ধারাবাহিক উপন্যাস : অদিতার আঁধার --অষ্টম পর্ব

দীপেন ভট্টাচার্য
------------------------------------------------------------------------------------------------------
প্রথম থেকে অষ্টম পর্ব পর্যন্ত এক সঙ্গে  পড়ার লিঙ্ক
------------------------------------------------------------------------------------------------------
অষ্টম পর্ব

রাত্রি হল। এক খাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এক মধ্যবয়সী পুরুষ, সত্তরের ওপর কিন্তু একশোর নিচে বয়স হতে পারে তার। খাদের নিচেই উত্তাল সমুদ্র। তার ঢেউ ভেঙে পড়ছিল নিচের পাথরে, জল ঢুকছিল পাথরের ফাঁক দিয়ে, আবার নেমে যাচ্ছিল শব্দ করে। ভাটার সময় এখন, জোয়ারের উঁচু জল ধীরে ধীরে নামছে। পশ্চিমে সমুদ্রের জলে চতুর্থীর চাঁদ ডুবছে। দিগন্তে চাঁদের ফলাকে বিশাল দেখাচ্ছে, তার প্রতিফলন পড়ছে সমুদ্রের জলে, চিকচিক করছে তা অন্ধকারে।
চাঁদের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল মানুষটি, যেন চাঁদকে চোখের চাহনি দিয়ে বেঁধে রাখবে পৃথিবীর সাথে। তার পরনে ছিল একটা কালো ওভারকোট। অল্প শীত পড়ছে, লোকটি তার ওভারকোটের কলার তুলে দিল গালের পাশে। তার চুল উড়ছিল দক্ষিণ থেকে উড়ে আসা বাতাসে। চাঁদ ডুবে গেলে একটা কালো নিকষ আকাশ নিচের ঊর্মিময় সমুদ্রকে অন্ধকারে ঢেকে দিল, তখন ঢেউয়ের সর্বব্যাপী শব্দ ঘিরে রাখল তাকে। সমুদ্রের গর্জন, ভাবল সে, পৃথিবীব্যাপী বিশাল দানব, সমুদ্রের অধীনেই এখন পৃথিবী।

সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার আশেপাশে কোনো জনবসতি ছিল না। দূরে থেকে দেখা গেল দুজন হেঁটে আসছে ঐ দিকে। টর্চের আলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে পাথর এড়িয়ে তার এগিয়ে আসছিল খাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে। বড় পাথরের আড়ালে তাদের হাতের টর্চের আলো কখনো হারিয়ে যাচ্ছিল, আবার কিছুক্ষণের জন্য দেখা যাচ্ছিল। লোকটি মাঝে মধ্যে পেছন ফিরে এদের অগ্রযাত্রা লক্ষ করছিল, তার দেহভঙ্গী দেখে বোঝা গেল সে হয়তো তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। এরকম মিনিট দশেক যাবার পরে তার কাছাকাছি এল দুজন - একটি যুবতী ও একটি যুবক। সমুদ্রের গর্জনের ওপর যেন তার কথা শোনা যায় সেজন্য উচ্চস্বরে চিৎকার করে ওঠে যুবক, “অশির সান!” লোকটি পেছন ফিরে তাকায় যুবক যুবতীর দিকে, হাত তুলে ইঙ্গিত করে তাদের এগিয়ে আসার জন্য।

বহু দূরে সাগরের ওপর জমা মেঘে বিদ্যুৎ চমকায়, তার শব্দ তীর পর্যন্ত পৌঁছায় না।

যুবক ও যুবতীটি অশিরের কাছে পৌঁছায়, মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করে। অশির অভিবাদনের উত্তর দেয় নিজের মাথা ঝুঁকিয়ে। এদের দুজনের তুলনায় অশির বেশ লম্বা। যুবতীর গায়ে পাত্লা কালো ওভারকোট, যুবকের গায়ে একটি খয়েরী জ্যাকেট। এদের দুজনেরই বয়েস ত্রিশের মত হবে। অশির তাদের দিকে তাকিয়ে তার বাঁ কব্জির দিকে ইঙ্গিত করে। তারা মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দেয় - হ্যাঁ, তাদের দেহের মধ্যে প্রোথিত ফোন ও কম্প্যুটার তারা অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে, এখানে তাদেরকে কেউই আর কোনোভাবেই ট্র্যাক করতে পারবে না।

অশির ঐ দুজনকে ইঙ্গিত করে তাকে অনুসরণ করা জন্য। তিনজন সমুদ্র ছেড়ে পাহাড়ের দিকে যায়, কিন্তু যে পথে ঐ দুজন তরুণ এসেছিল সে পথে নয়। বড় বড় পাথরের ওপর আলো ফেলে সাবধানে তার পথ চলে। মিনিট পনেরো ক্রমাগত চলার পরে তারা পৌঁছায় এমন একটি জায়গায় যেখানে পাহাড়ের শুরু হয়েছে বলা যায়, পাহাড়ের বন যেন হঠাৎ করেই সমুদ্রতটের পাথরে শেষ হয়েছে। এখানে কিছু ঝাউগাছ। অশির আলো ফেলে পাহাড়ে ওঠার একটা পথ বার করে। একটানা আবারো মিনিট পনেরো নীরবে হাঁটার পরে একটা গিরিখাতের মধ্যে ঢোকে তারা, সেখানে প্রচুর বনশিমুল গাছ, পাহাড়ের ঢাল আঁকড়ে আছে। টর্চের আলো মাঝেমধ্যে ওপরের পাতায় পড়ে একটা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি করে। দূরে কোনো বনজন্তুর ডাক শোনা যায়। হাঁটা পথটা ছেড়ে দিয়ে একটা প্রায় দেখা-যায়-না এরকম পথ ধরে তারা। সেই পথ ছিল আগাছায় পরিপূর্ণ, তবু তার মাঝে অশির অনায়াসে পথ খুঁজে পায়। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পথ চলতে পেছনের দুজনের অসুবিধা হচ্ছিল। এইভাবে মিনিট দশ চলার পর তারা একটি জায়গায় থামে। একটা গাছের ডাল নিচু হয়ে ছিল, অশির সেটাকে ডান হাত দিয়ে ওপরে তুলে পেছনের দুজনকে এগিয়ে যেতে বলে। তারা অশিরকে পাশে রেখে গাছটা পার হতেই সামনে দেখে একটি ছোট ঘর। কাঠের ঘর, হালকা ধূসর রঙ করা। তারা ওপরে তাকায়, আকাশ দেখা যায় না। গাছ আর পাহাড়ের সংযোগস্থলে আকাশ হারিয়ে গেছে, পৃথিবীর কক্ষপথের কৃত্রিম উপগ্রহের দৃষ্টিতে এই ঘর থাকবে অদৃশ্য।

পুরনো দিনের কালো রঙের তালা ঝোলে দরজায়। অশির একটা ধাতব চাবি দিয়ে দরজা খোলে। যুবক যুবতী একে অপরের দিকে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে তাকায়, তারা এরকম তালা-চাবি শুধু কম্প্যুটারের স্ক্রিনেই দেখেছে। ভেতরে ঢুকে দেয়ালে একটা সুইচ টেপে অশির, ঘরের দু-কোনে স্ট্যান্ডের ওপরে দুটো বেশ জোরাল বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে ওঠে। ছিমছাম সাজানো একটা ঘর, সেখানে চেয়ার সোফা ইত্যাদি সাজানো। কাঠের মেঝে তাদের ভারে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে। কাঠের দেয়ালে রঙ নেই। পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে আর একট ঘর দেখা যায়। তরুণ দুজন বোঝে বাইরে থেকে যা দেখা যায় তার চেয়ে অনেক বড় এই বাড়িটা।

অশির যুবতীর কোটটা খুলতে সাহায্য করে। কোটটা একটা সোফার ওপরে রেখে দেয়। যুবকটি তার জ্যাকেট খুলে সোফার ওপরেই রাখে।

তরুণ দুজন পাশাপাশি সোফায় বসে। অশির তাদের সামনে ছোট একটি চেয়ারে বসে। যুবতীর দিকে তাকিয়ে বলে, “তারপর, মিরা?”

মিরা অশিরের কোঁকড়া চুলের দিকে তাকায়, বাদামী চোখের দিকে, বলিষ্ঠ চোয়ালের দিকে। গত এক বছরে এই মানুষটিকে সে বেশ কয়েকবার দেখেছে। সে জানে অশির তার ওপর ভরসা রাখে। কয়েকদিন আগে, বিশালগড়ের এক গোপন আস্তানায় শেষবার তাদের দেখা হয়েছে। অশির বলেছিল তাদের গত রাতের অভিযান ‘লোহিতকে’র ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান। অশিরই তাদের শিখিয়েছিল কেমন করে রাস্তার সব ক্যামেরা অচল করে দিতে হয়, ফোনের সঙ্কেত জ্যাম করে দেয়া যায়, মাথার ওপরের কৃত্রিম উপগ্রহের নজরদারি থেকে নিজেদের অদৃশ্য রাখা যায়।

“আমাদের অভিষ্ঠ্য সবই সার্থক হয়েছে,” বলে মিরা, “আমরা অদিতা সানের মস্তিষ্ককে কোমায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি।” মিরার ছোট করে ছাঁটা কালো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমেছে। তীক্ষ্ম চোয়ালের মধ্যে একটা টোল, গালে আর একটি টোল। উজ্জ্বল বাদামী চোখের মণির ওপর চিকন করে ছাঁটা ভুরু। চোখের নিচে মনে হয় দিনরাত না ঘুমানোর ক্লান্তি।

“তাই?” মধ্যবয়সী মানুষটির কথায় সন্দেহ প্রকাশ পায়, “আপনারা কেমন করে নিশ্চিত হলেন?”

“আমরা নিলয় থেকে আসা রেডিও বার্তা শুনতে সক্ষম হয়েছি। ডকটর তারকার বাড়তি নিরাপত্তারক্ষী চেয়ে পাঠিয়েছেন,” বলে মিরা।

“কিন্তু তার মানে এই না যে অদিতা সানের মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় করে দেয়া সম্ভব হয়েছে?”


“হয়েছে,” খুব দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে মিরা, “আপনি এই ভিডিও রেকর্ডিংটা দেখুন।”

মিরা তার জামার পকেট থেকে একটা ছোট দেয়াশলাইয়ের বাক্সর মত জিনিস অশিরকে এগিয়ে দেয়। অশির বাক্সটাকে তার চোখের কাছাকাছি আনতেই তাতে একটা ত্রিমাত্রিক ভিডিও মূর্ত হয় - অদিতা নিলয়ের একটা জানালার ধারে দাঁড়ানো, তার পাশে দাঁড়ানো বিষাণ। এর পরের দৃশ্যে অদিতা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছে এবং মাটিতে পড়ার আগেই স-কুরা তাকে ধরে ফেলে ভেতরে নিয়ে যায়। পরবর্তী দৃশ্যে বিষাণ জানালার কাছে এসে বাইরের দিকে চাইছে - খুঁজছে তাদের যারা অদিতার মস্তিষ্ককে নিষ্ক্রিয় করেছে।

মিরা খেয়াল করে ভিডিওটা দেখতে দেখতে অশিরের চোখ কুঁচকে ওঠে, কপালে ভাঁজ পড়ে। অশিরের মুখে মুহূর্তখানেকের জন্য কি বেদনার ছাপ দেখা গেল, নিশ্চিত হতে পারে না মিরা। অশির জিজ্ঞেস করে, “প্রফেসর বিষাণ আপনাদেরকে দেখতে পায় নি?”

“না,” আবার বেশ জোরের সঙ্গে উত্তর দেয় মিরা।

“বেশ, আর ডকটর বিনতা?”

“তাঁর কাছ থেকে অদিতা সানের নিরাময় নম্বর ও পাসওয়ার্ড বার করা গেছে খুব সহজেই,” এবার কথা বলে সিলোন, “ওঁর ছেলেকে অত্যাচার করা হবে এই ভয়েই সব বলে দিলেন। আর ওনাকে হত্যা করাটাও খুব একটা কঠিন হয় নি।” সিলোনের কালো চুল ছোট করে ছাঁটা, চৌকো মুখ, কামানো গাল। তার চোখেও এক ধরণের দীপ্তি, কিন্তু না-ঘুমানোর ক্লান্তি তার মাঝেও স্পষ্ট।

“খুব একটা কঠিন হয় নি? একটা মানুষকে মেরে ফেললেন, আর বলছেন খুব একটা কঠিন হয় নি? আর বলছেন নম্বর পাসওয়ার্ড বার করা গেছে সহজেই? ছেলেকে নিয়ে ব্ল্যাকমেল করলেন বলেই তো উনি আপনাকে নম্বরটা দিয়েছেন।’ অশিরের রাগ দমিত থাকে না, ভিডিওর ছোট বাক্সটা তার বাঁ হাতে ধরাই ছিল, মিরা দেখল সেই হাত কাঁপছে।

সিলোন অশিরের ক্রোধে আশ্চর্য হয়। সে মিরার দিকে তাকায়, মিরার চোখেও বিহ্বলতা লক্ষ করে, তারপর বলে, “মানুষকে মেরে ফেলা তো আর ঠিক মেরে ফেলা নয়। আজকের মধ্যে তো ডকটর বিনতার জীবন ফিরে পাবার কথা। আর ওনার হত্যার নির্দেশ তো আপনিই দিয়েছেন।”

“হ্যাঁ, আমিই দিয়েছি সেই নির্দেশ, তার মানে এই না যে হত্যাকে আমরা নিছক খেলা হিসেবে গ্রহণ করব। একটা হত্যা মানে পৃথিবী থেকে একটা জীবনের অপসারণ।”

“কি বলছেন আপনি? কার জীবনের অপসারণ? ডকটর বিনতার মস্তিষ্ক ইতিমধ্যে নিশ্চয় প্রতিস্থাপিত হয়েছে, উনি এতক্ষণে নিশ্চয় বেঁচে উঠেছেন,” বিস্মিত হয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করে সিলোন।

“হ্যাঁ হয়েছে। কিন্তু এই ডকটর বিনতা কি সেই ডকটর বিনতা যাকে আপনি হত্যা করেছেন? নাকি এই দুইজন সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি? আমি বলি, তাঁরা দুজন আলাদা মানুষ, তাঁদের দুজনের দুটো আলাদা মস্তিষ্ক। একটি মস্তিষ্ককে আপনি নিভিয়ে দিয়েছেন, আর একটি মস্তিষ্ক সেটির জায়গায় এসেছে। কিন্তু যে মস্তিষ্ক এসেছে সে আমাদের সময়কার বিনতা নয়, সে আর একটি সময়ের, আর একটি মহাবিশ্বের বিনতা। এই দুইজন কিছু পুরনো স্বপ্ন নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে মাত্র, এর থেকে বেশী কিছু নয়। আমার থেকে এর চেয়ে কে আর বেশী জানে?’ অশিরের স্বরের প্রাবল্য বাড়ে, মিরা লক্ষ্য করে তার হাত আগের চেয়ে জোরে কাঁপছে।

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় অশির। ঘরের কোনায় দাঁড় করানো বাতিটার আলো পড়ে তার মুখের একদিকে। সেই আলোতে মানুষটাকে বুঝতে চায় মিরা। অশিরের মুখে, কথায়, দাঁড়িয়ে থাকার কিংবা হাঁটার ভঙ্গীতে এমন কিছু আছে যা সহজেই আকৃষ্ট করবে মানুষকে। তার ডাকেই সিলোনের মত তরুণেরা ‘লোহিতকে’র মত এমন একটা গোপন সংগঠনে যোগ দিয়েছে। আকৃষ্ট হয়েছে মিরাও, সেই আকর্ষণের জন্য তাকে মূল্যও দিতে হয়েছে। কিন্তু সেই মূল্য দিতে দ্বিধা করে নি, কারণ সে বিশ্বাস করেছে অশিরের কথাকে, অশিরকে। মানুষকে আবার মানুষের মত বাঁচতে দিতে হবে, বর্তমান এই সমাজকে বদলাতে হবে। আর অশিরকে বিশ্বাস করে বলেই বিনতাকে হত্যার মত কঠিন অভিযানে সে রাজি হয়েছে।

অশির অধৈর্য হয়ে পায়চারি করে। বলে, “আমরা যদি মানুষকে হত্যা করি, সেই দায়ভার আমাদের নিতে হবে। কারণ প্রতিটি জীবিত মানুষ অনন্য। যে বিনতাকে গত রাতে আপনি মেরেছেন সেই বিনতা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, যে আসবে সে হল আর এক বিনতা যাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল তিন বছর আগে। তিন বছর আগে কপি করা বিনতাও অনন্য। আর এবার চিন্তা করুন সেই কোটি কোটি মস্তিষ্কের কথা যারা তৃতীয় সংরক্ষিত মস্তিষ্কে পরিণত হয়। প্রতি তিন বছর অন্তর মস্তিষ্ক কপি করা হয়। আপনি জানেন একজন মানুষের মাত্র দুটো মস্তিষ্ক সংরক্ষাণাগারে রাখা হয়, একটি প্রতিস্থাপনের জন্য, অন্যটি থাকে ব্যাকআপ হিসেবে। কিন্তু এই দুটি ব্যবহার না হলেও ষষ্ঠ বছরের মাথায় আর একটি মস্তিষ্ক কপি করা হয়। সেই সময় ছ’বছর আগের কপি করা প্রথম মস্তিষ্কটিকে ধবংস করে দেয়া হয়, অর্থাৎ পুরনো মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখতে যে শক্তি প্রবাহ দরকার সেটা বন্ধ করা দেয়া হয়। আপনার কি মনে হয় না সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের জীবন ছিল? আপনার কি মনে হয় না সেই মস্তিষ্কের বাঁচার অধিকার ছিল? সংরক্ষাণাগারের হিম শীতলতায় সেই মস্তিষ্ক স্বপ্ন দেখে, আর স্বপ্ন যে দেখে সেই মানুষ। সেই মস্তিষ্ককে বন্ধ করে দেয়া মানে তাকে হত্যা করা। আমরা নাকি সভ্যতার শিখরে পৌঁছেছি, অথচ তার জন্য আমরা যে মূল্য দিচ্ছি তা প্রাচীন সব সমাজের বর্বরতাকে ছাপিয়ে যাবে।”

সিলোন মাথা নাড়ায়, সে এসব বোঝে, সে কোনো অন্ধ যান্ত্রিক আততায়ী নয়। তবু অশিরের কথার মাঝে এমন কিছু ছিল যা তাকে বিচলিত করে। অশিরের এমন প্রতিক্রিয়া, কথার তীক্ষ্মতা সে আশা করে নি। কোনো একটা অবোধ্য কারণে তার অস্বস্তি হয়।

অশির আবার চেয়ারে বসে, বলে, “কিন্তু সেটাও বড় কথা নয়। মানুষের সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে মৃত্যুবরণ করা জন্য, তার জীবনকাল যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য দীর্ঘায়িত করা হয় তবে সেটা অস্বাভাবিক, সেই জীবনের মুল্য কী? মৃত্যু আছে বলেই তো জীবনের মূল্য আছে।”

মিরা অনুভব করে ঘরটা গরম হয়ে উঠছে। অশিরের কপালে ঘামের বিন্দু খেয়াল করে সে। এই মানুষটি তার জীবন বদলে দিয়েছে। বিশালগড়ের বাইরে একটি ছোট খামারে মিরা কাজ করত, শাক সবজী টমেটো আলু, কিছু ফল এসবের ফলন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল সে। এক বছর আগে নিলয়ে নিয়মিত মস্তিষ্ক কপি করাতে এলে, নিলয়ের কাছেই ফোয়ারার চত্বরে, তার সঙ্গে একটি যুবকের পরিচয় হয়, তার পরে প্রেম। সেই যুবক ‘লোহিতক’ সংগঠনের সদস্য ছিল। তার মাধ্যমেই অশিরের সঙ্গে পরিচয়। মিরার প্রেমিক বন্ধুটি বলেছিল ‘লোহিতকে’র সর্বময় কর্তা হল অশির। অশির অবশ্য সেটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, বলেছিল পৃথিবীর অনেক বড়, তার দায়িত্বও অনেক, তার মত ছোট মানুষের পক্ষে সেই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। অথচ আজ যখন অশির কথা বলছে, মিরার মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত দায়ভার যেন অশিরের ঘাড়ের ওপরই ন্যস্ত। মানুষকে তার প্রকৃতির পথে ফিরিয়ে আনতে হবে, এই কথাগুলো মিরার মনে হয় একেবারেই অনন্য, শুধুমাত্র এক সর্বময় কর্তৃত্বের পক্ষেই এই কথাগুলো বলা সম্ভব।

পরের কথাগুলো অশির বলে খুব ধীরে, কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ে, “তাই ‘লোহিতক’ গোষ্ঠীর মিশন হল সমস্ত সংরক্ষিত মস্তিষ্ক ধ্বংস করে দেয়া।” মিরা আর সিলোন ‘লোহিতকে’র উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষা নিয়েই এর সদস্য হয়েছে, অশিরের কথায় তারা বিচলিত হয় না। অশির বলে, “হ্যাঁ, আমাদের যুক্তিমত এটা হবে একটা গণহত্যা। কিন্তু এই মস্তিষ্কগুলোকে তো কর্তৃপক্ষ ধ্বংসই করে দিত। কিন্তু সেই হত্যাকাণ্ড শুধু একবারই সংঘটিত হবে, হাজার হাজার বছর ধরে নয়। মানুষকে তার প্রকৃতির পথে ফিরিয়ে আনতে এর প্রয়োজন আছে।”

মিরার প্রেমিক মিরাকে ‘লোহিতক’ সংগঠনের কাজে যুক্ত করেছিল, মিরা যে কর্তৃপক্ষের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করছে না তার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। অশির প্রথম দর্শনেই মিরার মধ্যে এক বিশাল সম্ভাবনা দেখেছিল। তাই মিরার সেই প্রেমিকের অজান্তেই মিরার ওপর ন্যস্ত হয়েছিল গুরুতর দায়ভার। কিন্তু ইতিহাস বলে এধরণের সংগঠনের গোপন কার্যকলাপ এক ধরণের অন্ধকার নিয়ে আসে, ‘লোহিতকে’র ব্যাপারেও তার অন্যথা হয় নি। সংগঠনের সদস্যরা সেই অন্ধকার প্রথমে বুঝতে পারে না, কিন্তু নেতৃত্ব, দক্ষতা, নৈপুণ্য, বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা ও অহংএর লড়াইয়ে তাদের ব্যক্তিগত আত্মত্যাগ বিসর্জিত হয়। ‘লোহিতক’ সংগঠনে মিরার গুরুত্ব দেখে সেই প্রেমিকের ঈর্ষা হয়, সে মিরার সঙ্গে অশিরের একটা সম্পর্কের কথাও কল্পনা করে। অশির মনে করে সংগঠনের স্বার্থে মিরার প্রেমিককে সরিয়ে দেয়া দরকার, অশিরের এই সিদ্ধান্তে মিরা রাজিও হয়। তাই অশিরের সঙ্গে মিরার পরিচয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই সেই প্রেমিকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। অশির হয়তো সিলোনকে দিয়ে এই খুনটা করায়। কর্তৃপক্ষ সেটাকে আত্মহত্যা বলে ধরে নেয়। মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের পরে নতুন যে যুবকের আবির্ভাব হয় তার মাথায় ‘লোহিতক’, অশির বা মিরার কোনোই স্মৃতি ছিল না। মিরার সঙ্গে তার প্রেমের ইতিহাস মুছে গিয়েছিল। এভাবেই সংগঠনের স্বার্থে, বৃহৎ উদ্দেশ্যের নিমিত্তে মিরা তার প্রেমকে বিসর্জন দেয়।

তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের পরে বিশালগড়ের রাস্তায় সেই প্রেমিক দু-একবার মিরার পাশ দিয়ে গেছে, মিরাকে চিনতে পারে নি। এতে মিরার মনে যে একেবারে দুঃখবোধ হয় নি তা নয়, কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থের জন্য এটা একটা আত্মত্যাগ বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছে। ততদিনে অবশ্য অশিরের প্রতি এক আদিম আকর্ষণ তার মধ্যে সে অনুভব করেছে তাই সেই বেদনাকে মেনে নিতে তার অসুবিধে হয় নি। এক খামার শ্রমিক থেকে মিরা পরিণত হয়েছে এক বিপ্লবী আততায়ীতে, অশিরের জন্যই এই নতুন উত্তেজনাময় জীবন সম্ভব হয়েছে। ইতিহাস গড়ছে এই মানুষ, মিরাকেও ইতিহাসে ভূমিকা রাখতে সাহায্য করছে। অশিরের ব্যক্তিত্বে সম্মোহিত মিরা লোহিতকের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন করে না, জানতে চায় না কেন অশিরের নির্দেশে অদিতার মস্তিষ্ককে বেতার কম্পাঙ্ক দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হল, জিজ্ঞেস করে না কেন কোটি কোটি মানুষের মধ্যে অদিতাকে বাছাই করা হল।

সে রাতে অশিরের আস্তানায় বিশ্রাম নেয় মিরা আর সিলোন আলাদা ঘরে। ‘লোহিতকে’র নেতার সম্মোহন চুম্বকের মত, তার মোহ মিরার মত সাহসী আর পৃথিবী বদলে দেবার মত মানুষও অগ্রাহ্য করতে পারে না। মাঝ রাতে উঠে অশিরের ঘরে যায় মিরা।

---------------------------

ঐ একই রাতে বিশালগড়ের ‘নিলয়ে’ জেগে ওঠে নতুন (আসলে পুরনো) বিনতা। তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ঘুম ভাঙতেই সে চিৎকার করে ওঠে, “পারছি না, আর পারছি না, আমাকে মুক্তি দাও।” ঘরে দৌড়ে আসে স-কুরা। সে হাত রাখে বিনতার মাথায়, মুহূর্তে শান্ত হয়ে যায় বিনতা, মাথাটা হেলে পড়ে বালিশে। আবার আর এক ঘুমে ঢলে পড়ে, আবারো স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্ন দেখেছে সে গত দু-বছর নিলয়ের মাটির নিচের গুদামে, সংরক্ষাণাগারে। যে স্বপ্ন থেকে মুক্তি নেই, যে স্বপ্ন সত্যির কাছাকাছি, যে স্বপ্ন বলে তুমি এক হাত-পা দেহবিহীন মানুষ, আবদ্ধ আছ এক কাঁচের বড় শিশিতে, সেই শিশি থেকে তোমার মুক্তি নেই, মুক্তি নেই।

(চলবে)



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ