সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক রূপক (Communal-Political Allegory): খরগোশ, যারা সকল সমস্যার কারণ ছিল



মোজাফফর হোসেন
একটি পুরাতন রূপক গল্পের অনুবাদ--

সবচেয়ে অল্প বয়সী শিশুটার মনে আছে—নেকড়ে অধ্যুষিত এলাকায় খরগোশদের একটা পরিবার বাস করতো। নেকড়েরা জানিয়ে দিলো যে, খরগোশদের জীবনযাপনের রীতি-নীতি তাদের পছন্দ না। এক রাতে ভূমিকম্পের কারণে একদল নেকড়ে মারা পড়লো। আর দোষ গিয়ে পড়লো খরগোশদের ঘাড়ে। কেননা সবার জানা যে, খরগোশরা পেছনের পা দিয়ে মাটি আঁচড়িয়ে ভূমিকম্প ঘটায়। আরেক রাতে বজ্রপাতে নেকড়েদের একজন মারা পড়লো।
আবারো দোষ গিয়ে পড়লো ঐ খরগোশদের ওপরে। কারণ সবাই জানে যে, লেটুস পাতা যারা খাই তাদের কারণেই বজ্রপাত হয়। একদিন খরগোশদের সভ্য ও পরিপাটি করার জন্যে নেকড়েরা হুমকি দিলো। ফলে খরগোশরা সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা নিকটবর্তী দ্বীপে পালিয়ে যাবে। কিন্তু অন্যান্য জন্তু-জানোয়াররা যারা খানিক দূরে বসবাস করতো তারা ভর্ৎসণা করে বলল—তোমরা যেখানেই আছ বুকে সাহস বেঁধে সেখানেই থাকো। এ পৃথিবীটা ভিতু-কাপুরুষদের জন্যে নয়। যদি সত্যি সত্যি নেকড়েরা তোমাদের ওপর আক্রমণ করে, আমরা এগিয়ে আসবো তোমাদের হয়ে। 

কাজেই খরগোশরা নেকড়েদের পাশে বসবাস করতে থাকলো। এরপর এক ভয়াবহ বন্যা হল, সেই বন্যায় নেকড়েদের অনেকেই মারা পড়লো। এবারও যথারীতি দোষ গিয়ে পড়লো ঐ খরগোশ পরিবারের ওপর। কারণ সবাই জানে যে, যারা গাজর কুরে কুরে খায় এবং যাদের বড় বড় কান আছে তাদের কারণেই বন্যা হয়। নেকড়েরা দল বেঁধে খরগোশদের, তাদের ভালোর জন্যেই, ধরে নিয়ে গেল এবং তাদের নিরাপত্তার জন্যেই তাদের একটি অন্ধকার গুহার ভেতরে আটকে রাখলো।
কয়েক সপ্তাহ ধরে খরগোশদের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে অন্যান্য জন্তু-জানোয়াররা নেকড়েদের কাছে জানতে চাইলো খরগোশদের ব্যাপারে। নেকড়েরা জানালো যে, খরগোশদের সাবাড় করা হয়ে গেছে। যেহেতু তারা হজম হয়ে গেছে সেহেতু এটা এখন তাদের একান্ত নিজেদের বিষয়। কিন্তু অন্যান্য জন্তুরা হুমকি দিয়ে জানালো, যদি খরগোশদের খাওয়ার উপযুক্ত কোনো কারণ না দেখানো হয়, তাহলে তারা সব একত্রিত হয়ে নেকড়েদের বিপক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সুতরাং নেকড়েদের একটি যুৎসই কারণ দশাতেই হল। তারা বলল, খরগোশরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল; এবং তোমরা ভাল করেই জানো যে পলাতক-কাপুরুষদের জন্যে এ দুনিয়া না!


গল্পপাঠ : রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক অ্যালিগরি

এটি একটি আধুনিক ফেবল। লিখেছেন জেমস থার্বার। রচনাকাল আগস্ট ২৬, ১৯৩৯। সাধারণত এ ধরনের গল্প শিশুদের জন্য লেখা হয়ে থাকে। তবে থার্বার সমাজ বা রাষ্ট্রের কিছু বিষয় সমালোচনা করার জন্যে প্রতীকী উপস্থাপনের কৌশল হিসেবে এই সাহিত্য-কৌশলটি বেছে নেন। 

গল্পটির বেশ কিছু অন্তর্নিহিত অর্থ আছে। গল্পটি মূলত সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় এলিগরি। ব্রডভাবে বিশ্বের যে কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থাকে খরগোশের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা চলে। নেকড়েরা হল সংখ্যাগুরু, শাসকশ্রেণি। বিশ্বের বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন নানাভাবে বঞ্চনা ও নৃশংসতার শিকার হয়ে আসছেন। গত কয়েকদিনে দেশের আলোচিত বিষয়ই হল ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’। 

গল্পের মতোই কোনো একটা অজুহাত খাড়া করে এই নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নাসিরনগরে আমরা দেখেছি, একজন হিন্দুছেলে কাবাশরিফের ছবি বিকৃত করেছে এই গুজব রটিয়ে মহল্লা ধরে হিন্দুসম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। ‘বিকৃত’ সেই ছবি হামলাকারীদের কেউ দেখেছে কিনা সন্দেহ। প্রশাসনও হয়ত সেই ছবি না দেখেই ‘ধর্মের অবমাননা’ না করার নির্দেশ দিয়েছে দেশবাসীকে। উগ্রপন্থীরা একটা কারণ দেখিয়ে অনেকাংশে পার পেয়ে যাচ্ছে।

গল্পে দেখা যাচ্ছে—ভূমিকম্প, কিংবা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরীহ প্রাণী খরগোশকে দায়ি করা হচ্ছে। এটা অ্যাবসার্ড, আমরা জানি। কিন্তু তবুও প্রতিবার বলা হয়েছে, ‘সবাই জানে যে, যারা গাজর কুরে কুরে খায় এবং যাদের বড় বড় কান আছে তাদের কারণেই বন্যা হয়।’ অর্থাৎ ঘোষণার মধ্যেই বলে দেওয়া হচ্ছে যে, তুমি মানো আর না মানো, বিষয়টা সবাই জানে! এখানে একটা মিথ্যেকে সত্য বলে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই অনেক মিথ্যেকে আমাদের মাথার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে অদৃশ্য একটা শক্তি। যে কারণে আমরা দেখেছি, যখনই কোনো ব্লগার খুন হয়েছে তখন প্রশাসন খুনির পেছনে লাগার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে যে খুন হয়েছে তার ব্যক্তিজীবন ঘাটাঘাটি করে খুন হওয়ার যুৎসই কারণ বের করতে গেছে। এরপর বলেছে, যে উগ্রবাদীদের উসকে দেবে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। হয়েছেও।

গল্পের নীতিকথায় বলা হয়েছে, ‘পলাতকদের এ পৃথিবীতে কোনো স্থান নেই’। এটি ঐতিহাসিক সত্য। এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিংবা ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর মানুষরা কোথাও পালিয়ে গেলেও তাদের অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন ঘটবে না। কারণ তারা নিজদেশ ছেড়ে অন্যকোথাও গিয়ে উদ্বাস্তু-জীবন পাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ