স্বপ্নময় চক্রবর্তী'র গল্প : বিমলাসুন্দরীর উপাখ্যান



রেললাইনের ধার দিয়ে বিমলাসুন্দরী হাঁটে। কালো লোহার দু’ধারে কালো পাথর। কালো পাথরের ফাঁকে ফাঁকে অনামা জংলাফুল অনন্তকাল ফুটে আছে। বিমলা চোখকে বলে দ্যাখ, কানকে বলে শোন। লাইনের লোহার পাশে পাশে ওর দৃষ্টি চামরের মতো নড়ে। চকচকে লোহার কোথাও কি লেগে আছে কোনো রক্ত দাগ? সেলুনওলা আদিনাথ বলেছিল দু-নম্বর সিগনালের কাছে ডেডবডি আছে ও নিজে দেখেছে। বিমলা শেষ সিগনালের লাল রং ছাড়িয়ে যায়। কোনো কিছুই চোখে পড়ে না। ছেঁড়া কোনো বস্তার টুকরো-টাকরাও না। সেলুনওলা আদিনাথ বলেছিল তোমার সাবিত্রীকে বস্তাবন্দি করে মহিম ঘোষের মেজ ছেলে ওইদিকে নিয়ে গিয়ে ওইখানে, লাইনের ওপারে ফেলে রেখে গেছে। ও নিজে দেখেছে। একটু পরেই চলে গেছে রাত দশটা ছাপ্পান্নর ট্রেন বিমলাসুন্দরী দুই রেললাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ে সাবি…সাবি…সাবিততিরে…।


অফিসের বাবুরা সব রেকসিনের ব্যাগ হাতে আটটা ছত্রিশ ধরবে বলে পাথরের ওপর দিয়ে ছুটছে। লাইনের ধারে ধারে ঝুপড়িতে থাকা ঠিকে ঝিরা বাসনমাজা সারা করে ঘরে ফিরবে বলে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটছে। পাথরের ধারে ধারে অজানা অনামা সব ফুল অনন্তকাল ধরে ফুটে আছে।

লাইন বরাবর একটা রাস্তা। রাস্তার ওপর মা মনসা মিষ্টান্ন ভান্ডার। মহিম ঘোষের দোকান। সাবিত্রী ওখানে ঢুকেছিল। সেলুনওলা আদিনাথ বলেছে মহিম ঘোষের মেজছেলে বস্তায় ভরে…

অফিসমুখো এক বাবু খবর কাগজের ঝাপোট মেরে বলল ও মাসী, মরবে নাকি। ট্রেন আসছে যে। বিমলা তখন ঝমরঝম ঝমরঝম শব্দ শোনে। লাইনের পাশে সরে যায়। তীব্র কঠিন ঝমরঝমকে বলে আমার সাবিত্তিরকে দেকিচিস ভাই, দেকিচিস? ট্রেনের রং দু-ধারে ঝুপড়ির ধূসরে আর আগাছার সবুজে মিশে গেলে বিমলা দূরে দেখে পাখি। বড় ডানার পাখি কিছু উড়াল দিয়ে বসল ফের লাইনের পাশে পাশে, দূরে। মা মনসা মেঠাই দোকানের মা মরা বয় আকাশে তাকিয়ে দেখছে একটা লাল ঘুড়ি। বিমলা শুধোল, হ্যারে আমার সাবিত্তিরি…। হাতের চেটোয় নাক মুছে ছেলেটা বলল, ওই কালো বেড়ালটা খুড়ি? ওটা কিন্তু হেববি খচ্চর। রোজদিন ছ্যানা খেতে দোকানে আসে। কাল রাতে মেজদা ওটাকে কায়দা করে বস্তায় পুরে…।

--কই কোথায়?

--হুই যি। ছেলেটা দূর দেখায়। বিমলা দেখে পাখি। বোঝে, শকুন।

বিমলার এবার সামনে যেতে হবে। পা এগেোয় না। জল এগোয় না, তৃষ্ণা এগোয়। দুটি টান টান লোহার মাঝখান দিয়ে বিমলা এগোয়। ক্রমশ মেল ট্রেন হয়ে যায় বিমলাসুন্দরী। ক-টা শকুন উড়ে যায়। ক-টা শকুন ডেকে ওঠে। লাইনের ধারে ছেঁড়া বস্তায় রক্তদাগ। আলতা দাগ। ওই তো সাবিত্তিরি। সাবিত্রী মা আমার। কালো শরীরটা খুবলে খুবলে খাওয়া। লেজের কাছে সাদা দাগ। এ রূপ আর দেখব না।

মাথা নিচু করে ফিরে আসে বিমলা। পায়ের তলায় কালো রঙের পাথর। গর্তে কালো রঙের জল। আর হেরিব না কালো রূপ।

মহিম ঘোষ যেন ওলাওঠায় মরে। আজই মরে, এক্ষুণি মরে। আস্তে আস্তে পায়ে পায়ে স্টেশনে আসে বিমলা। স্টেশনের সিমেন্টে বাঁধানো লাল বেঞ্চিতে এসে বসে। একটা আপের ট্রেন দু-নম্বরে দাঁড়িয়ে আছে, লাইন কিলিয়ার নেই বোধ হয়। সমস্ত ট্রেন বন্ধ হয়ে যাক। সমস্ত দোকানের ঝাঁপ নেমে যাক। হরতাল হয়ে যাক। বট-অশত্থের ছায়া হয়ে যাক বাজার রাস্তা রেল ইস্টিশন।

তবু কোলাহল থাকে। মুসাম্বিলেবু সল্টেড-বাদামের হাঁক থাকে। তাজা খবর…মন্ত্রীসভার পরিবর্তন থাকে। পৃথিবীর কলশব্দ ঠিকই থাকে, এবং থাকে রেলগাড়িটার একটানা হিসহিস। সেই শব্দ ভিড়ের মধ্যে বিমলা শোনে। কি গো, চিনতে পারছ? বিমলা দেখে সিমেন্টের কালো বেঞ্চিটার গায়ে এইমাত্র একটা আঙুল চুন মুছল। হাতে পানের বোঁটা, ঠোঁট লাল। লাল ঠোঁটে থেমে থাকা হাসি। অ্যাসবেস্টাস শিট ভেদ করে আসা রোদ্দুরের ফালিটাও এখানে থেমেছে, ওই মুখে।

--হ্যাঁ গো, কেমন আছ গো!

বিমলা কথা বলল না।

--কোথায় থাকো? থাকা হয়।…

--এখানে।

--এখানে কোথায়?

--আচার কারখানার রাস্তায়। ভুবন রায়ের বাড়ি।

ট্রেন ভোঁ দিল। তুমুল। পলিথিনের পাম্পশু চঞ্চল হয়, ট্রেনের কামরাটার কাছে ধেয়ে গেল। ‘মেয়েকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি শ্বশুরঘর।’ হাতটা চেপে ধরল ট্রেনের হ্যান্ডেল। ‘আমি পরে দেখা করব বিমলা…।’ ট্রেন ছেড়ে দিল। ‘কেমন আছো বললে না…’। তুমুল শব্দের মধ্যে বিমলা চিৎকার করে বলল, ভালো আছি, খুব ভালো আছি। তারপর ঝপ করে জলটা মুছে নিল চোখ থেকে।

চোখের জলে সব দুঃখ ধুয়ে যায়। কিন্তু লাউশাকের বালি আর অন্তরের কালি শত ‍ধুলেও কি যায়? মনটা তো পুড়ে পুড়তে ছাই হয়েই গিয়েছিল। আবার কেন দেখা হল আজ? খুব জোরে নিশ্বাস ছাড়ে বিমলা। ওর দুঃখ মিশিয়ে দেয় চা-লিকারের ধোঁয়ার মধ্যে, হকারের শব্দে, স্টেশনের হাওয়ার হাহাকারে।

তবু ফিরে ফিরে আসে ওই মুখ। খুলিলে মনের দ্বার লাগে না কপাট।

কত বছর পর দেখল ওই মুখ? এর আগেও মাঝে মাঝে ওই মুখ দেখেছে বিমলা চিমনির ধোঁয়ায়, মেঘের কুণ্ডলীতে। বিছানায় মিথ্যা স্বপ্নে দেখেছে সে মুখ।

সেই মুখ বলেছিল বাঁজা মাগী।

খড় পচে, খড়কে পচে, কথা পচে না।

বিমলা তো বাঁজাই। বিয়ের পর ছ-বছরেও হল না কিছু। তাবিজ-মাদুলি, পীরের দরগায় ঢিল, বাবা তারকানাথ, জলপড়া, হাসপাতালের ডাক্তার। সেই মুখ বলেছিল তোমার নাড়িতে গেঁড়ো আছে, ডাক্তার বলেছে। বলেছিল ‘আবার বিবাহ হব।’ হয়েছিল। কত বছর হবে? তখন ইস্টিশনের ওই বিরাট বকুল গাছটা ছিল ছোট্ট দু-হাত। ডবল লাইন হয় নি। সিনেমা হলটার জায়গায় ছিল বাঁশঝাড়। কালীবাড়ির রাস্তাটা ছিল মোরামের। কালীবাড়ির পিছনে এখন যেখানে বসন্তবিহার নামে তিনতলা বাড়ি, ওখানে ছিল একটা ডোবা। ডোবার ধারে দোচালা ঘর। ওখানে থাকত বিমলার দিদি কমলাসুন্দরী। পতিঘর ছেড়ে দিদির কাছে উঠেছিল বিমলা। দিদির মুদি দোকান। পিছনের ডোবায় হাঁস চরত। আয় আয় আয় চৈ-চৈ। কত সময় বহে গেল। কত কথা বহে গেল। কত স্মৃতি। আয় আয় চৈ-চৈ। তোমার অম্বলের বেদনাটা আর আছে গো? তোমার পিঠের দাগটা আর বড় হয় নি তো? জর্দাটা বড্ড খাও। দাঁতগুলো আরো কালো হয়ে গেছে কিনা ভালো করে দেখাই হয় নি। পুরোনো ভালোবাসা টুপটাপ বৃষ্টি হয়ে নামে।

সেই বিয়েতেও ছিল বিমলা। উলু দিয়েছিল, কুলোয় প্রদীপ ধরেছিল। ফুলশয্যার রাতের দোর বন্ধ হবার শব্দ পর্যন্ত দাঁত চেপে ছিল বিমলা। তারপর দরজায় ছিটকিনির আওয়াজের গোঙানি বিমলার বুকের মধ্যে। পালিয়ে এসেছিল বিমলা, এক কাপড়ে লাস্ট ট্রেন ধরে। পশ্চাশ কিলোমিটার দূরে ওর দিদির বাড়ি।

দিদি বলেছির, সতীনের পুত হোক, পড়শির ভাত হোক। কিন্তু সতীন কাঁটা কঠিন কাঁটারে বুন। এসেচিস ভালোই করেচিস। দুখের ভাত সুখ করে খাব।

দিদি তখন তিন বছরের বেধবা। জামাইবাবুর মুদি দোকান দিদি চালায়। ছেলে মিলিটারি।

আর তো কেউ ছিল না বিমলার। বিমলার মা মরেছিল ছোটবেলায়, বিয়ে হবার দু-বছরের মধ্যে বাপ। দিদির দোচালাই বিমলার নতুন ঘর। পিছনে ডোবা। শুষনী-কলমী ল-ল করে। হাঁস চরে। আয় আয় আয় চৈ-চৈ।

মানুষটা খোঁজখবর করেছিল। সন্ধান করেছিল। একদিন খুঁজে খুঁজে এসেছিল দুপুরবেলা। দোকান ঘরের সামনে কমলা দিদিকে শুধিয়েছিল ও এখেনে এয়েচে কি?

বিমলার শরীরে গুঁড়ি গুঁড়ি ঘামবিন্দু। ঘামবিন্দু অভিমান হয়ে ঝরে পড়ছে।

এয়েচে।

ঝাক। নিশ্চিন্তি হলাম। কোথায় আছে, একবার দেখতুম। বিমলার পায়ের গোড়ালিতে অদৃশ্য ঘুঙুরের অভিমান নিঃশব্দে বেজে ওঠে। ঝামর ঝামর পায়ে দ্রুত বের হয় ঘর থেকে। কালীমন্দিরের অন্ধকারে যায়। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে একটা নারীজন্ম। লাল সিঁড়িতে ঘুঘু ডাকে একা।

একটু পরেই রোদ্দুরে পিঠে নিয়ে মানুষটাকে চলে যেতে দেখে। ঘাড়টা একটু নিচু। চলে যায়। নরম মাটিতে হাওয়াই চটির দুখী আল্পনা রেখে যায়।

কতকাল হবে? তখন স্টেশনের বকুল গাছহটা মাত্র দু-হাত। আয় আয় আয় চৈ-চৈ…।

এরপর কত রাত ফরসা হল। কত আশ্বিন-কার্তিকে ধানেরা গর্ভ পেল। কতবার বকুল ঝরল প্লাটফর্মের সানে। কত টিভি সিরিয়াল শেষ হয়ে গেল। বিমলার বয়স বাড়তে লাগল।

বিমলার দিদি মরল। মিলিটারি ছেলে পশ্চিম থেকে এল। বিমলা ভেবেছিল ওর বোনপো ওকে ওর কাছে নিয়ে যাবে। ওর বউয়ের হাতের পানসাজা খাবে। ওর ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াবে। যার যেমন কামনা, তেমনি ঢাকী বাজায় না। বোনপো বলল, এবার মাসী অন্য ব্যবস্থা দেখ। জমিটা বেচব। দেরাদুনে সেটল করব ভাবছি। বরং তোমায় মাসে কিছু পাঠাবখন।

তারপর কতবার বাড়ি বদলেছে বিমলা। গরুহাটার রসময় হালদারের বাড়িতে রাঁদুনি হয়ে থেকেছে। বিপিন চক্কোত্তির বাড়িতে থেকেছে ওর বুড়ো বাবার সেবা করার জন্য। রেশন দোকানের পিছনে খুপরি ঘরটায় থেকেছে ক-দিন…এখনও আচার কারখানার পিছনে। বাড়িওলা ভুপেন রায়।

দু-টো ক্রিম বিস্কুট কিনল বিমলা। কাগজে জাড়িয়ে নিল। বাবলু খাবে। কুকুরটা। বড় সরাটা ভেঙে গেছে, ছোট সরাটা আছে। সাবিত্রী নেই, বাবলু রইল। ও পথ চেয়ে আছে। বিমলা ওর কাছে যাবে। টিপির টিপির বৃষ্টি্ পড়ছে। মটরদানা কেনার ছিল। এখন থাক। আজ টিফিনবেলায় ইস্কুলে বসবে না বিমলা। মন ভালো নেই। নিতাই পাগলা এই পথ যদি না হয় থামিয়ে বলল, মাসী নমস্কার। হারু রিকশাওলা হাঁকল কী গো মাসী—তোমার ছেলেমেয়ে কেমন আছে? বিমলা কিছু বলল না। মন ভালো নেই। তোমার নাতি নাতনি? বিমলা আস্তে আস্তে হাঁটে।

এই হারুর রিকশা চেপে পুজোয় সময় একদিন বিমলা ঘুরেছিল এই মফস্বল। লাল সিটে বিমলার পাশে বসেছিল সাবিত্রী। বিমলার কোলে আঁটুল-বাঁটুল পায়ের কাছটাতে লাল জিভ নাড়ছিল বাবলু। বিমলা বলেছিল দ্যাক-দ্যাক নাগরদোলা। তোরা কুকুর বেড়াল না হয়ে যদি মানুষ হতিস, তোদের ওরা চড়তে দিত। তোদের আইসকিরিম খাওয়াতাম।

ঘরে ফিরল বিমলা। ঘরের সামনেটাতে জল জমেছে একটু। এই জলে সামনের বাড়ির বাগানের কলাবতী ফুলের হলুদ ছায়া। ওই ছায়ার মধ্যে ছোট্ট একটা ব্যাঙ লাফাচ্ছে একা একা। বাবলু বাঁধা আছে পাটের দড়িতে। ঘেউ করল। মানে এতক্ষণ? এবার অন্যরকমের আওয়াজ। গন্ধ পেয়ে গেছি মা গো। শিরগির দাও। ল্যাজ নাড়তে লাগল। আঁটুল-বাঁটুলরাও বিমলার পায়ের কাছে ঘুরঘুর। এবং মিউমিউ। আমাদের জন্য কি এনেছো। বিমলা বলল, থাম মুখপোড়ারা। মা খাগী। বাবলুর সামনে বিস্কুট দিল ভেঙে।

পাশের বাড়িতে বি.এ পাশ বউ কলাবতী ফুলের আড়াল থেকে দেখল আড়চোখে। আমার পয়সার আমি খাওয়াচ্ছি—তোর কী লো? বিমলা বিড়বিড় করে বলে।

অন্য কোনোদিন হলে এতক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ত বিমলা। হামানদিস্তার ঢক ঢক আওয়াজ হতো। ধনেভাজা জিরেভাজার গন্ধ ছড়াত। উনুনে ফুটত মটরদানা। ভগবতী বালিকা বিদ্যালয়ে টিফিন বেলায় বসে সে। ঘুগনি বেচে, আলুকাবলি বেচে। আচার কারখানায় কাজ পেতে পারতো বিমলা। সকাল আটটা থেকে সন্ধে ছ-টা ডিউটি দিতে হতো। এত সময় কি ওর আছে? সংসার কে সামলাবে। আজ শুয়ে রইল। একটু পরে দুটো ফুটিয়ে নেবেখনে। ভগবানের জীবগুলোনের মুখে তো কিচু দিতে হবে। টিনের চালায় টিপির টিপির মন খারাপের বাজনা।

বিমলা-বিমলা করে কে হাঁকে?

বাবলু চেঁচায় ঘেউ-ঘেউ। ও বাবলু চেঁচাস নি বাবুরে, চেঁচাস নি সোনামানিক আমার। বাড়িওলার ছোটছেলে ডাকছে। তুই ঘেউ করলে ওদের অপমান হবে নে? বিমলা হুড়মুড়িয়ে ওঠে। কি হল বাপধন?

বাবা ডাকছে। এক্ষুনি এস।

যাই। এক্ষুনি যাই।

বিমলা কথা কইবার আগেই ছেলেটা পিছু ঘুরেছে। বাড়িওলা ডাকছে কেন? বাড়িভাড়া বাকি ছিল। পরশু দিনই তো কিলিয়ার করে দিয়েছে। কুকুরটাকেও তা বেঁধে রেখেছে ক-দিন ধরে। সাবিও মরেছে। তবে! কাপড় ঠিক ঠাক করে বিমলা।

বাংলাদেশ থেকে এসে ভুবনবাবুরা এখানেই ছিল। এই দোচালা ঘরে । তারপর ভুবনবাবু বাজারে গমকমল দিল। পাশের জমিটা কিনল। মনিহারি দোকান ছিল, কোঠাবাড়ি হল। বাড়ি দোতলা হল। কাচের জানালা হল, জানালায় পর্দা ঝুলল। ওবাড়ি থেকে ঘিরে গন্ধ আসে, গানের শব্দে ভাসে। বিমলা এখন ওদের ফেলে আাস দোচালায় থাকে। তিনটে ঘর। একটায় বিমলা, অন্য দুই ঘরে বাবুদের বাতিল চেয়ার, বাতিল টেবিল, বাতিল আলমারী…। ভুবনবাবুর ছেলেরা আগে মাসী বলত। বিমলা মাসী। আজ ছোট ছেলেটাও নাম ধরে হেঁকে গেল। এখন ওদের কাছে যেতে হবে তাকে। ঘর ছাড়ার জন্য বলবে আবার? ক্ষমা তো চেয়েই নিয়েছে ও। তিনমাস সময়ও চেয়েছে। ভুবনবাবু বলেছিল: হ। ঠিক আছে। তিন মাস, চাইর মাস কইরো না কিন্তু।

ভুবনবাবুর ছোট ছেলেটাকে হারামজাদা গাল দিয়েছিল বিমলা। রাগ হলে কি মাথা ঠিক থাকে? রাগ হল নেকড়ার আগুন। নেভানো কষ্ট। ওই ছেলেটা যে এত খচ্চর, বাবলুর ওখানে নুন ছিটিয়ে দিলে। চিৎকার শুনে বিমলা ছুটে গেল। দেখল ওই ছেলেটা আর আরো দু-জন দাঁত কেলিয়ে হাসছে আর বেচারা জীব দটো চিৎকার করছে। বিমলা বলেছিল অসভ্য ইতর হারামজাদা।

তারপর তো হুলস্থুল মহাভারত। ছেলেটা কোঁত পেড়ে চিল্লাল, মা শুনে যাও, আমাকে কী যা তা খিস্তি দিল। আমাকে হারামজাদা বলল। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে লোহার গেট খুলে বেরিয়ে এল সব। বিমলা বলেছিল ভগবানের জীব দুটো চিৎকার করছে। বিমলা বলেছিল অসভ্য ইতর হারামজাদা।

তারপর তো হুলস্থুল মহাভারত। ছেলেটা কোঁত পেড়ে চিল্লাল, মা শুনে যাও, আমাকে কী যা তা খিস্তি দিল, কী যা তা দিস্তি দিল। আমাকে হারামজাদা বলল। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে লোহার গেট খুলে বেরিয়ে এল সব। বিমলা বলেছিল ভগবানের জীব দুটো একটু লীলা করছিল তখন এ নুন দিয়েছে।

হারামজাদা বলেছ কিনা বল। এত বড় আস্পর্ধা। কালই ছেড়ে দাও ঘর। মাথা নিচু করে ঘরে ফিরছিল বিমলা। পিছন থেকে বেবুশ্যা-টেবুশ্যে অনেক কিছুই শুনল সে। সামনের বাড়ির বি.এ পাশ বউ ম্যাক্সি পরে রগড় দেখতে এল। বিমলার মাথা নিচু। ঘরে ঢুকে যায়। একটু পরেই কুকুরটা হাঁপাতে হাঁপাতে এসেছিল বিমলার কাছে। বিমলা ওর গায়ে হাত বুলিয়েছিল। জল দিয়ে নুনলাগা জায়গাটা ধুয়ে দিয়েছিল। তারপর একটু দুধের সর লাগিয়ে দিচ্ছিল ওখানে। সরে ঠাণ্ডা করে। তক্ষুনি হাসি শুনেছিল বিমলা। বি.এ পাশ বউ দেখছে। পাশে ওর বর। আপিস যায় নি বুঝি। বউ কনুয়ের গুঁতো মারল বরকে। ভাতার সোহাগী। বর কি একটা ইংরেজি কথা বলল, বউকে।

সেইদিনই সন্ধেবেলা ভূবনবাবু ডেকে পাঠালেন বিমলাকে।

--কী সব শুনতাছি, অ্যাঁ?

বিমলার মুখ নিচু।

--ভগবানের জীব।

--ভগবানের জীব দেখাও। খাও ভাত, উগরাও নাটমন্দির? ঘরের সামনে এইসব করবে? আমার মেয়ে বড় হচ্ছে।

--ভাদ্দর মাস।

--ভাদ্দর মাস তো বাইন্ধ্যা রাখতে পার না?

--এবার থেকে বেঁধেই রাখব।

--আরও কি সব শুনতাছি?

বিমলার মুখে কথা নেই। চোখে জিজ্ঞাসা।

--তুমি নাকি তোমার কুকুরের সঙ্গে নষ্ট? রিপোর্ট আছে।

বিমলা কিছুই বুঝতে পারে না।

--তিনদিনের মধ্যে ঘর ছাড়বা তুমি। কী আরম্ভ করছ কি, অ্যাঁ? বিড়াল কুকুর নিয়ে অত্যাচার। তোমার বিলাই দুধ চুরি কইরা খায়, আমার মাছ খাইয়া পালায়। ঘরে হাগে। শেষকালে এইসব কদাচার। এই ভদ্রপাড়া। তার ওপর এতবড় দুঃসাহস। আমার ছেলেকে বলো হারামজাদা? পোঙায় এত রস? কবে ঘর ছাড়বা?

ক্ষমা চেয়েছিল বিমলা। তিনমাস টাইম চেয়েছিল সেদিন, এক মাসও তো হয়নি এখনো।

বিমলা ঘর খুঁজছে। নতুন নতুন কত ঘরবাড়ি উঠছে, দোচালা, চারচালা ভেঙে তিনতলা-চারতলা উঠছে। ওসব তো বিমলাদের জন্য নয়। টিনের ঘর, টালির ঘর কমে আসছে ক্রমশ। একদিন গোরুহাটা গিয়েছিল। রসময় হালদার এখন বুড়ো হয়ে গেছে। দেখেই চিনতে পেরেছিল। বলেছিল, কী গো কেমন আছ? ও বাড়িতে তিন বছর রাঁধুনি ছিল বিমলা। রসময় তখন রসে জড়িয়েছিল। বলেছিল, তোমায় যদি ইয়ে করি, থাকবা? অন্য বাসা ঠিক করে দেব। বিমলা বলেছিল আমি যে বাঁজা। রসময় বলেছিল সেই জন্যই তো আছি। রিকস্ নেই। বিমলার কপাল কুঁচকে উঠেছিল। রসময়ের চিটে চোখ তখন বিমলার ভ্রু-কুঞ্চনের দিকে ছিল না। রসময় বলেছিল, বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি বলেই তো জায়গার জিনিসপত্র জায়গা মতন আছে। হে-হে-হে। বাসনপত্র ভালো থাকলে ভোজনে যায়। হে-হে-হে। বিমলা সেইদিনই ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছিল। পিছন থেকে বিমলা শুনতে পেয়েছিল যদি কখনো দরকার পড়ে, এসো…



বিমলা এখন বাবুবাড়ি যাবে। কেন ডাকছে ভূপতি রায়। মাধবীলতার সামনে রাখা নিচু করে লোহার দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজা খোলার ক্যাঁচোর শব্দ বিমলার বুকের মধ্যেই ছিল। ফুল-নক্সাকাটা বারান্দায় পা দিতেই প্রেসারকুকার ফস্ করল। চেয়ারে বসে আছে ভূপতি রায়। বিমলকে দেখেই বলে উঠল, ঘর ছাড়ার কি করলা?

--তিন মাস টাইম…

--ওসব জানি না। সাতদিনের মধ্যে ছাড়বা। তোমার কালো বিড়ালটা আবার দুধ খেয়ে গেছে।

--আমার বিড়াল তো কাল রাত্রেই…।

--কী করছে রাত্রে?

--মরে গেছে।

--গুল মারবা না। সব্বাই দেখছে, ওই বিড়ালটারে। সব্বাই চিনে। যাও অখন।

বিমলা আঙুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে ফিরে আসে। ঘরে ঢুকেই দেখে, একি, সাবিত্রী, গর্ভিণী বিড়ালটা ল্যাজ উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিমলাকে দেখে মৃদুস্বরে বলে, মিউ।

হেলে দুলে কাছে আসে। বিমলা কোলে তুলে নেয় তাড়াতাড়ি। ওর গরম বিমলার বুকে লাগে। বিমলা স্টোভ ধরায়।

বিমলা হাঁটছে। রাইকিশোরীর মতো এগুচ্ছে। লালপেড়ে শাড়ি, কপালে সিঁদুর। আজ আলতাও পরেছে। বিমলার লালপাড় পা এগুচ্ছে। পিছনে পায়ে পায়ে তিনটে বেড়াল একটা কুকুর। সাবিত্রী বেড়াল সবার পিছনে। গর্ভভার। হেলে-দুলে হাঁটছে। আঁটুল-বাঁটুল হল সাবিত্রীর আগের গর্ভের। সাঁটুলও ছিল। ওটাকে হুলোয় মেরেছে। এখন শেষ বিকেলের রোদের হলুদ ওদের গায়ে। স্টেশনে এসেছে বিমলা ও তার সংসার। সাবিত্রীর আবার চায়ের নেশা আছে। ভাঁড়ে চা নিয়ে টুকরো পাঁউরুটি তাতে ডুবিয়ে সাবিত্রীকে দিচ্ছে বিমলা। শাদা টুকরোগুলি ছুঁড়ছে আঁটুল-বাঁটুলের দিকে। পাঁউরুটিটার মাথার পোড়া দিকটা বাবলুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বিমলা বলল, নে কেক খা। কুকুরটা একটু শু’কে বিমলার দিকে তাকাল—ইয়ারকি মেরো না বলছি। বিমলা তখন একটা সত্যিকারের কেক নিল। কিশমিশটা খুঁটে সাবিত্রীকে দিল। পোয়াতী মেয়ে। কেকটা বাবলুকে দিল বিমলা।

একটা আপ ট্রেন থেমেছে। মানুষটা যদি আসে, এখানে দাঁড়ায়, বিমলা কথা কইবে না। কথা পাথর হয়েই থাকবে। লোকটা যদি হাসে, জলের মতোই হাসে, কথা তবু পাথর হয়েই থাকবে। জলে পাথর নরম হয় না। পাথর নড়ে। আপ ট্রেন চলে যায়। আসবে লোকটা ঠিকই একদিন। আসবে এ রকম একটা ট্রেন। বিমলা এগোয়। একটা বাচ্চা মেয়ে বিমলাকে বলে মাসী, ও বেড়াল মাসী, কাল একটু বেশি ঝালনুন এনো তো, ফাউ দিও। বিমলা মৃদু হাসে। ওর আলতা-পাড় পা এগোয়। আর পায়ে পায়ে এগোয় তিনটে বেড়াল, একটা ‍কুকুর। পায়ে পায়ে এগোয় বিমলার দিন।

সক্কালবেলা। কাক ডাকছে। বুঁচির মা পাঁচির মা-রা সুখের কথা বলাবলি করতে করতে কাজে যাচ্ছে। বিমলা পাশ হাতড়ে টের পায় সাবিত্রী নেই। বিমলা না উঠলে সাবিত্রী ওঠে না। ও বড় সোহাগী মেয়ে। গা লেপটে শুয়ে থাকে। বিমলা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে যায়। দরজা বন্ধ জানলা খোলা। এদিক ওদিক বাইরে চায়। করবী ফুটছে। শিউলি ঝরছে। ইলেকট্রিকের তারের গায়ে একসারি জলের ফোঁটা। সামনের বাড়ির বি.এ পাশ বউ হেলেদুলে বাথরুম যাচ্ছে। মুখে টুথপেস্টের ফেনা। সাবিত্রী আছে কোথাও। কাছে-পিঠেই আছে। বিমলা এদিক চায়, ওদিক চায়। মাদার ডেয়ারির লাইন দিতে যাচ্ছে ও বাড়ির বুড়ো কর্তা। পাগলা নিতাই বেরিয়ে পড়েছে। তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর, হাসি আর গানে ভরে তুলব। পরনে হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি। সারাদিন গান গাইবে। ও বাড়ির বি.এ পাশ বউ বাথরুম থেকে এল। সামনের বারান্দায় বেতের চেয়ার। ওখানে বসবে। বসতে গিয়েই কেমন চিৎকার করে উঠল। চিৎকার শুনে পাজামার দড়ি বাঁধতে বাঁধতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল ওর স্বামী। চেয়ারের দিকে তাকাল। বউটা চিৎকার করল বিমলা, বিমলা, দেখে যাও, তোমার বেড়াল আমাদের চেয়ারের কুশনে হেগে গেছে।

বিমলা আস্তে আস্তে ও বাড়ির দিকে যায়। যেতেই হয়। বারান্দায় ওঠে। বউটা আর ওর স্বামী বলেই চলেছে, বলেই চলেছে। একদিন পিটিয়ে মারবে বলছে। আক্কেল নেই বলছে। বিমলা কলাবতী গাছেদের পাশ দিয়ে বারান্দায়। লাল কুশনে চুপচাপ শুয়ে আছে ছোট একটু গু। যেন কিচ্ছু জানে না। চেনা রং। চেনা গন্ধ। ও তবে আছে কোথাও। বিমলা তবু বলে, এটা যে আমার বেড়ালের বুঝলে কি করে? কি পোমান? পিরথিবীতে আর বেড়াল নেই?

একদম দেব ইয়ে করে।–বউটার স্বামী বলে। আর কোনো বেড়াল আসে না এখানে।–বউটা বলে। যাএ এক্ষুনি ওটা পরিষ্কার করো।–স্বামী বলে। কুশনসুদ্ধু নিয়ে যাও। বউটা বলে।

বিমলা নিয়ে গেল। কুশন সমেত। ওটা লাল কুশনে কেমন চুপচাপ শুয়ে আছে, যেন কিচ্ছু জানে না।

বউটা বলল শোনো, কুশনটা থাক। শুধু কভারটা খুলে নিয়ে যাও।

বিমলা তাই করল। বলল, সাবান-কাচা করে ধুয়ে পাঠিয়ে দেব। খুব যত্ন করে জড়িয়ে নিয়ে যায়। ও তাহলে আছে। কাছেই কোথাও আছে।

বুঁচির মা, পাঁচির মা-রা দুঃখের কথা বলাবলি করতে করতে ফিরে আসে। নিতাই পাগলা ‘যে দীপ জ্বালাতে নেহি পারো সমাধি পরে তা জ্বেলে দিও’ গাইতে গাইতে ফিরে আসে। সাবিত্রী ফেরে নি। ছায়ারা ছোট হয়ে এল। সাবিত্রী ফেরে নি। আজ কি একটা ছুটি। ইস্কুল বন্ধ। ইস্কুল বন্ধ থাকলে বিকেল বিকেল স্টেশনে বসে বিমলা, বিককির হয়ে যায়। সাবিত্রীকে কেউ মারল না তো। পোয়াতি মেয়েটা। কত মার খায় বেচারি। নাকে রক্ত মেখে, কানে রক্ত মেখে ফিরে এসেছিল একবার। কে জানে কোনো আঁটকুড়োর ব্যাটা কাটারির ঘা মেরেছিল।

বিকেলে ওর বাবলু কুকুরটাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিল বিমলা। আসলে খুঁজতে। পুকুরের পাশে একটা দোতলা বাড়ি আছে। ও বাড়ির একটা বড় লোমওয়ালা মাদি কুকুর বোধহয় বাবলুকে ভালোবাসে। লোমওয়ালাটা এখন বাগানে ঘুরছে। বাবলু থমকে দাঁড়াল। লোমওয়ালাটাও লোহার গ্রিল বেড়ার ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়াল। বাবলু ওর মুখে মুখ লাগাচ্ছে। লোমওয়ালাটা বিলিতি না? পিরিতির রাজ্যে জেতের বিচার নেই। চ বাবলু এখন চ। কে আবার দেখে ফেলবে। ওকে ছেড়ে দে। হবে নে। রুটি দেখিয়ে অন্য কাউকে নিয়ে আসবখন ঘরে। ঘর বন্ধ করে দেব। করিস।

কচুরিপানার নীল ফুল ছিঁড়ে কতকগুলি মেয়ে রান্নাবাটি খেলছে।

বিমলা শুধোল—হ্যাঁরে, আমার বেড়ালটাকে দেখেছিস তোরা কেউ?

একটি মেয়ে বলল, কালো বেড়ালটা তো, ল্যাজটায় সাদা।

--হ্যাঁ-হ্যাঁ, দেকিচিস?

মেয়েটি ঠোঁট উলটোল।

পরদিন নবনগরের দিকে গেল বিমলা। ওটা গয়লাপাড়া। ওদিকে যায় বিমলা। কোথাও কোনো কানাঘুসো শুনতে পায় না।

বাসার কাছেই ফিরেই দেখে একটু দূরে জটলা। নতুন দাড়ি রাখা ক্লাবের ছেলেটা তেড়ে এসে বলল, বল বুড়ি কবে তুমি পাড়া ছাড়বে। বাবলু হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। ছেলেটা বলে, মারব পেটে লাথি। বিমলা বলে, কি হয়েছে। ছেলেটা বলে, যাও, কাকলিদের বাড়ি গিয়ে দেখ তোমার বেড়াল কি করেছে।

বিমলার ঘর থেকে চারটে বাড়ি পরেই কাকলিদের বাড়ি। বামুনবাড়ি। নিত্যি পুজোর ঘন্টা ঘরে বসে শুনতে পায় বিমলা। হাত জোড় করে তখন। ওদের বাড়ির সামনেই লোকজন। সাবিত্রী তাহলে ওখানেই দুষ্টুমি করেছে। কি করতে পারে? পুজোর ভোগ খেয়েছে? নাকি বমি-টমি করল, নাকি ওদের ঠাকুরঘরেই বাচ্চা দিয়েছে। দুগগা-দুগগা।

বিমলাকে দেখেই কাকলির মা খিঁচিয়ে উঠল। তোমার বেড়াল আমাদের পাতকো নষ্ট করে দিল। বলো তার কী হবে। দেখগে পাতকোর জলে মরে ভেসে রয়েছে তোমার বিড়াল। বিমলার বুকে বাজ পড়ল। হাওয়ায় দু-হাত আঁচল লুটোচ্ছে। ছুটে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল কুয়ো পাড়ে। দেখল কালো জলে কালো শরীর। চোখ বোজে। ও রূপ আর হেরিব না। কুয়ো পাড়ে নিমগাছে কাকরা ডাকছে। বিমলা মাথা নিচু করে স্থির।

--কুয়োটা যে নষ্ট হল কে খেসারত দেবে?

বিমলার চোখের জল বসুমতীর গায়ে পড়ে।

--ক কেজি ব্লিচিং পাউডার ফেলে দিতে হবে।

--ব্লিচির পাউডার নয়, গ্যামাক্সিন।

--না-না, গ্যামাক্সিন পয়জন। ব্লিচিং।

আরে তার আগে তো ওটা ওঠাতে হবে, ট্রাই করছি তো, বালতিতে তো উঠছে না, ফস্কে যাচ্ছে। বালতি তোলার কাঁটা নেই? কুয়োর কাঁটা? কে একজন দড়ি জড়ানো কুয়োকাঁটা নিয়ে এল। ‘যদি তুলে দি, চা খাওয়াবেন বউদি।’ কাঁটা নেমে যায়। উঠছে উঠছে। মানুষের উল্লাস শব্দ। কাকের চিৎকার শব্দ। উৎসব। ছেলেটার হাতের পেশী ফুলে ফুলে উঠছে।

মাটিতে নামাল। ওর গা থেকে জল ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা। ওর সারা গা কাঁদছে। ওর গায়ের মধ্যে আটকে আছে কাঁটা। পেট ফুলে আছে। হায় রে গভ্য।

ও কেন ঝাঁপ দিতে যাবে কুয়োর জলে? ওর তো কোনো দুঃখ রাখেনি বিমলা? কেউ কি ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে ওকে?

--এবার এটা কি হবে, এটা?

--পুকুরপাড়ে ফেলে দে।

--তোর যেমন বুদ্ধি। পচে গন্ধ হবে না!

--তবে লাইনের ধারে।

সঙ্গে সঙ্গেই দড়ি জোগাড় হয়ে যায়। গলায় বাধা হয়ে যায়। টানতে টানতে নিয়ে চল। বলহরি হরিবোল। কাকেরাও চলল। রাস্তায় পড়ে রইল জলের দাগ। একটু পরেই শুকিয়ে যাবে।

বিমলা আঁচলে জড়িয়ে নিল সমস্ত কালো। ধীর পায়ে ঘরের শূন্যতার মধ্যে নিজেকে মেশাল। চারিপাশে সবকিছু ঠিকঠাক। চারিপাশে ‘আই অ্যাম এ কমপ্লান বয়।’ কাকেরা বাসায় ফিরছে।

লক্ষ্মীর শাঁখ। বামুনবাড়ির পুজোর ঘন্টাও বাজল। সাইকেলরিকশার হর্ন, ট্রেনের ভোঁ। নিতাই পাগলা গাইছে এক পলকে একটু দেখা আর একটু বেশি হলে ক্ষতি কি। চাঁদও উঠল ঠিকঠাক। সন্ধ্যামালতি ফুটল। দু-একটা জোনাকি উড়েতে থাকল এদিক ওদিক। পরটা ভাজার ডালডা ঘি-এর গন্ধ ভেসে এল কোনো বাড়ি থেকে। মাধবীলতার গন্ধ এল। দূরের রাস্তার আলো আর দূরের চাঁদ মিলেমিশে গাছটার ঝিরিঝিরি ছায়া ফেলেছে ঘরের সামনেটায়। সেই আলো-আঁধারির মধ্যে এসে দাঁড়াল কে?

--মিয়াও।

ল্যাজটা উঁচিয়ে আছে।

বিমলা তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নেয়। ওর গরম বিমলার বুকে লাগে। বিমলা স্টোভ ধরায়।



আমি এলাম।

মানুষটাকে দেখে অবাক হয়ে যায় বিমলা। করবী গাছের আলো-আঁধারির ছায়া-মায়া বিমলার মুখে খেলা করে।

--আসব বলেছিলাম না? এলাম।

--এসো।

--অনেক খুঁজেছি, বুঝলে, এক ঘন্টা খুঁজে তবে পেলাম।

--বোসো।

--ভুবন রায়ের নামটা মনে ছিল। একজন ভুবন রায় পাঠানপুরের দিকে থাকে ওদিকে দেখিয়ে দিয়েছিল। পরে আচার কারখানা মনে পড়ল। খুশি হও নি?

--খুব।

--এসব কী? এত কুকুর বেড়াল?

--আমার কামনা-বাসনা।

হারিকেনের আলোটা উশকে দিল বিমলা। বড় করে সিঁদুর টিপ পরল। মানুষটাকে প্রণাম করল।

--চা দেব?

--না। শুধু জল। আর শোনো, স্টেশনের সামনেটার দোকান থেকে রুটি মাংস এনিচি। ধরো।

বিমলা হ্যারিকেনের কোরোসিন শিখার দিকে চেয়ে বলল, রাখ। জল দিল। আঙুলে আঙুল লাগল। কতদিন কতকাল পরে। আঙুল মুঠো করে এনে সাবিত্রীবালা বেড়ালটার গায়ে বুলিয়ে দেয় বিমলা। আর তখন সাবিত্রীর গর্ভযন্ত্রণা শুরু হয়।

--বলো বিমলা, কেমন আছ?

--ভালো আছি। এখন সাবির প্রসব হবে।

--সাবি আবার কে?

বেড়ালটার গায়েই হাত রাখা ছিল বিমলার। লণ্ঠনটায় উশকে রাখাই ছিল। বিমলার চোখ এবং ভ্রু-যুগল তখন অদ্ভুত এক মায়া খেলা করে।

--ও বুঝিচি। তোমার কামনা-বাসনা। হে হে। বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়িতে অবশ্য জানে আজও মেয়ের বাড়িতেই আছি। তোমার এখানে চলে এলাম। হে হে।

হারিকেনের আলোটা একটু কমিয়ে দেয় বিমলা। জলের ঘটি সামনে রাখে। এক আঁচল জল নিয়ে হাত ধোয়। কোরোসিনের শিখার দিকে চেয়ে বিমলা মৃদুস্বরে বলল, প্রসব হচ্ছে প্রসব।

ছায়ারা কাঁপে।

একটা জোনাকী এল ঘরে। এক ঝলকা বাতাস এল। মাধবীগন্ধ এল।

--তোমায় নিয়ে যাব, বুঝলে, যদি অবশ্য তুমি রাজি থাক।ও, মানে, বলছিল যে…।

--এখন কোনো কথা কয়ো না। দোহাই। চুপ থাক। শুনছ না, টিভিরাও থেমে গেছে।

ও মেয়ে, মেয়ে আমার, কাঁদিস নারে। কাঁদিস না। এটা তোর নারীজন্ম। এটা কিচ্ছু কষ্ট না। আর একটু ধৈর্য ধর, ও মেয়ে, এটা তোর আনন্দ। এটা তোর নিতাই পাগল।

বিমলা বেড়ালটাকে কোলে তুলে নেয়। ওর গরম বিমলার বুকে লাগে। বিমলা স্টোভ ধরায়।


১৯৯২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ