সত্বেও গোকুলের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। যে গাইত ভাওয়াইয়া ‘ও উড়িয়া যাও রে ওরে বুলবুলি ময়না, একেলা ঘরে বসি রে ওরে বুলবুলি ময়না’। না, সবকিছু একদম বৃথা যায় নি।
ভরত কুইলার চিঠি ও তাকে গ্রেপ্তারের অংশটুকু বাদ দিলে এই কাহিনীর গতি রৈখিক। অমর মিত্রের ভাষা মমতায় পূর্ণ এবং direct, পাঠককে খুব সহজেই ধরে রাখেন তিনি। কাহিনীর শুরুই ভগবান বর্মণের ভাওয়াইয়া গান দিয়ে আর শেষ গোকুলের ভরত হয়ে ন’পাহাড়িতে ফিরে যাবার মাঝে। লেখকের হাতে পুলিশ ও সিভিল সার্ভিসের সাজশ ও দুর্নীতির রন্ধ্রে এই যাত্রা হয়ে উঠেছে এক গোয়েন্দা গল্পের মত। বহুমাত্রায় পূর্ণ এই কাহিনীর গতি দ্রুত, তার মূল্যবোধ আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক, চরিত্রসমূহ খুবই বাস্তব এবং পাঠকের অংশগ্রহণ নিবিড়। সেই নিবিড়তা আর একটু দীর্ঘ করলে হয়তো মন্দ হত না ওসি গোকুল কুণ্ডের আত্মিক জাগরণের পর্যায়টা আর একটু প্রলম্বিত করে, তার পাপ-স্খলনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের আগ্রহকে আর একটু প্রশ্রয় দিয়ে।
কারাগারে মানুষের ওপর অবিচার দেখে তলস্তয়ের নাখলুদভের আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ হয়েছিল। অমর মিত্রের পুনরুত্থান পড়ে শুধু পুলিশ ও সিভিল সার্ভিসের লোকদের নয়, আমাদের সবার হৃদয়ই নতুন বোধনে উদ্ভাসিত হবে এই আশা করা অন্যায় হবে না।
১. কয়লা ও কাহিনী
আজ থেকে পনেরো কোটি বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশ দক্ষিণ গোলার্ধে আফ্রিকার সাথে মিশে ছিল। তারও কোটি কোটি বছর পূর্বে তার জমিতে শায়িত হয়েছিল জলাভূমির উদ্ভিদ, ধীরে ধীরে সেই উদ্ভিদ স্তরের ওপর পড়েছিল নতুন মাটির স্তর। অবশেষে সেই উদ্ভিদস্তর পরিণত হয়েছিল কালো কয়লায়। ভারতীয় টেকটনিক প্লেট এরপরে যাত্রা করেছে উত্তরে, পৌঁছেছে উত্তর গোলার্ধে, সংঘাত হয়েছে তার এশিয়ার সাথে। মানুষের আবির্ভাব এসবের অনেক পরে, কিন্তু পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার নিরন্তর তাগিদে মানুষ শিখেছে সেই কয়লার ব্যবহার। একই সাথে, অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার বজায় রাখার দ্বন্দ্বে, সেই ব্যবহার নিয়ে এসেছে সংঘাত।
পশ্চিম বাংলা ও বিহারের সীমান্তে এক আশ্চর্য জায়গা ন’পাহাড়ি, ন’টি টিলা থেকে যার নাম। দামোদর নদের পাশে শাল পিয়াল হরতকীর বন, আরো আছে ময়ূর, গুলবাঘা আর হাতি। এছাড়াও আর একটি জিনিস আছে, মাটির অল্প গভীরেই, উষ্ণতার আকরিক কৃষ্ণ কার্বন কয়লা। আঙুলের মত সেই কয়লার স্তর ছড়িয়ে পড়েছে দামোদরের পাশে গ্রামগুলোর নিচ দিয়ে, পুকুর কাটতে, কুয়ো খুঁড়তে তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় অনায়াসে। কিন্তু ভূমিস্থ শায়িত সব খনিজের মালিকানা রাষ্ট্রের। তাই জমির মালিক লোক লাগিয়ে গোপনে খোঁড়ে তার জমি, বেআইনী পথে চালান দেয় কয়লা চোরাপথে সারা ভারতবর্ষে। তার লাভের বখড়ায় সামিল হয় স্থানীয় নেতা, পুলিশ, পরোক্ষভাবে সম্মানিত সিভিল সার্ভিসের লোকজন। অন্ধকার পাতালপুরী থেকে কোটি কোটি বছর পরে প্রাচীন জৈবের পুনরুত্থান হয়, কিন্তু সেই উথ্বান শুভ হয় না - কৃষ্ণ কয়লায় লাগে রক্তের ছোপ।
এই সূচনায় রচিত হল অমর মিত্রের উপাখ্যান পুনরুত্থান। হৃদয়কে বরফ করে দেবার গল্প। কাহিনীর প্রটাগনিস্ট থানার চল্লিশ বছরের নিরীহ কিন্তু নির্বীজ ওসি গোলকবিহারী কুণ্ডু। এই গল্পে তার ভূমিকা নায়কের নয়, আবার প্রতিনায়কের বা খলনায়কেরও নয়। গোলক এখানে এক বিচলিত কিন্তু জড় দর্শক, সে ঘুষ খায় না, কিন্তু ঘুষ বন্ধ করতে সচেষ্ট হয় না। তার নীতিজ্ঞান প্রচুর, কিন্তু উপরওয়ালার অন্যায় হুকুম অমান্য করতে তার সাহস হয় না।
ন’পাহাড়ির বেআইনী খাদানে কয়লা তুলতে গিয়ে নানা দুর্ঘটনায় পড়ে শ্রমিকেরা। তাতে তারা আহত হয়, মাঝে-মধ্যেই মারা যায়। তাদের মৃত্যুর খবর ধামাচাপা দেয়া হয়, এই অমানবিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে জমির মালিক, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, পুলিশ। সেই অন্যায়ের মাঝে আবির্ভূত হয় ভরত কুইলা; সে এই নিষ্ঠুর সাম্যাবস্থাকে মানতে পারে নি। তিনজন শ্রমিক অবিনাশ সরকারের কয়লা খাদানে কাজ করতে গিয়ে মারা যায়, অবিনাশ তাদের মৃতদেহগুলিকে গোপন করে। ভরত চিঠি লিখেছিল স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে তদন্তের আশায়। সেই চিঠি এল স্থানীয় পুলিশের কাছে। দুঃস্বপ্নের শুরু তখন থেকেই।
তরুণ ডেপুটি সুপার অফ পোলিস অনিন্দ্য তালুকদার। সেই এই কাহিনীর খলনায়ক। লেখক তাকে সম্বোধন করেছেন নীল রক্তের মানুষ বলে। জমিদারি রক্ত তার দেহে, তার বাবা, কাকা, পিসী সরকারী বিভিন্ন সার্ভিসে নিযুক্ত ছিল বা আছে - প্রশাসনিক, সিভিল, বিদেশ কোনোটাই বাদ নেই। ক্ষমতার অধিকারী আর ক্ষমতার কাছাকাছি যে সেই দেশের মালিক, যেমন বেআইনী লাভের বখড়া নেয় তেমনই নিজেকে সাধারনের দণ্ড-মুণ্ডের বিধাতা ভাবে। অনিন্দ্য ওসি গোলোককে দিয়ে ভরত কুইলাকে তুলে নিয়ে আসে থানায়। পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করা অনিন্দ্য ভরতকে পেটায় তার গাড়ির ড্রাইভার দিয়ে। অলিভার টুইস্ট-কপচানো অনিন্দ্য তালুকদার দ্বিধা করে না নাগরিক ভরত কুইলাকে মাছি-সম জ্ঞান করে মেরে ফেলতে। অনিন্দ্যকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো প্রশাসন।
ভরত কুইলার হত্যার দোষ বর্তায় ওসি গোলকবিহারী কুণ্ডুর ওপর। গোলক পালায় প্রথমে কলকাতায় তার বাড়িতে (যেখানে তার স্ত্রী ও কন্যা ছিল), তারপর সাব-ইনসপেকটর ভগবান বর্মনের বাড়ি কোচবিহার জেলার দিনহাটায়। সেখান থেকে ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহল হরিশের তালুকে। শুধুমাত্র সেখানেই, মানুষের যোগাযোগ থেকে বহু দূরে গোলকের বোধোদয় হতে শুরু করে যে সে এভাবে সারা জীবন পালিয়ে বাঁচবে না। সে ফিরে যায় বসিরহাটের কাছে তার গ্রামে, কিন্তু তার পৈত্রিকবাড়িতে ঢুকতে পারে না, তারই থাকতে-দেয়া লোক তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, পুলিশের ভয় দেখায়। অবশেষে দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকেছে তখন গোলকের পরিবর্তন হয়, সে হয়ে ওঠে ভরত কুইলা। ভরত কুইলা হয়ে ফোন করে সে ডিএসপি অনিন্দ্যকে, অনিন্দ্যর পেটোয়া লোক সাব-ইনসপেকটর সুধন্য মাইতিকে, জেলা শাসক সন্দীপ ঘোষকে। ভরত কুইলা যেন মাটি থেকে উঠে আসে সমস্ত অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে। এই পুনরুত্থান গোলক কুণ্ডুর পুনরুত্থান নয়, বরং ভরত কুইলার।
২. জাগরণ
বড় লেখক বড় মাপের চিন্তা করেন। তার বিষয়বস্তু নিজের অজান্তেই হয়ে ওঠে প্রাসঙ্গিক। স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশ বিরচিত পুলিশ ও সিভিল সার্ভিস বিদ্যমান তার উপনিবেশী চরিত্রে, তার ভূমিকা নিতান্তই নিষ্পেষণের, তাতে জনগনের কোনো অধিকার নেই। অমর মিত্র পুলিশ ও প্রশাসনের সেই জটিল কলকব্জার সন্ধান রাখেন, তার হাতে সরকারের এই শাখাগুলির কর্মকর্তাদের স্বত্ববান আত্মম্ভরী আচরণ মূর্ত হয়ে ওঠে। পাঠকের পক্ষে তাদের অমানবিকতা অসহ্য হয়ে ওঠে, রাগে ক্রোধে ফেটে পড়তে চায় পাঠক, অঙ্গারের বর্শা দিয়ে মাটি ভেদ করে চিৎকার করে পাঠক বলতে চায় নিকুচি করি এই পুলিশের, নিকুচি করি এই সিভিল সার্ভিসের। যে লেখা পাঠকের মনে এত ক্রোধ জন্মাতে পারে সেই লেখা সার্থক।
প্রতিটি মহৎ গল্পই এক ধরণের পুনর্জাগরণ। লে মিজেরাব্লের প্রায় তিন হাজার পাতা জুড়ে চলেছে জ্যাঁ ভালজ্যাঁর ফিরে আসার লড়াই। রক্তকরবীতে যক্ষপুরীর শিকল ভাঙার মাঝে পাতালের শ্রম থেকে মুক্তি, সেটাও পুনরুত্থান। অমর মিত্র সেই মহৎ রীতিকেই অনুসরণ করেছেন, কাহিনীর প্রথমেই তলস্তয়ের রেজারেকশন উপন্যাসের নামটি এনেছেন। উপন্যাসের শিরোনামটিও তলস্তয়ের রেজারেকশনের নামে। তলস্তয়ের পুনরুথ্বানে জমিদার-বংশীয় নাখলুদভ নিম্নবংশীয় কাতিয়ুশা মাসলোভার প্রতি চরম অন্যায় করেছিল, সেই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত নিয়েই রেজারেকশনের কাহিনী। অমর মিত্রের কাহিনীর শুরুতে অনিন্দ্য রেজারেকশনের এক্দম প্রথমে বর্ণিত রুশ দেশে বসন্তের আগমনের কথা চিন্তা করে। একই সাথে সে ব্যস্ত টেলিভিশনে মেয়েদের হ্যান্ডবল খেলা দেখতে। কয়েকটি বাক্যের পরই পাঠক এক বিবমিষায় আবিষ্কার করে যে একই সময়ে তারই আদেশে একটি মানুষকে অমানুষিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। টেলিভিশন থেকে মন উঠাতে পারে না অনিন্দ্য, সেই অমনোযোগিতায় ভরত কুইলা মরে যায়। অলিভার টুইস্ট আর রেজারেকশন-পড়া অনিন্দ্য বর্তমান ভারতের জন্য এক বিশাল প্যারাডক্স। এই প্যারাডক্স-সম্পন্ন চরিত্ররা আমাদের মাঝেই ঘোরাফেরা করে, অমর মিত্রের হাতে তারা হয়েছে মূর্তমান।
তলস্তয় নাখলুদভের হাত ধরে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন ১৯শ শতকের রুশ দেশের আইন ব্যবস্থার গভীর অবিচারে, ভিকটর উগো জ্যাঁ ভ্যালজাঁর নিরন্তর সংগ্রামে দেখিয়েছিলেন শাসক সমাজ বিত্তহীন শ্রেণীর প্রতি কিরকম উদাসীন। একটি রুটি চুরির অপরাধে ১৯ বছর জেল খাটতে হয়েছিল ভ্যালজাঁকে। গোকুল কুণ্ডু জ্যাঁ ভ্যালজাঁ বা নাখ্লুদভ নয়। তার কাপুরুষতায় আমরা বিমর্ষ হই, কিন্তু যে সমাজ নায়ক তৈরি করে না, সেই সমাজ থেকে কাপুরুষতাই আশা করা যায়। তাই গোলকের স্ত্রী রণিতা যখন তাকে বলে, “….তুমি লাঠিটা কেড়ে নেবার সাহস দেখাতে পার নি, অপরাধ না করেও অপরাধী, যাও কোথাও একটা….,” আমরা রণিতার কথায় সায় না দিয়ে পারি না।
তবু এর মধ্যে একজনের বিচক্ষণতা ও সাহস আমাদের আশ্চর্য করে। সুবিধাবাদী জেলা শাসক সন্দীপ ঘোষের মেয়ে সম্বিতা। এই জেলা শাসক অনিন্দ্য তালুকদারকে বাঁচাতে চেয়েছিল, কিন্তু তার মেয়ে কুইলার মৃত্যুতে বিচলিত হয়ে পিতার অমতে নপাহাড়িতে গিয়েছিল ঘটনাটা জানতে। আধুনিক মেয়ে সম্বিতা বড় হয়েছে সম্পদে তবু ন্যায়বোধ তার পিতা এবং পিতার সহকর্মীদের থেকে অনেক বেশী। সেই তার বাবাকে বাধ্য করেছিল এই ঘটনায় শেষাবধি হস্তক্ষেপ না করতে। অমর মিত্র তরুণ সমাজের এই কর্তব্যবোধ ন্যায়বোধকে চিহ্নিত করেছেন, মূল্য দিয়েছেন, সেটাও এই কাহিনীর একটা বড় অংশ। তাই এই কাহিনীর একজন নায়িকা আছে, যত ছোট সময়ের জন্যই সে আসুক নাটমঞ্চে। এছাড়াও রয়েছে সাব-ইন্সপেকটর ভগবান বর্মন যে কিনা নিজের চাকরি খোওয়া যাবার ভয় সত্বেও গোকুলের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। যে গাইত ভাওয়াইয়া ‘ও উড়িয়া যাও রে ওরে বুলবুলি ময়না, একেলা ঘরে বসি রে ওরে বুলবুলি ময়না’। না, সবকিছু একদম বৃথা যায় নি।
ভরত কুইলার চিঠি ও তাকে গ্রেপ্তারের অংশটুকু বাদ দিলে এই কাহিনীর গতি রৈখিক। অমর মিত্রের ভাষা মমতায় পূর্ণ এবং direct, পাঠককে খুব সহজেই ধরে রাখেন তিনি। কাহিনীর শুরুই ভগবান বর্মণের ভাওয়াইয়া গান দিয়ে আর শেষ গোকুলের ভরত হয়ে ন’পাহাড়িতে ফিরে যাবার মাঝে। লেখকের হাতে পুলিশ ও সিভিল সার্ভিসের সাজশ ও দুর্নীতির রন্ধ্রে এই যাত্রা হয়ে উঠেছে এক গোয়েন্দা গল্পের মত। বহুমাত্রায় পূর্ণ এই কাহিনীর গতি দ্রুত, তার মূল্যবোধ আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক, চরিত্রসমূহ খুবই বাস্তব এবং পাঠকের অংশগ্রহণ নিবিড়। সেই নিবিড়তা আর একটু দীর্ঘ করলে হয়তো মন্দ হত না ওসি গোকুল কুণ্ডের আত্মিক জাগরণের পর্যায়টা আর একটু প্রলম্বিত করে, তার পাপ-স্খলনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের আগ্রহকে আর একটু প্রশ্রয় দিয়ে।
কারাগারে মানুষের ওপর অবিচার দেখে তলস্তয়ের নাখলুদভের আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ হয়েছিল। অমর মিত্রের পুনরুত্থান পড়ে শুধু পুলিশ ও সিভিল সার্ভিসের লোকদের নয়, আমাদের সবার হৃদয়ই নতুন বোধনে উদ্ভাসিত হবে এই আশা করা অন্যায় হবে না।
1 মন্তব্যসমূহ
আলোচনা যথাযথ লাগলো । পুনরুত্থান পড়েছি । চমৎকার রচনা ।
উত্তরমুছুন