রুমা মোদক'এর গল্প : (অ) শিশুতোষ

আদ্যোপান্ত পড়ে যদি আপনার মনে হয় লেখাটি শিশুতোষ হয়ে উঠেনি, তবে আমি নিজেকে উদ্দেশ্যে অব্যর্থ ভাববো। মূলত আমি কোনো শিশুতোষ লেখা লিখতে বসি নি। যদিও গল্পের বিষয়বস্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনটি শিশুই, তবুও এই শিশু তিনটির সাথে আমার দেখা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরোই কাকতালীয়, মোটেই পূর্ব পরিকল্পিত নয়, এবং দেখা হওয়ার পরও তাদের সাথে আমার যে বিভীষিকাময় জার্নি, তাতেও আমার মোটেই কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ইচ্ছেও ছিলো না, অনিচ্ছেও নয়। যেনো আমি এক রিমোটচালিত সত্তা, তিনটি প্রাণবন্ত শিশুর মাঝে পড়ে গিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রনেই চালিত হয়েছি শেষাবধি। যেনো তাদের অব্যক্ত ব্যথা যা কিনা হয়তো পুরো বিশ্বের কাছে অজ্ঞাতই থেকে যাবে শেষপর্যন্ত যেনো তা ব্যক্ত করার জন্য আমার ভিতর থেকে উৎসরিত কৌতুহলগুলোও নিয়ন্ত্রক ছিলো তারাই। আমি যতই ভেবেছি নিজ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োগ ঘটিয়ে শিশুদের সাথে অতিবাহিত সময়টুকু শিশুতোষ করেই রাখবো, প্রতিক্ষনে বুঝতে পেরেছি আমি তা পারছি না। শেষ পর্যন্ত নিজেকে সমপর্ণ করেছি। এবং এতে ভয়াবহ সত্য আবিস্কৃত হয়েছে তা জানতে পাঠকরা আমার সঙ্গী হতে পারেন।

তো তোমরা তিনজন পূর্বপরিচিত- এভাবেই কথা শুরু করি আমি। খুব চেনা আর আপন ভঙ্গিতে। শুধু আমার সাথে নতুন পরিচিত হলে, তাইতো? আমার বলার ভঙ্গি এবং ইচ্ছা দুটোই ভীষণ আন্তরিক ছিল নিশ্চয়ই, ফলে তাদের সাথে কথোপকথনের প্রতিটি পর্বে পর্বে তাদের অতি সংক্ষিপ্ত জীবনের যে অভিজ্ঞতাগুলির পর্দা উন্মোচিত হতে থাকে, সেগুলি যে কতোটা ভয়াবহ আর নিষ্ঠুর তাদের প্রারম্ভিক কথায় তা আমি আঁচই করতে পারি না। হতে পারে আমার আন্তরিকতায় তারা আমাকে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগই দেয় না। কিন্তু আমি ভাবি এটাই স্বাভাবিক। শিশুসুলভ। তিনটি শিশুই সমান উজ্জ্বল ঝলমলে- ঠিক যেমন অন্য দশটি দেবশিশু থাকে। কতোই বা বয়স এদের ৮-১০। এর বাইরে নয় মোটেই। আমার প্রশ্নে প্রতিযোগিতা পরে যায় উত্তরের। তারা খলবলিয়ে বলতে চায় কে কাকে আগে চিনেছে সেই ইতিবৃত্ত। ওদের-তুই থাম আমি বলি, না তোরটা হয় নি, আমি যেটা বলেছি সেটাই ঠিক- ইত্যাদি বির্তকে আমি বুঝে নেই তারা পূর্ব পরিচিত ছিল না। মাত্রই পরিচয় হয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যেও, আমার সাথেও। তিনজনকে সাথে নিয়ে আমি একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকি। ওরা দোকানের এ পাশ ও পাশ ঘিরে দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি শুরু করে ঠিক যেমন অন্য শিশুরা করে। তোমরা কী খাবে-প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় ওদের নেই। আমি হাত ভর্তি করে চকলেট, কেক আর আইসক্রিম কিনি, সবচেয়ে ছোট ছেলেটি একটি খেলনার জন্য বায়না ধরে, অপেক্ষাকৃত বড় মেয়েটি চোখ রাঙ্গায়, ছোট ছেলেটি দমে যায়। আমি লক্ষ্য করি, কিন্তু বুঝতে দেই না। আমি চকলেট, কেক, আইসক্রিমগুলো ওদের হাতে দেই, ওরা পরস্পর তাকায়। টের পাই এই নাগরিক মধ্য আয়ের জীবনে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় পরিবার থেকে শিখানো চিরায়ত শিক্ষা-অচেনা কারো কাছ থেকে কিছু নেবে না, সাবধান বাণীটি তাদের প্ররোচিত করছে হাত না বাড়াতে, আমি সাহায্য নিজেকে তাদের আপনজন বলে পরিচয় দেই পুনরায়। তারা অবলীলায় বিশ্বাস করে, হাত বাড়ায়, চকলেটগুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। আমিও বিশ্বাস করি, মূলত কোনো কারণ ছাড়াই শিশুরা যে কোনো কিছু বিশ্বাস করে। তারা ঠকলেও বিশ্বাস করে ঠকে, জিতলে ও বিশ্বাস করে জিতে। বিশ্বাস করার আগেও হিসাব করে না, পরেও করে না। জিতলেও করে না, হারলেও করে না। এমনকি বিশ্বাস করে তারা জীবন দেয়, তবু তারা বদলায় না। তারা বিশ্বাস করে সবাইকে, সবচে বেশি করে পিতা-মাতাকে। এই শিশু তিনটিও করেছিল। বিশ্বাস করে ঠকেছিল।

প্রথম শিশুটি, ধরে নেই তার নাম ‘আকাশ’। হ্যাঁ যে প¦ারিপার্শ্বিকতায় বেড়ে উঠা তার, ধীরে-ধীরে, কষ্টে-সৃষ্টে অতি দরিদ্র থেকে ক্রমে ধনী হওয়া একটি পরিবার, যার অর্থ যোগান দেয় বৈদেশিক মুদ্রা, যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন রেমিটেন্স। জমি- জিরাত বিক্রি করে দুবাই গিয়েছিল সে পারিবারের বড় সন্তানটি, না গিয়ে ভূল নি। ভাই-বোন সমেত পুরো পরিবার টেনে তুলতে এবং যে পরিমাণ জমি বিক্রি করেছিল তার দ্বিগুণ পরিমাণ জমি জুড়াতে সে জীবনের পনেরটি বছর ব্যয় করেছে। গ্রামের মানুষ যার নামে ধন্য ধন্য করে, সে জীবনের পনেরটি বছরের বিনিময়ে কেবল একটি শখ পূরণ করতে পেরেছে। তা হলো একটা অপরূপ সুন্দরী বউ বিয়ে করেছে সে। অবশ্য গ্রামে গঞ্জে যে বয়সে বিয়ে করে ছেলেরা, তার থেকে একটু বেশি বয়সে, নিজ থেকে প্রায় পনের বছরের ছোট এক মেয়েকে। মেয়েটি আবার পড়ালেখা জানা, গ্রামের একমাত্র এম.পিও ভুক্ত স্কুলে মাস্টারি করে। সেই দম্পতির ঘরে প্রথম জন্ম নেয়া ছেলেটার নাম ‘আকাশ’ হতেই পারে। তার অসম্ভব সুন্দরী মা কে সে ভীষণ পছন্দ করত, ভালোবাসতো, আর মায়ের ভালোবাসা? এতো প্রাকৃতিক, সহজাত, অসামান্য নিশ্চয়ই। সে আর এখন হিসাব নিকাশ করার উপায় নেই। আকাশের মা জেল হাজতে। পুলিশ পরকীয়ার গুরুতর অপরাধে তাকে জেল হাজতে পুরেছে। আকাশ প্রগলভ হয়ে উঠে। আমরা রাজপথ লাগোয়া একটি অপ্রশস্ত পার্কে ঢুকি। পার্কটি সবুজ ঘাসে ঢাকা, এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো পাম গাছ, বসার জন্য কারুকার্যময় লোহার চেয়ার। আমরা পা মেলে ঘাসের উপর বসে পড়ি। -আংকেল আমি তো প্রথমে বুঝতেই পারি নি পরকীয়া কী? পরে বুঝলাম। আকাশের মুখে বয়সের তুলনায় বেমানান প্রাপ্ত বয়স্ক শব্দটি শুনে আমি না শুনতে পাবার মতো অন্যমনস্ক হবার ভান করি। অন্যমনস্ক হইও বটে কিছুটা। আমি গভীরে যাই, নিজের অনেক গভীরে, নিজেকে দাঁড় করাই কৈফিয়তের মুখোমুখি কোন সমাজ সংসার দিচ্ছি আমরা অপাপবিদ্ধ শিশুদের এই অশালীন শব্দগুলো, শব্দের মানেগুলো তারা জেনে যাচ্ছে অবলীলায়? বাকি দুজন তখন আকাশকে হামলে ধরে, তোমার মায়েরও পরকীয়া? আমার মায়েরও। যে বয়সে ওদের টম এন্ড জেরি, মিস্টার বিন নয়তো হালে জি বাংলায় শুরু হওয়া নতুন সিরিয়াল ‘ভূতো’ নিয়ে আলোচনা করার কথা, সে বয়সে ওদের আলোচনার বিষয় শুনে আমার অন্যমনস্ক হবার উপায় থাকে না। আকাশ বলে- শোন নীরা, আমার জানা হয় মেয়েটির নাম নীরা, আকাশ বলতে থাকে- কিন্তু আমার মায়ের তো পরকীয়া ছিল না। আমার মা আমার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতো। খুব প্রেম ছিল ওদের। বলে আকাশ নিজে নিজেই হো হো করে হাসে। ওর হাসিতে বাজতে থাকা করুন এক কান্নার সুর আমাকে খানিক কৌতুহলী করে। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি। নিজের কাছে নিজেই প্রতিশ্রুতি দেই, বড়দের এই নোংরা-অশালীন বাক্যের পৃথিবী থেকে আমি ওদের শিশু সুলভ শৈশবে নিয়ে যাবো। কিন্তু আকাশ হেসে গড়াতে গড়াতে যখন বলে- হায়রে প্রেম!! যে- সে প্রেম!! আমি তখন আমার প্রতিশ্রুতিতে স্থিত থাকতে পারি না। কৌতুহলী হই-তাই? অনেক প্রেম ছিল তোমার বাবা- মায়ের মাঝে? পরক্ষণেই পরশ্রী কাতর কুটিল চরিত্রের মানুষ বোধ হয় নিজেকে, কেন কথা বের করার জন্য খোঁচাচ্ছি ছেলেটাকে!! নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, আকাশ যখন আবার বলে- হ্যাঁ আংকেল অনেক প্রেম, তখন টের পাই গোপন কিছু জানার এক দুবৃত্ত নেশা পেয়ে বসেছে আমাকে। আমি নিজের সাথে যুদ্ধে পরাজিত- হয়ে ক্রমাগত নীচে নেমে ওকে খোঁচাতে আরম্ভ করি- তুমি কী করে বুঝলে অনেক প্রেম ছিল? আকাশ অবাক হয়- ওমা বুঝবো না কেন? না বুঝার কী আছে? বাবা দুবাই চলে যাবার সময় মা কে দামী টাচ ফোন কিনে দিয়ে গেছে। সে ফোনে হোয়াটস অ্যাপ, ভাইভার আছে। মায়ের ফেইসবুক ও আছে। গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে মা বাবাকে ভিডিও কল দিতো। মা কোথাও বেড়াতে গেলে সুন্দর শাড়ি গয়না পরে বাবাকে ছবি দিতো। আকাশ গলা নীচে নামিয়ে আনে, ভিতর থেকে উৎসারিত হাসি জোর করে হাত দিয়ে চাপানোর চেষ্টা করে- আমি একদিন লুকিয়ে দেখেছি মা ভিডিও কল করে বাবাকে চুমু খাচ্ছে। আমি আকাশকে থামাই। হোক না স্বামী-স্ত্রী, ছেলের মুখে তাদের সম্পর্কের কথা সীমা অতিক্রম করে কি না, ভেবে আমি বিব্রত হয়ে পড়ি। বলি- আকাশ মায়ের জন্য খুব কষ্ট হয় তোমার? আকাশের মুখে ঘন গভীর বিষাদের মেঘ নামে। আকাশ উত্তর দেয় না। উত্তর দেয় নীরার ভাই, যার নামটা এখনো জানা হয়ে উঠে নি আমার। বলে- আমার মায়ের জন্য মোটেই কষ্ট হয় না। শুনেছি মায়ের ফাঁসি হবে। হলে হোক। আকাশ ধমক দেয়- চুপ কর নীলয়। কোনো ছেলে মায়ের ফাঁসি চাইতে পারে? আমার জানা হয়, ছেলেটির নাম নীলয়। নীরা আর নীলয়, কী সুন্দর নাম। প্রেম করে বিয়ে করা এক দম্পতির সাজানো গুছানো পরিকল্পিত জীবন, অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্য নেই, অভাবও নেই। মাসে-ক’মাসে বেড়াতে যাওয়া হয় নানা বাড়ি, নিজের বাড়ি। ঈদে নতুন জামা-জুতো হয়, জন্মদিনে চাইনিজ হয়, বন্ধুদের নিয়ে কেক কাটা হয়। বাইরে থেকে দেখতে ছিমছাম মসৃণ পরিবারের প্রায় পিঠেপিঠি দু’ভাইবোন নীরা-নীলয় আমাকে উপেক্ষা করে তর্কে জড়িয়ে যায় আকাশের সাথে- তুই বললেই চুপ করতে হবে? কেন আমি সত্যটা বলবো না? কথাটা ছোঁ মেরে নেয় আকাশ- সত্য, সত্যটা তো কেউ জানে না। খুঁজেও না। সত্যটা কী আমাকে বলো- আমি কৌতুহল লুকাতে মমত্ব দেখানোর ভান করি। নিষ্পাপ আকাশ ভানটুকু বুঝে না, বলতে থাকে- সত্যিটা হলো এই আংকেল, রিয়াদ চাচা আমাকে খেলার মাঠ থেকে ডেকে নিলো চিপস্ খাওয়াবে বলে। আমি প্রথমটায় ভাবলাম সে আমাকে চিপস্ খাওয়াতে চায় কেন? মতলবটা কী? যাইতে চাইনি। কিন্তু এতোবার ডাকলো, না গিয়ে পারলাম না। কি গুছিয়ে কথা বলে ছেলেটা আমি অবাক হয়ে শুনি, সেই শৈশবে দাদীর কাছে শোনা গা ছমছম করা রাক্ষসের গল্পের মতো। নীরা একটু অবাক হয়- তুমি গেলে কেনো? তুমি জানতে না অচেনা কেউ ডাকলে যেতে হয় না? আকাশ একটু খেপে উঠে আরে বাবা জানবো না কেন বলছি কী? সে তো অচেনা নয়, রিয়াদ চাচা, আমাদের কয়েকটা বাড়ি পরেই তাদের বাড়ি। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিদিন ঠাট্টা করে- তোর মায়েরে বল সোনার যৌবন এভাবে বৃথা নষ্ট করা ঠিক না। কৈশোর ছুঁতে যাওয়া একটা শিশুর মুখে এসব অশালীন শব্দ শুনে আমার ভদ্রস্থ রুচি বারবার ধাক্কা খায় বটে, কিন্তু আমার কৌতুহল দ্বিগুন উৎসাহে বাড়তে থাকে, যেমনটি দেখি গ্রামের হোটেলে, কাঠকয়লার উনুনে কেরোসিন ঢালার পর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে আগুন। আমি জানতে চাই-তো সেই রিয়াদ চাচার সাথে তোমার মায়ের পরকীয়া হলো? আকাশ আবারো ক্ষেপে উঠে- না আংকেল মোটেই না, আমার মা আমার বাবাকে খুব ভালোবাসতো। টের পাই ওর মা-বাবার ভালোবাসাটাই ওর সবচেয়ে ভালোলাগা আর দুর্বলতার জায়গা। নীরা ঢুকে যায় মাঝখানে- সে তো আমার বাবা-মাও বাসতো। কত্তো শুনেছি তারা ৭ বছর প্রেম করে বিয়ে করেছে। তবে এরকম হলো কেন? আকাশ কথাটা কেড়ে নেয়- কেন এরকম হলো কে জানে, আমার মা রিয়াদ চাচার নাম শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতো। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রিয়াদ চাচার গালে জোরে থাপ্পড় মেরেছিলো। রিয়াদ চাচা দৌড়ে পালিয়েছিলো। হাঃ হাঃ হাঃ উচ্ছ্বল বাধভাঙা হাসিতে ভেঙে পড়ে আকাশ, ওর মুখ থেকে বিষাদের মেঘ পুরো উধাও। ও বাবা বলো কী- আকাশের আনন্দে আমিও সামিল হই কিংবা ওকে উচকে দিতে আনন্দিত হবার ভান করি- বলো কী হৈচৈ পড়েনি গ্রামে? না না কেউ দেখে নি তো, কেউ জানে না- আকাশ আমার অর্বাচীনতা দেখে অবাক হয়- তুমিও যে কী? এগুলো কেউ কাউকে দেখিয়ে করে? ওর বলার ভংগিতে মজা পাই আমি, নিজেকেই মনে হয় শিশু আর ওকে অভিভাবক- ও তাই, দেখিয়ে করে না? কক্ষনো না- বিজ্ঞের মতো জবাব দেয় আকাশ। তবে তুমি জানলে কী করে- যেনো ওকে ভীষণ বিপদে ফেলেছি এভাবে প্রশ্নটাই করি আমি। কিন্তু আকাশ নির্বিকার উত্তর দেয়- আমি তো শুনেছি রাতে, মা যখন বাবাকে ঘটনাটা বলে বলে কাঁদছিল তখন। আমি আবারো আকাশকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে বলি- ও তুমি বুঝি প্রতিদিন রাত জেগে বাবা-মায়ের কথা শুনতে? মোটেই বিব্রত হয় না আকাশ। অপরাধ বোধহীন উত্তর ওর- না, রোজ শুনতাম না তো, ঘুমিয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে মা যখন জোরে জোরে হাসতো কিংবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো তখন ঘুম ভেঙে যেতো। আমরা কিন্তু প্রতিদিন দেখতাম, বাবা-মায়ের ঝগড়া- নীরা বলে। আমি আকাশের দিক থেকে মনোযোগটা সরিয়ে এবার নীরা-নীলয়ের দিকে নেই। ওদের দিকে মনোযোগ এখন তো পুরো দেশবাসীর, আমি কোন ছার! আমার মনোযোগ কৌতুহলে রূপ নিতে সময় নেয় মাত্র কয়েক সেকেন্ড- তাই তোমার বাবা-মা প্রতিদিন ঝগড়া করতেন? আমার প্রশ্নটা যে কেবলই ওদের খুঁচিয়ে কথা বের করা কৌশল, নীরা-নীলয় তা বুঝতে পারে না। তারা সরল বিশ্বাস করে সব বলতে চায়, যেনো ওদের কথা শোনার মত বিশ্বস্ত কাউকে পেয়েছে ওরা প্রথমবার বলতে থাকে- হ্যাঁ প্রতিদিন, বাবা বাসায় ফিরলেই মা ঝগড়া বাঁধাতো, কেন দেরী হলো, ফোন কেন ওয়েটিং ছিল, বাবার অফিসের রিসিপসনিষ্ট লিজা অ্যান্টি ফেইসবুক কত্তো প্রসংগ ঝগড়ার। বাবাও ক্ষেপে উঠতো, আমাদের সুজন স্যারকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলতো। কী বলতো? প্রশ্নটা পাল্টা করে নিজেকে বোকা বোকা লাগে। ওগুলো তোমাকে বলা যাবে না, মুখে উচ্চারণ করা যায় না- ওদের বিবেচনা সম্মত সপ্রতিভ উত্তর আমার গালে যেনো এবার কষে থাপ্পড় মারে। বাচ্চারা যে ভাষা লজ্জায় মুখে নেয় না বড়রা কী অমানবিক অবিবেচকের মতো সে ভাষা তাদের সামনে ব্যবহার করে। নীরার বলার ভঙ্গিতে পৃথিবীর সব বড়দের অদমনীয় প্রবৃত্তির সকল লজ্জা ঘাড়ে নিয়ে মুখ বুজে বসে থাকি আমি। নীরা সেসব লক্ষ্য করে না, বলতে থাকে- প্রতিদিন ঝগড়া দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো হয়েছে। যা হয়েছে ভালো হয়েছে!! কী হয়েছে আংকেল ভয় পেয়েছেন ভালো হয়েছে বলেছি তাই? সাধ করে কী বলি? সেদিন সকালে ঝগড়া করে বাবা মায়ের গায়ে হাত তুললো। মা কান্নাকাটি করলো সারাদিন। বাবা সন্ধ্যায় ফিরে মা কে ‘সরি’ বললো, সবাই রাতে একসাথে চাইনিজ খেতে গেলাম- আহা কী আনন্দ! ভাবলাম সব মিটে গেছে। আর ঝামেলা নেই, আর ঝগড়াঝাটি হবে না। আমাদের দু’ভাইবোনের ঘরের কোনায় জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপতে হবে না। কিন্তু কে জানতো!! নীলার দীর্ঘশ্বাসে নীলয়ের দীর্ঘশ্বাস এসে যোগ হয়, ছোট্ট শিশুটিকে কত পরিণত বোধ হয় আমার-আপুনি বল সেই জীবন থেকে এখন কত ভালো আছি, প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে কিছু বলার আগে বারবার বাবা-মার চেহারা দেখে মেজাজ বুঝার ভয় নেই, কতো ভালো না বল! আকাশের মুখ আবার থমথম করে- না আমার ভালো লাগে না, মোটেই ভালো লাগে না, গোসল করে আসলে মা মাথা মুছে দেয় না, খেতে না চাইলে ভাত মেখে মুখে তুলে দেয় না। ঘুমানোর সময় কেউ পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় না, মা......মা........ বলে আকাশ কাঁদতে থাকে, একটা অসহায় শিশুর মতোই বিশ্বাস কর আংকেল আমার মায়ের কোনো দোষ নেই। রিয়াদ চাচা চিপস কিনে দেয়ার নাম করে নিয়ে গেল ওর ঘরে, নিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে জোর-জবরদস্তি করে বিছানায় ফেলল..... ঘরের কোনায় রাখা তেলের ক্যান থেকে তেল ঢেলে দিল আমার পাছায়, আমি কিছুই বুঝতে পারি নি আংকেল..... উঃ কী ব্যাথ্যা....... আল্লাহ গো...... মা গো........ আমার মুখ চেপে ধরে ব্যাটা, তারপর গলা.......। আকাশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে, ওর কান্নায় আমি ব্যাথ্যায় গোঙানোর অসহায় যন্ত্রণা টের পাই। ঘেন্নার কষ্টে আমার গা রি রি করে। বিষন্নতা সংক্রামিত হয় নীলয়-নীরার মাঝে। ভারাক্রান্ত গলায় বলে নীরা -আমরাও প্রথমটায় কিছুই বুঝতে পারি নি রে। কী খুশি ছিলাম দুপুরে চাইনিজ পেয়ে। তারপর, তারপর কী ঘটলো?- আকাশ নয়, মূলত যন্ত্রণাকাতর জেনেও ঘটনাটি শোনার তীব্র কৌতুহল আমি আবারো দমাতে ব্যর্থ হই। নীরা বুঝে না আমার অযাচিত কৌতুহল। ও মূলত বলে হালকা হতে চায়- আংকেল বিশ্বাস করুন আমি তো কখনোই বাবাকে বলতাম না সুজন স্যারের সাথে মা ঘরের ভিতর দরজা লাগিয়ে ছিলো, আমরা অসময়ে স্কুল থেকে ফিরে সেটা দেখে ফেলেছি। বিশ্বাস করুন আংকেল, লিজা আন্টিকে যে বাবা টেলিফোনে আই লাভ ইউ বলে সেটাও মাকে বলতাম না, এমনিতেই তো ঝগড়াঝাটিতে অসহ্য লাগতো প্রতিদিন। আমরা তো শান্তির জন্যই কিচ্ছু বলতাম না। তবু আমাদের মারলো কেন? নীলয় এবার বোনের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে- ভালো হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে। বাবা-মা ঝগড়া করে না খেয়ে শুয়ে পড়লে, আমাদের ও খিদে চোঁ চোঁ পেটে না খেয়ে শুয়ে থাকতে হয় না। মা কখন বাবার কাছে মার খেয়ে এসে সেই রাগ আমাদের পিঠে ঝারেন সেই ভয়ে থাকতে হয় না। কত শান্তিরে এখন.........। আমার শান্তি নেই রে- আকাশ বলে, চোখের অশ্রু শুকিয়ে ওর গাল জুড়ে আকাবাকা পৃথিবীর মানচিত্র এঁকে দিয়েছে। আমি মরে গেছি দুঃখ নেই আংকেল, বিশ্বাস করুন আমি প্রথমটায় বুঝতেই পারিনি আমি মরে গেছি। খেতের পাশ থেকে আমার কাদামাখা দেহটা যখন পুলিশ বাড়ির উঠানে এনো রাখলো, তখনো পর্যন্ত আমি বুঝিনি, এমনকী আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার মায়ের আহাজারিতেও না। আমার মনে হচ্ছিলো আমি ঘুমিয়ে আছি। এখনই জেগে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বো। কিন্তু পুলিশ যখন তার হাতের লাঠিখানা দিয়ে মাকে খুঁচিয়ে আমার কাছ থেকে সরিয়ে উঠান ভর্তি মানুষের সামনে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো- কতদিনের পরকীয়ার সম্পর্ক আপনার রিয়াদের সাথে, আমার মা সহ্য করতে না পেরে এক চিৎকারে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো আমি তখন চিৎকার করে সব বলতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না, আংকেল পারলাম না....... বুঝলাম আমি মরে গেছি। আমরা তো প্রতিটা মুহুর্ত টের পেতে পেতে মরেছি আংকেল- নীরার বিষন্নতা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে নীরা- নারে ভাইয়া, খেয়ে দেয়ে দিব্যি মায়ের কাছে ঘুমোতে গেছি। আর মা হঠাৎ.....। পুলিশ এলো, এ্যাম্বুলেন্স এলো, আমাদের লাশ কাটা ঘরে নিয়ে গেলো...... আমার মা যখন আমাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো- আমি ওদের মারিনি, আমি ওদের মারি নি বলে, তখন আমাদেরও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল মা কীভাবে আমাদের গলা টিপে ধরেছিলো, ভাইয়া খাটের নীচে লুকিয়েছিলো, আমরা কত বললাম, আমরা বাবাকে কিচ্ছু বলবো না, কিচ্ছু না, তবু মা শুনলো না।

ওদের কান্নার কোরাস কেমন অশরীরী আওয়াজ তুলে পার্কটির গাছের পাতায়, সাজানো বেঞ্চে অনুচ্চ দেয়ালে বাজতে থাকে করুন সুরে। হঠাৎ ওরা থেমে যায়, চোখ মুছে। একজন তাকায় অন্যজনের মুখের দিকে। তারপর তিনজন একসাথে আমার দিকে। এবার ওদের মুখে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ কৌতুহল। জিজ্ঞেস করি- কিছু বলবে তোমরা? ওদের মধ্যে সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী দৃঢ় আকাশ জানতে চায়- আচ্ছা তুমি কে? তোমাকে আমরা সব কথা কেন বললাম?? তোমাকে তো আমরা চিনিনা। আমার মুখে উত্তর যোগায় না। তোমাদের মৃত্যুর পর আপডেট, ফ্ল্যাশব্যাক, ফলোআপ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। সভা, সেমিনার, মানববন্ধন, পুলিশ, সংবাদপত্র, সমাজবিজ্ঞানী কতো মতামত, কতো অভিমত। সবার মাঝ খানে আমি কে? সত্যি তো আমি কে? যে রহস্য সবাই খুঁজতে খুঁজতে, গবেষণা করতে করতে হন্যে, আমি সেই রহস্য জেনে যাওয়া এক সত্তা ছাড়া কিছুই না। সমস্ত সভ্যতার দায় আর লজ্জা মাথা পেতে নেয়া এক অসহায় বিপর্যস্ত সত্তা, জেনে যাওয়া আর জানার দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করা ছাড়া কিছুই করার নেই যার ॥॥॥

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ