বরেনের বয়স সাতাত্তর। একবছর করে বয়স বেড়ে বেড়ে বরেন সান্যাল এই বয়সে পৌছেছেন। জন্মদিনে বয়স বাড়ে। কত বাড়বে বাড়ুক। জন্মদিন নিঃশব্দে পার হয়ে গেলে বরেন পুরোন বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে যান। একা মানুষ। তিনি একাই থাকেন। গত তিরিশ বছর একা কেটেছে বরেনের। তার আগে দিদি থাকত সঙ্গে। দিদিও বিয়ে করেননি কিংবা বিয়ে হয়নি দিদির। দিদির কি প্রেম ছিল ? জানেন না বরেন।
দিদি হঠাৎই মারা যান ঘুমের ঘোরে। দিদির হৃদযন্ত্রে কোনো গোলমাল ছিল বলে জানেন না বরেন। কিন্তু হৃদযন্ত্রই বিকল হয়েছিল। মৃত্যু যখন টার্গেট করে কাউকে, যেভাবেই হোক ঢুকে পড়ে দুয়ার আঁটা ঘরে। বরেনদের পরিবারে সকলেই দীর্ঘজীবী, দিদিই শুধু অকালে। অমন হয়। বরেন সান্যালের এক মামা অমনি গিয়েছিলেন।
বরেনের আরো দুই ভাই আছে। তারা তাঁর চেয়ে দু বছর দুবছর তফাতে জন্মেছে। তাদের একজন অশেষের বড় সংসার। ছেলের বিয়ে দিয়েছে, দুই নাতি নাতনি, মেয়ের তরফে এক নাতনি। বাড়িতে ছজন। আবার মেয়েও আসে প্রায়ই। একেই বলে ভরা সংসার।
বরেনের অন্য ভাই তাপস বিপত্নীক। দিল্লিতে থাকা ছেলের কাছে কালেভদ্রে যায়। একা বেশ আছে। আনন্দে আছে। তার নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে অন্তত তিরিশ বছরের পুরোন। পাড়ার সকলেই চেনে। মাঝেমধ্যেই দামী মদের আসর বসায় বেকার পেনশনভোগী সুদে বাঁচা বুড়োদের নিয়ে। তাপসও মোটা পেনশন পায়। সে একেবারেই একা নয়। একজন তাকে দ্যাখে। সেই মহিলার নামেও রটনা আছে। বছর পনেরর কন্যাকে বাবুর কাছে রেখে রাতে সে বাড়ি ফেরে। তাপস একা থাকতে পারে না। তার নাকি খুব ভুতের ভয়। গৃহকর্মীর কিশোরী কন্যা নাকি তার সঙ্গে শোয়। এ ব্যাপারে তাপস বলে মহাত্মা গান্ধীর কথা। নিজের সংযম পরীক্ষা করে সে নাকি সফল। বরেন সান্যাল এসব শুনেছে। তাকে অনেকে বলেছে সঙ্গে একজনকে অন্তত রাখতে। একা থাকা ঠিক নয়। আত্মীয় স্বজনেরা খুব বলে।
সেই সময়ে মায়ের খুড়তুতো বোন লিলি মাসির ছেলে, তার মাসতুত ভাই রমেনের পুতে বাপি কোচবিহার থেকে এসে তাঁর পেনেটির ফ্ল্যাটে গেড়ে বসেছিল। জেঠু কেন একা থাকবে? পেনেটির গঙ্গার ধারে সেই ফ্ল্যাট ভাড়ায় নিয়েছিল বরেন। বহুতলটিতে অন্তত কুড়িটি ফ্ল্যাট ছিল। জি-প্লাস ফাইভ তার গড়ন। কুড়িটি রাজকীয় ফ্ল্যাটই তৈরি হয়েছিল প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য। কম্পাউন্ডে বেশ বড় লন ছিল। কমিউনিটি হল, বাগান, সুইমিং পুল—সব। সিকিউরিটি ছিল জনা পাঁচ। তাদের আলাদা কোয়ার্টার ছিল। ফ্ল্যাটের মালিকরা কেউ ইউ,কে, কেউ ইউ,এস,এ, কানাডা এমন সব পশ্চিমে থাকেন। দু-তিন বছরে একবার হয়তো আসেন কিংবা আসেন না। ক’জন সিকিউরিটি নিয়েই সেই বহুতল নিঃঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
বরেন সামান্য ভাড়ায় পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকত। সেই ফ্ল্যাটের মালিক টোরেন্টো থাকেন। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে গঙ্গা দেখা যায়। দক্ষণেশ্বর মন্দিরের চূড়া দেখা যায় আবছা। সে ছাড়া আর কেউ ছিল না কোনো ফ্ল্যাটে। লিফট ছিল। লিফটে উঠত সে। নামত সিঁড়ি ভেঙে। সব ফ্লোরে সন্ধ্যায় আলো জ্বলত। নিঝুম পুরী। কী ভালোই না লাগত একা থাকতে। তার মনে হতো নির্জনতা আর নীরবতার কোনো বিকল্প হয় না। নীরবতার একটা রূপ আছে। নীরবতার একটি সুর আছে। বেহালার ছড় টানতেন বরেন একা।
বাপি ক’দিন তার কাছে থেকে চাকরির ইন্টারভিউ দেবে এই কথা বলে ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল। ইন্টারভিউ দিতে এসে নড়েই না। ক’দিন বাদে বলতে লাগল সে একটা কোচিং সেন্টারে অঙ্ক আর ভূগোল পড়াবে। মাসে তিন হাজার পাবে। দেড় বরেন জেঠুকে দেবে, দেড় তার থাকবে। বরেন টের পেয়েছিল বাপি তার ঘাড়ে চেপে বসছে। তার নিঃসঙ্গতা, বাড়িটির নীরবতা ভঙ্গ করছে। নিরুপায় হয়ে সে সিকিউরিটিকে বলে মধুপুর চলে গিয়েছিল।
মধুপুরে একটি নিঝুম বাড়ি আছে। সেখানে বরেন যেতেন বর্ষার সময়। মধুপুরের আকাশে মেঘ দেখতে ভালবাসেন তিনি। দিগন্তে প্রবাহিত নিস্ফলা প্রান্তরে সবুজ তৃণ জাগছে, আহা সে কী সুন্দর। সেবার বসন্তে গিয়ে তিনমাস বাদে ফিরেছিলেন গ্রীষ্মের দাপটে থাকতে না পেরে। ততোদিনে সিকিউরিটি বাপির প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল ফ্ল্যাট লক করে। মধুপুরে অচেনা মানুষের ভিতরে কাটিয়ে ফিরে এসে শুনেছিলেন বাপি এলাকার লোককে সংগঠিত করে ফ্ল্যাটে ঢুকতে চেয়েছিল। পারেনি। এন,আর,আই-দের ফ্ল্যাট। ভাড়াটে মানুষটিও হয়তো আমেরিকা গিয়ে বসে আছে। সেই কথা থানায় জানিয়েছিল ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি। দিনকয় এখানে ওখানে অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের বাড়ি ঘুরে বাপি কোচবিহার ফিরে গিয়েছিল। তখন আত্মীয় স্বজনের ভিতর বরেনের খুব নিন্দা হয়েছিল। খুব খারাপ করেছে সে। অতবড় ফ্ল্যাটে একটা ছেলের জায়গা হলো না? সেই সব কথা বেশ কিছুদিন বাদে বরেন শুনতে পেয়েছিলেন আচমকা তাপসের সঙ্গে টালা পার্কে কোহিনুর সার্কাসে দেখা হয়ে যেতে। বরেন আগে দেখতে পাননি তাপসকে। দেখলে লুকিয়ে পড়তেন ঠিক। ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে সুখ হয় না। কেমন হৈ হৈ করে কথা বলে। হে হে করে অনর্থক হাসে।
তাপস তার গৃহকর্মী এবং গৃহকর্মীর বড় হয়ে ওঠা কন্যাকে নিয়ে সার্কাস দেখতে এসেছিল। তাপস বলেছিল বাপি আবার আসবে বলে গেছে। বরেনজেঠু কেন একা থাকবে। সিকিউরিটিরা টাকা-পয়সা সব চোট করে দেবে। বরেনজেঠুর সঙ্গে কাউর থাকা উচিত। শুনে বরেন একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। বাপি যদি আবার ফিরে আসে! সিকিউরিটিদের কাউকে ঘুষ দিয়ে ঢুকে পড়ে? তখন কী করবেন তিনি ? আবার আরম্ভ হয়ে যাবে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে মোবাইলে চিৎকার করে কথা বলা। নিজের মনে বেসুরো গলায় কিশোরকুমারের গান। উফ! সে একদন্ডও চুপ করে থাকতে পারে না। ঘুমের ভিতরেও কথা বলে। খিস্তি-খেউড় করে। আবার একদিন তাপস তাকে ফোন করে জানাল, বাপি আসছে শীগগির। সে একটা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। শাসক দলের খুব ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছে বাপি। তাপস উপদেশ দিয়েছিল, বাপিকে তুই নিয়ে নে দাদা, আমিও তো দুজনকে পুষছি।
দিদি হঠাৎই মারা যান ঘুমের ঘোরে। দিদির হৃদযন্ত্রে কোনো গোলমাল ছিল বলে জানেন না বরেন। কিন্তু হৃদযন্ত্রই বিকল হয়েছিল। মৃত্যু যখন টার্গেট করে কাউকে, যেভাবেই হোক ঢুকে পড়ে দুয়ার আঁটা ঘরে। বরেনদের পরিবারে সকলেই দীর্ঘজীবী, দিদিই শুধু অকালে। অমন হয়। বরেন সান্যালের এক মামা অমনি গিয়েছিলেন।
বরেনের আরো দুই ভাই আছে। তারা তাঁর চেয়ে দু বছর দুবছর তফাতে জন্মেছে। তাদের একজন অশেষের বড় সংসার। ছেলের বিয়ে দিয়েছে, দুই নাতি নাতনি, মেয়ের তরফে এক নাতনি। বাড়িতে ছজন। আবার মেয়েও আসে প্রায়ই। একেই বলে ভরা সংসার।
বরেনের অন্য ভাই তাপস বিপত্নীক। দিল্লিতে থাকা ছেলের কাছে কালেভদ্রে যায়। একা বেশ আছে। আনন্দে আছে। তার নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে অন্তত তিরিশ বছরের পুরোন। পাড়ার সকলেই চেনে। মাঝেমধ্যেই দামী মদের আসর বসায় বেকার পেনশনভোগী সুদে বাঁচা বুড়োদের নিয়ে। তাপসও মোটা পেনশন পায়। সে একেবারেই একা নয়। একজন তাকে দ্যাখে। সেই মহিলার নামেও রটনা আছে। বছর পনেরর কন্যাকে বাবুর কাছে রেখে রাতে সে বাড়ি ফেরে। তাপস একা থাকতে পারে না। তার নাকি খুব ভুতের ভয়। গৃহকর্মীর কিশোরী কন্যা নাকি তার সঙ্গে শোয়। এ ব্যাপারে তাপস বলে মহাত্মা গান্ধীর কথা। নিজের সংযম পরীক্ষা করে সে নাকি সফল। বরেন সান্যাল এসব শুনেছে। তাকে অনেকে বলেছে সঙ্গে একজনকে অন্তত রাখতে। একা থাকা ঠিক নয়। আত্মীয় স্বজনেরা খুব বলে।
সেই সময়ে মায়ের খুড়তুতো বোন লিলি মাসির ছেলে, তার মাসতুত ভাই রমেনের পুতে বাপি কোচবিহার থেকে এসে তাঁর পেনেটির ফ্ল্যাটে গেড়ে বসেছিল। জেঠু কেন একা থাকবে? পেনেটির গঙ্গার ধারে সেই ফ্ল্যাট ভাড়ায় নিয়েছিল বরেন। বহুতলটিতে অন্তত কুড়িটি ফ্ল্যাট ছিল। জি-প্লাস ফাইভ তার গড়ন। কুড়িটি রাজকীয় ফ্ল্যাটই তৈরি হয়েছিল প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য। কম্পাউন্ডে বেশ বড় লন ছিল। কমিউনিটি হল, বাগান, সুইমিং পুল—সব। সিকিউরিটি ছিল জনা পাঁচ। তাদের আলাদা কোয়ার্টার ছিল। ফ্ল্যাটের মালিকরা কেউ ইউ,কে, কেউ ইউ,এস,এ, কানাডা এমন সব পশ্চিমে থাকেন। দু-তিন বছরে একবার হয়তো আসেন কিংবা আসেন না। ক’জন সিকিউরিটি নিয়েই সেই বহুতল নিঃঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
বরেন সামান্য ভাড়ায় পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকত। সেই ফ্ল্যাটের মালিক টোরেন্টো থাকেন। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে গঙ্গা দেখা যায়। দক্ষণেশ্বর মন্দিরের চূড়া দেখা যায় আবছা। সে ছাড়া আর কেউ ছিল না কোনো ফ্ল্যাটে। লিফট ছিল। লিফটে উঠত সে। নামত সিঁড়ি ভেঙে। সব ফ্লোরে সন্ধ্যায় আলো জ্বলত। নিঝুম পুরী। কী ভালোই না লাগত একা থাকতে। তার মনে হতো নির্জনতা আর নীরবতার কোনো বিকল্প হয় না। নীরবতার একটা রূপ আছে। নীরবতার একটি সুর আছে। বেহালার ছড় টানতেন বরেন একা।
বাপি ক’দিন তার কাছে থেকে চাকরির ইন্টারভিউ দেবে এই কথা বলে ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল। ইন্টারভিউ দিতে এসে নড়েই না। ক’দিন বাদে বলতে লাগল সে একটা কোচিং সেন্টারে অঙ্ক আর ভূগোল পড়াবে। মাসে তিন হাজার পাবে। দেড় বরেন জেঠুকে দেবে, দেড় তার থাকবে। বরেন টের পেয়েছিল বাপি তার ঘাড়ে চেপে বসছে। তার নিঃসঙ্গতা, বাড়িটির নীরবতা ভঙ্গ করছে। নিরুপায় হয়ে সে সিকিউরিটিকে বলে মধুপুর চলে গিয়েছিল।
মধুপুরে একটি নিঝুম বাড়ি আছে। সেখানে বরেন যেতেন বর্ষার সময়। মধুপুরের আকাশে মেঘ দেখতে ভালবাসেন তিনি। দিগন্তে প্রবাহিত নিস্ফলা প্রান্তরে সবুজ তৃণ জাগছে, আহা সে কী সুন্দর। সেবার বসন্তে গিয়ে তিনমাস বাদে ফিরেছিলেন গ্রীষ্মের দাপটে থাকতে না পেরে। ততোদিনে সিকিউরিটি বাপির প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল ফ্ল্যাট লক করে। মধুপুরে অচেনা মানুষের ভিতরে কাটিয়ে ফিরে এসে শুনেছিলেন বাপি এলাকার লোককে সংগঠিত করে ফ্ল্যাটে ঢুকতে চেয়েছিল। পারেনি। এন,আর,আই-দের ফ্ল্যাট। ভাড়াটে মানুষটিও হয়তো আমেরিকা গিয়ে বসে আছে। সেই কথা থানায় জানিয়েছিল ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি। দিনকয় এখানে ওখানে অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের বাড়ি ঘুরে বাপি কোচবিহার ফিরে গিয়েছিল। তখন আত্মীয় স্বজনের ভিতর বরেনের খুব নিন্দা হয়েছিল। খুব খারাপ করেছে সে। অতবড় ফ্ল্যাটে একটা ছেলের জায়গা হলো না? সেই সব কথা বেশ কিছুদিন বাদে বরেন শুনতে পেয়েছিলেন আচমকা তাপসের সঙ্গে টালা পার্কে কোহিনুর সার্কাসে দেখা হয়ে যেতে। বরেন আগে দেখতে পাননি তাপসকে। দেখলে লুকিয়ে পড়তেন ঠিক। ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে সুখ হয় না। কেমন হৈ হৈ করে কথা বলে। হে হে করে অনর্থক হাসে।
তাপস তার গৃহকর্মী এবং গৃহকর্মীর বড় হয়ে ওঠা কন্যাকে নিয়ে সার্কাস দেখতে এসেছিল। তাপস বলেছিল বাপি আবার আসবে বলে গেছে। বরেনজেঠু কেন একা থাকবে। সিকিউরিটিরা টাকা-পয়সা সব চোট করে দেবে। বরেনজেঠুর সঙ্গে কাউর থাকা উচিত। শুনে বরেন একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। বাপি যদি আবার ফিরে আসে! সিকিউরিটিদের কাউকে ঘুষ দিয়ে ঢুকে পড়ে? তখন কী করবেন তিনি ? আবার আরম্ভ হয়ে যাবে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে মোবাইলে চিৎকার করে কথা বলা। নিজের মনে বেসুরো গলায় কিশোরকুমারের গান। উফ! সে একদন্ডও চুপ করে থাকতে পারে না। ঘুমের ভিতরেও কথা বলে। খিস্তি-খেউড় করে। আবার একদিন তাপস তাকে ফোন করে জানাল, বাপি আসছে শীগগির। সে একটা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। শাসক দলের খুব ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছে বাপি। তাপস উপদেশ দিয়েছিল, বাপিকে তুই নিয়ে নে দাদা, আমিও তো দুজনকে পুষছি।
বরেন বলেছিলেন, বাপি কি তোকে ধরেছে তপু ?
তাপস বলেছিল, সে তো আমার ফ্ল্যাটে আসতে চায় রে।
রাখ তোর কাছে, বেশ ছেলে। বরেন ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমি একা থাকতে ভালবাসি, ও কেন তা হতে দেবে না?
ও পারটি করে, বলছে মানুষ কেন একা থাকবে, তাকে অনেককে নিয়ে থাকতে হবে।
ঠিক আছে, তোর ফ্ল্যাটে রেখে দে।
না, মেয়েটা রয়েছে, হবে না। তাপস বলেছিল, বাপি তোর কাছেই যাবে দাদা, কলকাতার কাছে থাকার পাকা জায়গা তোর ওখানেই হতে পারে।
তখন সোদপুর ছেড়ে বাগবাজারে গঙ্গার ধারে এক পুরোন বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বরেন। কাউকে ঠিকানা দেননি। একা মানুষ। একা থাকবেন। সেই বাড়ি থেকে গঙ্গা খুব কাছে। তবে পেনেটির মতো নিস্তব্ধ গঙ্গা নয়। গঙ্গার তীরে হল্লা লেগেই আছে। চক্ররেলের হুইসিল, লঞ্চের ভোঁ, কাশী মিত্তির ঘাটে শ্মশানযাত্রীর হল্লা, কীর্তন মিলে বেশ গোলমেলে।
তার ভিতরেও ভালো ছিলেন তিনি। ফ্ল্যাটে নিজের ভিতরে ডুবে থাকেন বরেন সান্যাল। বেহালায় ছড় টানেন। প্রিয় বই পড়েন, প্রিয় গান শোনেন। ঘুমিয়ে থাকেন, জেগে ওঠেন, রাস্তায় নেমে একা একা হাঁটতে থাকেন। বাজার করেন। রান্নার লোক রেঁধে দিয়ে যায়। ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যায় আর একজন। তিনি একা থাকেন।
বরেন সান্যালের বাড়ি পেতে অসুবিধে হয় না। সকালে একবার বেরিয়ে গঙ্গার ধারে ঘুরে আসেন , বিকেলে কলকাতা শহরে নিজের মনে। পথের মাঝে গিরিশ ঘোষের বাড়ি, বলরাম মন্দির, রাজবল্লভ পাড়া......। বরেন নিজের মনে হাঁটতে থাকেন। এই শহরে তাঁকে কেউ চেনে না, ভাবতেই বেশ লাগে। কেউ ডাক দেয় না, আরে বরেনবাবু যে, কেমন আছেন? পেনেটিতে বাপি গোলমাল করায় অনেকেই তাঁকে চিনে গিয়েছিল। হ্যাঁ মশায়, অসুবিধে হচ্ছে না তো?
তার ভিতরেও ভালো ছিলেন তিনি। ফ্ল্যাটে নিজের ভিতরে ডুবে থাকেন বরেন সান্যাল। বেহালায় ছড় টানেন। প্রিয় বই পড়েন, প্রিয় গান শোনেন। ঘুমিয়ে থাকেন, জেগে ওঠেন, রাস্তায় নেমে একা একা হাঁটতে থাকেন। বাজার করেন। রান্নার লোক রেঁধে দিয়ে যায়। ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যায় আর একজন। তিনি একা থাকেন।
বরেন সান্যালের বাড়ি পেতে অসুবিধে হয় না। সকালে একবার বেরিয়ে গঙ্গার ধারে ঘুরে আসেন , বিকেলে কলকাতা শহরে নিজের মনে। পথের মাঝে গিরিশ ঘোষের বাড়ি, বলরাম মন্দির, রাজবল্লভ পাড়া......। বরেন নিজের মনে হাঁটতে থাকেন। এই শহরে তাঁকে কেউ চেনে না, ভাবতেই বেশ লাগে। কেউ ডাক দেয় না, আরে বরেনবাবু যে, কেমন আছেন? পেনেটিতে বাপি গোলমাল করায় অনেকেই তাঁকে চিনে গিয়েছিল। হ্যাঁ মশায়, অসুবিধে হচ্ছে না তো?
বাপি মুখুজ্জে আপনার কেমন ভাইপো হয়?
ও মশায়, একা থাকতে ভয় করে না?
আসুন না আমাদের ক্লাব অবসর-এ, আমরা বার্ষিক অনুষ্ঠানে ‘ভাড়াটে চাই’ নাটক করছি, তারপর পিকনিকে যাব কদম্বগাছি।
হ্যাঁ দাদা, আমার নাতির বিয়ে, ক’জনকে দুদিন রাখবেন আপনার ফ্ল্যাটে, বাইরে থেকে আসছে, রাতে গিয়ে শোবে।
স্যার, আমার গুরুদেবের জন্মোৎসব, তিন তারিখে আসবেন প্লিজ।
পেনেটি ছাড়তে হলো সেই জন্যও। একদিন সকালে জনা চারেক যুবক দরজায় হাজির। মোটা গোফ, চোয়াড়ে মুখ, হেসে বলল, অসুবিধে হলে খবর দেবেন স্যার।
আচ্ছা দেব, নিশ্চয় দেব।
ওক্কে স্যার, কিন্তু বাপিদা থাকলে কি খুব অসুবিধে হবে স্যার, তার কলকাতায় থাকার কোনো জায়গা নেই, অথচ এখেনে উনিশটা ফ্ল্যাট খালি, আপনার তিন রুমের ফ্ল্যাটে একজন লোক।
এরপরেই বরেন বাগবাজার চলে আসেন। অত কোলাহলে থাকা যায় না। কিন্তু বাগবাজারেও একদিন রাতে তাঁর মোবাইল বাজল, বাপি ফোন করেছে অন্য নম্বর থেকে, জেঠু আমি যাব তোমাকে দেখতে।
তিনি চুপ। বাপি মোলায়েম গলায় বলল, আমি তোমার মোবাইল ট্র্যাক করে নিয়েছি জেঠু, এখন কেউ লুকোতে পারে না, কত আসামী মোবাইল থেকেই ধরা পড়ে যাচ্ছে বলো, হ্যাঁ জেঠু, এই ফ্ল্যাটটা কি আরো বড় ?
বাপি জবাব না পেয়ে আরো মোলায়েম সুরে কিশোরকুমারের গলায় বলল, সিং নেই তবু...... ডিম নেই তবু অশ্ব ডিম্ব, কী দারুন গান বলো, শোনো জেঠু, মোবাইলে ম্যাপ লোকেশন সার্চ করে তোমাকে বের করে নেব আমি, তুমি আমাকে ঐ ভাবে ফেলে চলে গেলে, আমি চাকরিতে জয়েন করতে পারলাম না, আরো এক মাস ওয়েট করতে বলেছিল পার্টি, বিশ হাজার টাকা প্লাস উপরি ।
তিনি কল কেটে দিলেন। ফোন সুইচড অফ করেও বুঝি অপেক্ষা করতে লাগলেন আবার কখন বাপির ফোন বেজে ওঠে। কদিন ভয়ে ভয়ে থাকেন, বাপি কখন দরজায় এসে দাঁড়ায়। না পেরে কলকাতা থেকে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন বরেন। একেবারে সুভাষগ্রাম থেকে মাইল পাঁচ ভিতরে। গ্রাম শহর হয়ে উঠছে সেখানে। বহুতল উঠছে। চারপাশে অবারিত মাঠ, ফলের বাগান, চাষের জমি। কত নিঝুম সেই জায়গা। তবে নিঝুম থাকবে না। কতদূর চলে গেছে চাষ জমি। সব্জির ক্ষেত। তিনি তাঁর নতুন ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে......।
বরেন সান্যাল আর ফেরেননি। ক্রমে আরো গভীর নির্জনতার ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল। বাপি এসেছিল মোবাইল বাজিয়ে বাজিয়ে। লোকেশন খুঁজে খুঁজে। কিন্তু কাছে এসেও সে খুঁজে পাচ্ছিল না। আকাশের নিচে সেই প্রান্তরের কোনো দিক ছিল না। দিক বলতে নীরবতা।
বরেন সান্যাল আর ফেরেননি। ক্রমে আরো গভীর নির্জনতার ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল। বাপি এসেছিল মোবাইল বাজিয়ে বাজিয়ে। লোকেশন খুঁজে খুঁজে। কিন্তু কাছে এসেও সে খুঁজে পাচ্ছিল না। আকাশের নিচে সেই প্রান্তরের কোনো দিক ছিল না। দিক বলতে নীরবতা।
6 মন্তব্যসমূহ
অপূর্ব! শেয়ার করলাম।
উত্তরমুছুন👍👍👍👍👍
উত্তরমুছুন👍👍👍👍👍
উত্তরমুছুন👍 👍 Hey
উত্তরমুছুনঅসাধারণ !
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো ।
উত্তরমুছুন