সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম'এর গল্প : অল্টার ইগো



থানা থেকে বেরিয়ে যে কথাটা খোন্দকার আফজালের প্রথম মনে এল, যা তাঁর অবস্থানের যে কোনো মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট, তা হল: এখন থেকে মাথার পেছনেও দুটো চোখ বসিয়ে রাখতে হবে; চোখদুটোকে শান দিতে হবে যাতে যে কোনো ছায়ার পেছনের কায়াটাকে খুঁজে নিতে পারে; নাকটাকে শেখাতে হবে, বিপদের সবচেয়ে অস্পষ্ট ঘ্রাণটাও যেন টেনে নিতে পারে।

থানার পুলিশ তাঁকে বলেছে, গত তিনদিন তাঁকে যে লোক টেলিফোনে হুমকি দিয়ে আসছে, সে শুধু এক ভয় ধরানো ভরা গলাই নয়, সে এক পেটানো শরীরের বেপরোয়া মেজাজের চূড়ান্ত দুর্ধর্ষ খুনিও। হ্যাঁ, দাউদ মিয়াই তার নাম। তাকে ধরা যায় না, সে ঘুরে তার দশ অবতার নিয়ে, অর্থাৎ যে কোনো মুহূর্তে দশটা শরীর ধরে সে বিচরণ করে, একটাকে পাকড়াও করা গেলেও নয়টা থেকে যায়, সেই নয়টাও শিগগির দশটা হয়ে দাঁড়ায়। সাত বছর জেল খেটে সে দু’মাস হয় বেরিয়েছে, কিন্তু এই সাত বছরে রক্ত হিম করা অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে তার কোনো না কোনো অবতার। খালাস পেলেও পালিয়ে বেড়াচ্ছে দাউদ, একটা মামলার রায় হতে যাচ্ছে যে কোনো দিন, তাতে আবারো লাল দালানে ঢুকতে হতে পারে তাঁকে। থানার কর্তা নতুন এসেছে, চোখে মুখে এখনও উৎসাহ, গলায় বিশ্বাস। সে বলেছে, লোকটাকে ধরতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব; নতুন এসেছি, তারপরও সময় বেশি নেব না-- সেরকম একটা কথা দিচ্ছি। কিন্তু ইন দ্য মিন টাইম সাবধানে থাকবেন, অতি সাবধানে।

খোন্দকার আফজাল জেলা শহরে উকিল ছিলেন, পাবলিক প্রসিকিউটরও, অর্থাৎ পি পি। বছর তিনেক আগে তাঁর স্ত্রীবিয়োগ হয়। তিন সন্তান বিয়েসাদী করে দেশে না হয় বিদেশে নিজেদের সংসার পেতে ব্যস্ত। ছেলেমেয়েশূন্য একলা বাসায় থাকাটা অসম্ভব ছিল না তাঁর জন্য, কিন্তু রিক্স্রা থেকে নামতে গিয়ে একদিন পায়ে এমন জখম জুটালেন যে চলাফেরাটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। এক কষ্টের দীর্ঘ রাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যথেষ্ট ওকালতি হয়েছে, একজীবনেরও বেশি। এখন ওকালতি নরকে যাক, শহরবাস নরকে যাক। তাঁর ছেলেমেয়ে -- তাঁর উত্তরপুরুষ -- তাঁকে একলা ফেলে নিজেদের সুখ খুঁজে নিয়েছে। তারাও নরকে যেতে পারে। তিনি বরং তাঁর পূর্বপুরুষদের আশ্রয়ে যাবেন। তাঁর বাবা বেঁচে থাকলে বয়স হত ৮৮, দাদার হত ১১৯, পৈদাদার ১৪৪। এতসব বয়সী মানুষের সামনে হু হু করে কেঁদে মনের কষ্টটা জানাতে তাঁর অসুবিধা নেই। তাঁর মাথায় হাত দিয়ে তাঁরা বরং সান্তনা দেবেন, বলবেন, বোকা ছেলে, কাঁদতে নেই। দু’দিন আগে দেশে থাকা একমাত্র সন্তান ওয়াহিদকে নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে অজান্তেই হয়তো গলায় কান্নার ভাব এনেছিলেন; এ জন্য কিনা কে জানে, যে তিনি মনে মনে খুব আশা করেছিলেন, কান্নার ভাবে কাতর হয়ে ওয়াহিদ তাঁকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবে, অথবা, নিদেন পক্ষে, মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে এসে থাকবে। অথচ কান্নার ভাব ওঠাতেই ওয়াহিদ বিরক্ত হয়ে বলছে, বুড়ো মানুষের মতো নাকি-কান্না কাঁদো কেন, বাবা?

বাহুবল থানা থেকে ছ’মাইল দক্ষিণে উঁচু নিচু জমি আর জঙ্গল ঘেরা ফতেপুরে বাপ দাদার পুরনো দালানে থানা গেড়ে বসার পর খোন্দকার আফজালের মনে হল, এত শান্তি কোনোদিন তাঁর পাওয়া হয়নি। গ্রামের বাড়িটা ভাঙ্গা হলেও কিছুটা সারিয়ে তুলে বাসযোগ্য করা গেল। দেখাশোনার জন্য পুরনো মানুষ সরকুম মিয়াকে পাওয়া গেল, এবং বোনাস হিসাবে তার স্ত্রী আর বিধবা এক মেয়ে, এবং সেই মেয়ের বড় মেয়েকে, যারা সবাই মিলে তাঁর দেখাশোনার দায়িত্ব নিল। খোন্দকার আফজালের দাবিদাওয়া সামান্যই -- তিন বেলার খাবারের ব্যবস্থা করা, কাপড় চোপড় ধোয়া, বিছানা করা, বাথরুম পরিস্কার রাখা। তারা কাজগুলো আনন্দ নিয়ে করল যেহেতু তাদেরও তিন বেলার খাবারের দায়িত্ব নিলেন খোন্দকার সাহেব। সেই সঙ্গে মাঝে মধ্যে টাকা পয়সা। আর মাথার ওপর একটা অভয়ের ছাতা।

ফতেপুরের ভিটে বাড়ির বাইরে জায়গা জমি খুব বেশি নেই। তাতে অবশ্য ধান সবজি ফলিয়ে সেসব বিক্রি করে টাকা পয়সা খারাপ আসেনা। এতদিন টাকাটা ওয়াহিদ নিত। ফতেপুর এসে খোন্দকার আফজাল সেই দায়িত্ব নিজের হাতে নিলেন। তাতে ওয়াহিদ বিরক্ত হল, কিন্তু এই নিয়মিত উপার্জন হারানোর পেছনে তার যে একটা ভূমিকা ছিল -- যথা, বাবাকে কান্নার জন্য ভর্ৎসনা করাটা Ñ সে কথা ভেবে সে চুপ করে গেল।

মাস সাতেক খুব ভালই চলছিল আফজাল সাহেবের। কিন্তু ভাল আর থাকল না এক সন্ধ্যায়, সেই ভয় ধরানো ভরাগলার লোকটা থেকে যখন একটা ফোন এল, এবং ফোনে যখন সে বলল, যথেষ্ট ইতরসুলভ ভাষায়, আমাকে মনে আছে, উকিলের বাচ্চা? নাই? হা হা হা? ঠিক আছে, মনে নাই। আমার নাম কি, জিজ্ঞাস করলি? নামের দরকার নাই, এখন থেকে এই নামটা না হয় মনে রাখ -- যম। হা হা হা।

নাম অবশ্য অনেকগুলো মনে হয়েছিল খোন্দকার সাহেবের, তবে সারা রাত ভেবে একটা নামে এসেই থমকে গেছেন তিনি -- দাউদ মিয়া। দুর্ধর্ষ ডাকাত, ক্ষমাহীন খুনি। ওই খুনির বিরুদ্ধে এক জোড়াখুনের মামলায় সফলভাবে লড়ে খোন্দকার আফজাল পি পি তার ফাঁসি আদায় করেছিলেন। আদালত যেদিন রায় দিল, দাউদ কাঠগড়া থেকে আগুন চোখে তাঁর দিকে তাকিয়েছিল। আফজাল দাউদকে দেখেননি, দেখেছিলেন তার চোখ দুটিকে। ঠিক যেন সুপার সাইক্লোনের কেন্দ্রে থাকা চোখ, যে চোখ দিয়ে মহাবিশ্বের কোনো পরাক্রমশালী শক্তি পৃথিবীটাকে দেখে, আর হাসে; ভাবে, এত ক্ষমতার দুনিয়াটা এত পল্কা, এত পাটকাঠির মতো? -- সেই ভয়াল তুফানচোখ, যাকে ঘিরে তুফানের সকল শক্তি আর ধ্বংস ঘুরে ঘুরে নাচে, যাদের এক ঝাপটাতে একখানা বড় জাহাজও পানি থেকে একশ ফুট উপরে উঠে আছড়ে পড়ে।

দাউদ তাকিয়ে দেখেছে খোন্দকার সাহেবকে, কিন্তু কোনো কথা বলেনি। শুধু একসময় একটা ঠাট্টার চিকন হাসি হেসেছে, যা হাসি নয় আবার শক্ত চোয়াল আর ফুঁসতে থাকা নাকের নিচে হাসিও; আর রক্তে চুবানো কড়ির মতো চোখ মেলে দেখেছে। ওই ভয়াল চোখের নিচে খোন্দকার আফজাল একটা পূর্ণ মানুষ থেকে বামুন হতে হতে মিলিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে দাউদের উকিলের হাসি। হাইকোর্টে এই রায় টিকবেনা, পি পি সাহেব, সে হাসতে হাসতে বলেছে। কাজটা ভাল করলেন না, আর খুব যে উঁচু গলায় নাটক করে বললেন, ‘এই ঘৃণিত নরপশুকে কোনো কৃপা দেখানো যায় না --’ এসব না বললেই পারতেন। দাউদ এগুলার হিসাব রাখে।

দাউদের উকিলের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলল। হাইকোর্ট দাউদের ফাঁসি রদ করে সাজাটা চৌদ্দ বছরে নামিয়ে দিল। এরপর আবারো আপিল হল। সুপ্রীম কোর্টে চৌদ্দ বছর কমে হল সাত বছর। এই সাত বছরের মধ্যে ঢুকে গেল জেলা আদালতের রায় থেকে আপীল পর্যন্ত কাটানো তার তিন বছর। থানার নতুন পুলিশকর্তা গলায় দু:খ নিয়ে বললেন, স্বাক্ষী সাবুদের এত বড় দুরবস্থা নিয়ে কতদূর যাওয়া যায়? লোকটা যে বেকসুর খালাস পায়নি, সেটাই ভাগ্য। তবে, তার বদ কসুরের কারণে সাত বছর তো পেয়েছিল। সেটাই বা কম কিসে?

দাউদ দিনে একবার তাঁকে ফোন করে, এবং কী আশ্চর্য, তিনি ফোন ধরেন। দ্বিতীয় দিন বলেছিলেন, গালিগালাজ করোনা, আমি ভদ্রলোক, ভদ্রলোকের ভাষায় কথা বল। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে আরো খারাপ গালি দিয়েছে দাউদ এবং তিনি ফোন বন্ধ করে দিয়েছেন। তৃতীয় দিনে অবশ্য দাউদ মেজাজ দেখায়নি, গালিও দেয়নি, শুধু ঠাণ্ডা গলায় বলেছে, খোন্দকার আফজালের কারণে সে তার বৌয়ের কবর নিজ হাতে দিতে পারেনি, তার জানাজাও পড়তে পারেনি, মরার সময় তার পাশেও থাকতে পারেনি; খোন্দকারের কারণে সে মেয়ের বিয়ে দেখতে পারেনি; অনেক অনেক রাত ঘুমাতে পারেনি; অনেক রাতে হাওরে গিয়ে মাছ মারতে পারেনি; চাঁদ ডোবা দেখতে পায়নি। ইত্যাদি। খোন্দকার আফজাল দেখেছেন, মানুষ একটা কামরায় বা একটা বাড়িতে বা একটা কোথাও দীর্ঘদিন আটকা পড়লে বাস্তবটা সে অল্প অল্প করে অস্বীকার করতে থাকে, যেন তা করলেই আটক অবস্থার অবসান হবে। একসময় যদি আটককালটাই একমাত্র বাস্তব হয়ে দাঁড়ায়, তখন একটা প্রকৃত বা কাল্পনিক রাগ দিয়ে তাকে খাটো করতে চায় মানুষ, অথবা প্রমাণ করতে চায় জগৎ তার প্রতি অবিচার করেছে, এখন সেই অবিচারের মাশুল জগৎকে দিতে হবে। খোন্দকার জানেন, দাউদ রাতে হাওরে গিয়ে মাছ মারুক আর না মারুক জেলে বসে ওই মাছ মারতে না পারার কাল্পনিক দু:খটা ছাপিয়ে গেছে তার বাস্তবের সত্যকে। ফলে সে প্রচন্ড ক্রোধ অনুভব করেছে, এবং এই ক্রোধ-- শুধু রাগ নয়, ক্রোধ-- দাউদকে তার আটককালটা কাটাতে, সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করেছে। তিনি জানেন জেলের ভেতরের একদিন বাইরের সাত দিন থেকেও ভারী। যার ক্রোধ নেই, জিঘাংসা নেই, শত্রুতা নেই, অথবা যার মনটা কল্পনার একটা বিকল্প জগৎ এবং সেই জগতে উড়ে যাওয়ার বাহন তৈরি করতে পারে না, তার বুকের ওপর সময়টা একটা ভারী পাটার মতো চেপে থাকে।

খোন্দকার বললেন দাউদকে, এসবের জন্য দায়ী তো সে নিজেই। সে যদি জোড়া খুন না করত, কে তাকে স্পর্শ করত? তখন তাঁর কাছে দাউদ মিয়া আর দশটা অন্য মানুষের মধ্যে তফাৎ থাকতো না; অথবা, আদালতের পেশকার, চায়ের দোকানদার তারা মিয়া অথবা ইউসুফ চৌকিদারের মতোই মনে না রাখার মতো একটা নাম হতো দাউদ মিয়া।

কথাটা বলেই অবশ্য বুঝলেন খোন্দকার আফজাল একটা নেহাৎ অপাত্রে তিনি ঘি ঢাললেন, এক বেকুবের উলুবনে তাঁর কথার মুক্তা ছড়ালেন। এসব কথা তিনি একান্তে বিকেলের বাতাসটাকেও বলতে পারতেন। দাউদ এসব শুনতে চায় না, জেল খাটতে থাকা মানুষের ক্রোধটাই, প্রতিহিংসাটাই সম্বল। সেখানে সত্য মিথ্যার হিসাবটা অচল। সবই সেখানে সত্য অথবা মিথ্যা, তবে নিজের যুক্তিটাই একমাত্র সত্য। দাউদকে বিশ্বাস করতে হবে জোড়াখুন সে করেনি, অথবা করলেও ঘোরতর যুক্তি ছিল সেই দুই খুনের পক্ষে: ‘দুই নরপশুকে প্রাপ্য শাস্তি দেয়া হচ্ছে’ ধরণের অকাট্য যুক্তি। দাউদের প্রতিক্রিয়া তা-ই প্রমাণ করল। আসলে তাও না, অথবা তা-ই শুধু না, প্রতিক্রিয়াটা জোরে হল ইউসুফ চৌকিদারের নাম বলার জন্য। এই ইউসুফ কিনা ধরেছিল দাউদকে, একেবারে, যাকে বলে জাপটে, নূরগঞ্জের আক্রাম উদ্দিনকে সন্ধ্যা ঘন হওয়ার আগেই খুন করে পালাবার সময়। এমন সাহসী লোক ছিল ইউসুফ, যে দাউদ তার ঘাড়ে চাপাতির একটা কোপ দেয়ার পরও জাপটে ধরেই ছিল তাকে। প্রায় চার মিনিট। এই চার মিনিটে ইউসুফের ছেলে আর প্রতিবেশী চার-পাঁচ জোয়ান ছেলে এসে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দাউদকে নির্জীব করে পাকড়ে থানায় নিয়ে দিয়েছিল। দাউদের জোড়াখুনের দ্বিতীয় শিকার ছিল ইউসুফ চৌকিদার।

দাউদ চিৎকার করে বলল, ওই হালা চৌকিদারের পাওনা মিটাইয়া দিছি। তার কথা কন ক্যানে?

খোন্দকার বললেন, না, ইউসুফের কথা তোলাটা ঠিক হয়নি আমার, ইউসুফ ভাল মানুষ ছিল, সাহসী মানুষ ছিল। তুমি তার পায়ের নোখের যোগ্য না।

দাউদের গলায় বিস্ফোরণ ঘটল।

নিস্তরঙ্গ গলায় খোন্দকার জিজ্ঞেস করলেন, কি করবে আমাকে, দাউদ?

দাউদ আশা করেছিল, খোন্দকার সাহেব ভয়ে কাতর হয়ে যাবেন। তাঁর গা কাঁপবে, হাটু কাঁপবে, গলা কাঁপবে। ফোনে তাঁর আতংক তাঁর কানে একটা তৃপ্তিকর গানের মতো বাজবে। সেরকম কিছু না হওয়ায় সে হতাশ হল এবং সেই কারণে দ্বিগুণ রেগে গেল। কী কী সে করবে, তার একটা ফিরিস্তি দিল।

খোন্দকার জিজ্ঞেস করলেন, কবে?

দাউদ এমন শব্দে ফাটল যে ফোনটাও প্রায় বিকল হল, একটা স্ট্যাটিক তৈরি হল, যাতে দাউদের কথা হারিয়ে গেল। সেই স্ট্যাটিক খোন্দকারকে জানিয়ে দিল, এই লোককে নিয়ে হেলাফেলা করা যায় না। পরে খোন্দকারের কাছে দাউদের সঙ্গে তাঁর আলাপের বিবরণ শুনে সরকুমের বিধমা মেয়ে বিনাও যথেষ্ট চিন্তিত হল। পৃথিবীটাকে সে চেনে। সে বলল, আব্বা, পুলিশে যান।

খোন্দকার আফজাল পুলিশে গেলেন।


২.

খোন্দকার সাহেব বললেন বটে মাথার পেছনেও চোখ বসাতে হবে, চোখ দুটোকে শান দিতে হবে, ইত্যাদি, কিন্তু তিনি জানেন এসব করেও পার পাওয়া যাবে না। কেউ পায়না। তাঁর মনে আছে, পাঁচ-সাত বছর আগে এক মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষীকে দুই পুলিশের পাহারায় আনার পরও বাঁচানো যায়নি। রাষ্ট্র বনাম আলমাস আলী মামলায় স্বাক্ষী মরে যাওয়ায় আলমাস আলী ছাড়া পেলেন। পরে এম পি হলেন। এম পি হওয়ার এক বছরের মাথায় তিনিও এক হামলার শিকার হয়ে একটা হাত একটা পা হারালেন। এরপর এম পির পদটাও।

সহিংসতার একটা স্পষ্ট যুক্তি অথবা অযুক্তি আছে, খোন্দকার দেখেছেন, এবং সেটি হল, হিংসাই হচ্ছে একমাত্র পথ, অহিংসা ঘোড়ার ডিম; হিংসা দিয়ে জগতের অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়। হিংসা অথবা সহিংসতা যুক্তি পছন্দ করে না। কিন্তু একটা বিকল্প যুক্তি, অথবা অযুক্তি খাড়া না করলে নিজেকে বৈধতাও দিতে পারে না। ফলে সহিংসতা নিজের গল্পটা নিজের অযুক্তিতেই তৈরি করে ফেলে, যার আগা মাথা প্রতিদিনের দুনিয়ার যুক্তিতে বোঝা মুশকিল। এই গল্প অবশ্য শেষটাতে এসে কোনো জটিলতা চায়না। বরং খুব পরিস্কার একটা অন্ত চায়। যেমন দাউদের গল্পের অন্তে খোন্দকারের বিয়োগ, যা তার জন্য বিশাল যোগ। অথবা, নিদেন করে হলেও খোন্দকারের অনিষ্ট।

দাউদকে যারা চেনে, তারা জানে, সে নিজের তৈরি একটা সুড়ঙ্গে থাকে সারা দিনমান। তার দৃষ্টিটাও সুড়ঙ্গের। সুড়ঙ্গের অন্তে যেটুকু আলো, তা তার নিজের উদ্ভাসের, আসল মুহূর্তে জ্বলে ওঠার। কিন্তু আসল মুহূর্তটা কখন?

খোন্দকার ভাবেন, মানুষ যখন কৃষিকাজ করত, তার সময় চলত সূর্য আর ঋতুর লম্বা ঘড়িতে। পরে কারখানা আর যন্ত্র আবিষ্কার হলে সময় চলে গেল স্প্রিং দেয়া ছোট ঘড়ির দখলে, বারো-চব্বিশ ঘন্টার হিসাবে। এখন তো সময় মাপা হয় এক সেকেন্ডের অযুতাংশে। ন্যানো, জেপ্টো নানা মুহূর্তাংশে। আর মানুষ যত অণু-মুহূর্তের প্রেমে পড়েছে, তার সময় ব্যবস্থাপনাও তত দুর্বল হয়েছে। এজন্য এই সময়ের মানুষের মনে এত শংকা, এত সন্ত্রাস। এত ভগ্নাংশে আকীর্ণ ভেঙ্গে পড়া জীবনে একটা অণু-মুহূর্তের নিশ্চয়তা কে কাকে দেয়? কিভাবে দেয়?

খোন্দকার আফজাল শুরুতে ভয় পেলেন, ভয়টা বাড়িয়ে দিল বিনা। সে বলল, আব্বা, আপনে ঘরের বাইরে যাবেন না। খোন্দকার দেখলেন, সন্ধ্যা হতেই বড় বড় তালা মারা শুরু হয়েছে সবগুলো ঘরে। সরকুমের গ্রাম সম্পর্কের এক ভাই গাছি মতিনকে বিনা রাজি করালো কিছুদিন রাতে খোন্দকারের পাহারায় থাকতে। গাছি মতিন দা চালানোতে ওস্তাদ। দাউদ একা হামলা করতে এলে মতিনের দা তার শিল্পকাজ করতে পারবে নির্বিঘ্নে। বিনা নিজেও জেগে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। বিনার স্বামী হাওরে নৌকা চালাত, অনেক রাত তাকে হাওরে কাটাতে হত। বিনার রাত জাগা হাতে গাছি থেকে ধার নেয়া একটা দা তখন সাহস জোগাতো।

এক ঝড়জলের দিনে হাওরে নৌকা ভাসানো বিনার স্বামী মাথায় বাজ পড়ে মরে গেল। সে আরেক গল্প।

থানার নতুন কর্তা একদিন মোটর সাইকেল চালিয়ে এলেন। তিনি খোন্দকারের সঙ্গে বসে কথা বললেন। বিনা তাকে চা খাওয়ালো। কর্তা অবশ্য নিজের প্রয়োজনেও কিছু কথা বললেন, তবে মূল্যবান যা যোগ করলেন, তা হল, দাউদ তার কাছের মানুষজনকে বলেছে, খোন্দকারকে সে একা খুন করবে। দড়ি দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে, ঝুলতে থাকা তাঁর হাত পা ভোঁতা চাপাতি দিয়ে আলাদা করতে করতে।

নরপশুর সংজ্ঞা কী, দাউদ তা খোন্দকারকে বোঝাবে, এরকম একটা ঘোষণা সে দিয়েছে।

পুলিশকর্তার কথা শুনতে শুনতে অনেকগুলি বোধ খোন্দকারের মনে খেলতে লাগল। একসঙ্গে, আলাদা আলাদা, একটার পর একটা, আবার জোড়ায় জোড়ায়। তাঁর যে ভয় হয়নি, তা নয়, বেশ ভয় হল, কিন্তু একসময় তাঁর চোখে একটা ছবিই উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকল -- তিনি ঝুলছেন একটা গাছ থেকে, এবং তাঁর হাত পা কাটা পড়ছে একটা একটা করে। কত উচ্চতায় ঝুলছেন তি?ি তাঁর কি ফাঁস লেগে শ্বাস বন্ধ হয়েছে নাকিটা দড়িটা দাউদ বেঁধেছে বুক বরাবর? হাতের কতটা কাটল? পায়ের? এক কোপে? না না, চাপাতিটা যেহেতু ভোঁতা, নিশ্চয় কোপের পর কোপে? তাঁর শরীর তাহলে তো ভয়ানক দুলল। এই দুলতে থাকা শরীরে কতটা সঠিক নিশানা নিয়ে কোপ দেয়া যায়?

যদি কোপের পর কোপ পড়ে, কয়টা পর্যন্ত তাঁর হুঁস জেগে থাকবে? কখন হুঁস ঘুমাবে?

একটা অস্ফূট অসম্ভব ভিডিও ছবির মতো শূন্যে ঝুলতে থাকা তাঁর শরীরের আর টুকরা টুকরা হয়ে মাটিতে পড়তে থাকা হাত পায়ের ছবিটা ঘুরতে থাকল খোন্দকারের মনে, তাঁকে অধিকার করে নিয়ে। আর যতই তিনি দেখলেন ছবিটা, ততই তাঁর অবাক ভাবটা বাড়তে থাকল -- তিনি কি আসলেই শরীরধারী কোনো মানুষ, খোন্দকার মোহাম্মদ আফজাল, বয়স ৬৪, সাকিন ফতেপুর, থানা বাহুবল, নাকি তিনি এক বিমূর্ত ছবির নাম, যা অনন্তকাল শূন্যে ঝুলছে, যার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কোনো অদৃশ্য খুনির চাপাতির আঘাতে ক্রমাগত ছিন্নভিন্ন হচ্ছে? তিনি কি কোনো প্রমিথিউস, যার নাড়িভূড়ি একপাল শকুনের ক্ষিধার কাছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আবার জন্ম নিচ্ছে শরীর জুড়ে, নতুন শকুনপালের নতুন ক্ষুধার খাদ্য হিসেবে?

প্রমিথিউসের সঙ্গে নিজের তুলনাটা তাঁকে হাসালো। কিন্তু তিনি টের পেলেন, এই ছবিটা তাঁর ভয় উড়িয়ে দিল। ভয় তো তিনি পেয়েছিলেন, যা বাড়িয়েছে বিনার সন্ত্রস্ত ভাব, কিন্তু পুলিশকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর মনে হল, ভয় থেকেও যেন একটা বিস্ময় তাঁর মনে বেশি কাজ করেছে -- বিস্ময়টা হচ্ছে: একটা গাছের ডাল থেকে তাঁর শরীরটা ঝুলছে আর তাঁর মন তা স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছে; তাঁর হাত পা টুকরা টুকরা হচ্ছে, অথচ তাঁর মন তা স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছে। এ কেমন কথা? তাঁর জীবন নিয়ে এমন কোনো উচ্চাশা তাঁর নেই, যেটুকু ছিল ওয়াহিদ তাতে পানি ঢেলেছে। তাঁর মনে হয়েছে, দাউদের অবস্থাটা বরং তাঁর থেকে অনেক করুণ-- তার স্ত্রী মারা গেছে, অথচ তার কবরটাও সে দিতে পারেনি। কারাগারে বসে বসে সে চোখের পানি ফেলেছে-- ফেলেছে নিশ্চয়, তার সেই কামানের গোলার মতো চোখ থেকে। তার মেয়েটার বিয়ে হয়েছে তাকে ছাড়াই -- মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি গেছে, অথচ মা অথবা বাবা কারো সান্তনার হাত তার মাথায় পিঠে স্পর্শ দিতে পারেনি, কারো আশীর্বাদ মিশে যেতে পারেনি তাঁর চোখের পানির সঙ্গে। খোন্দকারের স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে নিজের ঘরে, তাঁর পাথর হওয়া চোখের সামনে, তাঁর অক্ষম হাতের আঙ্গুল গলিয়ে। তাঁর মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে ...

যাক, সে আরেক গল্প, খোন্দকার ভাবলেন। এবং অনুভব করলেন, তাঁর কেমন একটা সহানুভূতি যেন হচ্ছে দাউদের জন্য। তার ক্রোধটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। এই ক্রোধের, এই প্রতিক্রিয়ার পেছনে গভীর বঞ্চনার যে একটা গল্প আছে, সেটাও যেন তিনি পড়তে পেরেছেন। ঝকঝকে সাদা সার্ট আর চকচকে কালো কোট-টাই-প্যান্ট-জুতো পরা খোন্দকার সাহেবকে দেখে কি সেই বঞ্চনার গল্পটা দাউদের মনে জেগে উঠত না? আদালতে কাঠগড়ায় এক ঠায় দাঁড়িয়ে দাউদ, বসার হুকুম নেই, দুই কনুইতে দুই পুলিশ, পুলিশের গালিগালাজ; আর এজলাশের সামনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তুলে তাকে নরপশু বলে গালাগাল করতে থাকা চকচকে খোন্দকার সাহেব, স্ত্রী আর পরিবারভাগ্য আর সম্মানের জীবন নিয়ে কত যোজন দূরে তাঁর অবস্থান। কিন্তু দু’জনের পার্থক্যটা আসলেই কী?

এই পার্থক্যতা সাত-আটদিন আগেও আকাশ আর পাতালের মতো ছিল খোন্দকার আফজালের কাছে। অথচ শূন্যে ঝুলতে থাকা তাঁর হাত পা কাটা শরীরের ছবিটা দেখতে দেখতে তাঁর শেষ পর্যন্ত মনে হল, ওই কাটা শরীরটা আসলে দাউদেরই, আর চাপাতি হাতে যে কাটছে.... সে কি তিনি? তিনি না হলে কে? সমাজ? পুলিশকর্তা? বিচারক?

তিনি শুনেছেন দাউদের মেয়ে দু’দিন আগে থানায় এসেছিল একথা জানাতে সে তার বাবাকে পথে ফেরাবে। স্যার, অর্থাৎ পুলিশকর্তা, যেন তাকে গ্রেপ্তার না করেন। উকিলকে হুমকি দেয়া যে ঠিক হয়নি, সে কথা মেয়েটা বাবাকে বোঝাবে। বোঝাতে পারবে, সে নিশ্চিত।

দাউদের মেয়ের কথায় খোন্দকারের নিজের মেয়ে রুমার কথা মনে পড়ল। কলেজে পড়ার সময় মেয়ের সিনেমা দেখার খুব শখ ছিল। অথচ রুমার মার খুবই অপছন্দ ছিল সিনেমা দেখা। খোন্দকার সাহেব লুকিয়ে মেয়েকে নিয়ে সিনেমা দেখতেন। লোকে এ নিয়ে হাসাহাসি করত। ছেলেছোকড়ারা বাঁকা কমেন্ট করত। সেসব তিনি আমলে নিতেন না। তিনি অবশ্য সিনেমা দেখার চাইতে অন্ধকার হলে একটু ঘুমিয়ে নিতেই পছন্দ করতেন। আর রুমা নায়ক শাকিব খান না হয় মান্নার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে ওদের দুর্দশায় ডুকরে কাঁদত। বাড়ি ফেরার সময় ফোলা চোখে সে বলত, তোমার মত বাবা হয় না, বাবা। সেই মেয়েটা বিয়ের পর অস্ট্রেলিয়া চলে গেল, বছর খানেক আগে দেশে এল, বাইশ দিনের জন্য। বাইশ দিনের কুড়ি দিনই সে থাকল মিটামইনে, শ্বশুর বাড়িতে, শুধু শেষদিন ফিরে যাওয়ার পথে এক বেলার জন্য বাড়ি এসে বাবাকে একটা উলের সোয়েটার দিয়ে গেল, যা তাঁর মতো চারজন মানুষ একসঙ্গে পরতে পারে। এক্সট্টা লার্জ । একসময় বাবার গায়ে লেপ্টে থাকা মেয়েটা সোয়েটার কেনার সময় ভেবে দেখার সময় পেলনা কোন সাইজটা তাঁর গায়ের জন্য উপযুক্ত? অবাক! সেই সোয়েটারটা তিনি পাড়ার মুদি দোকানদার, কুস্তিগীর শরীরের অমলেশকে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। পুলিশকর্তাকে তিনি বললেন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছেন, মানুষ ২৫ বছরেই মারা যায়, কিন্তু ৭৫ বছর পর্যন্ত তার কবর হয় না। আমার কবর হতে আরো ১১ বছর বাকি। এখন ১১ বছর আগে যদি দাউদ সেই দায়িত্ব নেয়, তাতে দোষ কি?

খোন্দকার সাহেবের গলায় এক আশ্চর্য নির্ভার ভাব, যে ভাবটা পুলিশকর্তাকে অবাক করল। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, কিন্তু তাঁর কথাগুলো তাকে বেশ ধন্ধে ফেলল। এত বড় ভয়ের সামনে লোকটা নিরাসক্তভাবে এসব কথা বলতে পারল?


৩.
দাউদ ফোন করল খোন্দকার সাহেবকে। তার গলায় বিরাট পরিবর্তন। এখন সে কথা বলছে সেই গলায় যে গলায় একজন মাছ শিকারি কথা বলতে পারে জালে আটকা পড়া কাতল মাছের সঙ্গে। গলাটা ভারি, তবে তাতে একটা নিশ্চিন্তির সুর। সে বলল, উকিল, জানাজা কে পড়াবে, ঠিক করছ?

খোন্দকার বললেন, আলহাজ্ব বাবলু মিয়া। পরহেজগার। জুম্মার খুৎবায় মানুষকে ভাল কাজ করতে বলেন। সন্ত্রাস-হাঙ্গামার বিরুদ্ধে দাঁড়ান।

দাউদ বলল, ভাল। কবর?

কবর বাড়িতেই । কাটিয়ে ফেলেছি। একটা ছোট টিলার মাথায়। কবরে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে পাব।

কবরটা একটু চওড়া করবা। তোমার শরীরটা আঠারো টুকরা করব। সব টুকরা যেন ঠিকঠাক গোর পায়, দাউদ বলল, এবং দুনিয়া কাঁপিয়ে হাসল। হাসিটা হঠাৎ থামালও সে, এবং একটু চিন্তাশীল গলায় বলল, তোমারে না মারলে উকিল, আমার বাইচ্যা থাকার কোনো মানে হয়না। তোমার মরণ আমার জীয়ন। হা হা।

তোমার মেয়ে তো শুনলাম তোমাকে শুধরানোর চেষ্টা করছে, খোন্দকার বললেন, তোমার মেয়েটা ভাল, লক্ষী মেয়ে।

দাউদের রাগটা ফিরে এল। আমার মেয়ের নাম মুখে আনবানা, বদমাশ, সে বলল, আমার মেয়ে ভাল না লক্ষী, তুমি বলার কে?

গালিগালাজটা না করলে হয় না? মেয়ে তো চেষ্টা করছে তোমাকে ভাল করতে। মেয়েকে একটু সম্মান কর। জবানটা একটু পরিস্কার কর, দাউদ। খোন্দকার বললেন।

কথাবার্তার গতি ভিন্নদিকে নিয়ে গেল দাউদ, যেদিকে সে স্বচ্ছন্দ। শুনলাম কাঁথা মুইড়া বিছানায় পড়ে থাকো, উকিল। ঘর থেকে বাইর হবানা?

কেন হব না? গত শুক্রবারেই তো জুম্মা পড়তে গেলাম। গতকাল কাজি বাড়ি গেলাম।

তোমারে আমি নিজ হাতে মারমু, উকিল। প্রথমে পিটামু। মাথাটা থ্যাতলামু, তারপর ভোঁতা চাপাতিটা এস্তেমাল করমু। দাউদ বলল।

ভোঁতা চাপাতি কেন, দাউদ মিয়া? আমার একটা নতুন চাপাতি আছে। খুব ধার। সেটা নেবে? খোন্দকার বললেন, খুব ঠান্ডা গলায়, যেন চাপাতিটা তিনি বিক্রি করছেন দাউদের কাছে। পয়সাটা তাঁর প্রয়োজন।

একটা মুহূর্ত সময় নিল দাউদ, তারপর আকাশ কাঁপিয়ে হাসল। ভোঁতা চাপাতি দিয়া মানুষ কাটার মতো সুখ নাই, উকিল। প্রতি কোপে শরীর কাঁপে, গলায় চিৎকার ফাটে, জানটা তড়পায়। অসহায়, অসহায়!

বাহ, খোন্দকার সাহেব আন্তরিকভাবেই বললেন, তিনটা বাক্য বলে ফেললে গালিগালাজ না করে। এইটা জারি রেখো।

দাউদ অসহিষ্ণু হল। আমার চিন্তা এই মাস শেষ হওয়ার আগে তোমারে তোমার বাপ দাদার কাছে পাঠাই।

তার মানে আরো ৬ দিন, খোন্দকার বললেন। তাঁর গলায় কোনো উদ্বেগ, ভয়, দু:খ নেই, কেন না তিনি ভাবছিলেন দাউদের সহজ সমীকরণটা নিয়ে। তাঁর মরণ দাউদের জীয়ন। এরকমই হয়। সন্ত্রাস-সহিংসতার যুক্তিটা, যাকে বলে এসপার-ওসপার ঘরানার। জর্জ বুশ যেমন বলেছেন, হয় আমাদের সঙ্গে আছ, না হয় ওদের সঙ্গে। একজনের নায়ক অন্যজনের ভিলেন। এটি একটি যুক্তি বটে তবে চূড়ান্ত অপযুক্তি। এটি সভ্যতাকে একটা ফল্টলাইন, একটা প্রাগৈতিহাসিক ফাটল রেখার ওপরে দাঁড় করিয়ে দেয়। হয় এসপার, নয় ওসপার। মাঝখানে কিছু নেই। এই অপযুক্তি থেকে মুক্তি নেই।

তিনি কোমল গলায় বললেন দাউদকে, আমি মরে গেলে কারো কিছু যাবে আসে না দাউদ, আমার সন্তানরা আমার অভাব বোধ করবে না, যেটুকু করবে, তা সরকুমের মেয়ে বিনা। কিন্তু তুমি মরলে তোমার মেয়েটার বুক ভেঙ্গে যাবে।

আমি মরমু ক্যানে? একটু অবাক প্রশ্ন দাউদের।

পুলিশ তোমাকে খুঁজছে, র‌্যাব খুঁজছে। আমাকে হুমকি দিয়েছ, সেটি জাতীয় মিডিয়াতে এসেছে। স্বরাষ্ট্র সচিব বাহুবলের মানুষ, র‌্যাবের এক পরিচালকও। বুঝেছ ব্যাপারটা?

দাউদ হাসল। জোরে জোরে।

এক কাজ কর, দাউদ, আমি কাল বাহুবল যাব। ইনাম আলির রিক্স্রায় চড়ে। বিকেল চারটায়। তুমি একটা পিস্তল দিয়ে তোমার কোনো শাগরেদকে পাঠাও। আমার মরতে আপত্তি নেই, কিন্তু তোমার শাগরেদ আমাকে মারলে তুমি বাঁচবে। তোমার মেয়েটার জন্য তোমার বাঁচার দরকার। আর দাউদ....

ঠাট্টা করছ, উকিল, আমি তোমার দুলাভাই? দাউদ চিৎকার করে বলল।

শোনো দাউদ, না থেমেই বললেন খোন্দকার, তোমার মেয়ে তোমাকে কখনো সোয়েটার কিনে দিয়েছে? বানিয়ে দিয়েছে?

দাউদের প্রান্ত থেকে হঠাৎ নীরবতা। তারপর তার হাসি শোনা গেল। আমার মেয়েরে নিয়া এত মাথাব্যাথা ক্যানে উকিল? ভাবছ ওর কথা বললে আমার মায়া পাইবা?

কাল চারটায় বাহুবল যাব। শাগরেদকে পাঠিও। তুমি মেয়েকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেও। সিনেমা হলে যে মেয়ে বাবার পাশে বসে সিনেমা দেখে, একবারও দেখে, সে সারাজীবন ওই সময়টা মনে রাখে। এমনকি অনেক পরে বাবার জন্য সোয়েটার কেনার সময়ও, যখন বাবাকে তার হঠাৎ বিরাট মনে হয়, যেন জীবনে যা, তার থেকে চারগুণ বড়। প্লিজ দাউদ, অন্তত একদিন মেয়েকে নিয়ে সিনেমা দেখ। যদি যাও, একদিন বুঝবে, কেন তোমাকে এমন করে সিনেমা দেখতে বলেছি -- যেন তিনি মুখস্থ কিছু পড়ছেন, সেরকম করে কথাগুলো বললেন, দাউদকে একটা শব্দও বলতে না দিয়ে। তারপর ফোন বন্ধ করে দিলেন। তাঁর চোখ ঝাপসা, কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য একটুখানি করুণা কি জাগল তাঁর, বিশেষ করে সোয়েটারের কথাটি বলার সময়?


৪.
বিনা প্রবল আপত্তি করল। সরকুমও। এমনকি বিনার ১২ বছরের মেয়ে মৌও। তারপরও ইনাম আলির রিক্সায় চড়ে বসলেন খোন্দকার আফজাল। তিনি একাই বসলেন, কিন্তু তাঁর পেছনে দা হাতে চলল গাছি মতিন। রিক্সার সামনে সাইকেলে ভূষণ, মতিনের এ্যাসিস্টেন্ট। তার দা’টা লুঙ্গির সঙ্গে বাঁধা।

রওনা দিয়ে খোন্দকার হাসলেন। দাউদ কি ভোঁতা চাপাতি ব্যবহার করবে, নাকি পিস্তল? পিস্তলের ক্ষমতা বেশি, পিস্তল কাজ করে দ্রুত, নিরাপদ বস্তুনিষ্ঠ দূরত্ব থেকে। দাউদের কাছে ইটালির তৈরি একটা ৯ মিমি বেরেটা পিস্তল আছে, পুলিশকর্তা তাঁকে বলেছে। নিশানা দুর্দান্ত। তবে এমন মারণাস্ত্রেরও কাজে নেমে কোনো বোধ অনুভূতি কাজ করেনা। সেই তুলনায় চাপাতির অনুভূতি আছে, এবং সেটা ব্যক্তিগত। চাপাতির বিস্তর আবেগ। পিস্তল নিজে পরিস্কার থাকে, শিকারের বুক মাথা তলপেট উরু থেকে রক্তের ফোয়ারা ছুটিয়েও। অথচ চাপাতি শিকারের রক্ত গায়ে মাখে, গায়ে না মাখলে নিজেকে সে অপদার্থ ভাবে। পিস্তল একটা ঘটনা ঘটায়, চাপাতি সেই ঘটনা ঘটিয়ে একটা ঘোষণাও দেয়। চাপাতি আসলেই একটা ঘোষণার নাম।

দাউদকে তিনি যেটুকু চিনেছেন, সে যেন ওই ঘোষণার অপেক্ষায় আছে। খোন্দকারের মৃত্যু একটা ঘটনামাত্র হলে সে তৃপ্তি পাবে না -- বিশেষ করে তার কোনো অবতার যদি সেই ঘটনা ঘটায়। তাহলে সে আশাহতই হবে।। দাউদ চায় ব্যক্তিগত ঘোষণা। সেজন্য চাই ভোঁতা চাপাতি। নিজের অজান্তে ঘাড়ে একটু আঙ্গুল বুলালেন খোন্দকার। রিক্সায় বসে তাঁর একটা শির শির ভয় হচ্ছে। তবে ভয়ের থেকেও বেশি একটা কাতরতা -- তিনি যে-মৃত্যুব্যথাটা পাবেন, ভেবে ভেবে তা কখন, কিভাবে, কতটা পাবেন, তা আন্দাজ করতে না পারার কাতরতা।

কিন্তু না দাউদ, না তার শাগরেদ/অবতারের দেখা মিলল। নির্বির্ঘ্নে বাহুবল পৌঁছে গেলেন খোন্দকার আফজাল। পৌঁছে, সোজা গেলেন থানায়। থানার কর্তা ঘন্টা দেড়েক আগে ফোনে বলেছে, একবার থানা ঘুরে যেতে।

থানার সামনে একটা ছোটখাটো জটলা। ক্যামেরা হাতে স্থানীয় দু’এক মিডিয়া কর্মী। কিন্তু পুলিশ থানার গেট দিয়ে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। খোন্দকার সাহেব গেটে পৌঁছালে দুই মিডিয়া কর্মী তাঁর সামনে দাঁড়াল। স্যার, একজন বলল, আপনিই তো খোন্দকার মোহাম্মদ আফজাল।

খোন্দকার অবাক হয়ে তাকালেন।

আপনি নিশ্চয় জানেন, এক মিডিয়া কর্মী বলতে শুরু করল..... কিন্তু পুলিশ এসে তাকে সরিয়ে দিয়ে খোন্দকার সাহেবকে গেটের ভেতর ঢুকিয়ে গেট বন্ধ করে দিল। স্যার ভেতরে যান, পুলিশ বলল।

ভেতরে মানে পুলিশকর্তার ঘরে। পুলিশকর্তা টেবিল জুড়ে বসে, মুখে হাসি। ঘর ভর্তি কালো পোশাক, কালো রোদ চশমা পরা র‌্যাবের লোকজন। খোন্দকারকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন পুলিশকর্তা। এই যে, উকিল সাহেব, গুড নিউজ, গুড নিউজ। আমি বলেছিলাম না, সময় লাগবে না? দেখলেন, কথা রাখলাম না?

গুড নিউজ হচ্ছে দুপুরে মুর্দাশিরির জঙ্গলে দাউদ মিয়ার এক শাগরেদের আস্তানায় হানা দিয়েছে পুলিশ-র‌্যাব, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে’। গোপন সংবাদ বলেছে, দাউদ তিনচার জনের একটা দলকে প্রস্তুত করছিল, একটা অপারেশনের জন্য। অপারেশনটা, পুলিশকর্তা জানালেন, মোস্ট লাইকলি খোন্দকার সাহেবকে এ্যামবুশ করে এলিমিনেট করার জন্য। র‌্যাব-পুলিশ আস্তনাটা ঘেরাও করে ফেললে দাউদ মিয়া টের পেয়ে যায়, এবং বারো রাউন্ড গুলি চালায়। স্মল আর্মস ফায়ার --শট গান, হ্যান্ড গান, এইসব। তবে র‌্যাবের কাছে সংবাদ ছিল তার কাছে লংরেঞ্জ রাইফেল আছে, স্নাইপার রাইফেল হতে পারে, যা শার্প শুটিং-এর জন্য আগেও দাউদ ব্যবহার করেছে। যাই হোক, দাউদ দুটি গ্রেনেডও ব্যবহার করেছে, কিন্তু তাতে কোনো ক্যাজুয়ালটি হয়নি। গোলাগুলি থেমে গেলে পুলিশ র‌্যাব মুভ ইন করেছে। দাউদ ও এক শাগরেদের ডেড বডি উদ্ধার করেছে। বাকি দু’জন পালিয়েছে। বাট পুলিশ লুক আউটে আছে। কোথায় গুলি লেগেছিল দাউদের, জিজ্ঞেস করলেন? গুলি একটা তো নয়, সেভারেল। দুটো চেস্টে, একটা তলপেটে, একটা মাথায়, একটা কপাল বরাবর। সবই ফ্যাটাল ছিল। ইনস্ট্যান্ট ডেথ।

চলুন, দাউদের ডেড বডি দেখবেন। পাশের ঘরেই আছে, এস পি স্যার এলে পরবর্তী পদক্ষেপ। এখনও মিডিয়াকে জানানো হয়নি। এস পি স্যার এলে হবে। যাবেন না? চলুন, চলুন।

পুলিশকর্তার মুখে দাউদের মৃত্যু সংবাদ শুনতে শুনতে খুব অবসন্ন লাগছিল খোন্দকার সাহেবের, মনটা বিষাদে ছেয়ে গিয়েছিল। দাউদের মৃত্যুটা তাঁকে যেন কিছুটা হলেও নি:স্ব করে দিয়েছে। দাউদের মরণ কি তাহলে তার জীয়ন? কিন্তু এই জীয়ন দিয়ে কী হবে?

আজ যখন রিক্সায় বাহুবল আসছিলেন তিনি, মনের ভেতর অনেকগুলি অনুভূতি খেলা করছিল। ভয় লাগছিল তো বটেই, একটা অনিশ্চিতির উদ্বেগও ছিল, আবার একটা উত্তেজনাও ছিল, হয়তো দাউদের সামনাসামনি হবেন । দাউদের চোখের দিকে তাকিয়ে দুটো কথাও বলবেন, তার মেয়ের খবর নেবেন। একসময় হয়তো দাউদ ক্লান্ত হবে, বলবে, আর না উকিল। এবার আল্লারে ডাক। দাউদের শুরুর তুই তুকারি, তারপরের তুমি-তামি তাঁকে বেশ মজা দিয়েছে। শেষ কে তাঁকে তুই বলে ডেকেছে? দাদা? ছোটবেলার বন্ধু রজত? তারা এখন কেথায়?

দাউদ তাঁকে তুই বলে একটা ভয়ানক যোগাযোগের সূত্রপাত করেছিল। তুমিতে উঠে তা কিছুটা উন্নত করলেও যোগাযোগের নিয়তি-নির্দিষ্টতা, তাঁর মৃত্যুবানতা তাতে কমেনি। খোন্দকার নিশ্চিত, কারাগারের সাত বছর এই যোগাযোগের একটা সূতাকে দাউদ প্রতিদিন তার ধ্যানে রেখেছে।

সাতটা বছর প্রতিদিন কে তাঁকে স্মরণ করেছে? ওয়াহিদ? তার বড় ভাই ওয়ালিদ? মেয়ে রুমা? হাহ্ । বৌও কি করতেন, প্রতিদিন? অপ্রয়োজনে?

খোন্দকার সাহেব নিশ্চিত, দাউদের লংরেঞ্জ-স্নাইপার রাইফেল থাকুক আর নাই থাকুক, সেটি সে ওই আস্তানাতেই ফেলে আসত। একটা স্মল আর্ম নিয়েই সে আসত, সম্ভবত সেই বেরেটাটা। তারও প্রয়োজন ছিল খোন্দকারের মুখোমুখি হওয়ার, মৃত্যুর আগে তাঁর মুখে অন্তত একটা ভয় অথবা উদ্বেগ অথবা বিপর্যয়ের ছবি দেখার।

দাউদের লাশ দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর ছিল না, কিন্তু পুলিশকর্তার ইচ্ছায় যেতে হল। একটা টিনের ট্রলিতে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে, শাগরেদটা স্থান পেয়েছে মেঝেতে। দাউদের মুখটা বেরিয়ে আছে, চাদরটা সে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তার কপালের সামনে একটা রক্তমাখা জখম, যেন একটা বড়সড় ড্রিল মেশিন দিয়ে কেউ একটা গর্ত করে দিয়েছে, আর গর্তটা বুজে আছে শুকিয়ে যাওয়া রক্তে, খুবলে ওঠা মাংসে। দাউদের চোখ বোঁজা, তাতে মুখে একটা বিশাল দু:খবোধ জগেছে। যেন সে খোন্দকারকে না মারতে পারার দু:খে ভীষণ কাতর। অথবা মেয়েকে সিনেমা দেখাতে নিতে না পারার জন্য। তাকে দেখে মোটেও ভয়ানক মনে হল না খোন্দকারের। তাঁর মাথায় ঢেউ খেলানো চুল, খোন্দকারের চুলহীন মাথাকে যেন তা উপহাস করছে। দাউদের মুখ দেখতে দেখতে হঠাৎ খোন্দকারের মনে হল, তিনি কি তাঁর বিকল্প সত্তাকে দেখছেন, তাঁর অল্টার ইগোকে? দাউদ কি পূর্ণ করেছে তাকে, তিনি দাউদকে? দাউদ যা নয়, তিনি কি তাই, আর তিনি যা নন, দাউদ তা? সকল অর্থেই তো তারা বিপরীত, শেষমেশ দুই মেয়ের পৃথক বিচারেও।

দাউদের এভাবে চলে যাওয়াটা তিনি কেন জানি মানতে পারলেন না। এস পি সাহেব থানায় এলে মিডিয়ার সামনে নিশ্চয় অনেক কথাই বলবেন এই দুর্ধর্ষ খুনিকে নিয়ে, বন্ধুক যুদ্ধ নিয়ে, গুলাগুলির এক পর্যায়ে দাউদের মারা যাওয়া নিয়ে, কিন্তু খোন্দকার সাহেবের মনে হল দাউদের তো এভাবে মারা পড়ার কোনো কারণ ছিল না। সেতো জানত পুলিশ-র‌্যাব তাকে খুঁজছে। তার তো খুব সাবধানে থাকার কথা ছিল। তাহলে? তার সাবধানতায় চিড় ধরিয়েছে কে অথবা কি? কেন সে একটা গাছের ডালে বসা অপ্রস্তুত পাখির মতো এত সহজে মরবে, তার কপালের মাঝখানের জখমটা যা প্রমাণ করে? সেতো মৃত্যুর খুঁজে বেরিয়েছিল, খোন্দকারের, সেই মৃত্যু কি ছিল তার নিজের? কেন হবে?

খোন্দকার সাহেবের চোখ অন্ধকার হয়ে গেল। একটা গাঢ় বিষাদ যেন সবকিছু ছাপিয়ে উঠল। এক ফাঁকে তাঁর মনে পড়ল, এখন দরজায় বিনাকে তালা মারতে হবে না, গাছি মতিনকে দা নিয়ে তাঁকে পাহারা দিতে হবে না। একটা উত্তেজনা জীবন থেকেই তো চলে গেল। এখন দাউদের মরা মুখ দেখে মনে হল, জীবনটা এখন প্রতিদিন বিষন্ন সূর্যোদয়ে জাগবে, বিষন্ন সূর্যাস্তে আড়ালে যাবে।

এই জীবন টানাটা খুব কষ্টের হবে, তিনি নিশ্চিত। তাহলে কি দাউদই জিতল? খোন্দকারই আসলে মারা গেলেন আজ? আর দাউদ? সে তো মরেই ছিল, এবং মৃত্যুতেও বেঁচে ছিল। খোন্দকার নিশ্চিত, চিরদিনের মতো মৃত দাউদ শিগগিরই বেঁচে থাকবে নতুন এক মিথ-এ। গ্রামের মায়েরা বাচ্চাদের খাওয়াবেন, ঘুম পাড়াবেন দাউদের নামে।

দেখলেন তো, পুলিশকর্তা বলল, আমি কথা রাখি।

খোন্দকার সাহেব চুপ থাকলেন। এখন যেতে হয়।

পুলিশকর্তা বলল, যা আমাকে অবাক করল, খোন্দকার সাহেব, দাউদের পকেটে পাওয়া অদ্ভূত একটা -- না দুইটা --জিনিস। এগুলোর কোনো অর্থ এখনো উদ্ধার করতে পারছি না। অবাক।

কি পেয়েছেন? খোন্দকার জিজ্ঞেস করলেন।

দুইটা সিনেমার টিকেট। রংমহল সিনেমার। সন্ধ্যা ছ’টার শ’য়ের।

অবাক। খোন্দকার বললেন, পুলিশকর্তাকে অনুসরণ করে।

ফিরে যেতে যেতে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল খোন্দকার সাহেবের, যেরকম দীর্ঘশ্বাস তিনি শেষ কবে ফেলেছেন, মনে করতে পারলেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ